short-story-shilpi

শিল্পী
তিলোত্তমা মজুমদার


কলেজ স্ট্রিট সংলগ্ন রামরতন ঘোষ বাইলেনে মাসিক বারোশো টাকায় ঘরখানি পেয়ে গেল ভিকি। অনেক ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে কলেজ স্ট্রিটের ঘর, গুদাম, দোকানের একনম্বর দালাল পাণ্ডের কৃপায় জুটে গেল বলা যায়। একখানা তিনকোনা ঘর। ছোট্ট জানালা। দরজা খুলে দক্ষিণের সিঁড়ির নীচে একফালি কলঘর। এই তিনকোণ ঘরের ভাড়াটের ব্যবহার্য।

এর চেয়ে শস্তা আর কিছুই হতে পারে না বলেই ভিকির মনে হল। একখানা আস্ত কলঘর তার পক্ষে খুবই স্বস্তিকর।

এই ঘরের জন্য পাণ্ডে দালালি বাবদ তার কাছ থেকে একমাসের ভাড়াটুকুই দাবী করেছে। তবে ছ’মাসের ভাড়া অগ্রিম চাই মালিকের। পাণ্ডেকে সঙ্গে নিয়েই কাছাকাছি এটিএম থেকে টাকা তুলে পাওনা চুকিয়ে দিল সে। তহবিলে আরও হাজার দশ মতো রইল তার। এই প্রথম তার মনে হল, ছবি আঁকার সরঞ্জামগুলির দাম অনেক। সে শুকনো হেসে পাণ্ডেকে ধন্যবাদ দিল।

পাণ্ডের অভিজ্ঞ চোখ। ভিকিকে দেখেই সে বুঝেছে, বাড়িতে ঝগড়া করে বেরিয়ে আসা রহিস ঘরের ছেলে। এখনো বাচ্চা। পাণ্ডের ছেলের মতোই, যে কিনা বিহারের দেশগাঁয়ে নিজের জেদ বজায় রেখে বড় হয়ে উঠছে। সে টাকা গুনে নিয়ে বলল, ‘একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, বাবু?’

ভিকি নিজের ওয়ালেট পকেটে গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলল, ‘করো, পাণ্ডেজি।’

‘আপনি কী করেন। এখানে থাকবেন, আমার একটা দায়িত্ব আছে। আপনার ঘর পরিবার, ঠিকানা আমাকে লিখে দিন। এসব ভাড়ায় কোনও এগ্রিমেন্ট তো হয় না। সব বিশ্বাসের ওপর।’

ভিকি বলল, ‘আমি ছবি আঁকি। বাড়ির ঠিকানা লিখে দেব তোমাকে। অসুবিধে কিছু নেই। সামনের মাস থেকে ভাড়া দেব কাকে? ঘরের মালিকের সঙ্গে তো পরিচয় হল না।’

‘হয়ে যাবে কোনও দিন। ভাড়া আমিই নিয়ে যাব এসে। মাসের পাঁচ তারিখের মধ্যে দিয়ে দেবেন। আপনাকে দেখে ভাল লাগল, কম ভাড়ায় ঘর দিয়ে দিলাম। এই জায়গায় এরকম ঘরের ভাড়া কম সে কম আঠারোশো টাকা। আপনাকে সেদিনই বলেছিলাম।’

পাণ্ডের এতখানি করুণার কারণ আছে, তা হল, বছরখানেক আগে এক কবি এই ঘরে আস্তানা নিয়েছিলেন, যুবক সেই কবি ট্রেনে কাটা পড়ে দেহত্যাগ করেন। তার পর অনেকেই এই ঘরে নানাবিধ আওয়াজ পায়, কান্না শোনে, যুবক কবির ছায়াশরীর দেখতে পায়। কোনও ভাড়াটেই পাওয়া যাচ্ছিল না। ভূতের কাহিনি লুকিয়ে ঘর ভাড়া দেওয়ার পক্ষপাতী নন এই বাড়ির মালিক, বইবাঁধাইয়ের ব্যবসায়ী ভূপেন দাস। তাই পাণ্ডে যখন ভিকিকে ভূতের রটনা জানায়, এবং ভিকি একটুও না হেসে বলে ওঠে, ‘সে আমি ভূতের সঙ্গে দোস্তি করে নেব, আপনি ভাড়া বলুন,’ পাণ্ডে ফস করে বলে ওঠে আঠেরোশো রুপিয়া, ভিকি শুকনো মুখে বলে,’ বারোশো টাকায় হয় না?’

তখনই পাণ্ডের নিজের ছেলেকে মনে পড়ে এবং ভিকিকে পুত্রসম বোধ হয়। সে ঘরের তালা খুলে একখানা ডাণ্ডা দিয়ে প্রবেশমুখের ঝুলকালি সরিয়ে বলে, ‘দেখুন, চলবে?’

ভিকি দেখল, কয়েকটা ইঁদুর সুড়ুৎ সুড়ুৎ পালিয়ে গেল। জানালায় ময়লা পর্দা। একটা লম্বাটে কাঠের টেবিল, তার ওপর ডাঁই করা বই। সামনে চেয়ার। চেয়ারেও কিছু বইপত্র। ভিতরে পূর্বকোণে আরও জায়গা, কিন্তু ঠাসা অন্ধকার। পাণ্ডে জানালা খুলে দিল। আলো প্রবেশ করে সইয়ে দিল চোখ। পূবমুখী কোণের কোলে রান্নার সরঞ্জাম। ধুলো পড়া ময়লা কিছু বাসন, শিশিবোতল, স্টোভ। সামান্য প্রসারিত অংশে সরু কিন্তু উঁচু খাট, চাইলে তলায় কিছু রাখা যেতে পারে। খাটের মাঝবরাবর একটা সিলিং ফ্যান। ফ্যানের চলন্ত অবস্থায় যদি কেউ ভুলক্রমে খাটে দাঁড়িয়ে পড়ে, ধড়মুণ্ড আলাদা হয়ে যাবে। সে এই চিন্তায় হেসে ফেলল। এর চেয়ে ছোট ঘর কি হয় না? তার আঁকার সরঞ্জাম, জমে থাকা ছবি ইত্যাদি রাখার জায়গা ভাবতে ভাবতে সে বলল, ‘এ ঘর সাফা করতে ক’দিন লাগবে পাণ্ডেজি?’

‘কয় দিন লাগবে? একদিনে হয়ে যাবে। কবে আসবেন সেটা বলুন।’

‘পরশু সকালের দিকে যদি আসি?’

‘চলে আসুন। এই জিনিসপত্তর সব ফেলে দেব তো?’

‘ইঁদুরে কাটা, ছেঁড়া বইগুলো ফেলে দিন। বাকি বই থাক। খাট আর চেয়ার- টেবিল থাক। বাসন স্টোভ ফেলে দেবেন। টেবিল সরিয়ে এইদিকে নিয়ে আসবেন। ঐ পশ্চিমের কোণ একদম ফাঁকা থাকবে। ওখানে আমার ছবিগুলো রাখতে হবে। দেওয়াল ভাল করে পরিষ্কার করতে হবে।’

‘শুনুন, ফার্নিচার সব মালিকের আছে। ওসব তো থাকবেই। আপনি আমাকে দো দিন বলুন, আমি দেওয়ালে রং ভি করিয়ে দেব। এতদিনের ধুলোয় দেওয়ালে পোকা বাসা করেছে।’

‘ঠিক আছে। আমি তিনদিন পর আসব। সব হয়ে যাবে তো?’

‘একদম। যাকে হয় জিজ্ঞাসা করে নিন, পাণ্ডের কথার খেলাপি হয় না।’




পাণ্ডের আন্দাজ ভুল নয়। ভিকি অর্থাৎ ভানুকর রায়ের বাবা একজন বড় চাকুরে, মা স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। ভিকির দাদা শুভ ডাক্তারিতে স্নাতকোত্তর করছে। জ্ঞান হওয়া অবধি ভিকি অর্থাভাব অথবা অন্নচিন্তা কী জানে না। তার দাদার মতো সেও মেধাবী ছাত্র, কিন্তু তার অপরাধ, সে অতি শৈশব থেকে চিত্রাঙ্কনে আসক্ত।

সে যখন ছোট ছিল, তার এই ছবি আঁকার ঝোঁক ছিল বাবা-মায়ের গর্বের বিষয়। যে কোনও ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতায় সে প্রথম হয়, পাড়ার যে স্কুলে সে আঁকা শিখতে যায়, সেখানকার শিক্ষক প্রায়ই বলেন, ভিকির ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা। বাবা-মা শুনে আহ্লাদে বিগলিত হয়ে যেতেন। কিন্তু যখন থেকে ভিকির বাটখারায় লেখাপড়ার ওজন চিত্রশিল্পচর্চার তুলনায় কম পড়ল, মা ও বাবা যুগপৎ ঝাঁপিয়ে পড়লেন কী করে ছেলেকে লেখাপড়ায় মনোযোগী করে তোলা যায়। বড়ছেলে মা-বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, ছবি আঁকা কারও জীবিকা হতে পারে, অতএব, ভিকি যা নিয়ে থাকতে চায় বা পড়তে চায়, তাই মেনে নেওয়া ভাল, কিন্তু তাঁরা গোড়াতে সহমত ছিলেন না। তাঁদের চেনা পৃথিবীতে চিত্রকর হিসেবে জীবিকা প্রতিষ্ঠা করা ও খ্যাতি লাভ করা এক অলীক বিষয়।

বাবা- মাকে স্বস্তি দিতে ভিকি গেল ফিজিক্সে অনার্স পড়তে। তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু সৌম্য একই বিষয় ও একই কলেজ হওয়ায় প্রথম বছর দুই ভিকি পদার্থবিদ্যায় মন বসানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হল এবং কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিল। অনেক বুঝিয়েও তাকে পদার্থবিদ্যাভিমুখী করা গেল না যখন, বাপ-মা হতাশ হয়ে তাকে আর্ট কলেজে দিলেন। সেখানে বছর দুই কাটিয়ে ভিকির মনে হল, এই প্রশিক্ষণ তাকে নতুন কিছু দিতে পারছে না, বরং তার মৌলিকতা নষ্ট করছে। সে এযাবৎ যা শিখেছে, যা শিখবে, সমস্ত নিজের উদ্যোগে, এমন বিশ্বাসে আর্ট কলেজের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে এল।

চিত্রাঙ্কন বিষয়ে অনেকগুলি অত্যন্ত দামী বই কেনার জন্য বাপ-মা অর্থব্যয় করেছিলেন। নানাবিধ রং, তুলি, অনেকগুলি ক্যানভাস ইত্যাদি লাগাতার সরবরাহ করেছেন। এখন তাঁদের প্রতীতি হল, এই সমস্ত টাকাই জলে গেছে।

বাবা অত্যন্ত ক্রোধে বললেন, ‘বাপ-মায়ের ছত্রছায়ায় থেকে দেলগারি অনেক দেখিয়েছ। বাস্তব কী, কিছুই জানো না। যদি ভাবো, তুমি রংতুলি নিয়ে ঘরে বসে খেলা করবে আর আমরা তোমার সেবা করে যাব, ভুল করছ।’

সেই রাতে ভিকির ঘুম হল না। বাপের কথাগুলি তার বুকের ভিতর আগুন লাগিয়ে দিল। সকালবেলায় সে মায়ের কাছে গেল। জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা ঠিক কী বলতে চাইল মা? ছবি আঁকতে চাইলে এ বাড়িতে আর থাকা যাবে না?’

মা বললেন,’ তোর বাবা চায় তোরা দুই ভাই প্রতিষ্ঠিত হবি। সব বাবা-মা তাইই চায়। সেটা অন্যায়ও নয়। নিজে রোজগার করে আঁকার শখ মিটিয়ে নে, কেউ কিছু বলবে না।’

‘মা, আমি শখে আঁকি না। ছবি আমাকে দিয়ে নিজেকে আঁকিয়ে নেয়। এই কাজ ছাড়া আমার অস্তিত্ব অর্থহীন।’

‘আমি অত বুঝি না, বাপু।’

‘তুমি কী চাও, মা। আমি চলে যাই?’

‘শোনো ভিকি, এই বিষয়ে আমি কিছু ভেবে দেখিনি। তবে আমার কথা হল, তুমি যখন কারও কথা শুনবেই না, তোমার মর্জিতেই চলবে, তখন নিজের পথ নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে।’

‘আমাকে তোমরা তাড়িয়ে দেবে, মা? ছবি আঁকি বলে তাড়িয়ে দেবে? কী করে কারও পক্ষে বলা সম্ভব যে কেউ কোনও কাজে অবশ্য সফল হবে?’

মা মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ভিকি কয়েকদিনের মধ্যেই তার প্রিয় বন্ধু সৌম্যর বাড়িতে আশ্রয় নিল। সেখানে, সেই বাল্যবেলা থেকেই সে সৌম্যর বাবা-মায়ের স্নেহের পাত্র। সমস্ত ছবি ও আঁকার সরঞ্জাম, বইপত্র ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে এনে সে ডাঁই করল সৌম্যদের একতলায়, সিঁড়ির নীচে। ছোট্ট একটু আস্তানার সন্ধানে হন্যে হয়ে পড়ল। সৌম্যর মা বললেন, ‘এখানেই থেকে যাও, ভিকি। সৌম্য বেঙ্গালুরু চলে গেলে আমাদের খুব ফাঁকা লাগবে। তুমি থাকলে সেই অভাব কিছুটা পূরণ হবে।’

ভিকি বলে, ‘আমার তো কোনও রোজগার নেই, কাকিমা। আপনাদের গলগ্রহ হয়ে কতদিন থাকা সম্ভব?’ সে কাকিমার বানানো পায়েস খেতে খেতে বলল। ছোট থেকেই সে কাকিমার রান্না করা পায়েসের ভক্ত। এমন পায়েস এ জগতে আর কেউ বানাতে পারে না, এই তার মত।

কাকিমা বলেন, ‘তোমার রোজগার থাকলেও কি আমরা তোমার কাছ থেকে কিছু নেব?’

উদাত্ত হাসিতে ঘর ভরিয়ে ভিকি তখনকার মতো প্রসঙ্গ ধামাচাপা দিয়েছিল। কিন্তু রাতে তাকে ধরল সৌম্য। জিজ্ঞেস করল, ‘ঘর ভাড়া নিয়ে থাকবি বলছিস, তোর খরচ আসবে কোথা থেকে? শুভদা কিছু ভরসা দিয়েছে?’

‘দাদা? না না। আমি নিজেই খরচ তুলব। সেই জন্যই তো কলেজ স্ট্রিটের দিকে বাসা খুঁজছি। সারা পৃথিবীতে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের মতো জায়গা আর একটাও নেই। এখানে শিল্পী, সাহিত্যিক, সবার জন্য কিছু না কিছু কাজ জুটে যায়। একজনের সঙ্গে কথা হয়েছে, আমি বইয়ের মলাটের ছবি আঁকব, ভিতরের পাতায় আঁকব। কাজ ভাল হলে ভাল কাজের অভাব হবে না।’

‘তার জন্যও তো সময় চাই। অন্তত একবছর চালাতে পারিস, সেই টাকা থাকা দরকার।’

‘কিছু আছে রে। অত ভাবিস না।’

‘ভাবনা এসেই যায়।’

‘কিছুদিনের মধ্যেই আমি একটা স্কুল খুলে ফেলব। দেখতে দেখতে জমে যাবে।’

‘আমি বেঙ্গালুরু চলে গেলে, কিছু দরকার পড়লে মাকে বলিস ভিকি।’

‘কাকিমাকে? হ্যাঁ। বলব।’




জিনিসপত্র নিয়ে ভিকির সঙ্গে সৌম্য এল। পাণ্ডে দেওয়ালে সাদা রং করিয়েছে। আলোর টিউব, পাখা পরিষ্কার করিয়েছে। জিনিসপত্র যা যা ফেলার, সব সরিয়েছে। বইপত্র সব ধুলো ঝেড়ে রেখেছে টেবিলে। তবু, ঘরে পা দিয়েই সৌম্যর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। সে বলল, ‘এই ঘরে তুই থাকতে পারবি? কখনও থেকেছিস এরকম?’

ভিকি বলল, ‘কত সস্তা বল। আর সব অভ্যাস হয়ে যাবে।’

‘কলকাতার গরমে তুই কখনও এসি ছাড়া ঘুমিয়েছিস? এখানে রান্না করবি কোথায়? খাবি কী? গরমে তো দম আটকে যাবে।’

‘এই এসে থেকে আমায় হতোদ্যম করছিস কেন বল তো? কোথায় বলবি, কেয়াবাৎ, লড়ে যা বন্ধু, তা না, ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যান। শোন, আমি রান্না করব না। ওসব আমার আসেও না। এই অঞ্চলে রোজ দশ হাজার লোক পাইস হোটেলে খায়, আমিও খাব। আর বেশি গরম লাগলে তোদের বাড়ি গিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া খেয়ে আসব।’

‘তুই সত্যিই গাঁঠ গোঁয়ার।’

‘তা বটে।’

সময়টা শীতের শেষের দিকে। শুরুতে মানিয়ে নিতে খুব অসুবিধে হল না ভিকির। একটা বৈদ্যুতিক কেটলি কিনেছে। ঘরে চা ও কফির ব্যবস্থা রেখেছে। ঘরের অর্ধেক এখন তার ছবিতে ভরে গেছে। অনেক কষ্টে সে ইজেল দাঁড় করাতে পেরেছে। এতদিনে সে জেনে গিয়েছে এই ঘরের সেই ভাড়াটের নাম, যে কবি ছিল। গুরুপদ হাজরা। তার অন্তত কুড়িটি বই পাঠযোগ্য আছে। বিবিধ বিষয়ের বই। যেমন, ভূত আছে, না নেই। সুগন্ধী ফুলের চাষ। চৌবাচ্চায় তেলাপিয়া মাছের চাষ। ছন্দের প্রথম পাঠ। একশো কবির কবিতা। ঈশ্বর ও বিজ্ঞান। জীবনানন্দ দাশের কবিতা সমগ্র। বইটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত। ভিকি অলস সময়ে বইগুলো উলটে দেখে। মনে হয় গুরুপদ দাশ বেশ খুশি হয়ে উঠছে। অদৃশ্য গুরুপদকে কল্পনা করে বেশ মজা পায় ভিকি। সে ঠিক করেছে, অশরীরী গুরুপদর ছবি আঁকবে। এর মধ্যে বেশ কিছু বইয়ের পাতায় ছবি আঁকার কাজ সে পেয়েছে। কিন্তু পারিশ্রমিক এতই স্বল্প যে সারাদিনে এরকম পঁচিশটা কাজ করতে পারলে সে মাসের থাকা-খাওয়ার খরচ তুলতে পারবে। আরও বেশি কাজ পাবার আশায় সে প্রকাশকের দোরে দোরে ঘুরতে লাগল। বইমেলা এসে যাওয়ায় বেশ কিছু কাজ সে পেতে থাকল জানুয়ারির দশ তারিখ পর্যন্ত। অবশেষে সেইসব কাজের পারিশ্রমিক আদায় করতে করতে এপ্রিল পেরিয়ে গেলে সে দেখল, এই কয়েকমাস সে শুধু বইয়ের জন্য ছবি এঁকেছে। তার মূল কাজ কিছুই করেনি। তবে যে পরিমাণ অর্থ সে উপার্জন করেছে, তাই দিয়ে তার দু’মাস চলে যাবে। সে আবার নিজের আনন্দে কাজে মন দিল। এর মধ্যে একদিন তার দাদা শুভ তাকে ফোন করেছিল। বলেছিল, শীঘ্রই একদিন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে কিছু জরুরি আলোচনা করবে। আর একদিন, সৌম্যর বাবা ডেকেছিলেন। তাঁদের কোম্পানি চারপিস ছবি কিনবে, পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা দাম দেবে একেকটি ছবির জন্য। তবে ছবিগুলো হতে হবে গণেশের। সিংহাসনে উপবিষ্ট গণেশ, নৃত্যপর গণেশ, আশীর্বাদের ভঙ্গিতে এবং সোনায় মোড়া সোনালি গণেশ।

ভিকি বলল, ‘আমার তো গণেশের ছবি নেই। আপনি বললে এঁকে দেব।’

‘কতদিন লাগবে?’

‘অন্তত দু’মাস।’

‘একটা ছবির জন্য পনেরো দিন? মাথা খারাপ? এক সপ্তাহ সময়। দেখো ভিকি, জীবনে সুযোগ বার বার আসে না। এটা হল দ্রুততার যুগ। বাণিজ্যিক দিক থেকে দেখলে সময়ের সঙ্গে অসম যুদ্ধ করে জিততে হয়। কে বলতে পারে, এই গণেশ তোমার জীবনের সাফল্য এনে দেবে না। এক জায়গায় ভাল কাজ করলে তুমি দশ জায়গায় কাজের সুযোগ পাবে।’

কাকিমা সেদিনও পায়েস রেঁধেছিলেন। ভিকি আনমনে খেতে খেতে বলল, ‘সাতদিন খুব কম সময়, কাকা। দেখি। যদি দুটো দিই?’

‘না। একজন শিল্পীর ছবিই চাই। সংস্কার, বুঝলে না?’

ভিকি অনেক ভাবল। রাতে ভাল করে ঘুম এল না। হঠাৎ তার গুরুপদ হাজরার কথা মনে এল। এতদিনের মধ্যে সে কোনও ছায়া বা কায়া কিছুই দেখেনি। ইঁদুর ছাড়া আর কেউ তাকে সমস্যায় ফেলে না। তার মনে প্রশ্ন জাগল, গুরুপদ হাজরা কি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল, নাকি আত্মহত্যা করেছিল? তাকেও কি কবি হওয়ার অপরাধে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল? সে কি ভেবেছিল কবিতা লিখে জীবন কাটিয়ে দেবে? তার কি অন্য কোনও পেশা ছিল?

সে বিছানা থেকে নেমে আলো জ্বেলে ইজেলের সামনে দাঁড়িয়ে গণেশের অবয়ব ভাবতে লাগল। একসময় স্কেচ শুরু হল। কখন ভোর হল, কখন সকাল দুপুর গড়িয়ে গেল, কয়েক কাপ কফি ছাড়া আর কিছুই খেল না, শুধুই এঁকে চলল, তিন দিন, তিন রাত। শুধু তুলি নয়, সে ব্যবহার করল ছেঁড়া ন্যাকড়া, টুথব্রাশ, কাচের গ্লাসের বৃত্তাকার তলপিঠ। অবশেষে অস্নাত, অভুক্ত, নিদ্রাহীন অবস্থায় সে চারখানি গণেশ নিয়ে, ট্যাক্সি চেপে, সোজা সৌম্যর বাবার আপিসে পৌঁছল। সেখান থেকে আবার ফিরে এল ডেরায়। রুটি আর তরকা কিনে, স্নান সেরে, খেয়ে যখন শুতে যাবে, সৌম্যর বাবা ফোন করে বললেন, ছবিগুলি অসাধারণ হয়েছে। সকলেই প্রশংসা করেছেন। প্রত্যেকটি ছবির জন্য তাকে দশ হাজার টাকা পারিশ্রমিক দেওয়া হবে।

টাকাটা কবে নাগাদ পাওয়া যেতেপারে, সে জিজ্ঞেস করল। সৌম্যর বাবা বললেন, ‘তা দিনদশেক লাগবে। শোনো ভিকি, তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি জিনিয়াস।’

সে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। প্রগাঢ় ঘুম। রাতে কখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এসেছে সে টের পেল না। খোলা জানালা দিয়ে জল ঢুকল। দরজার তলা দিয়ে জল ঢুকল। আস্তে আস্তে তার সমস্ত ছবির তলদেশ জল শোষণ করতে লাগল। রং গুলে ছবিগুলো হয়ে উঠতে লাগল কিম্ভূতকিমাকার। কোনও ছবি জলে গদ্‌গদে হয়ে গলে গেল। বেলা এগারোটায় যখন তার ঘুম ভাঙল তখন বৃষ্টি থেমেছে কিন্তু কলেজ স্ট্রিট এলাকায় জমে থাকা জল নিষ্কাশিত হয়নি।

ভিকি তার সর্বনাশের গভীরতা মাপতে লাফিয়ে নামল জলে। তার মনে ছিল না, বৃষ্টিতে কলেজ স্ট্রিট ডুবে যায়। একতলার ঘরে জল ঢুকে যায় প্রতিবছর। পাণ্ডেজিও তাকে এ বিষয়ে কিছুই বলেনি। সে একেকটি ছবি দেখে আর ফেলে দেয়। দেখে আর ফেলে দেয়। অবশেষে ঘর থেকে জল নিকাশের ব্যবস্থা না করেই সে চলে গেল সৌম্যর বাড়ি। বলল, ‘কাকিমা, আমাকে পায়েস খাওয়াও।’

কাকিমা বললেন, ‘এই সবে রান্না শেষ করে উঠেছি। আজ থেকে যাও। ওবেলা পায়েস করে দেব।’

ভিকি বলল, ‘আমি তাহলে আসি কাকিমা।’

‘চারিদিকে জলকাদা, যাবার দরকার কী।’

‘কাকিমা, এই বৃষ্টিতে আমার অতীত ধ্বংস হয়ে গেছে।’

‘ওভাবে কথা বলতে নেই। মা-বাবার সঙ্গে অত রাগও করতে নেই। একদিন গিয়ে দেখা করে এসো।’

‘আসি, কাকিমা।’

ঘরে ফিরে উঁচু খাট ঠেলে ঠেলে ইজেলের কাছে নিয়ে এল ভিকি। লম্বা গামোছায় মুড়িয়ে মুড়িয়ে শক্ত ফাঁস বানিয়ে ঝুলিয়ে দিল সিলিং ফ্যান থেকে। ফোনে ছবি তুলে পাঠিয়ে দিল তার মায়ের কাছে। তারপর ঝুলে পড়ল।




ভিকির বাবা-মা ভাবেন, আহা, কেন আমরা ওর প্রতি অত নিষ্ঠুর হলাম। আর একটু নরম হলে আজ ও বেঁচে থাকত।

শুভ ভাবে, কেন সে সময় বের করে ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেল না? গেলে আজ ভাই এমন কাণ্ড করত না।

সৌম্যর মা ভাবেন, ‘পায়েস খেতে ভালবাসত। খেতে চেয়েছিল। কেন আমি খাইয়ে দিলাম না?’

সৌম্যর বাবা ভাবেন, ‘ও হয়তো অনেক ধারবাকি করে ফেলেছিল। চল্লিশ হাজার টাকা তখনই ওকে দিয়ে দিলে ছেলেটা হয়তো এমন করত না।’

সৌম্য ভাবে, ‘কেন আমি কলকাতাতেই থেকে গেলাম না? আমি থাকলে ও কিছুতেই এরকম করত না।’

ঘর, বাড়ি, গুদামের দালাল পাণ্ডে ভাবে, ‘জয় বজরংবলী। হামার কোনও কসুর নাই। আমি তো ছেলেটার উপকারই করেছিলাম।’



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *