স্বপ্নময় চক্রবর্তী
আজ সেই দিন।
ধন ধান্য পুষ্প ভরা হচ্ছে, বঙ্গ আমার জননী আমার হচ্ছে, কৃষ্ণ করলে লীলা আমরা করলে বিলাও হচ্ছে। ক্লাবের সামনে ছেলেরা নাচছে, এই সকাল বেলাতেই শুরু হয়ে গেছে উৎসব। ক্লাবের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী।
আজ সেই দিন।
একটা মালা কিনতে বাজারে গেলেন কংসারি মিশ্র। বাড়িতে কয়েকটা ফুলের গাছ আছে। টগর, জবা, করবি। আর ক’টা দিন পর থেকেই গ্যাঁদাও হবে। গ্যাঁদা গাছগুলি আপন মনেই হয়। ক’দিন হল শেফালিও ফুটতে শুরু করেছে। শেফালি ফোটা মানেই ঝরা। সকালবেলায় গাছতলায় শেফালি ফুলগুলো উল্টে পড়ে থাকে। মরা। শেফালি ফুলগুলোকে মৃতদেহ মনে হয় কেন যে… যেন মুখে রক্ত।
বাড়িতে ফুল আছে, কিন্তু মালা গাঁথার লোক নেই। কে গাঁথবে? কংসারি মিশ্র এখন ষাট। চোখে ছানি। সূঁচে সুতো গাঁথতে খুব কষ্ট হয়। আর কংসারির স্ত্রী এই মালা গাঁথতে পারবে না। কেঁদে কেটে একসা করবে। আঙুলে সূঁচ ঢুকে যাবে। ফুলে রক্ত লাগবে।
বাজারে ফুলের দোকান বলতে একটাই। দোকানটা শুধু ফুলের নয়, সঙ্গে ফলও বিক্রি করে। এখানে ফুল কিনবে কে? সকলের বাড়িতেই তো ফুলের গাছ আছে। বাজারে যতগুলো দোকানঘর আছে, ওখানে ছবিতে মালা পড়ে, আর দু চারজন স্বর্গে যাওয়া বাপ মা কিংবা গুরুদেবের ছবির জন্য কেনে। কিছু রজনীগন্ধার ডাঁটিও রাখে ও। হালে কিছু লোকজন ঘরের ফুলদানিতে রজনীগন্ধা রাখতে শুরু করেছে।
কংসারি গিয়ে দেখল মালা নেই। রোগা রোগা কয়েকটা ছোট মালা পড়ে আছে, দোকানদার বলল, মালা সব বিক্রি হয়ে গেছে, অর্ডারিও ছিল, আজ কেলাবের ফাংসন কিনা…।
কংসারি বলল আমার যে খুব দরকার গো একটা মালার, কী করা যায় বলতো…।
দোকানের লোকটা বলে – কোন পুজো টুজো বুঝি? তা আপনার লাগবে যখন একটা বানিয়ে দিই? যে কটা আছে ওগুলোর সঙ্গে কুচো ফুল জুড়ে দিই?
তাই দাও।
আজ সেই দিন – এই ছেলেটাও ভুলে গেছে। দু বছরেই?
গত বছরেও ইস্কুলের দিদিমণিরা এসেছিল। মালা দিয়েছিল সুমির ছবিতে। বলেছিল আমরা ছাড়ব না। আমরা এম এল এ-কে চিঠি লিখেছি, এস পি-র কাছে যাব। ওদের শাস্তি হবেই।
“আরে না…
পারি না…
তোরে দেখলেই দিন আমার কেমন কেমন করে
আর না থাকিতে পারি ঘরে…।”
গান হচ্ছে। মাইকে। দেশপ্রেমের গানও হবে। পরে।
বাড়ি এসে স্নান করে মেয়ের ছবিতে মালাটা পরিয়ে দিলেন কংসারি মিশ্র। শঙ্খধ্বনি নয়, ক্রন্দন বেজে উঠল।
অন্নপূর্ণা কাঁদছেন।
আজ সেই দিন।
আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছিল আলোকমঞ্জির। সুমি স্কুলে গিয়ে আর ফেরেনি। তিন দিন পরে পালচৌধুরিদের পুকুরে দেহ ভেসে উঠেছিল, চারদিকে ফুটেছিল শাপলা। শাপলারা মৃত শরীরে আব্রু দিয়েছিল। সুমির স্কুলের পোষাক, বইয়ের ব্যাগ কিছু পাওয়া যায়নি। শুধু ছাই, শুধু ছাই ছিল পালচৌধুরীদের বিগ্রহহীন ভাঙ্গা মন্দিরে, আর দুটো চুলের ক্লিপ, প্লাস্টিকের। ছাই ঘেটে পুলিশ পেয়েছিল আধ পোড়া ইতিহাসের কয়েকটা পাতা, আর ইংরিজি রচনার একটুকরো – হোয়াই আই ওয়ান্ট টুবি এ টিচার। ওসব এখনো পুলিশের কাছে। চুলের ক্লিপ আর হাতের লেখা সনাক্ত করেছিল কংসারি।
পালচৌধুরীদের পুকুরে অনেক মাছ। মাঝরাত্তিরে ঘাই দেয়। বোয়াল মাছও আছে। মাছ খুবলে ছিল সুমির দেহ। পুকুর থেকে সকালবেলা সুমিকে টেনে এনেছিল হরিদাস। হরিদাস পালচৌধুরীদের বাঁধা মুনিষ। ওর বউয়ের শাড়ি দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল।
পুলিশ বলেছিল ধর্ষণ হয়েছিলই কিনা বলা যাচ্ছে না। শরীরে যে সব ক্ষত, এসব মাছেরা করেছে। মাছেরা খুবলে নিয়েছে। শরীর ঢাকা ছিল ডুরে শাড়িতে। গোড়ালি ঢাকেনি। বিক্ষত মাছ খেয়েছে ওর শ্রীচরণ।
ময়নাতদন্ত হয়েছিল। হয়েই থাকে। ওখানে ধর্ষণের কথা ছিল রিপোর্টে।
কিন্তু কে কিম্বা কে কে ধর্ষক তার প্রমাণ ছিল না। ধর্ষকরা এখন নাচছে।
দেশপ্রেমের গানের সঙ্গে, রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে নাচছে। আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে হচ্ছে। এফ আই আর করতে গিয়েছিল বিনোদ। সঙ্গে আরও দু চার জন।
কার নামে করবে? লিখেছিল আননোন পারসন। কিন্তু সবাই জানে এসব কার কাজ, কাদের কাজ। জানলেও বলবে না। ভয়।
হরিদাসের বাড়িটা তো পুকুরের কাছেই। হরিদাসের ছেলেটা বলেছে তো অনজিদ্দা, অনজিদ্দা…। হাত দিয়ে কিছু টেনে নেবার মূকাভিনয় করেছে। হরিদাসের ছেলেটা বোকা হাবা। ও ফিটগ্রস্ত, মুখ দিয়ে লালা গড়ায়। ও সব কথা উচ্চারণ করতে পারে না। ‘র’ কে ‘অ’ বলে, ‘ত’ কে ‘দ’। অনজিদ্দা মানে রনজিতদা, সবাই বুঝেছে। কিন্তু বোকা হাবার কথা গ্রহণযোগ্য নয়। পুলিশ মানে না, প্রশাসনও৷ নেতারাও। রনজিত গিরি এখন যুবা। ওই তো নাচছে।
সেদিনও মাইক বেজেছিল। নাচও ছিল কিছু। প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ছিল কিনা, সবুজ সংঘ। ক্লাবের কর্মকর্তারা বদলে গিয়েছিল আগেই। রনজিত গিরির লরি আছে। নদীর বালি তোলে। ও ক্লাবের নামের সঙ্গে মিলিয়েছিল সব। ঘরের রঙ সবুজ। নতুন প্লাস্টিকের চেয়ার, সবুজ বরণ।
মেয়েটার স্কুল ছিল বড় রাস্তায় দু কিলোমিটার। কাঁচা রাস্তায় আধা কিলোমিটার। এইটুকু পথ কিছু নয়। সবাই তো হেঁটেই যায়। সাইকেল নেয়নি। বাড়িতে সাইকেল ছিল। ছেলেদের সাইকেল। সুমির পক্ষে উঁচু। একটা লেডিজ সাইকেল কিনে দেবে ভেবেছিল। পারেনি।
কংসারি মিশ্র যজমানি করেন। বাড়িতে নারায়ণ আছে। নিত্যপূজা হয়। সাইকেলের বাস্কেটে সিংহাসন সমেত নারায়ণ শিলা চাপিয়ে কংসারি এ গাঁয়ে সে গাঁয়ে যায়। বিবাহ-অন্নপ্রাশন-গৃহপ্রবেশ এসব করেন। পালচৌধুরীরা জমিদার ছিলেন, ওদের নিত্যপূজার ভার ছিল মিশ্র পরিবারের উপর কংসারির ঠাকুরদার আমল থেকেই। নিষ্কর জমিও ছিল। এখন পালচৌধুরীদের ভগ্নদশা। শরিকরা ছিটকে গেছে। গ্রামে থাকে একমাত্র উত্তমকুমার। কী সব নাম হয়েছে। আগে ওদের পরিবারের ছেলেদের নাম হ’ত ললিতনারায়ণ, কন্দর্পনারায়ণ, চন্দ্ৰমোহন, অনিন্দ্যকান্তি…। এখন এইসব নাম। উত্তম ট্রাক্টর আর পাম্পসেট ভাড়া দেয়। উত্তমদের অংশে এখনো রাধামাধব আছেন। ওখানে নিত্যপূজা এখনো চলে। মাসে মাসে কিছু পেয়ে থাকেন কংসারি মিশ্র। উত্তম পালচৌধুরীকেও বলেছিল কংসারি – মেয়েটাকে যারা মারল, তারা তো ঘুরেই বেড়াচ্ছে। প্রতিকার করুন। আপনি জমিদার বংশ, আপনারাই তো বিচার করতেন হুজুর। হুজুর শব্দটা কংসারি মিশ্রর বলার কথা নয়। উনি ব্ৰাহ্মণ। ওদের পূজারী। বংশমর্যাদায় অনেক বড়। ওরাই প্রণাম করত। কিন্তু বলে ফেলল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। এই পিচ্ছিল শব্দ। দুর্যোগেই তো পিচ্ছিলতা হয়।
উত্তম পালচৌধুরী বলেছিল আমি কে ঠাকুরমশাই? গ্রামটা চালায় রনজিত আর জগা। আর রনজিতদের চালায় বিকাশ বেরা। আপনি বরং বিকাশ বেরার বাড়ি চলে যান। বলুন সব।
কংসারি বলেছিল তুমি তো ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। পুলিশ এলে তো তোমাদের বাড়িতেই বসে। তোমরাই তো সাদা পাথরের গেলাসে ঘোলের সরবৎ খাওয়াও।
—হ্যাঁ। ঐটুকুই। তাই বলে ভাবছেন পুলিশ আমার কথা শুনবে? কোন ক্ষমতা আছে? বেশি কিছু করলে আমার ট্রাক্টর ভাড়া দেওয়া বন্ধ করিয়ে দেবে। ট্রাক্টরের ইঞ্জিনে চিনি দিয়ে ইঞ্জিনের বারোটা বাজিয়ে দেবে। ঐ বিকাশ বেরা৷ মারলে মারেন, রাখলে রাখেন।
বিকাশ বেরা এসেছিল তো বাড়িতে। শুধু বিকাশ বেরা কেন, অধিকারীরাও এসেছিল। বাপ-ব্যাটা। সুমি মরার দিন কয়েক পরে এসেছিল ওরা। টিভিতে দেখিয়েছিল যে…। না, ওই খুবলে খাওয়া দেখায়নি, ঈশ্বরের করুণা,—তখনও খবর পায়নি ওরা। পুকুরটা দেখিয়েছিল, পুকুরের শাপলা ফুল দেখিয়েছিল, আর অন্নপূর্ণার বুক চাপরানো দেখিয়েছিল। পরপর দু তিন দিন টিভিওলারা এসেছিল। শত রকমের টিভি। এই প্রথম টিভির লোক এল, গাঁয়ের লোক দেখল তিন ঠেঙে ক্যামেরা, যাতে কান্না ভরে নিয়ে যায়। সেদিন নাকি হরিদাস ওর হাবা ছেলেটাকে বেঁধে রেখেছিল ঘরে। ওকে এটাই বলা হয়েছিল। নেতারা এসেছিল তারপর। মন্ত্রীও ছিল। বলেছিল ক্ষতিপূরণ দেবে। ছেলেকে চাকরিও দেবে।
কংসারি মিশ্রর ছেলের নাম বিনোদ। এম. এ. পাশ করে বসেছিল। কষ্ট করেই এম. এ. পাশ দিয়েছিল—বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কংসারি বলেছিল পূজা-আচ্চার লাইনটা খারাপ কি। শিখেনে। ছেলে এ লাইনে গেল না।
কিন্তু নেতারা কথা রেখেছে। ছেলের চাকরি হল। যে সে চাকরি নয়, এক্কেবারে প্রফেসারের চাকরি। পাকা চাকরি না হোক, চাকরি তো, প্রফেসারের চাকরি। বোনটা মরে দাদাকে চাকরি দিয়ে গেল।
মেয়ের ছবিতে মালা দিল কংসারি আর কয়েক ফোটা চোখের জল। বলল, তোর পিণ্ড ভক্ষণ করছি রে মেয়ে, আমরা পাপিষ্ঠ। তোর ইজ্জত, তোর উলঙ্গ শরীর ভক্ষণ করি আমরা। এই বাড়ির চালের নতুন টিন তোর উলঙ্গ শরীরের পরিবর্তে। প্রেশার কুকারের কী তীব্র ফোস্ শব্দ হয়, তোর আর্তনাদ রে, সুমি। আমরা সুসিদ্ধ ব্যাঞ্জন খাই। তোর দাদা নতুন কুকার এনেছে।
বিনোদের চাকরিটা পার্টটাইম। সাত হাজার টাকা বেতন। এই সংসারে সাত হাজার কম কী। বিনোদ স্নান করেছে। দিদির ছবির দিকে দেখল একবার। বাইরে থেকে ক’টা ঝরা শেফালি, মরা শেফালি কুড়িয়ে আনল। মুঠো ভরা। দিদির ছবির সামনে লজ্জামুঠি খুলে দিল। লজ্জাই তো। একটা গোটা বোনের বিনিময়ে পাওয়া হাফ চাকরি।
তখনো কামদুনি হয়নি। সবাই দাক্ষিণ্য নিয়েছে। বিনোদও। মাঝে মাঝে স্বপ্নে কামদুনির ঐ পরিবারটাকে দেখে বিনোদ। ঐ মিছিল। দুপাশে জল, মাঝখানে মানুষের ঢেউ।
বিনোদের কলেজে পরীক্ষা। চাকরি পেয়েছে সাত আট মাস হ’ল। আর মোটর সাইকেলটা তিন মাস। সেকেন্ড হ্যান্ড। বাড়ি থেকে কলেজটা আট কিলোমিটার। এই কলেজ থেকেই বি.এ. পাশ করেছিল বাংলায়। মোটর সাইকেলের ঘটঘট শব্দ ওকে ব্যঙ্গ করত। বলতো নিঃশব্দ হও, শব্দহীন হও। এখন সহ্য হয়ে গেছে। ওকে কেউ কেউ বলে হারামের মোটর সাইকেল। হ্যাঁ, মাইনের টাকা দিয়েই কিনেছে। অজয়ের সুজুকি। দশ বছরের পুরোন। অজয় নতুন কিনেছে। অজয় এই সবুজ সঙ্ঘের ট্রেজারার।
সবুজ সঙ্ঘ সরকারী অনুদান পেয়েছে। অনেক টাকা। একটা পাকা বেদি করেছে, ওখানে পতাকা ওড়ে। সবুজ সঙ্ঘের সবুজ পতাকা, মাঝে মাঝে জাতীয় পতাকা। খেলা হয়, গোলপোষ্ট, নতুন বল, ব্যাট এইসব। মনীষীদের ছবি। যাঁরা রাজ্য চালাচ্ছেন, তাঁদের ছবি। তাঁরাও তো মনীষী। আজ খাওয়া দাওয়া হবে দুপুরে। খিচুড়ি? আগের বছর খিচুড়িই হয়েছিল। এবার পোলাও হতে পারে। সে বারও খিচুড়ি ছিল। বিনোদও খেয়েছিল। গ্রামেই তো ছিল। সবার সঙ্গে বিনোদও বসেছিল। বেগুনি, আলুরদম, চাটনি। এর নাম পরিবর্তন। কই, আগে তো প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে খাওয়া দাওয়া ছিল না…।
সুমি বলে গিয়েছিল স্কুল ছুটির পর টিউশনি পড়তে যাবে। ইংরিজিটায় কাঁচা ও। ইস্কুল ছুটির পর টিউশনি পড়া। এধারে আসার পথেই মাস্টারের বাড়ি। ছটার মধ্যেই আসার কথা ছিল।
ছ’টা বাজল। তবুও সুমি এলো না। সাতটা বাজল, তবুও সুমি এলো না। বিনোদ বাড়িতে ফিরে দেখল মা উঠানে।
সুমির মোবাইল ফোন নেই। বিনোদের একটা ছিল। কিন্তু প্রায়ই ব্যালান্স থাকে না। বিনোদের কাছে সুমির মাস্টারের ফোন নম্বর ছিল না।
সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়েছিল বিনোদ। নুড়ি ঘরঘর কাঁচা রাস্তা। তারপর পাকা রাস্তা। রতন মাস্টারের বাড়ি। রতন মাস্টার বলল সোয়া পাঁচটা নাগাদ সুমিতা বেরিয়ে গেছে।
এবার কোথায় যাবে? কোন বন্ধুর বাড়ি গেল সুমিতা? কাকে জিজ্ঞাসা করবে? ওদের গ্রামের আর কেউ রতন মাস্টারের কাছে পড়ে না। ইলেভেন ক্লাসেও পড়ে না এ গাঁয়ের কেউ। আরতির সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব ছিল, ওর বিয়ে হয়ে গেছে পাশের গাঁয়ে। না, ওখানেও যায়নি। রাস্তা ধু-ধু। আকাশে ক্ষয়া চাঁদ। প্যাঁচা উড়ে যায়। গ্রামে ফিরে আসে। পালচৌধুরীদের হাহাকার করা ভাঙ্গা দরজা। ওধারে শিব মন্দির। রাস্তায় পড়ে আছে দুটো মদের বোতল। তারপর সবুজ সঙ্ঘ। তখন কেউ নেই। বাড়ি ফিরল। নটা বেজেছে। তবুও সুমি আসেনি। সারারাত চাঁদ আলো বমি করে গেল। রাতের পাখিরা উড়ল, শিউলিও ফুটল, ঝরে গেল ভোরে। সুমি এল না।
তারপর থানা। ডায়রি। রনজিতও গিয়েছিল। ভোলা, পাচু, সুধীররাও। রনজিত মোবাইলে বিকাশ বেরার সঙ্গে কথা বলেছিল। বিকাশ বেরা থানার ওসিকে বলে দিয়েছিল। ওসি সবাইকে চা-নিমকি বিস্কুট খাইয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল জিলিপি খাবেন?
পরে ভেসে উঠেছিল সুমি—শাপলা বনে। তিন দিন পর।
হরিদাসের হাবা ছেলেটা বেরিয়ে এসে বলেছিল –অনজিদ্দা, অনজিদ্দা… হুই…হুই…। আঙুলটা মন্দিরের দিকে।
থানায় যেতে হল। এফ আই আর-এ কারুর নাম ছিল না। ওসি জিলিপি আনিয়েছিল। বিকাশবাবুর ফোন ছিল যে…।
ক্ষতিপূরণের টাকাও নেবে বলেছিল। এখনো পায়নি। কিন্তু চাকরিটা নিয়েছিল। পঞ্চায়েতের ভোটের সভায় চাকরি দেয়ার কথা বলাও হয়েছিল।
রনজিত এবং দলবলের সঙ্গে খুব একটা মেশামিশি করে না বিনোদ। ওরা বলে তুই চাকরিটা আমাদের দিয়ে করিয়ে নিয়ে আমাদের পার্টিটা করিস না, শালা নিমকহারাম।
কিন্তু কলেজে করতেই হয়। যাদের পছন্দ নয়, তাদের পার্টি নিয়ন্ত্রিত এ্যাসোসিয়েশন। শুধু চাঁদা নয়, পার্টটাইম শিক্ষক সমিতির আহ্বায়কও করে দেয়া হয়েছে। প্রিন্সিপল বলল, পোর্টফোলিওটা নিয়ে যাও। তোমাদের চাকরি পলকা সুতোয় ঝুলছে, যখন তখন সুতো কেটে যেতে পারে। দু চারবার বক্তব্যও রেখেছে। একইরকম পড়িয়ে ক্লাশ করে নিয়মিত শিক্ষকরা পাচ্ছেন তিরিশ হাজার, আর এরা সাত হাজার। তাই বলে ক্লাশে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। সমস্ত উজাড় করে দিতে হবে ছাত্রদের। এবং নতুন সরকার যেন বিব্রত না হয়, তাই খুব একটা চাপ নয়, তবে দাবী রেখে যেতেই হবে। বক্তব্যর সময় কথাগুলোর গায়ে বারবার মমতা এবং মাটি মাখিয়ে দিতে হয়। এটাই নিয়ম। সবাই করে।
রনজিত মোটর সাইকেলে। ক্লাবের পাশ দিয়ে রাস্তা। যে গানটা হচ্ছিল, থেমে গেল। অন্য গান শুরু হল। ‘মার ঝাড়ু মার, ঝাড়ু মেরে ঝেটিয়ে বিদেয় কর…।’
না-না, ওকে উদ্দেশ্য করে নয়। এমনি চালিয়েছিল।
আজ পরীক্ষা। রনজিত গিরির বউ পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দিচ্ছে। বউটাকে চেনে। সুমির মৃত্যুর কিছুদিন পরই বিয়েটা হয়েছে। খুব ধুমধাম। ব্যান্ডপার্টি। টুনি লাইটে লেখা রনজিত ওয়েডস্ মধুমিতা। রনজিতের শ্বশুরবাড়ি বড়লোক। কাঁথিতে দুটো কাপড়ের দোকান, দীঘাতে হোটেল।
ইউনিয়নের দুটো ছেলে এসে ঘরে ঘরে বলে গেল আপনারা টিচার্সরুমে চলে যান। গার্ড দিতে হবে না, আমরাই গার্ড দিয়ে দিচ্ছি।
প্রিন্সিপলের কাছে গেল বিনোদ। ঘটনাটা বলল। প্রিন্সিপলও জানেন ঘটনাটা।
প্রিন্সিপল বললেন – আপনি ঘরেই থাকবেন, চেয়ারে। দরকার হলে চোখ বুজে থাকবেন। কিন্তু ঘরে থাকবেন। ঘর ছেড়ে চলে আসা এ্যালাও করব না। বিনোদ ক্লাসরুমে যায় আবার। চেয়ারে বসে। ছেলেগুলোকে বলে, আমাকে এই ঘরে থাকতে দাও, আমি চোখ বুজে থাকব।
বিনোদ চোখ বোজে।
চোখ বুজেই দেখে কামদুনির মেয়েগুলো। ওদের মিছিল। ধর্ষিতা মেয়েটার নেড়ামাথা ভাই, বলছে না, ক্ষতিপূরণ চাই না। বোনটা মরে গেল, এর আবার কী ক্ষতিপূরণ? মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ টাকা দিয়ে হয় নাকি? টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করতে পারবেন না। না, চাকরিও চাই না। ওদের ধরুন, শাস্তি দিন, এসব বন্ধ করুন। ঘরে ঘরে বোন আছে।
সুমির মৃত্যুর অনেকদিন পর এই কামদুমির ঘটনা। এইতো মাস কয়েক হল। তার আগেই ধর্ষণের গ্রেডেশন হয়ে গেছে। ধর্ষণের রকমফের হয় ক্ষতিপূরণের টাকার অঙ্কের রকমফের হয়। ধর্ষণের পর মৃত্যু না হলে একরকম মৃত্যু হলে অন্যরকম। গণধর্ষণের ক্ষেত্রে? অতো মনে নেই। সুমি হাইয়েস গ্রেডেই মরেছিল। সুমির পরিবার যেটা পাবে, পাওয়ার কথা, ওটা ধর্ষণের হাইয়েস্ট ক্ষতিপূরণ।
চোখ বুজে বিনোদ দেখল দুপাশে জল, মাঝখানে রাস্তা। রাস্তায় মিছিল। কাঁচা হাতের লেখা ধর্ষণের কোন ক্ষতিপূরণ হয় না, মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হয় না, শাস্তি চাই। মনে হচ্ছিল, দুপাশের স্থির জল থেকে অগ্নিশিখা উঠছে। দুপাশের আগুনের মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছে কামদুনির মেয়েগুলো।
যদি কামদুনির ঘটনাটা সুমির মৃত্যুধর্ষণের আগেই ঘটতো, তাহলে কি বিনোদ রাজি হ’ত? নিত এসব ভেট?
কে জানে?
বিনোদ চোখ খোলে।
দেখল সামনেই, ছোট ব্যাগ থেকে কাগজ বার করে খাতার পাশে রেখে টুকছে মেয়েটা। রনজিত গিরির বউ।
বিনোদ এগিয়ে গেল। বলল, কী হচ্ছে?
মেয়েটার বাঁ হাতে বিপদতারিনীর লাল ডোর।
সিঁথির সিঁদুর ছাড়া এইটুকু লাল ধারণ করতেই হয়। মেয়েটা ভ্রুভঙ্গী করে। দেখছেন তো কি হচ্ছে।
বিনোদ বলল এগুলো দিয়ে দিন।
মেয়েটা বলল দেব কেন?
টুকলি চলবে না।
মেয়েটা টুকলির কাগজ হাতে চেপে বলল – মানে? আপনার সাহস তো কম না। জানেন আমি কে?
বিনোদ বলে জানবার দরকার নেই। এটুকু জানি আপনি টুকছেন। অন্যায় করছেন।
তুমি নয়, আপনি করেই বলল বিনোদ। নেতার স্ত্রী কিনা!
বেশ করছি। গলা চড়ায় মেয়েটা।
বিনোদ হাতে চাপা কাগজটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করে।
মেয়েটা বলে, এত সাহস হয়ে গেছে? আমার গায়ে হাত?
ততক্ষণে কাগজটার অনেকটাই কেড়ে নিতে পেরেছে। কিছুটা ছিঁড়ে গেছে।
বিনোদ বলল, বাকি কি কি আছে দিয়ে দিন।
মেয়েটা চিৎকার করে। বাচ্চুদা, ভোম্বল, বিশু, দেখে যাও কী হচ্ছে। বিনোদও গলা চড়ায়। আর কোথায় কি আছে আমাকে দিয়ে দিন…
ততক্ষণে বাচ্চুবাহিনী এসে গেছে।
বিনোদ মেয়েটার খাতাটাও নিয়ে নেয়। দেখে খাতার ফাঁকে একটা গোটা পৃষ্ঠা বাংলার রেনেসাঁ। খাতাটা নিয়ে প্রিন্সিপালের ঘরের দিকে যায় বিনোদ। ছেলেগুলো বলে, কোথায় যাচ্ছেন?
বিনোদ বলে, আমার যা ডিউটি সেটা করতে।
ডিউটির গাঢ় মারি। ডিউটি মারানো হচ্ছে? দে, ফেরৎ দে খাতা…।
বিনোদ বলে, না, আমি এটা পাঠিয়ে দেব। ওর আর পরীক্ষা দেয়া হবে না।
ছেলেগুলো বলে, ও একা নাকি, সবাই তো টুকছে।
বিনোদ বলে, আমি আবার আসছি। কাউকেই টুকতে দেব না।
বিনোদের কলার চেপে ধরে একজন। অন্য একজন মুখে ঘুষি মারে। হাত খিমচে ধরে একজন। খাতাটা ছিনিয়ে নেয় ৷
বিনোদ প্রিন্সিপালের ঘরে যায়। ঘটনাটা বলে।
বলে, খাতাটা সিজ করুন স্যার।
প্রিন্সিপাল বলেন, কী দরকার ঝামেলায়? সামলানো যাবে না। জানেন না গভর্নিং বডিতে কারা আছেন? ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দিন। ভুলে যেয়ো না তুমি কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরি পেয়েছো।
বিনোদ বলে তা হলে আমি গার্ড দিতে পারব না স্যার, ছেড়ে দিন। প্রিন্সিপাল বললেন –তাহলে ছেড়ে দিচ্ছি, পুরোটাই ছেড়ে দিচ্ছি। রিজাইন কর।
বিনোদ চুপ করে যায়।
প্রিন্সিপাল বলে –মিউচুয়াল করে নাও। গার্ড তোমাকে দিতেই হবে। এখন সাবস্টিটিউট কোথায় পাব?
বিনোদকে ঐ ঘরে যেতে হয় ফের। চেয়ারে বসে থাকে। চোখ বোজে না ৷ চোখ বুজলেই ফের কামদুনির মুখগুলো ভেসে উঠতে পারে। ও তাকিয়ে থাকে। ওর চোখ মাছের চোখ, ওর চোখ মরা মানুষের চোখ। পরীক্ষা শেষের ঘণ্টা বাজে। বিনোদ প্যাক-টিটকিরি খেতে খেতে কলেজ থেকে বের হয়। বাড়ি ফেরে। পাকা রাস্তার পর কাঁচা রাস্তা। কাঁচা রাস্তার পাশে সেই পুকুর। তরঙ্গহীন। তরঙ্গহীন স্থির জলের ভিতরে গোপনে রয়েছে আগুন। হে অগ্নি, তুমি জাগো।
কংসারি মিশ্র সব শুনলেন। শুনে কিছুই বললেন না। মূক। বিনোদের মা মেয়ের মৃত্যুর পর থেকে প্রায় মূক। কথাই বলেন না তেমন। কোন কোনদিন ভুলে যান স্নানটা করেছিলেন কিনা।
কংসারি ভাবলেন নামটা বাবা ভুল রেখেছিলেন। কংসরা সব তো চারপাশে দিব্য আছে।
বিনোদ বলল, বাবা, আমি কি ভুল করেছি?
কংসারি বাক্যহীন।
একটু পরই চার পাঁচজন ছেলে এল। বলল, খুব রস হয়েছে। সাপের গর্তে হাত দিতে গিয়েছিলি। থানায় ডায়রি করা হয়েছে। শ্লীলতাহানি। এখুনি পুলিশ আসবে। এখন একদম বাইরে বেরোতে দেব না। ঘিরে রেখেছি আমরা। শালা চোর। রনজিতদার ওয়াইফের ব্যাগ থেকে টাকাও চুরি করেছিস শালা। পুরো ঢুকিয়ে দেব।
পুলিশ খুবই সক্রিয়। এসে গিয়েছিল। এফ আই আর এর ভিত্তিতে বিনোদ গ্রেফতার হল। ৩৫৪ এবং ৩৭৯ ধারা। জামিন অযোগ্য। শ্লীলতাহানি এবং চৌর্য্যবৃত্তি।
জিপ গাড়ি চলে যায়। কালো ধোঁয়া। কংসারি স্থির চেয়ে থাকে। মাছের চোখ। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে শরীর। শীতল। শীতল।
হে ঈশ্বর, দাহ দাও। হুতাশন হে, দহন্তু, দহন্তু সর্বে দহেয়ং সর্বগাত্রাণি। ওঁ অস্বে বিধৃত্বং ইহতিষ্ট ইহতিষ্ট ইহ সন্নিধেহি ইহ অত্রাধিষ্টানং কুরু।
ওঁ অগ্নেয় নমঃ।
অগ্নির আবাহন করেন কংসারি মিশ্র।
আজ সেই দিন।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন