অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য

“আমাকে একটা বড় ঘড়ি কিনে দিবি?”
“সারা বাড়িতে ঘড়ি অনেক আছে। আর ঘড়ি দিয়ে কী করবে বাবা?”
প্রভাত মুখুজ্যে দেওয়ালের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
–“ঐ হাওড়া ষ্টেশনে যেমন বড় ঘড়ি আছে। ঠিক তেমনি বড় একটা ঘড়ি।”
“ও, বাবা তোমার এখন সময় দেখার দরকার কী? সারাদিন তো শুয়ে থাকো। পাড়ার মধ্যে হাঁটাও বন্ধ করে দিয়েছ। টিভি দেখো আর ঘুমাও।
প্রভাত মুখুজ্যের কথাটা পছন্দ হল না। বিছানায় শুয়ে উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন।
শৌর্য বুঝেছে বাবা রাগ করেছে। বাবাকে জাপটে চুমু খেল “আচ্ছা আজকেই নিয়ে আসব অমন ঘড়ি।”
দন্তবিহীন মুখে সারল্যের হাসি ফুটে উঠেছে “সত্যি তুই নিয়ে আসবি?”
সন্ধেবেলায় দুজন মানুষ ধরাধরি করে নিয়ে এলো বিশাল এক গোল ঘড়ি। দেওয়ালে জানলা বাদে যে অংশ, বৃত্তাকার ভাবে সবটাই প্রায় দখল করে নিয়েছে নতুন ঘড়ি। ঘড়ি চলছে টিক্ টিক্ টিক্।
প্রভাতবাবু ঘড়ির নিচে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালেন – “মনে হচ্ছে আমি আবার ডিউটিতে ফিরে গেছি।”
রাত প্রায় একটা। ঘড়িতে ঢং করে কোন আওয়াজ না হলেও। প্রভাত মুখুজ্যের ঘুম ভেঙে গেছে। সারা ঘরে ডিম লাইটের আলো ছড়িয়ে পড়েছে।
টর্চের আলো ঘড়ির উপর ফেলতেই ছোট চলন্ত কাঁটা দেখতে পেলেন। ঘড়ির পাশে একটা টিকটিকি চুপ করে ঘুমচ্ছে নাকি ঘড়ির আওয়াজ শুনছে বুঝতে পারলেন না। প্রভাতবাবু লক্ষ্য করলেন তার হৃদয়ের লাব ডুবের সঙ্গে ঘড়ি বেশ ছন্দ মিলিয়ে নেচে চলেছে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে খুব অসুবিধা হয়। পুরনো কথা মনে পড়ে। একবার ট্রেন নিয়ে উত্তরপ্রদেশ যাচ্ছিলেন।ঠিক রাত একটা, ট্রেন লাইনের উপর এক মহিলা দৌড়ে এলেন। ট্রেন থামানো সম্ভব ছিল না। যতক্ষণে ট্রেন দাঁড়িয়েছে দেহ ছিন্ন ভিন্ন। মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু লোকো পাইলটের জীবনে এমন ঘটনা প্রায় ঘটে।
কুকুর, গরু, মোষ, মানুষ কতকিছু যে রেলের চাকায় পিষেছেন হিসাব করলে মুশকিল। এই মাঝরাতে এসব কথা মনে পড়ছে! ঘুমবার আগে রোজের মতো কথামৃত পড়ে ঘুমিয়েছেন। তবু এসব বিচ্ছিরি স্বপ্ন আসে কেন?
উঠে জল খেলেন একটু। হঠাৎ চোখ পড়ল সোফায় কয়েকজন বসে আছে। প্রভাতবাবু ঠিক চিনতে পারলেন না। এই রাতের বেলায় তারা বসেই বা আছে কেন? কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলেন – “আপনারা এখানে বসে কেন?”
লোকগুলো কথা বলছে না। প্রভাতবাবু লাইট অন করার জন্য হাত বাড়ালে একজন বলল – “আলো আমাদের ভালো লাগে না। আমাদের চেনার দরকার নেই তোমার। সেদিনও তো চিনতে পারো নি?”
“কোনদিন চিনতে পারিনি?”
একটা লোক প্রভাতবাবুর খাটে বসল।– “যেদিন আমি ট্রেনের দিকে ছুটে আসছিলাম। আমায় পিষে দিয়ে চলে গেলে।”
প্রভাতবাবু ঘামছেন – “কিছু করার থাকে না।আর কেউ সুইসাইড করলে লোকো পাইলটের দোষ কী?”
এবার আরও একজন প্রভাতবাবুর আরেকপাশে বসল – “দোষ দিলাম কোথায়?”
সোফায় একজন মা কোলে বাচ্চা নিয়ে বসে আছে। পাশে আরেকজন বসে।
– “আমরা ট্রেন লাইনে বসে রুটি খাচ্ছিলাম। দেখতে পাওনি আমাদের? নাকি সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”
প্রভাতবাবু নিজের দোষ সেদিনও স্বীকার করেননি। ঘুম নয় একটু চোখ লেগে গেছিল। ট্রেন অন্য লাইনে ঢুকে কিছুদূর যেতেই হুশ ফিরেছিল। ততক্ষণে মা বাবা সমেত বাচ্চাটা ট্রেনের চাকায় দলা পাকিয়ে গেছিল। ব্যপারটা নিয়ে জল ঘোলা হয়নি। ধামাচাপা পড়ে গেছিল।
প্রভাতবাবু গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন।
– “এসব ফালতু কথা বলতে এসেছ সব? আমায় ভয় দেখাতে এসেছ? এখুনি এখান থেকে যাও।”
সবকটা ছায়া এবার হাসছে।
– “আমরা তো আসিনি। তুমি সময়ের পিছনে ফিরতে চাইছ। তাই তো অমন বড় ঘড়ি নিয়ে এলে। আমরা কেন বাদ যাব? আমরাও তোমার স্মৃতির অঙ্গ।
প্রভাতবাবু হঠাৎ খুব রেগে গেলেন। আমি চাই না স্মৃতিতে ফিরতে। খাটের তলায় রাখা হাতুড়ি দিয়ে নতুন কেনা বড় ঘড়িটা ভেঙে ফেললেন। কাচ ভাঙার শব্দে ছেলে অন্য ঘর থেকে দৌড়ে এসেছে।
– “বাবা এটা তুমি কী করলে?”
“ভেঙে ফেললাম। স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখলেই সে গিলে খায়। নেই এখন কেউ নেই। দেখ আমার ঘরে কেউ আছে?”
“বাবা, কে থাকবে? তুমি কী পাগল হয়ে গেলে?”
সোফায় বসে তখনও ছায়ামূর্তিগুলো ফিসফাস করছে। শুধু তাদের দেখা যাচ্ছে না। দেওয়ালে টিকটিকি ডেকে উঠল টিক্ টিক্ টিক্।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
ভাল লাগল