পবিত্র সরকার
আমি নিজে বিশুদ্ধ ঢাকাই বাঙাল, এমনকি শহুরে বাঙালও নই, একেবারে গেঁয়ো বাঙাল। দেশভাগ/স্বাধীনতার বছর দশেক আগে জন্মেছি, আর দেশভাগের বছরেই চলে এসেছি। এসে মোটামুটিভাবে একটি ‘সম্ভ্রান্ত’ মধ্যবিত্ত অস্তিত্ব অর্জন করেছি। সেটা সহজসাধ্য হয়নি, আমার ‘অল্প পুঁজির জীবন’-এর প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে তার বিবরণ কিছুটা আছে। আমার মতো লক্ষ উদ্বাস্তু নেতাদের ওই সিদ্ধান্তের ফলে নষ্ট হয়ে হারিয়ে গেছে, কিংবা একটা ভাঙাচোরা ও জীর্ণগোছের জীবন পেয়েছে। আমার এই উঠে আসার জন্য আমার আত্মজনদের শ্রম ও ত্যাগের ইতিবৃত্ত যেমন আছে, তেমনই অনেক অনাত্মীয় মানুষের বিপুল সহায়তাও ছিল।
আমার অসংখ্য ‘ঘটি’ বন্ধু আছে, আছেন ‘ঘটি’ শুভানুধ্যায়ী, যাঁদের দানে আমার জীবন সমৃদ্ধ হয়েছে। তবু আমার এ কথা শুনে তাঁরা নিশ্চয়ই রাগ করবেন না যে, দেশভাগের (নামান্তরে ‘স্বাধীনতা’র) পরে প্রথম বেশ কয়েক বছর ধরে ওপার থেকে আসা উদ্বাস্তুদের প্রতি পশ্চিমবঙ্গবাসীদের অনেকের একটা তীব্র প্রতিরোধ ছিল। এমন নয় যে পূর্ববঙ্গবাসীরা তাঁদের কাছে ভিনগ্রহের জীব ছিলেন।
স্বাধীনতার আগে থেকেই তাঁদের কারও কারও অবস্থিতি তাঁদের আশেপাশে ছিল, কিন্তু সেটা কম ডোজে। তাঁদের তাঁরা সইয়েও নিয়েছিলেন, নিজেদের প্রতিবেশের অংশও নিশ্চয়ই ভাবতে শুরু করেছিলেন, হয়তো বিয়ে-থা ইত্যাদি সামাজিক সম্বন্ধও হয়েছিল। কিন্তু দেশভাগ নামক মনোরম ঘটনার পরে যেটা ঘটল সেটা হল একটা বিস্ফোরণ, ‘বাঙাল’দের ভয়াবহ, বিপর্যয়কারী এক প্লাবন, ইংরেজিতে যাকে বলে deluge। ফলে পশ্চিমবঙ্গবাসী কেন, পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের লোক এটা সামলাতে সমস্যায় পড়ত, এখনও পড়ে। তাই তাঁদের অনেকের মধ্যে যে একটা বিরূপতা জেগে উঠেছিল, সেটা ইতিহাসের ঘটনা। ব্যাপারটা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়, তার জন্যে তাঁদের অপরাধ বোধ করবারও দরকার নেই। বেশ ছিলেন সবাই, মন্বন্তর এবং মহাযুদ্ধের পরে দুর্মূল্যের বাজারে মোটামুটি কেটে যাচ্ছিল দিন-কাল—হঠাৎ পদ্মাপার থেকে পালে পালে সব এসে পড়ল, শেয়ালদা স্টেশনটাকে ছেয়ে ফেলল, সরকারি উদ্বাস্তু-শিবিরে গিজগিজ করতে লাগল লোকজন কাচ্চাবাচ্চা পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে, মনে হতে লাগল তারাই তখনকার সরকারের ‘সোনার চাঁদ সোনার টুকরো’ (এখন তপসিলিদের সম্বন্ধে উচ্চবর্ণেরা যা বলে) সন্তান, সব পাড়ায় পাড়ায় ‘আইসি খাইসি পাইসি’ করে ঢুকে পড়ল, এখানে ওখানে জমিদারদের ফেলে রাখা জঙ্গল আর পোড়ো জমি-জায়গা দখল করে করে হতচ্ছাড়া সব কলোনি বানিয়ে ফেলল, রাতারাতি জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিল, চাকরির বাজারে হুড়মুড় করে পাল্লা দিতে লাগল। তাই কোনো পশ্চিমবঙ্গীয় মহাকবি যদি এমন ছড়া বানিয়ে থাকেন যে, ‘বাঙাল মনুষ্য নয়, উড়ে এক জন্তু, লাফ দিয়ে গাছে চড়ে ল্যাজ নাই কিন্তু’—তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। এর প্রত্যুত্তরে তুলনীয় বাঙাল মহাকবি যে ছড়া বানিয়েছিলেন—‘বাঙ্গাল মনুষ্য নয় দেবতার তুল্য, ঘটি কী বুঝিবেরে বাঙ্গালের মূল্য’—তাতে, এই লেখক নিজে সার্টিফিকেটধারী উদ্বাস্তু হলেও স্বীকার করতে বাধ্য যে, পশ্চিমবঙ্গীয় মহাকবির কবিতার সেই জীবন্ত চিত্রলতা নেই।
আর-একটি চমৎকার এবং মূলত সত্য প্রবচন ছিল—‘বাঙাল, পুঁটি মাছের কাঙাল’, কিন্তু তার কোনো প্রতিবাদী প্রবচন আমি শুনিনি—এর জন্য রেজিস্টার্ড, সার্টিফিকেটধারী উদ্বাস্তু আর বাঙাল হিসেবে আমার একটু হীনম্মন্যতাই হয়। পরে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি এই কথা বলে যে, কথাটা তো নির্জলা ও নির্মম সত্য, সত্যের প্রতিবাদ করা শোভন হত কি?
তবু পশ্চিমবঙ্গীয় বন্ধুরা যে তখন আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং পরে ক্ষমাঘেন্না আর সহ্য করে আপন করে নিয়েছেন তার জন্যে তাঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। যারা ছিল অবাঞ্ছিত বহিরাগত, তারা হয়েছে হৃদ্য প্রতিবেশী, প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘ওরা থাকে ওধারে’ নামক ঘটি-বাঙালের প্রেম ও বিবাহের একটি অতিশয় স্বাদু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন, সম্ভবত প্রসিদ্ধ ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর আগে, যেখানে উত্তম (ঘটি) আর সুচিত্রার (বাঙাল) দুর্ধর্ষ জুটি প্রথম আমাদের হৃদয় কাঁপাতে শুরু করে। তার পরে ‘বর্ধমানের বর, বরিশালের কনে’র বিয়ে হয়েছে। এক ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা হলে সেই পুরোনো শত্রুতার স্মৃতি ফিরে আসে, তার পরে তা উবেও যায়। কবির ভাষায় ‘এখন সবই অলীক’। সেদিন আর জি করের ঘটনার প্রতিবাদে তো তিন প্রধানের সমর্থকদের এক আশ্চর্য সহমর্মিতা দেখলাম, চোখে জল এনে দেওয়ার মতো ঘটনা।
এ প্রসঙ্গে আমাদের দুই শিক্ষাগুরু সম্বন্ধে একটা গল্প বলি। এটা আসলে নোয়াখালির বর আর বর্ধমানের কনে-র গল্প। এক গুরু বর্ধমানের বরেণ্য সন্তান সুকুমার সেন, আর-একজন তাঁরও গুরু, স্বয়ং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। প্রথম গুরুর পূর্ববঙ্গ সম্বন্ধে একটু বিরূপতা ছিল, তা তাঁর বইপত্র পড়লে বোঝা যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিদ্যাচর্চার রাজনীতির সংকীর্ণ ইতিহাসে তার কারণও ছিল, আমরা তার মধ্যে যাব না। সেই সুকুমারবাবুর গুণবতী কন্যা, আমাদের শ্রদ্ধেয়া দিদি সুনন্দাদি, এম.এ পড়বার সময়ে ভালোবাসলেন সহপাঠী বিজিতকুমার দত্তকে। বিজিতদা দীর্ঘদেহী রূপবান সুমেধাযুক্ত পুরুষ, তাঁকে ভালোবাসা অনিবার্য ছিল। দু-জনেই পরে চমৎকার গবেষণা করে ডাকসাইটে অধ্যাপক হয়েছিলেন।
যখন দুজনের বিবাহের প্রসঙ্গ এল, সুকুমারবাবুর মনের মধ্যে কী আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল আমরা তার খবর রাখি না। কিন্তু স্নেহপুত্তলি একমাত্র কন্যার মনোবাসনাকে তিনি উপেক্ষা করতে পারলেন না, বিবাহে সম্মতি দিলেন। এবং, সেই বিবাহে নিমন্ত্রিত হয়ে এলেন, অনিবার্যভাবেই, তাঁর গুরু সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
খাওয়াদাওয়ার আগে আপ্যায়নের সময় তাঁর শ্রেষ্ঠ ছাত্রকে সুনীতিবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘সুকুমারবাবু, পাত্রের বাড়ি কোথায়?’ আমার ধারণা এটা সুনীতিবাবু দুষ্টুমি করে করেছিলেন, কারণ তিনি নিশ্চয়ই জানতেন পাত্রের বাড়ি কোথায়। তিনি সব ছাত্রকেই ‘আপনি’ করে বলতেন, তা হয়তো অনেকে জানেন। সুকুমারবাবু, এবং পরে তাঁর পুত্র বন্ধুবর সুভদ্রও এই রীতি অনুসরণ করেছিলেন। সেটা যে ছাত্রদের পক্ষে সব সময় স্বস্তিকর হত না সেও তাঁদের ছাত্রেরা জানে। কারণ সুকুমারবাবুর ক্লাসে আমরা কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারলে—উত্তর দিতে না পারার জন্যই আমরা প্রস্তুত থাকতাম—তিনি বলতেন, ‘আপনারা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে পড়েছিলেন?’
যাই হোক, গুরুর প্রশ্নের উত্তরে সুকুমারবাবু গুরুর চোখে না তাকিয়ে উত্তর দিলেন, ‘নোয়াখালি।’
সুনীতিবাবু, কয়েক সেকেন্ড চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইলেন সুকুমার সেনের দিকে। তার পর অট্টহাস্যের মতো স্বরে বললেন, ‘সুকুমারবাবু! কী বলছেন! একে বাঙাল, তায় নোয়াখালি! কী আর বলব, ভগবান আছেন!’
এই গল্প আমি শুনেছি প্রয়াত অধ্যাপক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার অগ্রজ সহকর্মী দেবীপদ ভট্টাচার্যের কাছে, তিনি গল্প বানানোর মানুষ ছিলেন না। আর আমি যেহেতু এ গল্প পুনরাবৃত্তি করছি মাত্র, এতে নোয়াখালির বাঙালদের সম্বন্ধে মতামত একেবারেই আমার ব্যক্তিগত মতামত নয়। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই নোয়াখালির সন্তান, কবীর চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী পরিবার, আরও সব মহা মহা ব্যক্তি—বহু মানুষ নোয়াখালির ভূমি থেকে উঠে এসেছেন। নোয়াখালির মানুষের উৎসাহ-উদ্যোম সম্বন্ধে বাংলাদেশের মানুষও রীতিমতো শ্রদ্ধাশীল। ঢাকায় তাঁদের কাছে এমন একটি কল্পবিজ্ঞানের গল্প শুনেছি যে, ১৯৬৯ সালে যখন মার্কিনি নিল আর্মস্ট্রং প্রভৃতিরা প্রথম চাঁদে গিয়ে নামেন, তখন নাকি সেখানে নোয়াখালির এক দোকানদারের কাছ থেকে তাঁরা মাটির ভাঁড়ে চা আর জর্দাপান কিনে খেয়েছিলেন। একটি সত্য ঘটনাও নোয়াখালির মানুষদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার ভায়রা ভাই বিধুভূষণ চক্রবর্তী ছিলেন নোয়াখালির, তিনি দেশ ছাড়েন এক সময়। কিন্তু তিনি যাতে নিরাপদে দেশ ছাড়তে পারেন তার জন্য তাঁর গ্রামের মুসলমান প্রতিবেশীরা তাঁকে আগলে আগলে সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে আসেন, লুঙ্গি পরিয়ে, মুসলমানের বেশে।
কিন্তু আমার বিষয় নোয়াখালির বাঙাল নয়, ঢাকার বাঙাল এবং বিশেষভাবে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন জানি না, ঢাকার বাঙাল সম্বন্ধে বাঙালির মনে একটি বিচিত্র দ্বন্দ্ব আছে, আছে এক দ্ব্যর্থকতা, যার বিনির্মাণ বা অবিনির্মাণ একমাত্র জাক দেরিদার মতো প্রতিভারই সাধ্য, আমাদের নয়। রজনীকান্ত সেনের ‘কাঙাল বলিয়া করিয়ো না হেলা’ গানটির একটি প্যারোডি আমরা শুনেছি—‘বাঙাল বলিয়া করিয়ো না হেলা, (আমি) ঢাকার বাঙাল নাহি গো!’ অর্থাৎ বাঙালকুলে ঢাকার বাঙালেরা একেবারে অন্ত্যজ, অধমস্য অধম, তাদের দূর থেকে লম্বা চিমটে দিয়ে ছোঁয়া যায় না। আমি খুব আশ্চর্য হয়ে যাই যে, বাংলাদেশেও কোনো কোনো জেলার (এখন অবশ্য অনেক জেলা সেখানে, তবে আমরা সেই পুরোনো ভূগোল নিয়েই কাজ করব) লোকও নাকি তাই মনে করে। যেমন ঢাকাই কুট্টিদের একটা গল্পেই পাই ফরিদপুরের লোকের হাতে এক ঢাকার লোকের হেনস্তা হওয়ার গল্প। ফরিদপুরের লোকটির সঙ্গে ঢাকার লোকের ঝগড়া শুরু হয়েছে, ঘটনার উপক্রমেই ফরিদপুরবাসী ঢাকার লোকের মুখে দুখানা মনোরম ঘুষি বসিয়ে দিয়েছে। ঢাকার লোক তখন রুখে উঠে বলেছে, ‘আবে হালায়, সাহস কত, মার দেখি আমার বউ রে!’ আক্রমণকারী তখন বউকেও মহানন্দে ধাক্কা লাগায়। তখন ঢাকার লোকটি আরও চ্যালেঞ্জ দেয় তার ‘পুলা-মাইয়ারে’ মারবার জন্যে। ফরিদপুরবাসী সে আমন্ত্রণও সানন্দে গ্রহণ এবং সম্পাদন করে। তখন ঢাকাবাসী সিলেটের সহযাত্রীকে বিষয়টার ব্যাখ্যা করে এইভাবে যে, ‘বোঝলেন না, এয়ারা য্যান্ বাইরতে যাইয়া কেউ কইতে না পারে মাইর আমি হালায় একলাই খাইসি।’ অবশ্য দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘সধবার একাদশী’তে, গিরিশচন্দ্র তাঁর ‘বেল্লিক বাজার’-এ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘প্রায়শ্চিত্ত’-তে, এমনকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘এই সময়’-এ ঢাকাবাসীদের চূড়ান্ত নির্বোধ আর কাপুরুষ হিসেবে দেখিয়েছেন। তখন, আজকালকার দিনের তত্ত্বের ভাষায়, কলকাতার লোক ছিল ‘আত্ম’, আর ঢাকার বাঙাল ছিল ‘অপর’। কিন্তু ঢাকার লোকেরা আবার বহু গল্পে নিজেদের বিস্ফারিত ‘ইগো’ নিয়ে বহাল-তবিয়তে চলাফেরা করেছে। ঢাকাই গল্পে ঢাকার লোকেরা অনেক সময় নিজেদের ‘আত্ম’ আর কলকাতার লোকেদের ‘অপর’ হিসেবে দেখিয়ে, এখনকার দেরিদাসম্মত ভাষায়—নিজেদের privilege করেছে।
যে কারণেই হোক, বাংলা সাহিত্যে ঢাকার বাঙালরাই হল বাঙালের ‘স্টিরিয়োটাইপ’—প্রতিরূপক। হ্যাঁ, তারা নানাভাবে নাকাল হয় বটে, কিন্তু তাদের অপরিমিত আর আকাশচুম্বী আত্মবিশ্বাস আর উচ্চম্মন্যতা কখনও কমে না। জানি না, এসবের কতটা তাদের স্বভাবসম্মত, আর কতটা বহিরাগতের হীনম্মন্যতা লুকোনোর জন্য একটা মারমুখো ভঙ্গি। ‘বাঙালের গোঁ’ কথাটার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব যেন ঢাকার বাঙালেরাই নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। এই গোঁ নিয়েই বাঙাল জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর পশ্চিমবঙ্গীয় স্কুলের সহপাঠীরা তাঁর বাঙাল কথা নিয়ে ঠাট্টা করায় ঘুষিয়ে তাদের ঠাট্টাকে নিরস্ত করেছিলেন। বা উদ্বাস্তু সমস্যার প্রথম যুগে, শুনেছি, ক্লাসে ছাত্রকে কোনো পশ্চিমবঙ্গীয় শিক্ষক পড়া জিজ্ঞেস করলে সে অম্লানবদনে বলত, ‘আমরা রিফুজি স্যার!’ কাহিনিকার ব্যাপারটা ঊহ্য রেখেছেন, কিন্তু ওই ছাত্রটি ঢাকার বাঙাল হওয়াই খুব বেশি সম্ভব। সেই যে একজন কলকেতার লোক এক ঢাকার লোককে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মশায়, আপনারা কতায় কতায় ‘শ’-এর জায়গায় ‘হ’ বলেন কেন?’ ঢাকার লোক তেড়ে উঠে প্রতিপ্রশ্ন করে, ‘কোন্ হালায় কইসে?’ তখন কলকাত্তিয়া লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘এ কী! এই তো এখনই বললেন!’ ঢাকার লোক কথাটা ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন এই বলে, ‘অইটা আপনের হুনতে বুল।’ আর-একজন ঢাকাবাসী আর-একটু বিশদ করে বলেছিল, ‘আমরা কওনের হময় তো ‘হোনাই’ (সোনাই) কই, আপনেরা হুনতে হোনেন হোনা।’ এই আড়ম্বরপুর্ণ অহমিকাবশতই তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘স্বর্ণলতা’ উপন্যাসে কালীঘাটের ঢাকাই চালওয়ালার কাছে পথশ্রমে ক্লান্ত ক্ষুধার্ত বিধুভূষণ যখন কালীঘাট মন্দিরের পথ জানতে চেয়েছে, তাখন গুরুগম্ভীর চালওয়ালা তার বাড়ি কোথায়, কোথা থেকে আসছে, যাবে ‘কোহানে’—এই সব জিজ্ঞেস করছে। বিধুভূষণ তিতিবিরক্ত হয়ে যখন বলেছে, আগে মন্দিরের পথটা বলুক, তখন চালওয়ালা মহাজন রেগে উঠে বলেছে, ‘বারি বরমানুষের ব্যাটা দেহি, কথার জবাব দেয় না! যা তুই দেহে নে গে মন্দিরের পথ। আমি ত কমু না!’
বন্ধুবর শামসুজ্জামান খান এবং স্নেহাস্পদা ফরিদা ইয়াসমিন দুটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঢাকাই রস-রসিকতার যে দুটি সংকলন করেছেন, তাতে ঢাকা বনাম কলকাতার অনেক গল্পে ঢাকার লোকেদের জিতে যাওয়ার গল্প আছে। সেখানে, আগে যেমন বলেছি, ঢাকাইয়া হল ‘আত্ম’, আর কলকাতার লোক হল ‘অপর’। যেমন কলকাতায় এসে এক ঢাকাইয়া নতুন স্যান্ডেল কিনে ফটফট করে চলেছে, তার কলকাত্তিয়া বন্ধু তার দারুণ প্রশংসা করতে শুরু করায় সে তাচ্ছিল্যভরে বলেছে, ‘পছন্দ অইলে নিয়া যান।’ তখন কলকাতার বন্ধু জিভ কেটে বলেছে, ‘আরে ছি ছি! বউদি জিজ্ঞেস করলে কী বলবেন?’ ঢাকাইয়া অম্লানবদনে বলেছে, ‘কমু-নে (বলব এখন) স্যান্ডেল কুত্তায় লইয়া গেসে।’ কিংবা মুজতবা আলী সাহেবের ‘পঞ্চতন্ত্র’-এ সেই বিখ্যাত ঢাকার বাঙালের গল্পটি — উদ্বাস্তু হয়ে এসে বাজারে গেছে, বাজারে তরকারিওয়ালাকে বেগুন দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, ‘বাইগন কত কইরা দাদা?’ পশ্চিমবঙ্গীয় সবজিওয়ালা ঠাট্টা করে বলেছেন, ‘ওহে বাঙালদাদা! ‘বাইগন’ আবার কী হে, শুদ্ধ কতা কইতে জাননি?’ উদ্বাস্তু জিজ্ঞেস করেছে, ‘অ। তা শুদ্ধু কথাটি কী অইব?’ সবজিওয়ালা বলেছে, ‘কেন? “বেগুন”—কী মিষ্টি কতা!’ তখন বাঙাল বলেছেন, ‘অ, মিষ্টি কইরা কইতে অইব? তাইলে আর ‘বেগুন’ কই ক্যান ছার? বেগুন না কইয়া ‘পেরাননাথ’ (প্রাণনাথ) কইলেই অয়!’ এইরকম ঢাকা আর কলকাতার দুই পকেটমারের মধ্যে বাজি হয়, কার হাতযশ বেশি, কে কত নিঃসাড়ে শিকারকে জানতে না দিয়ে তাকে নিঃস্ব করে ছাড়তে পারে। কলকাতার লোক গাছে উঠে কাকের পেটের তলা থেকে তার ডিম তুলে নিয়ে অবিশ্বাস্য হস্তচাতুর্য দেখায়, কিন্তু (সেন্সর বোর্ডের সদস্যগণ ক্ষমা করবেন) সেই সুযোগে ঢাকার সহকর্মী তার পরনের বস্ত্রটি কখন খুলে নিয়েছে তা সে (কলকাতার পকেটমার) টের পায় না।
আমার বিষয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, কিন্তু তার আগে ঘটির দেশে বাঙালের এসে পড়া আর তার সামাজিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে একটু বেশি বিস্তারিত ভূমিকা করার কারণ আছে। এই বিরোধী প্রতিক্রিয়া যে আস্তে আস্তে বদলে যায়, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সমাজে উদ্বাস্তুদের অভিযোজন যে শুরু হয়, তার একটা যুক্তি হয়তো চলচ্চিত্রে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনীত চরিত্রগুলি খাড়া করে। লোকগুলি বাইরে বোকা কিন্তু ভিতরে চালাক, একটু বেপরোয়া—আর কথাবার্তা আর আচরণে তুমুল মজাদার—এই ধারণাগুলি কি ঘটিদের বাঙালদের সম্বন্ধে মনোভাবের পরিবর্তনে বা নির্মাণে কোনও সাহায্য করেছিল? আমাদের মনে হয় করেছিল। এটা একটু সরলীকরণ হল, কিন্তু এই ‘বোকা বাঙাল’ টাইপের বাইরেও নিশ্চয়ই অনেক বাঙালি ছিল যারা তাঁদের বিদ্যাবত্তা বা কুশলতা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গবাসীর সহিষ্ণুতা বা এমনকি সম্ভ্রম উপার্জন করেছিল। তার কারণ পূর্ববঙ্গ থেকে মেধাবী ছাত্রদের আগমন অনেক আগে থেকেই কলকাতায় শুরু হয়েছে, এবং তাঁদের কেউ কেউ এই অঞ্চলে উচ্চপদ অধিকার করে, বা গুণবান শিক্ষক হিসেবে, বা ব্যবসায় সফল হয়ে সমীহা বা প্রীতি আদায় করেছেন। অর্থাৎ অভিযোজন প্রক্রিয়াও অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। কিন্তু দেশভাগ তার মধ্যে একটা বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে এল—আচমকা এত বেশি সহিষ্ণুতা আর অভিযোজন দাবি করল যে, তার ছিঁড়ে যায় বুঝি।
সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২০-১৯৮৩) যাঁর পিতৃদত্ত নাম, তিনি যে কেন বাংলার চলচ্চিত্র-সংস্কৃতিতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় হিসেবে জন্মান্তর গ্রহণ করলেন, তার রহস্য ভেদ করতে ব্যোমকেশ বক্সীর দরকার হয় না। যে ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে তিনি ঘটি বাঙাল উভয় পক্ষের মন জয় করবেন, বাঙালির কাছে দৃশ্য-শ্রাব্য হাস্যরসের এক নতুন প্রস্রবণ খুলে দেবেন, সেই চরিত্রগুলির সঙ্গে সাম্যময় নামটা একেবারেই যায় না। তবে আমরা অনেকেই জানি না যে, বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তিনি প্রথম ভানু বন্দ্য্যোপাধ্যায় নন। তাঁরও আগে একজন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন (১৮৮৮-১৯৬৬), যিনি বেশ সৌম্য ও অভিজাতদর্শন, নায়কের বন্ধুর ভূমিকায় যাঁকে প্রায়ই দেখা যেত। কিন্তু তিনি ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্ট্রেইট’ অভিনেতা, তাই, কখনোই ‘টাইপ’ হয়ে ওঠেননি, কমিক রোলেও তাঁকে খুব-একটা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সেই ভানুকে আড়াল করে দিয়ে আর-এক যে ভানুর আবির্ভাব হল তাঁর জীবনের প্রাগিতিহাস কম চিত্তাকর্ষক নয়। মায়ের সূত্রে সরোজিনী নাইডুর আত্মীয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ড. জ্ঞান ঘোষ, মোহিতলাল মজুমদারের প্রিয় ছাত্র, জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও দেশভাগের কারণে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার আগেই তিনি আর-এস-পি দলের সংস্কৃতি-সংগঠন ক্রান্তি শিল্পী সঙ্ঘের সদস্য হিসেবে নাটক করেছেন, আবার রাজবন্দিদের মুক্তি সংক্রান্ত আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। পরেও তাঁর এই রাজনৈতিক অভিমুখটি সক্রিয় ছিল।
কিন্তু তাঁর জীবনের ইতিহাস আমাদের মূল আলোচ্য নয়। এমনকি আলোচ্য নয় তাঁর জীবনের এই ‘সিরিয়াস’ ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর পরবর্তী পরিচয়ের কোনও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল কি না, কোনও আত্মপরিচয়ের সংকটে তিনি ভুগেছিলেন কি না, মনোবিজ্ঞানীর কাছে সেই উপাদেয় প্রসঙ্গ। বরং তিনি আমাদের যৌবনের সময়কে কী ভাবে উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন, তার একটু স্মৃতিচারণ করি। তাঁকে আমরা যখন দেখি, সম্ভবত ‘বসু পরিবার’ ছবিতেই সর্বপ্রথম, যেখানে তিনি ছিলেন এক সুদখোর মহাজন, বসুকর্তা পাহাড়ি সান্যালকে টাকা ধার দিয়েছিলেন, তার তাগাদা করতে আসতেন। আর একজন তাগাদাদার ছিলেন জহর রায়। এ দুজনের জুটি কালক্রমে অবিস্মরণীয় হবে। কিন্তু মহাজনরূপী ভানুর নিজস্ব একটি আইডেন্টিটি ক্রাইসিস বা আত্মপরিচয়ের সংকট ছিল, সেটা তিনি সংলাপে প্রকাশ করতেন। তাঁর পদবি ছিল পাল। ‘পাল’ পদবিটি প্রথাবদ্ধ হিন্দু সমাজের কুসিদ্ধান্তের ফলে খুব কুলীনত্বের দাবিদার ছিল না, কিন্তু ভানুর অভিনীত চরিত্রটি নামটা বলেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে দর্শকের সম্ভাব্য ভুল ও অবজ্ঞা প্রতিহত করবার জন্যে বলতেন, ‘কিন্তু ব্যবসাইত্ পাল না, অই যে রাজা মহীপাল, হেই!’ অর্থাৎ তিনি পূর্ববঙ্গের বিখ্যাত রাজা মহীপালের বংশধর, নেহাতই ভাগ্যের ফেরে মহাজনি ব্যবসা ধরেছেন। পুরো ছবিতে এই সংলাপটা কয়েকবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে। কখনও ‘হেই’ কথাটা শেষে বলতেন না, চোখ গোল গোল করে, দুই ঠোঁট চেপে, এমন একটা ভঙ্গি করতেন, যাতে শ্রোতার সমস্ত সন্দেহ নিরসন হয়ে যেত এবং দর্শক হিসেবে আমরা প্রায় সিট থেকে গড়িয়ে পড়তাম। পঞ্চাশের প্রথমগুলির প্রথম দিকে সেই ‘বসু পরিবার’ থেকেই তাঁর জয়যাত্রা শুরু, যেমন জয়যাত্রা শুরু উত্তমকুমারের। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ও এ ছবিতে নিজের স্বচ্ছন্দ অভিনয়-প্রতিভার জাত চিনিয়েছেন।
তার পরে এল সেই অবিস্মরণীয় ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, উত্তম-সুচিত্রার প্রথম দিককার দুর্ধর্ষ ছবি, যাতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহজ ও নিষ্পাপ ‘মাসিমা, মালপুয়া খামু’ কথাটি প্রায় সিনেমাহলের ছাদ ধসিয়ে দিয়েছিল। প্রতিবেশী মেসের ছেলেদের নেতা উত্তমকুমারের মন মজিয়েছে পাশের বাড়ির মেয়ে সুচিত্রা সেন, কিন্তু কেউ সেই বাড়িতে, যাকে বলে ‘এন্ট্রি’ নেওয়া—তা নায়ক নিতে পারছে না। ওদিকে উত্তমের আবেগকে মদত দিতে সকলে মিলে গান ধরেছে—‘আমার এ যৌবন-চম্পাচামেলি বনে অকারণ উচ্ছল দিন গো’ (এই বৃদ্ধের স্মৃতিতে এও ধরা আছে যে, এই সমবেত সংগীতের চিত্রায়ণ খুব সুন্দর হয়েছিল আর এতে স্বয়ং মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ও গানের সিকোয়েন্সে দর্শন দিয়েছিলেন)। যাইহোক যৌবনের চম্পা-চামেলি ফুটেছে, কিন্তু মেয়েটির বাড়িতে পৌঁছোনো যায় কী করে? তখন ডাকাবুকো ভানুকেই পাঠানো হল, এবং ভানু অকুতোভয়ে, অম্লানবদনে, অপাপবিদ্ধ সরলতায় গিয়ে দাবি জানিয়েছে, ‘মাসিমা, মালপুয়া খামু।’ মলিনা দেবীর মতো মাতৃত্বের আইকন বাঙালি মহিলারা এই কথায় বিগলিত হবেন না তা কি কখনও হতে পারে? এই একটি মোক্ষম কথাতেই বাজিমাত, এবং নায়ক ও নায়িকার রোমান্সের সরণিতে যাত্রা।
তার পরে ভানু অসংখ্য ছবি করেছেন, এমনকি, পৃথিবীর চলচ্চিত্র ইতিহাসে যা প্রায় অভাবনীয় ঘটনা, তাঁকে এবং জহর রায়কে স্বনামে চরিত্র করে ছবি হয়েছে, ‘ভানু পেল লটারি’, এবং ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’। ভানুর এ সব ছবি আমার দেখা হয়নি, কিন্তু পার্শ্বচরিত্র থেকে প্রমোশন দিয়ে তাঁকে নায়ক করে নির্মিত ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ দেখেছি—সর্বত্রই তাঁর সহজ কমেডি-নির্মাণের ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়েছি। মুগ্ধ হয়েছি তাঁর অন্য ধরনের অভিনয়েও। সলিল সেনের ‘নতুন ইহুদি’ নাটকটি আমি দেখিনি, কিন্তু তার চলচ্চিত্র রূপায়ণে ভানুর মস্তান হয়ে যাওয়া, বোন পরির বিয়ের জন্যে টাকা জোগাড় করে অন্য মস্তানদের হাত থেকে পালাতে গিয়ে ট্রামের তলায় চাপা পড়া, হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় সর্বাঙ্গে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় তার যন্ত্রণাময় গোঙানি—‘দিমু না, পরির বিয়ার টাকা দিমু না আমি।’ এখনও কানে লেগে আছে। তবু গুরুগম্ভীর ভানুকে বেশিরভাগ বাঙালি দেখেনি, তাই তাঁকে গুরুগম্ভীরটায় মনে রাখার কোনও কারণও খুঁজে পায়নি। কমিক্যাল ভানুকেই মানুষ মনে রেখেছে। এমনকি পরাজিত প্রেমিক ভানুকেও আমার পছন্দ হয়নি, ‘পাশের বাড়ি’ ছবিতে যেমন দেখেছি। তাতে তিনি ছিলেন সাবিত্রীর গানের শিক্ষক। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গলায় ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো রূপকথা নয় সে নয়’ গানটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাইতে গিয়ে তাঁর চড়াতে গলা ভেঙে যায়, ফলে গায়ক এবং প্রেমিক হিসেবে তিনি হেরে যান, এটাও আমাকে হতাশ করেছিল। ভানু প্রতিটি ফিল্মে আসবেন, দেখবেন, জয় করবেন—এই ছিল আমাদের প্রত্যাশা, চরিত্রের পরিসর যেমনই হোক। আর বাঙাল কথা ছাড়াও তাঁর অভিনয় দেখেছি। সেখানে তাঁর ওই কিশোর সারল্যমাখা মুখটি আমাদের আগ্রহ অটুট রেখেছে, কিন্তু ঢাকাই কথার যে স্বাদ তা থেকে সে চরিত্রটি বঞ্চিত হয়ে যেন একটু নিরিমিষ হয়ে গেছে।
পেছন ফিরে ভাবি, কী ছিল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়রের কমেডি ভূমিকায় এই অসামান্য সাফল্যের মূলে? নিজে ঢাকার বাঙাল হলেও আমার ব্যক্তিগত, অবশ্যই তর্কসাপেক্ষ, সিদ্ধান্ত এই যে, বরিশালের বাঙাল জহর রায়ের অভিনেতা হিসেবে সামর্থ্য ও ব্যাপ্তি একটু বেশি ছিল, খুব সহজে তিনি অসংখ্য চরিত্রের টাইপকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারতেন, নানা উপভাষায়ও বলতেন অতি সহজে। কিন্তু তবু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে বেশির ভাগ সময়ে তাঁকে গৌণ ভূমিকায় সন্তুষ্ট থাকতে হল কেন—‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’ ছবির নামটি যার প্রতীক?
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জহর রায়—দুজনেরই কিছু গ্রামোফোনের রেকর্ড ছিল রস-রসিকতার। আগে আমরা ধীরেন বসু প্রভৃতির বরিশালের ভাষার কমেডি ডিস্ক শুনেছি। যেমন শুনেছি নবদ্বীপ হালদারের। জহর যেখানে মান্য চলিতভাষা বলতেন, তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল দ্রুত উচ্চারণে, যেমন আগে করতেন জহর গাঙ্গুলি। আর ওই ডিস্কে জহরের চরিত্রগুলির ইংরেজি-প্রয়াস ছিল চমৎকার, যেমন বিপক্ষের সাহেব ক্যাপ্টেনের Who is the Captain?’ প্রশ্নের জবাবে বাঙালি ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন সগর্বে জবাব দিয়েছে, ‘। is the Captain?’ শুনে বিস্মিত আম্পায়ার যখন বলেছে, ‘Oh, You are!’ বাঙালি আর-একটু বুক ফুলিয়ে বলেছে ‘Yes, I are!” কিন্তু ভানু ঢাকাই ভাষার বাইরে যাননি। একটিতে ঢাকাই ‘স’-এর জায়গায় ‘হ’ বলার প্রবণতাকে লুকোবার জন্য তিনি ‘হারমোনিয়াম’-কে ‘সারমোনিয়াম’ বলে চালাবার চেষ্টা করেছিলেন বলে আমাদের মনে আছে। মনে রাখতে হবে, নাটকে বা চলচ্চিত্রে অভিনয় আর অভিব্যক্তি সংলাপকে সাহায্য করে, ডিস্কে (তখন মিনিটে মূলত ৭৮ ঘূর্ণনের) সে সমর্থন থাকে না। তাই তাতে শুধু বলা দিয়ে মানুষের কান টেনে রাখতে হয়। এতে ভানু জহর দুজনেরই সাফল্য স্মরণীয়। তার একটি কারণ আশ্রিত ভানুর চেহারা, ব্যক্তিত্বে আর সংলাপে। তাঁর গুম্ফশ্মশ্রুবিরল মঙ্গোলয়েড মুখে একটি কৈশোর যেন চিরস্থায়ী হয়ে ছিল তার সমস্ত সারল্য নিয়ে। এই কৈশোর না ভেবেচিন্তে হুটহাট কথা বলে, তার ঈষৎ হালকা কিন্তু তীক্ষ্ণ কথা, পুরো ঢাকাইয়া উচ্চারণে, যেভাবে বেরিয়ে আসে তা একেবারে মর্মে গিয়ে ঢোকে। চিত্রনাট্যকার তাঁর জন্যে চোখা চোখা সংলাপ তৈরি করেন। তাঁর ‘খ্যাংরা কাঠির ওপর আলুর দম’ (‘পাশের বাড়ি’র সংলাপ অনুযায়ী) রোগা লিকলিকে চেহারাটিও তাঁকে যোগ্য সমর্থন দেবে। শুনেছি কোনো পরিচালক ভানুকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, ‘প্রতি ছ-মাস অন্তর নিজের ভুঁড়ি মাপবে। যদি দ্যাখো ভুঁড়ি বাইশ ইঞ্চির বেশি বেড়েছে, তা হলে আর রোল পাবে না।’ পরে অবশ্য আমাদের চিনু বা চিন্ময় রায় সম্বন্ধেও এ গল্পটা পুনরাবৃত্ত হয়েছে।
দ্বিতীয় কারণটা কি সমাজতাত্ত্বিক? এ প্রশ্নটা অশিক্ষিতের শৌখিন সমাজতত্ত্ববিলাস বলে মনে হতে পারে। হয়তো আমার জল্পনা পুরোপুরিই ভুল। তবু মনে হয়, ঊনবিংশ শতাব্দীতে যেমন, স্বাধীনতার পরের বছরগুলিতে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সমাজে উদ্বাস্তু বাঙালিরা ছিল বহিরাগত, ‘অপর’। কিন্তু এই ‘অপরেরা’ সীমানা পেরিয়ে এখন বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মতো বিরল বা ক্ষণিক আগন্তুক হয়ে নেই। তাদের অনেকে নিছক কমিক রিলিফের গণ্ডিতেও আটকে থাকেননি, অন্য ধরনের সম্ভ্রান্ততা অর্জন করেছেন। তবু সেই ‘স্বাভাবিক’ ‘আমাদের মতো’ বাঙালদের সঙ্গেও ভানুর ওই বোকা বাঙলের একটা বিরোধ তৈরি হয়েছিল। ভানু যেন ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর হাস্যকর বাঙালদের এক বংশধর। তার ওই হাস্যকরতাই তাঁর সম্বন্ধে দর্শকদের কৌতূহল আকৃষ্ট করার পক্ষে যথেষ্ট। তাঁর ভাষা, আচার-আচরণ, নাগরিক পরিশীলন বা পরিমার্জনার অভাব, তাঁর শরীরে ও কথাবার্তায় এই ‘অপরত্ব’-এর চিহ্ন এমনভাবে জড়িয়ে রেখেছিল যে, তার স্বাদ অন্য কোনো কৌতুকাভিনেতা বাংলা চলচ্চিত্রে দিতে পারেননি। ভানুদের জন্যই ওই অপ্রার্থিত উদ্বাস্তু অপরেরা এক সময় পশ্চিম বাংলার সমাজে গৃহীত হয়েছে, বিদ্বেষ, অবিশ্বাস আর দ্বন্দ্বের জায়গায় একটা কৌতুকময় বিকল্প তৈরি করে, সকলের প্রিয় হয়ে। জহর বাবু অত্যন্ত শক্তিমান অভিনেতা, কিন্তু তাঁর গায়ে এমন ‘জংলি’ ethnicity-র ছাপ ছিল না, ফলে ভানুই তাঁর চেয়ে বেশি নজর কেড়েছিলেন। যাদের ‘ঘতি’রা করুণা করবে, ভালবাসবে, আবার রসিকতায় আক্রান্ত হয়ে তা সহ্যও করবে।
কিন্তু পরের ভানুরা ক্রমে এই ‘অপরত্ব’ হারাবে, নিজেদের ভাষা ভুলে তারা পশ্চিমবাংলার জনস্রোতে মিশে যাবে। তাই আমাদের ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও হয়ে থাকবেন এক ইতিহাসের দলিল, একক, উজ্জ্বল, স্মরণীয় এবং উপভোগ্য দলিল। এখন আর-একটা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এসে সেই অভিঘাত আর সৃষ্টি করতে পারবেন না। কারণ, অন্য straight বাঙালদের চেয়েও ভানুকে অনেক বেশি বহিরাগত মনে হত, আবার তিনিই হয়তো বাঙালদের ‘ঘটি’ সমাজে অনেক বেশি সহনীয় এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন। এখন তাঁরা অপরত্বের বৃত্ত থেকে কখন যে আত্মদের বৃত্তে ঢুকে গেছেন, তার হদিশ করাই মুশকিল।
পূর্ব প্রকাশিত – কিছু সংযোজন করা হয়েছে
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন