bibidho-otithi-sakhyat-ishwar

অতিথিই সাক্ষাত ঈশ্বর?
ফিচার
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

 

“বসুধৈব কুটুম্বকম্” নামে উপনিষদের এই সুক্তটি আমরা জানি। এর উৎসমূলে মূল সংস্কৃত শ্লোকটি হল –

“অয়ং নিজঃ পরোবেতি গণনা লঘুচেতসাম্।

উদারচরিতানামান্তু বসুধৈব কুটুম্বকম্।।”

এই শ্লোকটির অর্থ হল সমগ্র মানবজাতিই পরিবার। এটা আমার, ওটা অন্যের… এই ভাব শুধু এক ক্ষুদ্র স্বার্থবাদী মানুষের। এক উদার চেতনা সম্পন্ন মানুষ এই পৃথিবীর সবাইকে একই পরিবারভুক্ত ভাবে। এই বিশ্বই আমাদের ঘর। সেই বিশ্বের মানুষজনের সঙ্গেই আমাদের জগতজোড়া আত্মীয়তা।

এবং মূল এই শ্লোক থেকে “বসুধা” অর্থাৎ পৃথিবী + “এব” অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে + “কুটুম্বকম্” বা পরিবার যা সন্ধি করলে “বসুধৈব কুটুম্বকম্” বাগধারাটি আজ আমাদের বাংলাতেও দিব্য ব্যবহৃত হয়।

আদতে স্বাধীনতার পর থেকেই বেদ ও উপনিষদের প্রাণস্বরূপ আমাদের দেশ ভারতের পররাষ্ট্র নীতির মূল ভিত্তি স্বরূপ এই শ্লোকটি বিবেচিত হয়ে আসছে। যেটি ভারতের সংসদ ভবনের প্রবেশদ্বারে জ্বলজ্বল করছে।

তবে কেউ ভাবেন এক আর হয় আরেক। তাই উপনিষদের নীতিকথা হয়ত অনেকাংশেই মান্যতা পায় না সেভাবে। স্বার্থপর মানুষ এখন শুধু নিজের কথাই ভাবে বেশী করে। সত্যিসত্যি যদি সারা বিশ্ব জুড়ে এমন আত্মীয়তার বন্ধনে আমরা আবদ্ধ থাকতাম তাহলে হয়ত পৃথিবীটা একটু ভালোভাবে বাসযোগ্য হয়ে উঠত। তবে এই আপ্তবাক্য মাথায় রেখে নিজের সমাজ, সংসার তথা নিজের রাজ্যে তথা দেশের মধ্যেও অন্তর্জাতিক ভাবে সেই বার্তা ছড়িয়ে দিতেই পারি আমরা। তাই না? আমরা একে অপরের কুটুম্ব তো বটেই।

এই কুটুম্ব বা কুটুম প্রসঙ্গেই মনে পড়ে আরও একটি জনপ্রিয় সংস্কৃত বাগধারা “অতিথিদেবো ভব”। এর উৎসমূলে মহাভারতের অনুশাসন পর্বের এক গল্প।

তিথি না মেনে যিনি গৃহে আসেন তিনিই অতিথি আর সেই অতিথির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে তাঁকে পাদ্যঅর্ঘ্য থেকে খাদ্যদ্রব্য সবকিছুই বিশেষভাবে নিবেদনের রীতি ছিল সেই পুরাকাল থেকে। প্রাচীন ভারতবর্ষে অতিথিসেবা ছিল এক অবশ্য কর্তব্য। এই অতিথির সংজ্ঞা পাই মহাভারতের অনুশাসন পর্বে।

“অনিত্যং হি স্থিতো যস্মাত্তস্মাদতিথিরুচ্যতে” অর্থাৎ যিনি গৃহস্থের আবাসে অনির্দিষ্ট কাল অবস্থান করবেন তিনিই অতিথি। সেকালে দূর দূরান্ত থেকে আগত অতিথিরা পথশ্রমে হাক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত থাকতেন। তাঁরা কমপক্ষে একবেলা তো অবস্থান করবেনই। তাঁকে পাদ্য অর্ঘ্য বা পা ধোবার জল, মধুপর্ক বা ঘি, দৈ, মধু, দুধ ও চিনি মিশ্রিত পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করা এবং গৃহস্থ নিজের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য যা আহার্য প্রস্তুত করেছেন তা থেকেই দেওয়া অবশ্যকর্তব্য। তা সে খুদকুঁড়ো বা মুড়ি হোক বা খুদের জাউ, ফলাহার হোক বা ভাতের হাঁড়ি চেঁচে পুছে যৎসামান্য হলেও অন্ন আর আধুনিক কালে বিস্কিট বা সিঙ্গারা সহযোগে চা বা কফি অথবা শরবত তেমন কিছুই সাজিয়ে দেবেন সম্মানের সঙ্গে… এ এক প্রাচীন রীতি। মহাভারতে বিদুরের ঘরে শ্রীকৃষ্ণ কে ভক্তিভরে অর্পণ করা খুদকুঁড়ো দিয়ে আপ্যায়নের কথা আমরা জানি যা গ্রহণ করে কৃষ্ণ যারপরনাই তুষ্ট হয়েছিলেন। তা কখনোই বৈভব প্রদর্শন বা চব্য-চূষ্য-লেহ্য-পেয় ব্যাঞ্জনাদির মাধ্যমে নয়। মুখ্য উদ্দেশ্য হল অতিথি সেবার জন্য যথোচিত পরিষেবা দান। শ্রদ্ধার সঙ্গে সামান্যতম সৌজন্যপ্রকাশ এবং অতিথিকে আরাম দেওয়া। আশ্চর্যের কথা এই যে সেখানে শত্রুও যদি অতিথি হয়ে আসেন তাহলেও সংবর্ধনা প্রাপ্য।

মহাভারতের অনুশাসন পর্বে ভীষ্ম শরশয্যায় শায়িত। আর সেই অন্তিমকালেই তিনি মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে অতিথি সৎকার নিয়ে এক পুরাকালিক কাহিনি শুনিয়েছিলেন। সেখানেই আছে, মৃত্যুর ওপরে স্থান অতিথিসেবার মত ধর্মনিষ্ঠ ব্রত। প্রজাপতি মনুর পুত্র মহারাজ ইক্ষ্বাকুর শতপুত্রের মধ্যে দশম পুত্রের নাম দশাশ্ব। যার ঔরসে জন্ম মদিরাশ্বের। তাঁর পুত্র মহাবলপরাক্রান্ত দ্যুতিমান। দ্যুতিমানের পুত্র সুবীর আর সুবীরের পুত্র মহাত্মা সুদুর্জয়। সুদুর্জয়ের পুত্র ছিলেন অসামান্য বলশালী দুর্যোধন, যিনি ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর পুত্র দুর্যোধনের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন। এই দুর্যোধনের স্ত্রী নর্মদার গর্ভে জন্মেছিলেন সুদর্শনা নামে এক পরমাসুন্দরী কন্যা, যাকে পত্নীরূপে লাভ করেন অগ্নিদেবতা হুতাশন। তাঁদের পুত্রের নাম সুদর্শন। যথাকালে ওঘবতীর সঙ্গে সুদর্শনের বিবাহ হয়। অগ্নিপুত্র সুদর্শনের মনে সদা মৃত্যুজয়ের বাসনা জাগ্রত হয়। তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন গৃহাশ্রম থেকে মৃত্যুকে পরাজিত করবেন বলে। এই প্রতিজ্ঞা শুনে মৃত্যু চমকিত হলেন। একজন গৃহী রাজপুত্রের মৃত্যুঞ্জয়ী হওয়ার বাসনাকে তিনি দুঃসাহস বললেন। এত বড় আস্পর্ধা! সুদর্শনের অভীপ্সা নষ্ট করার জন্য মৃত্যু ছিদ্র অর্থাৎ পাপ, অর্ধমোচিত আচরণ খুঁজতে উদ্যত হলেন। মৃত্যু তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষিত পাপ মুহূর্তটির জন্য উৎসুক হয়ে রইলেন। এদিকে সুদর্শন জানেন গৃহে অতিথিসেবাই সর্বোত্তম ও শ্রেষ্ঠ ব্রত। সেই ব্রতপালনে তিনি সচেষ্ট হলেন আরও দৃঢ়ভাবে। স্ত্রী ওঘবতীকেও বললেন সদা জাগ্রত থাকতে যাতে গৃহে সমাগত অতিথির প্রতি কোনরূপ প্রতিকূল আচরণ যাতে না হয়।

“যেন যেন চ তুষ্যতে নিত্যমেব ত্বয়াতিথিঃ”

অগ্নিপুত্র সুদর্শনকে আশ্বস্ত করলেন ওঘবতী। স্ত্রী বললেন, স্বামীর ধর্মপালনই স্ত্রীর কর্তব্য। অতএব তিনি মাথা পেতে নিলেন স্বামীর আদেশ।

মৃত্যু আড়াল থেকে স্বামী-স্ত্রীর এই কথোপকথন শুনে রীতিমতো আতঙ্কিত হলেন। তিনি এমন অতিথিপরায়ণ দম্পতিকে কীভাবে পরাভূত করবেন ভেবে কূল পেলেন না। নিরুপায় হয়ে ছিদ্রাণ্বেষী মৃত্যু সুদর্শনের পিছু নিলেন। ওদিকে গৃহস্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে ব্রাহ্মণের বেশে অশরীরি মৃত্যু অতিথি হলেন আর ওঘবতীর কাছ থেকে যথোচিত মর্যাদায় অতিথি সৎকারের আয়োজন করতে বললেন। ওঘবতী সম্মত হয়ে বললেন তিনি প্রস্তুত। অতিথি কী চান তার নিকট, তা শুধু জানালেই তিনি তাঁকে তৃপ্ত করবেন। ব্রাহ্মণের বেশে অতিথিরূপী মৃত্যু জানালেন তিনি ওঘবতীকেই চান সেই মুহূর্তে। সেই মুহূর্তে নিজসত্ত্বায় কম্পন অনুভূত হলেও অতিথিকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে ওঘবতী অবিচল। তাই স্ব-দেহ দানের মত ঘৃণ্য এবং জঘন্য সেবায় অনিচ্ছায় সম্মতি দিয়ে বসলেন। তিনি জানেন যে তিনি পাপ করছেন কিন্তু অতিথি সৎকারে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অতিথি সৎকারের সমস্ত উপচার যেমন ফুল, মালা, চন্দন, মিষ্টান্ন সবকিছুই মজুত তার গৃহে কিন্তু ব্রাহ্মণের সন্তুষ্টি বিধানে দেহদান ব্যাতীত আর কিছুই গ্রহণে ব্রাহ্মণ অটল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নির্দ্বিধায় অতিথির সঙ্গে শয়ন কক্ষে প্রবেশ করলেন ওঘবতী। এদিকে স্বামী সুদর্শন গৃহে এসে উপস্থিত হলেন। গৃহলক্ষ্মীর অদর্শনে বারবার তার নাম ধরে ডাকলেন। ওদিকে ব্রাহ্মণের বক্ষলগ্না সাধ্বী ওঘবতী তখন লজ্জায় নিরুত্তর। তার বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। একসময় উদ্বিগ্ন সুদর্শনের উৎকণ্ঠা দেখে ব্রাহ্মণ নিজেই বাইরে এসে তাঁকে নিরস্ত করলেন। বললেন, হে রাজন্! আপনার স্ত্রী আমাকে যথাযথ মর্যাদায় অতিথি সৎকারে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন কিন্তু আমার আকাঙ্খা পূরণে সে আমার সঙ্গে মৈথুনে লিপ্ত হয়েছে।

মৃত্যু ইতিমধ্যে ভাবলেন, এবার নিশ্চিত প্রতিজ্ঞা ভ্রষ্ট হবে সুদর্শন। কারণ যে পুরুষ জানতে পেরেছে যে তার স্ত্রী পরপুরুষে উপগত হয়েছে সে ভ্রষ্টা রমণী। এহেন স্বামী ক্রুদ্ধ হতে বাধ্য আর তাঁর সেই স্বধর্মচ্যুত হবার কারণেই তাঁকে তিনি সংহার করবেন।

লৌহ মুষল হাতে নিয়ে সুদর্শনের পেছনে এসে দাঁড়ালেন মৃত্যু। সুদর্শন ওঘবতীর এরূপ আচরণে বিস্মিত হলেন। মনে প্রাণে ভেঙে পড়লেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে নিজের অন্তরের জ্বালা, যন্ত্রণা, ক্রোধ দূরে সরিয়ে রেখে স্মিতহাস্যে সেই অতিথি ব্রাহ্মণকে বললেন, আমি একটুও অসন্তুষ্ট নই। আপনি আমার গৃহে অতিথি। আপনার সৎকারই গৃহস্থের মুখ্য ধর্ম। এর চাইতে বৃহৎ ধর্ম আর কিছুই নেই। সত্যনিষ্ঠ সুদর্শন তা উচ্চারণ করলে দৈববাণী ধ্বনিত হল “তুমি সত্য বলিয়াছ”।

এতদূর বলে ভীষ্ম পিতামহ শ্রান্তি অনুভব করলেন। শরশয্যায় রক্তাক্ত দেহের দিকে তাকিয়ে যুধিষ্ঠির ব্যাথিত, ক্লিষ্ট। আর দৃষ্টি নিবন্ধ করতে পারছেন না। বললেন, হে পিতামহ, আজ আমার কারণেই আপনার এই ক্লেশ, এরূপ দুর্গতি।

ভীষ্ম বললেন, তুমি কেন ক্লেশ অনুভব করছো? আমার কৃতকর্মের ফল আমি অনুভব করছি। যা সত্য তা সত্যই। এবার শোনো কাহিনির শেষাংশ।

চারিদিক থেকে যখন দৈববাণী বারেবারে অনুরণিত হচ্ছে তখন সেই মৃত্যুরূপী অতিথি ব্রাহ্মণ সুদর্শনের নিকট এসে ত্রিভুবন অনুনাদিত করে বললেন, সুদর্শন, তুমি নিষ্পাপ ব্রাহ্মণ। আমি স্বয়ং ধর্ম। তোমার মঙ্গল হোক। তোমার পরীক্ষা নিতে আমি এসেছিলাম। তোমার সত্য নিষ্ঠায় আমি অভিভূত। ছিদ্রান্বেষণকারী মৃত্যুকে তুমি জয় করেছ। তোমার সাধ্বী স্ত্রী ওঘবতীর পতিব্রাত্যে আমি মুগ্ধ। সে মহান্ নারী। যোগযুক্তা ও বেদবাদিনীর মতো পবিত্র সে। তাই ধরিত্রীকে পবিত্র করার জন্য ওঘবতীর একটি শাখা নদী হয়ে পৃথিবীকে পুষ্ট করবে আর অর্ধেক দেহসংযোগে তোমার মত স্বামীর অনুগামিনী হবে। তোমরা উভয়েই পুণ্য কাজ করার কারণে সূক্ষ্ম ভূতময় অক্ষয়লোকে গমন করবে যথাসময়ে। ভীষ্ম আবারও স্তব্ধ হলেন। শ্রদ্ধাবনত যুধিষ্ঠির সম্যক অনুভব করলেন, গৃহে আগত অতিথির সেবা কোন স্তরে উত্তীর্ণ হলে মানুষ মৃত্যুকেও জয় করতে পারে। প্রণত যুধিষ্ঠির বিনম্র কন্ঠে বললেন,

“অতিথিদেবো ভব” পিতামহ! আপনার এই আশীর্বাদে এই সত্য আজ হৃদয়ঙ্গম করলাম।

অক্ষয় তৃতীয়ার ব্রতকথাতেও আমরা পাই অতিথি আপ্যায়নের এমন লোকশিক্ষার বার্তা। সেখানে দেখি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সমাপ্তিতে হস্তিনাপুরে প্রতিষ্ঠিত ধর্মরাজ্যের সিংহাসন আরোহণ করেও মহারাজ যুধিষ্ঠিরের মনে অশান্তি। যুদ্ধে প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি, আত্মীয়স্বজন বিয়োগ, বিষয় সম্পত্তির বিপুল অপচয় হয়েছে। আকাশে বাতাসে তখনো কান্নার শব্দ। এহেন পরিস্থিতিতে কাতর ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। কি হবে ভবিষ্যৎ? কে নেবে এই বিস্তর পাপের বোঝা? যুধিষ্ঠিরের মনের অস্থিরতা বুঝতে পেরে মহামুনি শতানিক তাঁকে শোনালেন অক্ষয় তৃতীয়া তিথির মাহাত্ম্য কীর্তন।

শতানিক বললেন, পুরাকালে খুব ক্রোধসর্বস্ব, নিষ্ঠুর এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। ধর্মকর্মে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। একদিন এক দরিদ্র ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণ তার নিকট অন্ন এবং জল ভিক্ষা চাইলেন। রণচন্ডী হয়ে ব্রাহ্মণ কর্কশ স্বরে তাঁর দুয়ার থেকে ভিখারীকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন আর বললেন যে অন্যত্র ভিক্ষার চেষ্টা করতে। ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর ভিখারী চলে যেতে উদ্যত হল।

এদিকে ব্রাহ্মণী সুশীলা অতিথির অবমাননা দেখতে না পেরে দ্রুত স্বামীর নিকট উপস্থিত হয়ে ভরদুপুরে অতিথি সত্কার না হলে সংসারের অমঙ্গল হবে এবং গৃহের ধন সমৃদ্ধি লোপ পাবে, একথা জানালেন। 

স্বামীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ভিখারীকে তিনি ডাক দিলেন এবং ত্রস্তপদে তার জন্য অন্নজলের ব্যবস্থা করলেন। অতিথি ভিক্ষুক সুশীতল জল এবং অন্ন-ব্যঞ্জনে অতীব সন্তুষ্ট হয়ে সে যাত্রায় সুশীলাকে আশীর্বাদ করে সেই অন্নজল দানকে অক্ষয় দান বলে অভিহিত করে চলে গেলেন।

বহুবছর পর সেই উগ্রচন্ড ব্রাহ্মণের অন্তিমকাল উপস্থিত হল। যমদূতেরা এসে তার শিয়রে হাজির।  ব্রাহ্মণের দেহপিঞ্জর ছেড়ে তার প্রাণবায়ু বের হ’ল বলে। তার শেষের সেই ভয়ঙ্কর সময় উপস্থিত। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় তার কন্ঠ ও তালু শুকিয়ে গেল। তার ওপর যমদূতেদের কঠোর অত্যাচার। ব্রাহ্মণ তাদের কাছে দুফোঁটা জল চাইল এবং তাকে সে যাত্রায় উদ্ধার করতে বলল।

যমদূতেরা তখন একহাত নিল ব্রাহ্মণের ওপর।

তারা বলল “মনে নেই? তুমি তোমার গৃহ থেকে অতিথি ভিখারীকে নির্জ্জলা বিদেয় করেছিলে?’ বলতে বলতে তারা ব্রাহ্মণকে টানতে টানতে ধর্মরাজের কাছে নিয়ে গেল।

ধর্মরাজ ব্রাহ্মণের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই মহা পুণ্যবান ব্যক্তিকে কেন আমার কাছে এনেছো?  বৈশাখমাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে তাঁর ধর্মপত্নী তৃষ্ণার্ত অতিথিকে অন্নজল দান করেছেন। এই অক্ষয় দানের পুণ্যে ব্রাহ্মণও পুণ্যাত্মা। আর সেই পুণ্যফলে তাঁর নরক গমন হবে না। ব্রাহ্মণকে তোমরা জল দাও। যাতে আরামে তাঁর প্রাণবায়ু নির্গত হয়। তবেই শীঘ্রই স্বর্গ গমন করবেন’।

এমনও হত বুঝি সেই পিতৃতান্ত্রিক যুগে? সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য লাভ। আমরা তো উল্টোটাই শুনে আসছি এ যাবত। কিন্তু অতিথিকে দেবজ্ঞানে সেবা করার কথা আজও ভাবায় বটে।

শুধু বাড়িতেই নয় ভারতবর্ষের অনেক স্থানে, আপিস কাছারি, হোটেলে আমরা আজও তাই দেখি জল দিয়ে অতিথি আপ্যায়নের রীতি। আর তাই বুঝি রবিঠাকুরও বলেছিলেন…

“কল্যাণদীপ জ্বালায়ো ভবনে

বিশ্বেরে কোরো অতিথি,

মানবের প্রেমে জাগায়ো জীবনে

পুণ্য প্রেমের প্রতীতি।”

 

তথ্যসূত্র

কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত মহাভারত অনুশাসন পর্ব। দ্বিতীয় অধ্যায়
পৌরাণিক পঞ্চবিংশতি (আনন্দ পাবলিশার্স) – হর্ষ দত্ত
ব্রতপিডিয়া (কলিকাতা লেটারপ্রেস) – ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
প্রবাদের খইচুবড়ি (মান্দাস) – ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

 



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “bibidho-otithi-sakhyat-ishwar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *