ম্যারিনা নাসরীন
বিশ্রীরকমের দ্রিম দ্রিম শব্দে ফোনটা বেজে ওঠে। তুলতুলের কাজ। মেয়েটা পারলে ঘন্টায় ঘন্টায় বাবার ফোনের রিংটোন বদলায়। বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমুচ্ছে তুলতুল। ফোনের শব্দে ঘুম না ভেঙে যায়। ফরহাদ খুব সাবধানে এবং ক্ষিপ্রগতিতে ফোনটা চোখের সামনে ধরে। স্ক্রিনে আননোন নম্বর ভাসছে। রিসিভ করতেই কর্কশ একটা পুরুষকন্ঠ খরখর করে ওঠে। রমনা থানার সায়েম নামে কোন এক ডিউটি অফিসার। নির্দেশের সুরে বলেন, এক্ষুনি ফরহাদকে থানায় যেতে হবে। বিষয় কি, এত ভোরে থানায়? কে কোন কেসে ফেঁসে গেল? ফরহাদ কুলকিনারা করতে পারে না। হোকগে, যার যা হোক। ধীরে সুস্থে গেলেই হবে। ফরহাদ আরেকটু ঘুমের প্রস্তুতি নেয়।
দশমিনিট না যেতেই আবার ফোন। একই নম্বর। এবার আর ফোন রিসিভ করে না ফরহাদ। নাহ! আর শুয়ে থাকা যাবে না। নিশ্চয়ই কিছু একটা ঝামেলা আছে। দেরী হলে পুলিশ বাসায় এসে হাজির হবে। সেটা ভালো দেখাবে না। কিন্তু ঝামেলা বাধায় তুলতুল। সে ঘুম থেকে উঠে বসেছে। বাবাকে কিছুতেই ছাড়বে না। ওর হাত ধরেই বেরিয়ে যায় ফরহাদ।
শুনশান ভোর। থানায় পৌঁছাতে বেশি সময় লাগে না। কিন্তু থানা বাউন্ডারীর মধ্যে ঢুকে মুহূর্তের জন্য ফরহাদের মস্তিস্ক স্মৃতিশূন্য হয়ে পড়ে। কোথায় আছে, কেন আছে বুঝতে পারে না। সামনে রাখা ভ্যানের ওপর রিনা। নিথর, নিস্তব্ধ। মাথার একপাশ আর একটা হাত থেঁতলে গেছে। সম্বিৎ ফিরে দুহাতে তুলতুলের চোখ চেপে ধরে ফরহাদ। মনে হয়েছিল মাকে এভাবে তুলতুল না দেখুক। কিন্তু মেয়ে আগেই মাকে দেখে ফেলেছে। মাম্মি বলে আকাশ বাতাস এক করে কেঁদে ওঠে। তুলতুলের কান্নার শব্দেই সম্ভবত ডিউটি অফিসার সহ আরো দুজন বেরিয়ে আসেন। শিশুকে সাথে করে নিয়ে এসেছে বলে অফিসার কিছুটা নাখোশ হন। তিনি সাথের একজন ভদ্রলোকের সাথে ফরহাদকে পরিচয় করিয়ে দেন।
“ইনি রাজিব। আপনার স্ত্রীর সাথে ছিলেন।” রাজিবকে ফরহাদ চেনে। রিনার কলিগ। কিন্তু রাজিব এলো কোথা থেকে? তিনদিন আগে যখন রিনা অফিস টুরের কথা বলে চট্টগ্রাম যায় তখন বলেছিল সাথে ওর কলিগ সায়মা যাচ্ছে। গতকাল বিকেলেও ফোনে বলেছে আজ রাতের ট্রেনে ওরা রওনা দেবে। আগামী কাল ভোরে ঢাকা পৌঁছনোর কথা। অফিসার বলে চলেছেন, “কমলাপুর স্টেশন থেকে দুজনে রিকশায় ফিরছিলেন। চলন্ত মাইক্রোবাস থেকে ছিনতাইকারী রিনার ব্যাগ ধরে টান দিলে তিনি নীচে পড়ে যান। মাইক্রোবাস তাকে চাপা দিয়ে ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যায়।” ফরহাদের মাথায় অফিসারের কথা ঢুকছিল না বা তুলতুলের কান্নাও তার চিন্তায় কোন ধরণের ঢেউ তুলছিল না। ওর মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল, রাজিব আর রিনা কি হোটেলের একই রুমে ঘুমিয়েছিল?
মৃত ব্যক্তির সততাকে সন্দেহ করা অথবা পদস্খলনের অনুমান করা অত্যন্ত নিদারুণ দয়াহীনতা