short-story-dujone

দুজনে
দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়


যে মেয়েটা এইমাত্র ট্রেন থেকে নামল, সে সোহিনী। ডাক নাম টুলু। হাতে মোবাইল, কানে হেডফোন। পোশাকটা এই সময়ের- কোনদিন টপ জিন্স, কোনোদিন সালোয়াড় কামিজ। অত্যন্ত ভাল ব্যবহার ওর। পাড়া-বাড়ি কেউ কোনোদিন ওর নামে বলতে পারবে না টুলু খারাপ ব্যবহার করেছে।

টুলু যে ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে তা একটা ছোট ষ্টেশন। মোটে দুটো প্ল্যার্টফর্ম। একটু দূরে ডানদিক আছে নদী, নদীর উপর কারুকার্য করা বাহারি ব্রিজ।

টুলু আপের ট্রেন ধরে নদী পেরিয়ে এখানে নামে। ষ্টেশনের কাছেই একজায়গায় কাজ করে তারপর আবার ট্রেন ধরে ফিরে যায়।

মিনিট পাঁচেক পরে ডাউন ট্রেন ধরে ষ্টেশনে নামে দীপক। বছর তিনেক ধরে তাই চলছে। কে কার সঙ্গে আগে কথা বলেছে খেয়াল নেই, একই জায়গায় প্রায় আগে পরে নামতে নামতে দুজনের চেনা হয়ে গেছে। তারা দুজন একইসঙ্গে সিঁড়ি ধরে নামে, চলতে চলতে কথা বলে। দীপক বলে, ‘যা! তোমার মোবাইলের কভারটা আনতে ভুলে গেলাম।’

‘ভুলে তো যাবেই।’

‘না। না। খুব মনে আছে। কাল আনব।’

আসলে দীপকের পরিচিত কেউ এইসব কভার বিক্রী করে। দীপক একটা দুটো পায় বা কালেক্ট করে রেখেছিল। দীপক ভেবে রেখেছিল সেটা ও টুলুকেই দেবে।

সিঁড়ি ধরে অল্প কথা বলার পর তারা দুজন রাস্তার দুদিকে চলে যায়। দীপক অন্য একটা জায়গায় কাজ করে। ফেরার সময়টুকু তারা ঠিক করে রাখে। ট্রেন ধরার আগে দুজনের আবার কথা বলার সুযোগ হয়।

কিন্তু আজ যেন দিনটা অন্যরকম। টুলুকে কেউ যদি খেয়াল করে, ওর চোখের দিকে তাকায় তাহলে একটা অন্যরকম ভাবনা ঠেকবে। টুলুর সুন্দর চোখ দুটো জলে ভরা।

মেয়েরা নানারকম কারণে চোখে জল আনে, সে চোখের জল মিথ্যেও হতে পারে। কিন্ত এই নির্জনে যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দুচারজন ছাড়া কেউ নেই, খামোকা সে কেন চোখে জল আনতে যাবে?

মনে হয় টুলু আজ কাজে যাবে না। কাজে যাবার বিষয়টা ওর মাথায় নেই। সকাল থেকেই ওর সঙ্গে ফোনে দীপকের ঝগড়া হয়েছে। সেই ঝগড়ার কথাই মাথায় ঘুরছে। একটু পরে দীপক আসবে। তারপরেই ওরা একটা চরম সিদ্ধান্ত নেবে। আজ তারা রিলেশন ব্রেক আপ করবে।

উঁচু সিঁড়ি। কদিন আগেও নামবার সময় টুলু ব্যাগ থেকে একটা কিছু বার করেছে। দীপককে দিয়ে বলেছে ‘ধর’।

‘কী এটা?’

‘গিয়ে দেখিস। দুপুরেই খাবি কিন্তু।’

দীপক ব্যাগের পেটে ঢুকিয়ে রাখে।

টুলু বলে, ‘একে ওকে দিস না। নিজে খাস।’ দীপকের বিলিয়ে দেবার অভ্যেস আছে। ওর কথা শুনে দীপক হেসে মাথা নেড়ে বলে ‘আচ্ছা। দেব না। শোন না। ওদিকে আবার এক ঝামেলা হয়েছে!’

‘ঝামেলা? কিসের?’

‘ওই একই ব্যাপার। জানিস তো।’

টুলু চিন্তায় পড়ে। দীপকের ঝামেলা কবে থেকে যেন তার ঝামেলা হয়ে গেছে!

ঝামেলা মানে খুব ছোট, তা নেহাত ব্যক্তিগত। বিশ্বে ঘটমান কোনো গুরুত্বপূর্ন ঘটনা নয়। সেইসব গুরুত্বপূর্ন ঘটনার কথা তাদেরও কানে আসে। বেশীরভাগ মানুষের মতোই তারা বড়জোর ‘ইস ‘বা ‘আহা’ বা ‘বেশ হয়েছে’ গোছের মন্তব্য করে। মন্তব্য করার ফাঁকেই মনে পড়ে তাদের খুব গোপন ব্যক্তিগত সমস্যার কথাটা। সে সমস্যার কথা কারুকে বলা যায় না। খুব তুচ্ছ, নগন্য। অথচ মানুষের তাই মনে পড়ে। লোককে তা বলা যায় না। কিন্তু টুলু অচেনা নয় বরং সে দীপকের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। ওর কাছে তাই দীপক ধীরে ধীরে রাগ, বিরাগ, হিংসা সব উগরে দিয়েছে। টুলু চুপচাপ শোনে। দীপককে কে কে হিংসে করে সে জেনে যায়। ও কি কি চায় সে জানে। ও যেখানে থাকে তাকে কে কি বলে, তার নামধাম চেহারা ছবি টুলু না গিয়েও চিনে ফ্যালে। দীপক যদি অবিনাশের কথা বলে তা শুনে টুলু বলে ‘অবিনাশ মানে ওই যে মোটা মত লোকটা? মাথায় টাক আছে? কি বলছিল ও?’ অথবা দীপক কখনো সোনামাসির কথা বললে টুলু হেসে ওঠে। দীপক অনেকবার সোনামাসীর কথা বলেছে। খুব রাগী, চিৎকার করে কথা বলে। তবে দীপককে খুব ভালবাসে। সুতরাং দীপকের সমস্যা অনেকদিন ধরেই টুলুর সমস্যা হয়ে গেছে। টুলু ওকে সমাধানের উপায়ও বলেছে। মাথা ঠান্ডা রাখার কথা বলেছে। দীপক খুব রাগি, এমন রাগ ভাল নয়, টুলু জানে। সে বলে, ‘ঠিক আছে। মাথা গরম করবি না কিন্তু।’

‘ছাড়। ছাড়। ও ঝামেলা মিটে যাবে।’

এরকম ছোট ছোট সমস্যা এসেছে তা কেটেও গেছে অচিরে। কিন্তু এবার অন্য একটা ঝামেলা এসেছে। এবার তা বাইরের নয় তাদের নিজেদের মধ্যে। একারণে তাদের সম্পর্কটা দিন দিন জটিল হয়ে গেছে। যার অনিবার্য ফল তারা আজ ব্রেক আপ করতে রাজি।

যদিও সমস্যাটা নিরীহ। মাস ছয়েক টুলুর এক কো-প্যাসেঞ্জার হয়েছে। অনুপম। সে টুলুর সঙ্গেই আসে। একইভাবে দীপকেরও একটি কো-প্যাসেঞ্জার হয়েছে। কথাকলি। সেও দীপকের সঙ্গে যাতায়াত করে। এমন ঘটনা স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাভাবিক হলেও রোজ রোজ পরস্পরকে অন্যের সঙ্গে দেখে তাদের দুজনেরই তা অপছন্দ হতে শুরু করেছে। মনের মধ্যে কবে থেকে বেসুর বাজছে। ইদানিং দুজনে যখন গল্প করে তখন তাদের আলোচনায় অবধারিত ভাবে চলে আসে অনুপম ও কথাকলি।

দীপক বিরক্তস্বরে বলে ‘তুই ওর সাথে যাস কেন?’

‘কি করব? আমি আর অনুপম একই ষ্টেশন থেকে উঠি। তুইও তো আসিস কথাকলির সঙ্গে! তারবেলা?’

‘আমি তোর মতো বকবক করি না।’

‘না। করিস না। দেখি তো।’

এটুকু বিরক্তিই তারা দেখায়। আবার চাপা পড়ে যায় তা। কিন্তু দুজন দুজনকে লুকিয়ে দ্যাখে। ডাউনে নামে দীপক আর কথাকলি। আপে নামে টুলু আর অনুপম। টুলু দ্যাখে কথাকলিকে আর দীপক অনুপমকে। দুজনেই বিরক্তিতে ভরে ওঠে। কথাকলির কথায় দীপক হেসে গড়িয়ে পড়ছে দেখে টুলু গম্ভীর হয়ে যায়। টুলুও অনুপমের সঙ্গে বকবক করছে দেখলে দীপকের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।

টুলু বা দীপক দুজনেরই মনে হয়, একটা কিছু পাল্টান দরকার। ট্রেনের টাইম কি তারা বদলে ফেলবে? তাহলে কি সমস্যা মিটে যাবে? কিন্তু আগের বা পরের ট্রেন ধরা তো তাদের হাতে নেই। ডিউটিতে তারা কি করে ঠিক সময়ে আসবে? তাহলে সবকিছু গোলমাল হয়ে যাবে।

ওরা দুজনেই টের পায় বুকের ভেতর একটা জ্বালা গরগরিয়ে নামছে। এখানে ওখানে ছোপ ফেলছে। এজন্য মাঝে মাঝেই তারা পরস্পরকে দোষ দেয়। টুলু বলে ‘তোরা এক কামরায় আসিস কেন পাল্টাতে পারিস না?’

দীপক বলে ‘তুই কি করিস? তুইও তো ছাড়িস না। সারা রাস্তা গল্প করতে করতে যাস।’

টুলু বলে, ‘সেদিন বাদাম কিনে খাওয়ালি দেখলাম তো!’

দীপক বলে ‘ওকে সেদিন কেমন এগরোল খেতে ডাকছিলি? শুনিনি?’

সেদিন ঝগড়াটা খুব বেড়ে গেল। অনুপম ও কথাকলি কিছু একটা বুঝেই আগে বিদায় নিল। টুলুরা ট্রেনের কথা ভুলে চেঁচাতে শুরু করল। রাগ বেশি দীপকের। টুলুও সেদিন কম যায় না। লোক দেখছে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে শুনছে। তাতে কি? দুজনেই বেহুঁশের মতো চিৎকার করে।

কথা, ঝগড়া, চিৎকার তারপর হঠাৎ একসময় তারা দুজনেই চুপ। বিরক্তিতে সরে গেল তারা। একজন আপে আর একজন ডাউনে। যাবার আগে দুজন আড়চোখে দুজনকে দেখল।

সে গোলমালটাও অবশ্য খুব তাড়াতাড়ি মিটে গেছে। দিন দুই তারা কথা বলে নি। তারপর একরাতে টুলু একটা মেসেজ করল ‘নেলপালিশটা আনিস।’ দীপক লিখল ‘পারব না।’ টুলু হাসল। সে জানে কাল ঠিক নেলপালিশ আনবে দীপক। ওর জন্য একটা বডি স্প্রে কিনেছে তা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল টুলু।

আপাত সন্ধি হয়ে গেল দুজনের। দিন হুড়মুড় করে কাটল। কিন্তু দুমাস যেতে না যেতেই আবার শুরু হল গভীর অসন্তোষ। আবার সেই একই সন্দেহ মনের মধ্যে দানা বাঁধল। একটু একটু করে অনুপাতে অনুপাতে রাগ জমতে শুরু করল। টুলুর মনে হল কথাকলির দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে দীপক। দীপকেরও মনে হল অনুপম না হলে টুলুর চলে না। তারই পরিনতি আজ সকালে ঘটল। শুরু হয়েছে গত রাত থেকে। আজ সকালে ফোনে। একটু পরে স্টেশনে তার পরিনতি ঘটবে।

এখনো দীপকের ট্রেন ঢোকেনি। টুলু থমথমে মুখে চেয়ে। অন্যদিনের মতো অনুপম আজও তার সঙ্গী। সে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে। ওর দিকে টুলুর তাকাতে ইচ্ছে করছে না। সে ওকে বলেছে কাজে চলে যেতে। আজ সে কাজে নাও যেতে পারে একটু পরে যাবে। কিন্তু অনুপম শোনেনি। ও দাঁড়িয়ে আছে।

একটু পরে ডাউন ট্রেন এল। ট্রেন থেকে দীপক কথাকলি দুজনে নামল। ট্রেনের যাত্রীরা সব নেমে গেল। শুধু দীপকরা দাঁড়িয়ে আছে।

দীপক বোধহয় ওদিক দিয়ে হাঁক মারল। টুলু মুখ ফিরিয়ে নিল। সে উত্তর দেবে না। কিছমুহূর্ত গেল। টুলু দেখল দীপক ডাউন প্ল্যার্টফর্মের মাথায় চলে এল। সেখান থেকে নেমে ও রেললাইন ক্রশ করে আপ প্ল্যাটফর্মে উঠল। এমন কি ওই কথাকলিও ওর সঙ্গে আসছে। টুলু ঠিক করল আজ সরাসরি অপমান করবে কথাকলিকে। যা নয় তাই সে ওকে বলবে। ও যদি না আসত, দীপকের সঙ্গে কাজ যদি না করত তাহলে কি এমন হত? তিল তিল করে গড়ে ওঠা সম্পর্কটা কথাকলির জন্যই ভেঙ্গে গেছে।

এমন কথা দীপকও ভাবছিল। রেললাইন পেরোনোর সময় তার মাথায় একথা ঘুরল। সে দূর থেকে অনুপমকে দেখতে পেল। মুখ থমথমে হয়ে গেল। ও কিসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে এখনও? ওর জন্যই তাদের সম্পর্ক এখন ভাঙনের পথে। দীপক উত্তেজনায় পা ঠোকে।

চারজন এখন পাশাপাশি এসে দাঁড়াল। পরস্পর পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল। যে কোনো মুহুর্তেই প্রবল ঝগড়া, কান্নাকাটি, হাতাহাতি কিছু একটা ঘটতে পারে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার। কিছু ঘটল না! বরং একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার দেখা গেল। টুলুর চোখে জল নেই। দীপকের চোয়ালও আগের মত শক্ত নয়। সবচেয়ে দুর্লভ দৃশ্য দেখা গেল টুলু হেসে হেসে কথা বলছে কথাকলির সঙ্গে! দীপকও অনুপমের কথা শুনে মাথা নাড়ছে!

আরো পাঁচ মিনিট বা দশ মিনিট। ওরা কথা বলে গেল। মাঝেমাঝে চারজনের হাসিও শোনা গেল। তারপর টুলু আর দীপক রয়ে গেল। ওদের দিকে টাটা করে চলে গেল অনুপম আর কথাকলি।

কি ঘটল কিছুই মাথায় ঢুকল না!

মাথায় অবশ্য টুলুদেরও ঢোকেনি। ওরা হাসছিল ঠিকই। কিন্তু অনুপম ও কথাকলি চলে যাবার পর ওরা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। তারা দুজনেই ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছে। একটা বিরাট হাসির মতো ব্যাপার যেন এইমাত্র ঘটে গেল। টুলু অবাক চোখে হেসে উঠে বলল ‘কি সাংঘাতিক!

দীপকও মাথা নেড়ে বলল, সত্যি!

দুজনে ভেবে হেসে উঠল। সাংঘাতিক নয় তো কি! কে জানত অনুপম ও কথাকলির মধ্যে প্রেম আছে! ওরা কখনো জানায়নি। আজ প্রথম ডিক্লেয়ার করল! কদিন পর ওরা দুজনে এখানে কাজও করবে না। অন্য কোথাও চলে যাবে।

ভেবে হাসে দুজনে। মনে মনে টুলু ভাবল বেশ হয়েছে এবার দীপক শান্ত হবে। উড়ু উড়ু মন বশে আসবে। দীপকও তাই ভাবল।

কিন্তু মন অচেতন। টুলু একবার তাকায় দূরে চলে যাওয়া অনুপমের দিকে। দীপকও তাই। সে দেখছে কথাকলিকে। একটু যেন হতাশ লাগে। বেশি কিছু প্রাপ্য ছিল কি? ছিল না। তবু, তবু, কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেল!

এরপর থেকে আবার তারা কেবল দুজন!



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *