রম্যাণী গোস্বামী
ভারতের উত্তরে প্রায় দুহাজার মাইল বিস্তৃত তুষারে মোড়া হিমালয় পর্বতমালার অগণিত শৃঙ্গের মধ্যে রয়েছে প্রায় একশোটির মতো চব্বিশ হাজার ফুট উচ্চতার পিক, কুড়িটি ছাব্বিশ হাজার ফুটের জায়ান্ট পিক এবং ছ’খানা সাতাশ হাজার ফুটের সুপার জায়ান্ট পিক। কিন্তু এদের সবাইকে ছাড়িয়ে একা ওই একজনই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। যার উচ্চতা উনত্রিশ হাজার বত্রিশ ফুট! ব্রিটিশ সরকারের অধীনে আনুমানিক একশো বছর ধরে চলা হিমালয় পর্বত জরিপের সময় ১৮৫২ সালে যখন প্রথমবার এই উচ্চতম চূড়াটিকে শনাক্ত করা হয় তখন শিখরের অবস্থানের ক্রমানুসারে তার নাম ছিল ১৫ নং শৃঙ্গ (Peak XV)। এই শৃঙ্গের আবিষ্কারক একজন বাঙালি, যাঁর নাম রাধানাথ শিকদার। যদিও পরে ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল স্যর জর্জ এভারেস্টের নাম অনুসারে শিখরটির নামকরণ করা হয়।
মাউন্ট এভারেস্ট বা তিব্বতি ভাষায় ‘চোমোলাংমা’ শব্দটির অর্থ ‘দ্য গডেস মাদার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’। এর শিখর ছোঁয়ার স্বপ্নটা একশো বছর আগে বহু সফল পর্বতারোহীর কাছেই দুঃসাহসিকতার নামান্তর ছিল। ১৯৫৩ সালের প্রথমবারের সফল অভিযানের আগে বেশ কয়েকবার বিশ্বের এই সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ছোঁয়ার চেষ্টা করা হয়। সেই আপাত ব্যর্থতার ইতিহাসও কিন্তু কম রোমাঞ্চকর নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮,৮৪৮ মিটার বা ২৯,০৩২ ফুট উচ্চতায় ধূ ধূ বরফে ঢাকা ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা। পদে পদে খারাপ আবহাওয়ায় পথ হারিয়ে ফেলবার সম্ভাবনা। তাছাড়া শ্বাসকষ্ট, অল্টিট্যুড সিকনেস, ফ্রস্ট বাইট, স্নো ব্লাইন্ডনেসের আশঙ্কা। এছাড়া প্রায়শই তুষারঝড়, পথের কোথাও খাড়াই বরফের দেওয়াল, পা গাঁথা যায় না এমন তেলতেলে মসৃণ গা, পাশেই সুগভীর খাদ, বরফের ধস নেমে গভীর খাদে বা ক্রিভাসের ভিতরে চিরতরে তলিয়ে গিয়ে প্রাণ হারানো এসব তো আছেই।
মনে রাখতে হবে যে সেই সময় কোনও পর্বতের শিখর ছোঁয়ার জন্য পূর্বনির্ধারিত বা প্রতিষ্ঠিত (established) রুট বলতে যা বোঝায়, তেমন কিছুর অস্তিত্বমাত্র ছিল না। ছিল না বিপদজনক পথে আগে থেকেই শেরপাদের সহায়তায় সেট করে রাখা নাইলনের দড়ি বা রোপ ল্যাডারের ব্যাকআপ। থাকবেই বা কেমন করে? সে পথে যে এর আগে কোনও মানুষের পা অবধি পড়েনি! সুতরাং সামনে কী বিভীষিকা অপেক্ষা করে আছে সেটাও সকলের অজানা। সমস্যা এখানেই শেষ নয়। অত উচ্চতায় মাইনাস তাপমাত্রায় ক্যাম্পের জন্য তখন ব্যবহার করা হত সাধারণ কাপড়ের তাবু। তীব্র তুষারঝড়ের সামনে যা খড়কুটোরই সমার্থক। তাছাড়া এখন যেমন পর্বতারোহীদের বারবার বেশি উচ্চতার ক্যাম্পে পৌঁছে আবার সেখান থেকে নেমে আসতে হয় কম উচ্চতার বেস ক্যাম্পে, এভাবে একাধিকবার নামাওঠার ফলে উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে acclimatization করা বা সইয়ে নেওয়ার পদ্ধতিটি তখনও অনাবিষ্কৃত। এমনকি বেস ক্যাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থাও একমাত্র পায়ে হেঁটেই কারণ প্রযুক্তিগত দিক থেকেও মানুষ অনেকটাই পিছিয়ে। আর শৃঙ্গটি যে-সে নয়, স্বয়ং এভারেস্ট! এবং একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে সেই সময়ে পাহাড়ে ওঠার সাজসরঞ্জাম, অক্সিজেন সিলিন্ডার ইত্যাদি এখনকার মতো হাল্কা, আধুনিক এবং অপ্রতুল ছিল না। এতগুলো দিনের রসদ, বিভিন্ন সরঞ্জাম ও লোকজন নিয়ে পায়ে হেঁটে সুদীর্ঘ দুর্গম বিপদসঙ্কুল পথ অতিক্রম করে অনেক বাধা বিপত্তি এড়িয়ে অভিযাত্রীদের এভারেস্টের পাদদেশ অবধি পৌঁছনোটাও ছিল অত্যন্ত কঠিন ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ। যেখানে হাতের কাছেও ছিল না কোনও নির্ভরযোগ্য ম্যাপ। ছিল না আধুনিক পরিবহণের সুযোগ সুবিধে।
তবুও পাহাড়ে ওঠার নেশা যাঁদের মজ্জায় মজ্জায়, তাঁদের কাছে এসব কঠিন কঠিন বাধা তো তুচ্ছ! এতকিছুর পরেও, ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ টপকে তাই মানুষগুলো ছুটে গিয়েছিল এভারেস্টের শিখর ছুঁতে।
রয়্যাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি ও অ্যালপাইন ক্লাবের উদ্যোগে প্রথমবার ‘এভারেস্ট অনুসন্ধান’ অভিযানে সামিল হলেন ব্রিটিশরা। ততদিনে নর্থ ও সাউথ পোলে মানুষের পা পড়েছে। কাশ্মীর হিমালয়ের ছাব্বিশ হাজার ফুট উচ্চতার ব্রাইড পিকও ছোঁয়া হয়ে গেছে। কিন্তু তিব্বত ও নেপাল দুই- ই তখনও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ বিদেশিদের জন্য। এইরকমই একটা সময়ে ১৯১৩ সালে জন নোয়েল নামক এক ব্রিটিশ আর্মি অফিসারের এভারেস্টের পথে পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা গায়ের রোম খাড়া করে দেওয়ার মতোই।
স্থানীয় নেপালি ও ভুটিয়া শেরপাদের সহায়তায় বিখ্যাত ও কিংবদন্তী বাঙালি অভিযাত্রী শরৎচন্দ্র দাশের দেখানো পথ দিয়ে লুকিয়ে ইন্দো টিবেট বর্ডার ধরে প্রথমে দার্জিলিং, তারপর সিকিম, অবশেষে তিব্বত হয়ে এভারেস্টের পূর্ব গ্লেসিয়ারের দিকে যাওয়ার চরম সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন নোয়েল। ভুললে চলবে না যে ঘটনাকাল ১১১ বছর আগেকার। নোয়েল তিব্বতের পথ ধরে কিছুটা এগিয়েছিলেন বটে কিন্তু শৃঙ্গের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেননি। তবে গোটা যাত্রাপথে তিনি অনুভব করেছিলেন তিব্বতের অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। সেই সঙ্গে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেছিলেন তিব্বতীদের লোকাচার, তাঁদের সংস্কার ও ধর্মীয় রীতিনীতি, মৃতদেহ সৎকারের অভিনব পদ্ধতি ইত্যাদি। আর এসবেরই নিখুঁত বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর লেখা “Through Tibet to Everest” নামের বইটিতে। (প্রকাশকাল – ১৯২৭)
এরপর ১৯১৯ সালে আরেকজন ব্রিটিশ চার্লস হাওয়ার্ড বারি বহু সাধ্যসাধনার পর তিব্বতের দলাই লামার কাছ থেকে এভারেস্ট অভিযানের জন্য অনুমতি আদায় করতে সক্ষম হন এবং ঠিক তার দুবছর পরে অর্থাৎ ১৯২১ সালে আটজন ব্রিটিশ একটি স্থানীয় মালবাহকের দলের সঙ্গে সিকিমের চুম্বি উপত্যকা পেরিয়ে তিব্বতে প্রবেশ করেন। এই দলে ছিলেন বিখ্যাত পর্বতারোহী জর্জ ম্যালোরি, এডওয়ার্ড অলিভার হুইলার এবং আলেকজান্ডার কেলাস। পাহাড়ে চড়ার সহজাত দক্ষতা ছিল ম্যালোরির। ওদিকে লন্ডনের প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার ও পর্বত অভিযাত্রী আলেকজান্ডার কেলাস উচ্চতার সঙ্গে মানবদেহের শারীরবৃত্তীয় কার্যপ্রণালী নিয়ে বিস্তর ভাবনাচিন্তা করেন এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে ধীরে ধীরে শরীরের সহনশীলতা বাড়িয়ে এবং উচ্চতার সঙ্গে সইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অনুযায়ী বিনা অক্সিজেনের যোগান সত্ত্বেও এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছনো হয়তো অসম্ভব কিছু নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯১৯ এর অভিযান চলাকালীন তিব্বতের কাম্পা জংয়ের কাছে হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয় ডক্টর কেলাসের। ১৫,০০০ ফুট উচ্চতায় কাম্পা দুর্গের পাহাড়ি ঢালে মাটির তলায় চিরনিদ্রায় শায়িত রইলেন তিনি। চারপাশ থেকে তাঁকে আগলে অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে রইল তুষারশুভ্র পর্বতমালা। সেই হিমালয়, যা ছিল তাঁর একমাত্র ধ্যান জ্ঞান।
শেষ পর্যন্ত ছিয়ানব্বই দিনের এই রুদ্ধশ্বাস অভিযানের পর ১৯২১ এর তেইশে সেপ্টেম্বর জর্জ ম্যালোরি, হুইলার ও বুলাক সত্যি সত্যিই অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়া ৭,০২০ মিটার উচ্চতায় (২৩,০০০ ফুট) নর্থ কল অবধি পৌঁছন। দেখা গেল যে ডক্টর কেলাসের হাইপোথিসিসে সত্যিই কোনও ভুল ছিল না। কিন্তু তারপরই আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায় এবং তীব্র ঝোড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে দুইজন পোর্টার খুইয়ে দলটি নেমে আসতে বাধ্য হয়। রংবুক হিমবাহ পর্যন্ত সফলভাবে রুট ম্যাপ তৈরি করা এবং সামিটের সম্ভাব্য দিশা খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁরা। সুতরাং সেদিক থেকে দেখতে গেলে চার্লস হাওয়ার্ড বারি সাহেবের উদ্যোগে ১৯২১ এর ‘Everest reconnaissance mission’ কিংবা ‘এভারেস্ট অনুসন্ধান মিশন’ একশো শতাংশ সফল। অত উচ্চতায় বরফের সফেদ বুকে তাঁরা বিচিত্র কিছু পায়ের ছাপও দেখতে পেয়েছিলেন। হাওয়ার্ডের মতে সেগুলো ছিল বিশালাকার কোনও ধূসর নেকড়ে জাতীয় প্রাণীর। যদিও সঙ্গের শেরপারা তা তুষার মানবের পদচিহ্ন বলেই দাবী করেছিলেন।
যাই হোক, পরের বছর ইন্ডিয়ান আর্মির ব্রিগেডিয়ার জেনেরাল চার্লস ব্রুসের নেতৃত্বে আবার অভিযান আরম্ভ হয়। এবারেও তাতে যোগ দিলেন ম্যালোরি এবং ক্যাপ্টেন নোয়েল। নোয়েলই ছিলেন গোটা অভিযানের অফিশিয়াল ফটোগ্রাফার। এই প্রজেক্টটিও ছিল মূলত reconnaissance অর্থাৎ এভারেস্টের শিখর ছোঁয়ার জন্য সুবিধেজনক পথ বা সামিট রুট খুঁজে বের করা এবং সম্ভব হলে প্রথমবার শিখরে পৌঁছনো। সময়টা ১৯২২। তিব্বতের দিক থেকে এভারেস্টের পাদদেশে এসে পৌঁছল ১০০ জন সুস্থ সবল পোর্টার বা শেরপা সম্বলিত ৪০০ টি পশুচালিত ক্যারাভান। নানা বাধাবিঘ্ন টপকে ব্রুসের টীম ৮,৩২৬ মিটার উচ্চতা অবধি পৌঁছে গেলেন। এই প্রথম মানবজাতি পা রাখল ৮০০০ মিটার বা ২৬,২৮৭ ফুটের ডেথ জোনের এক্তিয়ারে। যা কিনা এতদিন অসম্ভব বলেই ভাবা হত।
কিন্তু সামিট? শেষমেশ হল কি?
নাহ্। ওতে বাধ সাধল ওই ভারি ভারি অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলোর যান্ত্রিক গোলযোগ। তার উপরে ঘটে গেল এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। নর্থ কলের কাছে নেমে এলো প্রবল হিমবাহ ধস। দৈবশক্তিতে ম্যালোরি, সমারভেল প্রমুখ অভিযাত্রী বেঁচে গেলেও বিপুল বরফের ভার তাঁদের বাকি সঙ্গীদের নিয়ে নেমে গেল অনেকখানি নীচে। কেউ তলিয়ে গেলেন ক্রিভাসের অন্ধকারে, কেউ বা চাপা পড়লেন দৈত্যাকার বরফের গোলার তলায়। কঠিন বরফের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কারোর কারোর দেহ। ফলে মৃত্যু হল সাতজন মালবাহক শেরপা পোর্টারের। ১৯২২ এর এই অভিযানের ওখানেই ইতি।
দুটো বসন্ত ঘুরে গেছে ইতিমধ্যে। সালটা ১৯২৪। দুইবার ব্যর্থতার পর সাঁইত্রিশের টগবগে যুবক ম্যালোরির মন থেকে এভারেস্টের শিখর ছোঁয়ার ইচ্ছেটা তো ফিকে হয়ে যায়ইনি, বরং আরও বেশি কঠোর হয়েছে তাঁর মনোভাব। স্ত্রী রুথ’কে লেখা চিঠিতে ম্যালোরি বর্ণনা করছেন প্রথমবার এভারেস্টকে দেখা ও তার প্রেমে পড়ার অবিস্মরণীয় পরম ক্ষণটির কথা নিজের বয়ানে – “Suddenly our eyes caught glint of snow through the clouds. A whole group of mountains began to appear in gigantic fragments. Mountain shapes are often fantastic seen through a mist. These were like the wildest creation of a dream… far higher in the sky than imagination had dared to suggest the white summit of Everest appeared.” একটি প্রেস কনফারেন্সে রিপোর্টার যখন তাঁকে বারবার এভারেস্টের দিকে ছুটে যাওয়ার কারণ জিগ্যেস করছেন, তখন তিনি মুহূর্তের ভগ্নাংশ সময় ব্যয় না করে উত্তরে বলছেন তাঁর সেই কিংবদন্তী উক্তিটি – “Because it’s there.”
এবারে ম্যালোরির নেতৃত্বাধীনে ব্রিটিশ টীম আবার রওয়ানা হল এভারেস্টের শিখর ছোঁয়ার লক্ষে। অন্যান্য সুদক্ষ অভিযাত্রীদের সঙ্গে টীমে এবারেও ছিলেন ক্যাপ্টেন নোয়েল, যথারীতি একজন photographic historian এর ভূমিকায়। সেই সময়ে ভারি ভারি ছবি তোলার যন্ত্রপাতি অত উচ্চতায় টেনে নিয়ে গিয়ে চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ায় ক্যাম্পে অস্থায়ী স্টুডিও বানিয়ে ফটোগ্রাফির গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেওয়া নেহাত ছেলেখেলার ব্যাপার ছিল না। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে ক্যাপ্টেন নোয়েল মোশন পিকচারসের পক্ষ থেকে ১৯২২ সালের এভারেস্ট অভিযানের যা যা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভিডিও তুলেছিলেন তা দিয়ে পরবর্তীতে তিনি একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানান যার নাম “The Epic of Everest”। কথিত আছে যে স্বয়ং বার্নার্ড শ লন্ডনের ফিলহার্মোনিক হলে সেই ডকু ফিল্মটি দেখতে এসেছিলেন। ১৯২৪ সালের অভিযানেও নোয়েলই ছিলেন ফটোগ্রাফির দায়িত্বে।
যাই হোক। ফিরে আসা যাক ১৯২৪ এর সেই অভিযানের কথায়। প্রথম দুটো চেষ্টায় অনেকখানি সাফল্য চলে এলো। ছুঁয়ে ফেলা গেল যথাক্রমে ৮,২০০ এবং ৮,৫৭৩ মিটার। তবে সামিট তখনও অধরা। এরপর তৃতীয় বা সর্বশেষ প্রচেষ্টা। অভিজ্ঞ ম্যালোরির সঙ্গী হলেন আরভিন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সেরা অ্যাথলিট। প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্টুডেন্ট বছর বাইশের আরভিন। শেষের অনেকটা কাছে এসে পৌঁছে গেছেন ওঁরা। নর্থ ইস্ট রিজ ধরে পরপর তিনটে ধাপ আছে। সেই তিনটে খাড়াই পেরতে পারলেই সামিট।
তারিখটা হল জুনের আট, ১৯২৪। সকাল আটটা। ৮,১৬৮ মিটার উচ্চতায় ক্যাম্প নাম্বার ছয়ে তোলা একটি ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে তাঁরা দুজন চোখে গগলস পরে পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেঁধে ফাইনাল পুশের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। ঠিক তার আগের রাতেই ২৭,০০০ ফুট উচ্চতার আইস ক্লিফ ক্যাম্প থেকে ফিরতি পোর্টার লাকপা’র হাত দিয়ে আত্মবিশ্বাসী ম্যালোরি একটি ছোট্ট নোট লিখে পাঠিয়েছিলেন নীচের ক্যাম্পে থাকা ক্যাপ্টেন নোয়েলকে। কীভাবে কোন রুটে তাঁরা সামিটের দিকে এগিয়ে যাবেন, আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে কোথায় ক্যামেরা বসালে টেলিফটো লেন্সের সাহায্যে তাঁদের ছবি তোলা সম্ভব হবে, এসবের খুঁটিনাটি লেখা ছিল সেই চিঠিতে। ম্যালোরির লেখা সেই শেষ চিঠিখানা আজীবন নিজের কাছে পরম যত্নে সংরক্ষিত করে রেখেছিলেন নোয়েল। শেষ চিঠি বলছি কারণ নর্থ রিজের দ্বিতীয় ধাপটির কাছে অর্থাৎ ৮,৬০০ মিটার উচ্চতায় শেষবারের মতো জীবিত দেখা যায় এই জুটিকে। সামিটের খুব কাছে, মাত্র দুশ আটচল্লিশ মিটার নীচে!
৮,০০০ মিটার উচ্চতার অন্য একটি পর্বতে বিশ্রাম নিতে নিতে ওঁদের দেখতে পেয়েছিলেন তাঁদেরই অপর এক সহযাত্রী নোয়েল ওডেল। তিনি পরবর্তীতে যা বলেছেন তার অনুবাদ করলে মোটামুটিভাবে এরকম দাঁড়ায় – “সেদিন বেলা বারোটা নাগাদ আচমকা আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে গেল। গোটা সামিট রিজ আর পিরামিডের মতো এভারেস্টের শিখর স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল আমার চোখের সামনে। আমার দৃষ্টি তখন স্থির হয়ে গেছে তুষারাবৃত ঢালে নড়াচড়া করা দুটো ক্ষুদ্র কালচে ছায়ামূর্তিতে। একে একে প্রথমজন বিশাল পাথুরে ধাপটাকে অতিক্রম করে তার মাথায় পৌঁছয়, তাকে অনুসরণ করে দ্বিতীয়জন। তারপরেই আবার মেঘ এসে ঢেকে দিল সমস্ত দৃশ্যমানতা।”
অনেকেই মনে করেন যে ম্যালোরি ও আরভিন শেষ অবধি তাঁদের স্বপ্নের সামিটে পৌঁছেছিলেন। এবং ওঠার নয়, নেমে আসার সময়তে তাঁরা নির্ঘাত কোনও ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। পঁচাত্তর বছর পরে ১৯৯৯ সালে যখন ম্যালোরির দেহ আবিস্কার হয়, তখন নর্থ রিজের যে অংশে তাকে পাওয়া যায়, যুক্তি অনুযায়ী ওঠার নয়, ক্লান্ত ও অবসন্ন শরীরে নেমে আসবার সময়তেই পা হড়কে অনেক উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে এমনভাবে মৃত্যু ঘটা সম্ভব। যাত্রাকালে ম্যালোরির গলায় ঝুলছিল নিকনের ক্যামেরা যা আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। তাঁর পকেটে স্ত্রী রুথের ছবিটিও মিসিং। সেই ছবিখানাই তো সামিটে পৌঁছে সেখানে রেখে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি প্রিয়তমা পত্নীকে। তাই মনে হয় বারবার, ক্যামেরাটা যদি খুঁজে পাওয়া যেত একটিবার। হয়তো এভারেস্ট বিজয়ের ইতিহাস বদলে দেওয়ার মতো চাঞ্চল্যকর ছবি বুকে লুকিয়ে পাঁজা পাঁজা বরফের তলায় শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে সেই ক্যামেরা আজও। ম্যালোরি বলেছিলেন – “I will not come back unsuccessful.” প্রমাণ পাওয়া যায়নি সাফল্যের। ব্যর্থতার তকমা গলায় ঝুলিয়ে ফিরে আসেননি তাই। একইভাবে ফেরা হয়নি আরভিনেরও।
ম্যালোরির ক্যামেরার চাইতে সামান্য একটু আলাদা উইলসনের নোটবুকের আখ্যান। রদ্দি কিছু পাহাড়ে ওঠার সাজসরঞ্জাম, অসীম মনের জোর, দু’চোখে স্বপ্নের ঘরবসত আর ওই নীল চামড়া বাঁধানো নোটবুককে সঙ্গী করে একাই এভারেস্টের শিখর ছুঁতে এগিয়ে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ সৈনিক মরিস উইলসন। যাত্রাপথের ৬,৫০০ মিটার উচ্চতায় বরফের কোলেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন চিরনিদ্রায়। এক বছর পর খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর মৃতদেহ। শরীরের সঙ্গে লেপটে থাকা সেই নোটবুক। শেষ এন্ট্রিতে এক উজ্জ্বল ঝকঝকে ‘গর্জাস’ ভোরে ফের যাত্রা শুরুর ইঙ্গিত। সালটা ১৯৩৩-৩৪।
দ্রুত ক্যালেন্ডারের খোপ বদল হল। এবার পালা এল এরিক শিপটনের। কিন্তু সামিট হাতে এল না। প্রায় সাত হাজার মিটার পর্যন্ত পৌঁছে খারাপ আবহাওয়ার জন্য ব্যর্থ হয়েই ফিরতে হল তাঁকে। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল ফেরত আসা সেই দলে ছিলেন তেনজিং নোরগেও। ব্যর্থতাই তো আসলে সাফল্যের সোপান। পাহাড় কিংবা জীবনের গল্পগুলো এখানে এসে কীভাবে যেন মিলেমিশে যায়। এরপর ১৯৩৬ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে দাঁতে দাঁত চেপে আরও কয়েকটি প্রচেষ্টা চলল। সামিট কিন্তু সেই অধরাই থেকে গেল। ১৯৩৬ এ রাটলেজ, ১৯৩৮ এ বিল টিলম্যান ও তাঁর সঙ্গীরা, ১৯৪৭ এ কানাডার ডেনম্যান, সঙ্গে আবারও শেরপার ভূমিকায় নোরগে। ভয়াবহ তুষারঝড় এলো। ৬,৭০০ মিটার উচ্চতা থেকে কোনওমতে প্রাণে বেঁচে ফিরে এলেন তাঁরা।
১৯৫০ সালে চিন তিব্বত দখল করে নেওয়ায় ব্রিটিশদের চিরাচরিত তিব্বতের পথ ধরে এভারেস্ট জয়ের আকাঙ্ক্ষা একেবারেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল। ওই সময় বারো বছর পরে বিল টিলম্যান আবার ফিরে এলেন সামিটের উদ্দেশ্যে। তাঁর জেদ চেপে গেছে। তাঁরা তিব্বতের আশা ছেড়ে এবার চেষ্টা করলেন নেপাল হয়ে অভিযান চালানোর। বর্তমানে প্রতিবছর এই রুটটিতেই এভারেস্টমুখী হচ্ছেন শত শত অভিযাত্রী। টিলম্যানেরা পারলেন না। কিন্তু নতুন পথের দিশা দেখিয়ে গেলেন। এ যেন সযত্নে রিলে রেসের ব্যাটন তুলে দেওয়া পরবর্তী খেলোয়াড়ের হাতে।
১৯৫১ সালে নেপাল হয়ে লো-লা পাস দিয়ে আরও একটি দল ৬,৮০০ মিটার পর্যন্ত উঠেছিল। ওই একই বছরে আবার চেষ্টা চালালেন সঙ্গীসাথী নিয়ে এরিক শিপটন। শিপটনের দলই প্রথম আবিষ্কার করল খুম্বু আইসফল। যা আর কিছু নয়, এভারেস্টের তলদেশের একটি হিমবাহ। আর এই আবিষ্কারে যাঁর প্রত্যক্ষ অবদান তিনি বছর চৌত্রিশের একজন ভারতীয় তথা বাঙালি পর্বতারোহী। তাঁর নাম ড. গোপেন্দ্র নাথ দত্ত। পেশায় জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার জিওলজিস্ট। পাহাড়ের টানে কলকাতার হেস্টিংসের বাড়ি থেকে গোপেন্দ্র নাথ ছুটে এসেছেন হিমালয়ে ব্রিটিশ অভিযাত্রীদের দলে যোগ দিতে। ২ অক্টোবর এভারেস্টের অজানা পথের সন্ধান করতে করতে তিনি একাই উঠে পড়লেন ২০,০০০ ফুট উচ্চতায়। সেখান থেকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন খুম্বু হিমবাহকে। সেই পর্যবেক্ষণের ফলস্বরূপ এটুকু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে ওই এবড়োখেবড়ো খুম্বু আইসফল না পেরতে পারলে এভারেস্টের শিখর ছোঁয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই।
ড. গোপেন্দ্র নাথ দত্তের উল্লেখ পাই হিমালয়ান জার্নালের একটি বিশেষ সংখ্যায়। যার লেখক নিজেও একজন পর্বতারোহী। তাঁর নাম শ্রী শম্ভুনাথ দাস। হিমালয়ান জার্নালের পাতায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে হিমালয় পর্বত অভিযান সংক্রান্ত একের পর এক আর্টিকেল লিখে চলছিলেন শম্ভুবাবু। তাঁর লেখাতেই উল্লেখ রয়েছে প্রথম বাঙালি পর্বতারোহী ড. গোপেন্দ্র নাথ দত্তের। যাঁকে খোদ শিপটনই পাঠিয়েছিলেন বিকল্প কোনও পথের খোঁজে। ১৯৫১ সালের ৬ অক্টোবর গোপেন্দ্র নাথ একা একাই চলে গেলেন ইমজা ভ্যালিতে এবং সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় জয় করলেন একটি শৃঙ্গ, পরে শিপটন যার নাম রাখেন আইল্যান্ড পিক। আর এটাই ছিল প্রথম এককভাবে একজন বাঙালির সফল পর্বতারোহণ। আজ আমরা ক’জন গোপেন্দ্র নাথের নাম মনে রেখেছি?
শিখর ছোঁয়ার চেষ্টা ওদিকে অব্যাহত। ১৯৫২ সালে পরপর দুটি সুইস অভিযাত্রী দল এভারেস্ট শিখর অভিযান চালান। জেনেভার এডওয়ার্ড উইজ ডুনান্টের নেতৃত্বে দুর্ভেদ্য ও অতিমাত্রায় দুর্গম খুম্বু গ্লেসিয়ার পেরিয়ে প্রথমবার সুইস অভিযাত্রীর দল তুষারাবৃত ওই অংশে পা রাখলেন যেখানে আগে কখনও মানুষের ছায়ামাত্র পড়েনি। হেড শেরপা তেনজিং নোরগেকে সঙ্গী করে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় একের পর এক বাধা টপকে ৮,৫৯৫ মিটার উচ্চতায় পৌঁছেও গেলেন তাঁরা। এই জায়গায় ব্রিটিশদের দারুণ টক্কর দিলেন সুইসরা। আর দেবেন নাই বা কেন? সুইসদের রক্তেই যে পাহাড়প্রেম। সহজেই তাঁরা মিশে যেতে পারেন শেরপাদের সঙ্গে। জাত mountain people ওঁরা। এভারেস্টের শিখর ছোঁয়ার সাফল্য প্রায় এসেই গিয়েছিল সুইস অভিযাত্রীদের মুকুটে কিন্তু এবারেও শেষের খুব কাছে এসে ভাগ্যদেবী মুচকি হাসলেন। খারাপ আবহাওয়ার জন্য সামিট তো হলই না, বরং ধসে প্রাণ গেল অন্য এক শেরপার। শিখরের মাত্র ৮০০ ফুট নীচ থেকে ভগ্নহৃদয়ে ফিরে আসতে হল ওঁদের।
অবশেষে এলো সেই দিনটি! শেষ পর্যন্ত সামিট হাতের মুঠোয়! এতদিনের এত মানুষের চেষ্টা সফল! নেপালের তেনজিং নোরগে এবং নিউজিল্যান্ডের এডমণ্ড হিলারি প্রথমবার পারলেন শিখর ছুঁতে। তারিখটা স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসের পাতায়। ১৯৫৩ সালের ২৯ মে। তারপর থেকে এই জয়যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। দেশ বিদেশের হাজারো পুরুষ নারী, তরুণ তরুণীর স্বপ্ন সফল হয়েছে শিখর ছোঁয়ার। পিছিয়ে নেই ভারতীয় তথা বাঙ্গালিরাও। ২০১০ সালে এভারেস্ট জয় করেন প্রথম বাঙালি অসামরিক জুটি বসন্ত সিংহরায় এবং দেবাশিস বিশ্বাস। ২০২২ এ চন্দননগরের মেয়ে পিয়ালি বসাক কোনওরকম সাপ্লিমেন্টারি অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্টের শিখর ছুঁয়ে নজির সৃষ্টি করেছেন।
আচ্ছা, এভারেস্টের শীর্ষ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে পায়ের তলার পৃথিবীটাকে ঠিক কেমন লাগে? প্রথম বাঙ্গালি মহিলা এভারেস্টজয়ী শিপ্রা মজুমদার এই প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “আমার ভাষার ক্ষমতা নেই যে, এই মুহূর্তের অনুভূতিকে ধরে রাখতে পারে। সাদা তুলো তুলো মেঘ ভেদ করে আমার নীচে দিকচক্রবাল আচ্ছন্ন করে রয়েছে একের পর এক রুপোলি শৃঙ্গ। অক্সিজেনের ঘাটতি, বিশেষ পোশাকের আস্তরণ ভেদ করে দাঁত বসানো শীত, কিছুই আর গায়ে লাগছে না। পুরোটাই যেন স্বপ্ন।”
এই স্বপ্ন দেখার কারণেই কি প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে প্রতি বছর দলে দলে অভিযাত্রীরা শিখরের টানে নেপালের পথ ধরে ছুটে আসেন? তাঁদের মধ্যে অনেকেই আবার প্রাণ হারিয়ে চিরকালের মতো লুটিয়ে পড়েন পথপ্রান্তে বরফের কোলের অন্তিম আশ্রয়ে। হঠাৎ সোঁ সোঁ বাতাসে মেঘ সরে যায়। অমোঘ অজড় হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নীল আকাশের বুকে রোদে ঝকঝক করে তুষারশুভ্র কিংবদন্তী মাউন্ট এভারেস্ট। নেপালি ভাষায় ‘সাগরমাথা’ যার আরেকটি নাম।
*****************
তথ্যসূত্র –
১। Through Tibet to Everest, by Noel, J.B.L. Published by London: Edward Arnold, 1927
২। The Epic of Everest, Documentary (BFI National Archive)
৩। Several volumes of Himalayan Journal available online at www.himalayanclub.org
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
ভাল লাগল। রম্যানীর কলম বর্ণময়।