micro-story-parul-somachar

পারুল সমাচার
মাহবুবুল ইসলাম

 

জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে কমরআলী হিসেবের খাতা খুলে বসেছে মনে মনে। এতো বছরের হিসেব কি আর এক ঝটকায় মিলে? কমরআলী তার পিছন দিকে হাতড়ে খুঁজে ফিরে শৈশব কৈশোর যৌবন। কোথায় গেল সেই সব সুসময়গুলো! যে সময় সে ভাল না থাকতে চাইলেও খারাপ থাকা হত না। যে সময়গুলো সে অনায়েসে নষ্ট করেছে অন্যকে সুসময় এনে দিতে গিয়ে। কোথায় লুকিয়েছে সে সময়গুলো যখন পাশের গ্রামের পারুলের সঙ্গে লুকিয়ে কাটিয়েছে খড়ের গাঁদার ভেতরে। সময় লুকিয়ে যায়, পালিয়ে যায়, হারিয়ে যায়! হতাশা আর স্মৃতি চিঠির খামে লেগে থাকা ডাক বিভাগের সিলের মতো লেগে থাকে।  

  কমরআলী তার জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলেছে অনেক কিছু, যেমন অনেকে মাটিতে বসে থেকে উঠে যাওয়ার সময় পেছনে লেগে থাকা ঘাস ঝেড়ে ফেলে, তেমন। কমরআলী যখন নিজেই প্রায় ঝড়ে যাবে সে সময় তার মনে এসে উঁকি দেয় কিছু ঝেড়ে ফেলতে না পারা সময় আর নাম। যে সময় আর নামগুলো স্বযত্নে পাশ কাটিয়ে চলেছে এতো কাল।  

  কমরআলীর ঝাপসা চোখের সামনে আরো বেশি ঝাপসা হয়ে ভেসে উঠতে চায় পারুল হীন সময়গুলো। কমরআলীর বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে খালের মতো নালা। বর্ষা কাল ছাড়া সারা বছর হত দরিদ্র মানুষের কপালের মতো যে খালের বুক ফেটে থাকে। সেই খালে একা একা কোষা নৌকা নিয়ে চলে গেছে পারুলদের গ্রামে। এমন অনেক দিনই হয়েছে দেখা হয়নি পারুলের সঙ্গে, তবু গেছে কমরআলী। পারুলের দেখা না পেলেও পারুলের গ্রামে গেলেই কমরআলী পারুলের গায়ের ঘ্রাণ পেতো। কমরআলী পারুলের ঘ্রাণ নেয়ার জন্য ঝড় বাদল, রোদ বৃষ্টি মাথায় করে চলে গেছে পারুলদের গ্রামে।  

  কমরআলী এই ঝাপসা চোখেও পরিষ্কার দেখতে পায় পারুলের চোখের পাতা, খুব আবেগে পারুলের চোখের পাতাগুলো কেমন ডানা ঝাপটানো পাখির ডানার মতো দেখাতো। কমরআলী দেখতে পায় পারুলের শরীরে কেমন লেপ্টে থাকে সুতি শাড়ি যখন পারুল খাল থেকে স্নান সেরে ফিরে যেত ঘরে। পারুলের শরীর এবং মন ছিল খালের মতোই, শুধু বর্ষাতেই জমে উঠতো ভরে উঠতো।

  একদিন কমরআলী পারুলের জন্য শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট, চুড়ি, আলতা, পাউডার নিয়ে সারা রাত অপেক্ষা করেছে ঝিম ধরা বৃষ্টির মধ্যে। পারুল আসেনি। আসতে পারেনি। কমরআলী রাগে দুঃখে ভোরবেলা তালের রসের তাড়ি খেয়েছে। ঝিম ধরা মাথা নিয়ে কোথায় কোথায় গেছে কি কি করেছে কিছুই খেয়াল করতে পারেনি। পরের রাতে পারুলকে হাতের কাছে পেয়ে এমন ভাবে জড়িয়ে ধরেছিল যে পারুলের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কমরআলী তার হাতের জিনিসপত্র পারুলের হাতে দিয়ে বলে ছিল এখনি ব্লাউজটা পড়ে দেখো টাইট বা ঢিলা হলে পালটিয়ে আনবো। পারুল কমরআলীর দিকে পিঠ দিয়ে গায়ের ব্লাউজ খুলে কমরআলীর দেয়া নতুন ব্লাউজ পড়ে ছিল। কমরআলীর চোখের সামনে এখনো পারুলের সেই তামাটে পিঠ ভেসে উঠে। চাঁদের আলোয় দেখা তামাটে পিঠের নেশার কাছে কমরআলীর তাড়ির নেশা যেন কিছুই না। ব্লাউজ পড়ে বুতাম লাগাতে লাগাতে পারুল মুখোমুখি হয়ে কমরআলীকে বলেছিল একেবারে ফিট হইছে, ঢিলাও হয়নাই টাইটও হয় নাই! শরীর থেকে খুলে রাখা পুরনো ব্লাউজটা কমরআলী হাতে নিয়ে পারুলকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল এইটা আজ থেকে আমার কাছে থাক। পারুল অবাক হয়ে জানতে চাইলো কি করবা এইডা দিয়া? কমরআলী পারুলের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল তোমার শরীরের ঘ্রাণ ছাড়া আমার ঘুম আসে না। পারুল মুচকি হেঁসে কমরআলীর হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে পুরনো ব্লাউজটা রেখে সেদিন চলে গেছিলো। যেতে যেতে বলেছিল তুমি জড়িয়ে না ধরলে আমারও ঘুমা আসে না।

  অথচ ত্রিশ বছরের অধিক সময় ধরে কমরআলী পারুলের শরীরের ঘ্রাণ ছাড়াই ঘুমাতে গেছে, পারুল কমরআলীর জড়িয়ে ধরা ছাড়াই ঘুমাতে গেছে। সেই ত্রিশ বছর আগে দুজনের কেউই ভাবতে পারেনি একে অন্যকে ছেড়ে বাঁচতে পারবে! অথচ হাড় জিরজিরে জীবনে এসেও তারা বেঁচে আছে চুম্বকের দুই মেরুর মতো। কমরআলী কখনো কখনো ভাবে পারুল কি মনে রেখেছে আমাকে? পারুলের শরীরের ঘ্রাণ কি বদলে গেছে? পারুল কি ঘুমোতে যাওয়ার সময় ভাবে আমার কথা? কমরআলীর ভাবনা নিজের মধ্যেই থাকে, ভাবনাগুলোর কোন উত্তর আসে না।

 



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *