মাছের সাতকাহন
(আফরোজা নাজনীন)
নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে ভাত-মাছ বাঙালীদের প্রধান খাদ্য। প্রথিতযশা লেখক শ্রীপান্থ লিখেছেন, বাঙালী যখন দুটি পদে খাওয়ার কথা বলে, তখন হয় বলে ডাল-ভাত বা দুধ-ভাত অথবা মাছ-ভাত। প্রাচীন কবি-লেখকদের লেখা থেকেই বোঝা যায় বাঙালীর জীবনে ওতপ্রোতভাবে মাছ জড়িত।
প্রাচীন বাঙালীদের মৎস্যপ্রীতির পরিচয় পাওয়া যায় পাহাড়পুর ও ময়নামতির পোড়ামাটির ফলকে। নীহার রঞ্জনের গ্রন্থে এই ধরনের ফলকে খোদাই করার তথ্য পাওয়া যায়। কৃত্তিবাস তাঁর রামায়ণে বাঙালীর প্রিয় রুই ও চিতল মাছের কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের এই মৎস্যপ্রীতি আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির কাছে অপ্রীতিকর ছিলো। তবে বাংলার প্রধান ও প্রথম স্মৃতিকার ভট্ট ভবদেব বাঙালীর মাছ খাওয়ার অভ্যাসের সমর্থন জানিয়েছিলেন। সব মাছ ব্রাহ্মণরা খেতে পারতেন না। তারা খেতেন সাদা ও আঁশযুক্ত মাছ। আঁশবিহীন মাছ, পচা ও শুটকি মাছ ব্রাহ্মণরা খেতেন না।
প্রাকৃত বাঙ্গালীর খাদ্য প্রসঙ্গে ডাঃ রায় বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন। প্রাকৃতপৈঙ্গল গ্রন্থে তিনি চমৎকার খাদ্য তালিকার উল্লেখ করেছেন। সেখানে পাট শাকের সাথে মৌরলা মাছের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন : যে নারী কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল আর পাট শাক পরিবেশন করতে পারেন তার স্বামী নিঃসন্দেহে পুণ্যবান।
বরিশালের কবি বিজয় গুপ্ত ও ময়মনসিংহের কবি দ্বিজবংশীদাসের লেখায় রয়েছে মাছ ও মাছের বৈচিত্র্যময় রন্ধনশিল্পের পরিচয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অনেক লেখাতেই মাছের নানা প্রসঙ্গ এনেছেন। তাঁর ‘জীবন স্মৃতি’ গ্রন্থে তিনি জীবনের নানা ঘটনার উল্লেখ করেছেন আর সেই সাথে উঠে এসেছে চিংড়ি মাছের চচ্চড়ি, মৌরলা মাছের ঝোল, ইলিশ মাছ, কাঁটা চচ্চড়ি, মাছের ঝোল, মাছের কাঁটা দিয়ে ঘন্ট এরকম আরও নানা পদের কথাও। খাদ্য রসিক কবি ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর কবিতায় বিশেষ করে তোপসে ও চিংড়ি মাছের কথা উল্লেখ করেছেন। পুরনো কলকাতায় ইলিশের মত তোপসে মাছও খুব প্রিয় ছিলো। কল্যাণী দত্ত তার ‘থোড় বড়ি খড়া’ উপন্যাসে তোপসে মাছের কথা লিখেছেন। রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ইলিশ মাছকে বাঙালীর সবচেয়ে প্রিয় ও গর্বের মাছ বলে উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন কালেও ইলিশ মাছ বাঙালীর প্রিয় মাছ ছিলো। বুদ্ধদেব বসু ইলিশকে জলের উজ্জ্বল শস্য বলে উল্লেখ করেছেন। প্রাবন্ধিক রাধাপ্রসাদ গুপ্ত তার ‘মাছ ও বাঙালী’ গ্রন্থে ইলিশ মাছ নিয়ে লিখেছেন। মানিক বন্দোপাধ্যায় ,কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখাতেও ইলিশের চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়। খাদ্য রসিক যমদত্ত ইলিশ নিয়ে অনেক গবেষণা করে ও নানা নদীর ইলিশ খেয়ে বলেছেন,পুব দেশের মাছে তেল আর কলকাতার ইলিশের সুগন্ধ বেশি। ইলিশের মত চিংড়ি মাছও বাঙালীদের পছন্দের ছিলো। ভোজন রসিক কবি ঈশ্বর গুপ্ত তার ‘হেমন্তের বিবিধ কাব্য’ নামক কবিতায় গলদা চিংড়ি মাছের চমৎকার বর্ননা দিয়েছেন। খাদ্য রসিক যমদত্তও তার কোন একটা লেখাতে গলদা চিংড়ি খাওয়ার গল্প করেছে। ইতিহাসের পাতা থেকে পাওয়া যায় চিংড়ি মাছের মালাইকারির সূত্রপাত ঘটেছিল মালয় দেশবাসীর রান্নাঘরে। একসময় কই মাছ ছিলো দুই বাংলারই খুব পছন্দের মাছ। তখন যশোর জেলায় বড় বড় কই মাছ পাওয়া যেত। বঙ্কিম চন্দ্র তার একটা লেখাতে কুলগুরুদের কই মাছ প্রীতি নিয়ে লিখেছিলেন। পূর্ব বাংলার সরষে কই, নারকেল কই ও কই পাতুরীকে সর্ব কালের সেরা রান্না বলা হয়। শরৎ সাহিত্যে যেমন দত্তা, রামের সুমতি, শ্রীকান্ততে মাছের বর্ণনা পাই আমরা। কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু তার ‘ভোজনশিল্পী বাঙ্গালী’ নামক চার পর্বে প্রকাশিত প্রবন্ধে মৎস্যপ্রিয় বাঙালীর মাছ নিয়ে অনেক কিছু লিখেছেন।বুদ্ধদেব বসু চিতল মাছের মুইঠ্যাকে বলেছেন “পূর্ব বাংলার এক বিশিষ্ট অবদান।”
বাংলা ভাষার প্রথম দুই রান্নার বই হল ‘পাক রাজেশ্বর’ ও ‘ব্যঞ্জন রত্নাকার’ । যদিও এই দুই বইতে রুই মাছ ছাড়া তেমন কোন মাছের পদের কথা উল্লেখ করা হয়নি। বাংলা ভাষার সবচেয়ে যুগোপযোগী রান্নার বইটি আমরা পেয়েছি ১৮৮৯ সালে বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় এর কাছ থেকে। তার বইটির নাম ছিল ‘শৌখিন খাদ্যপাক’। শাক সবজি, মাংস ছাড়াও এই বইতে রয়েছে মাছ রান্নার নানা রকম রন্ধন প্রণালী। এর এগারো বারো বছর পর প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ গুরুত্বপূর্ন রন্ধন প্রনালীর বই হল ঠাকুর বাড়ির মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার।’