ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়
বেড়াল আর বাঙালির যুগযুগান্তের সম্পর্ক! কেন জানেন? আমরা অনেকখানি বেড়াল গোত্রের। নিজেকে দিয়ে বুঝি, প্রচুর মিল আছে। ওইরকম মিচকে, ওইরকম ছিঁচকে। ওইরকম আদুরে, ওইরকম ভিতু। অকম্মার ধাড়ি। যতই বলা হোক, ইঁদুর তাড়াতে বেড়াল সিদ্ধহস্ত, পুরো ফালতু কথা। আরে বাবা, সিদ্ধিদাতার একনিষ্ঠ সেবক তথা বাহনকে তাড়াবি তুই কে রে? তুই যার বাহন, সেই মা ষষ্ঠী তো কোনো কুলীনদেবীই নন!
অথচ এই বিড়ালই হল গিয়ে নাকি ভয়ানক হিংস্র বাঘের মাসি! ইনিই নাকি আবার পৃথিবীর অন্য দেশের প্রাচীন সভ্যতায় দেবতা! আর কালো বেড়াল? উরিব্বাপ! সাক্ষাৎ অপদেবতা। কত যে অদ্ভুতুড়ে গল্প লেখা হয়েছে কালো বেড়াল নিয়ে।
সব মিলিয়ে বেড়াল অতীব ইন্টারেস্টিং জীব। আজকাল অবশ্য আমবাঙালির ঘরে ঘরে অন্য দেশের দেখাদেখি নানাজাতের সারমেয় পোষা এক ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেড়াল হেজিপেজি, ঠিক স্ট্যাটাস সিম্বল নয়।
“স্যার! এ কি বুলডগ?”
“দ্যুৎ! তুমি একেবারে ইল্লিটারেট! একটু পড়াশোনা করো। এ হল গিয়ে জার্মান শেফার্ড।”
কী যে তফাত, কিছুই ছাই বুঝি না। তবে কুকুরকুলে নানা সাইজ, নানা স্বভাব, নানা আকৃতির ছড়াছড়ি। কোনোটা ঘ্যাঁক করে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তেড়ে আসে, কোনোটা আবার পায়ের কাছে এসে ল্যাজ নাড়ে।
বেড়ালের তেমন গোত্রকৌলীন্য নেই। কাবুলি, পাহাড়ি, বুনো, সব এমন মিলেজুলে গেছে, আর ওদের স্বভাব চরিত্র এতটাই একরকম, আলাদা করা যায় না। আর ওদেরকে কিনে আনতে হয়না। হুস করে কখন বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে পড়ে। আর একবার ঢুকে পড়লে বার করা ভারি মুশকিল।
যেমনটা দেখেছিলাম আমার ছোটবেলায়। তখন এই উত্তর কলকাতার বাড়িতে বাড়িতে বেড়াল থাকত। থাকত বলছি এইজন্য যে, তাদের কিন্তু আনতে হত না কুকুরের মতো। গায়ে গায়ে সব বাড়ি। আশপাশ প্রতিবেশীদের বাড়িতে বেড়াল পুষছে। একবাড়ির মা বেড়াল এসে বাচ্চা পাড়ল দু’বাড়ির কমন প্যাসেজে। পশমের বলের মতো পাঁচ-ছটা ছানা। ব্যস, তাদের থেকেই একটাকে এ বাড়ির ছোট ছেলে তুলে নিয়ে এল তার ঠাকুমার কাছে।
“ঠাকুমা! আমি একে পুষব।”
“না সোনা! বেড়াল পোষা বড্ড ঝক্কিঝামেলা। খাওয়া শোওয়া… যেখানে সেখানে হিসি হাগু করে নোংরা করবে… শিগগির রেখে দিয়ে আয় বাছা। বাবা খুব বকাবকি করবে।”
“না ঠাকুমা!” বাড়ির আদুরে ছোট ছেলে গাল ফোলায়, “তুমি বাবাকে একটু বুঝিয়ে রাজি করাবে। আমি ওর দেখাশোনা করব। আমি ওর নাম রেখে ফেলেছি, মিনু।”
বলেই সে বেড়ালছানাকে কোলে তুলে ঘাঁটতে শুরু করল। ব্যস, হয়ে গেল। মিনু রাতারাতি থেকে গেল বিরাট জয়েন্ট ফ্যামিলির বাড়িতে। সারাক্ষণ বাড়ির ছোটবড় সব্বার পায়ে পায়ে ঘোরে, দিব্বি মাছ মাংসের এঁটো কাঁটা খায় ভাত দিয়ে, দেখতে দেখতে তাগড়া বেড়াল হয়ে ওঠে। কাক পাখি ইঁদুর সবাই তাকে সমঝে চলে।…
হ্যাঁ, এক দু’বার ভুলভাল করে সিঁড়ি দালান নোংরা করে ফেলেছে ঠিকই। তবে কড়া করে বকে দেওয়ার পরে আর তাকে জায়গা বুঝিয়ে দেওয়ার পরে সে আর অপকীর্তিগুলো করেনি। বেড়াল মোটেও বোকা নয়! কুকুরের মতোই মানুষের কথা দিব্যি বুঝতে পেরে যায়।
মিনু খুবই আদুরে। তার জন্য আলাদা বিছানা হয়েছে ছেলেটার শোবার ঘরে। এমনকী নাতির আবদারে মিনুর জন্য ঠাণ্ডা পড়তে একখানা পুরোন কম্বলের টুকরোও ব্যবস্থা করে দিলেন ঠাকুমা।
সেইকালে মজার কার্টুন ছবি হলে সে ছবিতে এদিক ওদিক থেকে এক আধটা বেড়াল উঁকি দিতই দিত। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী দেবাশীষ দেব ওঁর যেকোনো অলংকরণে অন্তত একখানা মজার বেড়াল চরিত্রকে বরাবর রেখে দিয়েছেন। পরের প্রজন্মের চিত্রশিল্পীরা অনেকেই তার অনুকরণও করেছে।
তো ওই ছেলেটা বইটইয়ে বেড়ালের ছবি দেখলেই পাঁজাকোলা করে নিয়ে আসত তার আদরের মিনুকে। বইয়ের বা ম্যাগাজিনের পাতায় আঙুল দিয়ে দেখাত, এই যে! এই দ্যাখ মিনু, তোর ছবি বেরিয়েছে। ছেলেটার মনে হত, মিনুর চোখ চকচক করে উঠেছে, গোঁফের ফাঁকে সে মুচকি মুচকি হাসছে।
কিন্তু অতি আদরের মিনুর সঙ্গে ছেলেটার মাখামাখি বেশিদিন স্থায়ী হলনা। আদর করে মিনু নাম দিলেও আদতে মিনু কিন্তু ছিল একটি পুরুষ, যাকে বলে হুলো বেড়াল। আর হুলোর যা ধর্ম, মিনু কি তার ব্যতিক্রম হতে পারে কখনও?
তখন তার ভরা পৌরুষ। রাত গভীর। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে কাদা। মিনু সুট করে তার বিছানা ছেড়ে উঠে চরতে বেরিয়ে পড়ে। ছেলেটা রাতে বাথরুম যেতে গিয়ে শোনে মিনুর গলা ফোলানো ডাক, ম্যাও…ও…ম্যাও!
তারপরে আরেক বেপাড়ার হুলোও জবাব দিচ্ছে… ‘ম্যাও’…! সাবধান! দুটো বেড়ালের বেড়ালীনির দখল নিয়ে কিছু তর্জন গর্জন। একটু পরেই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর খ্যাঁচ ম্যাচ! মারপিট, কামড়াকামড়ি।
ঘুম থেকে ওঠার আগেই শয়তানটা এসে শুয়ে পড়ত বিছানায়। কিন্তু শরীরের নানা জায়গায় ক্ষত। নাতি ঠাকুমার খুব বকাবকি। হতচ্ছাড়াটা তখন একেবারে ভিজে বেড়াল! থাবার মধ্যে মুখ লুকিয়ে আদরের ডাক, মিঁউ মিঁউ…। যেন খুব অন্যায় করে ফেলেছে। কিন্তু সে বড়জোর এক-দুদিন। রাতে যেই হুলোগুলো ডাকতে শুরু করত, অমনি ফের সেই এক গল্প।
বয়েস কাউকে ছাড়ে না! মিনু গুণ্ডার শরীরের তাগদ কমে এসেছে। একবার ফিরল সে মারাত্মক জখম হয়ে। ঠাকুমা অনেক ওষুধ-বিষুধ দিয়েও ঘা সারাতে পারছেন না। রস গড়াচ্ছে তার গলা দিয়ে।
বাবা ফাইনাল হুলিয়া জারি করলেন। রীতিমতো হুঙ্কার ছাড়লেন, কোনো কথা নয়। মিনুকে ইমিডিয়েট বিদেয় করতে হবে। এ আমার অর্ডার! নইলে বাড়িতে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়বে।
তখন ছেলেটা স্কুলে। বাড়ি ফিরে দেখে, তার মিনু নেই! যাকেই জিগ্যেস করে, সে বলে বেড়ালটা নাকি সকালে বেরিয়ে গেছে। শেষে বাড়ির দারোয়ান রহিনীকা জানাল, বড়াবাবুর হুকুম! তাই বাড়ির কাজের লোক বস্তায় পুরে তাকে নিয়ে গেছে। দূরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে আসবে।
ছেলেটা কেঁদে কেটে পাড়া মাথায় করল। বাবা হিটলার। কোনো লাভ হল না। কারো সাহস নেই, ওকে ফিরিয়ে আনার।
আনতেও হল না। সন্ধে হতে না হতেই মিনুমিঁয়া মিউ মিউ করতে করতে ফিরে এল। মা বাবাকে বলল, দেখলে তো! মা ষষ্ঠীর বাহন বলে কথা! না যেতে চাইলে তুমি ওকে পার করতে পারবে না।
এরপরে আর বেশিদিন জ্বালায়নি মিনু। ওই ঘা সেপটিক হয়ে গেল। চোখের সামনে ব্যথায় মিউ মিউ করতে করতে চিরদিনের মতো চোখ বুজল মিনু। সেইদিন চোখ মুছতে মুছতে ছেলেটা প্রতিজ্ঞা করল, এই প্রথম, এই শেষ। আর কোনোদিন কোনো পোষ্য সে পুষবে না।
কিন্তু সে না পুষলে কী হবে! প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে একেবারে গায়ে লাগানো বাড়িতে রিটায়ারমেন্টের পরে সদলবলে এসে হাজির হলেন জজসায়েব। ছেলে মেয়ে স্ত্রী এবং একটা-দুটো নয়, মাত্র গোটা দশেক বেড়ালবাহিনী। তাদের কাজই হল, ও বাড়িতে খায়দায় আর এ বাড়িতে এসে মলমূত্র ত্যাগ করে!
কীভাবে করে? লুকিয়ে থাকে অফিসের আলমারি, লাইব্রেরি কিম্বা বই গোডাউনের আড়ালে। তিন-চারটেতে মিলে লুকোচুরি খেলে। তারপর কাগজে মেঝেয়, তাকে বর্জ্য ত্যাগ করে নিমেষে হাওয়া।
এমনকী তাদের কাণ্ডকারখানাও যথেষ্ট ভয়প্রদ! রাতে একা বসে একমনে কাজ করছি। চতুর্দিক নিস্তব্ধ। ত্রিসীমানায় কেউ নেই।
হঠাৎ – খস্… খস্ স্ খসখস…! কে রে বাবা! কোত্থেকে আওয়াজটা আসছে? বুকের মধ্যে হালকা কাঁপুনি।
চেয়ার ছেড়ে পা টিপেটিপে উঠেছি। দরজা খুলে যেই না করিডরে বেরিয়েছি, বুক কেঁপে উঠল। অন্ধকারে দু জোড়া সবুজ চোখ।
অ্যা-অ্যাই ই! কে কে রে?
অমনি দুড়দাড় শব্দ! একলাফে দু-দুটো শয়তান লম্বা করিডর টপকে গিয়ে পড়ল চালে। সেখান থেকে দুলাফে নেমে পড়ল নিজেদের টেরিটরিতে।
ওদের ভালোবাসা থেকে রক্ষা পেতে আমাদের অফিসের একতলায় কোলাপসিবল গেটে লোহার জাল বসেছে, দোতলায় শিক বসেছে, ফাইবার শেড বসেছে!
এমনকী আমাদের অফিসের ছেলেমেয়েরা সন্ধের আগে জানলার পাল্লা এঁটে দেয়। তবু…তবু…
প্রায়ই সকালে শুনতে পাই বাড়ির কেয়ারটেকার শ্রীমান অর্জুনের ডাক, হাবুদা! ও হাবুদা! ঝাঁটা বালতি নিয়ে এসো।
একটু পরেই ওবাড়ির বহুকালের পুরোনো গোবেচারা হাবুর জিনিসপত্রাদিসহ সজ্জিত আবির্ভাব। অর্জুন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের অফিস বা গোডাউনের সেইসব মার্জার-আক্রান্ত এলাকায়, যেখানে দুর্গন্ধে টেঁকা দায়!
এরকম ঘটনা ঘটেই চলেছে। ওবাড়ির বেড়ালসংখ্যাও মা ষষ্ঠীর দয়ায় ছোট বড় মাঝারি সবমিলিয়ে আপাতত পনেরো।
আমার মাঝেমাঝে মনে হয়, এ সব মিনুরই কাজ! সে তার প্রতি আমার পিতাঠাকুরের বঞ্চনা আর অবহেলার শোধ তুলছে তার উত্তরসুরিদের দল বেঁধে ও বাড়ি পাঠিয়ে। এবার দ্যাখো হে, কেমন লাগে!
দারুণ লাগল