সাবিনা ইয়াসমিন রিংকু
আজকাল পুতুল ভীষণ জ্বালাচ্ছে। কাজ করতে এসে কানের কাছে সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করছে— “তোমার রান্নার হাত এত ভালো, একটা হোম ‘ডিলিভারি’ খোল না বৌদি! খদ্দের আমি জোগাড় করে দেব। পঞ্চবটীর বাইশ নাম্বার ফেলাটে রোশনী বৌদি ব্যবসা জমিয়ে ফেলেছে। খালি রাজমা, গাট্টে কা সবজি, শুখা আলুর দম বানিয়ে পোচুর টাকা কামাচ্ছে। আর তোমার হাতে তো জাদু আছে! আমিষ, নিরামিষ সবেতেই তুমি সেরা। তুমি রান্নার ব্যবসা খুললে আর দেখতে হবে না। পাড়ার বেপাড়ার সবাই তোমাকেই অডার দেবে।”
পুতুলের কথা শুনে মজা পায় কুমু। এই বয়সে এসে ব্যবসা! চৌধুরি সাহেব তো কম টাকা রেখে যান নি! অবশ্য করোনার সময়ে ওই টাকা কোনও কাজে আসেনি। জীবনে মদ, সিগারেট না খাওয়া চৌধুরী সাহেবের ফুসফুসটাকে পুরোই খেয়ে ফেলেছিল কোভিড। কুমুও হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল। সে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও চৌধুরী সাহেব ফেরেননি। হাসান চৌধুরীকে চৌধুরী সাহেব বলেই ডাকত কুমু। মাঝেমাঝে আহ্লাদিপানা করে ডাকত হাসু। যে সময় তারা বিয়ে করেছিল, সেই সময় হিন্দু মুসলমানের বিয়ে হওয়া মানে বড় খবর। সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না বটে ,কিন্তু সে খবর বাতাসে তুলোর মত উড়ে গিয়ে দূর দূরান্তে পৌঁছে যেত দ্রুত। চৌধুরী সাহেব মায়ের সঙ্গে থাকতেন। সৈনিকদের বুট তৈরির কারখানা ছিল তাঁদের। বেকবাগানে নিজেদের বিশাল বড় তিনতলা বাড়ি। দুটো গাড়ি। পাঁচিলঘেরা বিশাল বাগান।
কুমুদের বাড়ি ছিল কোলকাতা এয়ারপোর্টের একেবারে গা ঘেঁষে, নারায়ণপুরে। চৌধুরী সাহেবের এক দূর সম্পর্কের ভাগ্নেকে ইংরেজি পড়াতে হবে। সেই সূত্রেই প্রথম চৌধুরী ভিলায় পা রেখেছিল কুমু। চৌধুরী সাহেবের দেশের বাড়ি বসিরহাট। ওখানেও পেল্লাই বাড়ি। প্রচুর আত্মীয়। কলকাতায় পড়াশোনা করতে এলে বা ডাক্তার দেখাতে এসে তারা সবাই চৌধুরী ভিলাতেই উঠত।
কুমুর শাশুড়ি অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। পোলাও, বিরিয়ানি, কাবাব, কোরমা, কোপ্তা, ফিরনি রান্নায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তবে নিরামিষ রান্নায় খুব একটা পারদর্শী ছিলেন না। কুমু তাঁকে মোচা, এচোড়, পনীর, কচুর লতি রাঁধা শিখিয়েছিল। তখনও সে মিসেস চৌধুরী হয়নি। ইংলিশ দিদিমণি কেবল। ৪৫ নম্বর বাস ধরে পড়াতে আসত সে। সপ্তাহে তিনদিন। নাসিম বানু, চৌধুরী সাহেবের মা ঠিক এক তারিখে একটা খাম ধরিয়ে দিতেন তার হাতে। পড়ানোর মাঝখানে তিনি নিজেই প্লেটে করে নিয়ে আসতেন পরোটা বা রোল। কখনও চালের আটার রুটি, ছোলার ডালের হালুয়া। সঙ্গে গাঢ় দুধের চা। ওপরে সর ভাসত।
কুমুর মুখে বা ব্যবহারে এমন কিছু একটা ছিল বলেই বোধহয় কদিনের মধ্যেই সে যেন চৌধুরী বাড়ির সদস্য হয়ে গেল! তখন ৪৫ নম্বর বাসের বদলে সে চৌধুরী সাহেবের সব চেয়ে দামী গাড়িতে চড়ে পড়াতে আসত। ড্রাইভার রহমান তাকে নিয়ে আসত, আবার পড়ানো হয়ে গেলে বাড়ি পৌঁছে দিত।
কুমু কোনোদিন ভালো করে তাকায়নি চৌধুরী সাহেবের দিকে। খুব লজ্জা করত। কিন্তু কেন লজ্জা করত, বুঝতে পারত না। অথচ পেপারের বিজ্ঞাপন দেখে সে যখন এই বাড়িতে এসেছিল, তখন চৌধুরী সাহেবই তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তাকে বলেছিলেন এত দূরে এসে পড়াতে তার কোনো অসুবিধে হবে কী না! তখন সে রবীন্দ্রভারতী থেকে ইংলিশে মাস্টার্স করছিল, হাত খরচের জন্য টাকার প্রয়োজন ছিল। প্রাইভেট পড়ানোর হিসেবে টাকার অঙ্কটা বেশ লোভনীয় ছিল। চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে রোজ দেখা হতো না। যেদিন দেখা হতো, বুকের মধ্যে ড্রাম বাজত। গলা শুকিয়ে যেত। আবার দেখা না হলেও ভালো লাগত না। উৎসুক নয়নদুটি কেবল এদিক সেদিক করত। চৌধুরী সাহেবের ভাগ্নের কাছ থেকে কায়দা করে জেনে নিত তিনি কখন বেরিয়েছেন, কখন ফিরবেন! বেশিরভাগ দিনই ভাগ্নেটি কোনও সদুত্তর দিতে পারত না। যেদিন পারত, সেদিন বেশি সময় ধরে পড়াত আর মনে-মনে চৌধুরী সাহেবের জন্য অপেক্ষা করত। নাসিম বানু এবং ড্রাইভারের সঙ্গে যখনই তার কথা হতো, কেবল চৌধুরী সাহেবের প্রসঙ্গ আনত সে। কী খেতে ভালোবাসেন! রাগী কী না! কী ফুল ভালোবাসেন! মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল কুমুর।
আগুন লাগলে কী আর একদিক থেকে লাগে! দুই দিক থেকেই আগুন লাগল। চৌধুরী ভিলায় একেকদিন কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে কুমু সকালে চলে আসত, বাড়ি ফিরত সেই সন্ধেবেলায়। এই বাড়ি, ফুলের বাগান, এই বাড়ির মানুষগুলোকে ভালো লাগতে শুরু করেছিল। নাসিম বানুর পোষা বেড়াল হামানদিস্তা তাকে পছন্দ করেছিল। সে এলেই ছুটে আসত।
কোনও একটা শবেবরাতের আগের দিনে কুমু নাসিম বানুর পাশটিতে বসে শিখে ফেলেছিল গোটা মশলায় মাটন। কোনরকম বাটা মশলা ছাড়াই নাসিম বানু কী সুন্দরভাবে মাংসটা রান্না করেছিলেন। মাংসের ঘ্রাণ বাগান ছাড়িয়ে সদর গেট টপকে অনেকদূর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল।
এখনও মনে আছে সেই রেসিপি।
গোটা মশলায় মাটন
উপকরণ: মাটন ১ কেজি, আটটা গোটা শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা ২ টো, আস্ত ছোট সাইজের পেঁয়াজ খোসা ছাড়িয়ে নেওয়া ৬/৭ টা, গরমমশলা ১০ গ্রাম, আদা কুচো, রসুন কুচো, এক কাপ পেঁয়াজ কুচি, টক দই ১০০ গ্রাম, সর্ষের তেল এবং নুন পরিমাণ মতো।
প্রণালী: মাংস ধুয়ে তাতে দই মাখিয়ে রেখে দিতে হবে তিন চারঘণ্টা। এবার কড়াইতে তেল গরম করে গোটা গরম মশলা, তেজপাতা, কিছুটা শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিতে হবে। কুচো পেঁয়াজ তেলে দিয়ে হালকা ব্রাউন করে ভেজে মাংস দিয়ে দিতে হবে। নেড়েচেড়ে আদা কুচি, রসুন কুচি এবং বাকি শুকনো লঙ্কাগুলো আধখানা করে মাংসে দিতে হবে। খানিক কষে এক কাপ মত গরম জল দিয়ে কড়াইয়ের ঢাকনা এঁটে দিয়ে ঢিমে আঁচে মাংসটা রান্না করতে হবে। কিছুক্ষণ পরে ঢাকা খুলে মাংসটা নেড়ে আস্ত পেঁয়াজগুলো দিয়ে দিতে হবে। জল লাগলে আরেকটু গরমজল দেওয়া যেতে পারে। যখন মাংস সেদ্ধ হয়ে যাবে এবং তেল ভেসে উঠবে, তখন গ্যাস অফ করে দিতে হবে।
পুতুলের কথা শুনে মজা পায় কুমু। এই বয়সে এসে ব্যবসা! চৌধুরি সাহেব তো কম টাকা রেখে যান নি! অবশ্য করোনার সময়ে ওই টাকা কোনও কাজে আসেনি। জীবনে মদ, সিগারেট না খাওয়া চৌধুরী সাহেবের ফুসফুসটাকে পুরোই খেয়ে ফেলেছিল কোভিড। কুমুও হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল। সে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও চৌধুরী সাহেব ফেরেননি। হাসান চৌধুরীকে চৌধুরী সাহেব বলেই ডাকত কুমু। মাঝেমাঝে আহ্লাদিপানা করে ডাকত হাসু। যে সময় তারা বিয়ে করেছিল, সেই সময় হিন্দু মুসলমানের বিয়ে হওয়া মানে বড় খবর। সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না বটে ,কিন্তু সে খবর বাতাসে তুলোর মত উড়ে গিয়ে দূর দূরান্তে পৌঁছে যেত দ্রুত। চৌধুরী সাহেব মায়ের সঙ্গে থাকতেন। সৈনিকদের বুট তৈরির কারখানা ছিল তাঁদের। বেকবাগানে নিজেদের বিশাল বড় তিনতলা বাড়ি। দুটো গাড়ি। পাঁচিলঘেরা বিশাল বাগান।
কুমুদের বাড়ি ছিল কোলকাতা এয়ারপোর্টের একেবারে গা ঘেঁষে, নারায়ণপুরে। চৌধুরী সাহেবের এক দূর সম্পর্কের ভাগ্নেকে ইংরেজি পড়াতে হবে। সেই সূত্রেই প্রথম চৌধুরী ভিলায় পা রেখেছিল কুমু। চৌধুরী সাহেবের দেশের বাড়ি বসিরহাট। ওখানেও পেল্লাই বাড়ি। প্রচুর আত্মীয়। কলকাতায় পড়াশোনা করতে এলে বা ডাক্তার দেখাতে এসে তারা সবাই চৌধুরী ভিলাতেই উঠত।
কুমুর শাশুড়ি অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। পোলাও, বিরিয়ানি, কাবাব, কোরমা, কোপ্তা, ফিরনি রান্নায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তবে নিরামিষ রান্নায় খুব একটা পারদর্শী ছিলেন না। কুমু তাঁকে মোচা, এচোড়, পনীর, কচুর লতি রাঁধা শিখিয়েছিল। তখনও সে মিসেস চৌধুরী হয়নি। ইংলিশ দিদিমণি কেবল। ৪৫ নম্বর বাস ধরে পড়াতে আসত সে। সপ্তাহে তিনদিন। নাসিম বানু, চৌধুরী সাহেবের মা ঠিক এক তারিখে একটা খাম ধরিয়ে দিতেন তার হাতে। পড়ানোর মাঝখানে তিনি নিজেই প্লেটে করে নিয়ে আসতেন পরোটা বা রোল। কখনও চালের আটার রুটি, ছোলার ডালের হালুয়া। সঙ্গে গাঢ় দুধের চা। ওপরে সর ভাসত।
কুমুর মুখে বা ব্যবহারে এমন কিছু একটা ছিল বলেই বোধহয় কদিনের মধ্যেই সে যেন চৌধুরী বাড়ির সদস্য হয়ে গেল! তখন ৪৫ নম্বর বাসের বদলে সে চৌধুরী সাহেবের সব চেয়ে দামী গাড়িতে চড়ে পড়াতে আসত। ড্রাইভার রহমান তাকে নিয়ে আসত, আবার পড়ানো হয়ে গেলে বাড়ি পৌঁছে দিত।
কুমু কোনোদিন ভালো করে তাকায়নি চৌধুরী সাহেবের দিকে। খুব লজ্জা করত। কিন্তু কেন লজ্জা করত, বুঝতে পারত না। অথচ পেপারের বিজ্ঞাপন দেখে সে যখন এই বাড়িতে এসেছিল, তখন চৌধুরী সাহেবই তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তাকে বলেছিলেন এত দূরে এসে পড়াতে তার কোনো অসুবিধে হবে কী না! তখন সে রবীন্দ্রভারতী থেকে ইংলিশে মাস্টার্স করছিল, হাত খরচের জন্য টাকার প্রয়োজন ছিল। প্রাইভেট পড়ানোর হিসেবে টাকার অঙ্কটা বেশ লোভনীয় ছিল। চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে রোজ দেখা হতো না। যেদিন দেখা হতো, বুকের মধ্যে ড্রাম বাজত। গলা শুকিয়ে যেত। আবার দেখা না হলেও ভালো লাগত না। উৎসুক নয়নদুটি কেবল এদিক সেদিক করত। চৌধুরী সাহেবের ভাগ্নের কাছ থেকে কায়দা করে জেনে নিত তিনি কখন বেরিয়েছেন, কখন ফিরবেন! বেশিরভাগ দিনই ভাগ্নেটি কোনও সদুত্তর দিতে পারত না। যেদিন পারত, সেদিন বেশি সময় ধরে পড়াত আর মনে-মনে চৌধুরী সাহেবের জন্য অপেক্ষা করত। নাসিম বানু এবং ড্রাইভারের সঙ্গে যখনই তার কথা হতো, কেবল চৌধুরী সাহেবের প্রসঙ্গ আনত সে। কী খেতে ভালোবাসেন! রাগী কী না! কী ফুল ভালোবাসেন! মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল কুমুর।
আগুন লাগলে কী আর একদিক থেকে লাগে! দুই দিক থেকেই আগুন লাগল। চৌধুরী ভিলায় একেকদিন কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে কুমু সকালে চলে আসত, বাড়ি ফিরত সেই সন্ধেবেলায়। এই বাড়ি, ফুলের বাগান, এই বাড়ির মানুষগুলোকে ভালো লাগতে শুরু করেছিল। নাসিম বানুর পোষা বেড়াল হামানদিস্তা তাকে পছন্দ করেছিল। সে এলেই ছুটে আসত।
কোনও একটা শবেবরাতের আগের দিনে কুমু নাসিম বানুর পাশটিতে বসে শিখে ফেলেছিল গোটা মশলায় মাটন। কোনরকম বাটা মশলা ছাড়াই নাসিম বানু কী সুন্দরভাবে মাংসটা রান্না করেছিলেন। মাংসের ঘ্রাণ বাগান ছাড়িয়ে সদর গেট টপকে অনেকদূর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল।
এখনও মনে আছে সেই রেসিপি।
উপকরণ: মাটন ১ কেজি, আটটা গোটা শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা ২ টো, আস্ত ছোট সাইজের পেঁয়াজ খোসা ছাড়িয়ে নেওয়া ৬/৭ টা, গরমমশলা ১০ গ্রাম, আদা কুচো, রসুন কুচো, এক কাপ পেঁয়াজ কুচি, টক দই ১০০ গ্রাম, সর্ষের তেল এবং নুন পরিমাণ মতো।
প্রণালী: মাংস ধুয়ে তাতে দই মাখিয়ে রেখে দিতে হবে তিন চারঘণ্টা। এবার কড়াইতে তেল গরম করে গোটা গরম মশলা, তেজপাতা, কিছুটা শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিতে হবে। কুচো পেঁয়াজ তেলে দিয়ে হালকা ব্রাউন করে ভেজে মাংস দিয়ে দিতে হবে। নেড়েচেড়ে আদা কুচি, রসুন কুচি এবং বাকি শুকনো লঙ্কাগুলো আধখানা করে মাংসে দিতে হবে। খানিক কষে এক কাপ মত গরম জল দিয়ে কড়াইয়ের ঢাকনা এঁটে দিয়ে ঢিমে আঁচে মাংসটা রান্না করতে হবে। কিছুক্ষণ পরে ঢাকা খুলে মাংসটা নেড়ে আস্ত পেঁয়াজগুলো দিয়ে দিতে হবে। জল লাগলে আরেকটু গরমজল দেওয়া যেতে পারে। যখন মাংস সেদ্ধ হয়ে যাবে এবং তেল ভেসে উঠবে, তখন গ্যাস অফ করে দিতে হবে।
কুমুর মনের খবর কুমুর নিজের বাড়ির লোকেরা টের পায়নি। একদিন সন্ধেবেলায় প্রবল ঝড়বৃষ্টি। তখনও মোবাইলের যুগ আসেনি। ল্যান্ডফোনই ভরসা। চৌধুরী সাহেবের বসার ঘরে একটা কালো রংয়ের হুমদো ল্যান্ডফোন ছিল। কুমুর বাড়িতে ফোন ছিল না। কুমুদের নিম্ন মধ্যবিত্ত পাড়ায় কারোর বাড়িতেই ফোন ছিল না। রাস্তার মোড়ে ভুট্টোর দোকানে পয়সা দিয়ে ফোন করা যেত। বছরে দু তিনবার আত্মীয় পরিজনের মৃত্যুর খবর এলে ভুট্টো দয়া করে নির্দিষ্ট বাড়িতে গিয়ে সেই সংবাদ শুনিয়ে আসত।
সেদিন ঝড় বৃষ্টি থেমে গেলে বেশ রাতে চৌধুরী সাহেব নিজেই ড্রাইভ করে কুমুকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন।
চৌধুরী সাহেব একটা বিশেষ পারফিউম ব্যবহার করতেন। গন্ধটাকে কুমু ভালোবেসে ফেলেছিল। সেদিন গাড়ির সামনের সিটে চৌধুরী সাহেবের পাশে বসে কেমন যেন উতলা হয়ে পড়েছিল কুমু।
“তোমার বৃষ্টি ভালো লাগে?”
কথাটা শুনতেই পায়নি কুমু।
“ভালো লাগে না বৃষ্টি?”
স্বপ্নরাজ্য থেকে ফিরে এসেছিল কুমু।
খুব ভালো লাগে।
“আর আদা চা?”
কী বলবে কুমু? বৃষ্টি, আদা চা আর আপনাকে…… খুব, খুব ভালো লাগে!
তেঘরিয়ার কাছে রাস্তার ধারে একটা ঝুপড়ি চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়েছিলেন চৌধুরী সাহেব। তখন আজকের মত এত চকচকে রেস্টুরেন্ট, দোকান বাজার হয়নি। মেঘ কেটে আকাশে তখন চাঁদের আলো। সেই আলোয় চৌধুরী সাহেবের মনটা পড়ে ফেলেছিল সে।
আজকেও পুতুল কাজে এসে কুমুর মাথা খারাপ করে দিল।
“অ বৌদি, কী ঠিক করলে গো? হোম ‘ডিলিভারি’ খুলবা না? দুগ্গা পুজো তো এসেই গেল! এখুনি খুললে সপতুমি, অষ্টুমি, নবমী, দশমীর অডার পেয়ে যাবে। তোমার সেই ছানার কোপ্তার রেসিপিটা নিরামিষের দিনে যা জমবে না! খদ্দেরদের দিয়ে কূল পাবা না….”
নিরামিষ রান্নায় কুমুর মা খুবই পারদর্শী ছিল। যেকোনো নিরামিষ রান্না তার মায়ের হাতের গুণে স্পেশাল হয়ে উঠত। লক্ষ্মী পুজোতে, জন্মাষ্টমীতে মা নিজের হাতে ভোগ রান্না করত। চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে তার বিয়ের কথায় বাড়ির কেউ খুশি হয়নি। মুসলমানদের সম্বন্ধে খুব একটা ভালো ধারণা পোষণ করত না তার বাড়ির লোকেরা। ওপার বাংলা থেকে নিজের ঘরবাড়ি, জমি, বাগান, স্বাচ্ছন্দ্য রেখে এক কাপড়ে চলে আসার বেদনা কখনও ভুলতে পারেনি। এমন একটাও দিনের কথা কুমুর মনে পড়ে না যেদিন ঠাকুমা বরিশালের কথা বলেননি। কলকাতায় এতদিন বাস করার পরেও বুকের ভেতরে একখণ্ড বরিশালকে লালন করতেন।
কুমু বুঝিয়েছিল চৌধুরী সাহেবের পরিবারটি শিক্ষায়, রুচিতে, বিত্তে অনেক এগিয়ে, তবুও তার বাড়ির লোক এই সম্পর্কে সায় দেয়নি।
বাবা বলেছিলেন, “আমরা তোমাকে নিষেধ করব না, মতও দেব না।”
ঠাকুমা আরও আশ্চর্য কথা বলেছিল। “বিয়ার পর আওনের দরকার নাই। আমাগো সহ্য হবে না।”
চৌধুরী সাহেব বলেছিলেন, “তাহলে থাক। এত ঝামেলার প্রয়োজন নেই। বিয়ের কারণে নিজের বাড়িটাই যদি না থাকে, তাহলে এমন বিয়ে না হওয়াই ভালো।”
কুমু খুব মৃদু কন্ঠে উত্তর দিয়েছিল, বাড়িটা আদৌ আমার? না কী মেয়েদের নিজের কোনো বাড়ি হয়!
ও বাড়ি থেকে আসার সময় কিছুই আনেনি কুমু। সবসময় পরে থাকত যে সোনার হারটা, সেটাও খুলে রেখে এসেছিল।
অনেকটা অভিমান আর মায়ের কতগুলো অসাধারণ নিরামিষ রেসিপি মনের মধ্যে ভরে চৌধুরী ভিলায় পা দিয়েছিল, স্থায়ীভাবে।
ছানার কোপ্তাকারি মায়ের একটা অন্যতম সেরা রান্না ছিল। এ বাড়িতে কুমু সরস্বতী, লক্ষ্মী পুজো করত। ছাদে একটা ঠাকুরঘর বানানো হয়েছিল। একেকদিন কুমু পুজো করতে উঠলে, শাশুড়িও উঠতেন। কুমুর পাশে বসতেন। চৌধুরী সাহেবও বিশেষ বিশেষ দিনে ঠাকুরঘরে গিয়ে বসতেন।
পুজোর ভোগে মায়ের রেসিপিতে ছানার কোপ্তাকারি রান্না ক’রে কুমু ঠাকুরকে নিবেদন করত। এখনও করে।
উপকরণঃ ছানা বড় এককাপ, ময়দা ২ টেবিল চামচ, একটা বড় সাইজের সেদ্ধ আলু, কড়াইশুঁটি সেদ্ধ হাফ কাপ, হলুদ গুঁড়ো, গরমমশলার গুঁড়ো, অল্প বেসন।
গ্রেভির জন্য লাগবে—আদা, কাঁচালঙ্কা, ধনে, জিরে… সব একসঙ্গে বাটা, কাজুবাদামের টুকরো, টমেটো কুচি, ছানার জল, স্বাদ অনুযায়ী নুন, চিনি, সর্ষের তেল।
প্রণালী: দুধ কাটিয়ে ছানা তৈরি করে একটা সুতির কাপড়ের ওপরে রেখে জল ঝরিয়ে নিতে হবে। এবার ছানার সঙ্গে ময়দা মিশিয়ে মসৃণভাবে মেখে ছোট ছোট বল বানিয়ে নিতে হবে।
এরপর আলু ও কড়াইশুঁটি চটকে নিতে হবে। ওর মধ্যে কাজুবাদাম কুচো, নুন, চিনি, হলুদগুঁড়ো গরমমশলা গুঁড়ো লঙ্কাকুচি দিয়ে নাড়াচাড়া করে নামিয়ে নিতে হবে। এবার তা ছানার বলগুলোর মধ্যে ভরে দিয়ে বেসনে মাখিয়ে বলগুলোকে বাদামী করে ভেজে নিতে হবে। এবার কড়ায় তেল দিয়ে জিরে, শুকনো লঙ্কা,গরমমশলা ফোড়ন দিয়ে ধনে জিরে কাঁচালঙ্কা আদা বাটাটা দিয়ে দিতে হবে। টমেটো কুচি, নুন, চিনি, হলুদগুঁড়ো দিয়ে ভালো করে কষিয়ে নিতে হবে। এবার ছানার জল দিয়ে বলগুলো ফুটিয়ে নিয়ে গরমমশলার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলেই রেডি।
উপকরণঃ ছানা বড় এককাপ, ময়দা ২ টেবিল চামচ, একটা বড় সাইজের সেদ্ধ আলু, কড়াইশুঁটি সেদ্ধ হাফ কাপ, হলুদ গুঁড়ো, গরমমশলার গুঁড়ো, অল্প বেসন।
গ্রেভির জন্য লাগবে—আদা, কাঁচালঙ্কা, ধনে, জিরে… সব একসঙ্গে বাটা, কাজুবাদামের টুকরো, টমেটো কুচি, ছানার জল, স্বাদ অনুযায়ী নুন, চিনি, সর্ষের তেল।
প্রণালী: দুধ কাটিয়ে ছানা তৈরি করে একটা সুতির কাপড়ের ওপরে রেখে জল ঝরিয়ে নিতে হবে। এবার ছানার সঙ্গে ময়দা মিশিয়ে মসৃণভাবে মেখে ছোট ছোট বল বানিয়ে নিতে হবে।
এরপর আলু ও কড়াইশুঁটি চটকে নিতে হবে। ওর মধ্যে কাজুবাদাম কুচো, নুন, চিনি, হলুদগুঁড়ো গরমমশলা গুঁড়ো লঙ্কাকুচি দিয়ে নাড়াচাড়া করে নামিয়ে নিতে হবে। এবার তা ছানার বলগুলোর মধ্যে ভরে দিয়ে বেসনে মাখিয়ে বলগুলোকে বাদামী করে ভেজে নিতে হবে। এবার কড়ায় তেল দিয়ে জিরে, শুকনো লঙ্কা,গরমমশলা ফোড়ন দিয়ে ধনে জিরে কাঁচালঙ্কা আদা বাটাটা দিয়ে দিতে হবে। টমেটো কুচি, নুন, চিনি, হলুদগুঁড়ো দিয়ে ভালো করে কষিয়ে নিতে হবে। এবার ছানার জল দিয়ে বলগুলো ফুটিয়ে নিয়ে গরমমশলার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলেই রেডি।
এই বাড়ির বউ হওয়ার পরেরদিনই শাশুড়ি তাকে রান্নাঘরের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ঘরোয়া রান্নাগুলো সে এত ভালো করত যে ও আসার পর চৌধুরী সাহেব পোলাও বিরিয়ানি খেতে চাইতেন না। সরু চালের ভাত, ডাল, একটা পাঁচমিশালি সবজি, মাছের ঝোল আর দেশি চিকেন কষা থাকত রোজকার মেনুতে। কাঁটাবিহীন মাছ পছন্দ করতেন বলে পাবদা, ভেটকি, ট্যাংরা, আড় খুব প্রিয় ছিল ওঁর। কাতলার রসা, রুইমাছের দোপেঁয়াজা পছন্দ করতেন।
কুমু বিরিয়ানিটা শাশুড়ির কাছ থেকে খুব মন দিয়ে শিখেছিল । তবুও কিছুতেই শাশুড়ির মত হতো না। শাশুড়ি যে বিরিয়ানি বানাতেন তার মশলা আসত নিউমার্কেট থেকে। বিরিয়ানি বানালে চার পাঁচ কেজি চালের বিরিয়ানি বানাতেন শাশুড়ি। হাজী মিট শপ থেকে আসত চালের দ্বিগুণ পরিমাণ দেশি ছাগলের মাংস। প্রতিবেশীরা সেই বিরিয়ানির ভাগ পেতেন।
মাংস তৈরির উপকরণ: মাটন ১ কেজি, জল ঝরানো টকদই ২০০ গ্রাম, ৪ টে পেঁয়াজ ঝিরিঝিরি কাটা, আদা রসুন বাটা ৪ টেবিল চামচ, শুকনো লঙ্কাগুঁড়ো ২ টেবিল চামচ, ছোট এলাচ ৮ টা, বড় এলাচ ৪টে, দারচিনির কাঠি ৪ টে, তেজপাতা ৪টে, আলুবোখারা ৮ টা, সাদা তেল এবং নুন পরিমাণ মতো।
প্রণালী: প্রেশারকুকারে তেল গরম করে পেঁয়াজ ভেজে নিতে হবে। এবার মাংস দিয়ে একটু ভেজে বাকি সব মশলা এবং টকদই দিয়ে কষিয়ে নিতে হবে। নুন এবং চারকাপ গরম জল দিয়ে প্রেশারকুকারের ঢাকনা এঁটে মাংস সেদ্ধ করতে হবে এবং ঝোল থাকতেই গ্যাস অফ করে দিতে হবে।
আলু তৈরির উপকরণ: চন্দ্রমুখী আলু মাঝারি সাইজের ১০টা খোসা ছাড়িয়ে নেওয়া, আদা রসুনবাটা ২ চামচ, ঘি, গুঁড়োলঙ্কা, গরমমশলা, একবাটি দুধ, ৪টে আলুবোখারা, নুন, চিনি (আধ চা চামচ)
প্রণালী: একটা পাত্রে দুধ দিয়ে তাতে বাটা মশলা, লঙ্কাগুঁড়ো, নুন, চিনি, ঘি ২ চামচ, গরমমশলা, আলুবোখারা দিয়ে একদম শুকনো শুকনো করে সেদ্ধ করে নিতে হবে।
ভাত তৈরির উপকরণ: বাসমতি চাল ১ কেজি, নুন, ছোট এলাচ ৪ টে, বড় এলাচ ৪টে, লবঙ্গ ৬ টা, দারচিনি তিন টুকরো।
প্রণালী: চাল আধঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন। একটা হাঁড়িতে জল দিয়ে তাতে গরমমশলা এবং নুন দিয়ে টগবগ করে ফোটান। জল ফুটে উঠলে চাল দিয়ে দিন। চাল আধসেদ্ধ হলে জল ঝরিয়ে নিন।
দম দেওয়ার আগে যেগুলো হাতের কাছে রাখতে হবে, সেগুলো হল……কেওড়া জলে ভেজানো জাফরান, অল্প গোলাপ জল, বড় এক কাপ দুধ, একটা বড় পেঁয়াজ ঝিরিঝিরি করে কেটে মুচমুচে করে ভেজে নেওয়া, আলুবোখারা, বিরিয়ানি মশলা, মিঠা আতর, ২ কাপ ঘি।
দম দেওয়ার পদ্ধতি: একটা বড় হাঁড়িতে পুরো ঘি’টা গরম করে হাঁড়ির ভেতরটাতে মাখিয়ে নিয়ে এককাপ ঘি তুলে রেখে দিতে হবে। তারপর হাঁড়ির ঘিয়ের মধ্যে খানিকটা মাংসের ঝোল দিতে হবে। মাটনের পিসগুলো সাজিয়ে দিয়ে বিরিয়ানি মশলা ছড়িয়ে দিতে হবে। এই সময় আলুবোখারা দিতে হবে। একটু কেওড়ার জল যোগ করতে হবে। তারপর আলুগুলো সাজিয়ে আবার অল্প বিরিয়ানি মশলা দিতে হবে। ভাজা পেঁয়াজ, ঘি ছড়িয়ে এমনভাবে ভাত বিছিয়ে দিতে হবে যাতে মাংস, আলু দেখা না যায়! এরপর ভাতের ওপরে বাকি বিরিয়ানি মশলা, মাংসের ঝোল, আলুবোখারা, ঘি, দুধ, জাফরান, অল্প গোলাপজল, ভাজা পেঁয়াজ দিয়ে ঢাকনা এঁটে ঢিমে আঁচে আধঘন্টা দমে বসিয়ে রাখতে হবে। দম দেওয়া সম্পূর্ণ হলে গ্যাস অফ করে আরও আধঘণ্টা পরে ঢাকনা খুলে বিরিয়ানি সার্ভ করতে হবে।
মুসলিম বাড়িতে এসে কুমুকে নিজের ধর্ম পালনে কেউ বাধা দেয়নি। গ্রাম থেকে আসা আত্মীয়রা এ নিয়ে মনে-মনে বিক্ষোভ দেখালেও মুখে কিছু বলতে সাহস পেত না। চিকিৎসা বা বেড়াতে এসে কোলকাতায় থাকা খাওয়ার এমন একটা নিশ্চিন্ত জায়গা হারাতে চায়নি তারা। কুমু খুব বলত চৌধুরী সাহেব আমার একটা মুসলিম নাম দাও না গো।
অনেক কষ্টে এবং বহু অনুশীলনের পর আপনি থেকে তুমি হয়েছিলেন চৌধুরী সাহেব।
খুব ঘনিষ্ট মুহূর্তে আপনি সম্বোধন করলে চৌধুরী সাহেব বলতেন “কুমু তুমি কি আমায় আপন করে নিতে পারোনি?”
কুমু বলত, খুব চেষ্টা করি। কিন্তু মুখ ফসকে আপনি বেরিয়ে যায়। আগে আমার একটা নাম দাও। শর্মিলা ঠাকুর যেমন বিয়ের পরে বেগম আয়েশা সুলতানা হয়েছিলেন!
“ধুর! কুমুদিনী নামটা তোমার জন্য একদম পারফেক্ট। মুসলিম ফ্যামিলিতে বিয়ে হয়েছে বলেই এতদিনের নামটা পাল্টে ফেলতে হবে?”
এই জন্য চৌধুরী সাহেবকে এত ভালো লাগত কুমুর। তিনি এখন নেই। কিন্তু তাঁর প্রতি সেই একইরকম ভালো লাগা রয়ে গিয়েছে।
বিয়ের পরে চাকরি করা নিয়ে এ বাড়িতে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। কিন্তু শাশুড়ির বয়স হচ্ছিল, তিনি আর আগের মত সবকিছু দেখাশোনা করতে পারছিলেন না। এত বড় বাড়ি কাজের লোকের ওপরে ছেড়ে দিলে কাঠের দামী আসবাবপত্রের ওপরে পুরু ধুলো জমে থাকত। মালী গাছগুলোকে সার জল দিয়ে সতেজ করত বটে, কিন্তু কলির গায়ে কুমু হাত না বুলিয়ে দিলে ফুল ফুটত না। অনেকগুলো কুকুরবেড়ালকে খাওয়াতে হতো নিয়মিত। কুমু চাকরি করলে এসব কী করে হতো!
তারপর শুভ আসার পরে ব্যস্ততা চারগুণ বেড়ে গেল। মাকে খবর দেওয়া হয়েছিল। চৌধুরী সাহেব নিজে গিয়েছিলেন খবর দিতে। বাইরের ঘরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল অনেকক্ষণ।
তারপর মা এসে চৌধুরী সাহেবকে নিরাসক্ত কন্ঠে বলেছিল, “খুব ভালো। আশীর্বাদ রইল।”
চৌধুরী সাহেবরা এপার বাংলার মানুষ। দাদা, পরদাদা…. সকলেই পশ্চিমবঙ্গের। দেশভাগের কলঙ্কের কোনও চিহ্ন তাদের গায়ে ছিল না। কিন্তু কুমুর পরিবার চৌধুরী সাহেবকে দেখলেই রেগে যেত।
কুমু শাশুড়ির কাছ থেকে মায়ের ভালোবাসা, যত্ন পেয়েছিল। কিন্তু নিজের মায়ের অভাব কি কখনও পূরণ হয়! গোপন ব্যথার জায়গাটি চৌধুরী সাহেব অনুভব করতেন এবং কুমুর জন্য কষ্ট পেতেন।
শুভ আসার পর চৌধুরীবাড়ি আরও ঝলমলিয়ে উঠল।
শাশুড়ি নাতির নাম রেখেছিলেন সাহিল। কুমু আর চোধুরী সাহেবের দেওয়া নাম শুভ।
সেইসময় দিনগুলো চরম ব্যস্ততার সঙ্গে পার হতে লাগল। কুমু যখন একটু ফুরসৎ পেয়ে নিজের দিকে তাকাল, দেখল বেলা অনেকখানি গড়িয়ে গেছে। চৌধুরী সাহেব আরও ব্যক্তিত্ববান হয়েছেন। আর তার নিজের চুলগুলো প্রায় বেশিরভাগটাই সাদা হয়ে গেছে।
ইতিমধ্যে প্রিয় নাতির কোলে মাথা রেখে নাসিম বানু ইহলোক ত্যাগ করলেন। শুভ চাকরি করতে বাইরে চলে গেল। বিয়ে করে ওখানেই থিতু হল।
চৌধুরী সাহেব, মিসেস কুমু চৌধুরী, কাজের মেয়ে পুতুল, বৃদ্ধ ড্রাইভার রহমান, পুরোনো মালী নিয়ে দিন কাটতে লাগল। তারপর চৌধুরী সাহেবও চলে গেলেন!
বাড়িটা খা খা করে এখন। বসিরহাট থেকে আত্মীয়রা কোনো কারণে কোলকাতায় এসে চৌধুরী ভিলায় উঠলে কুমু খুশি হয়। যত্ন করে। আবার আসতে বলে।
“কী গো বৌদি! তুমি কিন্তু কিচ্ছু বললা না!”
কী ব্যাপারে? না বোঝার ভান করল কুমু।
“রান্নার ব্যবসা করবা কী না! আমি পাড়ায় কাউরে বলতে পারছি না। এদিকে আমার পেট ফাটতেছে।”
বুঝেছি। তোর কষ্টটা খুব বুঝতে পারছি। হাসল কুমু। কিন্তু শুরুটা কী দিয়ে করব…. সেটাই তো বুঝতে পারছি না!
“কেন! বিরানি আর ফিরনি। সবচেয়ে লোভনীয় খাবার। আমার তো শুনলেই খেতে ইচ্ছা করে!”
ফিরনির কথা শুনে কুমুর মনে পড়ল শাশুড়ি তাকে শিখিয়েছিলেন বাদাম ফিরনি। সে স্বাদ ভোলার মত নয়।
উপকরণ: দুধ ১ লিটার, বাসমতি চাল ৫০ গ্রাম, চিনি, আমন্ড বাদাম, জাফরান ১ চিমটে, গোলাপজল ১ ফোঁটা।
প্রণালী: বাসমতি চাল ভিজিয়ে রেখে দিতে হবে। তারপর জল ছেঁকে পেপারের ওপরে রেখে জল শুকিয়ে নিতে হবে। চাল শুকনো হয়ে গেলে গুঁড়ো করে নিতে হবে। চাল একটু দানা দানা থাকলে ভালো। আমন্ড বাদামগুলো তাওয়ায় সেঁকে খোসা ছাড়িয়ে গুঁড়িয়ে নিতে হবে।
এবারে জাফরান মিশিয়ে দুধ ফুটিয়ে ঘন করে নিয়ে চালেরগুঁড়ো দিয়ে ক্রমাগত নেড়ে যেতে হবে। আমন্ড গুঁড়ো, চিনি দিতে হবে। থকথকে হলে গ্যাস বন্ধ ক’রে গোলাপজল মেশাতে হবে। তারপর মাটির বাটিতে ঢেলে আমন্ড বাদামের কুচি সাজিয়ে পরিবেশন করতে হবে।
ফিরনির কথা শুনে পুতুল নেচে উঠল। মুখ দিয়ে লোভ লাগা একটা অদ্ভুত রকমের শব্দ বের করে বলল
“ওহ! বৌদি গো, কী যে ভালো হবে! তুমি শুরু করে দাও। পুতুল তোমার সঙ্গে জান লড়িয়ে দেবে।”
আহা… জান লড়ানোর কিছু নেই। তুই বিষয়টা পাঁচকান করে দিলেই হবে।” পুতুলের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসল কুমু।
কুমু ভাবল আজ রাতে এই পরিকল্পনাটার কথা শুভকে জানাবে। কুমু জানে শুভ বলবে… “মা এখন তুমি এত ঝামেলা নিতে পারবে না। আরেকবার ভেবে দেখো।”
চৌধুরী সাহেব থাকলে খুব খুশি হতেন। কুমুর যেকোনো কাজে তাঁর খুব উৎসাহ, আনন্দ, সহযোগিতা থাকত। চৌধুরী সাহেবের কথা খুব মনে পড়ছে কুমুর।
কুমুকে উদাস দেখে পুতুল বলল…. “এত কী ভাবতেছ বুঝি না! নেমে পড়। দেখবা খুব ভালো লাগবে।”
কুমু হাসল। পুতুলের চিবুকটা ধরে বলল… পাকা বুড়ি একটা! ভাবছি রান্নার ব্যবসা করতে গেলে একটা নাম লাগবে তো!
পুতুলের ঠোঁটের ডগায় উত্তর রেডি ছিল। একটুও সময় নষ্ট না করে বলল, “কুমুর হেঁশেল।”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব ভালো লাগলো, আর রেসিপি গুলো তো অসাধারণ।
অসাধারণ। রেসিপি এবং গল্প দুই ই ।
অসাধারণ লিখেছেন, খুব ভাল লাগল পড়ে। রেসিপি গুলো সব কটাই ট্রাই করব।
Heartwarming. Writing and recipes, both
কুমুর জবাব নেই, লাজবাব…
যেমন লেখা, তেমন মেনু।
অপূর্ব! গল্পে বিরানির খুশবু এবং বিরিয়ানিতে গল্পের মৌতাত!
ভালো লাগলো। অনায়াস, সাবলীল লেখনী।
কি সুপাক পরিবেশনা।! এমন পাকে পাকে রেঁধেছেন আর বেঁধেছেন!