মানসী গাঙ্গুলী
ভারতের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো যদি না এই কুচক্রী, ঘৃণ্য নারীর জন্ম হতো। তিনি হলেন মেহেরুন্নিসা বেগম, একদা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দী খানের বড় মেয়ে, যিনি ঘসেটি বেগম নামেই ইতিহাসে পরিচিত। নবাব আলিবর্দী খাঁ’র প্রাসাদ হীরাঝিলের একমাত্র শক্তিশালী নারী চরিত্র এই ঘসেটি বেগম, যাকে বাইরের পৃথিবী চিনতে পেরেছে। তিনি এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে মুর্শিদাবাদে নবাব আলীবর্দী খাঁ’র তিন মেয়ের মধ্যে একমাত্র তাঁরই আলাদা একটি প্রাসাদ ছিল। তিনি ছিলেন সুন্দরী, আভিজাত্যপূর্ণ, চতুর, বদমেজাজী ও উচ্চাভিলাষী। ঘসেটি বেগমের ‘রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ ছিল এবং তিনি প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ছিলেন। তাঁর সুপারিশে কেউ পদ হারিয়েছে আবার কেউ ক্ষমতার কেন্দ্রে এসেছে। তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা, তাঁর দাম্ভিক ব্যক্তিত্ব, এবং সুযোগসন্ধানী মনোভাব তাঁকে আর দশটা নারী থেকে পৃথক করেছিল।
তাঁর বিবাহ হয়েছিল আলিবর্দী খাঁ’র বড় ভাই হাজি আহমদের বড় ছেলে নওয়াজিস মোহম্মদ শাহমৎ জঙ্গের সঙ্গে। তিনি ঢাকার নায়েবে নাজিম ছিলেন কিন্তু মূলতঃ ঢাকা পরিচালনা করতেন ঘসেটি বেগম ও তাঁর বিশ্বস্ত দেওয়ান হোসেন কুলি খান। অনেকের মতে হোসেন কুলি খানের সঙ্গে ঘসেটি বেগমের প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল। নিঃসন্তান হওয়ায় এই দম্পতি সিরাজউদ্দৌলার কনিষ্ঠ ভাই ইকরামউদ্দৌলাকে পালকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ঘসেটি বেগমের মনে বাসনা ছিল নবাব আলিবর্দী খাঁ’র মৃত্যুর পর ইকরামকে নবাব হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার, কারণ তাতে তিনিই হবেন নেপথ্যে দেশের সর্বময় কর্ত্রী। ইকরামকে তিনিই পরিচালনা করবেন, কিন্তু তরুণ বয়সে গুটিবসন্তে ইকরাম মারা যায়। নওয়াজিসও অল্প বয়সে মারা যান। মেহেরুন্নিসা বেগম উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর স্বামীর কাছ থেকে প্রভূত সম্পদ পান।
নওয়াজিস ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে একটি ঘোড়ার জুতার আকৃতির হ্রদ তৈরী করেছিলেন। বস্তুতঃ, নবাব আলিবর্দী খাঁ’র সময়ে মুর্শিদাবাদে বহু অট্টালিকা প্রস্তুত করার জন্য ইঁটের প্রয়োজনে যে সমস্ত খাদ কাটা হয়েছিল, উক্ত খাদকেই সংস্কার করে মতিঝিলে পরিণত করা হয়। এই ঝিলে প্রচুর মুক্তোর চাষ হতো, তাই এর নাম মতিঝিল রাখা হয়। মতিঝিল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলিবর্দী খাঁর জামাতা নওয়াজিস ওই ঝিলের বাঁকে নিজ স্ত্রী ঘসেটি বেগম ওরফে মেহেরুন্নিসার বসবাসের জন্য ‘সঙ্গ-ই-দালান’ নামে পাথরের প্রাসাদ তৈরি করেন। এই প্রাসাদটি ১৭৪০ সালে নির্মিত হয়েছিল। এই প্রাসাদটি তখন বিভিন্ন জাতের ফুল গাছ এবং মূল্যবান মার্বেল দিয়ে সজ্জিত ছিল। এটি মতিঝিল প্রাসাদ নামেও পরিচিত। এছাড়া নবাবের হীরাঝিল প্রাসাদের মতই জাঁকজমকপূর্ণ এই প্রাসাদের নাম দেওয়া হয়েছিল, নবাবের প্রাসাদের সঙ্গে মিলিয়ে, মতিঝিল। তবে ঘসেটির মতিঝিল প্রাসাদটি ছিল ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ। তিনি প্রাসাদটি এতটাই জাঁকজমকের সঙ্গে সাজিয়েছিলেন যে নবাবের প্রাসাদও যেন জৌলুসের দিক দিয়ে এর কাছে হার মানত। নবাব আলিবর্দী খাঁ তাঁর এই জেষ্ঠ্যা কন্যাটিকে বিশেষ একটি জায়গা দিয়েছিলেন। জানা যায়, রাগ হলে ঘসেটি বেগম গোঁসাঘরে ঢুকে বসে থাকতেন। তখন তাঁর মান ভাঙাতে হতো।
বাংলার ইতিহাসে মুর্শিদাবাদের মতিঝিল এক কালো অধ্যায়ের নাম। বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের রূপরেখা ইংরেজদের কাসিমবাজার কুঠি ও মতিঝিলের ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ থেকেই প্রণয়ন করা হয়েছিল। সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাতের পরিকল্পনায় ঘসেটি বেগম প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন। এই প্রাসাদেই বাংলার স্বাধীন নবাবকে হটিয়ে ইংরেজদের অধীনস্থ মীরজাফরকে মসনদে বসানোর ষড়যন্ত্র হয়। সে ষড়যন্ত্র সফলও হয়। ইংরেজদের হাত ধরে মীরজাফর মসনদে বসেন। মতিঝিল কিছুটা নির্জন স্থানে থাকায় সিরাজ বিরোধীরা এখানে এসে শলাপরামর্শের সুবিধেটাও পেত।
নবাব আলিবর্দী খাঁ, পুত্র না থাকায় তাঁর আদরের দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে তাঁর পরবর্তী বাংলার নবাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে যান। আলিবর্দী খাঁ দরবারে স্নেহভাজন দৌহিত্রকে পাশে বসিয়ে ঘোষণা দেন, “আমার পরে সিরাজ-উদ-দৌলাই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মসনদে আরোহণ করবে।” ইতিহাসে এই ঘটনাকে সিরাজ-উদ-দৌলার যৌবরাজ্যাভিষেক বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই সময়ে সিরাজ-উদ-দৌলার বয়স ছিল মাত্র সতেরো বছর। তবে তাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করার ঘটনা তার আত্মীয়বর্গের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। অনেকেই তার বিরোধিতা শুরু করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন আলিবর্দী খাঁর বড় মেয়ে ঘসেটি বেগম এবং তার স্বামী নওয়াজিশ মোহম্মদ। এতে ঘসেটি বেগম রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তিনি চেষ্টা করেছিলেন দ্বিতীয় বোনের পুত্র শওকত জংকে সিংহাসনে বসানোর, কারণ তিনি জানতেন স্বাধীনচেতা, সাহসী সিরাজকে বশে রেখে ক্ষমতা ভোগ করা যাবে না। তাই তিনি সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সুযোগ খুঁজতে লাগলেন। এছাড়া হোসেন কুলী খাঁর সঙ্গে ঘসেটি বেগমের অবৈধ সম্পর্ক ছিল অনুমান করে নবাব আলিবর্দী সিরাজকে ইঙ্গিত করেন হোসেন কুলী খাঁকে হত্যা করতে। সিরাজ সেই নির্দেশ পালন করেন। এ কারণেও ঘসেটি বেগম সিরাজউদ্দৌলার প্রতি বিরূপ হন।
ঘসেটি বেগমের ওপর সিরাজউদ্দৌলার মনোভাবও কখনই প্রসন্ন ছিল না। কেবল আলিবর্দী খাঁর জন্য বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেননি। ঘসেটি বেগম যে কখনও চাননি সিরাজ নবাব হোক তা সিরাজ বুঝতে পারতেন। প্রকৃতপক্ষে আলিবর্দী খাঁ মারা যাবার আগেই সিরাজউদ্দৌলার বিপক্ষ দল যে ঘসেটি বেগমকেই কেন্দ্র করে বেড়ে উঠেছিল সেটা সকলেই টের পেয়ে গিয়েছিলেন। এমনকী সিরাজউদ্দৌলার মনে দৃঢ় ধারণা হয়েছিল, ইংরেজরাও নাকি ওই দলে আছে। সুতরাং প্রথমেই ঘসেটি বেগমের চক্রান্ত চূর্ণ করার জন্য তিনি সচেষ্ট হন। আর তাই একদিন মতিঝিল প্রাসাদের সামনে গিয়ে থামল সিরাজ-বাহিনী। ধীরে ধীরে ঘেরাও হয়ে গেল প্রাসাদ। চারিদিকে একটা থমথমে ভাব, এই বুঝি যুদ্ধ লেগে যায়। খবর গেল ঘসেটি বেগমের কাছে, তাকে বন্দী করা হবে। এক নবাবের কন্যা তিনি, ফলে নবাবী বৈশিষ্ট্য তিনিই বা কম দেখাবেন কেন? তাই তিনিও সিদ্ধান্ত নিলেন প্রতিরোধের। কিন্তু সিরাজবাহিনীর বিরুদ্ধে ঘসেটিবাহিনী কোনও প্রতিরোধই গড়তে পারবে না। তাসের ঘরের মতোই ভেঙ্গে যাবে তাদের প্রতিরোধের যাবতীয় প্রচেষ্টা। সেসময় সিরাজের বিরুদ্ধে শেষ সিদ্ধান্ত নেবার জন্য নাচ-গানের জলসার আড়ালে গোপন বৈঠক চলছিল ঘসেটির মতিঝিল প্রাসাদে। দেউড়িতে কড়া পাহারায় সশস্ত্র প্রহরী। আলোচনা যখন অগ্রসর হচ্ছিল তখন হঠাৎ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে তার গোপন বৈঠকের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখে অসাধারণ বুদ্ধিমতী ঘসেটি বেগম মনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। নবাব তাঁর খালাআম্মা ও উপস্থিত সবাইকে জানিয়ে দেন, তিনি নিজে এসেছেন তাঁর শ্রদ্ধেয়া খালাআম্মাকে নিজের প্রাসাদে নিয়ে যেতে। বুদ্ধিমতী নারী বুদ্ধির খেলায় নিজের কোলেপিঠে মানুষ করা বোনপোর কাছে শোচনীয়ভাবে হেরে গিয়ে হতাশায় ভেঙ্গে পড়েন। ক্ষোভে দুঃখে তিনি পাগলিনী হয়ে যান। মুখের খোলশ আর তিনি বজায় রাখতে পারেন না। তিনি প্রকাশ্যে উপস্থিত ওমরাহদের সাহায্য কামনা করেন। তিনি একজন বিধবা, তাঁর ওপর সিরাজ ওভাবে অত্যাচার করছে জানিয়ে তিনি রাজবল্লভ, জগৎ শেঠ প্রমুখ ব্যক্তিদের সাহায্য কামনা করেন। দুঃখে, হতাশায়, আশাভঙ্গের বেদনায় তিনি সিরাজকে অভিশাপ দেন। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই উচ্চাভিলাষী রমণীর সকল আশার সমাধি রচনা করে নবাবের আদেশে মোহনলাল তাঁকে সসম্মানে নিয়ে যান নবাবের প্রাসাদে, নবাব-জননী তাঁর ছোটবোন আমিনা বেগম আর নবাব মহিষী লুৎফুন্নেসার কাছে।
মতিঝিল চড়াও হয়ে সিরাজউদ্দৌলা ঘসেটি বেগমের লোকজন সব তাড়িয়ে দিয়ে সৈন্যসামন্তদের কয়েদ করে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি লুঠে নিলেন। ঘসেটি বেগমের স্বামীর অনেকদিনের সঞ্চিত বিস্তর টাকাকড়ি, প্রচুর ধনরত্ন সমস্তই সিরাজউদ্দৌলার হাতে এসে গেল। তার জন্য সিরাজকে যুদ্ধ করতে হয়নি, বেগমের লোকজনদের ঘুষ দিয়েই কাজ সেরে ফেলেছিলেন তিনি। বেগম-সাহেবা নিজে নিতান্ত প্রাণে মারা গেলেন না বটে, কিন্তু তাঁকে আর মতিঝিলে বাস করতে হল না। রাতের আঁধারে ঘসেটি বেগমকে একটি বজরা নৌকায় করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার পথে, তাঁকে জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দী করে রাখার উদ্দেশ্যে। অবশ্য তাঁর সেবাযত্ন ও দেখাশোনায় কোনোরকম ত্রুটি রাখা হয়নি। ঈর্ষা ও হিংসায় অন্ধ, বন্দিনী ঘসেটির কণ্ঠে তাই ধ্বনিত হয় সিরাজের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও অভিশাপ। এক অসহায় নারীর দীর্ঘশ্বাসে এবং অকল্যাণের কামনায় প্রতিনিয়ত শিকার হন সিরাজ ও লুৎফা। এমনকী সিরাজের দুর্দিনে তিনি যেমন মনের খুশি গোপন করেন না, তেমনই পলাশির প্রান্তরে নিজের মুক্তি এবং নবাবের নবাবির অবসান আসন্ন জেনে উৎফুল্ল হন। এভাবেই এক রাজপরিবারের অনাথা বিধবা ঈর্ষা-হিংসা ও স্বার্থপরতার জীবন্ত বাস্তব চরিত্র হয়ে ওঠে। তিনি সিরাজের সর্বনাশ কামনা করেন, বাংলার সিংহাসন থেকে তাঁকে বিতাড়িত করবার জন্য তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেন। অথচ ছেলেবেলায় সিরাজকে তিনিই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিলেন। সিরাজ-জননী সে কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি বলেন, “অদৃষ্টের পরিহাস, তাই ভুল করেছিলাম। যদি জানতাম বড় হয়ে সে একদিন আমার সৌভাগ্যের অন্তরায় হবে, যদি জানতাম অহরহ সে আমার দুশ্চিন্তার একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়াবে, জীবনের সমস্ত সুখশান্তি সে গ্রাস করবে রাহুর মতো, তাহলে দুধের শিশু সিরাজকে প্রাসাদ চত্বরে আছড়ে মেরে ফেলতে কিছুমাত্র দ্বিধা করতাম না।”
সিরাজ বাংলার নবাব আর তিনি তাঁর প্রজা, এ ব্যাপারটা ছিল তাঁর কাছে অত্যন্ত অসহ্য। নবাব তাঁকে নিজের প্রাসাদে এনে আবদ্ধ করে রেখেছেন, দেশের অশান্তি দূর না হওয়া পর্যন্ত বাইরের কারও সঙ্গে যাতে তিনি যোগাযোগ করতে না পারেন সে ব্যবস্থা করেছেন। নবাবের এ ব্যবস্থা ছিল যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কিন্তু ঘসেটি বেগম তাতে ভীষণ ক্ষুব্ধ। ঘসেটি সিরাজের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ও অভিসম্পাত করেছেন কিন্তু রাজনৈতিক কারণেই সিরাজ ঘসেটিকে গৃহবন্দী করে রেখেছিলেন। তাতে ঘসেটি আরও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। ঘসেটির মুখেই সেই প্রতিহিংসার কথা প্রকাশ পায় – “আমার রাজ্য নাই, তাই আমার কাছে রাজনীতিও নাই, আছে শুধু প্রতিহিংসা।” এই প্রতিহিংসা তাঁর পূর্ণ হবে সেইদিন যেদিন সিরাজের প্রাসাদ অপরে অধিকার
করবে, তাঁকে সিংহাসন থেকে ঠেলে ফেলে কেউ হত্যা করবে। সিরাজ-বিরোধী ষড়যন্ত্রে
তিনি ছিলেন প্রধান ব্যক্তি। নবাব বিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে ইংরেজ তোষণে বাংলার পতন ডেকে আনতেও পিছপা হননি তিনি। শুধুমাত্র রাজ্য লোভে সন্তানতুল্য সিরাজের বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন ঘসেটি। এই চরিত্রে নারীসুলভ সুকুমার মনোবৃত্তি তো ছিলোই না বরং কর্কশ নির্মমতা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর নিঃশ্বাসে যেন বিষ, দৃষ্টিতে আগুন, অঙ্গ সঞ্চালনে ভূমিকম্প। স্নেহময়ী নারীর কোনো স্বভাব বৈশিষ্ট্য ঘসেটির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তিনি মানবী নন, দানবী। সিরাজ তাঁকে মায়ের সম্মান দিয়েছিলেন কিন্তু ঘসেটির মধ্যে মায়ের স্নেহ ছিল না। ছিল তীব্র প্রতিহিংসার দহনজ্বালা। তিনি এক কুচক্রী, স্বার্থান্বেষী, প্রতিহিংসাপরায়ণা কূট নারী।
পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ে মীরজাফরের থেকেও ঘসেটি বেগমের ভূমিকাই ছিল বড়। তিনি সিরাজের সমস্ত শত্রুদের এক ছাতার তলায় এনে উসকে দিয়েছিলেন। এই মতিঝিলেই হয়েছিল সিরাজ বধের প্রথম চক্রান্ত যেখানে তাঁর সঙ্গে সামিল ছিলেন আলিবর্দী খানের সেনাপতি মীরজাফর, ব্যবসায়ী জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায় বল্লভ, রাজা নন্দকুমার, রাজা স্বরূপচাঁদ, ইয়ার লতিফ খান, লর্ড ক্লাইভ এনারা। এঁদের বিশ্বাসঘাতকতায় পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয় হলে পরাজিত বিধ্বস্ত নবাব পাটনায় যাবার পথে সপরিবারে ধরা পড়েন। তাঁকে নিয়ে আসা হয় মুর্শিদাবাদে। মীরজাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে মোহম্মদী বেগ তাঁর শিরশ্ছেদ করেন।
পরদিন যখন সিরাজের মৃতদেহ হাতির পিঠে করে মুর্শিদাবাদ শহরে ঘোরানো হয় রাস্তার দু’পাশে অগণিত প্রজাদের চোখে জল, ওদিকে আনন্দে ফেটে পড়লেন তার আপন মাসি ঘসেটি বেগম। আনন্দে তিনি সকলকে মিষ্টিমুখ করালেন।
পলাশীতে জয় হয়েছিল খলেরই। আম্রকাননে এক বিষবৃক্ষের মতোই যেন মীরজাফর, জগৎ শেঠদের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ঘসেটি বেগম। ইংরেজদের সব মিলিয়ে ছিল ৯৫০ গোরা আর ২১০০ সেপাই। সঙ্গে মাত্র আটটি কামান আর দুটি বড় তোপ। অন্যদিকে সিরাজের ছিল জঙ্গি আর ঘোড়সওয়ার মিলে ৫০ হাজার সৈন্য এবং ৫৩টি বড় কামান। কিন্তু জয় হলো ঘসেটি বেগমেরই। ২৫ বছর বয়সে মাত্র ১৪ মাস নবাব থাকার পর সিরাজ ঘসেটির ক্রোধ আর হিংসার দাবানলে পুড়েছেন অহরহ।
নবাব আলিবর্দী খাঁ’র মৃত্যুর পরে সিরাজ নবাব হলে চারিদিকে শুরু হয় প্রচন্ড অরাজকতা ও ষড়যন্ত্র। কলকাতায় ইংরেজদের প্রতাপ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ঘসেটি বেগমের প্রশ্রয়ে তারা সিরাজকে অমান্য করতে শুরু করে। ঘসেটি বেগম নবাব আলিবর্দী খাঁর সেনাপতি মীরজাফর, ব্যবসায়ী জগৎ শেঠ এবং উমিচাঁদের সঙ্গে গোপনে ষড়যন্ত্র করেন। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ পরাজিত হন এবং ইংরেজরা মীরজাফরকে নবাব বানান।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর নবাব মীরজাফর মুর্শিদাবাদে প্রথমেই পরাজিত নবাবের মাতা আমিনা বেগমসহ ঘসেটি বেগমকে বন্দি করেন। অতঃপর তাদের ঢাকায় সরিয়ে নেন এবং তাদের ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে অন্তরীণ করে রাখেন। কিন্তু ঘসেটিকে বিপজ্জনক শত্রু মনে করে মীরজাফর পুত্র মীরন ১৭৬০ সালে তাঁকে মুর্শিদাবাদে ফেরত নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। পলাশী যুদ্ধ পরবর্তীতে তিনি নিজেও শিকার হয়েছিলেন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের। এর পরই ঘসেটি বেগম নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি নবাব পত্নী লুৎফাকে সতর্ক করেছিলেন, ‘যেভাবে, যে পথেই তাঁরা পালান, যেন নদীপথে তাঁরা না যান।’ লুৎফা প্রথমবারের মত ঘসেটি বেগমের চোখে মাতৃত্বের ছায়া দেখেছিলেন। তার মনে হয়েছিল, ‘হয়ত নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন তিনি’। ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে বাংলার মানুষের কাছে তিনি বরাবর ঘৃণিত ও জটিল মানসিকতার প্রতীক এক চরিত্র। এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক গঠন নিয়ে বেড়ে ওঠা ঘসেটি বেগমের জীবনাবসানও হয়েছিল করুণ এক অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে। ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে মানুষের ঘৃণা আর অবজ্ঞাই কুড়িয়েছেন শেষাবধি।
তাই ঘসেটি বেগম আজ আর শুধু ব্যক্তিমাত্র নন। তাঁর এ নাম আজ বিশেষ্য থেকে হয়েছে বিশেষণ। যুদ্ধ শেষে তার সাঙ্গাত মীরজাফর নবাব হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবেই হয়তো কুষ্ঠরোগে ১৭৬৫ সালে মারা যান তিনি। নবাবির লোভে মত্ত মীরন, সিরাজের বংশের একটি ছেলেকেও যে জ্যান্ত ছাড়েনি, তার মৃত্যু বজ্রাঘাতে। কী দুঃখে কে জানে রবার্ট ক্লাইভ মরেছিলেন নিজের গলায় নিজেই ক্ষুর চালিয়ে। আর ঘসেটি বেগম? একদার দোসর মীরজাফরের ছেলে মীরনের কূটকৌশলে করুণ এক সলিল সমাধি হয়েছিল তাঁর ঢাকার অদূরে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা আর ধলেশ্বরীর ত্রিমোহনায়। সঙ্গে সলিল সমাধি হয় সিরাজের মা নিরপরাধী আমিনা বেগমেরও। দুইবোনকে একসঙ্গে একজায়গায় বন্দী করে রাখা হয়, তাদের বুঝতে না দেবার জন্য একসঙ্গেই দু’জনকে মুর্শিদাবাদ পাঠানোর ছল করা হয়। মীরন দায়িত্ব দিলেন তার বিশ্বস্ত অনুচর আসফ খাঁকে। মিশন – ঘসেটি ও আমিনা বেগমের বিশ্বাসভাজন হয়ে তাদের খতম করে দেওয়া।
অল্প সময়ের মধ্যেই দুই বোনেরই আস্থার পাত্র হয়ে যান আসফ। বিশেষ করে ঘসেটি বেগমকে তিনি বোঝাতে সক্ষম হন যে, আসলে তাঁকে নিতেই ঢাকায় এসেছেন আসফ। কারণ, সিরাজদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যূত করতে তাঁর অবদানের কথা ভুলে যাননি মীরজাফর। তাই তাঁকে মুর্শিদাবাদে এনে সম্মানীত করতে চান তিনি। জাঁকজমকে পরিপূর্ণ মতিঝিল প্রাসাদ আবারও ঘসেটি বেগমের হাতে তুলে দিতে চান। ফলে মুর্শিদাবাদে ফিরে যেতে ঘসেটি বেগমের আর তর সইছিল না। ওদিকে আমিনা বেগমের রাজি হওয়ার কারণ ছিল ভিন্ন। তাকে বলা হয়েছিল, তিনি মুর্শিদাবাদের খোশবাগে পুত্র সিরাজের কবর প্রদক্ষিণের অনুমতি পেয়েছেন। কবর প্রদক্ষিণ শেষে আবারও তাঁকে এখানে ফিরিয়ে দিয়ে যাওয়া হবে।
অবশেষে সময়-সুযোগমতো একদিন দুই বোনকে রাতে এক বজরায় দুটো আলাদা রুমে তুলে দেওয়া হয়। তাঁদের কেউই একে অপরের উপস্থিতি সম্পর্কে জানতেন না। পাশে ছিল আরেকটি বজরা। গভীর রাতে দুই বোনের বজরা ছেড়ে মাঝিরা চলে গেলো অন্য বজরায়। কেন? দুই বোন যে বজরায় করে যাচ্ছিলেন তা বানানো হয়েছিল বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে। এর নিচের দিকে কয়েকটি বড় ছিদ্র করে সেগুলো খিল দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। মাঝিরা অন্য নৌকায় যাওয়া মাত্রই আসফ খিলগুলো খুলে ফেলেন। ফলে নৌকায় খুব দ্রুত জল ঢুকে যেতে শুরু করে। দু’বোন তখন বুঝতে পারেন যে তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। আমিনা বেগম প্রাণভিক্ষা চাননি। তিনি কেবল সৃষ্টিকর্তার কাছে মীরনের বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি চেয়ে দোয়া করেছিলেন। বলেছিলেন,
“হে আল্লাহ, তুমি মীরনের অপরাধী মস্তকের উপর বিনা মেঘে বজ্রপাত নিক্ষেপ করে বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার দিও।”
ওদিকে ঘসেটি বেগম অনেক অনুনয়-বিনয় করেন, অতীত স্মরণ করিয়ে দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে তিনিও মীরজাফর আর মীরনের পক্ষেরই লোক। বলেছিলেন, “মীরজাফর সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করায় সিরাজ তা জানতে পেরে পদচ্যুত করেছিলেন তাঁকে। ঐ দুঃসময়ে আমি মীরজাফরকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছি। মীরজাফরের কোনো ক্ষতি তো আমি করিনি।” কিন্তু তাঁর এসব আবেগপূর্ণ ও কান্নামাখা কথায় চিঁড়ে ভেজেনি। যাদেরকে তিনি এককালে রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশি আপন বলে মনে করেছিলেন, তাদেরই পাতা ফাঁদে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় তাঁকে। অসহায়ভাবে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে বুড়িগঙ্গার জলে ডুবে যেন নিজের বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম ভোগ করলেন ঘসেটি বেগম।
এইভাবে নিঃসন্তান ঘসেটি বেগম হলেন ইতিহাসের ঘৃণ্য, কুচক্রী মহিলা। বাংলা – বিহার – উড়িষ্যার মাটি ঠাঁই দেয়নি এই কুচক্রীকে, নৌকাডুবিতে মৃত্যু হয় তাঁর। সাড়ে-তিন-হাত মাটিও জোটেনি এই বিশ্বাসঘাতিনী ক্ষমতালোভীর কপালে।
তথ্য ঋণ
আমি সিরাজের বেগম- শ্রী পারাবত
পলাশীর যুদ্ধ – তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়
অন্তর্জাল
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন