micro-story-kholas

খোলস
মহুয়া ব্যানার্জী


প্রতিদিনের এই ঝঞ্ঝাট আর নেওয়া যায় না, বিরক্তি চাপতে গিয়ে সাতসকালেই মনামীর মসৃন কপালে ভাঁজ পড়ে। ওভেন থেকে চায়ের পাত্রটি নামানোর শব্দেই বোঝা যাচ্ছে হাওয়া গরম।

-দুটো রুগী পড়ে আছে দু ঘরে। তাদের দেখাশোনার জন্যই তো তোমাকে রাখা, সেটাও যদি আমায় দেখতে হয় তাহলে এই সংসারের কাজ আমি করব কিভাবে? তীব্র রাগ আছড়ে পড়ে সামনের হাসিমুখ মেয়েটির ওপর।

সাতাশ বসন্ত পার করা মেয়েটির মুখের হাসি তবু মোছে না। মনামির ছোঁড়া তীরগুলো ঝেড়ে ফেলে গুনগুন করতে করতে নিজের কাজে ডুবে যায় রেবা।

দেড়বছর ধরে সে মনামির শ্বশুর-শাশুড়ির আয়া। কিছু উপরি উপার্জনের জন্য মনামির হাতে হাতে টুকটাক কাজও করে। কাজে কোন ফাঁকি নেই। কেবল সময়জ্ঞানের অভাব। সেটাই মনামির বিরক্তির কারণ।

আরো একটা ব্যাপার আছে বৈকি। শত অভাবেও এত কাজের চাপেও রেবার মুখ থেকে কখনো হাসি মুছে যায়নি। একটা মানুষ সারাদিন এত পরিশ্রম করে, লোকের বাড়ির এতো মুখ ঝামটা খেয়েও কি করে এত আনন্দে থাকতে পারে?

মনামি কিছুতেই ভেবে কুল পায় না! কি সুন্দর সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে কাজে আসে। তাই প্রতিদিন রেবার প্রতি বিষাক্ত থেকে আরও বিষাক্ত হয় মনামী। অকারনেই!

কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভিডিও কল, ফিসফিস গল্প, আরক্ত মুখে সলজ্জ হাসি মনামির মাথায় আগুন ধরায়। সে তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচায়,

– এই তো বললি বরের সাথে ঝামেলা হয়েছে। তোর ঘাড়ে বসে বসে খায় জোয়ান পুরুষ। লজ্জা করে না। রোজ মারপিট, ঝগড়া আবার তার সাথেই ঢলাঢলি! ছিঃ।

– কাজ করে খাই দিদি, কাজে ফাঁকি দিলে যা খুশি বলো। কিন্তু আমার মরদের ব্যাপারে কিছু বোলো না। গরীব মানুষদের ভালোবাসার ধরন এমনটাই।

না পোষালে ছাড়িয়ে দাও। জেবন এই আছে, এই ফুস। গতর খাটাব, খাব, শখ আহ্লাদ করব। ব্যস।

আমার মরদ যখন কাজ পায়, করে। সে টাকায় আমায় সিনিমা দেখায়, ঝাল ঝাল মেটে চচ্চড়ি খাই দুজনে, আর রেতে হি হি হি…

হাসতে হাসতেই বলে, কামাইয়ের আবার মেয়ে মরদ কি গো? সংসারটা চললেই হল, যেই টাকা কামাই করুক না কেন। রেবার কথাগুলো মনামির শরীরের কোষে কোষে জ্বালা ধরায়। তবুও রেবাকে সে কিছুতেই ছাড়তে পারে না।

মনামি পঁচিশ বছর ধরে এই সংসারের প্রধান দুটি মানুষের হাতের পুতুল হয়ে নিজেকে নিংড়ে দিয়েছে। জীবনের মাঝপথে নিজের সেই কেরিয়ার থেকে শুরু করে সমস্ত ত্যাগগুলোর কথা ভেবে ভীষণ আফশোস হয়। সে বোকামির মাসুল দিয়েছে অনেক।

এখন আর পেরে ওঠে না। মন, শরীর সব বিদ্রোহ করে। যে মানুষটির মুখ চেয়ে কলের পুতুল সাজা সে কখন যে সরে গেছে পাশ থেকে টের পায়নি। শুধু টাকাপয়সা, গয়না দিয়ে তাকে ভরিয়ে দিলেই কি পাশে থাকা হয়!

-এত নির্বিকার কেন সুমন্ত? কেন আমার প্রতি এত উদাসীন? নিজের মনেই বিড়বিড় করে মনামি।

তুমি তো চেয়েছ। আত্মীয়বন্ধুদের সামনে সুখী গৃহকোণের বিজ্ঞাপণ হয়ে উঠতে চেয়েছ। জোর করে সংসারের জোয়াল টেনে মহান হতে চেয়েছ। ঘরের দায়িত্ব ভাগ করলে তোমার পারফেক্ট বৌমা হওয়া হবে না, তাই সুমন্তকে শুধু কাজের দিকে ঠেলে উপার্জনের মেশিন বানিয়েছ। শেষ কবে সুমন্তর জন্য তার মনামি হয়ে উঠেছিলে? কবে? মনামির অবচেতন থেকে কথাগুলো মাথায় ধাক্কা দেয়। রাতের সাথে মাইগ্ৰেনের যন্ত্রনাও বাড়তে থাকে।

বারান্দা থেকে ফিসফিস কথা আর হাসির শব্দ ভেসে আসে। দরজা অল্প ফাঁক করে মনামি নিঃশব্দে আড়ি পাতে রোজকার মত। রেবার মরদকে ভাবতে ভাবতেই মনামীর খোলস ছেড়ে রেবা হয়ে ওঠে সে। তপ্ত শরীর ঠাণ্ডা হলে সব ব্যথা সেরে যায়। ইদানিং মনামির ওষুধের প্রয়োজন হয় না।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “micro-story-kholas

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *