রাখী নাথ কর্মকার
সেপ্টেম্বরের নরম বিকেল। সপ্তাহান্তের ঝকঝকে উজ্জ্বল নীল আকাশ থেকে চুঁইয়ে পড়ছে বিকেলের সোনালি রোদ্দুর। আর সেই গলানো সোনার প্রলেপ পড়েছে আটলান্টিক মহাসাগরের আদিগন্ত নীল জলশরীরের ভাঁজে ভাঁজেও! নিউ জার্সির আটলান্টিক সিটির সমুদ্রসৈকতে সারাদিন জলকেলির পর এবার কৌতূহলী পায়ে আমরা এসে উপস্থিত হয়েছি শহরের বিস্তৃত কাঠের বোর্ডওয়াকে। বোর্ডওয়াকের ধারে ধারে একটু একটু করে মানুষের ভিড় জমতে শুরু করেছে। বোর্ডওয়াকের একপাশে সার দিয়ে পাতা সাদা চেয়ারে বসে আছেন দর্শকরা! আর একটু পরে এখানে এলে হয়ত আমরা দাঁড়ানোর জায়গাও পেতাম না! আশ্চর্য! কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁকা বোর্ডওয়াকে দেখি ‘তিল ঠাঁই আর নাহি রে…!” কারণ, জানতে পারলাম, গত কয়েক বছর ধরে লাস ভেগাসে থাকার পর এ বছরই… ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত ‘মিস আমেরিকা ২০১৪’ প্রতিযোগিতাটি আবার তার নিজের শহর এবং জন্মস্থান বোর্ডওয়াক হল, আটলান্টিক সিটি, নিউ জার্সিতে ফিরে এসেছে। আর সেই ঐতিহ্যবাহী ‘মিস আমেরিকা প্যাজেন্ট’এর ‘শো আস ইয়োর শুস’ প্যারেড আজ এখানেই নিউ জার্সি এভিনিউ থেকে শুরু করে বোর্ডওয়াক ধরে এগিয়ে যাবে অলবানি এভিনিউএর দিকে। সুতরাং আমাদেরও এবার এ এক সুবর্ণ সুযোগ … এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার
বস্তুত, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা তো পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রতিটি বছরই অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। এই ‘মিস আমেরিকা প্যাজেন্ট’এর বিশেষত্ব কী…যা এই প্রতিযোগিতাটিকে অন্য সব প্রতিযোগিতা থেকে স্বতন্ত্র, অনুপম করে তুলেছে! আসলে, ‘মিস আমেরিকা প্যাজেন্ট’ এবং এর স্পনসর, মিস আমেরিকা অর্গানাইজেশন, বর্তমানে এমন এক প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে যা এখন আর শুধুমাত্র সমুদ্রসৈকতে উচ্ছল স্নানপোশাকের সুন্দরীদের সৌন্দর্য প্রদর্শনেই থমকে নেই, এখন তা প্রতিযোগীদের বিভিন্ন স্কলারশিপ এবং তাদের সার্বিক উন্নতির জন্যে প্রয়োজনীয় সামাজিক কারণগুলির উপরও জোর দিয়ে চলেছে।
ইতিহাসের পাতা উল্টোলেই দেখা যাবে … ১৯২১ সালে প্রথম ‘ইন্টার-সিটি বিউটি কন্টেস্ট’এর বিজয়ীকে ‘মিস আমেরিকা’র মুকুট পরানো হয়েছিল এবং তিনি প্রথম পুরস্কার হিসেবে একশো ডলার প্রাইজ মানি পেয়েছিলেন। তবে শুনলে অবাক হবেন না, প্রথম প্রতিযোগিতাটিতে আমেরিকার পূর্ব উপকূলের শহরগুলো থেকে মাত্র সাতজন প্রতিযোগী যোগদান করেছিল! যদিও তারপর প্রতিটি দশক জুড়েই প্রতিযোগীর সংখ্যা এবং প্রতিযোগিতার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছিল, কিন্তু হঠাৎই ১৯২৭ সালে ক্রমবর্ধমান সমালোচনা এবং অনৈতিকতার দায়ের পাশাপাশি আর্থিক সহায়তার অভাবের কারণে প্রতিযোগিতাটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তবে ১৯৩৩ সালে আয়োজকরা প্রতিযোগিতাটিকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এবং তার কয়েক বছরের মধ্যেই … ১৯৪০ সালের মধ্যেই, প্রতিযোগিতাটি তার হারানো সম্মান ফিরে পেয়েছিল। ক্রমশ এটি একটি ‘অলাভজনক ইভেন্ট’ হিসাবে পরিচিতি পেতে থাকে। ১৯৩৫ সালে ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ ডিরেকটর হিসেবে নিযুক্ত হন লেনোরা স্লটার, যিনি স্টেট কম্পিটিশন, স্কলারশিপ প্রোগ্রাম এবং ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের মতো বৈশিষ্ট্য যুক্ত করে এই প্রতিযোগিতাকে এক আধুনিক প্রতিযোগিতার রূপ দিয়েছিলেন। স্লটারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হল মিস আমেরিকা স্কলারশিপ প্রোগ্রাম। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন –“আমি জানতাম যে একটি মেয়ের চুলের উজ্জ্বলতা তাকে জীবনে সফল করবে না।” এর আগে এই প্রতিযোগিতায় পুরষ্কারগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বলতে যা ছিল তা হল … হয় একটি পশম কোট, নয় একটি হলিউড চুক্তি বা মডেলিং থেকে অর্থ উপার্জনের সুযোগ। কিন্তু তাঁর আমলে প্রতিযোগীদের শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতির সুযোগ দিয়ে স্লটার মধ্যবিত্তের সংবেদনশীলতাকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৪০ সালে, আনুষ্ঠানিকভাবে এর শিরোনাম হয়ে ওঠে ‘দ্য মিস আমেরিকা প্যাজেন্ট’ এবং প্রতিযোগিতাটি আটলান্টিক সিটির কনভেনশন হলে অনুষ্ঠিত হতে থাকে।
১৯৯০এর দশকে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর প্রতিযোগিতাটি ‘মিস আমেরিকা অর্গানাইজেশনে’ নামে পরিচিতি পায়। এটি এমন একটি ‘নট-ফর-প্রফিট কর্পোরেশন’ যা তিনটি স্বতন্ত্র বিভাগ নিয়ে গঠিত: ঐতিহ্যবাহী মিস আমেরিকা প্যাজেন্ট, স্কলারশিপ ফান্ড এবং মিস আমেরিকা ফাউন্ডেশন। সংগঠনটি প্রতিটি রাজ্যে একটি ‘দায়িত্বশীল’ সংস্থাকে রাজ্যের ফ্র্যাঞ্চাইজি প্রদান করে। মিস আমেরিকা অর্গানাইজেশন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সমস্ত নিয়ম-কানুন মেনে প্রতিটি রাজ্য নিজস্ব রাজ্যস্তরে একটি প্রতিযোগিতা পরিচালনা করে। রাজ্য প্রতিযোগিতা সংস্থাগুলি আবার স্থানীয় এবং আঞ্চলিক স্তরে প্রতিযোগিতাটি স্পনসর করার জন্য প্রতিটি রাজ্যের মধ্যে ‘দায়িত্বশীল’ সংস্থাগুলির ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করে। স্থানীয়, রাজ্য এবং জাতীয় সংস্থাগুলি আবার সারা বছর ধরে এই প্রতিযোগিতার কাজ করার জন্য অগুনতি স্বেচ্ছাসেবক এবং আর্থিক সমর্থকদের উপর নির্ভর করে থাকে।
প্রতিযোগিতার সমস্ত স্তরের প্রতিযোগীরা চারটি বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে: প্রতিভা, সন্ধ্যার পোশাক, সাক্ষাৎকার এবং শারীরিক সুস্থতা। মিস আমেরিকা অর্গানাইজেশনের মূল লক্ষ্য হল প্রতিযোগীদের আর্থিক অনুদান এবং পুরস্কারের মাধ্যমে তাদের পেশাদার এবং শিক্ষাগত লক্ষ্য অর্জনের সুযোগ দেওয়া। ১৯৪৫ সালে স্কলারশিপ প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠার পর থেকে, মিস আমেরিকা প্রোগ্রামটি শুধুমাত্র শিক্ষাগত অনুদানেই প্রায় দেড়শো মিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ করেছে, যা এটিকে মহিলাদের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম ‘স্কলারশিপ প্রোগ্রামে’ পরিণত করেছে। প্রতি বছর স্থানীয়, রাজ্য এবং জাতীয় স্তরের মিস আমেরিকা প্রোগ্রামে অংশগ্রহণকারী হাজার হাজার নারীদের জন্য তিরিশ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিভিন্ন বৃত্তি দেওয়া হয়। মিস আমেরিকা প্রার্থীরা নিজেরাও বছরে অন্তহীন কমিউনিটি সার্ভিস ঘন্টায় অবদান রাখেন।
ইতিহাস ও হিসেবশাস্ত্রের কচকচানি ছেড়ে আপাতত না হয় একটু বর্তমানে ফিরে আসা যাক! কী সৌভাগ্য আমাদের! আজ, শনিবারের এই ফুরফুরে বিকেলে, আটলান্টিক সিটির এই কাঠের বোর্ডওয়াকেই সেই ঝলমলে ‘শো আস ইয়োর শুস’ প্যারেড অনুষ্ঠিত হবে! আর আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল … সেই চোখ ধাঁধানো প্যারেড নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা! আমেরিকার ৫০টি রাজ্য এবং কলাম্বিয়া থেকে আগত মোট ৫১ জন শিরোপাধারীরা এই প্যারেডে অংশগ্রহণ করবে যারা পরবর্তী মিস আমেরিকা হওয়ার জন্য অপেক্ষারত। এখানে এই সুন্দরীরা তাদের অনন্য প্যারেড পোশাক এবং সুসজ্জিত জুতোগুলি প্রদর্শন করবে। জানতে পারলাম, বিশের দশকে ‘মিস আমেরিকা’ প্রতিযোগিতা শুরু হলেও এই প্যারেড কিন্তু শুরু হয়েছিল সত্তরের দশকের শুরুর দিকে। সত্যি বলতে কী, এই অভূতপূর্ব প্যারেডটি প্রথমবার দেখার উন্মাদনাই আলাদা। কখন যেন খেয়াল হল, চারপাশের সকলের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে আমরাও চিৎকার করতে শুরু করেছি … ‘শো আস ইয়োর শুস’! ‘শো আস ইয়োর শুস’! এই বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজে মিস আমেরিকার প্রতিযোগীরাই যে শুধু আছেন তা কিন্তু নয়, এখানে নাকি প্রায় উনপঞ্চাশটি নাচের দল, ১৪টি ফ্লোট, ১৪টি মার্চিং ব্যান্ড এবং ১৬টি গায়ক দলও অংশগ্রহণ করছে!
ঐ তো … এই সম্মোহিত বিকেলে, আমাদের চোখের সামনে মিস আমেরিকার সব প্রতিযোগীরা কুচকাওয়াজে অংশ নিয়ে তাদের নিজেদের অনন্য জুতো প্রদর্শন করে চলেছেন – যেমন মিস পেনসিলভানিয়াকে দেখলাম – লাল, সাদা এবং নীল হাই হিল সহ আমেরিকার পতাকার মতো জুতো পরতে! মিস হাওয়াই পরেছিলেন – একটি কাঠের হিল সহ ফুলের জুতো। মিস ইলিনয়এর পায়ে দেখলাম আইস স্কেট! মিস নিউ ইয়র্ক এসেছেন এক উজ্জ্বল আলোর শহর থেকে … তাই তার জুতোয় রয়েছে এলইডি ফ্ল্যাশিং লাইট সহ হিল! মিস কানসাস – থেরেসা ভাইল কমব্যাট বুট সহ সম্পূর্ণ আর্মি গিয়ার পরে রয়েছেন! মিস আলাবামার লাল, কালো, সাদা পোশাকের থিম ‘রোল টাইড’! মিস নিউ জার্সি – কারা ম্যাককোলাম একটি মারমেইডের পোশাকের সঙ্গে স্টারফিশ, ঝিনুক এবং মুক্তার হিল পরে এলেন! আর মিস অ্যারিজোনা – তিনি কোন রাজ্য থেকে এসেছেন তা নিয়ে আলাদা করে বলবার আর কিছু নেই … তিনি তার ক্যাকটাস জুতো পরে এসেছেন!
একের পর এক সুন্দরীরা এলেন, দেখলেন, জয় করলেন আমাদের মন। তারপর এগিয়ে গেলেন বোর্ডওয়াক ধরে অলবানি এভিনিউএর দিকে। ইতিমধ্যে ছটফটে বিকেল ছুট দিয়েছে কোনদিকে কে জানে! খেয়াল হল … সন্ধ্যার অন্ধকার আলগোছে ঝুঁকে পড়েছে এই অনুপম সমুদ্র শহরের মাথার ওপরে। মাথার ওপর দিয়ে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া চঞ্চল ডানায় নীড়ে ফেরা পাখিদের মতো আমাদেরও যে এবার ঘরে ফিরতে হবে। এক আশ্চর্য সুন্দর বিকেলের স্মৃতি নিয়ে ধীর পায়ে এবার আমাদের এগিয়ে যাওয়া পার্কিং লটের দিকে…
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন