binodan-smritir-studiopara-part-15

স্মৃতির ষ্টুডিও পাড়া – পর্ব ১৫
গীতা দে কে কখনও পার্ট পড়াতে হয় না
প্রিয়ব্রত দত্ত
গীতা দে

সেদিনের সিনেমা জগতের একটি মানুষকেই আমি ভীষণ ভয় পেতাম। গীতা দে। তৎকালীন সিনেমার ডাকসাইটে ভিলেন। সিনেমায়, সিরিয়ালে প্রৌঢ়া মহিলাটির বদমাইশি দেখে একটা বিরূপ ধারনা তৈরি হয়েছিল যে, মানুষটি আদপে ওই রকমই দজ্জাল। দূরে দূরে থাকতাম। পারতপক্ষে এড়িয়েই চলতাম। কিন্তু শট থাকলে মিস করতাম না। ফ্লোরের এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে গীতা দে’র অভিনয় দেখতাম। এক কথায় তুলনাহীন। গীতা দে’কে আমি কোনওদিন এক শট দু’বার দিতে দেখিনি। সহ অভিনেতা ভুল করলেন, সেটা আলাদা কথা। তখন হয়তো দুবার বা তিনবার ‘শট’ দিলেন। ওঁর জন্য শট এনজি হয়েছে এমনটা আমি অন্তত কখনও দেখিনি। সব সময় মুখে পান গোঁজা। গম্ভীর, বিরক্তি মাখা মুখ। সিঁদুর দিয়ে কপালটা যেন কিসের অসন্তুষ্টিতে কুঁচকেই আছে। শুধু আমি কেন, স্টুডিও পাড়ার সবাই গীতা দে’র সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলতেন। সারাক্ষণ হাসি-ঠাট্টা,  হৈ হুল্লোড়ের হট্টমেলায় গীতা দে ছিলেন মূর্তিমতী মনসা মা! ওই দাপট, অমন ব্যক্তিত্ব গত তিরিশ বছরে আর কোনও অভিনেত্রীর মধ্যে দেখিনি। স্টুডিওয় ঢুকলে বোঝা যেত কোন দিকে গীতা দে অবস্থান করছেন। কারণ, সেই অঞ্চলের কাক-পক্ষীও ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বসে থাকত। ঝাঁ ঝাঁ লু বওয়া গ্রীষ্মের দুপুরে গাছের পাতাগুলোও আওয়াজ করত না। সেই রাশভারী, রাগী মহিলাটির সঙ্গেই কেমন করে জানি না ‘মা – ছেলে’র সম্পর্ক হয়ে গেল! যতদিন বেঁচে ছিলেন, গীতা দে কে আমি ‘গীতা মা’ বলেই সম্বোধন করতাম। আর আমাকে ডাকতেন ‘এই ছোঁড়া’ বলে। অমন আদরের সম্বোধনে আর কখনও কেউ কাছে ডাকেনি। আজও এনটি ওয়ান, টেকনিশিয়ান, ইন্দ্রপুরীতে ঢুকলে বয়ে যাওয়া হাওয়ার শব্দে, পাখির কুজনে, অ্যাকশন – কাট চিৎকারের ফাঁকে ফোকড়ে মনে হয় গীতা মা চাপা, কাচের মতো পরিষ্কার উচ্চারণে ডাকছেন, ‘এই ছোঁড়া… একবার এদিকে আয় দিকিনি…’। আজও স্টুডিও পাড়া আছে। থাকবেও। সেখানে কত শত অভিনেতা, কলাকুশলীর আনাগোনা। রমরমা। কিন্তু মানুষের বড় অভাব।

গীতা দে’র সঙ্গে আলাপ ভারতীদেবীর দৌলতেই, একটা সিনেমার শুটিংয়ে। ছবির নামটা আজ আর মনে নেই। টেকনিশিয়ান স্টুডিওয়। আলাপ মানে ভয় ভেঙে প্রথম কথা বলা। লাঞ্চ ব্রেক চলছে। ভারতীদেবী আমায় মেকআপ রুমে ডেকে নিয়ে এসেছেন। সেদিন উনি বাড়ি থেকে আলুর পরোটা তৈরি করে নিয়ে এসেছেন। সঙ্গে কালোজিরা দিয়ে সাদা আলুর তরকারি। পরম যত্নে ভারতীদেবী আমাকে পাত পেড়ে খেতে দিয়েছেন। দিদি’র সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা মারতে মারতে আলুর পরোটা খাচ্ছি। এমন সময় দুম করে দরজা ঠেলে গীতা দে’র প্রবেশ। আমার মুখের গ্রাস মুখেই। ঢোক গিলতে পারছি না। 

ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়িয়ে কপাল  কুঁচকে গীতা দের ফার্স্ট লুক আমার দিকে। তারপর তীব্র, কর্কশ কণ্ঠে ভারতীদেবীকে প্রশ্ন, ‘এটা কে?’ 

আমার গলায় আলুর পরোটা খাবি খাচ্ছে। হেঁচকি তুললাম। বিষম খেলাম। ভারতী দেবী সোফা ছেড়ে উঠে আমার মাথা চাপড়ে ফুঁ দিয়ে ‘ষাট…ষাট…’ বলছেন। আর মুচকি মুচকি হাসছেন। ‘মরণ’ বলে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন গীতা দে। 

 

গীতা দে

‘ও আমার ছোট নাতি’, আমার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন ভারতীদেবী। আমি উল্টোদিকের টেবিলে। আমার তখন সাপের ছুঁচো গেলার মতো অবস্থা। না পারছি খাবারটা গিলতে, না পারছি ওগরাতে। 

‘ছোট নাতি!’ আঁচল দিয়ে গলার ঘাম মুছে ভারতীদেবীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ছোঁড়াকে তো এ সেটে ও সেটে প্রায়ই ঘুরঘুর করতে দেখি।’ 

এবার আমার দিকে তাকিয়ে, ‘কী মতলবে শুনি ?’ আমি তখন রীতিমত হেঁচকি তুলছি। ঘরে জল নেই। ওই অবস্থাতেই প্লেট হাতে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছি। ‘বোস বোস… গীতা ওইরকম… একটু বকাঝকা করে…।’ ভারতীদেবী আমার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলেন, ‘খা তো… ঘরে একটুও জল নেই।’ 

‘এই কে আছিস’ বলে গীতা দে হাঁক পাড়লেন। কোনও প্রত্যুত্তর নেই। ভারতীদেবী বললেন, ‘ও খবরে কাগজে লেখে। ভারী ভালো ছেলে। আমার সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।’

 ‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি।’ বলে সোফায় বসেই হাত বাড়িয়ে দরজার একটা পাল্লা খুলে বললেন, ‘ঘাটের মড়াগুলো সব গেল কোথায়…সেই কখন এক গ্লাস জল চেয়েছি…সবাই কি মরে গেছে নাকি…!’

আমি রীতিমতো ঘামছি। ভারতীদেবী কিংকর্তব্যবিমূঢ়। প্রোডাকশনের একজন ছুটে এলেন। ‘জল … জল বোঝেন ভাই…ঘরে এক ফোঁটাও জল নেই… আপনাদের প্রোডাকশন কন্ট্রোলারকে ডাকুন।’ গোটা চত্বর জুড়ে গমগম করছে গীতা দে’র গলা। ডাকতে হল না। প্রোডাকশন ম্যানেজার দৌড়ে হাজির। 

‘কী চাই দিদি?’ শুনে আরও খেপে গেলেন গীতা দে, ‘আমি কি জনে জনে বলে বেড়াবো নাকি যে এই ঘরে একফোঁটাও জল নেই…’ কথা শেষ হল না, আগের ছেলেটি হাজির গ্লাস ভর্তি জল নিয়ে। দৃশ্যত হাত কাঁপছে ছেলেটির। দেখে গীতা দের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া, 

‘আ মোলো যা… তিন তিনটে প্রাণী ঘরের মধ্যে খাবি খাচ্ছে, আর উনি একটি মধুপর্কের গ্লাস হাতে থরথরিয়ে কাঁপছেন।’ প্রোডাকশন ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই ঘাটের মড়াগুলোকে কোত্থেকে জোগাড় করেন বলুন তো।’ ঢোঁক গিলে প্রোডাকশন ম্যানেজার বললেন, ‘আপনি এটা নিন। আমি জগ, গ্লাস পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ ‘আমাকে নয়, ওই ছোঁড়াটাকে গ্লাসের জলটা দিন।’ গীতা দে’র নির্দেশে ছেলেটি কাঁপতে কাঁপতে আমার দিকে গ্লাসটা বাড়িয়ে ধরলেন। কাঁপছি আমিও। গ্লাসটা হাতে নিয়ে চুমুক দিলাম। গলা দিয়ে খাবারের দলাটা নামল। শব্দ করে ঢেঁকুর তুললাম। ছেলেটি বেরিয়ে যেতেই গীতা দে দড়াম করে পাল্লাটা ভেজিয়ে দিলেন। 

‘এ ছোঁড়া দেখছি তো গ্লাস এঁটো করে জল গেলা। আবার ঢেঁকুর তোলা… কোথায় থাকা হয়? কোন কাগজে লেখা হয়… তা এখানে কী করতে…’ সবকটি প্রশ্নই ভাববাচ্যে। ভারতীদেবী পাশের চেয়ারে বসে পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘খেয়ে নে আগে।’ উনি আমার হয়ে উত্তরগুলো দিলেন। 

বললেন, ‘ও আমার পুরনো পাড়ার ছেলে। কলেজ স্ট্রিটে থাকে। সান্ধ্য আজকালে লেখে…।’ 

‘তার মানে কমলের পাতায়…’ 

গীতা দে’র কথায় আমি ঘাড় নাড়লাম। দরজায় টোকা। পরক্ষণেই দরজা ঠেলে একজন ঢুকে গ্লাস, জলের জগ টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। আমার খাওয়া ততক্ষণে শেষ। খেলাম না, বাকিটুকু গিললাম বলা যায়। সেই দেখে ভারতীদেবী মিটিমিটি হাসছেন। কখন বাঘিনীর খাঁচা থেকে রেহাই পাব, সুযোগ খুঁজছি। প্রোডাকশনের ছেলেটি প্লেট আর এঁটো গ্লাসটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে বললেন, ‘আসুন বাইরে, জল দিচ্ছি…’ আমি লাফ দিয়ে উঠে পড়ে বাঁ হাতে ব্যাগটা তুলে নিয়ে পালাতে যাব, ঘ্যাঁক। 

 

গীতা দে

‘এই ভাই টেবিলটা মুছে দেবেন। আর এই যে কমলের ছোঁড়া হাত মুখ ধুয়ে ঘরে আসবি। কমলকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল। ভালোই হলো। নিয়ে যাবি।’ বলে নিজের ঝোলাটা টেনে নিলেন গীতা দে। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। একেবারে ‘তুই!’

হাত, মুখ ধুয়ে অগত্যা ফের বাঘিনীর গুহায় ঢুকতেই হল। ততক্ষণে ঝোলা থেকে একটা কাগজের বাণ্ডিল বার করেছেন। ভারতীদেবী বললেন, ‘কী এটা?’ 

‘একটা শ্রুতি নাটকের স্ক্রিপ্ট।’ 

আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে গীতা দে বললেন, ‘এটা কমলকে দিয়ে দিবি। আর রাতে একটা ফোন করতে বলবি।’ 

আমি বললাম, ‘আজ তো কমলদার সঙ্গে দেখা হবে না। সেই কাল সকালে সাড়ে দশটা এগারোটা নাগাদ দেখা হবে, অফিসে।’ 

‘আ মোলো যা, তুই আজ আর অফিস ফিরবি না?’ ঝোলাটাকে কোলের কাছে নিয়ে হতাশ গলায় বললেন গীতা দে। 

‘না। দুপুরে সান্ধ্যর কাজ হয়ে যাবার পর টালিগঞ্জে…’ 

‘টো টো করতে বেরিয়ে পড়িস!’ আমাকে থামিয়ে দিয়ে গীতা দে বলতে লাগলেন, ‘খবর যে কত করিস তা তো জানা আছে। কচি মেয়েদের সঙ্গে শুধু ফস্টিনস্টি। সেদিন সোনালীর সঙ্গে কী এত রসের কথা হচ্ছিল শুনি।’ 

আমি ভূত দেখার মতো চমকে গেলাম। দু’দিন আগে এনটিওয়ান স্টুডিওতে একটা সিনেমার শুটিং হচ্ছিল। সব্যসাচী চক্রবর্তী জমিদার। তখনকার উঠতি অভিনেত্রী সোনালী চৌধুরী বাঈজী। গানের শট চলছিল। লাঞ্চ ব্রেকে খেতে খেতে সোনালীর সঙ্গে আড্ডা মারছিলাম। আসলে কমলদা তখন এটিএন বাংলায় ‘প্রিয়া প্রিয় শিল্পী’ নামে একটি সাক্ষাৎকার ভিত্তিক নন ফিকশন পরিচালনা করতেন। সোনালী ওই নন ফিকশনটায় অ্যাঙ্কারিং করত। আমি বেশ কয়েকটা এপিসোডের শুটিং-এ ছিলাম। সেই সূত্রে সোনালীর সঙ্গে আলাপ, বন্ধুত্ব। স্টুডিওয় দেখা হলেই শটের ফাঁকে আমরা আড্ডা মারতাম। ও-ও অনেক খবরাখবর দিত। বিশেষ করে কেচ্ছা কেলেঙ্কারির কাহিনি। এই নিয়ে খুব হাসাহাসি হতো। তা গীতা দে দেখলেন কখন? আমি স্পেল বাউন্ড! 

‘মেয়েটা কমলের সিরিয়ালে অ্যাঙ্কারিং করে না?’ একদম হেডদিদিমণির গলায়, ভঙ্গিমায়, দাপটে আমাকে জিজ্ঞাসা করে বললেন, ‘আমাকে টালিগঞ্জ ফিল্ম পাড়ায় সবাই কী বলতো জানিস তো? মন্থরা বুড়ি।’ 

গীতা দে’র কথা বলার ধরনে হোহো করে হেসে উঠলেন ভারতীদেবী। ‘তুই পারিসও বটে গীতা। ও রিপোর্টার। এখনকার নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে গল্প গুজব করবে না?’ 

‘ওই গল্প পর্যন্ত ঠিক আছে। গুজবটা যেন না দেখি। আমার শকুনির মতো দৃষ্টি। এই স্টুডিও পাড়ার ফাঁকে ফোকরে কোথায় কী চলছে, ঘটছে স…ব আমার নখদর্পণে। বেচাল দেখলেই কমলকে বলে দেবো। খুব সাবধান। জানিস তো আমি কিসের পার্ট করি…’ গীতা দে হুমকি দিয়েই চলেছেন। আর ভারতীদেবী হেসে লুটোপুটি খাচ্ছেন। এমন বীভৎস র‌্যাগিং স্টুডিও পাড়ায় আর কেউ কখনও কোনও দিন করেননি। দরজায় আবার টোকা পড়ল। একদম ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে গীতা দে বললেন, ‘ইয়েস…কাম ইন!’ 

স্ক্রিপ্ট হাতে ভেতরে ঢুকলেন একজন সহকারী পরিচালক। পার্ট পড়াবেন। তাঁকে মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গিতে বললেন, ‘স্ক্রিপ্টটা রেখে যান। পড়ে নেবো। গীতা দে’কে কখনও পার্ট পড়াতে হয় না।’ তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, ‘তাহলে দিদি শট রেডি হলেই ডাকছি’ বলে পালিয়ে বাঁচলেন। এখানে একটা কথা বলে রাখি। গীতা দে এক বর্ণও ইংরেজি পড়তে পারতেন না। শুনে মুখস্থ করে নিতেন। আর এমনভাবে বলতেন যেন তিনি বাঙালি নন, ব্রিটিশ মহিলা। এত নিখুঁত উচ্চরণ। এমনিতেই গীতা দে’র বাংলা উচ্চারণ ছিল কাচের মতো স্পষ্ট ও পরিষ্কার। যত দ্রুতই উচ্চারণ করুন না কেন, প্রতিটি বর্ণ মুক্তোর মতো ঝরে পড়ত জিভ থেকে। অথচ সারাক্ষণ মুখে পান গুঁজে রাখতেন। এই রকম ‘পানাসক্ত’ আর এক শিল্পীর সান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তিনি কণ্ঠশিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিষ্কার উচ্চারণে তিনি যখন ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই’ গাইতেন, তখন তাঁর ডান বা বাঁ গালে পোরা থাকত দু-তিন খিলি পান! আশ্চর্য! 

 

গীতা দে

গীতা দে একটা টেলিফিল্ম করেছিলেন। নাম ‘দুধের দাম’। ট্রেন সফররত একদল কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে এক কোণায় জড়সড় হয়ে বসে থাকা বুড়ি যাতে বুঝতে না পারে তার জন্য নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলছিল। বুড়ির উপস্থিতি তাদের কাছে কতটা অস্বস্তিকর সেটা ইংরেজি ভাষায় ব্যক্ত করছিল। শেষে সহ্য করতে না পেরে বুড়ি ইংরেজিতেই ছেলেমেয়েদের যোগ্য জবাব দেন। সিনটায় পাতা দুয়েক ইংরেজি ডায়লগ গীতা দে স্রেফ মুখস্থ করে বলেছিলেন। সঠিক ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে। 

পরেরদিন কমলদাকে গীতা দে’র দেওয়া স্ক্রিপ্ট দিতেই হেসে উঠলেন। বললেন, ‘গীতাদি কাল ভাল রগড়েছে তো?’ 

আমি আর কী বলব। মাথা চুলকোলাম। কমলদা আর এক দিস্তে কাগজ ব্যাগ থেকে বার করে বললেন, ‘এটা আজ গীতাদির বাড়িতে দিয়ে আসতে হবে।’ ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ে বললাম, ‘অসম্ভব! আপনি অন্য কাউকে পাঠান। আবার চাটবেন। রিল, রিয়েল দুই লাইফেই সমান দজ্জাল।’ কমলদা হাসছেন। বললেন, ‘বরং সম্পূর্ণ উল্টো। ওঁর মতো মাদারলি উওম্যান ইন্ডাস্ট্রিতে আর কেউ নেই। বাড়ি যাও। আলাপ কর। অনেকে কিছু জানতে পারবে শিখতে পারবে। থিয়েটার কর। উচ্চারণটা পা ধরে শিখে নিও। ওঁর বাইরেটা ওইরকম। ভেতরটা মাখনের মতো নরম। গীতাদির তোমাকে ভালো লেগেছে। উনি তোমাকেই স্ক্রিপ্টটা নিয়ে যেতে বলেছেন। যাও…এই সুযোগটা মিস কোরো না।’

দিন-ক্ষণ-তারিখ-মাস কিচ্ছু মনে নেই। শুধু মনে আছে সেই সন্ধ্যেটা। মানিকতলার দিক থেকে বাগমারি ব্রিজে ওঠার আগে ডানদিকের রাস্তা ধরে একটু এগোলেই ডানহাতে একটি প্রশস্ত পাড়া। সেই পাড়ার শেষ প্রান্তে বাঁদিকের কোণের বাড়ির চারতলায় গীতা দে’র বসবাস। 

পৌনে ছ’টা নাগাদ গিয়ে পৌঁছলাম বাড়ির দরজায়। কমলদা বলে দিয়েছিলেন। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে সোজা উঠতে লাগলাম চার তলায় উদ্দেশে। প্রাচীন ভাঙাচোরা বাড়ি। দেখলে মনে হয় হাল্কা ভূমিকম্পেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে বাড়িটা। ঢটা ওটা লাল সিঁড়ি। নড়বড়ে রেলিং। টিমটিম করে তলায় তলায় জিরো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। আমি সাবধানে, অতি সাবধানে উঠছি ভারতীয় সিনেমার এক জীবন্ত ইতিহাসের চৌকাঠ পেরোনোর আহ্বানে। গিয়ে দাঁড়ালাম চারতলার চাতালে। বাঁ দিকে বন্ধ দরজা। ডানদিকে সিঁড়ি ঘুরে চলে গেছে ছাদে। কড়া নাড়লাম। ভেতর থেকে ভেসে এলো সেই বুকে কাঁপন ধরানো কণ্ঠস্বর, ‘আসছি।’ 

কয়েক সেকেন্ডের দুরু দুরু অপেক্ষা। সবুজ রঙের দরজা দু’হাট হল। সামনে যিনি আটপৌরে ঘরোয়া ঘেরে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে, কপালে লাল সিঁদুরের টিপ এঁকে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি পর্দা কাঁপানো ভিলেন বা ভ্যাম্প গীতা দে নন, সাক্ষাৎ মা সরস্বতী! দরজার পাল্লা ছেড়ে শাঁখা পলা পরা ডান হাতে আমার বাঁ হাতটা ধরে বললেন, ‘আয়… ছোঁড়া…ভেতরে আয়!

 



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *