রম্যরচনা
চুমকি চট্টোপাধ্যায়
‘আজকে কীসের গল্প বলবে বাবাই? কালকে যে বাঘের গল্পটা বলেছিলে, সেটা ভালো ছিল না। অন্য গল্প বলো।’
‘আজ একটা দারুণ গল্প বলব। এই গল্প যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে চলে আসছে। একে বলে পুরাণ। আমি শুনেছি, বড় হয়ে বইও পড়েছি। আমার বাবা শুনেছে, আমার ঠাকুর্দাদা শুনেছে, তার বাবা, তার বাবা… বুঝেছিস তো? আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির একটা অঙ্গ এই কাহিনি।’
‘তোমার বাবা, তার বাবা, তার বাবা, তার বাবা লেখাপড়া জানত না?’
‘এমা, কেন জানবে না? কত বড় বড় চাকরি করতেন তাঁরা।’
‘তুমি তো বললে, তুমি শুনেছ আবার পড়েছ। কিন্তু ওরা তো কেবল শুনেছে বললে। ‘
‘আরে ছোটবেলায় সবাই এই গল্প শোনে, বড় হয়ে পড়ে, বুঝলি? ওঁরাও সবাই পড়েছেন। তুই এখন শুনছিস, বড় হয়ে পড়বি। শোন এবারে।’
‘বাবা, ভারতীয় মানে কি ইন্ডিয়া?’
‘ইন্ডিয়া মানে ভারত আর ইন্ডিয়ান মানে হল ভারতীয়।’
‘আর সংস্কিতি মানে? আমাদের ম্যাম? সংস্কিতি ম্যাম আমাদের ড্রয়িং শেখায়।’
‘আরে না রে বাবা, সংস্কৃতি মানে হল কালচার। মানে, কী বলব, এখন অত বোঝার দরকার নেই, বড় হলে বুঝবি। শোন এবার।’
রাজা সান্যাল তার ছেলে সম্রাট, যার ডাক নাম সমু, তাকে গল্প শোনাচ্ছে। আজকাল বাচ্চাদের অতিরিক্ত টিভি, মোবাইলের নেশা নিয়ে অভিভাবকমহল ভয়ানক চিন্তিত। রাজা এবং তার স্ত্রী পারমিতা তাই ঠিক করেছে, এতদিন যা হয়েছে, হয়েছে। এখন থেকে ছেলেকে আগেকার দিনে রাত্রে ঘুমোতে যাবার সময় যেমন গল্প বলা হতো, তেমন গল্প বলবে।
কর্তা গিন্নি দুজনেই চাকরি করে। সমুর বয়েস সাড়ে পাঁচ বছর। আপার কেজিতে পড়ে। স্কুল থেকে ফিরে আয়ামাসির কাছে থাকে। তখন টিভিতে কার্টুন চালাতেই হয় নয়তো খাওয়ানো যায় না।
এভাবে চললে স্ক্রিনের অ্যাডিকশন থেকে বের করা মুশকিল। রাজার খুব ইচ্ছে, ছেলে গল্পের বই পড়ুক। সে নিজে প্রচুর বই পড়ে। পারমিতাও রাজার কাছে কোনো বইয়ের প্রশংসা শুনলে সেই বইটা পড়ে। রাজার ওপরেই মূল দায়িত্ব পড়েছে সমুকে গল্প বলার।
পারমিতা বলে, আগে ওকে রামায়ণ মহাভারতের গল্প বলো। ওর ভালোও লাগবে আবার তোমার অনেকদিনের রসদ হয়ে যাবে। ওগুলো কমপ্লিট হলে স্টেপ বাই স্টেপ ছোটদের বইগুলো ধরে নিও।’
পারমিতার পরামর্শ মনে ধরে রাজার। আজকালকার বাচ্চাদের আইকিউ প্রখর। এই সব এপিক ওর ভালো লাগবে বলেই মনে হয়, অ্যাডভেঞ্চার ওর পছন্দ। রামায়ণ, মহাভারতে অ্যাডভেঞ্চারের মশলা প্রচুর।
প্রচুর প্রশ্ন করে সমু। প্রথম দিন বাঘ শিকারের গল্প বলতে গিয়ে নিজেই প্রায় শিকার হয়ে যাচ্ছিল ছেলের প্রশ্নের ঠেলায়। তবে আগ্রহ থাকা একদিক থেকে ভালো। তাতে কনসেপ্ট ক্লিয়ার হয়। আজ রামায়ণ শুরু হবে। ‘অনেক কাল আগে অযোধ্যায় দশরথ নামে এক রাজা ছিলেন।’ বেশ আবেগমথিত গলায় ছেলেকে গল্প বলা শুরু করল রাজা। ‘সরযূ নদীর…’ বাক্য সম্পূর্ণ করার আগেই সমুর প্রশ্ন করা শুরু হয়ে যায়।
‘দশরথের কি দশটা রথ ছিল বাবা?’
‘দশটা কেন, অনেক অনেক রথ ছিল। রাজা তো! রাজাদের…’
অযোধ্যার রাজা তো আদিত্যনাত। মামাভাই সেদিন যে তোমাকে বলছিল, অযোধ্যায় রাম মন্দির বানাচ্ছে আদিত্যনাত, খুব সুন্দর দেখতে। তুমি বললে, লোকের টাকা ধ্বংস করে ওই সবই করুক। আমার মনে আছে।’
রাজা অবাক হয়ে পারমিতার দিকে তাকায়। পারমিতা মুখ টিপে হাসছে তখন। এ ছেলে তো সাংঘাতিক! মনে মনে ভাবে রাজা। পুরো টেপরেকর্ডার।
‘যা শুনেছিস সেসব কথা এখন বুঝবি না, বড় হলে তখন বুঝতে পারবি। গল্প বলি এবার?’
‘হ্যাঁ –‘ বড় করে ঘাড় নাড়ে সমু।
‘বেশ। কতটা বলেছি? ও, হ্যাঁ, অযোধ্যার রাজা ছিলেন দশরথ। খুবই প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন তিনি।’
‘পজাবল মানে কি?’ সমুর প্রশ্ন।
‘প্রজাবৎসল — মানে হল, প্রজাদের খুবই দেখাশোনা করতেন। প্রজা মানে বুঝিস?’ সমুর উত্তরের অপেক্ষা না করে রাজা বলে যায়, ‘প্রজা মানে হল, অযোধ্যা রাজ্যে যত লোক বাস করত তারা সবাই।’
‘আমাদের রাজা কি মোদীজি? আমরা সবাই তার প্রজা?’ ‘এখন আর রাজা হয় না, এখন আমরা ভোট দিয়ে আমাদের নেতা বেছে নিই। এসব বুঝতে আরও খানিকটা বড় হতে হবে তোকে। ১৮ বছর হলে তুইও ভোট দিবি।’
‘আমার আঙুলেও কালি লাগিয়ে দেবে?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ দেবে, যারাই ভোট দেয় তাদেরই আঙুলে কালি লাগিয়ে দেয়।’
‘কালি মুছে ফেলা যায়, আমি টিভিতে দেখেছি।’ সমুর কথা শুনে হেসে ফেলে সম্রাট। বলে, ‘ওসব কথা এখন থাক। গল্প না শুনলে বল, আমি থেমে যাচ্ছি।’
‘না, তুমি বলো।’
‘আচ্ছা। রাজা দশরথের তিন রাণী ছিল। কৌশল্যা, কৈকেয়ী আর সুমিত্রা।’ এটুকু বলতেই শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে সমু। বড় বড় চোখ করে বলে, ‘তিন রাণী ছিল কেন? তিন রাণী মানে তিনটে বউ?’
‘হ্যাঁ, তিনজন স্ত্রী।’ একটু ভদ্র ভাষায় বলার চেষ্টা করে রাজা।
‘কেন তিনজন? সবার তো একটা করে বউ থাকে। জেবাবার একটা বউ, তোমার একটা বউ, ছোটকার একটা বউ, সুজিকাকুর একটা বউ…।’
‘ওরে থাম বাবা, আমি জানি আমাদের সবার একটা করে বউ। রামায়ণের ঘটনা অনেক হাজার বছর আগের। তখন এক একজনের অনেকগুলো করে বউ থাকত।’
‘তখন পুলিশ ছিল, বাবাই?’
‘হ্যাঁ ছিল তো। রাজামশাইয়ের পেয়াদা ছিল, দুষ্টুমি করলে তারা ধরে নিয়ে যেত।’ ‘তাহলে রাজা দশরথকে ধরল না কেন? পিয়াদিদির বর আর একটা বিয়ে করেছিল বলে তো পুলিশ ধরে নিয়ে গেছিল।’
বোবা হয়ে যায় রাজা। এত কিছু জানে কী করে এইটুকু ছেলে! পিয়ার ঘটনা মাস ছয় সাত আগের। তার মানে এই নিয়ে যখন আলোচনা হতো, পিয়া আসত, তখন আপাতদৃষ্টিতে সমু নিজের মনে পাজল নিয়ে বা অন্য কিছু নিয়ে খেলা করছে মনে হলেও, কান এদিকেই থাকত যে সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। নাহ, এই ছেলের সামনে খুব বুঝেসুঝে কথা বলতে হবে। পেছন ফিরে পারমিতাকে দেখার চেষ্টা করল রাজা, দেখতে পেল না। মনে হয় ও কিচেনে গেছে।
‘এবার শোন। তোর প্রশ্নের ঠেলায় আসল গল্পতেই যেতে পারছি না। রাজা দশরথের সবই ছিল কিন্তু ছেলেমেয়ে ছিল না বলে খুব কষ্টে থাকতেন। রাণীদের মনেও সুখ ছিল না। রাজা তখন ঠিক করলেন তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন যাতে তাঁর সন্তান হয়।’ এটুকু বলেই রাজা বুঝল সে ভুল করেছে। এতকিছু না বললেই হতো। ভাবনা শেষ হবার আগেই সমুর প্রশ্ন করা শুরু হয়ে যায়।
‘যজ্ঞ কী বাবা? আর তুমি কী যেন নাম বললে…বেদ যজ্ঞ না কি?’
‘যজ্ঞ হচ্ছে ভগবানের উদ্দেশে পুজো করার একটা স্পেশাল কায়দা। অশ্বমেধ যজ্ঞ কি, তা তুই বড় হয়ে যখন নিজে রামায়ণ পড়বি, তখন বুঝবি।’
‘এখন যদি নাই বুঝতে পারি তাহলে সেরম গল্প আমাকে বলছ কেন?’
‘গল্প ঠিকই বুঝতে পারবি, এই যে অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা বললাম, এ এক বিশাল ব্যাপার, সেই সব তুই বড় হলে নিজে পড়ে বুঝতে পারবি, সেটাই বলছি। বাদ দে, শোন, রাজার চারটে ছেলে হলো।’
‘দশরথের ছেলে কেমন করে হলো বাবাই? বাবাদের তো ছেলে হয় না, মা’দের হয়। আমি কি তোমার ছেলে? তাহলে দশরথের…’ ‘আরে বাবা, দশরথের ছেলে হলো মানে তিন রাণীর ছেলে হলো। বড় রাণী কৌশল্যার ছেলে হলো রাম, মেজরাণী কৈকেয়ীর ছেলে হলো ভরত, ছোটরাণী সুমিত্রার দুটো ছেলে — লক্ষণ আর শত্রুঘ্ন।’
‘এই যাঃ, গোলমাল হয়ে গেল।’
‘কীসের আবার গোলমাল হলো?’ ছেলের কথায় অবাক হয়ে জানতে চায় রাজা।
‘ওই যে, ছোটরাণীর দুটো ছেলে, অন্য রাণীগুলোর একটা একটা ছেলে, এটাই গোলমাল! একজনেরা সব টাকা পয়সা পাবে, দুজনেরা মারামারি করবে।’
‘কে তোকে বলেছে এই সব শুনি? তুই জানিস ওদের ভাইয়ে ভাইয়ে কত ভাব ছিল? মন দিয়ে শোন তাহলেই বুঝতে পারবি।’
‘কান দিয়ে তো শোনে বাবাই, মন দিয়ে শোনে না কেউ। তুমি কিচ্ছু জানো না।’
‘উফ, কান দিয়েই শোনে আমি জানি বাবা, মন দিয়ে শোনা মানে হলো কনসেন্ট্রেট করা। মানে জিনিসটা বোঝার চেষ্টা করা।’
‘রামায়ণ কবে হয়েছিল, বাবাই?’
‘সে অনেক হাজার বছর আগে।’
‘অত আগের গল্প তবে তুমি কেন বলছ? দাদাই যে বলে, পাস্টে কি হয়েছে তা মনে না রেখে ফিউচার নিয়ে ভাবো। তুমি কি হতে চাও সেটা চিন্তা করো। তাহলে তুমি অত পুরনো গল্প কেন বলছ?’
‘রামায়ণ মহাভারত হচ্ছে এপিক, ছাড়, তুই এসব এখন বুঝবি না। এর থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। আর কথা নয়, চুপ করে শোন।’ রাজার পাশেই রাখা ছিল ওর মোবাইল। তাতে টিং করে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ ঢুকল। রাজা আড়চোখে তাকিয়ে দেখল পারমিতার মেসেজ।
বাঁ হাত দিয়ে খুব সন্তর্পণে মেসেজ নামিয়ে দেখল লেখা আছে ‘জিস্ট’। রাজা বুঝে গেল পারমিতা কী বলতে চাইছে। সংক্ষেপে বলতে হবে যা বলার।
‘এবার শোন কী হলো। রাজা দশরথ বুড়ো হয়েছে। রাম বড়ো হয়েছে। তিনি চাইছেন এবার রাম রাজা হোক।’
‘কেবল রামই বড় হয়েছে, বাকিরা হয়নি?’
‘আরে সবাই বড়ো হয়েছে। কিন্তু রাম সবার থেকে বড় বলে নিয়মমতো ওই রাজা হবে। এবারে কি হলো শোন।’
বাবার মুখের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাল সমু। মারামারি হলো নির্ঘাত।
‘মেজো রাণীর নাম কী বলেছি মনে আছে?’
‘কৈকেয়ী, কেমন কৈ মাছ কৈ মাছ নাম, না বাবাই?’
কিছু একটা বলতে গিয়েও সামলে নিল রাজা। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, ঘেঁটে যাবে ব্যাপারটা। নেহাত গল্প শোনার অভ্যেস তৈরি করা জরুরি তাই এত ধৈর্য নিয়ে এখনো চালাচ্ছে। মাথা ঠান্ডা রেখে এগোতে হবে। একবার ইন্টারেস্ট পেয়ে গেলে তখন বাকিটা নিজেই বলতে বলবে।
‘মেজো রাণী কৈকেয়ীর একজন দাসী ছিল, তার নাম মন্থরা। দাসী মানে হচ্ছে কাজের মাসী, মাকে যেমন তরুদিদি হেল্প করে, তেমন।’ সমুর প্রশ্নের আগেই রাজা ক্লিয়ার করে দেয়।
‘সেই মন্থরা একটু দুষ্টু ছিল। রাম রাজা হবে শুনে সে কি করল, কৈকেয়ীকে বলল, রাম রাজা হলে তোমার ছেলে ভরতকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেবে নয়তো চাকর করে রাখবে।’
সেই শুনে কৈকেয়ী তো ভয়ে অস্থির হয়ে গেল। রাজা দশরথের কাছে গিয়ে বলল, ভরতকে রাজা করতে হবে আর রামকে চোদ্দ বছরের জন্য বনে পাঠিয়ে দিতে হবে।’ ছেলে চুপ করে শুনছে দেখে রাজা বোঝে তার ভালো লাগছে। মনে মনে খুশি হয় খুব। যাক, পরিশ্রম কাজে লাগছে।
‘কেন? ভরত রাজা হলে রামকে বনে যেতে হবে কেন?’
‘যাতে রাম ভরতের ক্ষতি না করতে পারে। রামকে রাজা হতে না দিলে রামের রাগ হতে পারে, সেজন্য যদি সে ঝামেলা করে তাই মন্থরাই রাণীকে শিখিয়ে দিয়েছিল এই কথা বলতে।’
‘মন্থরাকে ছাড়িয়ে দিল না কেন রাজা? সুশীলামাসিকে তো মা ছাড়িয়ে দিয়েছিল চুরি করেছিল বলে।’
‘মন্থরা কৈকেয়ীর খুব প্রিয় ছিল তাই ওকে ছাড়ায়নি। শোন না তারপর কী হলো। রাম খুব ভালো মানুষ, সে কোনো আপত্তিই করল না। ভরত রাজা হবে শুনে খুশিই হলো। আর মেজো মা চাইছে বলে বনে যেতেও রাজি হয়ে গেল।’
‘বন মানে কি?’
‘বন মানে হচ্ছে অরণ্য, মানে জঙ্গল। যাকে বলে ফরেস্ট।’
‘এ বাবা, রামটা হেব্বি বোকা তো! কেউ জঙ্গলে যায়? জঙ্গলে বাঘ, সিংহ, হাতি থাকে। রামকে খেয়ে নেবে তো! সিঙ্গাপুর যেতে পারল না?’
ছেলের কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রাজা। পারমিতা মুখে হাত চাপা দিয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়েছে। দ্রুত সামলে নিয়ে রাজা বলে, ‘ছি সমু, রাম সম্পর্কে এরকম কথা বলতে নেই। রামকে ভগবান মেনে পুজো করা হয় জানিস না তুই। রাম বাবা মায়ের খুব ভক্ত ছিল বলে ওঁরা যা বলত, রাম তাই শুনত। তাছাড়া জঙ্গল মানে বাঘ-ভাল্লুকে ভরা জঙ্গল নয়। সে সব বনে ঋষিরা বাস করতেন। দৈত্য দানব ছিল ঠিকই তবে সে অন্য গল্প। আর একদিন বলব। ‘
‘ও বুঝেছি, তার মানে পার্ক। আচ্ছা বাবাই, রামের বাবা একটা আর মা তো তিনটে। তিনটে মা অন্য অন্য কথা বললে কার কথা শুনত রাম?’
‘তিন মা একসঙ্গে কেন কিছু বলবে। যে যখন বলত, তাঁর কথা রাম শুনত।’
‘কৈমাছ তো রামের আসল মা নয়। আসল মা বারণ করেনি জঙ্গলে যেতে?’
‘মা বারণ করেছে, অনেক কেঁদেছে কিন্তু বাবার আদেশ রাম পালন করবেই, মানে শুনবেই।’
‘এই তো বললে কৈমাছ জঙ্গলে যেতে বলেছে, এখন আবার বলছ বাবা বলেছে — ধ্যাত, তুমি আজেবাজে বলছ।’
‘আরে বাবা, কৈকেয়ী এসে রাজা দশরথকে বলেছে, দশরথ রামকে বলেছে। বুঝলি?’
‘দশরথ পাজি আছে, কৈমাছের কথা শুনল কেন? তুমি কি মামাইয়ের সব কথা শোনো?’
‘এর কারণ আছে। কৈকেয়ীকে কোনো এক সময়ে দশরথ তিনটে বর চাইতে বলেছিলেন। কৈকেয়ী সেগুলো জমা রেখেছিল। সেই তিনটে বর কৈকেয়ী এখন চাইল।’
‘বর আবার কী? দশরথ তো কৈমাছের বর, আবার বর কেন চাইল?’
‘ওহো, সরি সরি, এখানে বর কথার মানে হলো ইচ্ছেমতো কিছু চাওয়া। যেমন তুই সেদিন আমার কাছে ফুটবল চাইলি, তেমন। ইংরেজিতে বলে boon, বুঝলি?’
‘হুম।’
‘এবার কি হলো, সীতা বলল সেও রামের সঙ্গে যাবে।’
‘সীতা অউর গীতার সীতা, বাবাই?’
‘এই সেরেছে, তুই এই নামটা জানলি কী করে? এটা তো একটা সিনেমার নাম।’
‘জানি জানি, বড়মামনি দেখছিল একদিন। আমিও দেখেছি একটুখানি।’
‘বুঝেছি। আমারি ভুল হয়েছে, সীতার কথা বলা হয়নি। সীতা হলো রামের বউ। সীতার কীভাবে জন্ম হলো সেও অনেক লম্বা গল্প, পরে একদিন বলব। সীতাও রামের সঙ্গে যাবে বলল।’
‘আমি কেমন করে জন্মালাম, বাবাই? মাম্মামের পেট কেটে? তুমিও তো ঠামের পেট কেটে জন্মেছ। তাহলে সীতা আবার কেমন করে জন্মাল, ডিম থেকে? ও কি পাখির বাচ্চা ছিল?’
রাজার ধৈর্যের পারদ নামছিল। এই ছেলেকে রামায়ণের গল্প বলতে গিয়ে বেহাল অবস্থা হচ্ছে। এর থেকে মনীষীদের গল্প বলা ভালো, এত প্রশ্ন করত না। পারমিতার পরামর্শ মতো পুরাণের গল্প না শুরু করলেই ভালো হতো। ধুর বাবা! এটাও ঠিক যে, ছেলেমানুষের কৌতূহল মেটাতে হবে, রাগ করলে হবে না। বড় করে শ্বাস নিল রাজা।
‘পাখির বাচ্চা হতে যাবে কেন, লাঙল দিয়ে মাটি চাষ করতে গিয়ে লাঙলের ডগায় উঠে এসেছিল ছোট্ট মেয়ে সীতা। এবার লাঙল কি, চাষ কি এসব জিগ্যেস করবি তো? তাই বললাম, অনেক বড় গল্প, পরে সব বুঝিয়ে বলব। এবার শোন কী হলো।
রাম সীতা আর লক্ষ্মণ — তিনজন রওনা হয়ে গেল বনবাসের জন্য। মানে, বনে গিয়ে থাকবে বলে। রামের মা কৌশল্যা, লক্ষ্মণের মা সুমিত্রা, রাজবাড়ির দাস দাসীরা, প্রজারা — সবাই খুব কান্নাকাটি করল।’
‘আর দুটো যে ভাই ছিল তারা কাঁদল না? ওই ভরত আর শত্রু?’
‘শত্রু নয়, শত্রুঘ্ন। ওদেরও খুবই মন খারাপ। ভাইদের মধ্যে খুব ভাব ছিল, সবাই সবাইকে ভালোবাসত। তারপর কী হল শোন। পঞ্চবটী নামের একটা বনে গিয়ে ওরা কুটির বানিয়ে থাকতে শুরু করল। সেখানে একদিন শূর্পনখা নামের এক রাক্ষসী এসে রাম আর লক্ষ্মণকে খুব বিরক্ত করতে লাগল। লক্ষ্মণ তখন তলোয়ার দিয়ে শূর্পনখার নাক কেটে দিল।’
‘এ বাবা, তরোয়াল দিয়ে খালি নাক কাটল? গলাটাই তো কেটে দিতে পারত! নাক তো ছুরি দিয়েই কাটা যায়। লক্ষ্মণের মাথায় বুদ্ধি নেই।’
‘অ্যাই, এরকম বলতে নেই। লক্ষ্মণ ভালো বলেই শূর্পনখার গলা কাটেনি। কাউকে মেরে ফেলা কি ভালো? দুষ্টুমি করেছিল বলে নাক কেটে দিয়েছিল। যাইহোক, এবার কি হল, শূর্পনখা সোজা চলে গেল ওর দাদা রাবণের কাছে। নাক কাটা শূর্পনখাকে দেখে আর সব শুনে রাবণ বেজায় রেগে গেল। রাবণ কে ছিল জানিস তো?’
‘কে ছিল, বাবাই?’
‘রাবণ ছিল লঙ্কার রাজা।’
রাজা এই কথা বলামাত্র সমু হেসে কুটোপাটি হল। রাজা যত বলে, ‘হাসছিস কেন? হাসির মতো কী বললাম? গল্পটা শোন…।’
‘লঙ্কার আবার রাজা কী বাবাই। লঙ্কা তো খায়। তার রাজা হয় নাকি? কী বোকা গল্প বাবা!’
‘আরে ভগবান, লঙ্কা একটা দেশের নাম, সেই দেশের রাজা ছিল রাবণ, বুঝলি?’
‘হ্যাঁ -অ্যা -অ্যা।’ সুর টেনে বলল সমু।
‘বোনের ওই অবস্থা দেখে রাবণ গেল প্রচন্ড রেগে। সে একটা ফন্দি আঁটল রামকে শিক্ষা দিতে। মারীচ বলে একটা রাক্ষস ছিল। সে খুব ভালো ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারত।’
‘ছদ্মবেশ কি, বাবাই?’
‘বলছি বলছি। ছদ্মবেশ মানে হল, অন্যরকম রূপ নেওয়া। মানে, ধর আমি তোর বাবাই তো, হঠাৎ দেখলি আমি তোর মাম্মামের মতো সেজেছি বা, জয় আঙ্কলের মতো লাগছে আমাকে দেখতে। একে বলে ছদ্মবেশ।’
‘গো অ্যাজ ইউ লাইকের মতো?’
‘একদম তাই। শাব্বাশ বাচ্চা! তো সেই মারীচ কি করেছে, সোনালি রঙের হরিণ সেজে রাম সীতা যেখানে থাকত, সেই কুটিরের সামনে এসে ঘোরাঘুরি করছে। সুন্দর হরিণটাকে দেখে সীতার খুব পছন্দ হয়েছে। রামকে বলেছে হরিণটাকে ধরে আনতে, ও পুষবে।’
‘এ মা, হরিণ আবার কেউ পোষে নাকি! কুকুর পোষে, বেড়াল পোষে। আমার বন্ধু আদৃতদের বাড়িতে অনেক পাখি পুষেছে ওরা।’
‘তখনকার সময়ে পুষত। শোন না, এবার রাম গেছে হরিণ ধরতে। খানিক বাদেই সীতা শুনতে পেল, রাম ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চীৎকার করছে। সীতা ভয় পেয়ে গেছে। ভেবেছে রামের কিছু বিপদ হয়েছে। লক্ষ্মণকে পাঠিয়েছে রামের কাছে। যাবার আগে লক্ষ্মণ বাড়ির সামনে চক দিয়ে দাগ দিয়ে সীতাকে বলেছে সেই দাগের বাইরে না যেতে। এই সময়ে বাড়ির সামনে একজন সাধু ভিক্ষে চাইতে এসেছে।’
‘দাগের বাইরে গেলে কী হবে? লক্ষ্মণ পার্কে যাবার সময়ে চক নিয়ে গেছিল বাবাই?’
‘আরে বাবা চক আমি বলেছি যাতে তুই বুঝতে পারিস, কিছু একটা দিয়ে, যেমন ধর ইঁটের টুকরো বা ওইরকম কিছু দিয়ে দাগ দিয়েছিল।’
‘দাগ দিলে কী হয়?’
‘সেটাই তো বলছি, দাগ হচ্ছে একটা সুরক্ষা। এখন যেমন সিসি টিভি বসাই আমরা, তখন তো সেসব ছিল না, তাই দাগ দিয়ে প্রোটেক্ট করেছিল।’
‘দাগ দিলেই হয়ে যাবে। কাল আমি সব ঘরের সামনে দাগ দিয়ে দেব চক দিয়ে। যখন আমরা বেড়াতে যাব, বাইরের দরজার সামনেও দাগ দিয়ে দেব, তাহলে আর তালা দিতে হবে না।’
‘উফ, একটু চুপ করে শোন। না শুনলে বল, আর বলব না।’
‘বলো না, শুনছি তো।’
‘সীতা সেই দাগের ভেতর থেকে সাধুকে ভিক্ষা দিতে পারছিল না। সাধু সীতাকে দাগের বাইরে গিয়ে ভিক্ষে দিতে বলল। যেই না সীতা দাগের বাইরে বেরিয়েছে, ওমনি সাধু হা হাহা হাহা করে হেসে সীতাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে চলে গেল। সাধু আসলে ছিল রাবণ। বোনের নাক কাটার বদলা নিতে এই কান্ডটা করল।’
অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেয়ে আগ্রহ নিয়ে সোজা হয়ে বসল সমু।
‘রাবণ সীতাকে নিয়ে রথে করে উড়ে চলল লঙ্কার দিকে।’
‘ও বাবাই, রথ আবার ওড়ে নাকি? কী সব গুল দিচ্ছ তুমি! রথ তো টানতে হয়। কই আমার রথ ওড়ে না তো?’
‘আসলে ওটা এরোপ্লেন ছিল, সে সময়ে বলত রথ। রাবণ লঙ্কায় নিয়ে গিয়ে সীতাকে অশোক বনে বন্দী করে রেখে দিল। অনেক রাক্ষসীদের পাহারায় রেখে দিল যাতে সীতা পালাতে না পারে।’
জটায়ুর বিষয়টা ইচ্ছে করে বাদ দিয়ে গেল রাজা। আবার কী প্রশ্ন করে বসে সমু, সেই কারণে।
‘রাম আর লক্ষ্মণ সীতাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। হনুমান ছিল রামের খুব ভক্ত। সে তখন বলল, সীতামা কোথায় আছে আমি খুঁজে দেখব। হনুমান খুব শক্তিশালী, ছোট হতে পারে, বড় হতে পারে।’
‘হনুমান ছোট হতে পারে আবার বড় হয়ে যেতে পারে! ও বাবাই, একটা হনুমান কিনে দাও না, পুষব। সায়ম আমাকে চিমটি কাটে খুব। ওকে বাড়িতে ডেকে আনব আর হনুমানকে বলব বড় হতে। ব্যাটা এমন ভয় পাবে না, খুব মজা হবে। ও বাবাই, দাও না।’
সমুর বায়না শুনে রাজা বলে, ‘ওরে তুই যে হনুমান দেখিস রামায়ণের হনুমান তেমন ছিল না। তাকে আমরা পুজো করি। ঠামের ঠাকুরঘরে হনুমানজির ছবি আছে দেখেছিস তো?’
‘ওই হনুমানজি আর চিড়িয়াখানার হনুমান আলাদা! ও বাবা! তাহলে আর পুষে কি হবে।’
‘হনুমান সাগর পেরিয়ে লঙ্কায় গিয়ে পৌঁছে সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে অশোক বনে পৌঁছে গেল। সেখানে সীতাকে দেখতে পেয়ে নিজের পরিচয় দিল। রামের কথা বলল। সীতা বলল, রাম লক্ষ্মণ যেন তাড়াতাড়ি এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এদিকে হনুমানকে দেখতে পেয়ে রাবণের লোকেরা ওকে বেঁধে নিয়ে গেল রাবণের কাছে। রাবণ বলল, ওর ল্যাজে আগুন ধরিয়ে দিতে।’
‘কেন?’ সমু চোখ বড় করে জিগ্যেস করল।
‘যাতে হনুমান ফিরে যেতে না পারে। ফিরে গেলেই তো রাম খবর পেয়ে যাবে সীতা কোথায় আছে। ওরা কি করল, হনুমানের ল্যাজে ভালো করে কাপড় জড়িয়ে তাতে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিল।
এইবার হনুমান নিজেকে বড় করতে লাগল। বড় হতে হতে বিশাল আকার হয়ে সে লাফিয়ে লাফিয়ে এ বাড়ির ছাদ থেকে ও বাড়ির ছাদ করে করে সারা লঙ্কায় আগুন ধরিয়ে দিল। রাবণের সাধের লঙ্কা আধপোড়া হয়ে গেল। হনুমান আবার ছোট হয়ে সাগর ডিঙিয়ে ফিরে এসে রামকে খবর দিল।’
‘ইয়ে য়ে য়ে য়ে… এইটা হনুমান খুব ভালো কাজ করেছে। ঘুরে ঘুরে ল্যাজের আগুন দিয়ে সব পুড়িয়ে দিয়েছে।’ সমু উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে খাটে ঘুরতে লাগল।
‘রাম খবর পেয়ে লক্ষণ আর বানর সেনাদের নিয়ে লঙ্কার দিকে রওনা হল সীতাকে ফিরিয়ে আনতে।’
‘এই তো বললে হনুমান, আবার বাঁদর বলছ কেন?’
‘হনুমানজি তো ছিলই, বানররাও অত্যন্ত রামভক্ত ছিল তাই তারাও দলে দলে রামের সেনা হিসেবে যোগ দিয়েছিল। রাম পৌঁছে গেল লঙ্কায়। ধুন্ধুমার যুদ্ধ হল। শেষে রাবণ হেরে গেল, রাম সীতাকে নিয়ে ফিরে এল।
এর মধ্যেও অনেক ঘটনা আছে। যেমন ইন্দ্রজিতের বাণে লক্ষ্মণ অজ্ঞান হয়ে গেছিল, তখন হনুমান পুরো গন্ধমাদন পাহাড় উঠিয়ে এনেছিল ওষুধ খুঁজে না পেয়ে, রাবণের ভাই বিভীষণ রামের দলে যোগ দিয়েছিল, রামের ছেলেলব কুশ, সীতার পাতালে চলে যাওয়া– এরকম সব গল্প আছে যেগুলো পরে বলব।’ গলা শুকিয়ে আসছিল রাজার, সেই কখন থেকে বলেই চলেছে। তাই সংক্ষেপ করে কাজ সারল।
‘কেমন লাগল বল।’ রাজা হাসিমুখে জিগ্যেস করল ছেলেকে।
‘ভালো না।’ সমুর সটান জবাবে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রাজা।
‘কেন? কী খারাপ লাগল তোর?’
‘দশরথ দুষ্টু , কৈমাছ পাজি, রাম বোকা, লক্ষ্মণ হাঁদা, সীতা কথা শোনে না, হনুমান ক্যাবলা।’
রাজার সাহস হল না ছেলেকে জিগ্যেস করে সে কেন এরকম বলছে। কেবল হনুমানের মতো তেজস্বী একজনকে ক্যাবলা বলার কারণ না জিগ্যেস করে পারল না সে।
‘হনুমানের কত শক্তি, বুদ্ধি। সীতাকে দেখতে পেয়ে নিয়ে চলে এল না কেন বাবাই? তাহলে তো রামকে কষ্ট করে যুদ্ধ করতে হতো না। ক্যাবলাই তো!’
পারমিতাকে রাজা বলেছে আর সে পুরাণের গল্প সমুকে বলবে না। ওর জন্য ওই শিকারের গল্পই ঠিক আছে। রামায়ণের চরিত্রদের নিয়ে নতুন করে চিন্তায় ফেলে দিল! বাপ রে বাপ!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
দারুণ লাগল। অন্যরকম।
Darun. Ekhonkar bacchader chobita porishkar. Nice sense of humour. Enjoyed thoroughly.