মোহনা মজুমদার

‘বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে, বাবা মহাদেব! ‘গাজন গাইতে গাইতে গলার নালী যেন শুকিয়ে আসে দিবাকরের। গায়ের কমলা গেঞ্জিটা ভিজে চপচপে। আজকাল আর কেউ শিবের গাজনে ভিক্ষে দিতে চায় না। শুধু ডমরু, ঢাক, গাজনের আওয়াজে মুখ বাড়িয়ে ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে তাকায়, ওই অদ্ভুত সাজ নিরীক্ষণ করে, আবার ভেতরে ঢুকে যায়। চৈত্রের সকাল, বড় রোদের তেজ আজ। ত্রিশুলে জড়ানো মালাটাও যেন ধুঁকছে। গলি গলি ঘুরেও বিশেষ কিছু ভিক্ষে জমেনি আজ দিবাকরের ঝোলায়। কুড়িয়ে বাড়িয়ে একমুঠো চাল, আলু, আর একটা বেগুন মিললো। ‘এটুকুর জন্য সারাদিন চলে গেল?’ মিনতি দেখলেই আবার বকবক করবে। কিন্তু কি করবে, এই গাজনের ভিক্ষে সংগ্রহ যে ওদের বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। ছোটবেলায় বাবা-মার সঙ্গে গেলেও, এখন মিনতিকে বললে ও সঙ্গে যেতে চায় না। বলে দেয় ‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট, তার থেকে তুমি যাও, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াও’। মিনতি যে কেন এতো বিরক্ত থাকে সবসময় ওর ওপর, কথাগুলো খারাপ লাগলেও চুপ করে থাকে দিবাকর। অ্যাতো বছর এক ছাদের তলায় থেকেও মিনতির মন যেন পড়তে পারে না সে। আবার নিজেকে বোঝায় সত্যিই তো, এসব করার থেকে রিক্সাটা নিয়ে বেরোলে দু পয়সা ঘরে আসতো।
– মা, তোমায় যে টাকাটার কথা বলেছিলাম, ওটা কি কিছু…?
– না রে, দেখছিস তো সংসারের যা অবস্থা, তোর বাবাটাও ওরম। আমি একা আর কতদিক সামলাবো?
– মা, রুমেলিকে বলেছি। ও পরের মাস থেকে দুটো টিউশন দেবে বলেছে। তখন আর আমাদের অ্যাতো কষ্ট থাকবে না, দেখো।
মিনতি কিছু না বলে আলতো করে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে। চোখ দুটো জলে চিকচিক করে ওঠে।
– শোন, খাটের তলায় খাবার চাপা দিয়ে রাখা আছে, সময় মতো খেয়ে নিস। আমি বেরোলাম।
পরেশদার চায়ের দোকানের পাশে রাস্তার এক কোণায় প্লাস্টিক বিছাচ্ছে মিনতি। তার ওপর একে একে চুলের ক্লিপ, সেফটিপিন, ইমিটেশনের কানের দুল, চিরুনি সব সাজাচ্ছে।
– পরেশদা, মেয়েটার পড়াশোনার খরচ আর টানতে পারছি না, গো। তোমার চায়ের দোকানে তো সারাদিন অনেক বাবুরা চা খেতে আসে, একটু দেখো না, যদি ওর একটা চাকরীর ব্যবস্থা করা যায়।
– দেখছি, দেখছি, তুই এ্যাতো চিন্তা করিস না, মিনতি। আগে ওকে কলেজটা পাস করতে দে। তবে তো কাউকে বলতে পারবো।
– ঠিক বলেছো। পড়াশোনাটা আগে শেষ করুক। আজ জানো বাবা তারকনাথের কৃপায় অনেক কটা মাল বিক্রি হয়েছে। ভাবছি মেয়েটার জন্য একটু বিরিয়ানী কিনে নিয়ে যাবো। ওই বাসস্ট্যান্ডের দোকানটায় – হাফ পেলেট, পঞ্চাশ টাকা।
– যা ভালো বুঝিস কর। আমার আর মাথা খাস না। অনেক কাজ পড়ে আছে। যা এখন।
হঠাৎই একটা কলরব কানে আসে পরেশের। কাছেই মানুষের জটলা। ছুটে গিয়ে দেখে অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে মিনতি। রক্তাক্ত, প্রায় অসাড়।
পরেশ দৌড়ে গিয়ে কাছে টেনে নিতেই ও বলে, ‘পরেশদা আমাদের মেয়েটাকে দেখো, মনে রেখো ওর শরীরে যে তোমারই রক্ত বইছে, একথা কেউ কোনোদিন যেন জানতে না পারে।’
পথে পড়ে থাকে বিরিয়ানীর প্যাকেট, ছড়ানো-ছেটানো আলু, চাল, মাংস আর সত্যি না হতে পারা এক গোপন সংসার..
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন