‘আমায় দিদি বলে ডাকবি, বুঝেছিস‘
প্রিয়ব্রত দত্ত

কানন দেবী, চন্দ্রাবতী দেবী, মলিনা দেবী, সুনন্দা দেবী ও ভারতী দেবী ভারতীয় তথা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এই পাঁচ ‘দেবী’র মধ্যে একমাত্র ভারতীদেবী’র স্নেহ সান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল এই অধমের। যখন আলাপ হয় ভারতীয় সিনেমার এই ‘পঞ্চকন্যা’র শেষোক্তজনের বয়স তখন আটাত্তর। অথচ ব্যক্তিত্বে, সৌন্দর্যে এবং অভিনয় দক্ষতায় ভারতীদেবী তখনও তুলনাহীন। এক অদ্ভুত কাকতালীয় সন্ধিক্ষণে ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ। আমাকে আপন করে নিতে লাগল মাত্র মিনিট খানেক। সেই মুহূর্ত থেকে হয়ে গেলাম ওঁর ছোটনাতি। কিন্তু আমি পড়লাম সমস্যায়। কী বলে সম্বোধন করি ওঁকে। আমার সঙ্গে ভারতীদেবীর বয়সের ব্যাবধান আটচল্লিশ বছরের। সমাধানের রাস্তাটা উনিই বাতলে দিলেন। ডানহাতের তিন আঙুলে থুতনি নেড়ে দিয়ে বললেন, ‘আমায় দিদি বলে ডাকবি, বুঝেছিস!‘ কাছে টেনে নিয়ে জয়দীপকে বললেন, ‘আমাদের একটা ছবি তুলে দে তো দিকিনি।‘
সেদিনও রুটিন মাফিক ঢুঁ মারতে দুপুর দুপুর এনটিওয়ান-এ হাজির। এলোপাথাড়ি ঘুরছি, দেখি হনহনিয়ে জয়দীপের আগমন। জয়দীপ দত্ত। ফটো জার্নালিস্ট। সান্ধ্য আজকালে সিনেমা, টিভি, সংস্কৃতির পাতায় ফ্রিল্যান্স করে। দারুণ ফটো তোলে। হাতের লেখা মুক্তোর মতো। ওর লেখা দেখে বোঝা যেত না ছাপা অক্ষর, না হাতে লেখা। জয়দীপের সঙ্গে যুগলবন্দিতে বহু এক্সক্লুসিভ করেছি। জয়দীপ আর আমার বোঝাপড়া ছিল দুর্দান্ত। ওকে বলতে হতো না, আমার লেখা অনুযায়ী ঠিক সেইরকম ফটো তুলতো জয়দীপ।
হন্তদন্ত হয়ে আমার কাছে এসে জয়দীপ বলল, ‘চল আজ তোর সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দেবো। এদিকে আয়।‘ জয়দীপ এনটিওয়ান-এর শেষ প্রান্তে ডান হাতে ঘুরে যে ফ্লোরটা এখনও আছে সেদিকে হাঁটা লাগাল। আমি ওকে অনুসরণ করলাম।
‘আনন্দধারা’ ধারাবাহিকের ফ্লোর। পরিচালক অরুন গুহঠাকুরতা। ভদ্রলোকের সঙ্গে আগেই আলাপ ছিল। সজ্জন মানুষ। আমাদের দুজনকে দেখেই হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। বসে আছেন মনিটরের সামনে।
ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বার করতে করতে জয়দীপ জিজ্ঞাসা করল ‘ডার্লিং কোথায়?’
হেসে ফেললেন অরুনদা, ‘ডার্লিংই বটে। ভারতী দেবী এখনও হার্টথ্রব। একটু আগে শট দিয়ে মেকআপ রুমে গেছেন। এখনই আবার শট আছে। চলে আসবেন। শট রেডি, খবর দিয়েছি… ওই তো এসে গেছেন।‘

পেছন ফিরে তাকালাম। চোখ জুড়িয়ে গেল। সাক্ষাৎ মাতৃপ্রতিমা। ধবধবে সাদা শাড়ি আর ব্লাউজ। চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। কোনও প্রসাধন নেই। আমি বিস্মিত আর মুগ্ধ চোখে দেখছি জ্যান্ত সরস্বতীকে। কী সৌম্য সৌন্দর্য! ইনিই সেই ‘ডাক্তার’, ‘নির্জন সৈকতে’, ‘গল্প হলেও সত্যি’-র ভারতীদেবী! বিশ্বাস হচ্ছে না। চোখ রগড়ালাম। বাংলা সিনেমার জলজ্যান্ত ইতিহাস ধীর পদক্ষেপে হেঁটে আসছেন। জয়দীপের উপর রাগ হল। সকালে অফিসে দেখা হয়েছিল, তবুও একবারও বলেনি, আজ এনটিওয়ান-এ ভারতীদেবীর শুটিং আছে। কিচ্ছু না জেনে ভারতীদেবীর মতো একদা শীর্ষ নায়িকার সঙ্গে কথা বলবো কী করে? মিনিমাম রিসার্চ তো দরকার। তখন গুগল, উইকিপিডিয়া বলে কোনও শব্দের ভ্রুণই তৈরি হয়নি, জন্ম তো জিসাস জানে। তখন কারও সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করতে কালঘাম ছুটে যেত। আনন্দবাজার, আজকাল- এর মতো পত্রিকার আর্কাইভ অথবা ন্যাশনাল লাইব্রেরির নিউজ পেপার সেকশন, আর সিনিয়রদের স্মৃতিচারণ। এই ছিল তথ্যের সোর্স। প্রচুর সময়সাপেক্ষ ও তোষামোদের ব্যাপার। এখন কী করি! হাতের সামনে এমন একজন সিনে পার্সোনালিটি, অথচ ইন্টারভিউ করতে ভয় লাগছে। এদিকে প্রচণ্ড ইমোশনাল হয়ে পড়েছি। রীতিমতো উত্তেজনায় কাঁপছি, তার উপর যদি ভুলভাল ছড়িয়ে ফেলি! জয়দীপকে দেখি, ভারতীদেবীকে ঢিপ করে প্রণাম করে ফেলল। দেখাদেখি আমিও নিচু হয়ে পা ছুঁলাম। পায়ে সাধারণ আটপৌরে স্যান্ডেল। মাথায় হাত রাখতেই সারা শরীরটা শিউরে উঠল। ঝট করে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।
মুখ তুলে থুতনি ছুঁয়ে নিজের আঙুলে চুমু খেয়ে জয়দীপকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটি কে?’
‘ও প্রিয়ব্রত। আমাদের রিপোর্টার। তোমার সঙ্গে আলাপ করাতে নিয়ে এসেছি।‘ জয়দীপ ক্যামেরার ফোকাস ঠিক করতে করতে বলল।
‘বাহ… নামটি তো বেশ… থাকেন কোথায়?’
আমি কুঁকড়ে গেলাম, বললাম, ‘কলেজ স্ট্রিট। দয়া করে আপনি বলবেন না।‘ ‘কলেজ স্ট্রিট! আমার পুরনো পাড়া। আমরা তো ছোটবেলায় পটুয়াতলায় থাকতাম। পড়াশোনা করেছি আমহার্স্ট স্ট্রিটের লঙ সাহেবের ইংরেজি স্কুলে…’। আমি লাফিয়ে উঠলাম, ‘মানে সেন্ট পলস স্কুলে! ওই স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন জেমস লঙ। আমিও তো সেন্ট পলস স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছি। কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন।‘ ‘দেখো কাণ্ড! কী অদ্ভুত যোগাযোগ…’ ভারতীদেবীর মুখে তখন শিশুর উচ্ছ্বাস।
এক সহকারী এসে বাধ সাধলেন, ‘দিদি শট রেডি। অরুনদা ডাকছেন।‘
‘হ্যাঁ চলুন…’ বলে ভারতীদেবী আমার বাঁ হাতের কবজিটা ধরে বললেন, ‘কোত্থাও যাবি না। আমরা এক পাড়ার মানুষ। এক ইস্কুলের সতীর্থ। খুব জমবে আমাদের। শটটা দিয়ে আসি। পিঠে, পাটিসাপটা খেতে খেতে জমিয়ে আড্ডা হবে।‘
ধীর পায়ে, দৃপ্ত ভঙ্গিতে ক্যামেরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন উত্তমকুমারের প্রথম নায়িকা। মাথার ঘোমটাটা ঠিক করে নিয়ে অরুনদার কাছে শট বুঝতে শুরু করলেন। তখন অন্য ভারতীদেবী। তাঁর চরিত্রের নাম বিধুমুখী। সার্থক নাম। গোটা ফ্লোরের মধ্যে অ্যাক্টিং জোনটায় যেন জ্যোৎস্না ঝরে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘চাঁদের হাসি বাধ ভেঙেছে’। ধবধবে ফর্সা। কী গ্ল্যামার! তখনও। ওই আটাত্তর বছর বয়সেও। দুই পাশে দুই অভিনেতা। হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রের নাম ‘অরিদমন’। আর শুভাশিস মুখোপাধ্যায় ‘হরি’। চাকরের চরিত্র। অরিদমন পেশায় উকিল। বদমেজাজি এবং অভিমানীও। ছেলে অরিদমনের মেজাজ সামলাতে হিমশিম বিধুমুখী। হরি অরিদমনের দোসর। চ্যালা। খবর দিয়েছে, নিচে চেম্বারে দশ, বারোজন মক্কেল বসে আছে। শুনে উত্তেজিত অরিদমন হাফপ্যান্ট পরেই মক্কেলদের সঙ্গে মিট করতে তৎপর। বিধুমুখী ছেলেকে কিছুতেই ওই অবস্থাতে মক্কেলদের কাছে যেতে দেবেন না। সেই নিয়ে মা-ছেলের হুলস্থুল। চূড়ান্ত টানাটানির মধ্যে অরিদমন ছিটকে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বিধুমুখী মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।

কী কমেডি সেন্স! অ্যাক্টিং স্কিল ! ‘কাট’ বলে উঠলেন পরিচালক। সেদিনের মতো ভারতীদেবীর শুটিং শেষ। এদিকে মনিটরে শট দেখে পছন্দ হল না ভারতীদেবীর। পরিচালককে বললেন, ‘আর একবার শটটা দিলে খুব অসুবিধা হবে অরুন?’ ‘একেবারেই না।‘ পরিচালকের সম্মতির পরে দুই অভিনেতারও মতামত জানতে চাইলেন তিনি। দুজনেই জানালেন যে, তাঁদের কোনও আপত্তি নেই। ‘টেক টু’তে আরও ভালো ও সাবলীল দক্ষতায় অভিনয় করে দেখালেন ভারতীদেবী। দুর্দান্ত! চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। অথচ কী অমায়িক। অত বড় অভিনেত্রী, কিন্তু কী বিনয়!
শট শেষ। ‘আয়…ঘরে আয়।‘ বলে সোজা, গটগটিয়ে ফ্লোর থেকে বেরিয়ে গেলেন ভারতীদেবী।
মিনিট দশ পনেরো পর ভারতীদেবীর মেক আপ রুমে ঢুকে দেখি এলাহি কাণ্ড। বলতে গেলে প্রায় এক হাঁড়ি নানা রকম পিঠে তৈরি করে নিয়ে এসেছেন। সঙ্গে মিষ্টি তো আছেই। আমি আর জয়দীপ প্রায় একসঙ্গেই জিজ্ঞাসা করলাম ‘ব্যাপার কী?’
‘আয় তোরা… ভেতরে আয় বলছি’, মিষ্টি হেসে হাত বাড়িয়ে ডাকলেন ভারতীদেবী। ‘এই নে পাটিসাপটা খা। নিজে হাতে তৈরি করেছি।‘
‘আজ তো তোমার জন্মদিন নয়, তবে…’ পাটিসাপটায় একটা কামড় বসিয়ে জিজ্ঞাসা করল জয়দীপ।
‘আজ আমার অভিনয় জীবনের ষাট বছর পূর্ণ হল। এই এনটিওয়ান-এই ‘ডাক্তার’ ছবির জন্য প্রথম শট দিয়েছিলাম। সেই সঙ্গে আমার নামেরও ষাট বছর পূর্তি। খাওয়া বন্ধ করে আমি হাঁ করে চেয়ে আছি ভারতীদেবীর দিকে। ‘নামের ষাট বছর.. ব্যপারটা বোধগম্য হল না’, ভ্যাবলার মতো বললাম আমি। ‘এগুলো অবশ্য তোদের জানার কথাও হয়। আমার আসল নাম মহামায়া দাস। ‘ডাক্তার’ সিনেমার শুটিং শুরুর আগে সকলে মিলে আমার নাম বদলে দিয়ে রাখল ‘ভারতী’! ডাক্তার হিট করে গেল। আর আমার ভারতী নামটাই রয়ে গেল।‘
পটুয়াতলা ছাড়লেন কেন? ‘আমি তো ছাড়িনি। বাবা তেরো বছর বয়সে আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। বেনারস চলে গেলাম। ব্যস কলেজ স্ট্রিট পাড়ার সঙ্গে আমার সম্পর্কও ছিন্ন হয়ে গেল। তবে ওই জায়গাটাকে আজও ভুলতে পারিনি। গোলদিঘিতে বেড়াতে যাওয়া, বাড়ির পেছনে এক আখড়ায় লাঠি খেলা শেখা, খোখো, ব্যাটমিন্টন খেলতে যাওয়া, মেজকাকার সঙ্গে সেতার বাজাতে বসা, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে নাটক দেখতে যাওয়া…. ছোটবেলার স্মৃতি তো… ভুলতে পারিনি।
এতক্ষণ টেনশন হচ্ছিল ভারতীদেবীকে কী প্রশ্ন করব তাই নিয়ে। দেখলাম উনি নিজেই গল্পের ছলে সবই গড়গড় করে বলে চলেছেন। বললেন, ‘তোদের বাড়িটা ঠিক কোথায়?’ বললাম। ‘তাহলে তো একদিন তোদের বাড়ি যেতে হবে দেখছি!’
‘আপনি যাবেন!’ আমি তো অবাক। ‘কীরে জয়দীপ, নিয়ে যাবি না আমার পুরনো পাড়ায়! মরে যাবার আগে আমার শৈশব, কৈশোরের কলেজ স্ট্রিটকে একবার শেষবারের মতো দেখতে বড় ইচ্ছে করে।‘
‘নিয়ে যাব ডার্লিং, ঠিক নিয়ে যাব। কবে যেতে চাও বলো?’ জয়দীপ আমার দিকে তাকাল। আমিও বললাম, ‘কবে যাবেন? আপনাদের সেই পুরনো বাড়িটা আছে?’
আমার মাথায় তখন অন্য স্টোরি ঝিলিক দিচ্ছে। ‘না রে… সে বাড়ি আর নেই। ও সব হাত বদল হয়ে গেছে। হ্যাঁ রে গোলদিঘিতে সাঁতার কাটিস? আমার খুব ইচ্ছে ছিল সাঁতার শেখার। কিন্তু ওখানে তখন মেয়েদের সাঁতার শেখার বন্দোবস্ত ছিল না।‘ অতীতে ডুব দিয়েছেন। এক অপার্থিব আলো ভারতীদেবীর মুখে। আমি বললাম, ‘আমি একটু আসছি।‘

ষাট বছর পূর্ণ হওয়ার ব্যাপারটা বললাম। লাফিয়ে উঠলেন অরুনদা। ‘আমরা আজ ফ্লোরের মধ্যেই ভারতীদেবীর এই জার্নিটা সেলিব্রেট করব। ভালো হবে না?‘ অরুনদা খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রোডাকশনের একজনকে ডাকলেন, পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে টাকা নিয়ে তাঁর হাতে দিয়ে একটা বড়সড় কেক কিনে আনতে বললেন। হারাধনদা শুনেই উঠে দাঁড়ালেন। ‘উরিব্বাস! এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার! বাংলা সিনেমায় ওঁর কন্ট্রিবিউশন ইতিহাস হয়ে থাকবে।‘ রীতিমতো উত্তেজিত হারাধনদা। শুভশিসদা তো গোটা স্টুডিওতে ভারতীদেবীর অভিনয় জীবনের ষাট বছরের বিষয়টা রাষ্ট্র করে দিলেন।
লাঞ্চ ব্রেক শেষ। আমি, জয়দীপ ফ্লোরে। ততক্ষণে কেক এসে গেছে। মোমবাতিও। সেদিন স্টুডিওতে যত আর্টিস্ট, টেকনিশিয়ান যে যেখানে ছিলেন সবাই ‘আনন্দধারা’র ফ্লোরে জড় হয়েছেন। সব আয়োজন সম্পূর্ণ। অরুনদা তাঁর এক সহকারীকে বললেন ভারতীদেবীকে ডেকে নিয়ে আসার জন্য। একজন বললেন, ওঁর তো প্যাকআপ হয়ে গেছে। আছেন তো মেকআপ রুমে? শুভাশিসদা অননুকরণীয় ভঙ্গিতে বললেন, ‘আলবাৎ আছে। থাকতেই হবে। এই তো প্রিয়র মুখে শুনলাম উনি প্রচুর পিঠে-ঠিঠে নিয়ে এসেছেন। বাড়িতে তো ফেরত নিয়ে যাবেন না নিশ্চয়ই। এর মধ্যে প্রিয়, জয়দীপ গোটা চারেক সাঁটিয়ে এসেছে। আমাদের এখনও ডাক পড়েনি। আছেন… উনি আছেন। আমি যাচ্ছি। নিয়ে আসছি।‘ বলে শুভাশিসদা প্রায় নাচতে নাচতে ফ্লোর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর দেখা গেল শুভাশিসদার বাঁ হাতে পাটিসাপটা ডান হাতে ভারতীদেবীর বাঁ হাত। ফ্লোরে পা দিতেই করতালিতে মুখর হয়ে উঠল গোটা ফ্লোর। হাততালি থামতেই চায় না। প্রথমে কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেন ভারতীদেবী। দাঁড়িয়ে পড়ে চশমা নামিয়ে শাড়ির আঁচলটা দু’চোখে চেপে ধরলেন। তখনও সবাই হাততালি দিয়ে চলেছে। অরুণদা ‘সাইলেন্ট’ বলে হেঁকে উঠলেন। বলতে হল না, হারাধনদা উচ্চস্বরে বললেন, ‘আমরা ধন্য। ভারতীদেবীর অভিনয় জীবনের ষাট বছর পূর্তির লগ্নে সামিল হতে পেরে। ওঁর সঙ্গে শট দিয়ে। উনি শুধু ধারাবাহিকে আমার মা নন, এখানে যতজন আছেন তাঁদের তো বটেই, গোটা ইন্ডাস্ট্রির মাতৃসমা। ভগবানের কাছে কামনা করি ভারতীদি যেন সুস্থ দেহ ও মনে আরও বহুদিন অভিনয় করতে পারেন।‘
হারাধনদা থামতেই আবার হাততালির ঝড়। স্তিমিত হতেই আমার দিকে তাকিয়ে ভারতীদেবী বললেন, ‘এই দুষ্টুটার কাণ্ড না? একটুখানি আসছি বলে কেটে পড়ল। পিঠে খেয়েছিল, এবার তোর পিঠে দেবো।‘ হাতজোড় করে বললাম ‘আপনি কিছু বলুন প্লিজ।‘
বললেন, ‘সেই প্রথম দিনের কথা মনে পড়ছে। ‘ডাক্তার’ এর ডিরেক্টর ফনীবাবু (মজুমদার) বললেন, ‘যা বলব, ঠিক যতটুকু করতে বলবো, ঠিক ততটাই করবে। যদি একেবারেই শট ঠিক হয় তাহলে পুরস্কার পাবে। জীবনের প্রথম শটই ‘ওয়ান টেক’ হয়ে গেল। ফনীবাবুও সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে চকলেটের প্যাকেট বার করে আমার হাতে দিলেন। এরপর যতবার শট ওয়ান টেক ওকে হয়েছে ততবারই চকলেট বার করে আমার হাতে দিয়েছিলেন ফনীবাবু। আমার প্রথম হিরো ছিলেন জ্যোতিপ্রকাশ ভট্টাচার্য। ১৯৪০ সালে ডাক্তার মুক্তি পেল…’ আবার সমবেত হাততালিতে ভারতী দেবীর কণ্ঠস্বর ডুবে গেল। এবার দৃশ্যতই কেঁদে ফেললেন তিনি। এগিয়ে এসে ভারতীদেবীকে জড়িয়ে ধরলেন লাবনী সরকার। অদ্ভুত আবেগঘন মুহূর্ত। তখন এখনকার মতো অডিও ভিসুয়াল মিডিয়ার যুগ নয়। দু’চোখ ভরে এক বর্ণময় অভিনেত্রীর জীবন নাট্যের জলজ্যান্ত দৃশ্য দেখছি। লাইভ। জয়দীপ ফিল্মের মায়া না করে খচাখচ ছবি তুলেই যাচ্ছে। লাবনীদি ভারতীদেবীকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। নরম, মায়া জড়ানো কণ্ঠে ভারতীদেবী বলে চলেছেন ভারতীয় সিনেমা শিল্পের আঁতুরঘরের উপাখ্যান। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওর বীরেন্দ্রনাথ সরকার, দেবকী বসু, নীতিন বসু, রাইচাঁদ বড়াল, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, পঙ্কজ মল্লিকদের কথা। হাঁ করে শুনছি সবাই। শুটিং-এর কথা সব বেমালুম ভুলে গেছে। মনে হচ্ছে কলঙ্কহীন এক চাঁদ খসে পড়েছে ফ্লোরের মধ্যে। আর সেই টুকরো চন্দ্রিমা ঘিরে আমরা সবাই কোনও এক অলৌকিক, অপার্থিব জগতে ভেসে চলেছি।
অনাড়ম্বর আয়োজন। অথচ কী আন্তরিক! হাততালির বন্যায় ভেসে কেক কাটলেন ভারতীদেবী। তাকালেন আমার দিকে। মুখ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘এদিকে আয়।‘ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, ‘আমি!’
‘হ্যাঁ… আয় আমার কাছে… সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আজই আলাপ হল। আমার নতুন বয়ফ্রেন্ড।‘ শুনে শুভাশিসদার চিৎকার, ‘ওরে জিও প্রিয়…’ হাততালির চোটে আমার লাল হয়ে যাওয়া কান দিয়ে যেন তখন আগুন বেরোচ্ছে। ‘হাঁ কর…’ মুখ খুলতেই একটুরো কেক হাতে করে খাইয়ে দিলেন ভারতী দেবী। মনে হচ্ছিল অজ্ঞান হয়ে যাব। কোনওরকমে নিচু হয়ে পা ছুঁলাম। টেনে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ডানহাতের তিন আঙুলে থুতনি নেড়ে দিয়ে বললেন, ‘আমায় দিদি বলে ডাকবি, বুঝেছিস।‘
(ক্রমশ)
লাঞ্চ ব্রেক শেষ। আমি, জয়দীপ ফ্লোরে। ততক্ষণে কেক এসে গেছে। মোমবাতিও। সেদিন স্টুডিওতে যত আর্টিস্ট, টেকনিশিয়ান যে যেখানে ছিলেন সবাই ‘আনন্দধারা’র ফ্লোরে জড় হয়েছেন। সব আয়োজন সম্পূর্ণ। অরুনদা তাঁর এক সহকারীকে বললেন ভারতীদেবীকে ডেকে নিয়ে আসার জন্য। একজন বললেন, ওঁর তো প্যাকআপ হয়ে গেছে। আছেন তো মেকআপ রুমে? শুভাশিসদা অননুকরণীয় ভঙ্গিতে বললেন, ‘আলবাৎ আছে। থাকতেই হবে। এই তো প্রিয়র মুখে শুনলাম উনি প্রচুর পিঠে-ঠিঠে নিয়ে এসেছেন। বাড়িতে তো ফেরত নিয়ে যাবেন না নিশ্চয়ই। এর মধ্যে প্রিয়, জয়দীপ গোটা চারেক সাঁটিয়ে এসেছে। আমাদের এখনও ডাক পড়েনি। আছেন… উনি আছেন। আমি যাচ্ছি। নিয়ে আসছি।‘ বলে শুভাশিসদা প্রায় নাচতে নাচতে ফ্লোর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর দেখা গেল শুভাশিসদার বাঁ হাতে পাটিসাপটা ডান হাতে ভারতীদেবীর বাঁ হাত। ফ্লোরে পা দিতেই করতালিতে মুখর হয়ে উঠল গোটা ফ্লোর। হাততালি থামতেই চায় না। প্রথমে কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেন ভারতীদেবী। দাঁড়িয়ে পড়ে চশমা নামিয়ে শাড়ির আঁচলটা দু’চোখে চেপে ধরলেন। তখনও সবাই হাততালি দিয়ে চলেছে। অরুণদা ‘সাইলেন্ট’ বলে হেঁকে উঠলেন। বলতে হল না, হারাধনদা উচ্চস্বরে বললেন, ‘আমরা ধন্য। ভারতীদেবীর অভিনয় জীবনের ষাট বছর পূর্তির লগ্নে সামিল হতে পেরে। ওঁর সঙ্গে শট দিয়ে। উনি শুধু ধারাবাহিকে আমার মা নন, এখানে যতজন আছেন তাঁদের তো বটেই, গোটা ইন্ডাস্ট্রির মাতৃসমা। ভগবানের কাছে কামনা করি ভারতীদি যেন সুস্থ দেহ ও মনে আরও বহুদিন অভিনয় করতে পারেন।‘
হারাধনদা থামতেই আবার হাততালির ঝড়। স্তিমিত হতেই আমার দিকে তাকিয়ে ভারতীদেবী বললেন, ‘এই দুষ্টুটার কাণ্ড না? একটুখানি আসছি বলে কেটে পড়ল। পিঠে খেয়েছিল, এবার তোর পিঠে দেবো।‘ হাতজোড় করে বললাম ‘আপনি কিছু বলুন প্লিজ।‘
বললেন, ‘সেই প্রথম দিনের কথা মনে পড়ছে। ‘ডাক্তার’ এর ডিরেক্টর ফনীবাবু (মজুমদার) বললেন, ‘যা বলব, ঠিক যতটুকু করতে বলবো, ঠিক ততটাই করবে। যদি একেবারেই শট ঠিক হয় তাহলে পুরস্কার পাবে। জীবনের প্রথম শটই ‘ওয়ান টেক’ হয়ে গেল। ফনীবাবুও সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে চকলেটের প্যাকেট বার করে আমার হাতে দিলেন। এরপর যতবার শট ওয়ান টেক ওকে হয়েছে ততবারই চকলেট বার করে আমার হাতে দিয়েছিলেন ফনীবাবু। আমার প্রথম হিরো ছিলেন জ্যোতিপ্রকাশ ভট্টাচার্য। ১৯৪০ সালে ডাক্তার মুক্তি পেল…’ আবার সমবেত হাততালিতে ভারতী দেবীর কণ্ঠস্বর ডুবে গেল। এবার দৃশ্যতই কেঁদে ফেললেন তিনি। এগিয়ে এসে ভারতীদেবীকে জড়িয়ে ধরলেন লাবনী সরকার। অদ্ভুত আবেগঘন মুহূর্ত। তখন এখনকার মতো অডিও ভিসুয়াল মিডিয়ার যুগ নয়। দু’চোখ ভরে এক বর্ণময় অভিনেত্রীর জীবন নাট্যের জলজ্যান্ত দৃশ্য দেখছি। লাইভ। জয়দীপ ফিল্মের মায়া না করে খচাখচ ছবি তুলেই যাচ্ছে। লাবনীদি ভারতীদেবীকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। নরম, মায়া জড়ানো কণ্ঠে ভারতীদেবী বলে চলেছেন ভারতীয় সিনেমা শিল্পের আঁতুরঘরের উপাখ্যান। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওর বীরেন্দ্রনাথ সরকার, দেবকী বসু, নীতিন বসু, রাইচাঁদ বড়াল, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, পঙ্কজ মল্লিকদের কথা। হাঁ করে শুনছি সবাই। শুটিং-এর কথা সব বেমালুম ভুলে গেছে। মনে হচ্ছে কলঙ্কহীন এক চাঁদ খসে পড়েছে ফ্লোরের মধ্যে। আর সেই টুকরো চন্দ্রিমা ঘিরে আমরা সবাই কোনও এক অলৌকিক, অপার্থিব জগতে ভেসে চলেছি।
অনাড়ম্বর আয়োজন। অথচ কী আন্তরিক! হাততালির বন্যায় ভেসে কেক কাটলেন ভারতীদেবী। তাকালেন আমার দিকে। মুখ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘এদিকে আয়।‘ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, ‘আমি!’
‘হ্যাঁ… আয় আমার কাছে… সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আজই আলাপ হল। আমার নতুন বয়ফ্রেন্ড।‘ শুনে শুভাশিসদার চিৎকার, ‘ওরে জিও প্রিয়…’ হাততালির চোটে আমার লাল হয়ে যাওয়া কান দিয়ে যেন তখন আগুন বেরোচ্ছে। ‘হাঁ কর…’ মুখ খুলতেই একটুরো কেক হাতে করে খাইয়ে দিলেন ভারতী দেবী। মনে হচ্ছিল অজ্ঞান হয়ে যাব। কোনওরকমে নিচু হয়ে পা ছুঁলাম। টেনে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ডানহাতের তিন আঙুলে থুতনি নেড়ে দিয়ে বললেন, ‘আমায় দিদি বলে ডাকবি, বুঝেছিস।‘
(ক্রমশ)
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন