Long Story – Dweep jele jai

দীপ জ্বেলে যাই
অভীক মুখোপাধ্যায়

কপিলাবস্তু। গণতন্ত্র দিবসের* উল্লাসে ডুবে থাকা নগরীর সংকীর্ণ গলি থেকে বিস্তীর্ণ রাজপথ আলোয় আলোময় হয়ে উঠেছে প্রদীপের আলোয়। দেখলে মনে হয়, শাক্যদের বৈভব আজ রাজপ্রাসাদের অন্ধকার গর্ভগৃহ ছেড়ে রাজপথে নেমে এসেছে।  

প্রদীপের নীচে আছে অন্ধকারও। গণতন্ত্র দিবস উদযাপনে আগের সেই শুচিতা আর নেই। মদে মত্ত পুরুষদের পা কাঁপছে। কম্পমান তাদের কণ্ঠও। তারই মধ্যে গুঞ্জরিত হচ্ছে সুন্দরীদের হাস্যধ্বনি। এই কলতান শুনলে কাকপক্ষীর কা কা রবের মধ্যে কোকিলের মদভরা কুহু ডাকের কথা মনে পড়ে।

নগরীর কেন্দ্রে রাজমার্গের বামদিকে অবস্থিত শাক্য সেনাপতি তক্ষকের বিশাল   ভবন। গণতন্ত্র দিবসের শুভ অবসরে অট্টালিকার শীর্ষে উন্নীত হয়েছে শাক্যদের গৌরব পতাকা – চঞ্চল, উন্নত। তক্ষকের ভবনে আজ মধুবাসর। কত অতিথি এসেছেন! ধূপধুনোয় এবং সুগন্ধীতে ম’ ম’ করছে আসরের কক্ষ। পানপাত্রের মদিরা, নৃত্যের তাল এবং সঙ্গীতের স্বর অতিথিদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কল্পনা-লোকে।

‘সেনাপতির সুস্বাস্থ্যের কামনা করি,’ বলে মদে ভরা চষক নিজের ওষ্ঠে ঠেকিয়ে সেনাপতি তক্ষকের দিকে এগিয়ে দিল নর্তকী ইরাবতী।

তক্ষক বললেন, ‘নেশা কীসে হবে ইরাবতী? মদ্যে না তোমার ঠোঁটের স্পর্শে? তুমি নিজেও কি কম মাদক?’

আনন্দে হইহই করে উঠল সকলে। চটুল রসিকতা শোনা গেল দুই একজনের মুখে। পানপাত্র এক চুমুকে শেষ করলেন তক্ষক। নিমেষে পাত্র নিঃশেষিত হল অভ্যাগতদেরও।

সেনাপতির নতুন নেশার নাম ইরাবতী। তার মাদক স্পর্শ পাওয়ার জন্য চুর হয়ে থাকেন তক্ষক। চুম্বক যেমন লোহাকে আকর্ষণ করে, ঠিক তেমনি টান তিনি বোধ করেন ইরাবতীকে দেখলেই। মদিরার পাত্র এবার নিজের ওষ্ঠে স্পর্শ করিয়ে ইরাবতীর দিকে এগিয়ে দিলেন সেনাপতি। মুখে বললেন, ‘তোমার যৌবনের দীর্ঘায়ু কামনা করি!’

‘এ কী মান্যবর? আপনার পানপাত্র যে শূন্য!’ খলখল করে হেসে উঠল ইরাবতী।

সামান্য লজ্জা পেলেন তক্ষক। উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বললেন, ‘তাতে কী? নিজের প্রেমরসে ভরে দাও এই পাত্র।’ ইরাবতী ধীর লয়ে নিজের দেহভার রাখল সেনাপতির জানুতে।

উপস্থিত অতিথিরা এ কথা শুনে এবং এই দৃশ্য দেখে উল্লাস করে উঠল। সময় যত বাড়ছে, ততই মৌতাত জমাচ্ছে মদের নেশা। তীব্র হচ্ছে তৃষ্ণা। অতিথিদের আরও মদিরা প্রয়োজন। মদিরার বৃহৎ পাত্রটিও শূন্য হয়েছে। এক অনুচরকে ইঙ্গিত করলেন তক্ষক। এবং সেই অনুচর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ডাক দিল, ‘রূমণ্বান!’

এক শ্যামল, হৃষ্টপুষ্ট কিশোর এসে উপস্থিত হল তটস্থ ভাবে। স্নিগ্ধ চোখমুখ তার। ভীত সে হরিণের মতোই। মাথা নুইয়ে রাখল কুণ্ঠায়। কেবল ঠোঁট নড়ল, ‘আজ্ঞা, দেব!’

অনুচরটি কিছু বলার আগেই তক্ষক বললেন, ‘কাল মগধের সেনাপতি সুপর্ণ আমাকে বিশেষ ভাবে প্রস্তুত এক ধরণের মদিরা পাঠিয়েছেন। দেখো, অন্তঃপুরে একটি বড় আকারের স্বর্ণপাত্রে রাখা আছে সেই পানীয়। যাও, নিয়ে এসে পরিবেশন করো!’

নতশির রূমণ্বান আরও একটু নিচু হয়ে আনুগত্য দেখিয়ে সেই পাত্র আনতে চলে গেল। এবং পরক্ষণেই ফিরে এসে কক্ষে প্রবেশের অনুমতি চাইল। হাতে ধরা স্বর্ণপাত্র। সেনাপতি সেটিকে নামিয়ে রাখার জন্য ইঙ্গিত করলেন। পাত্র নামিয়ে রাখতে গেল রূমণ্বান, আর তখনই ইরাবতী হাত বাড়িয়ে জৃম্ভণের ভঙ্গীতে লাস্য প্রদর্শন করল। ইরাবতীর হাত গিয়ে লাগল রূমণ্বানের হাতে ধরা পাত্রে। ফল যা হওয়ার তাই হল। কক্ষতল ভেসে গেল সুগন্দিত মদিরায়। এক ধারে গড়াগড়ি খেতে লাগল মদিরা ধারণের সোনার পাত্রখানি।

‘অন্ধ! মূর্খ!’ চিৎকার করে উঠলেন সেনাপতি তক্ষক। নেশাতুর চোখ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে এল ভয়ানক ক্রোধ। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তার পর টলতে টলতে গিয়ে নামিয়ে নিলেন কক্ষের গাত্রে ঝুলিয়ে রাখা চর্মনির্মিত কশা। রূমণ্বানের ওপর আরম্ভ করলেন কশাঘাত। সঙ্গীতের স্বরের স্থানে কক্ষ গুঞ্জরিত হয়ে উঠল রূমণ্বানের আর্ত চিৎকারে। মদিরাপাত্রের স্থলে কক্ষের তলে গড়াগড়ি খেতে লাগল রূমণ্বানের দেহ। এবং রঙিন মদিরার স্থানে দেখা দিল লাল রক্ত।

অতিথিরাও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। নেশাগ্রস্থ থাকায় কিছুক্ষণ প্রহার করার পর ক্লান্ত হয়ে পড়লে তক্ষক হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন কশা। সংজ্ঞা হারিয়েছে রূমণ্বান। ভঙ্গ হয়েছে বাসর। অভাগা দাস রূমণ্বানকে গালমন্দ করতে করতে বিদায় নিল অতিথিরা। রূমণ্বানকে আবারও কশাঘাত করতে চাইলেন তক্ষক, কিন্তু ইরাবতী তার কপোলে হাত বুলিয়ে বলল, ‘আজ নয় প্রিয়। আজ তুমি বড় ক্লান্ত। এসো, ক্লান্তি দূর করে দিই।’ তক্ষক বললেন, ‘এই মূর্খটাকে আর কালকের সূর্য দেখার সুযোগ দেব না আমি। তবে তুমি যখন বলছ, তখন আগের কাজটা আগেই সারি।’ একে অপরের বাহুলগ্ন হয়ে শয়নকক্ষের দিকে চললেন দুজনে।

***

কপিলাবস্তুর ধনিকদের প্রত্যেকেরই বাসভবন যত বড়, মন ততটাই ক্ষুদ্র। এত বড় ভবনেও দাসদের বসবাসের জন্য স্থান কিন্তু নির্দিষ্ট থাকে ক্ষুদ্রতম কক্ষটিই। সেই কক্ষ হয় অন্ধা কারার মতোই। বাতাস নেই। আলো নেই। গণতন্ত্র দিবস উদযাপনের আলোকরশ্মি সেখানে পৌঁছনোর আগেই পথ হারায়। তক্ষকের অট্টালিকায় তেমনই একটি কক্ষে অর্ধমূর্ছিত অবস্থায় পড়ে আছে রূমণ্বান। আর থেকে থেকেই বলছে, ‘জল দাও…জল দাও…।’

তার মাথার কাছে বসে আছে সমবয়সী এক কিশোর। হাতে তার একটি জলপাত্র। অন্ধকার দাসাবাসে, রাত্রির এই অর্ধপ্রহরে রূমণ্বানের ক্ষীণ কণ্ঠের আর্তনাদ ছাড়া আর যদি কিছু শোনা যায়, তা হল সেবারত কিশোরটির সান্ত্বনা।

কিশোর তক্ষকের দাস। সে রূমণ্বানের বয়স্য। বন্ধুও। তার নাম অম্বরীষ। রূমণ্বানের মাথা নিজের কোলে টেনে নিল অম্বরীষ। হাত বুলিয়ে দিতে লাগল কপালে। ব্যাথায় কাতর রূমণ্বানের ক্ষতবিক্ষত শরীর মোচড় দিচ্ছে যন্ত্রণায়। অম্বরীষ অন্ধকারে ভালো করে চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করল রূমণ্বানের মুখ। রক্তের ছোপ লেগে আছে সেখানেও।

সাধারণ মানুষের যে রক্তকে এত সহজে বইয়ে দেন শাক্য রাজপুরুষেরা, সেই রক্তের ভিতেই তো আজ শাক্য-বৈভব মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে–ভাবে অম্বরীষ। দাসদের ঘামের শীতলতাকেই ছায়া রূপে ব্যবহার করে আজকের বিলাসিতায় মত্ত শাক্যরা। ভুলে গেছে অতীতের কথা। ডুবে গেছে মদের নেশায়। আর সেই দাসদের সঙ্গেই এমন পাশবিক আচরণ? এহেন আচরণ দেখে পশুও লজ্জা পাবে!

দাঁতে দাঁত চাপল অম্বরীষ। কঠোর হয়ে উঠল তার হনু। ফুলে উঠল কপালের রগ, হাতের পেশী। ক্রোধে, ঘৃণায় চোখে জল এল। আবছা হতে থাকল চোখের সামনে থাকা রূমণ্বানের মুখ। তার স্থানে ফুটে উঠল অন্য একজনের ছবি। তার মুখেও লেগে আছে রক্তের ছোপ।

ওই ছবি অম্বরীষের মায়ের। মাত্র চারদিন আগেই নিজের মায়ের রক্তাক্ত শবদেহ কোলে নিয়ে কেঁদেছিল অম্বরীষ। গণতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে বেগবান অশ্বদের নিয়ে দৌড় প্রস্তুতির সময়ে সেনাপতি তক্ষক ভ্রূক্ষেপ অবধি করেননি যে ক্রীড়াঙ্গনের মধ্যস্থলে একজন নারী পড়ে আছেন এক রাজপুরুষের কশাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে। নিজের কাজ দ্রুত করে উঠতে না-পারায় তার প্রভু তার দেহ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নিতে দ্বিধা করেননি। দ্বিধা করলেন না তক্ষকও। অশ্বচালনা করে দিলেন সেই রমণীর দেহের ওপর দিয়েই। মুহূর্তে তার দেহ তালগোল পাকিয়ে বীভৎস রূপ নিল। পরিণত হল মাংসপিণ্ডে।

সংবাদ পেতে বিলম্ব হয়েছিল অম্বরীষের। এসে এবং সব দেখে শুধু কোলে তুলে নিয়েছিল দেহখানি। অনুমান করার চেষ্টা করেছিল কোনটা মাথা, কোনদিকে পা। সেদিন অম্বরীষের অশ্রু মিশেছিল ওর মায়ের রক্তে। রূমণ্বানের রক্তে এই যেমন আজ মিশে চলেছে।

‘আহ্!’ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে উঠল রূমণ্বান। নিজের দুই চোখের জল মুছে ফেলে অম্বরীষ রূমণ্বানের ঠোঁটে অল্প জল ঢেলে দিল। অম্বরীষের চোখের জল রূমণ্বানের কপালে পড়ে গড়িয়ে নামছে। রক্ত এবং অশ্রু … অশ্রু এবং রক্ত!

‘কবে নিষ্কৃতি পাব এই দাসত্ব থেকে? এভাবে বাঁচার চেয়ে মৃত্যু ভালো। এভাবে অপমান আর অত্যাচার সহ্য করতে করতে যে একদিন দাসদের চোখের জল আর বুকের ব্যাথাও শেষ হয়ে যাবে!

না! না! একদিন শাক্যরাই এই রক্ত আর চোখের জলে ডুবে মরবে।’ মনে মনে বলতে থাকে অম্বরীষ।

‘কিন্তু সব শাক্যই কি? সবাই যে এক ধরণের নয়,’ নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে চলে সে। উত্তরও স্থির করে নিজেই, ‘হ্যাঁ, সবাইকেই মরতে হবে। একজনের করা অত্যাচার যে অন্যজন থামাতে আসেনি। সব্বাই এক!’

আবেগে কাঁপতে লাগল অম্বরীষের ঠোঁট। ‘জল…জল,’ রূমণ্বান আবার জল চাইল।

তারাদের ঔজ্জ্বল্য কমছে। যৌবন হারাচ্ছে রাতের চন্দ্রমা। আকাশের দিকে তাকাতেই যেন সম্বিৎ ফিরল অম্বরীষের। শীঘ্রই সূর্য উঠবে। প্রভাত হলেই আলো করাঘাত করবে মদের নেশায় চুর শাক্য সেনাপতি তক্ষকের চোখের পাতায়। তাঁর সঙ্গে আবার জেগে উঠবে আগের রাতের ক্রোধ। এবং তখন রূমণ্বানের জীবনপ্রদীপ নিভিয়েই শান্ত হবেন তিনি।

সেনাপতি তক্ষককে ভালো ভাবেই চেনে অম্বরীষ। শান্ত হয়ে সে মনস্থির করল। সিদ্ধান্ত নিল। কিছু একটা করতেই হবে, নাহলে রক্ষা করা যাবে না রূমণ্বানের প্রাণ। রূমণ্বানের মাথাটা নিজের কোল থেকে নামিয়ে মাটিতে রাখল সে। নিজেদের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এগোল সেনাপতির শয়নকক্ষের দিকে।

চতুর্দিক নিস্তব্ধ। কেউ কোথাও নেই। প্রহরীরাও মদের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমোচ্ছে। মার্জার পদক্ষেপে কক্ষে প্রবেশ করল অম্বরীষ। প্রদীপের ম্লান আলোয় সবটাই দৃশ্যমান। শয্যায় নগ্নিকা ইরাবতীকে বক্ষলগ্না করে নিদ্রায় ব্যস্ত তক্ষক। অম্বরীষ প্রদীপের শিখাটাকে ডানহাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে চেপে ধরে নিভিয়ে দিল। তার পর সন্তর্পণে খুলে নিল তক্ষকের হাতের মুদ্রাঙ্গুরীয়।

সামান্য নড়াচড়ায় কী যেন বিড়বিড় করে বলে উঠল তক্ষক। ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল অম্বরীষ। কিন্তু ভয়ানক কিছু ঘটল না। ইরাবতীকে আরও জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে রইলেন সেনাপতি। নিভিয়ে দেওয়া প্রদীপের সলতেটাকে লাল হয়ে জ্বলতে দেখে অম্বরীষ সেটাকে আঙুলে ধরে পিষে দিল। অন্ধকারে তার মুখে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত হিংস্রতা। কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে মনে মনে শপথ নিল সে, ‘এই গণরাজ্যের প্রতিটা প্রদীপ একদিন এভাবেই নিভিয়ে দেব আমি।’

***

রাত্রির অন্তিম প্রহর প্রায় অতিক্রান্ত। আলো ফুটবে যে কোনো মুহূর্তেই। দুজন অশ্বারোহী কপিলাবস্তুর প্রাণকেন্দ্র থেকে ক্রমশ দূরে সরে এসে উপস্থিত হয়েছে নগরীর প্রান্তে। এখানেই নগরী থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার মুখ্যদ্বার। দ্বাররক্ষককে ডেকে তুলল একজন অশ্বারোহী। নষ্ট হওয়া ঘুম যে দ্বারপালকে বিরক্ত করে তুলেছে বোঝাই যায়।

অশ্বারোহী হাত তুলে দেখাল সেনাপতির মুদ্রাঙ্গুরীয়। সে অম্বরীষ। তার সঙ্গীজন রূমণ্বান। মুদ্রাঙ্গুরীয় দেখে আশ্বস্ত দ্বারপাল শেকল টেনে তুলে দিল মুখ্যদ্বার। ঘড়ঘড় শব্দে উন্মোচিত হল লৌহকপাট। ধীর গতিতে নগরী থেকে নিষ্ক্রান্ত হল দুই বন্ধু। মুক্তির আস্বাদ নিয়ে দুজনেই তাকাল আকাশের দিকে। একটা খসা তারা আকাশের বুক চিরে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে গিয়ে ডুবল শাক্য রাজপ্রাসাদের পিছনে।

ভয়ানক অট্টহাস্য করে উঠল অম্বরীষ। মুখে বলল, ‘শাক্যদের ভাগ্যতারা খসে গেল আজ। একদিন সুপ্ত আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরিত হবে। এবং সেইদিন ওই আগুনে জ্বলেপুড়ে ভস্ম হয়ে যাবে শাক্য গণরাজ্যের অন্তিম চিহ্ন!’ নিজের বাক্য শেষ করে অশ্বের পেটে দুই পা দিয়ে আঘাত করে তার আভীষব টেনে ধরল অম্বরীষ। বন্ধুর কথা শুনে দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ছাড়ল রূমণ্বান। তার চোখ ভিজে উঠল।

‘মাতৃভূমির প্রতি এমন অসীম ঘৃণা নিয়ে মনকে কী ভাবে সুন্দর রাখবে অম্বরীষ? এই ভয়ানক আগুনে জ্বলে কি তোমার নিজের হৃদয়ই হাহাকার করে উঠবে না? ব্যক্তির অন্যায়ের উত্তর সমগ্র রাষ্ট্রের কাছে কেন দাবী করছ বন্ধু? কোনো ব্যক্তির অত্যাচারের বিরোধে মাতৃভূমিকে বিনাশের আগুনে ঠেলে দিয়ে নষ্ট করে ফেলার মতো দানবীয় এবং নীচ চিন্তাকে নিজের বিশাল হৃদয়ে স্থান দিও না অম্বরীষ। অত্যাচারের সমাপ্তি শুধু অত্যাচারীর হৃদয় পরিবর্তনের পরেই সম্ভব। প্রতিশোধের মাধ্যমে অত্যচারের প্রতিকার করা তো সেই বর্বর, আদিম যুগের উপায়, যখন মানব সভ্যতা শিশু ছিল। তখন বন্যপশুদের সংস্পর্শে থাকা মানুষ হিংস্র ছিল, প্রতিশোধের ওপরে উঠে কিছু ভাবার ক্ষমতাই ছিল না তার। সেই অসভ্য এবং অসফল পদ্ধতিকে বার বার কাজে লাগিয়ে কী পাবে অম্বরীষ?’ কেঁপে উঠল রূমণ্বানের স্বর।

আবেগে স্তব্ধ হয়ে গেল রূমণ্বানের কণ্ঠ। শাক্য দার্শনিক রত্নাম্বরের চিন্তাধারা তার মনকে উথালপাতাল করছিল অনবরত।

‘তুমি মূর্খ! আবেগপ্রবণ! আর নিষ্ঠুর জগতে আবেগের কোনও স্থান নেই। এই সংসার কটু বাস্তবের ক্রীড়াভূমি! অত্যাচারের বৃক্ষকে কাটার জন্য শক্তির তরবারির থেকে বড় দ্বিতীয় কোনো উপায় না ছিল, না আছে, এবং না থাকবে।’

‘অম্বরীষ, এ বিধির বিধান। ঈশ্বরের ওপর আস্থা রাখো।’

‘সে-ই হাতের রেখায় ভবিষ্যৎ খোঁজে, যে নিজের বাহুবলে আস্থা রাখতে পারে না রূমণ্বান।’

‘কিন্তু…’ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল রূমণ্বান। হাতের ইঙ্গিতে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল অম্বরীষ, ‘তুমি চুপ করো!’ অম্বরীষ একটাই বিষয় বুঝতে পারল না যে, অমন অসহ্য অত্যাচার সহ্য করেও রূমণ্বান কেন অমন কথা বলছে।

দুজনেই চুপ করে গেল। অশ্ব দুটি ধীর গতিতে এগিয়ে চলল। দুঃখের সাগরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রূমণ্বান আকাশের ফিকে হতে থাকা তারাদের দেখতে দেখতে কল্পনার জগতে বিলীন হতে থাকল ক্রমশঃ। অন্যদিকে অম্বরীষ নিজের মনের প্রতিশোধের আগুনে ইন্ধন জোগাল নিজেই। পূর্ব দিগন্ত রক্তিম হয়ে উঠল অল্পক্ষণের মধ্যেই। রূমণ্বানকে দিকনির্দেশ করে পূবেই অশ্বচালনা করে দিল অম্বরীষ।

***

সন্ধ্যা নেমেছে। পাখিরা ফিরে চলেছে নিজ নিজ বাসায়। শুধু দুই গৃহহীন কিশোরের ঠাঁই নেই কোথাও। তারা অশ্বের পিঠে চলে আসছে বিগত ছয়দিন ধরে। দীর্ঘ ছিল যাত্রাপথ। পথে বহুবার থেমেছে দুই বন্ধুতে। বিশ্রাম নিয়েছে। খাদ্যপানীয় গ্রহণ করেছে প্রয়োজন মতো। অবশেষে দুজনে এসে উপনীত হয়েছে কোশল মহাজনপদের সীমান্তে।

অশ্ব থামিয়ে মাটিতে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিল অম্বরীষ। এমন সময়ে সামনে থেকে এক যুবা অশ্বারোহীকে সবেগে আসতে দেখল সে। সেই অশ্বারোহীর পিছনে অশ্বের পিঠে আরও পাঁচজন সশস্ত্র ব্যক্তিকে দেখা গেল। চমকে উঠল অম্বরীষ। অশ্ব থেকে অবতরণ করা আর হল না তার।

প্রথমে অম্বরীষ আর রূমণ্বান দুজনেই ভেবেছিল ওই যুবক এবং অপর পাঁচজন অশ্বারোহী তাদেরই আক্রমণ করতে আসছে। কিন্তু মুহূর্তে ভেঙে গেল তাদের মনের ভুল। আসলে সম্মুখে থাকা যুবকটিকে বাকী পাঁচজনে আক্রমণ করছিল। ক্রমশঃ দূরত্ব কমে আসছিল দুই পক্ষের। দেখতে দেখতেই অগ্রবর্তী যুবকটিকে ঘিরে ফেলল পাঁচজনে। কটিবন্ধ থেকে তরবারি বের করে আনল যুবক। তরবারি ঝকঝক করে উঠল অন্য অশ্বারোহীদের হাতেও।

ঝনঝন করে উঠল অসি। বীরত্বের সঙ্গে লড়তে থাকলেন একাকী যুবক। পাঁচজনের বিরুদ্ধে একজন। কিন্তু সম্মুখ সমরে শুধু বীর্যই যে সব নয়। ক্রমশঃ কোণঠাসা হয়ে পড়তে লাগলেন যুবক।    

অম্বরীষের না-জানি কী মনে হতেই অশ্বের পেটের দুদিকে পা দিয়ে তাল ঠুকল। হ্রেষ্বাধ্বনি তুলে জীবটাও সবেগে ধাবিত হল যুযুধান দুই পক্ষের দিকেই। নিজের তরবারি কোষমুক্ত করে যুবকের পক্ষ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল অম্বরীষ। বীরবিক্রমে লড়তে লাগল সে। রূমণ্বানও ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়ল, ঠিক যেমনটা অবাক হল ওই পাঁচ অশ্বারোহীতে।

অল্পক্ষণের মধ্যেই পালটে গেল পাশার দান। অম্বরীষের হাতের তরবারি বিদ্যুতের বেগে এক অশ্বারোহীর মুণ্ড বিচ্ছিন্ন করে দিল তার ধড় থেকে। এই দৃশ্য দেখে যেমন কেঁপে উঠল চারজন জীবিত আক্রমণকারীর বুক, তেমনই বুকে বল পেলেন ওই যুবক। বিপরীত পক্ষের অসাবধানতার সুযোগ নিয়ে তিনি বিদীর্ণ করে দিলেন একজনের উদর। অবশিষ্ট দুইজন আক্রমণকারী নিজেদের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচল। যুবক কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন অম্বরীষের দিকে।

ইতিহাস জন্ম নেয় প্রতি মুহূর্তে। ক্ষণে ক্ষণে উন্মোচিত হয় তার নতুন পাতা। তেমনই একটি পাতা মেলে ধরল সময়। নিয়তি হাসল অদৃষ্টে। মহাকালের এ বড় অদ্ভুত আচরণ। তিনি কারো কথা শোনেন না, কিন্তু প্রত্যেককে দৃষ্টিতে ধরে রাখেন প্রতি মুহূর্তে। তিনি বধির, কিন্তু অন্ধ নন। এই যেমন অম্বরীষকে আবদ্ধ করে দিলেন কোশল মহাজনপদের ভাবী সম্রাট বিরুধকের ভুজা বন্ধনে।

***

অম্বরীষ এবং রূমণ্বান, দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু। একজন অন্যজনের জন্য নিজের প্রাণ দিতেও পিছিয়ে আসবে না। অথচ ভিন্ন দুজনের অধিকাংশ বিচার, মত এবং সিদ্ধান্ত। ভিন্নতা এতটাই যেন আগুন আর জল। একজনের আত্মায় বিনাশের বিধ্বংসী ঝড় এবং অন্যজনের কল্পনায় শান্তিপূর্ণ ক্রান্তির স্বপ্ন। এবং এত প্রগাঢ় বন্ধুত্ব থাকা সত্ত্বেও যা অবশ্যম্ভাবী তাই ঘটল–বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল দুই অমরসঙ্গীর চলার পথ।  

বিরুধক কোশলের রাজকুমার। তাঁর পিতা রাজা প্রসেনজিত। মাতার নাম বাসবী। কিন্তু বাসবী শাক্য রাজপুরুষ মহানামের কন্যা হলেও বাস্তবে ছিলেন এক দাসীপুত্রী। কোশলরাজ প্রসেনজিত চেয়েছিলেন শাক্যকুলের কোনো দুহিতাকে বধূ করে আনতে। কিন্তু শাক্য গণরাজ্য চায়নি নিজেদের কৌলিন্যকে কোশল সাম্রাজ্যবাদের গ্রাসে ঠেলে দিতে। অপরদিকে কোশলের উপরে নির্ভরশীল হওয়ার কারণে প্রসেনজিতকে নস্যাৎ করার দুঃসাহস দেখাতে পারেননি শাক্যরা। তাই মহানাম কূট পদ্ধতিতে বাসবীর পরিচয় গুপ্ত রেখেই এই বিবাহ সংঘটিত করেন। বিবাহের পর জন্ম হয় বিরুধকের।

বিরুধক রাজার কুমার হলেন বটে, কিন্তু আগুনকে ছাইচাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। মুখে মুখে রটতে থাকে বাসবীর দেহের দাসীরক্তের কথা। বিরুধকের রাজবংশী হওয়াকেও ফেলা হয় প্রশ্নের মুখে। তবে এসবই নীরবে হচ্ছিল। সকলেই সব কিছু জানলেও কেউই কিছু বলার সাহস করত না। নিজের রাজ্যেই রাজকুমার বিরুধক অনাদরের পাত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন। এই বিষয়টা কুরে কুরে খাচ্ছিল বিরুধককে। ব্যঙ্গমিশ্রিত অবহেলা পেতে পেতে বিরুধক ক্রমশঃ হিংস্রতার প্রতিমূর্তি হয়ে উঠছিল। এবং এরই অপেক্ষায় ছিল অম্বরীষ। অল্পদিনের মধ্যেই সব বুঝে নিয়েছিল সে। শাক্যদের বিরুদ্ধে নিজের প্রতিহিংসাকে চরিতার্থ করার জন্য রণবেশ পরাচ্ছিল সে মনে মনে। কারণ ভিন্ন হলেও দুজনের লক্ষ্য একই হয়ে উঠল। বিরুধক অগ্নি হলে অম্বরীষ হয়ে উঠল আহুতি। যখনই বিরুধকের মনের প্রতিহিংসার আগুন নিভু নিভু হয়ে এল, তখনই বায়ুর মতো সেই আগুনকে পুনর্বার জ্বালিয়ে তুলল অম্বরীষ।

কানাঘুষো চলতে থাকে। ক্রমশ বিষিয়ে ওঠে বিরুধকের মন। রানি বাসবীকে সে জানতে চায়, ‘মাতা, কে আমার মাতামহ? কেই বা মাতামহী?’

‘তাঁরা কপিলাবস্তু নগরীতে থাকেন পুত্র। সে অনেক দূরের পথ,’ উত্তর দেন বাসবী।

‘তাহলে আজ্ঞা দিন মাতা। দেখে আসি আমার আত্মীয়দের। গুরুজনদের আশিস নিয়ে আসি আমি তবে।’

এরপর আর কোনো কথা বলতে পারেন না বাসবী। বলবেনই বা কী? পুত্রের রোষ সর্বজনবিদিত।

অতএব, কোশল মহাজনপদের রাজকুমার বিরুধক চললেন কপিলাবস্তুর উদ্দেশে। উদ্দেশ্য নিজের মাতামহ, মাতামহীর দর্শন লাভ।

কপিলাবস্তুর রাজকীয় অতিথিশালায় বিরুধককে রাজসিক ভাবে স্বাগতম জানালেন শাক্য গণপতি মহানাম। একটি বিশেষ রূপে সুসজ্জিত কক্ষে সকল রাজপুরুষ বসে ছিলেন। বৃদ্ধ গণপতি মহানাম নিজের পরিচয়ে বিরুধককে পরিচিত করিয়ে দিতে লাগলেন কপিলাবস্তুর প্রমুখ ব্যক্তিদের সঙ্গে। প্রত্যেক ব্যক্তির পরিচয় শুনে বিরুধক হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন, কিন্তু উত্তরে কোনো অভিবাদন জানালেন না রাজপুরুষেরা। ভয়ানক রুষ্ট হলেন কোশলের রাজকুমার। চোখ রাঙা হয়ে উঠল ক্রোধে। অম্বরীষ ছায়াসঙ্গী হয়ে ছিলই রাজকুমারের পাশে পাশে। সম্পূর্ণ বিষয় দেখে মনে মনে যারপরনাই আনন্দিত হল সে। তার অনুমান এবং ইচ্ছা অনুসারেই চক্র চলছিল যে। সব চাল সঠিক পড়ছিল।

রাজকুমারের ক্রোধের ব্যাপারটা কিন্তু মহানামের চোখ এড়াল না। তিনি কারণ অনুধাবন করলেন বিচক্ষণ ভাবেই। বিরুধকের রোষ প্রশমনের জন্য তিনি বললেন, ‘রাজকুমার, ক্রুদ্ধ হবেন না। এখানে উপস্থিত সকলেই বয়সে এবং সম্মানে আপনার থেকে বড়।’

মহানামের যুক্তি শুনে শান্তই হলেন বিরুধক। ঠোঁটে দেখা দিল সন্তোষের আভা। আশ্বস্ত হলেন গণপতি মহানাম। কিন্তু এসব দেখে বিরক্ত হল অম্বরীষ। বিষের হাসি দেখা দিল তার ওষ্ঠে।

‘গণপতি মহানাম, আপনি সত্য স্বীকার করছেন না কেন? বলেই ফেলুন না যে, দাসীপুত্রীর সন্তান বলে বিরুধকের নমস্কারের উত্তর দিতে মানে বাধছে কুলীন শাক্যদের। বলুন না…’ অম্বরীষের তীক্ষ্ণ স্বর আছড়ে পড়ল কক্ষের ভিতর। বিরুধকের বুকের উপর। তির বিদ্ধ করল সঠিক লক্ষ্যকে। মর্মর মূর্তির মতোই স্থবির হয়ে গেলেন সকলে।

গণপতি মহানাম কিছু বলে উঠতে পারার আগেই আহত সর্পের মতো ফুঁসে উঠল বিরুধক, ‘এই মুহূর্তে আমি কপিলাবস্তু ছেড়ে চলে যেতে চাই!’

সমগ্র কপিলাবস্তু ডুবে গেল অমঙ্গলের আশঙ্কায়।

সর্বাগ্রে চললেন রাজকুমার বিরুধক। পিছনে অশ্বপৃষ্ঠে সৈন্যদল। নগরদ্বারে এসে উপনীত হলেন তাঁরা। হঠাৎ অম্বরীষ সকলকে থামার নির্দেশ দিয়ে বলল, ‘আমাকে যে একবার ফিরে যেতে হবে রাজকুমার। আমি নিজের ছুরিকা ফেলে এসেছি ওই কক্ষেই।’

ফিরে গেল অম্বরীষ। নির্দিষ্ট কক্ষে প্রবেশ করতে যাবে এমন সময় সে দেখল দুজন দাসী মিলে কক্ষের তল পরিষ্কার করছে। দুধ দিয়ে। অম্বরীষ হেসে প্রশ্ন করল, ‘আমরা চলে যাওয়ার পরে দুধ দিয়ে সব কিছু ধুয়ে পবিত্র করে তোলা হচ্ছে বুঝি?’

চমকে উঠল দাসী, ‘এ কেমন অসম্ভব কথা বলছেন শ্রীমান? দুধ ভর্তি মাটির কলস ভেঙে এই বিপত্তি।’

‘তাই নাকি? আমি তো এমনিই বলে দিলাম,’ নিজের কথা শেষ করে হাতে ছুরিকা নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করল অম্বরীষ। তবে তার হাতে থাকা অদৃশ্য তির দেখতে পেল না কেউই। সে তির অব্যর্থ!

নগরদ্বারে এসে পৌঁছাল অম্বরীষ। থমথমে মুখ, স্ফুরিত নাসাপট। তাকে দেখেই বিরুধক প্রশ্ন করলেন, ‘কী হল মিত্র?’

‘কিছু না…’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল অম্বরীষ।

‘কিছু না বললেই হল? তোমার হাবভাব বলছে তুমি স্বাভাবিক নেই। কিছু তো হয়েছে অবশ্যই। তোমার কথা না-শুনে আমি এগোনোর নির্দেশ দেব না।’

‘রাজকুমার, সে কথা শুনে তুমি সহ্য করতে পারবে না।’

অম্বরীষের কথায় বিরুধকের মনের জিজ্ঞাসা আরও তীব্র হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ‘আমি সব কিছু সহ্য করতে অভ্যস্ত। তোমাকে বলতেই হবে। বলো!’ কথা সমাপ্ত করে আবেগে অম্বরীষের দুই হাত চেপে ধরলেন রাজকুমার।

‘তবে শোনো, যে স্থানে তুমি দাঁড়িয়েছিলে, সেই স্থান দুধ দিয়ে ধুয়ে পবিত্র করা হচ্ছিল।’

যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হল। নিজের কটিবন্ধ থেকে তরবারি কোষমুক্ত করে ফেললেন বিরুধক। তাঁর হাতের পেশী শক্ত হয়ে উঠল। চোখে জ্বলে উঠল প্রতিহিংসার আগুন। এক হাতে কিছুটা মাটি তুলে নিয়ে তিনি বললেন, ‘কপিলাবস্তুর মাটি ছুঁয়ে শপথ করছি, যদি এই ভূমি শাক্যদের রক্তে ধুতে না পারি তবে আমার নামও বিরুধক নয়!’

মুহূর্তে পরিবর্তিত হয়ে গেল বাতাবরণ। নিজের অশ্ব কোশলের উদ্দেশ্যে চালনা করে দিলেন বিরুধক। মুখে হাসি ফুটল অম্বরীষের। দীর্ঘ সময় ধরে আগুন জ্বালিয়ে রাখার মতো আহুতি যে দিয়ে দেওয়া গেল।

অম্বরীষ জানত যে, শাক্যদের ভূমিকে রক্তরঞ্জিত করে তোলার পথের সবথেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবেন কোশলরাজ প্রসেনজিত। এবং নিজের পথের কাঁটা তুলে ফেলার বিদ্যাও তার অজানা নয়। তার মন্ত্র অব্যর্থ! তাই রাজকুমার বিরুধককে সে কুলীনবংশী শাক্য শাসকদের কট্টর শত্রুতে পরিণত করে তুলল। কেবল শাক্যই নয়, যে কোনো কুলীনবংশীয় শাসকই হয়ে উঠল তার চোখের বালি। এবং এসবের মধ্যেই একদিন অম্বরীষ রাজকুমার বিরুধককে এ কথাও বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হল যে, নিজের জীবদ্দশায় প্রসেনজিত কোশলরাজের আসন তাঁর জন্য ছেড়ে দেবেন না।

সঙ্কেত স্পষ্ট ছিল। প্রস্তুত ছিল যোজনা। এবং একদিন অম্বরীষের সৃষ্ট চক্রে পড়ে কোশলরাজ প্রসেনজিতের রাজমুকুট গিয়ে উঠল বিরুধকের মস্তকে।

***

‘মহামন্ত্রীর জয় হোক!’ প্রহরী জয়ধ্বনি দিয়ে নিজেদের হাতের ভল্লের ফলা নীচু করে অম্বরীষের সামনে এসে দাঁড়াল। কোশলের মহামাত্য অম্বরীষের সম্মুখে।

‘বলো, কী সংবাদ?’ রাজকীয় গৌরবে ভরা স্বরে প্রহরীকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল অম্বরীষ।  

‘বৎস্য মহাজনপদের সেনাপতি আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী।’

‘বৎস্য সেনাধীশ? রূমণ্বান? কই সে? কোথায়?’ হর্ষে উৎফুল্ল হয়ে উঠল অম্বরীষের মুখ। নিজের গলা থেকে গজমোতির মালা খুলে প্রহরীর হাতে দিয়ে সে বলল, ‘এই সুসংবাদের পুরষ্কার।’

অচিরেই সাক্ষাৎ হল দুই বন্ধুর। রূমণ্বানকে জড়িয়ে ধরল অম্বরীষ।

রূমণ্বান। বৎস্য মহাজনপদে এক নতুন তারকা সে। মহারাজ উদয়নের সেনাদলের ভার পেয়েছে নিজের যোগ্যতায়। তার রাশিছকের সব গ্রহই সম্ভবত মুখ তুলে চেয়েছে তার দিকে। রাজানুগ্রহ, সেনার দায়িত্ব, এত ক্ষমতা, এ কি সহজ কথা? বৎস্যরাজ উদয়নের স্নেহধন্য সে। বিশ্বাসের পাত্রও বটে।

আকাশে চন্দ্রমা ম্লান হলেও আকারে পূর্ণতা পেতে আরম্ভ করেছে। রাজভবনের উন্মুক্ত বারান্দায় বসে দুই বন্ধু। সেবকেরা ছিটিয়ে চলেছে সুগন্ধিত জল। বাতাস করে চলেছে সমানে। অতীতের কত কথা বলল দুজনে! এরপর বর্তমান নিয়ে কিছু প্রশ্ন করল রূমণ্বান।

‘মিত্র অম্বরীষ, এ কথা কি সত্য যে, কোশল মহাজনপদের বিশাল সেনা শাক্যভূমি কপিলাবস্তুকে পদদলিত করার জন্য শীঘ্রই প্রস্থান করবে?’

‘হ্যাঁ,’ কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিল অম্বরীষ।

‘কিন্তু মিত্র, তুমি কি ভুলে গেছে যে কপিলাবস্তু আমাদেরও মাতৃভূমি? ওই মাটিতে খেলেই বড় হয়েছি আমরা। ওর কণায় কণায় জড়িয়ে আছে আমাদের বাল্যস্মৃতি। জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের থেকেও বড়!’

‘কোন জন্মভূমির কথা বলছ বন্ধু? যে মাটিতে কুলীন শাক্যদের এঁটো খেয়ে কুকুরের মতো ঘৃণ্য জীবন যাপন করে বেঁচে থাকে দলদাসেরা? হ্যাঁ, আমি ওই মাটির সন্তান। তুমি ওখানকারই ভূমিপুত্র। কিন্তু কোথায় ছিল তোমার এই অমোঘ বাণী যখন ঐশ্বর্যের মদে মত্ত শাক্যরা তোমার মাতার হত্যা করেছিল? কুলীন শাক্যদের বাসনার আগুনে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হতে থাকা রমণীদের জন্য তুমি কি এই বাণীই উচ্চারণ করবে? ওই মাটির কণায় কণায় তোমার বা আমার মতো মানুষের রক্ত মিশে আছে। গণতন্ত্র ওখানে প্রহসন! দুর্বলের অশ্রু, নির্ধনের রক্তে সঞ্চিত হয়েছে কপিলাবস্তুর ধন, ঐশ্বর্য। মন দিয়ে শোনো রূমণ্বান, আমি কেবল কপিলাবস্তুর নয়, প্রত্যেক গণরাজ্যের শত্রু হয়ে উঠেছি। গণরাজ্য, গণতন্ত্র এসব শব্দেরা মিথ্যাচার মাত্র। জনগণকে ছলনা করা।’

সামান্য বিরাম দিল অম্বরীষ। আবার আরম্ভ করল, ‘আমি এমন এক সাম্রাজ্য স্থাপনার স্বপ্ন দেখি, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের হিত সুরক্ষিত থাকবে। দাস, দুর্বল, অসহায় ব্যক্তির নাগরিক হিত কোনো গণরাজ্যে সুরক্ষিত থাকতে পারে না। সেখানে ধনসম্পদ মুষ্টিমেয় মানুষের হাতেই কুক্ষিগত থাকে, অবশিষ্টরা ডুবে যায় দারিদ্রের অন্ধকারে। আজকের নিপীড়িত মানুষই যেদিন রাজদণ্ড হাতে ধারণ করবে, সেদিন বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায় আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য অতি মহৎ, কিন্তু গণরাজ্যে কী ঘটে বন্ধু? অল্পজন হিতায়, অল্পজন সুখায়। তাই না? মানুষের সুখের পথের সব থেকে বড় বাধা, সব থেকে বড় প্রতারণার নামই হল গণতন্ত্র। তা শুধুই মৃগমরীচিকা। দলিত, পীড়িত মানুষের কাছে চিরন্তন ভ্রম। আমি তাকেই সমূলে উপড়ে ফেলতে চাই মিত্র। এবং এই মহানাশের যজ্ঞে শাক্যগণই হবে আমার প্রথম আহুতি!’

‘ভুল করছ অম্বরীষ। ভুলেও গেছ তুমি। হিংস্র প্রতিশোধের দ্বারা এই ধনী – দরিদ্রের বর্গভেদের শেষ হবে না। কুলীনের পরিবর্তে নাহয় এল দলিত মানুষেরা। তারাই তো হবে নতুন কুলীন। হবে না কি? আবার এরাই তখন আগের কুলীনদের দলিত করবে পায়ের চাপে। অতীতের কুলীন তখন সাপের মতো ফণা তুলবে, বিষ ঢালবে সাধ্য মতোই। আবার বিপরীত পক্ষ দংশন করবে। এই চলবে তখন। চক্রের আকারে। প্রতিশোধের চক্র। বর্গভেদের খাদ হয়ে উঠবে গভীর থেকে গভীরতর। আর একথার দায়িত্ব কে নেবে যে, যাদের হাতে গণতন্ত্রকে রক্ষার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে, তারাই আবার খেয়ে ফেলবে না তো গণতন্ত্রকে? এই যে গণতন্ত্র দেখছ, এখানে কোন না কোনো শেকলে বাধা পড়বেই অত্যাচারীরা। অপরাধ করলে শাস্তি পাওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। কিন্তু সম্রাটের শাসন তো একনায়কের তন্ত্র। সেখানে তিনি নিরঙ্কুশ। অম্বরীষ, বন্ধু আমার, গণতন্ত্রকে হত্যার চেষ্টা কোরো না। গণতন্ত্রই মানুষের সুকুমার ভাবনাগুলোর সবথেকে কাছাকাছি থাকা বিষয়। গণতন্ত্রের চিন্তা শাশ্বত। মানবতার আদর্শের স্বপ্ন পূরণের জন্য তাই তোমার পথ রোধ করে দাঁড়াব আমি। আজ এক্ষণে কথা দিলাম,’ শেষ  দিকে দৃঢ় হয়ে উঠল রূমণ্বানের কণ্ঠস্বর।

আবার বলে উঠল রূমণ্বান, ‘তাই বলে এই নয় যে, দাসদের উপরে হওয়া অত্যাচার দেখে আমার বুক কেঁপে ওঠেনি। দাসত্বের বেদনা আমিও সহ্য করেছি মিত্র। আমি চাই তারা মুক্তি পাক। অপমানের আগুন আমাকেও পোড়ায়। অন্তরে। শাক্য সেনাপতি তক্ষকের কশাঘাতের চিহ্ন আজও আমার পিঠে বহন করছি আমি। পরিবর্তন আমিও চাই, কিন্তু বিনাশ চাই না। আমার পথ পৃথক। পদ্ধতি ভিন্ন। এক বিন্দু রক্তও না-বইয়ে অনেক কিছু করে দেখিয়েছি আমি। বৎস্য মহাজনপদে বসে বসেই আমি শান্তিময় ক্রান্তির চক্র চালনা করছি। শাক্যদের মহাপ্রভু রত্নাম্বরের শিষ্য সংখ্যা বেড়ে হয়ে গেছে কয়েক সহস্র। পরিবর্তিত হচ্ছে শাক্য যুবকদের হৃদয়। হিংসা, ঘৃণা এবং অত্যাচারের মহাপাশ থেকে উদ্ধার করার জন্য যত্নশীল হয়ে উঠেছেন বুদ্ধ তথাগত। দুর্বল, নিপীড়িতদের কষ্ট লাঘব হবে শীঘ্রই। এসবই কিন্তু ঘটছে গণতন্ত্রের মধ্যে। সম্রাটের শাসনে তো মাথা তোলাও অপরাধ হয়ে দাঁড়ায় অম্বরীষ।’

উত্তর যে দিতেই হয় অম্বরীষকে। সে মুখ খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু হাতের সংকেতে তাকে থামিয়ে দিল রূমণ্বান। বলতে আরম্ভ করল আবার, ‘ভুলো না অম্বরীষ, যদি গণতন্ত্র একবার নষ্ট হয়ে যায় তবে ওই সমস্ত লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষদের কণ্ঠ শোনার জন্য দীর্ঘকাল আর কাউকে পাওয়া যাবে না। তরবারি আর রক্তপাত দিয়ে যেমন হৃদয় পরিবর্তন করা যায় না, তেমনই কোন সমস্যার সমাধানও হয় না। বরং সমস্যা আরও বাড়বে। আরও শোনো। আমার গুপ্তচরেরা বিশ্বস্ত সূত্র থেকে এই সংবাদ পেয়েছে যে, আগামী গণতন্ত্র দিবসে শাক্য গণপতি সমস্ত দাসদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেবেন।  হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটছে অম্বরীষ। বৃথা নিজের মাতৃভূমিকে বিনাশ করার কলঙ্ক নিজের কপালে কেন লাগাবে তুমি? আমার কথা শোনো বন্ধু। বিনাশের পথ বিজয়ের পথ নয়। ফিরে এসো। এখনও সময় আছে।’

‘তুমি নিজে যেমন সরল, তেমনই সহজ অন্যদেরও ভাবো। এটাই সমস্যা। রাজনীতি আদরশের পাঠশালা নয়, কূটনীতিক প্যাঁচের আখড়া। মিত্র, শাক্য গণপতি যদি দাসদের মুক্তির ঘোষণা করেও দেয়, তবে তা নিশ্চিত ভাবে রাজনীতির নতুন কোনো ছলনার অঙ্গ বিশেষ। কী যেন বললে তুমি? মাতৃভূমির হত্যা…? ওসব শব্দবন্ধে আমার মনে আর কোনো প্রভাব পড়ে না বন্ধু। আমি কল্পনালোকে বিচরণ করি না। যথার্থ বাস্তববাদী। ঘোর সংসারী! আমার মনের কোমলতা প্রাণ হারিয়েছে শাক্যদের অশ্বের পায়ের খুরে, তাদের কশার আঘাতে। অনেকটা পথ আমি পেরিয়ে এসেছি যে। এখন ফেরা অসম্ভব। শাক্যদের বিনাশ আমার সংকল্প। এবং যে কোনো মূল্যে আমি তা করে দেখাব। আমার পথের বাধা হয়ে দাঁড়িও না বন্ধু,’ গম্ভীর ভাবে বলল অম্বরীষ।

নিরাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল রূমণ্বান। বন্ধুত্ব পরাজিত হল। জয় হল সিদ্ধান্তের। ক্ষমা পদাহত হল। বিজয়োল্লাস করে উঠল প্রতিশোধ।

***

অম্বরীষ আর রূমণ্বানের সাক্ষাৎকারের পর কেটে গেছে এক পক্ষ কাল। অভিযানের প্রস্তুতি পূর্ণ করে নিয়ে বিরুধক এবং অম্বরীষ সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে আক্রমণ করল শাক্যনগরী। ভয়ংকর সে আঘাত। প্রতিরোধ প্রায় গড়েই তুলতে পারল না শাক্যরা। নগরীর দ্বার বিধ্বস্ত হল। ভয়ানক অট্টহাসি নিয়ে নগরীতে প্রবেশ করল বিরুধক এবং অম্বরীষ। শত শত শাক্যের রক্তে রাঙা হয়ে উঠল কপিলাবস্তুর মাটি।

নিজের হাতে উল্কাদণ্ড জ্বালিয়ে শাক্য সেনাপতি তক্ষকের বাসভবনে আগুন লাগাল অম্বরীষ। কপিলাবস্তু জ্বলতে লাগল চিতার মতোই। চতুর্দিক হাহাকারে ভরে উঠল। পোড়া গন্ধের মহাসমুদ্রে ডুবে গেল শাক্যভূমি। অবশিষ্ট রইল শুধু সেই অতিথিশালা, যেখানে পা রেখে অপদস্থ হয়েছিল বিরুধক। তার ইচ্ছা জীবিত শাক্যদের রক্ত দিয়ে ধোয়া হবে অতিথিশালাটির কক্ষতল।

সন্ধ্যা নেমেছে। সংঘর্ষ অনেকটাই স্তিমিত। জীবিত তথা বন্দি শাক্যদের ধরে আনা হয়েছে অতিথিশালায়। আজ শাক্যদের অন্তিম চিহ্ন অবধি মুছে দিতে বদ্ধপরিকর দুই বন্ধু–বিরুধক ও অম্বরীষ। আজ মুছে যাবে কপিলাবস্তু, তার অন্তিম গণতন্ত্রদিবসে। আজ শাক্যভূমির গণতন্ত্রদিবস যে!

সার দিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে বন্দিদের। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে অম্বরীষের মন ফিরে গেল অতীতে। বাতায়ন দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল সে। পূর্ণ চন্দ্রমা শোভা পাচ্ছে সেখানে। আজও আলোয় আলোময় হয়ে উঠেছে কপিলাবস্তুর প্রতিটি কোণ, তবে প্রদীপের আলোয় নয়, বিধ্বংসী আগুনে। গণরাজ্যের অগ্নিপরীক্ষা নিচ্ছে অম্বরীষ। সে হাসছে। অট্টহাসি। অতীতের কথা স্মরণ করে হাসছে সে। সেদিন চোরের মতো কপিলাবস্তু ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল কিশোর অম্বরীষ। রূমণ্বানের ক্ষতবিক্ষত মুখ ফুটে উঠল তার চোখের সামনে। ‘রূমণ্বান!’ নিজের মুখে একবার প্রিয় বন্ধুর নাম ডেকেই চমকে উঠল সে। বজ্রাহতের মতো।

অম্বরীষের চিন্তার জাল ছিন্ন হল পর মূহুর্তেই। হাতে তরবারি নিয়ে অতিথিশালায় প্রবেশ করলেন মহারাজ বিরুধক। তাঁকে অভিবাদন জানাল অম্বরীষ। আরম্ভ হল এক একজন শাক্যের মাথা কাঁটা। রক্তে ভেসে গেল অতিথিশালা। কয়েকজন সৈন্য বস্ত্রখণ্ড হাতে নিয়ে সেই রক্তে মুছতে লাগল কক্ষের তল। সাম্রাজ্যবাদের প্রবল ঝড়ে গণতন্ত্রের বিপন্ন প্রদীপ নিভু নিভু হয়ে এল।

হঠাৎই শোরগোল শোনা গেল। প্রথমে স্পষ্ট হল অশ্বের খুরধ্বনি। তারপর অস্ত্রের চমক। বজ্রের মতো প্রবেশ করল বৎস্য রাজ্যের সেনাদল। চমকে উঠল অম্বরীষ। তীব্র বেগে দৌড়াতে থাকা একটি শ্বেত অশ্ব এসে থামল তার সামনে। আরোহী আর কেউ নয়, স্বয়ং রূমণ্বান। ধীরে অশ্বের পিঠ থেকে নেমে এল সে। তার দুচোখে ব্যাথা। মুখে আশাহত হওয়ার ছায়া। বুঝতে পারল যে, বিলম্ব করে ফেলেছে সে। বিনাশ যা হওয়ার হয়েই গেছে। চোখ তুলে রূমণ্বান তাকাল অবশিষ্ট জীবিত তথা বন্দি শাক্যদের দিকে। আশার রেখা এটুকুই। প্রদীপের অবশিষ্ট তেল।   

বিরুধক গর্জে উঠলেন, ‘কে তুমি?’

বিরুধককে প্রায় গুরুত্ব না দিয়ে অম্বরীষের দিকে ফিরে উত্তর দিল রূমণ্বান, ‘বৎস্য দেশের সেনাপতি।’

কথার মাঝে বিরতি দিয়ে সে অম্বরীষকে বলল, ‘গণতন্ত্রের অন্তিম চিহ্ন এই শাক্যদের প্রাণে মেরো না অম্বরীষ। তুমি কথা না শুনলে আমাকে বাধ্য হয়ে বলপ্রয়োগ করতে হবে। চোখের সামনে গণতন্ত্র এবং মাতৃভূমির হত্যা হতে দেব না আমি।’

‘ইহজগতের কোনো ব্যক্তি, কোনো শক্তিই আজ আমার হাত থেকে এই শাক্যদের রক্ষা করতে পারবে না!’ উত্তরে বললেন বিরুধক। সঙ্গে সঙ্গেই হাওয়ায় ঝলসে উঠল তাঁর হাতের তরবারি। আর একজন শাক্যের কাটা মুণ্ড গড়িয়ে গেল কক্ষতলে।

অগ্নিগোলকের মতো ধ্বক করে জ্বলে উঠল রূমণ্বানের চোখ। শক্ত হয়ে উঠল বাহুর পেশী। কটিবন্ধ থেকে মৃত্যুসংবাদ নিয়ে বেরিয়ে এল তার অসিও। বিরুধক এগিয়ে এসে তরবারি চালনা করলেন। দুজনের অস্ত্র একে অপরকে আঘাত করে আগুনের ফুলকি ছোটাল। কালবৈশাখীর মেঘের মতোই রূমণ্বান কালান্তক হয়ে উঠল। বিরুধক ক্রমশ পিছু হটতে শুরু করলেন। রূমণ্বানের ঘাতক প্রহার সহ্য করতে করতে দুলে উঠতে লাগল বিরুধকের জীবননৌকা। ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসছিল বিরুধকের প্রত্যাঘাত। কাঁপতে আরম্ভ করল তার দেহ। হাত থেকে খসে পড়ল তাঁর অসি। মহাকালের মতো ভয়ংকর বোধ হতে লাগল রূমণ্বানকে। বিরুধকের উপর শেষ তথা প্রাণঘাতী প্রহার করার জন্য তরবারি তুলল সে।

এতক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে দেখছিল অম্বরীষ। সহসাই কী মনে হওয়াতে সে এগিয়ে এসে ঢাল হয়ে রক্ষা করতে গেল বিরুধককে। ততক্ষণে রূমণ্বানের তরবারি ইন্দ্রের বজ্রের মতো আঘাত হেনে ফেলেছে। কর্তিত বৃক্ষের মতো ধরাশায়ী হল অম্বরীষ। ‘হায়, হায়!’ করে উঠল রূমণ্বান। হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিয়ে সে বুকে তুলে নিল আহত বন্ধুকে। আর সুযোগ দেখে তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রাজা বিরুধক।

প্রাথমিক ভাবে বিপর্যস্ত বোধ করলেও প্রত্যাঘাত করতে বিলম্ব করল না রূমণ্বান। দাবানলের মতো তার মনে ছড়িয়ে পড়েছিল ক্রোধ। বন্ধুকে মৃত্যুমুখে পতিত হতে দেখে আরও অধিক ভয়ানক হয়ে উঠল তার প্রহার। অম্বরীষকে সযত্নে মাটিতে শুইয়ে রেখে ক্ষতবিক্ষত করে দিল সে বিরুধককে। এবং শেষ মুহূর্ত অবধি এমন ভাবে আঘাত করে গেল কোশলরাজকে, যাতে তাঁর দেহ পরিণত হল একদলা মাংসপিণ্ডে।

চোখের আগুন এবার ঝরে পড়ল জল হয়ে। মুঠোয় শিথিল হয়ে এল তরবারির হাতল। রক্তস্নাত তরবারি হাত থেকে খসে পড়ল কক্ষের তলে। ঝনঝন শব্দে। অম্বরীষের নিথর দেহে মুখ গুঁজে রূমণ্বান কাঁদতে লাগল অবোধ শিশুর মতো।   

চাঁদ ঢলে যেতে আরম্ভ করেছে আকাশে। অম্বরীষের শবদেহ নিজের কোলে নিয়ে বসে আছে রূমণ্বান। সেই রাত! সেই গণতন্ত্রদিবস! মনে পড়ছে পুরোনো কথা। কত স্মৃতি! রূমণ্বানের উষ্ণ অশ্রু টপটপ করে পড়তে লাগল অম্বরীষের মুদিত চোখে।

কপিলাবস্তুর ভগ্ন নগরদ্বার দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল রূমণ্বান। হাতে তার শাক্য ধ্বজা। তাকে অনুসরণ করে চলল জীবিত শাক্য নাগরিকরা। আজ অবশিষ্ট শাক্যদের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। কোনো বর্গ নেই। না কুলীন, না দাস; না ধনী, না দরিদ্র। অগ্নির তাপে ভস্ম হয়েছে কালিমা, শুধুই সোনা। সবটাই স্বর্ণাভ।

***

কপিলাবস্তুর নগরসীমায় দাঁড়িয়েই বৎস্য মহাজনপদের বিশাল বাহিনী চোখে জল এবং হৃদয়ে বেদনা নিয়ে বিদায় দিচ্ছে নিজেদের সেনাপতিকে। নিজের হাত থেকে রাজমুদ্রা খুলে রাখল রূমণ্বান। কটিবন্ধ থেকে তরবারি আর ছুরিকা খুলে সে হস্তান্তরিত করল নিজের অধীনস্থ নায়ককে। মনের কষ্ট চাপতে না-পেরে কেঁদে ফেলল নায়ক। তাকে দেখাদেখি কাঁদতে লাগল সকল সৈন্য। পীড়ার অশ্রু নদী হয়ে বইতে লাগল।

সজল হয়ে উঠল রূমণ্বানের নেত্রও। ধীরে ধীরে সেনাদল সুদূর ক্ষিতিজে অদৃশ্য হয়ে গেল। যতক্ষণ তাদের দেখা গেল, ততক্ষণ সহস্র তরবারি দিয়ে অভিবাদনের অন্তিম সঙ্কেতে তারা সম্মান জানিয়ে গেল রূমণ্বানকে।

****

ইতিহাস বলে, কোনো এক কালে ঘৃণ্য দাসপ্রথার পোষক শাক্যরা পরবর্তী সময়ে নিজেদের নবীন গণরাজ্যের ধ্বজাতলে ওই বর্বর দাস ব্যবস্থার কট্টর বিরোধী হয়ে উঠেছিল। গণপতি রূমণ্বানের নেতৃত্বে সুদূর পার্বত্য উপত্যকায় সূর্যের মতো ঝকমক করে উঠেছিল এই নবীন গণরাজ্য। অগ্নিসিদ্ধ কপিলাবস্তু। সেখানে আর কোনো মিথ্যা বংশাভিমান ছিল না, পদদলিত দাস ছিল না, দমনকারী কুলীন ছিল না। শোষক আর শোষিতের চক্র সেখানে স্তব্ধ হয়েছিল চিরকালের জন্য।

হার মেনেছিল ঘৃণা। জয় হয়েছিল প্রেমের। পাশবিক অন্ধকার দূর হয়ে মানবতার আলোয় হেসে উঠেছিল কপিলাবস্তুর মাটি। কুটিল, নীচ, স্বার্থপর দাসপ্রথার উপরে সর্বপ্রথম এবং সর্বাধিক শক্তিশালী আঘাত সেই শাক্যরাই করেছিল, যারা একসময়ে এর প্রবলতম পৃষ্ঠপোষক ছিল। সময়ের আঘাতে স্বার্থ আর দম্ভের আবরণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

কুলীন এবং দাস নিজেদের মধ্যে মিথ্যা ভেদাভেদ ভুলে এগিয়েছিল প্রগতির পথে। এসেছিল সেই যুগ, যেখানে মানুষ ছিল মানুষের জন্য।

সাম্রাজ্যবাদের ঝড় এল এবং গেল। কিন্তু দীপ নেভেনি। সে জ্বলেছে শান্ত, অনির্বাণ ভাবে। রূমন্বান ঠিকই বলেছিল। আজও বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কণ্ঠ থেকে গণতন্ত্রকে সমর্থন করে গগনভেদী স্বর বেরিয়ে এসে কাঁপিয়ে তোলে বাতাস। আশা করি, রূমণ্বানের আত্মা তা দেখে এবং তৃপ্ত হয়।

জনশ্রুতি চলে যে, কপিলাবস্তুর ভগ্ন নগরীতে আজও পূর্ণিমা রাতে এক ছায়ামূর্তিকে শাক্য গণরাজ্যের ধ্বজা হাতে ঘুরতে দেখা যায়। আর তখন বাতাস পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে গেয়ে ওঠে – দীপ জ্বেলে যাই।

*গণতন্ত্র দিবস – ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের পর্বে গণতন্ত্রের উল্লেখে পাঠক ভ্রু কোঁচকাতে পারেন, তাই সামান্য ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এ দেশের গণতান্ত্রিক শাসন কিন্তু বিদেশের শাসন ব্যবস্থার আদলে তৈরী হয়নি। সেদিক থেকে দেখলে বলা যায় ভারতবর্ষই এ বিশ্বকে গণতন্ত্রউপহার দিয়েছে। এই ভারতের বৈশালীতেই জন্ম হয়েছিল বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্রের। কপিলাবস্তুর শাসনও ছিল গনতান্ত্রিক। একজন গণপতি থাকতেন, যিনি অনেকটা রাজার মতোই ছিলেন। তবে রাজ্য পরিচালনার কাজে তাঁকে সাহায্য করতো গণপরিষদ।  তবে আজকের দিনের মতো নির্বাচন পদ্ধতি ছিল না সে সময়ে, বরং ২১ বছর বয়স হলেই রাজনীতির প্রাঙ্গনে প্রবেশ করতো প্রত্যেক যুবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *