ফিল্ম রিভিউ
অদিতি বসুরায়

ভারতীয় দর্শনে, শব্দকে ব্রহ্ম মানা হয়। সেই শব্দ যে অস্ত্র হিসেবে, আঘাত করারা ক্ষমতা রাখে, তা মানে ক’জন? ভার্বাল আবিউজ-এ গায়ে হাত তোলা হয় না – কালশিটে ফেলা যায় না – রক্তপাত দেখা যায় না কিন্তু তাতে যে মানুষের আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস ক্রমে তলানিতে পৌঁছতে পারে, তা বিশ্বাস করতে শিখুন। সম্প্রতি, লজ্জা নামের ওয়েব সিরিজটিতে ভার্বাল আবিউজের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়ায় এক নারীর জীবন কীভাবে ওলোট-পালোট খেয়ে যায় – তার কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্নও তোলা হয়েছে গল্পকার এবং চিত্রনাট্যকারের পক্ষ থেকে। এবং সেই বিশ্বাসকে শিলমোহর দিয়েছেন পরিচালক অদিতি রায়। আমাদের প্রচলিত গালাগাল মানে সাদা বাংলায় যাকে ‘খিস্তি’ বলা হয়, তার উৎস কেন মেয়েরাই? খানকির ছেলে থেকে শুরু করে তালিকা দীর্ঘ। মা-মাসী এক করে দেওয়া এই সব স্ল্যাংও কিন্তু মেয়েদের অসম্মান করাই শেখায়। আজন্ম শুনে আসা এই ধরনের গালিগালাজ – মেয়েরা সহ্য করে নেয় আর তার থেকেও বড় ব্যাপার হল – তারা এ নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায়ও না। যেমন, আমাদের জয়া। জয়া সিনহা – বয়েস আটত্রিশ – চাকরি করে না। এক কিশোরীর মা। স্বামী, পান থেকে চুন খসলেই তাকে যা মুখে আসে বলে যায়। লজ্জার প্রথম সেশনে, আমরা দেখি, পার্থর (জয়ার স্বামী) সঙ্গে নতুন ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশের জমায়েতে, জয়া ফ্ল্যাটের মাপটা ঠিক মতো বলতে পারেনি। মাত্র সেই কারণে, বন্ধু-বান্ধবদের সামনেই, পার্থ তাকে ‘গান্ডু’ বলে দেয় নির্দ্বিধায়। তাছাড়া, সে কেবল বউকে নয় , মেজাজ হারালেই স্থান-কাল-পাত্র ভুলে যা তা বলে বসে। এদিকে, সারাক্ষণ নানা অমুদ্রণযোগ্য ভাষা শুনে শুনে জয়ার হীনমন্যতা বাড়তে থাকে। সে মনে মনে ভেবে নেয়, এই গালাগাল, তার প্রাপ্য। তার কৃ্তকর্মের কারণেই এ সমস্ত তাকে শুনতে হয়। গুটিয়ে যেতে থাকে সে। বাপের বাড়িতে জানালে, আপন বোনই সবার আগে তার বিরুদ্ধাচারণ শুরু করে। আর অন্যান্য সদস্যরা তো ভেবেই পান না- যেখানে কোনও ভাবে মারধোর করা হচ্ছে না, গায়ে হাত তোলা হচ্ছে না – সেখানে জয়ার অভিযোগের কোনও ভিত্তি থাকতে পারে কিনা। কেবল তার বউদি ব্যাপারটা বোঝে কিন্তু সেও নিরুপায়। যেমন অধিকাংশ মেয়ে শ্বশুড়বাড়িতে হয়ে থাকে আর কী! এদিকে, পরিস্থিতি ক্রমশ সহ্যের সীমা পেরোতে থাকে। প্রথম সেশনের শেষে, শ্বশুরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয় জয়া। এদিকে বাপের বাড়িতে তাকে স্বাগত জানায় না কেউ। একটা সামান্য এন জি ও-র কাজ ছাড়া নিঃসম্বল সে। দ্বিতীয় সেশন থেকে খেলা ঘুরতে শুরু করে। ভার্বাল আবিউজ যে কেবল পুরুষতন্ত্রের ছায়ায় বাড়ে তা মিথ্যে প্রমাণিত হয়। গার্হস্থ্য হিংসা যে কেবল ঘরের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকে- তা কিন্তু নয়।
দ্বিতীয় সেশনে, আচমকা পরিস্থিতির এমন পরিবর্তন হয় যে, জয়ার দুর্দশা আরও বাড়ে। সিরিজের গল্পটা এখানে অলিখিত থাকাই ভাল। বরং কথা বলা দরকার, শব্দের অপপ্রয়োগ এবং তার প্রভাব নিয়ে। কেবল ছেলেরাই নয়, একটি মেয়ের মনোবল ভেঙে দিতে, অনেক ক্ষেত্রেই আরেকটি নারীও যথেচ্ছ খারাপ কথা অবলীলায় বলে দেয়। আর ক্রমশ জীবন থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকে, জয়ার মতো সরল, শান্তিপ্রিয় মেয়েরা। নিজের ওপর ঘটা সমস্ত অবিচারকে তারা জাস্টিফাই করতে চায়, নিজের দোষ হিসেবে। কথা বলতে গেলেও তখন তারা দু’বার ভাবে। নিজের কথা তো সামনে আনতেই পারে না – ক্রমাগত শব্দের অভিঘাত সইতে সইতে, যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় এবং তারা নিজের স্বভাবের বীপরীত আচরণ করতে থাকে, তখন সমাজ এবং সংসার একত্রে তাদের ‘মেন্টালি আনস্টেবল’ দাগিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে চায়। কিন্তু লজ্জা সেই রাস্তায় হাঁটে নি। দ্বিতীয় সেশনের কোর্টরুম –সিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে কাহিনীকার শেষ পর্যন্ত জিতিয়ে দিয়েছেন জয়াকে। এবং সেই সঙ্গে তিনি লড়তে শিখিয়েছেন আরও সহস্র মেয়েকে যারা প্রতিনিয়ত এই শব্দ-অস্ত্রের আঘাত পেতে পেতে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। কেবল কথার কথা নয় – আইনের আশ্রয়ও যে তাঁরা পেতে পারেন –সে কথাও জানিয়েছে ‘লজ্জা’। যে প্রয়োজন তা হল – মুখ খোলা। শব্দের মুখে শব্দ ছোঁড়া। জয়া যেমন ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে – তেমনই ঘুরে দাঁড়ানো দরকার। খুব ভাল কাজ করেছেন প্রিয়াঙ্কা সরকার, খেয়ালী দস্তিদার, অনুজয় চট্টোপাধ্যায়। তবে অনিন্দিতাকে তাঁর অতিরিক্ত উগ্রতার কারণে খানিক চড়া দাগের মনে হয়েছে। অনেক কাল পরে, দীপঙ্কর দে’কে পর্দায় দেখে খুব ভাল লাগলো। চমৎকার অভিনয় করেছেন। আর হ্যাঁ, খারাপ কথা মেনে নিতে নিতে একবার, জয়ার মতো দরজা খুলে দেখবেন মাঝে মাঝে – পাখির সঙ্গে আলোও আসবে। এবং সাহসও। আমরা নিশ্চিত। কাহিনী ও চিত্রনাট্যকার সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পরিচালক অদিতি রায়কে অনেক ধন্যবাদ, এই অন্ধকারে ইতিবাচক বার্তা দেওয়ার জন্য। লজ্জা এবং লজ্জা টু – স্টিমিং হচ্ছে হইচইতে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন