কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে অমিতেশ বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই ঝুপ করে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজ থেকে গাঙ্গুলীদের বাড়িটা ভাঙা শুরু হলো। বড়ো বড়ো বুলডোজার মত্ত ষাঁড়ের মত গিয়ে ধাক্কা মারছে গাঙ্গুলীদের বাড়িটায়। দুটো জেসিবি কাঁকড়ার দাঁড়ের মত হাত নিয়ে অপেক্ষা করছে খুবলিয়ে খুবলিয়ে বাড়িটাকে শেষ করতে।
এই পাড়ায় শেষ দুটোই বাড়ি ছিল। অমিতেশদের আর গাঙ্গুলীদের। স্কাইলাইন রিয়্যাল স্টেটের যখন চোখ পড়ল এখানে, এই পাড়ায় অনেকেই বাড়ি বিক্রি করার বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু স্কাইলাইন রিয়্যাল স্টেটের মালিকপক্ষ আগরওয়ালরা জানে মধ্যবিত্ত বাঙালিকে কীভাবে ভাঙতে হয়। একদিকে পাড়ায় সকলে মিলে যখন প্রতিরোধ করার মিটিং করতেন, অন্যদিকে আগরওয়ালরা তখন নিত্যনতুন ‘অফার’ নিয়ে আসত। বিরাট হাউসিং প্রজেক্ট হবে। তার ‘আর্লি বার্ড’ অফার। জমির দামের সঙ্গে ‘ইন্টেরিয়র’ করে দেওয়া থেকে ‘বেস্ট লোকেশনের’ ফ্ল্যাট। কন্সট্রাকশনের সময় কাছাকাছি বিনা-পয়সায় থাকার অফার। প্রজেক্ট শেষ হয়ে গেলে কমিউনিটি ক্লাবের আজীবন সদস্যপদ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। এই সুযোগ বলা হয়েছিল দেওয়া হবে শুধু তাঁদের, প্রথম পাঁচজন যে পরিবার একমাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
কয়েক সপ্তাহ প্রতিরোধ করার পর প্রথম ভাঙল পালচৌধুরীরা। তারপর একে একে দাসগুপ্ত, ব্যানার্জ্জী, মিত্ররা। একমাসের মাথায় আগরওয়ালরা ঠিক ‘আর্লি বার্ড’ অফার বন্ধ করে দিয়েছিল আর শুরু হয়ে গিয়েছিল হা, হুতাশ। তলে তলে একান্ত গোপনীয় সুযোগ সুবিধা দিয়ে আগরওয়ালরা একটা একটা করে বাড়ি নিতে নিতে গোটা পাড়াটাকে গ্রাস করতে শুরু করেছিল। কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তারমধ্যে দুটো দ্বীপের মত এতদিন বেঁচে ছিল গাঙ্গুলী আর অমিতেশদের বাড়ি। আজ থেকে সেই দ্বীপ একটা হলো।
বারান্দায় যাওয়ার দরজাটা বন্ধই থাকে। এখন পুরোদমে কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে। আওয়াজতো আছেই, সেই সঙ্গে ধুলো। শ্রীতমার ধুলোতে অ্যালার্জি আছে। এই দিকের দরজা জানলা সব বন্ধ করে রাখেন। গাঙ্গুলীবাড়িটা যে আজ থেকে ভাঙা শুরু হবে সুপ্রিয় গাঙ্গুলী কথাটা গোপনই রেখেছিলেন। কয়েকদিন আগে অস্থায়ী ঠিকানায় মালপত্তর নিয়ে চলে যাওয়ার আগে নেহাত প্রতিবেশীর ভদ্রতার খাতিরে অমিতেশকে বলেছিলেন, “অনেক আলোচনা করে দেখলাম ভাই অমিতেশ। আমাদের বাড়িটার যা বয়স হয়েছে তাতে রিটায়ার করার পর মেন্টেনেন্স আর টানতে পারব না। চুন সুরকির ছাদ, দু’বছর অন্তর যা টাকা ঢালতে হচ্ছে…”
অমিতেশের মনে হয়েছিল কথাগুলো যেন সুপ্রিয় গাঙ্গুলী বলছেন না, আগরওয়ালদের কোনও কর্মচারী বলছে। এইসব অসুবিধার কথা তো ওরাই পেরেক পোঁতার মত মাথায় পুঁতে দিয়েছে। তবুও কিছুদিন আগে পর্যন্ত সুপ্রিয় অমিতেশের সঙ্গে এককাট্টা ছিলেন। সুপ্রিয়র শেষ কথাগুলো শুধু মনে আছে, “… তাই, তুমিও ভেবে দ্যাখো অমিতেশ কী করবে। শেষ বাড়িটাতো তোমারই রইল। আগরওয়াল ভালো অফার দেবে ঠিক মতন নিগোশিয়েট করতে পারলে।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অমিতেশ বলেছিলেন, “লাস্ট বার্ড।”
মুখে মাস্ক পরা। তার ওপর আঁচলের খুঁট নাকে চেপে শ্রীতমা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে দেখলেন অমিতেশ চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে রেলিং-এ কুঁনুইয়ের ভর দিয়ে উদাস চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। অমিতেশের দৃষ্টি অনুসরণ করে শ্রীতমা দেখলেন অমিতেশ উদাস দৃষ্টিতে গাঙ্গুলীদের বাড়ি ভাঙা দেখছেন। শ্রীতমা আক্ষেপের গলায় বলতে থাকলেন, “থাকো, তোমার তাজমহল নিয়ে থাকো। কিছুদিন পর যখন দেখবে সবাই ফিরে এসে দারুণ দারুণ একেকটা ফ্ল্যাটে উঠছে, তখন তোমার তাজমহল ধুয়ে জল খেয়ো।”
অমিতেশ জানে আগরওয়ালরা যখন বুঝে ফেলেছে অমিতেশকে দিয়ে সুবিধা হবে না তখন গোপনে শ্রীতমাকেও বোঝাতে শুরু করেছে। সামান্য সাড়ে তিন কাঠা জমির ওপর দু’কাঠার বাড়িটা বাবা অনেক কষ্টে করেছিলেন। প্রথমে একতলা। অমিতেশের জন্মের আগে। তারপর অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে দো’তলা। দো‘তলার ছাদ ঢালাই যখন হয়েছিল অমিতেশ তখন ক্লাস সিক্সে। কিন্তু ছাদ ঢালাইয়ের দিনটার উত্তেজনা এখনও স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে স্পষ্ট। একদিকে মিস্ত্রিরা সুর কেটে কেটে ছাদ পেটাই করছে। আরেকদিকে মিস্ত্রিদের জন্য মাংস রান্না করছে রাসুদা। সেই মাংস ভাত অবশ্য অমিতেশও খেয়েছিল। কী অপূর্ব স্বাদ। কত স্মৃতি। আর শুধুই কি বাড়ি তৈরির স্মৃতি। কত বয়সের কত স্মৃতি মেখে বসে রয়েছে বাড়িটা।
যে স্মৃতি, যে আবেগ অমিতেশের এই বাড়িটার জন্য আছে, শ্রীতমার তা নেই। থাকার কথাও না। শ্রীতমা এই বাড়িতে এসেছেন বউ হয়ে। তবুও আঠাশ বছর হয়ে গেল। কিন্তু আলাদা করে কোনরকম টান জন্মায়নি। শ্রীতমার মতই ছেলে ঋভুও। আজকালকার ছেলে। ইঞ্জিনিয়ারিং আর এমবিএ করে বিদেশে চলে গেছে। স্পষ্ট করে বলেই গেছে কোনদিন আর কলকাতায় ফিরবে না। এই বাড়িটা কেন, এই শহরটার জন্য কোনও টান, অনুভূতি, মনকেমন নেই ঋভুর।
“ইস, কী ধুলো উড়ছে। চায়ের ওপর ধুলো ফেলে খাচ্ছ কেন?” শ্রীতমা বিরক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
সম্বিত ফিরে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অমিতেশ বুঝলেন চা‘টা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এক ঢোঁকে চা’টা শেষ করে শ্রীতমাকে খালি কাপটা ফেরত দিলেন। শ্রীতমা আর দাঁড়ালেন না। ভেতরে যেতে যেতে বলে গেলেন, “ধুলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকো না। ভেতরে এসে দরজাটা বন্ধ করে দাও।”
অমিতেশ ভেতরেই চলে আসছিলেন। হঠাৎ একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল। যেটা এককালে পাড়া ছিল সেটা এখন কনস্ট্রাকশন সাইট। বারান্দায় দাঁড়ালে যেখানে প্রতিটি চেনা মানুষকে দেখতেন এখন সেখানে অসংখ্য কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার। মাথায় হলুদ হেলমেট, গায়ে কমলা রঙের ফ্লোরেসেন্ট জ্যাকেট, পায়ে গামবুট। এইসব অচেনা মানুষদের মধ্যেই আরেকজন অন্যরকম অচেনা মানুষ। একটা মেয়ে। কাদা জলের সাইটের মধ্যে একদিকে ফাঁক খুঁজে নিয়েছে মেয়েটা। সামনে একটা ইজেল। ছবি আঁকছে।
অমিতেশ একটু আশ্চর্যই হলেন। মেয়েটা কখন এলো? হয়ত অনেকক্ষণ। অমিতেশ বারান্দায় আসা ইস্তক গাঙ্গুলীদের বাড়ি ভাঙাটা এত ভগ্ন মন নিয়ে দেখছিলেন যে অন্যদিকে তাকাননি। তবে অমিতেশকে আরও যেটা আশ্চর্য করল, মেয়েটা যেন এই বাড়িটার ছবিটাই আঁকছে। বারবার এই বাড়িটার দিকে তাকাচ্ছে আর ইজেলে আঁচড় টানছে। অমিতেশ বারান্দায় দাঁড়িয়েই চোখটা একটু কুঁচকে দূরে মেয়েটাকে একটু ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করলেন। আর বুকের মধ্যে একটা দোলা খেলেন।
অমিতেশ ঘরের মধ্যে ঢুকে বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে পোশাক বদলে পাজামা পাঞ্জাবি পরলেন। তারপর চটি গলিয়ে সদর দরজাটা খুলতেই শ্রীতমার চোখে পড়ে গেলেন।
“উফ! এখন আবার কোথায় যাচ্ছ? আবার সাদা পাজামাটা কাদা মাখামাখি করে আসবে। আমি তো আর কেচে কেচে পেরে উঠছি না।”
অমিতেশ যেন শুনতেই পেলেন না। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলেন। এখন আর রাস্তা নেই। আগরওয়ালরা চায় অমিতেশের যতটা অসুবিধা করা যায়। কাউন্সিলরকে বলে লাভ নেই। সবাইকে ওরা পকেটে পুরে রেখেছে। অমিতেশের বাড়ি থেকে বড়ো রাস্তা পর্যন্ত যাওয়ার জন্য কাদামাখা সাইটে কিছু লোক দেখানো ইঁট বিছিয়ে রেখেছে। ইঁটের ওপর সাবধানে পা ফেলে ফেলে মেয়েটার দিকে এগোতে থাকলেন। আর যত এগোতে থাকলেন বুকের মধ্যে বহু পুরনো একটা ধুকপুকানি বাড়তে থাকল।
মেয়েটার কাছে এসে দাঁড়াতেই অমিতেশের আর কোনও সন্দেহই রইল না। সেই চোখ। এক বহু পুরনো স্মৃতি যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
“হাই আঙ্কেল।” মেয়েটা মুখ তুলে অমিতেশকে দেখে এক গাল হেসে বলল, “অ্যায়াম লিলিয়ান।”
অমিতেশ একেবারে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। কিছু বলতে গিয়েও মুখে যেন কথা জোগাল না।
লিলিয়ান নিজের থেকেই ইংরেজিতে বলতে থাকল, “আপনি ওই বাড়িটায় থাকেন তো? বারান্দায় আপনাকে দেখলাম। আপনার বাড়ির ছবিই আঁকছি। স্যরি আঙ্কেল আপনার পারমিশন নেওয়া উচিত ছিল। আসলে কী বলুন তো, আমি কনস্ট্রাকশন ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলেই এখানে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকছি। ওদের জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনার পারমিশন নিতে হবে কিনা। ওরা বলল, কথা বলার দরকার নেই। আপনি ভীষণ বদরাগি। কিন্তু আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি, আপনি মোটেই সেরকম মানুষ নন।”
লিলিয়ান গালে টোল ফেলে হাসল। অমিতেশ আবার আশ্চর্য হলেন। এখনও পর্যন্ত একটাও কথা বলেননি মেয়েটার সঙ্গে। তাহলে মেয়েটা বুঝল কীভাবে, অমিতেশ বদরাগি না শান্ত প্রকৃতির মানুষ। তাহলে কি এখানে প্রতিটা অচেনা লোককে দেখলে মুখের পেশিগুলো যেভাবে শক্ত হয়ে ওঠে, সেগুলো এখন খুবই কোমল?
“আঙ্কেল দেখুন ছবিটা কেমন হচ্ছে?”
অমিতেশ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন লিলিয়ানের মুখোমুখি, ইজেলের পেছন দিকে। একটা ঔৎসুক্য নিয়ে লিলিয়ানের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন, লিলিয়ান বাড়িটার প্রায় সবটাই এঁকে ফেলেছে। পেন্সিল স্কেচ। একেবারে নিখুঁত। তবে ক্যানভাসের মধ্যে বাড়িটা ছাড়া বাকি ক্যানভাসটা ফাঁকা।
“বাঃ!“ অস্ফুস্ট গলায় অমিতেশ বলে উঠলেন।
“থ্যাঙ্ক ইউ।” লিলিয়ান বলল।
“তুমি কোথায় থাকো লিলিয়ান?“
“প্যারিসে।”
অমিতেশের বুকের মধ্যে থেকে একটা ভারি শ্বাস বেরিয়ে এলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করলেন, “প্যারিস থেকে এখানে এসেছ ছবি আঁকতে?”
“এটাই আমার নেশা আঙ্কেল। একটু পয়সা জমিয়ে সোলো ট্রিপে চলে যাই পৃথিবীর কোনও কোণে। তবে এবার একটু স্পেশাল। আমার একটা কলকাতা কানেকশন আছে। আমার মা…”
“মধুমিতা।” খুব নিচু গলায় নামটা এত বছর পর আবার উচ্চারণ করে ফেললেন কিনা বুঝতে পারলেন না অমিতেশ।
“আমার মায়ের নাম মধুমিতা। মায়ের স্কুল লাইফটা এখানে কেটেছিল। আমার দাদুর অবশ্য এখানে বাড়ি ছিল না। ভাড়া থাকতেন। আপনি মা‘কে চিনতেন?”
কত স্মৃতি। মধুমিতা স্কুলে যেত, সেই সময়টা বাসস্ট্যান্ডে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন অমিতেশ। মধুমিতা টিউশন পড়ে রাত্রিবেলায় যখন ফিরত অন্ধকারে কত পিছু নিয়েছিলেন। সরস্বতী পুজোর দিন কাঁচা হলুদ শাড়ি পরে যখন মধুমিতা পাড়ার পুজোর প্যান্ডেলে আসত, পৃথিবীটাকে একেবারে অন্যরকম মনে হত। রাতের পর রাত পাশবালিশ আঁকড়িয়ে মধুমিতার ওম খুঁজেছেন। কত ব্যর্থ কবিতা লিখেছেন, কত কত প্রেমপত্র। কিন্তু কোনদিনই সাহস করে তার একটাও মধুমিতার কাছে পৌঁছিয়ে দিতে পারেননি। তারপর একদিন ওরা চিরদিনের মত পাড়া ছেড়ে চলেই গেল। কী যে অবসাদ গ্রাস করেছিল তখন, কাউকে বুঝতে দেননি। বহুদিন লেগেছিল সেটা কাটিয়ে উঠতে।
লিলিয়ান একটা প্রশ্ন করে অমিতেশের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখ। অবিকল সেই চোখ। হাসলে গালের টোলটা পর্যন্ত। অনেক কষ্টে দুদিকে মাথা ঝাঁকিয়ে অমিতেশ বললেন, “ঠিক খেয়াল করতে পারছি না।”
“কোয়াইট পজিবল আঙ্কেল। অনেকদিন আগের ব্যাপার। ইন ফ্যাক্ট মা জানেনা আমি কলকাতায় এসেছি। মা জানে আমি বেনারসে গঙ্গার ঘাটের ছবি আঁকতে এসেছি। অ্যাকচুয়ালি তাই এসেছিলাম। ফেরার ফ্লাইটটা কলকাতা থেকে। একদিন এক্সট্রা কলকাতায় থেকে গেলাম মা‘কে একটা সারপ্রাইজ দেব বলে।”
“সারপ্রাইজ?”
“মায়ের টিন এজটা যেখানে কেটেছিল সেখানকার একটা ছবি এঁকে মা’কে জন্মদিনে…“
“২রা আগস্ট…“ আবার বিড়বিড় করে বললেন অমিতেশ। বেশ মনে আছে মধুমিতার জন্য ক্যাডবেরী কিনে, নিউ মার্কেট থেকে কার্ড কিনে, তারমধ্যে পারফিউম স্প্রে করে গিফট র্যাপ করে মধুমিতাকে দেবেন ভেবেছিলেন। একবার নয়, পর পর তিন বছর। কিন্তু কোনবারই দিয়ে উঠতে পারেননি।
“স্যরি আঙ্কেল। কিছু বললেন?”
“না। তুমি বলছিলে তোমার মায়ের জন্মদিনের কথা।”
“ও ইয়েস। সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আমি এখানকার ঠিকানাটা পর্যন্ত খুব গোপনে আমার এক মামার কাছ থেকে জোগাড় করেছি। কিন্তু একটা সমস্যায় পড়েছি।”
“কী সমস্যা?”
ক্যানভাসের চারদিকে ফাঁকা জায়গাটা দেখিয়ে লিলিয়ান বলল, “আপনার বাড়িটা ছাড়া আর একটাও পুরনো দিনের মানে মায়ের সময়ের বাড়ি নেই। গোটাটাই কনস্ট্রাকশন সাইট। এসব দেখলে মা খুব দুঃখ পাবে। একেবারে শকড হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে নষ্টালজিক হয়ে এত কথা বলে এখানকার।”
“তোমার মা এখানকার খবর রাখেন?”
“না, এখনকার খবর রাখে না। সব ওই টিন এজের সময়ের।”
“জানিনা তোমাকে সাহায্য করতে পারব কিনা,“ ক্যানভাসের ফাঁকা জায়গা দেখিয়ে অমিতেশ বলতে থাকলেন, “এই আমাদের বাড়ির বাঁ পাশেই ছিল তরফদারদের বাড়ির বাগান। বড়ো একটা আম গাছ ছিল। আরেকটা নারকেল গাছ। নারকেল গাছটা নুইয়ে থাকত আমাদের বাড়ির দিকে। আর ডান দিকে হালদারদের বাড়ি। এক বুক উঁচু লম্বা একটা পাঁচিল ছিল। তারপর দাসগুপ্তদের বাড়ি। ওদের বাড়ির সামনে একটা রোয়াক ছিল। আর এই আমাদের বাড়ির সামনেটা দেখছ, ওখানে একটা গলি ছিল। সোজা বড় রাস্তায় গিয়ে পড়েছিল। তোমার মা হয়ত এই রাস্তা দিয়েই স্কুলে যেতেন। সাদা জামা, মেরুন স্কার্ট…”
অমিতেশ একটা ঘোরের মধ্যে বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন আর লিলিয়ান ততটাই দক্ষতার সঙ্গে নিখুঁত স্কেচ করে যাচ্ছে। কোথাও বর্ণনার সঙ্গে ছবিটা না মিললে অমিতেশ সংশোধন করে দিচ্ছেন। ক্যানভাস ভরে উঠছে একরাশ স্মৃতিকে পুঞ্জিভূত করে। অমিতেশের ঘোর কাটল পকেটে মোবাইলটা বেজে ওঠায়।
“কোথায় তুমি? আরে আমি তো স্নানে যেতে পারছি না। নিশ্চয়ই সদরের চাবিটা নিয়ে যাওনি। আমার হয়েছে যত জ্বালা।”
“আসছি।” ফোনটা ছেড়ে অমিতেশ লিলিয়ানকে বললেন, “আমাকে এবার এগোতে হবে লিলিয়ান। ভালো থেকো।”
অমিতেশের হাতটা ধরে লিলিয়ান বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ আঙ্কেল। একমাত্র আপনার জন্যই এবার মায়ের জন্মদিনটা খুব খুব স্পেশাল হবে।“
অমিতেশ বাড়ি ফিরতেই শ্রীতমা যথারীতি গজগজ করতে করতে স্নানঘরে ঢুকলেন। অমিতেশ চুপ করে বসে থাকলেন। বহুদিনের একটা পুরনো মন খারাপ যেন ঘুম থেকে উঠে আবার অবসাদের দেশে নিয়ে যেতে চাইছে। বাইরে কনস্ট্রাকশন সাইটের পাইলিং এর আওয়াজ। গাঙ্গুলীদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভাঙার আওয়াজ। আর ভেতরে ঘড়ির কাঁটার টিক টিক করে বয়ে চলার আওয়াজ।
‘টিং’ করে ডোরবেল বাজার আওয়াজ হলো। নিশ্চয়ই আবার আগরওয়ালদের ম্যানেজারটা এসেছে নতুন কোনও অফার নিয়ে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে অমিতেশ উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে খুব আশ্চর্য হয়ে গেলেন। লিলিয়ান। ওর হাতে পাকানো ক্যানভাসটা।
“স্যরি আঙ্কেল। আরেকবার ডিস্টার্ব করতে এলাম। আসলে স্কেচটা শেষ করে খুব ইচ্ছে করল আপনাকে একবার দেখিয়ে নিয়ে যাই।” বলতে বলতে লিলিয়ান ক্যানভাসটা খুলে মেলে ধরল। ক্যানভাসটা দেখে অমিতেশ একেবারে বিহ্বল হয়ে গেলেন। যতক্ষণ উনি ছবি আঁকা দেখেছিলেন ক্যানভাসে কোনও মানুষ আঁকেনি লিলিয়ান। এখন ছবিতে দেখছেন ওর বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোর। আর বাড়ির সামনে গলিটায় সাদা জামা, মেরুন স্কার্ট পরা এক কিশোরী স্কুল যেতে যেতে ঘাড় উঁচু করে সেই কিশোরকে দেখছে।
“ভেতরে এসো।” অমিতেশ বুঝতে পারলেন তাঁর গলাটা পুরো ধরে এসেছে।
“আজ নয় আঙ্কেল। ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে। পরে কখনও…“
অমিতেশ লিলিয়ানের মাথায় হাত রেখে বললেন, “তোমার মা‘কে আমার শ্রদ্ধা জানিও।”
স্নানঘরের বন্ধ দরজায় টক টক করে টোকা দিয়ে অমিতেশ বললেন, “আমি একটু বেরচ্ছি। সদর দরজার চাবিটা নিয়ে যাচ্ছি।”
ভীষণ বিরক্ত গলায় শ্রীতমা বললেন, “আবার কী হলো? উফ, শান্তিতে কি চানটাও করতে দেবে না? কোথায় আবার যাচ্ছ এখন? এইতো ঘুরে এলে।”
গলাটা ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিয়ে অমিতেশ বললেন, “আগরওয়ালদের সাইট অফিসে। ওদের ম্যানেজারকে বলে আসছি, সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে ফেলেছি। বাড়িটা ওদের দিয়ে দেব। আর কিছু পাওয়ার নেই আমার এই বাড়িটা থেকে।”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন