micro-story-binashak

বিনাশক
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি


ছোট পেনের মতো দেখতে একটা যন্ত্র। মেয়েদের হাতব্যাগেই ধরে যায়। আশেপাশে থাকা কোনও মানুষের মনে যদি কোনও নারীকে ধর্ষণ করার ইচ্ছে জেগে ওঠে, সঙ্গেসঙ্গে যন্ত্রটা প্রথমে গরম হবে, তারপর সেখান থেকে তীব্র একটা নীল আলো বেরিয়ে এসে সম্ভাব্য আততায়ীকে আঘাত করবে। সাময়িকভাবে অচেতন হয়ে যাবে কালপ্রিট। তখন তাকে আইনের হাতে তুলে দেওয়া যাবে সহজেই।

এই যন্ত্রটার পেটেন্ট নেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন বিজ্ঞানী রুদ্র গাঙ্গুলি। সেটা পেয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু সরকারি টালবাহানায় নিয়মের বেড়াজালে তার বাণিজ্যিকীকরণ আটকে আছে। কিছু ট্রায়ালের অনুমতি চেয়েছিলেন যন্ত্রটার, মেলেনি। অনেক চিঠিচাপাটি করেও কোনও সদুত্তর মিলছে না। এদিকে দিনে মোটামুটি একশ’টা করে ধর্ষণ এখন সরকারিভাবেই নথিভুক্ত হয় এদেশের পুলিশের খাতায়। আর কে না জানে, নথিভুক্ত না হওয়া সংখ্যাটা এর চেয়ে ঢের বেশি। যেমন কয়েক বছর আগের সেই দুটো রেপ কেস। ডঃ গাঙ্গুলির অস্থির লাগে।

তিনি বারবার ভুলে যেতে চান এগারো বছর আগের সেই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রাত। তিনি সেদিন একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে ভিনরাজ্যে গেছিলেন। গোলমালের খবর পেয়ে ফ্লাইট ধরে ঘরে ফিরে আসতে না আসতেই সব শেষ। চারদিকে যেন শ্মশানের স্তব্ধতা। পোড়া ইটকাঠের সঙ্গে মিশে গেছে মানুষের পোড়া চামড়ার গন্ধ। প্রশাসন ‘কড়া’ হাতে দাঙ্গা দমন করার আগেই সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছিল। আরও অনেকের সঙ্গে তাঁর হতভাগিনী স্ত্রী-কন্যাও সেই বিভীষিকাময় রাতে শেষ হয়ে গেছিলেন, তবে তার আগে দুষ্কৃতিরা তাঁদের দুজনকেই ধর্ষণ করতে ছাড়েনি। ওটা তাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে যে!

তিনি সেদিন থেকেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সারাজীবনের অধীত বিদ্যা আর অর্জিত জ্ঞানকে সম্বল করে নিজের সবকিছু ঢেলে দিয়েছিলেন এই যন্ত্র আবিষ্কারে। আজ সেটা যখন তৈরি হয়েছে, তখন আর কোনও এমন ঘৃণ্য অপরাধ যাতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাজারজাত না হলে এর কথা লোকে জানবে কী করে? আশ্চর্য লাগে তাঁর। যে সরকার মুখে বলে নারী নির্যাতন নির্মূল করার কথা, তারা কীভাবে এমন একটা কার্যকর যন্ত্রকে সহজলভ্য হতে দিচ্ছে না?

রুদ্র গাঙ্গুলির গবেষণাগারে কিছু কমবয়সি মেধাবী ছেলেমেয়ে কাজ করে, তাঁকে কাজে সাহায্য করার জন্য। তাদের স্টাইপেন্ডও দেন তিনি নিজের উদ্যোগেই। কাজ শেষে কয়েকজনকে সুপারিশ করেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গবেষণার কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য। এমনই একটি মেয়ে তৃণা। তৃণা সুন্দরী, বুদ্ধিদীপ্ত, সুস্বাস্থ্যের অধিকারিনী। ওকে দেখলেই ডঃ গাঙ্গুলির বারবার নিজের প্রয়াত হতভাগ্য কন্যা স্নেহার কথা মনে পড়ে।

তৃণাকে একদিন আলাদা করে ডেকে তিনি যন্ত্রটার একটা নমুনা তার হাতে তুলে দিলেন। ভাল করে তাকে বুঝিয়ে দিলেন এর প্রয়োগপদ্ধতি। তবে ওকে দেওয়ার আগে তিনি যন্ত্রের কাজে বা ক্ষমতায় কিছুটা রদবদল করে দিলেন। সেটা কিন্তু তৃণা বা আর কাউকেই বললেন না তিনি। নিজেও চাইলেন এর একটা বাস্তব পরীক্ষা হোক। সেটাই হবে সবচেয়ে বড় ট্রায়াল।

যন্ত্রের ক্ষমতা টের পাওয়া গেল অচিরেই। তৃণা ল্যাব থেকে বাড়ি ফিরছিল। একটু বেশি রাত হয়ে গেছিল। পাড়ার কাছেই একটা শুনশান গলিতে পিছনে পায়ের শব্দ শুনে চকিতে ঘুরে তাকিয়ে দেখল চারটে ছেলে। মুখগুলো চেনা। ভোটের সময় ওদের নাওয়া-খাওয়ার ঠিক থাকে না। এখন ওদের শরীর থেকে তীব্র দিশি মদের গন্ধ বেরচ্ছে। একজন বলল, “মামনি, এত রাতে কোত্থেকে ফিরছ?” আরেকজন বলল, “তাও আবার একা একা!” তৃতীয়জন বিশ্রী হেসে বলে, “আমরা কিন্তু একা নই! হি হি!” তৃণা টের পায়, ব্যাগের ভিতর যন্ত্রটা গরমে দপদপ করছে। চতুর্থজন আরেক পা এগিয়ে এসে তাকে আপাদমস্তক জরিপ করে প্রথমজনকে বলে, “কী ফিগার মাইরি, গুরু! আমার তো…” প্রথমজন তাকে একরকম ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলে। “চোপ সালা! তোরা কেউ আগে খাবি না ওকে। আগে আমি। ওয়েট কর।” তৃণা আর দেরি করে না। যন্ত্রটা বের করে বাগিয়ে ধরে তাদের দিকে। যথেষ্ট গরম হয়ে গেছে সেটা।

“ওটা আবার কী বে? খেলনা পিস্তল নাকি? খি-খি– আঁক!” কথা শেষ হল না প্রথম ছেলেটার। যন্ত্র থেকে বেরনো তীব্র নীল রশ্মির ঘায়ে সে ছিটকে পড়ল মাটিতে। তারপর আরেকজন, তারপর আরও একজন। শেষ ছেলেটাকে ইচ্ছে করেই পালাতে দিল তৃণা। যাক বেচারা। কাউকে খবর দিলে দিক। ভয়টা থাকুক ওদের মনে। রাস্তায় পড়ে থাকা নিথর দেহগুলোর দিকে তাকায় তৃণা। বুদ্ধিমতী মেয়ের বুঝতে অসুবিধা হয় না, ডঃ গাঙ্গুলির হাতে সামান্য পরিবর্তনের ফলে যন্ত্রটার মারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আর সম্ভাব্য ধর্ষককে নিজের হাতে মৃত্যুদণ্ড দিতে কারও বাধা থাকবে না। ডঃ রুদ্র গাঙ্গুলিকে মনে মনে প্রণাম জানায় তৃণা।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “micro-story-binashak

  1. খুব সুন্দর হয়েছে 👌
    বাস্তবেও যদি এমন যন্ত্র থাকতো তাহলে অনেক তিলোত্তমা হয়তো আজ বেঁচে থাকতো ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *