মুক্ত গদ্য
রূপা মজুমদার
সারাজীবন নারী ভোগের পর রাজা ভর্তৃহরি যেদিন বৈরাগ্যে এলো তিনি আক্ষেপ করে লিখলেন –
“গলায় বন্ধনরজ্জু, অনাহারে কঙ্কালসার কুকুরও কুকরীকে দেখে, খাদ্য অন্বেষণ ছেড়ে তার পেছনে ছোটে। এই কামনার শেষ নেই, এ আগুনের নির্বাণ নেই, এ তৃষ্ণার বার্ধক্য নেই। একমাত্র এই তৃষ্ণাই এক পাত্র জল নিঃশেষিত করে আর এক পাত্রের জন্য লেলিহান হয়ে ওঠে।”
ভালো ও মন্দের উর্ধ্বে উঠে যদি ভাবি তাহলে কামনা হল সৃজনের সহচর। তার একমাত্র কাজ হল বীজকে রক্ষা করা। কাম স্বয়ং প্রভু, অন্য কারোর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো ধার ধারে না।
এই কামের নির্দয় প্রভুত্বের একঘেয়েমি থেকে নিজেকে উদ্ধার করবার জন্য মানুষ দ্বিতীয় স্বর্গলোকের মত প্রেমকে আবিষ্কার করেছে। প্রকৃতির রাজ্যে প্রেম নেই। আছে শুধুই ইন্সটিংক্ট অর্থাৎ কাম, সে নিজের নিয়মে চলে সেখানে ইচ্ছা-অনিচ্ছার বালাই নেই। কিন্তু কামের অনুষঙ্গ হিসেবে প্রেম প্রতিষ্ঠা পেয়েছে একমাত্র মানুষের জীবনে। যেখানে কাম সহজাত, প্রেম সেখানে তপস্যা।
প্রেম যদি না আসতো তাহলে সুন্দরবনের বাঘ আর বাঘিনীর যৌন জীবনের সঙ্গে আমাদের যৌন জীবনের কোন তফাৎ থাকতো না। প্রেম না থাকলে মেঘদূত লেখা হতো না। কবিতা কবিতা রচনা করত না।
যৌনতার বাস্তবতার মধ্যে এমন একটা একঘেয়েমি আছে যে দুদিন পরেই আমাদের মনকে ক্লান্ত করে তোলে, তাই প্রতিদিনের জীবনে যৌনতাকে ব্যবহার করতে হলে চাই প্রেমের আবরণ। যেমন আগুনকে উপভোগ করতে হলে একটি আবরণ দরকার হয়, ঠিক তেমনই। আবরণহীন বিদ্যুৎ অপমৃত্যু আনে, আবার আবরণে বদ্ধ বিদ্যুৎ আলো আর শক্তি দেয়। ঠিক সেইরকম প্রেমের আবরণ ব্যতীত যৌনতা ক্লিশে, অনুপভোগ্য।
আমাদের দেশে একজন ঋষি অবশ্য চরম দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন কামকে নিয়ে শাস্ত্র রচনা করে। কিন্তু তিনি তার শাস্ত্রে যে সমাজের কথা, যেসব নর-নারীর কথা লিখেছিলেন, সেই সমাজ আজ চৌষট্টি কলা অভিজ্ঞা বারবনিতার সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তিনি বাদে আমাদের দেশে প্রাচীন শাস্ত্রে বা সাহিত্যে কোন কবি তাঁর ব্যক্তিগত প্রেমের কথা বলেননি। তাদের অধিকার ছিল একমাত্র দেবতা বা রাজার প্রেমের কথা বলবার। মেঘদূত পড়লে, কালীদাসের ব্যক্তিগত অনুভূতির স্পর্শ স্পষ্ট অনুভূত হয়, কিন্তু সেটি প্রকাশ পেয়েছিল নির্বাসিত যক্ষকে সামনে রেখে। ঠিক একই ভাবে বিদ্যাপতিকে তার জীবনের ব্যক্তিগত প্রেম বিরহের কাহিনিকে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের মোড়কে পরিবেশন করতে হয়েছিল। অবশ্য তার দুরন্ত দুঃসাহসে দেবতা, মানুষ রূপে ধরা দিয়েছিলেন সাহিত্যে। যে বিরহ বিচ্ছেদ মানুষের, তাই দিয়ে তিনি দেবতাকে গড়ে তুলেছিলেন। বৈষ্ণব কবিরা প্রেমের একটি ক্রমিক ধারা মেইনটেইন করতেন – প্রথম দর্শন, পূর্বরাগ, রূপ সৌন্দর্য বর্ণনা, প্রেম, মিলন, মান, অভিমান, অভিসার, ব্যর্থ অভিসার, বিরহ।
প্রেমের ব্যক্তিগত প্রকাশের জন্য পাশ্চাত্য দেশে যেতে হয়। গ্যেটের জীবনের সমস্ত প্রেম কাহিনি সুবিস্তৃত ভাবে আমরা জানি, শেলী বা বায়রনের জীবনে কোন নারী তাদের মনে কতটা দোলা দিয়েছিলেন সে খবরও জানি। আসলে পাশ্চাত্য দেশে কৃতি মানুষরা যতই কৃতি হন তারা দেবতা হয়ে যান না, মানুষই রয়ে যান, তাই তাদের অন্তরঙ্গ কাহিনির খবর আমরা পাই। তাতে একটা সুবিধা আছে, সেটা তারা নিজেরাই রেখে যান বলে বিকৃত হবার সম্ভাবনা থাকেনা। আমাদের দেশে বায়রন বা ক্যাসানভা জন্মালে তাদের জীবনী থেকে সংবাদ পেতাম যে তারা অত্যন্ত সাধু পুরুষ ছিলেন, যদি তিনি অবিবাহিত হন তাহলে আজন্ম ব্রহ্মচারী ছিলেন এবং যদি বিবাহিত হন তাহলে পত্নীগত প্রাণ, আদর্শ স্বামী ছিলেন। আসলে আমাদের দেশের কৃতি মানুষদের জীবনীতে তাদের অন্তরঙ্গ কাহিনিগুলোকে সযত্নে বাদ দেওয়া হয়।
বয়সন্ধিক্ষণের সময় মানুষের যেরূপ স্বাভাবিক প্রেমের প্রবণতা জাগে, ঠিক সে রকম যৌবনের আধিপত্যের সীমানা ছাড়িয়ে সে যখন পঞ্চাশের দিকে পা বাড়ায়, সেই সময় প্রকৃতি আরো একবার দেহমনকে বিচারহীন প্রেম প্রবণ করে তোলে। এই কারণেই সংযত জীবনযাপন করা একটি মানুষ হঠাৎ জীবনের মধ্যপথে এসে প্রেম চঞ্চল হয়ে ওঠে। দুষ্মন্ত মৃগয়া করতে এসে গাছের আড়াল থেকে শকুন্তলাকে যখন দেখেছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল পঞ্চাশের কাছাকাছি, কিন্তু তাঁর প্রণয় মুগ্ধতার সঙ্গে তরুণ-তরুণীর প্রণয় মুগ্ধতার কোনো তফাৎ ছিল না। প্রৌঢ় জীবনে প্রেমের দ্বিতীয় বার আক্রমণে নর-নারী আকুল হয়ে ওঠে। পরকীয়ার লজ্জা, জ্বালা, জয়-পরাজয়, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, পরিণতির অভাব প্রেমকে সার্থকতা দেয়।
পুরুষ নারীর মধ্যে শ্রেয়সীকে পুজো করে কিন্তু প্রেয়সীকে অন্তরঙ্গভাবে চায়। পুরুষের সর্বোত্তম কামনা স্ত্রী যদি প্রেয়সী হয়। নারীর সর্বোত্তম কামনা এক দেহে স্বামী ও প্রেমিককে পাওয়া। আমাদের জীবনের ট্রাজেডি হলো স্ত্রী হতে গিয়ে নারী প্রেয়সী হতে ভুলে যায় এবং স্বামী হতে হয়ে পুরুষ প্রেয়সীকে শুধু স্ত্রীতে পরিণত করে ফেলে। ফলে কর্তব্যপরায়ণ সুন্দরী স্ত্রীকে ফেলে পুরুষ ঘুরে বেড়ায় প্রেয়সীর সন্ধানে, আবার আদর্শ স্বামী চন্দ্রশেখরকে পরিত্যাগ করে শৈবালিনী অজানা বিপদসংকুল পথে প্রতাপ-এর সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। স্বামী স্ত্রীর প্রেমকে বলা হয় বৈধ, আবার অবৈধ বলে শাসন করা হয় প্রতাপ শৈবালিনীর প্রেমকে। বৈধ প্রেম কিন্তু সন্তান ছাড়া আর কিছুই প্রসব করে না, অথচ অবৈধ প্রেম সৃষ্টি করেছে যুগ যুগান্তর সঞ্চিত মানুষের বিরাট সাহিত্য-শিল্প সংগীত। যতদিন মানুষের মনে থাকবে সৃজন পিপাসা ততদিন প্রেম তাকে আকর্ষণ করবে। ভালো-মন্দ, উচিত – অনুচিত খাতে যেসব জিনিস সাজিয়ে রাখা যায়, প্রেম কিন্তু সে বস্তু নয়। প্রেমের একমাত্র পরিচয় সে চিরন্তন।
যুগ থেকে যুগে প্রেম সম্বন্ধে মানুষের ভাবনা বদলে এসেছে। যুগে যুগে প্রেম কিন্তু চেহারা বদলে বদলে এসেছে। পৌরাণিক যুগে প্রেম ছিল ঈশ্বরের মতো ইন্দ্রিয়ের স্পর্শের বাইরে, শুধু অনুভূতি গ্রাহ্য, রহস্যাবৃত। তারপর এল মধ্যযুগ, যেখানে দান্তে প্রেমকে অমর করে রেখে গিয়েছেন ডিভাইন কমেডি মহাকাব্যে। অর্থাৎ রূপকথার যুগ। তৃতীয় হলো আধুনিক যুগ অর্থাৎ কামনা – বাসনা দেহ সচেতনতা প্রাধান্য পায়। প্রাচীন প্রেমের আত্মিকতা, আধুনিক প্রেমের দেহসচেতনতা, তার মাঝখানে যোগসূত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রেমের রূপকথার যুগ। পাশ্চাত্য জগতে প্রেম নিয়ে আসে শিভালরি সৌরভ, যেখানে নারীর একটা মুখের কথায় নাইটরা দেহ বিসর্জন দিতে পারতো। আবার পূর্ব জগতে এই প্রেম সৃষ্টি করেছে লায়লা মজনু, রুপমতী রাজাবাহাদুর, আনারকলি সেলিমকে।
এই প্রেমকে শেলী বলেছেন গ্র্যান্ড প্যাশন। মৃত্যু তুচ্ছকারী গ্র্যান্ড প্যাশন আজ জগত থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
আজকের জগতে লায়লা মজনু, সেলিম আনারকালি আর জন্মগ্রহণ করে না।
তাহলে কি জীবন থেকে চলে গেল সেই গ্র্যান্ড প্যাশন নাকি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রেমেরও বিবর্তন হয়েছে। আসলে ডিজিটাল যুগে, যেখানে প্রতি মুহূর্তে ‘এ আই ‘ আমাদের জীবনের নিয়ন্ত্রণকর্তা হয়ে গিয়েছে, সেখানে মুক্ত ভাবনা, চিন্তার প্রক্রিয়া এবং আবেগের ওপরও তার প্রভাব থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই স্বাভাবিক ছন্দে প্রেমে পড়া ব্যাহত হচ্ছে, অগ্রগতি পাচ্ছে যুক্তি এবং তর্ক। সম্পর্কের সমীকরণ বদলে যাচ্ছে, মানুষ আবেগ তাড়িত কম হয় এখন, প্রাধান্য পাচ্ছে যুক্তি সঙ্গত চিন্তা শক্তি। এত হিসেব নিকেশের মধ্যে বেচারি প্রেম এখন কোণঠাসা। আরো একটি ব্যাপার আছে। প্রেম মানে একটু আলো আঁধারি, মান অভিমান, বিরহ বেদনা, দুর্নিবার আকর্ষণ, চুপিচুপি সাক্ষাৎ, প্রগাঢ় ভালবাসা। কিন্তু ‘কর লো দুনিয়া মুটঠিমে’ র যুগে এইসব ভ্যানিশ হয়ে গেছে, মানুষ সবসময়ই কানেক্টেড, তাই প্রেম নামক গ্র্যান্ড প্যাশন বিবর্তিত হয়ে গেছে। হয়ে উঠেছে স্মার্ট। এ আইয়ের যুগে প্রেম এখন অনেক বেশি স্মার্ট।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন