হর্ষ দত্ত
আর কতটা যেতে হবে? আর কত দূর? কঙ্কণা নিজেকে আর টানতে পারছে না। ওর ভেতর থেকে যেন আরও একজন কঙ্কণা বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। বাবা দীপায়ন আর লম্বা, ছিপছিপে, সুন্দরী পিসিমণি ঊর্মিলার মাঝখানে বসে আছে কঙ্কণা। ড্রাইভার বিক্রমদার পাশে সুজিতকাকু, বাবার ছোটবেলার বন্ধু। পিসিমণিকে নাকি বিয়ে করতে চেয়েছিল সুজিতকাকু। কিন্তু হাইটে বেমানান হয়ে যাওয়ায় ঠাকুরদা রাজি হয়নি। পিসেমশাই পিসিমণির চেয়েও দীর্ঘকায়। মা আসতে পারেনি। সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে স্টেপিং-এর গণ্ডগোলে লাম্বার পেইনে ভুগছে। এতটা রাস্তা গাড়িতে একভাবে বসে আসা সম্ভব হত না। মা পরে আসবে।
কলকাতার জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে কঙ্কণা। নন্দীগ্রাম জায়গাটার নাম, ও কলেজজীবন এবং এম.এ পড়ার সময় থেকে শুনে আসছে। বাবা এবং বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কথা শুনে বা খবরের কাগজে যতটা পড়েছে, তাতে ওর মনে হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বদলের চমকপ্রদ এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তনের অভিমুখ নন্দীগ্রাম। হুগলির সিঙ্গুরে কৃষকদের জমিতে, টাটা কোম্পানির ন্যানো গাড়ির কারখানা হতে না-দেওয়ার আন্দোলন নাকি পরিবর্তনের ভিত্তিভূমি। আর পুলিশের গুলিচালনা, রক্তপাত, মৃত্যুর মিছিলে এবং প্রতিরোধে নন্দীগ্রাম হয়ে উঠেছিল বিপ্লবের আগ্নেয়গিরি। সেই ইতিহাসের অধ্যায় আজও নানাভাবে লেখা হচ্ছে।
কঙ্কণা এই নন্দীগ্রাম থানার অন্তর্গত ঈশানপুর নামে একটি গ্রামের, কো-এডুকেশন কলেজে অ্যাসিস্টান্ট প্রফেসরের চাকরি পেয়েছে। বিষয় ইংরেজি। কলেজ সার্ভিস কমিশন থেকে রেকমেন্ডেশন লেটার পেয়ে কঙ্কণা কেঁদে ফেলেছিল। জমজমাট পূর্ব কলকাতা থেকে পূর্ব মেদিনীপুরের বিতর্কিত নন্দীগ্রাম! যার আগাগোড়া রেজাল্ট ভাল, কলকাতার একাধিক নামী কলেজে গেস্ট লেকচারার হিসেবে পড়িয়েছে, তাকে বাঁশবনে নির্বাসন দেওয়ার মানেটা কী? খোদ কলকাতা না হয় কঙ্কণা বাদই দিল, কিন্তু শহরতলিতেও অনেক খ্যাতনামা কলেজ আছে। সেগুলোর একটাতেও কি ওকে পোস্টিং দেওয়া যেত না? চাকরির ক্ষেত্রে কি ভাল-খারাপের বিচার নেই! সি এস সি-র চিঠিটা ক্ষোভে-দুঃখে ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিল কঙ্কণা। চাই না পার্মানেন্ট চাকরি। কম মাইনের অতিথি অধ্যাপক হিসেবেই এই শহরে ও জীবন কাটিয়ে দেবে। কিন্তু সেদিন ওকে সবাই বাধা দিয়েছিল।
বাবা বেশ জোর দিয়ে বলেছিল, ‘দেখছিস তো, চাকরি-বাকরির বাজার কী সাংঘাতিক খারাপ! তুই এন ই টি মানে নেট ক্লিয়ার করেছিস। প্রফেসরশিপ তোর প্রাপ্য চাকরি।’
চিৎকার করে উঠেছিল কঙ্কণা, ‘তা বলে ভিখারির দিকে পয়সা ছুড়ে দেওয়ার মতো…’
দীপায়ন ম্লান হেসেছে, ‘জানি, তুই মেনে নিতে পারছিস না। অরণ্য থেকে উপড়ে আনা গাছ শহরের কংক্রিটে বসানো চরম ভুল। সে গাছ শেকড় ছড়াতে পারে না। তারপর সবুজ পাতা চিরদিনের মতো ঝরে গিয়ে কাঠে পরিণত হয়। তোর ক্ষেত্রে তেমনই হবে। আমি তোর সমব্যথী, কঙ্কা।… তবে প্রথম থেকেই এত নেগেটিভ ভাবনা থেকে বেরিয়ে আয়। আগে কলেজটায় জয়েন কর। পরিবেশটাকে বুঝে নে।…ওখানে থাকবি কি থাকবি না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার।…’
মেয়ের কান্না দেখে মা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি। অশ্রুসিক্ত স্বরে বলেছিল, ‘তুই চলে গেলে বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যাবে। তোর জীবনে যেন চাকরি পাওয়া একটা অভিশাপ। শনিবার যদি অত দূর থেকে বাড়ি আসতে পারিস, তাহলে তোকে কাছে পাব। কোথায় থাকবি, কীভাবে খাওয়া-দাওয়া করবি…আমার সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে!’
বাবা গম্ভীর গলায় মাকে বলেছিল, ‘বোকার মতো কথা বলছ কেন? দূরে থাকবে ঠিকই, কিন্তু প্রত্যেক দিন ভিডিও কলে, কঙ্কার সঙ্গে আমরা কথা বলতে পারব। ’
দূরত্বের বিষয়টাকে ঊর্মিলা গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি। হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘জানিস, মানুষ আসানসোল, বর্ধমান, কৃষ্ণনগর থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে। তোকে অন্তত সেটা করতে হবে না। চাকরিটায় আগে ঢুকে পড়। বদলি নেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই আছে। তখন দেখা যাবে।’
গলা চড়িয়ে কঙ্কণা বলেছিল, ‘ঈশানপুরের কলেজটা গভর্নমেন্ট কলেজ নয়। ট্রান্সফারেবল জব বলে তোমরা আমাকে পাবলিক সারভিস কমিশনে অ্যাপ্লাই করতেই দাওনি। এখন বোঝ। সরকারি কলেজে অধ্যাপনা পেলে, আমি তো আর সারা জীবন দার্জিলিঙ গভর্নমেন্ট কলেজে পড়াতাম না। নানা জোনে বদলি হতে হতে, একদিন হয়তো প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপিকা হয়ে চলে আসতাম। কিন্তু এখন আমার জীবন থেমে গেল এক গ্রামীণ কলেজের ঘেরাটোপে। ওখান থেকে আর আমার মুক্তি নেই।’
যাকে কঙ্কণা ভালবাসে, যার সঙ্গে ও ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে রেখেছে, সেই স্মার্ট এবং বিনয়ী তরুণটিও এই দোলাচলে নতুন কোনও পথের সন্ধান দিতে পারেনি। বরং বাবার মতো অগ্নিমিত্র বলেছিল, ‘তোমাকে চাকরি করতেই হবে, এমন আবদার আমি করছি না, করবও না। ব্যাঙ্ককর্মীর চেয়ারে বসে, আমি যা মাইনে পাই, তাতে আমাদের মধ্যবিত্ত জীবন কোথাও থেমে থাকবে না, চলে যাবে। কিন্তু এই ক্রাইসিসের যুগে, হাতের মুঠোয় অধ্যাপকের চাকরি পেয়েও ছেড়ে দেওয়া চরম হঠকরিতা। সবচেয়ে আনন্দের বিষয়, তুমি যে-সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছ, সেই কোর এরিয়ায় তোমার এমপ্লয়মেন্টে সরকার সিলমোহর দিয়েছে।’
ফোঁস করে উঠেছিল কঙ্কণা, ‘তুমি কায়দা করে ঘুরিয়ে সেই নিজের কথা বলছ। কেন বলতো?’
‘বাঃ, বলব না!’ অগ্নিমিত্র দুঃখ লুকিয়ে সামান্য রুক্ষস্বরে উত্তর দিয়েছিল, ‘জিওগ্রাফি নিয়ে পড়ে, কেউ যদি ব্যাঙ্কে কেরানিগিরি করে, তা কি খুব সুখসংবাদ! হ্যাঁ, চাকরির সুযোগকে উপেক্ষা করার মতো বুকের পাটা বা কোনও উচ্চস্তরের সঙ্গে, আমার মতো মধ্যবিত্ত ছেলের সংযোগ ছিল না। এসব কথা তোমার অজানা নয়।’
‘আমি কী করব অগ্নি, তুমি আমাকে বলে দাও।’ আত্মসমর্পিতার মতো কঙ্কণা বলেছিল।
ওকে আলতো আদর করে অগ্নিমিত্র আশ্বাস দিয়েছিল, ‘ধরে নাও, তুমি যুদ্ধে যাচ্ছ।…ধরে নাও, ব্যাটল ফিল্ডটা দেখে নেওয়ার পর ফিজিক্যালি জয়েন করবে বা নিজের সুবিধে মতো সিদ্ধান্ত নেবে।…সবচেয়ে বড় ব্যাপার, ব্যাটল ফিল্ডটা দেখে নেওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছ।…আমি আশা করব, যুদ্ধক্ষেত্র দেখে তোমার মনে হবে, লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারবে।… আর না-পারলে নির্দ্বিধায় বলে আসবে—বাই বাই।’
বোম্বে রোড নামে বেশি পরিচিত, ন্যাশনাল হাইওয়ে সিক্স থেকে মেছেদা-দীঘা রুটে গাড়ি ঘুরিয়ে বিক্রমদা থেমে গেল। এই রাস্তা দিয়ে কয়েক বছর আগে একদল বন্ধুর সঙ্গে দীঘায় বেড়াতে গেছিল কঙ্কণা। যাতায়াত মিলিয়ে সেই পাঁচ দিনের ট্যুর ওর অনুপুঙ্খ মনে আছে। অভিভাবকদের প্রাচীর ভেঙে নিজেদের মতো এখানে-ওখানে ঘুরতে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। একইভাবে শান্তিনিকেতন ও ডুয়ার্সে বন্ধুরা মিলে বেড়িয়ে এসেছে। গাড়ির জানলা দিয়ে দেখে কঙ্কণার মনে হল, মেছেদা হল্টের দু’পাশে আরও অনেক ধাবা ও রেস্তোরাঁ তৈরি হয়েছে। ‘আমাদের দোকানে আসুন’, ‘এই ধাবায় সব পাবেন,’ ‘এখানে বাড়ির মতো আপ্যায়ন’—এমনভাবে চিৎকার করে খদ্দের ধরার চেষ্টা করছেন কিছু লোক। সব মিলিয়ে রাস্তার এপাশ-ওপাশ জমজমাট।
গাড়ি থেকে প্রায় লাফিয়ে নেমে সুজিতকাকু বলল, ‘বিক্রম আমার মনের কথা বুঝে ফেলেছে দেখছি। পেট চুঁইচুঁই করছে। আমরা সবাই জানি, ব্রেকফাস্ট করার এটাই আদর্শ জায়গা। অনেক ধরনের খাবার পাওয়া যায়। এখানেই জলখাবার খেয়ে নেওয়া ভাল।… হারি আপ, হারি আপ। নেমে পড়, নেমে পড়।’
কঙ্কণার অন্তরে চেপে বসে থাকা কষ্ট ও বাইরের মলিন আবরণ, দীপায়ন ও সুজিতকাকুর হইচই আর আনন্দ-আহ্বানে, সাময়িকভাবে হলেও ভেঙে গেল। ওর মুখে হাসির আলোকরেখা দেখে ঊর্মিলা ভারী খুশি হয়ে বলল, ‘তোর হাসিমুখ না দেখতে পেলে আমার মনখারাপ হয়ে যায়।…কঙ্কা, এটা তো মানবি, মানুষ যেখানে মৃত্যুশোক মেনে নিতে পারে, সেখানে জায়গার দূরত্ব তো কোন ছার!’
চোখ নামিয়ে কঙ্কণা বলল, ‘জানি, পিসিমণি।’
‘তাহলে ফালতু কষ্ট বয়ে বেড়াবি কেন? বি হ্যাপি, বি স্ট্রং অ্যান্ড রিলাই ইওরসেলফ্।’ পিসিমণি ওর ঠোঁটে পরম মমতায় চুমু খেল।
গাড়িতে পুনরায় ওঠার আগে বিক্রমদা বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘দাদা, আমরা কি চণ্ডীপুর দিয়ে ঢুকে রেওয়াপাড়া হয়ে, টেঙ্গুয়া বাসস্ট্যান্ডের পাশ কাটিয়ে নন্দীগ্রামে যাব?’
দীপায়ন কিছু বলার আগেই সুজিতকাকু নিশ্চিত গলায় বিক্রমদাকে পরামর্শ দিল, ‘তা কেন করবে? এত ঘুরবে কেন বাপু? চণ্ডীপুর থেকে কয়েক মাইল এগোলেই দীঘা যাওয়ার এই রাস্তাটার ধারে জমজমাট হেঁড়িয়া গ্রাম ও বাজারের চৌমাথা।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে। আমি মানিকতলা বাজারের এক মাছওয়ালা নাড়ুগোপালকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। নাড়ু মেদিনীপুরের লোক। ও ব্যাটা বলেছিল, হেঁড়িয়ার ডানদিকের রাস্তায় ঢুকে সোজা মুগবেড়িয়া গ্রাম। গ্রামের প্রান্ত দিয়ে বাঁ দিকে আর একটা পাকা রাস্তা, সিধে নন্দীগ্রামে চলে গেছে। ঈশানপুর গ্রাম বেশ বড়সড় এবং শিক্ষা-দীক্ষায় নাকি এগিয়ে। কিন্তু নন্দীগ্রাম থানার আন্ডারে। চাষিদের বিপ্লবের জন্যে সবাইকে পেছনে ফেলে এঁদো নন্দীগ্রাম বিখ্যাত হয়ে গেছে।’
‘আরি ব্বাস, বিক্রম দেখছি হিস্ট্রি-জিওগ্রাফি সব জানে ‘সুজিতকাকু উচ্ছ্বসিত, ‘তাহলে হেঁড়িয়া থেকে রাইট সাইডের বাইফারকেশন রোড ধরে নেবে। দিস ইজ ফাইনাল। তাই তো রে, দীপায়ন?’
বাবা কেবল সম্মতিসূচক মাথা নেড়েছিল। বাকি রাস্তায় আর তেমন গল্প-গুজব, হাসি-ঠাট্টা হল না। তার বদলে এই মুহূর্তের বঙ্গ রাজনীতি, বাঙালির অবস্থা ও অবস্থান, তরুণ-তরুণীদের ভবিষ্যত, চতুর্দিকে বিশৃঙ্খলা ও কোটি কোটি টাকা চুরি, মামলা ইত্যাদি নিয়ে টুকরো-টাকরা আলোচনা জায়গা করে নিয়েছে। বিক্রমদা হাট বা বাজারের মতো জায়গায় দু’তিনবার গাড়ি থামিয়ে, গন্তব্যে ঠিকমতো যাচ্ছে কিনা যাচাই করে নিল। গ্রামের মানুষ আগ্রহের সঙ্গে পথ বলে দিয়েছেন।
পিচ ঢালাই রাস্তার বাঁ পাশে সবুজ ধানক্ষেত আর পদ্মফুলে ভর্তি একটা বড় পুকুর। ভেসে থাকা পদ্মপাতার রং গাঢ় সবুজ। ঠিক এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝখান দিয়ে সোজা সিমেন্ট বাঁধানো প্রায় পনেরো ফুট চওড়া রাস্তা। রাস্তা যেখানে শেষ, সেখানে থামে লাগানো লোহার গেট। ওরা গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। এই সেই দূরান্তের কলেজ। থাম দু’টোর ওপরে লিনটাসের গায়ে ঝুলছে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা সাইন বোর্ড: দেবী বীণাপাণি কো-এডুকেশন কলেজ। গ্রাম ও ডাক: ঈশানপুর। থানা: নন্দীগ্রাম। জেলা: পূর্ব মেদিনীপুর। দীপায়ন এদিক-ওদিক তাকিয়ে জরিপ করল, দোতলা কলেজ বিল্ডিংটা বেশ লম্বা, বারান্দাসহ তেমনই চওড়া। ইংরেজি E শেপে তৈরি। বাড়িটার রং সামান্য মলিন।
‘কলেজটা দেখতে খারাপ নয়। এর অন্দরমহলও নিশ্চয়ই ভাল হবে।’ ঊর্মিলা শাড়ি ঠিক করতে করতে বলল।
সুজিত সোজা মেন গেটের কাছে গিয়ে উঁকি-ঝুঁকি মারছে। কাউকে দেখতে না পেয়ে, ফিরে এসে বলল, ‘আজ কি কলেজ বন্ধ? গেটে তালা লাগানো… চারদিক নীরব, ছাত্র-ছাত্রী বা স্টাফদের দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু বাঁদিকের কয়েকটা ঘরের দরজা খোলা। কী হল রে, দীপু?’
দীপায়ন খুব অসহায় বোধ করছে। এত দূর উজিয়ে, পড়ন্ত দুপুরে এসে যদি কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা না-বলে যদি ফিরে যেতে হয়, তবে সেটা হবে খুব দুর্ভাগ্যজনক। কঙ্কার কষ্টকে অনুভব করতে পেরেও, ওরা সবাই প্রায় উড়িয়ে দিয়েছে। এই অবারিত প্রকৃতির মধ্যে কি একাকিত্বের ইঙ্গিত নেই? অবশ্য়ই আছে। নানা রঙের শহুরে জীবনে থাকতে অভ্যস্ত তরুণ-তরুণীর কাছে, এই নিঃস্তব্ধ গ্রাম একসময়ে একঘেয়ে হয়ে উঠবে। বাবাকে একটু তফাতে একাকী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, কঙ্কণা ধীর পায়ে দীপায়নের কাছে এসে বলল, ‘বাবা, তোমরা আসবে জানার পর, আমি আর অগ্নি কলেজের ল্যান্ড লাইনে কয়েকবার কল করেছি। কিন্তু কেউ ফোন তোলেনি।’
‘ল্যান্ড লাইন!’ দীপায়ন অবাক।
‘হ্যাঁ, সি এস সি-র চিঠিতে দুটো ল্যান্ড লাইন নম্বর লেখা ছিল। কোনও মোবাইল নম্বর ছিল না। তুমি হয়তো খেয়াল করনি। চিটিটা নিয়ে এসেছি। দেখবে? গাড়িতে আমার ফাইলে রাখা আছে।’
‘এই হচ্ছে সরকারি কাজ। না, আনতে হবে না মা। ওই তো সুজিত আবার যাচ্ছে। কিছু একটা উপায় ও বের করবেই।’
সুজিত গেটের কাছাকাছি যেতেই একজন মাঝবয়সি সুশ্রী, প্রায় ঊর্মিলার মতো লম্বা মহিলা, নমস্কার জানাতে জানাতে গেটের কাছে এসে, মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কি কলকাতা থেকে আসছেন? কঙ্কণা মিত্রর বাড়ির লোক?’
ওরা খানিকটা হতচকিত হয়ে প্রতিনমস্কার জানাল। সুজিত সবিস্ময়ে বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। কঙ্কণাও আমাদের সঙ্গে এসেছে। ওই যে…’
ভদ্রমহিলা তেমনই স্মিত হেসে বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি।’ তারপর নিজের হাতে তালা ও দরজা খুলে অনুরোধ জানালেন, ‘ভেতরে আসুন। বসবেন চলুন। গাড়িটা কংক্রিটের রাস্তায় রেখে দিতে পারেন।’
দীপায়ন আর চুপ থাকতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার পরিচয় জানতে পারলে ভাল লাগত।’
রুপোর সরু তারের মতো কয়েকটা পাকা চুল, স্বল্প সিঁদুরে রাঙানো ওঁর সিঁথির দু‘পাশে। এবার হাসি মুছে ফেলে নম্র স্বরে তিনি বললেন, ‘আমি এই কলেজের প্রিন্সিপাল সায়ন্তনী মণ্ডল। আপনাদের পরিচয় জানতে পারলে আমারও ভাল লাগবে।’
বাবা সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। স্মিত মুখে সবাইকে অভ্যর্থনা জানিয়ে শ্রীমতী মন্ডল বললেন, ‘আজ কলেজের প্রতিষ্ঠা দিবস। সকালে ছাত্র-ছাত্রী ও টিচাররা যৌথভাবে সাংস্কৃতিক উৎসব-অনুষ্ঠান করেছে। প্রতিবছরই উৎসবের পর কলেজে ছুটি দেওয়া হয়। তাই কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না।…আসুন, মিটিং রুমে বসে আপনারা ফ্রেশ হয়ে নিন। অ্যাটাচ্ড বাথরুম আছে।…কোনও অসুবিধে হবে না। তারপর সামান্য খাবার দেব। আপনাদের খাওয়া হয়ে গেলে কথা বলব।’
ঊর্মিলা অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘আশ্চর্য, খাওয়ার ব্যবস্থাও করে রেখেছেন! আপনি কি জানতেন আমরা আসব?’
‘না।’ অধ্যক্ষা মাথা নাড়লেন, ‘ছেলে-মেয়ে ও অধ্যাপক-অধ্যাপিকা-কর্মীরা নেওয়ার পর কিছু ফুড প্যাকেট বেশি হয়েছে। তার থেকেই…প্লিজ, আপত্তি করবেন না। কলকাতা থেকে সেই কোন সকালে বেরিয়েছেন… ‘সায়ন্তনী মণ্ডলের কথায় যেন আদেশের সুর ঝরে পড়ল, ‘ভাবী অধ্য়াপিকাকে আমি এই কাজের দায়িত্ব দিলাম। আমি একটু পরেই আসছি।’
ওদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রিন্সিপাল মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। বিরাট ঘরটার আবহাওয়া হালকা করার জন্যে সুজিত কৃত্রিম গাম্ভীর্যে বলল, ‘ভদ্রমহিলা সিওর বিয়ে করেননি। মায়া-মমতার কোনও প্রকাশ নেই গা! কী কড়া শাসন! আমরা যেন ওর পড়ুয়ার দল।’
সবাই হাসল, যদিও নিঃশব্দে। তারপর প্রকৃতির ডাকে যতটা সম্ভব পরিচ্ছন্ন হয়ে নিল। মিটিং রুমের লম্বা টেবিলের দু‘ধারে চেয়ার পাতা। এপাশে-ওপাশে কয়েকটি কাঠের আলমারি। সিলিং থেকে দেড় ফুট নিচে বিভিন্ন মহামানব-মনীষীদের ছবি। সব ছবি একই সাইজের। দু’জন সম্ভবত ফোর্থ ক্লাস মহিলা স্টাফ তিন প্লেট ভেজিটেবল চপ, ক্রিম রোল, কড়া পাকের সন্দেশ ও জল ভর্তি গ্লাস টেবিলে রেখে গেল। যাওয়ার আগে অল্পবয়সি স্টাফটি বলে গেল, ‘চপগুলো মাইক্রো আভেনে গরম করে দিয়েছি। খেয়ে নিন।’
হতবাক হয়ে ঊর্মিলা ভাইঝিকে বলল, ‘দেখেছিস কঙ্কা, কলকাতার জীবন এই অজ পাড়াগাঁ অবধি পৌঁছে গেছে। মাইক্রো আভেন পর্যন্ত! তাহলে আর কিছু বাকি নেই।’
কঙ্কণা সত্যিই এই গ্রামীণ জীবনের প্রেক্ষাপটে এতটা অগ্রগতি ও ভাবতে পারেনি। সাংঘাতিক খিদে পেয়েছে তা নয়। তবু অধ্যক্ষা ও কঙ্কার সম্মানের কথা মাথায় রেখে, ওরা কোনও অজুহাত না দেখিয়ে খাবার মুখে তুলল। বিক্রমকে গাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে এল দীপায়ন। ওরা কেউ কোনও কথা বলছে না। কারণ, শ্রীমতী মন্ডল যে-কোনও সময়ে চলে আসবেন। তবু সুজিতকাকু নিচু স্বরে বলল, ‘চপটা হেভি টেস্টি।…ভেবেছিলাম পাণ্ডববর্জিত জায়গা। আদতে তা নয়।’
ওরা যা ভেবেছিল, ঠিক তাই হল। মিসেস মন্ডল ওদের খাওয়া-দাওয়ার মাঝপথে, একটা ফাইল হাতে ঘরে ঢুকেই বললেন, ‘আপনাদের আর সময় নষ্ট করব না। আপনারা খেতে খেতে কাজের কথাগুলো একটু শুনে নিন। প্রায় একমাস আগে আমি সি.এস.সি থেকে দুটো সাবজেক্টে, ইংলিশ অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সে দু‘জন সহকারি অধ্যাপক নিয়োগের সুপারিশ পত্র পাই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক রেকমেন্ডেশনের দশ-বারো দিনের মধ্যে জয়েন করেছেন।…আমাদের চিন্তা হচ্ছিল মিস কঙ্কণা মিত্রকে নিয়ে। উনি রেকমেন্ডেশন লেটার আদৌ পেয়েছেন কিনা, কিংবা পেয়ে থাকলে কেন যোগাযোগ করছেন না—এসব নিয়ে আমরা ভাবছিলাম।… তবে আপনাদের দেখেই মনে হয়েছিল, মিস কঙ্কণা মিত্র হাজির।’ সবাই হাসল।
কঙ্কণা বলল, ‘ম্যাডাম, আমি সি.এস.সি-র চিঠি পেয়েছি। কিন্তু কিছুতেই কনটাক্ট করতে পারছিলাম না। কেননা চিঠিতে কলেজের নাম-ঠিকানা স্পষ্ট থাকলেও, ল্যান্ড লাইনের নাম্বার দেওয়া হয়েছে। আমি ও অন্যরা অনেকবার চেষ্টা করেও কল জেনারেট করতে পারিনি।’
ফিকে হাসলেন সায়ন্তনী, ‘এদিকে কলেজ সার্ভিস কমিশন আপনার যে-মোবাইল নাম্বার দিয়েছে, সেটা আবার ভুল। একজন অবাঙালির কাছে কল চলে যাচ্ছিল।…এই গ্রামের পোস্ট অফিসে স্পিড পোস্টের সুবিধে নেই। কোনও ক্যুরিয়র সার্ভিস ফোন নাম্বার ছাড়া চিঠি নিতে রাজি নয়। খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছিলাম। আপনি এবং আপনারা এসে সমস্যার সমাধান করে দিলেন।…কিন্তু এতদিন পরে এলেন কেন?’
কঙ্কণা উত্তর দেওয়ার বদলে মাথা নিচু করতেই দীপায়ন বলল, ‘…আসলে কলকাতায় মেয়ের জন্ম, বেড়ে ওঠা…এত দূরে, এই গ্রাম্য পরিবেশে থাকতে পারবে কিনা…এসব নিয়ে আমরা ভাবছিলাম।’
‘এই কলেজের সত্তর ভাগ প্রফেসরই দূরান্ত থেকে এসেছেন। আমারই বাড়ি চন্দননগরে। এই গ্রামেরই একটা বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকি।…মিস মিত্র যদি জয়েন করেন, তাহলে ওঁকে মুগবেড়িয়ায় থাকতে বলব। কলেজের কয়েকজন শিক্ষিকা একটা পাকা বাড়ি ভাড়া নিয়ে মেস তৈরি করেছেন। এখনও দুজনের মতো থাকার জায়গা খালি আছে।‘
কথা বলতে বলতে ফাইল খুলে, সায়ন্তনী একটা এ-ফোর সাইজের লেটার হেড বের করে, কঙ্কণার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই নিন আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। কলেজ কমিটির প্রেসিডেন্টকে দিয়ে আগেই স্বাক্ষর করিয়ে রেখেছি। আজ কলেজের পুণ্যদিনে আমি সই করব ও জয়েনিং ডেট হিসেবে আজকের তারিখই লিখব। আপনার কোনও আপত্তি বা দ্বিধা নেই তো ?… আপনার মতো ভাল রেজাল্ট যাঁরা করেছেন, তাঁদের হয়তো সরকার পরিকল্পনা করে রিমোট এরিয়ায় পাঠাচ্ছে। যেখানে শিক্ষার মোমবাতি জ্বলেছে, কিন্তু এখনও মশাল জ্বলেনি। আপনারা সেই মহান কাজটি করবেন।’
মনের মধ্যে দোলাচল এখনও পুরোপুরি থামেনি। বেদনায় কঙ্কণার হৃদয় ভারাক্রান্ত। অধ্যক্ষার দেওয়া চিঠির দিকে তাকিয়ে অশ্রুতে ভরে উঠছে চোখ। অথচ কয়েক জোড়া অপলক চক্ষু ওকে দেখছে। কঙ্কণা মাথা তুলে শক্ত গলায় জানাল, ‘না, কোনও আপত্তি নেই। আমি রাজি।’
‘ভেরি গুড। আপনি আমাকে অ্যাকসেপটেন্স লেটার লিখে দিয়ে, তিন-চার দিনের জন্যে বাড়ি চলে যান। নিজের পোশাক, জিনিসপত্র, বইখাতা ইত্য়াদি নিয়ে আরও সকালের দিকে চলে আসবেন। আমি মুগবেড়িয়া মেসে আপনার কথা বলে রাখব।…কোথাও কোনও অসুবিধে হবে না। যদি হয়, আমি তো আছি। যেদিন থেকে ক্লাস নিতে শুরু করবেন, সেদিনই আপনার সঙ্গে প্রায় সবার আলাপ হয়ে যাবে।…হাতে সময় থাকলে আপনারা গ্রামটা ঘুরে দেখতে পারেন, মন্দ নয়। শান্ত ও শান্তির অপূর্ব সহাবস্থান।…ঠিক আছে, আবার দেখা হবে। আলাপ হয়ে খুব ভাল লাগল। আমি আসছি, একটা জরুরি কাজ সারতে হবে। নমস্কার…’
কঙ্কণা ছাড়া সবাই ঈশানপুর দেখতে বেরোল। বিক্রমদা গাড়ির একটা দরজা খুলে দিয়েছে, যাতে ও বসতে পারে। ব্যাগ থেকে কাগজ-কলম বের করে সম্মতিপত্রটি লিখল। তারপর মোবাইলে তিনবারের চেষ্টায়, অগ্নিকে ধরতে পেরে কঙ্কণা সিক্তস্বরে বলল, ‘আমার যা কিছু স্বপ্ন, তার ইতি টেনে দিয়ে দূরত্ব জিতে গেল।’
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন