মধুজা বন্দ্যোপাধ্যায়
বৈষ্ণব তীর্থ হিসেবে সুবিখ্যাত বাংলার নদীয়া জেলার নবদ্বীপ। অনেক গবেষকের মতে নবদ্বীপই মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেবের জন্মস্থান। কিন্তু বৈষ্ণব ভক্তির বিশাল পরিধির বাইরেও আছে অন্য এক নবদ্বীপ যা বাংলার শাক্ত পরম্পরার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই প্রাচীন বৈষ্ণবভূমির বুকে।
মধ্যযুগের বাংলা ছিল ভারতবর্ষের প্রথম সারির শিক্ষাপীঠ। চৈতন্যভাগবতে আছে –
“নানা দেশ হইতে লোকে নবদ্বীপে যায়।
নবদ্বীপে পড়িলে সে বিদ্যারস পায়।।”
পঞ্চদশ শতকের বাংলার বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন বাসুদেব সার্বভৌম – একদিকে তিনি ছিলেন নব্যন্যায়ের প্রণেতা, অন্য দিকে তাঁর খ্যাতি ছিল চৈতন্যদেবের শিক্ষক হিসেবে। এই বাসুদেব সার্বভৌম নবদ্বীপের বটতলায় কালীর ঘট স্থাপন করেন। আর তাকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলেন তাঁর চতুষ্পাঠী। সেই দেবী পরিচিত ‘পোড়া মা’ নামে। কথিত আছে এক অগ্নিকান্ডে সেই বটতলা পুড়ে গেলে দেবী ‘পোড়া মা’ বলে প্রসিদ্ধ হন। এই পোড়া মা মূর্তি রূপে আরাধিতা নন।
দেবী কালীর দক্ষিণাকালীর কল্যাণী মূর্তি যা আজ বাঙ্গালীর ঘরে পূজা পায় – সে রূপের রূপকার ছিলেন শ্রী কৃষ্ণানন্দ আগম্বাগীশ। দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে কৃষ্ণানন্দর জন্ম ১৬০৫ থেকে ১৬১০ সালের মধ্যে। সময়টা ষোড়শ শতকের বাংলা। এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের কাল।
বাংলার শক্তিশালী বারো ভুঁইয়া – একে একে বশ মানছেন মুঘল শাসনের কাছে। সবচেয়ে ক্ষমতাবান ভুঁইয়া ঈশা খাঁ মারা গেলে একে একে হার স্বীকার করছেন রাজা কেদার, যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য। জাহাঙ্গীরের প্রতিনিধি মান সিঙ্ঘের কাছে প্রতাপাদিত্যের হার বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি ধর্মের ইতিহাসেও এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যশোরের দেবী যশোরেস্বরী কালীর মন্দির সতিপীঠের অন্যতম। কথিত আছে দেবী সতীর হাতের তালু পড়েছিল এখানে। প্রতাপাদিত্যের পরাজয়ের পর মানসিংহ সেই দেবী নিয়ে গিয়ে রাখেন রাজস্থানে তাঁর নির্মিত অম্বর দুর্গে। এই দুর্গের গণেশ দরজা লাগোয়া মন্দিরে দেবী আজও পূজা পান শিলামাতা রূপে। ১৬০৪ সালে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার বিবরণ আছে রায় গুণাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদা মঙ্গলে।
শিলাময়ী নামে ছিলা তার ধামে
অভয়া যশোরেস্বরী।
পাপেতে ফিরিয়া বসিল রুষিয়া
তাহারে অকৃপা করি।।
বুঝিয়া অহিত গুরু পুরহিত
মিলে মান সিংহ রাজে
লস্কর লইয়া সত্বর হইয়া
প্রতাপাদিত্য সাজে।।
নদীয়া রাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদার মান সিংহের দাক্ষিণ্যে রাজা হয়েছিলেন তাই পূর্বপুরুষের গৌরব গাথা রচনাকালে তাঁরই নির্দেশে হয়ত ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গলে উপরের পংক্তিখানি লিখেছিলেন। এই তথ্য না দিয়া তথা বাংলার কালী সাধনার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়- কারণ এই সময়কাল পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে হয় যন্ত্রে নয় শিলায় পূজিত হতেন দেবী কালীকা। যশোরেস্বরী দেবী শিলা তারই সাখ্য বহন করে। যদিও পাল বা সেন যুগে কালীর যে মূর্তি পাওয়া যায় তার সঙ্গে বজ্রযান বৌদ্ধ দেবী তারার মিলই বেশী। সে রূপ ভীষণা। কালীর মঙ্গলময়ী রূপ- যে রূপে আজও বাংলার ঘরে ঘরে তিনি পূজিত হন – সেই দক্ষিণা কালীর রূপকার নদীয়ারই পন্ডিত শ্রী কৃষ্ণানন্দ আগম্বাগীশ। কৃষ্ণানন্দের সময়কাল চৈতন্য পরবর্তী বাংলা। একটু একটু করে কমে আসছে বৈষ্ণব ধর্মের উদারতাবাদ। এক কালে যে ধর্ম কৃষ্ণ প্রেমের উপর ভিত্তি করে মুক্তি দিয়েছিল মানুষকে সেখানেও চলে আসছে জাতিভেদ, বর্ণভেদ আর দলাদলি। অন্যদিকে ভারতীয় তন্ত্র শাস্ত্রের মূল ভিত্তি যে শক্তিবাদ তাও ধীরে ধীরে বিকৃত হতে থাকে তান্ত্রিক দুরাচারে। তন্ত্রের দক্ষিণাচারী দর্শন নয় বাংলায় তখন বামাচারী দর্শন মানে আক্ষরিক অর্থেই পঞ্চ “ম”কার মানে – মদ্য, মাংস, মৎস, মুদ্রা ও মৈথুনে লিপ্ত বাংলার তন্ত্র সমাজ। এই ব্যাভিচার থেকে বাংলাকে রক্ষা করার জন্যই ১৭ শতকে কৃষ্ণানন্দ লিখলেন বৃহৎ তন্ত্র সার। কৃষ্ণানন্দ বুঝেছিলেন তন্ত্র গৃহী মানুষের মনে এক ভয়ের জন্ম দেয়। তাই, চৈতন্যর সময় কালে যে ভক্তি মার্গে ভেসেছিল বাংলা, তারই প্রভাব পড়ল তাঁর শাক্ত মার্গে। ১৭০ টি তন্ত্রর বই এর মূল ভাব নিয়ে কৃষ্ণানন্দ রচনা করেন বৃহৎ তন্ত্র সার গ্রন্থের। দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে এই বইটি লেখার সময়কাল ১৬৬৮ থেকে ৮৮ সালের মধ্যে। এই বইটিতে কালীর বন্দনায় আগম্বাগীশ লিখছেন –
জয় জয় দেবী চরাচর সারে।
নয় নয় মাত রঘার্ণবপারে।।
জহি জহি ভারত দুরগতিঘরং।
কুরু কুরু মাত রুপেক্ষীত্রাণম।।
অর্থাৎ দুর্গতি বিনাশ করে ভারত সন্তানদের ত্রাণ কর মা।
তন্ত্রে পরিমার্জনা করেই থেমে যাননি আগম্বাগীশ। গৃহী মানুষের ঘরে করালবদনাকে তিনিই বানিয়েছিলেন মঙ্গলময়ী দক্ষিণা কালী। কিংবদন্তী আছে, কোনও এক কার্তিকের ভোরে গোপ পল্লীর এক শ্যামাঙ্গী বধূর আদলেই কৃষ্ণানন্দ গড়েছিলেন মায়ের দয়াময়ী রূপ। পঞ্চমুন্ডীর আসনে প্রতিষ্ঠিত হন দক্ষিণা কালী। আজও নবদ্বীপের আগম্বাগীশ তলায় কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমীতে খড় বাধা দিয়ে মূর্তি নির্মাণের সুচনা হয়। একাদশীতে অবয়ব আর অমাবস্যায় চক্ষুদান।
কৃষ্ণানন্দের এই ভক্তিভাবই পরবর্তী কালে প্রভাবিত করে রাম প্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য ও রামকৃষ্ণ পরমহংসকে।
নদীয়ায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রর আমল থেকে বাংলায় এই ভক্তিমূলক শাক্ত ধর্মের বিশাল প্রসার শুরু হয় শ্রীরামপুরের পাদ্রী ওয়ার্ড সাহেবের তথ্য অনুযায়ী নদীয়ায় কার্ত্তিকী অমাবস্যায় নাকি দশ হাজার দক্ষিণা কালী পুজো হত।
পোড়া কালী, আগম্বাগীশ কালীর পাশাপাশি নবদ্বীপ সমান জনপ্রিয় ভবতারিণী কালী। শোনা যায়, -নদিয়ায় কৃষ্ণচন্দ্রের পুর্বপুরুষ – ১৬৬৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এক গণেশ মূর্তি। একশো বছর পর ১৭৬০ সালে নবদ্বীপে গঙ্গার ভাঙ্গনে মন্দির সহ সে মূর্তিও ভেঙ্গে যায়। পণ্ডিতদের নির্দেশে কৃষ্ণচন্দ্র তাকে রাখেন মাটির নীচে। একশো বছর পর কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র গিরিশ চন্দ্রের আমলে মাটির নীচ থেকে সে মূর্তি উদ্ধার করায় ভেঙ্গে গেল তার শুঁড়। পণ্ডিতদের নির্দেশে সেই গণেশ মূর্তি শুঁড় বাদ দিয়ে তার থেকে নির্মিত হল ভবতারিনী কালী। গনেশের মতো তাই তিনি পাদ্মাসনে বসে আছেন শিবের ঊপরে। দেবীর মোটাসোটা চেহারা, বড় কান ও চওড়া জিভ দেখলে এখনও গনেশের আদল বোঝা যায়। পোড়া মায়ের মন্দিরের চত্বরেই তাঁর আজও অবস্থান। পাশে আছেন ভবতারণ শিব। ১৮২৫ সালে নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এই মন্দির।
শাক্ত ও বৈষ্ণব ভেদাভেদ ঘোচাতে অদ্বৈত আচার্যর উত্তরসুরি মথুরেশ গোস্বামী কৃষ্ণানন্দ আগম্বাগীশের প্রপৌত্রের সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন – এই ঘটনা সে সময়ের নিরিখে বৈপ্লবিক। বর্তমান সময়ে যেভাবে সনাতন ধর্মের ছাতার নীচে হিন্দু ধর্মকে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চলছে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলার এক জেলা নদীয়া দীর্ঘদিন ধরে বয়ে চলেছে বহুত্ববাদের ইতিহাস।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
Such an information rich piece. Khub bhalo laglo pore.