সোলমেট

(নন্দিনী নাগ)

+অনুচ্ছেদ ১

সারাটা দিন ঘেরাও করে রেখেছিল ছাত্রছাত্রীরা। ঘেরাও উঠল রাত আটটায়, তারপর বাড়ি ফেরা। কলেজ থেকে বেরিয়ে, ফুটপাথ ধরে হাঁটা শুরু করেছিল সোহাগ। রোজ এই পথটুকু অটোতেই যায় সে, কখনো বা বাসে, কিন্তু আজ দশঘন্টা প্রায় একই জায়গায় বসে থেকে, হাতে পায়ের পেশীগুলোতে যেন মরচে ধরে গেছে। তাই একটু হাঁটার সিদ্ধান্ত নিল সে; হাঁটলে হাত পায়ের জড়তা কাটবে, মাথায় একটু অক্সিজেন ঢুকবে।
প্রায় দশমিনিট হাঁটার পর বড় রাস্তা ছেড়ে গলির মুখে ঢোকার সময়টাতেই বিপত্তি। হঠাৎ–ই একটু মাথাটা ঘুরে উঠল, চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে গেল…, জ্ঞান হারাল সে।
কতক্ষণ পর সেদিন জ্ঞান ফিরেছিল, সেই কথাটা পরে আর কখনোই জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি সাহিলকে। দু–মিনিট, তিন মিনিট, পাঁচ মিনিট…নাকি আরো বেশী, জানা হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি, সঠিক সময়টা বলা কারও পক্ষে সম্ভবই নয়, কারণ কে–ই বা ঘড়ি দেখতে গেছে তখন! আর ঐ সময়টুকু যে তার জীবনে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, সে–টা কে–ই বা জানত! সে নিজেই জানত না।
”উঠে বসতে পারবেন?”

একটা বেঞ্চে শায়িত অবস্থায়, চারপাশে ঘিরে থাকা কৌতুহলী মুখের মাঝে, নিজেকে যখন জ্ঞান ফেরার পর প্রথম আবিষ্কার করে সোহাগ, তখন এই প্রশ্নটাই প্রথম কানে এসেছিল তার। বেঞ্চের কোনটা ধরে, সে আস্তে আস্তে উঠে বসার চেষ্টা করতেই প্রশ্নকর্তা এগিয়ে এসে বাড়িয়ে দিয়েছিল হাত–

-‘আমার হাতটা ধরে, উঠুন আস্তে আস্তে‘।

তাই করে সোহাগ। সে উঠে বসার পর সেই ছেলেটিই, তার চারপাশে ভিড়টাকে সরিয়ে দেয়।

-‘তোরা সরে যা, ম্যাডামের হাওয়া লাগছে না‘।

টেবিল ফ্যানটাকে সোহাগের দিকে আরও একটু এগিয়ে দেয় সে। চারপাশের জমাট বাঁধা ভিড়টা সরতে, সোহাগ দেখতে পায় সে একটা ওষুধের দোকানের মধ্যে পাতা বেঞ্চে বসে। তবে সেটা যে কোন জায়গায় সেটা সে বুঝতে পারে না। ইতিমধ্যে ছেলেটি ছোট একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতলের সিল খুলে তার দিকে এগিয়ে দিয়েছে–

-‘একটু জল খান ম্যাডাম, ভালো লাগবে‘।

সোহাগের সত্যিই খুব জল পিপাসা পেয়েছিল। ছেলেটির কাছ থেকে বোতলটা নিয়ে একবারে পুরোটা শেষ করে ফেলে। জলটা খেয়ে সে বেশ সুস্থ বোধ করে। তাই ছেলেটিকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিয়ে সে বাড়ি ফেরার জন্য বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়ে, কিন্তু চটি জোড়া দেখতে পায় না। ছেলেটি কোথা থেকে যেন চটি দুটো এনে তার পায়ের কাছে দেয়–

–চলুন ম্যাডাম, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি”।

-”না না, আপনি কেন যাবেন! আমি ঠিক আছি, একটা রিক্সা ধরে নেব”।

-”স্ট্যান্ডে তো রিক্সা নেই! কখন আসবে ঠিক নেই! গরম পড়েছে না, ব্যাটারা আর ভাড়া খাটতে চায় না।‘

বাস্তবিকই স্ট্যান্ডে একটাও রিক্সা ছিল না। রিক্সার জন্য আর দাঁড়াতেও ভালো লাগছিল না সোহাগের, তার শরীরটা তখন বিছানা চাইছিল। হেঁটে ফেরার ইচ্ছাটাও মরে গেছিল একেবারে। তাকে ইতস্ততঃ করতে দেখে, ছেলেটি আবার বলে, –আমার বাইক আছে, চলুন পৌঁছে দিই কতক্ষণ দাঁড়াবেন রিক্সার জন্য!”

সোহাগ ভদ্রতা করে বলে, -”আমার জন্য আবার কষ্ট করবেন?”

-”কষ্টের কি আছে? বিপদে মানুষকে সাহায্য করা তো মানুষের কর্তব্য, তাই না?”

সোহাগ আর কথা বাড়াতে পারেনা। কারণ ছোট থেকে সে নিজেই একথা মেনে এসেছে যে বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো মানুষের কর্তব্য। কাজেই এই পরোপকারী ছেলেটিকে, তার কর্তব্য কর্ম থেকে কিভাবে সে বিরত করে। সুতরাং ছেলেটির বাইকে সওয়ার হয়ে যায় সে।

-”আপনি কি আমকে চেনেন? বাইক স্টার্ট দেবার পর প্রথম কথা বলে সোহাগ।”

-”চিনি বলতে, আপনি প্রতিদিন যাওয়া আসা করেন এখান দিয়ে, তখন দেখতে পাই, তাই মুখটা চেনা।”

-”আপনি ঐ দোকানটাতেই থাকেন?”

-”হ্যাঁ। ওষুধের দোকানটা আমাদের। আমি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ওখানেই থাকি।”

-”ও! আসলে,, আমি কখনো আপনাকে দেখিনি।”

–সেটাই তো স্বাভাবিক।

সোহাগের বাড়ি ইতিমধ্যে চলে এসেছিল। বাড়িতে ঢোকার সময় সে ছেলেটিকে অনুরোধ করে ভেতরে আসতে। কিন্তু সে রাজী হয়নি।

-‘আজ থাক্‌। অন্য কোনো দিন আসব। আপনি কাল একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন ম্যাডাম।”

সারাদিনের এত ধকলের পর সোহাগ বাড়িতে ঢুকে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে নেওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছিল না। শাওয়ারের তলায় নিজেকে মেলে ধরার পর যখন শরীরটা ঠান্ডা হল, মাথার ভেতর জমে থাকা ঝামেলা ঝঞ্ঝাটগুলো জলের সঙ্গে ধুয়ে বেরিয়ে গিয়ে, মাথাটাকে হালকা করে দিল, তখনই মনের মধ্যে বিদ্যুৎ ঝলকের মত উদয় হল ভাবনাটার–

-”আরে, এত উপকার করল যে ছেলেটি, তার নামটাই জিজ্ঞেস করা হল না!”

+অনুচ্ছেদ ২

”পাওলো কোয়েলহো পড়েছিস, অ্যালকেমিস্ট?” কলেজ ক্যান্টিনে বসে চা খেতে খেতে প্রশ্ন করেছিল ঈশানদা।
সদ্য গ্রাজুয়েশন করতে আসা সোহাগ তখনও পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের বাইরে ইংরাজীতে লেখা বই কিছুই পড়েনি। যদিও বাংলায় লেখা বই সে প্রচুরই পড়ে, পাঠ্যবইয়ের থেকে অনেক বেশীই পড়ে। বিষয়ের ব্যাপারেও কোনো খুঁতখুঁতানি নেই তার, যা পায়, তা–ই পড়ে ফেলে। কিন্তু ‘অ্যালকেমিস্ট‘ তার পড়া তো নয়–ই, এমনকি নাম ও শোনেনি সে। সেকথা সে নির্দ্বিধায় জানায় ঈশানদাকে।
-”পড়িস, ভীষণ ভালো লাগবে। আমার কাছে আছে, এনে দেব।”
ঈশানদা সোহাগদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র, এখন মাস্টার্স করছে, সেই সূত্রে দাদা। ওদের ডিপার্টমেন্টে সিনিয়র জুনিয়রদের সকলের সঙ্গেই সকলের ভালো সম্পর্ক, সবাই মিলে যেন একটা পরিবার। এই ব্যাপারটা সোহাগের খুব ভালোলাগে। সবাই সবাইকে সাহায্যও করে প্রচুর, সে পড়াশোনা হোক বা অন্য যে কোনো ব্যাপারে। সদ্য পরিবার ছেড়ে হোস্টেলে থাকতে আসা সোহাগের কাছে এটা একটা উপরি পাওনা। এই ঈশানদার সঙ্গে সোহাগের এখন কত ভালো সম্পর্ক। অথচ প্রথমদিন ক্লাশে আসার পরে, ডিপার্টমেন্টের সিনিয়ররা যখন জুনিয়রদের সঙ্গে পরিচয় করার নামে ছোটমোটো একটা ‘র‍্যাগিং’ গোছের ব্যাপার করতে আসে, তখন এই ঈশান–ই সবচেয়ে বেশী ওকে ঘাঁটিয়েছিল, যাকে ওদের কলেজের কথ্য ভাষায় বলে চেটেছিল! খুব রাগ হয়েছিল সেদিন সোহাগের, ঈশানদার ওপর। প্রশ্নের পর প্রশ্ন তো ছিলই, তার ওপর আবার বলে কি–না,

”সাইন কার্ভ অনুযায়ী হেসে দেখা”।

সোহাগ এমনিতেই যথেষ্টই স্মার্ট, কিছুতে–ই ঘাবড়ে যায় না, কিন্তু ‘সাইন কার্ভ‘ অনুযায়ী কিভাবে হাসা যায়, সেটা তখুনি তার মাথায় আসছিল না।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে ঈশান আবার বলে, -‘কিরে ফিজিকস পড়তে এসেছিস, আর সাইনকার্ভ বুঝিস না? তাহলে পড়বি কি করে ফিজিকস?”

সাবজেক্ট তুলে কথা বলায় সোহাগ খুব অপমানিত বোধ করে। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়-‘বুঝি বলেই তো চিন্তা করছি, সাইন কার্ভের নেগেটিভ হাফ সাইকেলগুলোকে নিয়ে কি করব?”

-‘এতো সিম্পল! হাসি উল্টে গেলে যা হয় তাই করবি।‘ ঈশান বলে।

অগত্যা তা–ই করে সোহাগ। সাইন কার্ভের প্রথম হাফ সাইকেলে, সে একটু একটু করে হাসির জোর বাড়াতে বাড়াতে অট্টহাস্য করে, তারপর হাসির জোর কমাতে কমাতে একেবারে থেমে যায়। এবার বিপরীত দিক অর্থাৎ নেগেটিভ হাফ সাইকেলের পালা। হাসির বিপরীত যখন কান্না, তখন আর কি করা! সোহাগ একটু একটু করে কান্নার জোর বাড়াতে বাড়াতে একেবারে গলা ছেড়ে কাঁদে; তারপর কান্না কমাতে কমাতে একদম চুপ করে।

ঘর ভর্তি যত জন সিনিয়র দাদা দিদিরা ছিল, প্রত্যেকে হাত তালি দিয়ে ওঠে। সবার হাততালি থামলে শোনা যায় ঈশানের গলা–যে গলায় ছিল প্রশংসার সুর–

-”একসেলেন্ট! আমি ভাবিনি, এটা তুই করতে পারবি। ওর চোখে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল সোহাগের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব।

সোহাগের কিন্তু সেদিন ঈশানের প্রতি কোনো ভালো মনোভাব তৈরী হয়নি, বরং মনে মনে ও ভেবেছিল।

-”নিজেকে বিশাল কিছু মনে করে ছেলেটা! আর বাকী সবাইকে বুদ্ধু ভাবে।”

পরে যখন ডিপার্টমেন্টের পিকনিকে ভালো করে পরিচয় হল ঈশানের সঙ্গে, তখন সোহাগ বুঝল ঈশান মানুষটা আসলে খুবই ভালো। বিভিন্ন বিষয়ে ও ওর প্রচুর পড়াশোনা, আর নিজের ভালোলাগার বিষয়গুলোতে ঈশানদার গভীরতা খুব বেশী। সবথেকে ভালো ব্যাপার যেটা, সেটা হল, ছেলেটা খুবই সাহায্য প্রবণ। পড়াশোনাতে ভালো বলে, কোনো অহঙ্কার নেই, সবার সঙ্গেই সহজভাবে মেশে।

সোহাগের বাবা–মা দুজনেই সক্রিয়ভাবে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সোহাগের বাবা জেলও খেটেছেন। এমন পরিবারে বড় হবার সুবাদে, সোহাগের রাজনৈতিক সচেতনতা আর পাঠ্যবইয়ের বাইরের পড়াশোনাও অনেক বেশী। আর সেইজন্যই, তার সমবয়সীদের বেশীর ভাগের তুলনায় তার জীবনবোধ, চিন্তাভাবনার পথও আলাদা। সোহাগের কাছে কলেজে পা দেওয়া তাই শুধুমাত্র পড়াশোনা–ই নয়, নিজেকে সমস্ত দিক থেকে পূর্ণাঙ্গ ভাবে তৈরী করা; যে স্বপ্ন তাকে ছোটবেলা থেকে মা বাবা দেখতে শিখিয়েছেন, তার কাছাকাছি পৌঁছনোর রাস্তা তৈরী করা। সুতরাং কলেজে যে সোহাগ সক্রিয় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক আর প্রতীক্ষিত।

ইউনিভার্সিটির ইউনিয়ন রুমে প্রথম দিন সে যখন গেল, পূর্ব পরিচিত তার কেউই ছিল না, এক ঈশানদা ছাড়া। ইউনিয়ন রুমে প্রথম দিন সে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যায়, আর নিজের পরিচয় দেয়। রাজনীতিতে বিশেষ পরিচিত তার বাবা মায়ের নাম উল্লেখ করে। বাবা মায়ের নাম বলার সঙ্গে সঙ্গেই সে লক্ষ্য করে সকলের মুখেই একটা সমীহের ছাপ, কেই কেউ বাবা মায়ের কুশল সংবাদও নেয়। ফলতঃ তার মনে এক প্রছন্ন গর্ববোধ কাজ করে যে, বয়সে সে উপস্থিত সবার চেয়ে ছোট হলেও, তার হোমওয়ার্ক সবার চেয়ে বেশী আর তাই জ্ঞানের পরিধিও সবার চাইতে বেশী, কাজেই দেখা গেল, কিছুক্ষণ পরে ইউনিয়নরুমে সে–ই হয়ে উঠেছে বক্তা, আর বাকী সবাই শ্রোতা।

এই ব্যাপারটা নিয়ে পরে অনেক হাসাহাসি করেছে ঈশান-”এতটুকু পুঁচকে মেয়ে! এমন ভাবে কথা বলছিলি সেদিন, মনে হচ্ছিল আমাদের সবার মাষ্টারনি।

-”তুমি তো থামাতে পারতে।”

-”ভালো লাগছিল শুনতে! আমাদের ভবিষ্যৎ জননেত্রীকে দেখতে পাচ্ছিলাম তো!”

একসঙ্গে ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে ঈশানকে আরো কাছ থেকে জানতে পারছিল সোহাগ। বুঝতে পারছিল, তার মতো পারিবারিক উত্তরাধিকার না থাকা সত্ত্বেও, ঈশানের রাজনৈতিক জ্ঞান কত গভীর, ধারণা কত স্বচ্ছ! পড়াশোনার ক্ষেত্রেও ঈশান তাকে সাহায্য করছিল। ঈশানের সাহায্য না থাকলে, ফিজিক্সের মত একটা সাবজেক্টকে সামলানো তার পক্ষে বেশ কঠিনই হত; বিশেষত সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে মাঝে মাঝেই তার দুটো একটা করে ক্লাশ মিস্‌ হয়ে যাচ্ছিল যেখানে। অনেক সময় আবার এমনও হয়েছে, ক্লাশে উপস্থিত থেকে সে লেকচার ফলো করতে পারেনি, কারণ ঐ স্যার বা ম্যাডামের আগের দিনের ক্লাশটা তার করা হয়নি। ফলে বেশ কিছু কিছু টপিক না বোঝা থেকে যাচ্ছিল তার, যেগুলো পরে নিজে নিজে পড়েও কিছু বুঝতে পারছিল না সে, ফলতঃ সেগুলো জমেই যাচ্ছিল, আর তার মনের ওপর চাপ বাড়াচ্ছিল। দু একবার সে ভেবেছিল ঈশানদাকে বলবে কথাটা, কিন্তু আবার ভেবেছে, ঈশানদারও নিজের পড়ার চাপ রয়েছে, তার ওপর সে–ও তো সোহাগের মত রাজনোতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে, কিভাবে সে–ই বা সময় পাবে! তাই আর বলেনি। সময় করে বন্ধুদের কাছ থেকেই বুঝে নেবে বলে ঠিক করে রেখেছিল।

একদিন একটা পথসভা সেরে হোস্টেলে ফেরার পথে, ঈশান নিজে থেকেই পাড়ে কথাটা–

-”পরীক্ষা তো এসে গেল। পড়াশোনাটা করছিস তো ঠিক করে? রেজাল্টটা কিন্তু ভালো রাখতে হবে!”

ঈশান বলতেই পারে একথা। কারণ সবকিছু চালিয়ে ও সে গ্রাজুয়েশন ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্ট।

-”কয়েকটা ব্যাপারে একটু সমস্যা হচ্ছে। ক্লাশ করতে পারিনি তো, এখন বুঝতে পারছি না।”

-”বলবি তো আগে! সকালের দিকে চলে আসবি আমার হোস্টেলে, বুঝিয়ে দেবো।”

তাই করে সোহাগ। পর পর কয়েকদিন সকালে ঈশানের হোস্টেলে যায়। ওর কাছে এক ঘন্টা করে বসলেই ওর দশঘন্টার প্রস্তুতি হয়ে যায়। আর এত সুন্দর করে বোঝায় ঈশান যে সোহাগ বলেই ফেলল একদিন–

-”আচ্ছা ঈশানদা, বল তো, স্যাররা কি ইচ্ছা করেই কঠিন করে ক্লাশে পড়ান?”

-”মানে?”

-”মানে, এই টপিকটা, যেটা তুমি এখন বোঝালে, সেটা ক্লাশে যেদিন স্যার পড়িয়েছিলেন, আমি কিছুই বুঝতে পারিনি, ফলে আমি হীনমন্যতায় ভুগছিলাম, এত কম বুদ্ধি নিয়ে আমার ফিজিক্স পড়তে আসা উচিৎ হয়নি। কিন্তু দেখ, এখন তো দিব্যি বুঝলাম।”

-”কয়েকজন আছেন ঠিকই, যাঁরা ছাত্রছাত্রীদের বোঝানোর চেয়ে, নিজেদের পান্ডিত্য জাহির করতেই বেশী আগ্রহী।”

-”তবে তো এঁরাও আমাদের শ্রেণী শত্রু” বলে সোহাগ।

খুব একচোট হাসে দুজনে।

+অনুচ্ছেদ ৩

ডিপার্টমেন্টের পেছনদিকের মাঠে গোল হয়ে বসে গল্প করছিল ওরা কজন, তোর্সা, রিম্বিক, ঋষি, আয়েশা আর সোহাগ। ওদের গ্রুপের প্র্যাকটিকাল ক্লাশটা আজ অফ্‌ যাচ্ছে, কারণ ম্যাম একটা সেমিনারের জন্য কলকাতার বাইরে। অফ্‌ পিরিয়ড টা ক্যান্টিনে না বসে মাঠেই বসেছিল ওরা আড্ডা দেবার জন্য কারণ ডিসেম্বরের রোদটা বেশ আরামদায়ক লাগছিল।
-”তুই যে গণতন্ত্র, মুক্তি, সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন এইসব নিয়ে দিনরাত গলা ফাটিয়ে যাচ্ছিস, প্রকৃত মুক্তি কি কখনও আসবে বলে তোর মনে হয়?” ঋষি প্রশ্ন করে সোহাগকে।
সোহাগ কিছু বলার আগেই তোর্সা চেঁচায়,
-”ওয়ান মিনিট, ওয়ান মিনিট, আই হ্যাভ ওয়ান কোয়েশ্চন বিফোর দ্যট, প্রকৃত মুক্তি বলতে তুই কী মীন করছিস ঋষি?”

এবারেও সোহাগের মুখ খোলার আগেই রিম্বিক বলে

-”আমি পার্সোনালি মুক্তি বলতে কি বুঝি, সেটা বলি?”

”হ্যাঁ হ্যাঁ বল। যেখানটা ঠিক হবে না, সোহাগ কারেকশন করবে” আয়েশা বলল।

-”তা কেন? প্রত্যেকের কাছে মুক্তির ডেফিনেশন আলাদা হতেই পারে। রিম্বিকেরটা রিম্বিক বলবে, সোহাগের টা সোহাগ”।

ঋষির প্রস্তাবে সহমত হয় সকলে। রিম্বিক বলতে শুরু করে, দ্যাখ, তোরা যে শ্রেণীশত্রু, বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থা, শোষণ থেকে মুক্তির গল্প শোনাস, ফ্র্যাঙ্কলি স্পীকিং ওসব কথা আমার মগজে কোনো ইমপ্যাক্ট ফেলে না। আমি মুক্তি বলতে বুঝি, চিন্তার মুক্তি, চেতনার মুক্তি, সবচাইতে বেশী যে–টা বুঝি, সেটা হল প্রতিটা মানুষের, তার নিজের মত করে বাঁচবার স্বাধীনতা।

-”যেমন? উদাহরণ দে। জানিস–ই তো আমি লেটে বোঝা পাবলিক।” আয়েশা বলল।

-”যেমন? যেমন ধর, তোকে বোরখা পড়তে হয়না ঠিকই, কিংবা ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশায়ও তোদের বাড়িতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের ইউনিভার্সিটিতেই কত মেয়ে আছে, যাদের এসব মধ্যযুগীয় প্রথা মেনে চলতে হয়। এগুলো তাদের ধর্মীয় প্রধানদের চিন্তার দৈন্যতা ছাড়া কি বল? অর্থাৎ কি–না চিন্তা, চেতনায় মুক্তির অভাব।” সকলেই সহমত হয় রিম্বিকের সঙ্গে।

আয়েশা বলে,-”তুই ঠিকই বলেছিস রিম্বিক। বাড়িতেও আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করি। তবুতো দ্যাখ ভারতে আমরা অনেক ভালো আছি। আরব কান্ট্রিগুলোতে মুসলিম মেয়েরা তো মধ্যযুগেও নয়, পুরনো প্রস্তর যুগে পড়ে আছে।”

-”আরব পর্যন্ত যেতে হবে কেন? বাড়ির কাছে আফগানিস্থান কে ভুলে গেলি নাকি?” তোর্সা সংযোজন করে।

-”তারপর দ্যাখ, দুজন বন্ধু ফেসবুকে কি শেয়ার করল, কি পোস্ট করল, তার জন্য তাদের গ্রেপ্তার করা হবে? যে কারোর স্বাধীনভাবে চিন্তা করার অধিকার থাকবে না, এগুলি কি হচ্ছে? মামার বাড়ি নাকি? একুশে আইন?” রিম্বিকের গলা ক্রমশঃ চড়তে থাকে।

-”কুল ডাউন রিম্বিক” ঋষি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে রিম্বিককে ‘অত উত্তেজিত হোসনা, তোকে আবার রাষ্ট্রদ্রোহী বলে অ্যারেস্ট করে নিতে পারে। চারদিকে যা হচ্ছে, কিছুই বলা যায় না।”

-”করুক শালা অ্যারেস্ট! এসব ভাবলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। আমরা সবাই স্বাধীন মানুষ। আমি কি কথা বলব, কি চিন্তা করব, তার ওপর অন্য কেউ কেন খবরদারী করবে বল তো?”

রিম্বিকের উত্তেজনা কমার কোনো লক্ষণ না দেখে, ঋষি অন্য দিকে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে।

-”আচ্ছা, সোহাগ কিন্তু মুখ খোলেনি এখনও! ও কোন মুক্তির স্বপ্ন দেখে জানতে হবে না?”

-”রিম্বিকের সঙ্গে আমি একমত।” সোহাগ মুখ খোলে এবার। ‘তারসঙ্গে আমি আরও কিছু চাই। যেম্ন ধর, জেন্ডার বায়াসনেস থেকে মুক্তি, তারপর”…

-”দাঁড়া, দাঁড়া, তোর্সা মাঝপথে থামায় সোহাগকে, তারমানে ঐ যে মেয়েগুলো হাফ প্যান্ট পড়ে ক্যাম্পাসে এসেছে এটাকে তুই সমর্থন করছিস?”

-”হাফপ্যান্ট পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা কারো ক্ষেত্রেই কি সমর্থন যোগ্য? ছেলে বা মেয়ে, উভয়ের ক্ষেত্রেই দৃষ্টিকটু।

-”কিন্তু এটা নিয়ে কিছু বলা মানে তো ওদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে?” আয়েশা বলে।

-”কেউ বলতে যাবে–ই বা কেন? অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোর এক্তিয়ার আমাদের কে দিয়েছে? এছাড়া এটা যার যার রুচির প্রশ্ন। দুনিয়ার সবার রুচি কি একরকমের হয়?

সোহাগের কথায় সম্মতি দেয় তোর্সা। ও বলে,

-”ঠিকই বলেছিস। আমাদের স্বভাবটা ভীষণ খারাপ। নিজেদের দিকে না তাকিয়ে, সারাক্ষণ, অন্যদের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি।

-”তারপর আরও দেখ, ঋতুপর্ণ ঘোষকে একসময় মাথায় তুলে নাচত যারা, যে–ই সেক্স চেঞ্জ করতে চাইল, ছিছিক্কারের বন্যা বইয়ে দিল। আরে বাবা! শরীরটা তার, সেটা নিয়ে সে কি করবে, সেটাও ও অন্য লোক ঠিক করে দেবে?” রিম্বিক আবার উত্তেজিত হয়ে পড়ে।

-”বটেই তো। আমি কাকে ভালোবাসব, সেটা সম্পূর্ণই আমার ব্যাপার। সে একই লিঙ্গের হবে না কি বিপরীত লিঙ্গের তাতে শালা কার বাপের কি?” এবারে ঋষির গলা চড়ে।

-”ঠিকই বলেছিস, আমি মনে প্রাণে এই মুক্তিই চাই। এগুলোই চিন্তা, চেতনার মুক্তি। তারপর দেখ, আমরা তো বন্ধু, বন্ধুর কোনো জেন্ডার হওয়াই উচিৎ নয়। তাই আলাদা করে ছেলেদের কথা, মেয়েদের কথা এসব থাকা উচিৎ না। তোদের যদি খিস্তি মারতে ইছা করে, আমাদের সামনেই করবি, এটাই আমি চাই। আর আমার যদি প্যাড বদলানোর প্রয়োজন হয়, তবে আমিও যেন তোদের সেটা নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি। এই রকমের মুক্তির স্বপ্নই আমি দেখি। আমার বাবা মা যে যুক্তির স্বপ্ন নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তারপর অনেক বদলে গেছে দিন, মানুষ। তাই এখন আমার মনে হয়, সমাজ বদলানোর চেষ্টা করার আগে, মানুষের মনোভাব বদলানোর চেষ্টাটাই করা উচিৎ।

+অনুচ্ছেদ ৪

”ওই সোহাগ মেয়েটার সঙ্গে তোমার এত মাখামাখি কিসের?” দেখা হতেই পর্ণা ঝাপিয়ে পড়ে ঈশানের ওপর।
-”মাখামাখি আবার কি দেখলে? পার্টির কার্যে একসাথে ঘুরতে, বসতে তো হবেই।”
-”শুধু পার্টির কাজ? আরও তো মেয়ে আছে তোমাদের দলে, তাদের সঙ্গে ঘোরা নিয়ে আমি কিছু বলেছি কখনও? এক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি দেখছি, তাই বলছি।”
-”কি বাড়াবাড়িটা দেখেছ শুনি?”

-”ও তোমার হোস্টেলেও যায়, এ খবর আমি রাখিনা ভেবেছ?” রাগে পর্ণার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠেছিল।

-”হোস্টেলে যেতে আমিই বলেছিলাম।” ঈশান ও গম্ভীর হয়ে যায়।

-”তুমি তো জান, পড়ার ব্যাপারে জুনিয়ারদের আমি সবসময়ই সাহায্য করি, ওকেও তাই করেছি, এতে তোমার অসুবিধাটা কোথায়, সেটা তো বুঝলাম না।”

-”তুমি তো কিছুই বুঝবে না। আর ঐ মেয়ের এত পার্টি–পার্টি করে দৌড়নোর–ই বা কি আছে, বুঝিনা বাবা, মা পড়তে পাঠিয়েছে, এটাই করনা মন দিয়ে।” পর্ণার সোহাগের প্রতি আক্রোশ যায় না।

-”সবাই কি আর তোমার মত হয়। কেউ কেউ আছে, যারা নিজের আগে অন্যের কথা ভাবে। আর তারা আছে বলেই দুনিয়াটা এখনো চলছে, থমকে যায়নি।”

ঈশানের এই কথায় আগুনে যেন ঘি ঢালা হল।

-”ও! তারমানে তুমি বলতে চাইছ, আমি স্বার্থপর, আত্মসুখী! আর যত বিশ্বপ্রেমী তোমার ঐ সোহাগ, বেশ তো! তুমি যখন তোমার উপযুক্ত পার্টনার পেয়েই গেছ, আমাকে আর তোমার কিসের দরকার! থাকো তুমি তোমার সোহাগকে নিয়ে!” পর্ণা উঠে পড়ে চেয়ার ছেড়ে, রাগে মুখটা তার থম্‌থম্‌ করছিল।

-”সিন ক্রিয়েট কোরো না পর্ণা। সবাই দেখছে। বসে পড়ো”।

দাঁতে দাঁত চেপে বলে ইশান। কিন্তু পর্ণা আর দাঁড়ায় না, ঈশানের অনুরোধ কানেও তোলে না, রাগে গজ গজ করতে করতে ক্যান্টিন ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ক্যান্টিনে সেই সময় যারা ছিল, তারা প্রত্যেকে ঈশানকে চেনে বলে, সে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করতে থাকে। সে চুপচাপ মাথা নীচু করে বসে থাকে, অসম্মানটা হজম করার জন্য প্রয়োজনীয় সময়টুকু পাওয়ার জন্য। তার হাতে ধরা সিগারেট জ্বলে যাচ্ছিল, আর ছাইগুলো উড়ে এসে পড়েছিল সামনে রাখা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের গ্লাসে। পাশের টেবিলে ছিল ঈশানের বন্ধু অভিষেক, যে পর্ণার চেঁচামেচি শুনে এদিকে তাকিয়েছিল আর ব্যাপারটা দেখতে না চাইলেও দেখেছিল, শুনেছিল। ঈশানকে অমনভাবে বলে থাকতে দেখে অভি এসে বসে ওর পাশে।

তোকে বারণ করেছিলাম ঈশান, বড় লোকের একমাত্র মেয়ে, প্যামপারড চাইল্ড, তার ওপর আবার সুন্দরী, ওদিকে পা বাড়াস্‌ না।”

ঈশান বলে না কিছু। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে।

-”ওদের সঙ্গে আমাদের স্টেটাস, ক্লাশ কিছু মেলে না রে। একেবারে যাকে বলে সিক্স ইলেকট্রন ভোল্ট এনার্জি গ্যাপ। এই গ্যাপ কোনোদিনই পার করা যাবে না।”

ঈশান এবারেও কিছু বলে না। শুধু বাইরে থেকে দৃষ্টিটাকে ফিরিয়ে এনে অভির মুখের ওপর ফেলে। অভি, ঈশানের হাতে হাত রেখে আলতো করে চাপ দেয়, আর বলে

-”চলে ক্লাশে চল, এসব কথা মন থেকে ঝেড়ে ফ্যাল” ঈশান ওঠে। অভির সঙ্গে ক্লাশে যাবার জন্য পা বাড়ায় দরজা দিয়ে বার হবার মুখে হঠাৎ–ই সামনে হুড়মুড় করে সদলবলে এসে পড়ে সোহাগ। এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ সামনে সোহাগকে দেখে কেমন যেন আনস্মার্ট হয়ে যায় ঈশান। হয়ত বা একটা হার্টবিট ও মিস হয়ে যায় তার। সোহাগ তার বন্ধুদের থেকে একটু আড়াল করে ঈশানকে জিজ্ঞাসা করে,

– ”পর্ণাদিকে দেখলাম ভীষণ গম্ভীরভাবে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যেতে। আমি হাসলাম, বোধহয় দেখতেই পেলনা, কিছু হয়েছে?”

ঈশান আরো নার্ভাস হয়ে পরে, কি জবাব দেবে এই মেয়েকে ”তোকে নিয়েই তো যত ঝামেলা”, একথা তো আর বলা যায় না! আবার হঠাৎ করে বানিয়ে মিথ্যা কথা ও বলতে পারেনা সে। ঈশানকে থতমত খেতে দেখে, পরিত্রাতার ভূমিকায় এগিয়ে আসে অভি, -”দাম্পত্য কলহ বুঝলি? বুঝলি না তো! আগে একটা প্রেম কর, তারপর বুঝবি!”

-”ও, তাই বল! আমি ভাবলাম বুঝি সিরিয়াস কিছু! তাই জিজ্ঞেস করলাম।” সোহাগ হেসে ফেলে।

-”চিন্তা কোরো না ঈশান দা, ঠিক হয়ে যাবে, বরং প্রেম আরো বাড়বে, তাই না অভিদা,” সোহাগ হাসতে হাসতে পা বাড়ায় ওর বন্ধুদের টেবিলের দিকে।

অভির সঙ্গে ক্লাশরুমের দিকে পা বাড়ায় ঈশান। অভি বক্‌বক্‌ করে চলেছিল সকালে করা প্র্যাকটিকালটার ডেটাগুলোতে কি সমস্ত আবোল তাবোল গ্রাফ আসছে, সেই সব নিয়ে। যাতে ঈশানের মন পর্ণার দিক থেকে সরে আসে। কারণ অভি ভালো করেই জানে, কোনোভাবে একবার ঈশানের মন পড়াশোনায় ঢুকে গেলে, দুনিয়ার কোনোকিছুই আর ওর মাথায় ঢুকবেনা। কিন্তু অভির চেষ্টা সবটাই বৃথা যাচ্ছিল, কারণ ঈশানের কানে অভির কোনো কথাই ঢুকছিল না তখন। পর্ণার কথা, পর্ণার ব্যবহারে এতক্ষণ যে ওর মনটা তেতো হয়ে গেছিল, সেই কথা, সবই ঈশানের মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিল সেই সময়ে। ওর মাথায় তখন ঘুরছিল বহুবার শোনা ওর খুব পছন্দের একটা গজলের কয়েকটা লাইন…

”ইয়ে দুনিয়াভর কি ঝগড়ে, ঘর কি রিস্তে, কাম কি বাঁতে,

ভালা দিলসে নিকাল্‌ যায়ে, অগর তুম মিলনে আ যাও।

তমন্না ফির মচ্‌ল যায়ে, অগর তুম মিলনে আ আ যাও”

অভিকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ–ই গুণ গুণ করে গেয়ে ওঠে ঈশান, ”তমন্না ফির মচল যায়ে অগর তুম মিলনে আ যাও” এই পরিস্থিতিতে ঈশানকে গান গাইতে দেখে, অভি তো হাঁ। অভির হাঁ করা মুখকে, আরো বড় হাঁ করিয়ে দিয়ে ঈশান এবারে গুনগুন করা বন্ধ করে বলে,-তুই ক্লাশে যা অভি, আমি হোস্টেলে ফিরছি, একটু ঘুমবো।”

অভি ক্লাশে যেতে যেতে ভাবে,-”ট্যালেন্টেড লোকেরা চিরকালই খ্যাপাটে হয়।

আর ঈশান সোহাগের কথা ভাবতে ভাবতে হোস্টেলে ফেরে। পর্ণার সঙ্গে খিটিমিটি হওয়াতে তার মন যে তেতো হয়ে গেছিল, সোহাগকে দেখা মাত্রই সেটা যেন কোথায় মিলিয়ে গেল! সোহাগের উপস্থিতিতেই যেন একটা শান্তির প্রলেপ ছড়িয়ে দেয়, সব কিছুকে ভালোবাসাতে ভাবিয়ে দেয়। ওর সাথে দেখা হলে, কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলে, হোস্টেলে ফিরে পড়াশোনাতে যেন একস্ট্রা এনার্জি আসে। কি যেন একটা জাদু আছে মেয়েটার মধ্যে, মনে হয় তার।

হোস্টেলে ফিরে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে ঈশান, সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, পর্ণা একদম তা–ই। উচ্চতা ফিগার গায়ের রং, মুখের গড়ন, সবই সুন্দর, উপরন্তু, ওর মুখের আদুরে আদুরে একটা ভাব আছে, যেটা ওকে আরো বেশী আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ফার্স্ট ইয়ারে যখন ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে এসে পর্ণা ভর্তি হল, গোটা ক্যাম্পাসে ওকে নিয়ে আলোড়ন পড়ে গেছিল। সেই মেয়ে যখন নিজে থেকে এসে ঈশানকে প্রপোজ করল, ঈশান মোহগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। ওর কাছের বন্ধুরা বারণ করেছিল, কিন্তু ঈশান না বলতে পারেনি। হয়ত বা একটা প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ কাজ করেছিল ওর এর পেছনে; সবাই যাকে চাইছে, সে স্বেচ্ছায় আমাকে ধরা দিয়েছে, এটা সবাইকে দেখানোর লোভ ছাড়তে পারেনি বোধহয়।

যদি সোহাগের সঙ্গে পর্ণার রূপের তুলনা করা যায়, তবে পর্ণার কাছে সোহাগ কিছুই না। ওর ঝক্‌ঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা ওকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছে, এই পর্যন্তই। সাজগোজের ধারপাশ দিয়েও যায়না সোহাগ, ওর পোশাক হাবভাব চলাফেরা সব কিছুতেই মেয়ে–মেয়ে গন্ধটা একটু কমই। কিন্তু ঈশানের মনে হয়, সব চেয়ে সাংঘাতিক ব্যাপারটা রয়েছে ওর দু চোখে। ঐ দু চোখে কি যেন এক বার্তা আছে, ঈশান তার পাঠোদ্ধার করতে পারেনি। ঐ চোখদুটো চুম্বকের মত টানে ঈশানকে; মনে হয়, অনেক অনেক বছর ধরে সোহাগ তার ভীষণ–ই চেনা। অনেক বছর আগে, সোহাগ তার কাছের মানুষ ছিল, খুবই কাছের।

এ জন্মে নয়, পূর্বজন্ম কিংবা তারও আগে সে সোহাগকে ভালো বাসতো, পরস্পরকে তারা চাইত ভীষণ ভাবেই কিন্তু পাওয়া হয়নি তাই সেই অতৃপ্তি এখনো টানছে তাকে সোহাগের দিকে।

চিরকালের নাস্তিক ঈশানের এইসব কথা ভেবে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে জন্মান্তর, সোহাগের চোখে তাকিয়ে ফিরে পেতে ইচ্ছা করে পূর্ব জন্মের স্মৃতি। ”খ্রীষ্টের জন্ম কিংবা তারও আগে থেকে, আমরা দুজন হাত ধরে পাশাপাশি হেঁটেছি অনেক, অনেক দিন, সোহাগ, তুই কি বুঝিস, আমরা দুজন একে অন্যের সোলমেট।” সোহাগের দু চোখে ডুব দিয়ে মনে মনে একথা বলেছে ঈশান অনেকদিনই, কিন্তু মুখে বলা হয়নি কোনোদিনই, আর হবেও না হয়ত।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিল ঈশান। ঘুম ভাঙ্‌লো অভির ধাক্কাধাক্কিতে,

-”ঈশান, শিগগিরি ওঠ্‌, পর্ণার মা ডাকছে তোকে।”

-”পর্ণার মা? কাঁচা ঘুম থেকে উঠে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ঈশান।”

-”হ্যাঁ, তোর শাশুড়ি তোকে ডাকছেন। বাইরে গিয়ে দেখ্‌। হোস্টেলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।‘

ঈশান ওঠে। এ সময়ে পর্ণার মায়ের সঙ্গে মোটেও দেখা করতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু কিছুতো করার নেই; অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাশে খুলে রাখা টি–শার্টটা কোনো রকমে গায়ে গলিয়ে বাইরে বেরোয়।

পর্ণার মাকে কোনোদিন দেখেনি ঈশান। কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা দামী গাড়ি, আর গাড়ির মধ্যে একজন সুবেশা মধ্যবয়স্ক মহিলাকে বসে থাকতে দেখে, বুঝতে অসুবিধা হয়না উনিই পর্ণার মা। তাই সে সরাসরি গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ঈশানকে আসতে দেখে ভদ্রমহিলা গাড়ি থেকে নেমে এলেন।

-”আমি পর্ণার মা, তুমি ঈশান তো?”

-”হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কেন এসেছেন, এখানে…কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”

-”দেখো, তুমি আমার ছেলের মত, সেইজন্যই এলাম। আমি মোমের কাছে তোমার কথা শুনছি। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে।”

কথার গতি কোনদিকে এগোবে বুঝতে না পেরে ঈশান চুপ করে থাকে। ভদ্রমহিলা একটু থেমে আবার শুরু করেন, এবার একটু নিচু গলায় সম্ভবত ড্রাইভারের কান বাঁচানোর জন্য।

-”আজ ও বাড়ি ফিরে সেই যে ঘরে ঢুকে শুয়েছে দুপুরে, উঠছে না। খায়নি, কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর ও দিচ্ছে না। ওর বাবা ও নেই শহরে, আমি খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম জানো! তাই তোমার কাছে এলাম, তুমি একটু আমার সাথে যাবে?”

-”আপনাদের বাড়ি?” ঈশান প্রস্তাব শুনে হোঁচট খায়।

-”কেন? অসুবিধে আছে? গেলে খুব ভালো হত।”

পর্ণার মায়ের চিন্তিত মুখ দেখে ঈশান কথা বাড়ায় না তার, চুপচাপ উঠে বসে গাড়িতে। ওদের বাড়ি যাবার সারাটা পথ ভদ্রমহিলা একনাগাড়ে বকবক করে চললেন, সবটাই তাঁর আদরের মেয়ের নানান কথা; ঈশানের কানে দু একটা শব্দ ছাড়া কিছুই ঢুকছিল না। ভদ্রমহিলার উৎসাহে তবু কোনোরকম ঘাটতি হচ্ছিল না, বোঝাই যাচ্ছিল, মোমের কথা উঠলে, তার মুখ বন্ধ করানোই মুশকিল।

ঈশানের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল, দম যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। অবশেষে এল পর্ণাদের বাড়ি। পর্ণার মা ঈশানকে সঙ্গে করে পর্ণার ঘরে নিয়ে এলেন।

-”দেখ মোম, কাকে নিয়ে এসেছি।”

ভদ্রমহিলার মুখে এভারেস্ট জয়ের হাসি। ভাবটা এমন যে, তুই চাইলে, চাঁদও পেড়ে এনে দিতে পারি তোকে! এই ঈশান তো ছেলেমানুষ, ওর বাপকেও এনে হাজির করতে পারি তোর সামনে!

-”তোমরা কথা বল, আমি আসছি, অনেক কাজ আছে।”

মায়ের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ঈশান পড়ল মেয়ের হাতে। পর্ণার রাগ দেখতে হল প্রথমে, তারপর অভিমান, তারপর অভিযোগ শুনতে হল, সমস্ত উপখ্যানটা যাথারীতি শেষ হল কান্নায়। সেটাও সামলাতে হল ঈশানকে। সমস্ত অধ্যায়টাই ঈশান শেষ করে এরকম যান্ত্রিক ভাবেই। যেন যা যা ঘটনা ঘটছে, তার মধ্যে কোনোখানেই সে নেই আছে ঈশান নামধারী একটা শরীর, যে শরীরের ভেতর সবকিছুই আছে, শুধু মনটা–ই কোন ফাঁক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সামাজিক ও মানবিক কর্তব্যকর্ম তাকে দিয়ে যা যা করাচ্ছে, ঈশান নামধারী মানুষটি রোবটের মত নিঁখুত যান্ত্রিকতায় সব কিছু করে চলেছে নিঃশব্দে।

এই মানভঞ্জনের পালার শেষে, দেখা গেল পর্ণার চোখে মুখে বিজয়ীর হাসি, কারণ ঈশানকে যেহেতু তার বাড়ি বয়ে এসে রাগ ভাঙাতে হয়েছে, তাই পর্ণার স্বাভাবিক ভাবেই মনে হতে থাকে, এই যুদ্ধে সেই জয়ী হয়েছে।

রাগারাগির পালা শেষ হবার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে মনে করে ঈশান যখন ফেরার উপক্রম করছে, হঠাৎ–ই ঈশানকে অবাক করে দিয়ে, পর্ণা ঝাঁপিয়ে পড়ে তার বুকে, আর তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় তীব্রভাবে। ঈশান প্রস্তুত ছিলনা, তবু কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থাটা কাটার পর সে ও জড়িয়ে ধরেছিল পর্ণাকে, সহজাত প্রবৃত্তিতে বুকের মধ্যে অনুভব করতে পারছিল পর্ণার নরম বুকের স্পর্শ, তার দ্রুতলয়ে চলা হৃৎস্পন্দন, অনুভব করতে পারছিল তার তীব্র হয়ে আসা শ্বাসপ্রশ্বাস। কিন্তু প্রথম চুম্বন, প্রথমবার অনাস্বাদিতের আস্বাদ, আকাঙ্খিত নারীর প্রথম আলিঙ্গন যতটা বিহ্বল করে দেয় একজন পুরুষকে, ঈশান কিন্তু তা হতে পারলনা। কারণ পর্ণাকে সে বুকে টেনে নিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে মিশিয়ে দিতে পারেনি নিজেকে। একটা অজানা দূরত্ব থেকেই গিয়েছিল।

পর্ণা সেদিন ছাড়তেই চাইছিল না ঈশানকে; সে নিজে থেকে এগিয়ে এসেছিল বলে হয়ত ঈশানের কাছ থেকে চাইছিল আরো বেশী কিছু, আরো একটু উষ্ণতা, আরো আদর কিন্তু ঈশান সাড়া দিতে পারেনি পর্ণার অনুচ্চারিত ডাকে। পর্ণার হাত ছাড়িয়ে ফিরে এসেছিল সে। কারণ সে বুঝতে পারছিল, তার শরীর আর মন একই সুরে বাজছে না।

পর্ণার ঘর থেকে বেরোনোর পর, ওর মা ভারী জলখাবার খাইয়ে তবে ছেড়েছিলেন। গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে আসতেও চাইছিলেন, কিন্তু ঈশান রাজী হয়নি। কারণ সে ওদের মা ও মেয়ের কাছ থেকে ছাড়া পেতে চাইছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। সে নিজের সঙ্গে কিছুটা সময় একা হতে চাইছিল। বাড়ি ফেরার পথে, নিজের সঙ্গে একা হয়ে, আজকের দিনটার কথা ভাবছিল ঈশান। আজকের মত এত ঘটনাবহুল দিন জীবনে খুব কমই এসেছে তার। প্রথমে সোহাগকে নিয়ে ঝামেলা পর্ণার সাথে, তারপর সোহাগকে নিয়ে অবচেতন মনে যেসব ভাবনারা দানা বাঁধছিল সেগুলোকে চেতন মনে এলে, নিজের কাছে নিজের স্বীকারোক্তি, সর্বপরি পর্ণাদের বাড়ির অধ্যায়টা। এত বিভিন্ন মাত্রার ঘটনার চাপে তার মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছিল। কোন ঈশানটা সত্যি? যে, সোহাগের প্রতি অকৃত্রিম আকর্ষণ বোধ করে, আত্মার সঙ্গী মনে করে সোহাগকে সে, না–কি এইমাত্র যে পর্ণার আলিঙ্গনে বাঁধা ছিল, পর্ণার আদরে ডুবে ছিল সে? কোন ঈশান জয়ী হবে এই দ্বৈরথে? ঈশান ভাবতে পারে না আর। সারাজীবন তার নিজের জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত সে নিজেই নিয়েছে, কিন্তু এখন কি করবে সে? সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবে? যা হবার তা–ই হবে ভেবে ছেড়ে দেবে নিজেকে? ভীষণ বিপন্ন বোধ হয় তার! সে যেন এক ডুবতে থাকা জাহাজের নাবিক, সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, জাহাজের সঙ্গে–ই ডুববে, না–কি বিনা লাইফ বোটে ঝাঁপ দেবে সমুদ্রে?

হোস্টেলে ফেরার পর স্বভাবতই বন্ধুদের প্রশ্ন, ঠাট্টা ইয়ার্কির মুখে পড়তে হল তাকে। কারণ ততক্ষণে সবাই জেনে গেছে তার শাশুড়ির সঙ্গে গাড়ি চড়ে যাবার কথা।

-”তোর কপাল তো খুলে গেল ঈশান! আমরা লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম করি আর তোকে শাশুড়ি সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যায় প্রেম করার জন্য।”

-”শাশুড়ি কি কি খাওয়ালো, আর বউ কি খাওয়ালো বল।”

বন্ধুদের ঠাট্টা চলতেই থাকে, সেটা স্বাভাবিক, তাই ওদের ওপর রাগ করতে পারেনা ঈশান। কিন্তু ওর এসব কিছুই ভালো লাগছিল না। মনের ভেতর চলতে থাকা দ্বিধাও ওকে স্থির হতে দিচ্ছিল না। কোনোরকমে বন্ধুদের কৌতুহল মিটিয়ে ও ঘরে ঢুকে আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়ে, যাতে কেউ এসে আবার ঘরে ঢুকে নতুন করে আড্ডা না বসাতে পারে। শুয়ে পড়লেও ঘুম আসেনা তার, একটা গানের কলি বার বার ঘুরে ঘুরে আসতে থাকে ওর মাথায়। ঈশানের মনে হতে থাকে, এই গানটা যেন ওর কথা ভেবেই লেখা হয়েছিল–

মেরে জিন্দেগি কী সি ঔর কী

মেরে নাম কা কৌঈ ঔর হ্যায়

সেইরাতে হোস্টেল মোটামুটি নিঃস্তব্ধ হয়ে এলে, যারা জেগেছিল তারা প্রত্যেকে শুনতে পায় ঈশানের বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে গীটারের তার নিংড়ে বার করা সুরের শব্দ। যারা চিনতে পারল সেই সুর, তারা বুঝল গীটারের তার মুক্তি দিচ্ছে ঈশানের ভেতরের অবরুদ্ধ দ্বিধাবিক্ত হয়ে যাবার যন্ত্রণাটিকে

”মেরে জিন্দেগী কী সি ঔর কী

মেরে নাম কা কৌঈ ঔর হ্যায়।

+অনুচ্ছেদ ৫

কলেজ থেকে ফেরার পথে, অটো থেকে নামতেই, মোড়ের মাথার ওষুধের দোকানটার দিকে সোহাগের চোখ চলে গেল নিজে থেকে। গতরাতের উপকারী ছেলেটিকে দোকানের কাউন্টারে বসে থাকতে দেখে, সে এগিয়ে গেল সেদিকে, উদ্দেশ্য গতরাতের উপকারের জন্য ধন্যবাদ জানানো আর নিজের অভদ্রতার বোঝা আর না বাড়িয়ে, ছেলেটির নামটা জিজ্ঞেস করে নেওয়া।
দোকান ফাঁকাই ছিল, তাই সোহাগকে দোকানে ঢুকতে দেখে, কাউন্টার ছেড়ে নিজেই বাইরে বেরিয়ে এল সাহিল। সাহিল কাছে আসতেই সেই গন্ধটা, পেল সে, যেটা গতরাতে ঘুমে তলিয়ে যাবার আগে পেয়েছিল সে আচমকা–ই, যদিও গন্ধটা তার পরিচিত নয়, আর ঐ রকম গন্ধের কোনো উৎস তার বাড়িতেও ছিল না। এখন সাহিল কাছে আসতেই বুঝতে পারল সোহাগ এই গন্ধটাই কেমন ভাবে তার মাথায় ঢুকে গেছিল কাল, আর সেটাই কোনোভাবে তার মনে পড়েছিল গত রাতে। গন্ধটা নিঃসন্দেহে কোনো পারফিউম বা ডিওর; গন্ধটা ভাল না খারাপ কোনো নামকরা ব্রান্ডের নাকি অনামি সে সব নিয়ে কোনোরকম ভাবনা চিন্তা করার প্রয়োজন ছিল না সোহাগের, কিন্তু তার মনে হল গন্ধটার মধ্যে কেমন যেন সম্মোহনী ক্ষমতা আছে, এক মুহূর্ত্তে তাকে বিবশ করে ফেললো, আপন করে নিল, বেশ একটা অদ্ভুত ভালোলাগার বন্ধন তৈরী হয়ে গেল গন্ধের মালিকের সঙ্গে।
-”কাল আপনাকে একবারও ধন্যবাদ জানানো হয়নি। পরে মনে পড়েছে যখন, খুব লজ্জিত হয়ে পড়েছি।”
-”বেশ তো, বন্ধুত্ব করে নিন, তাহলে আর লজ্জা পাবেন না। মানে, বন্ধুকে তো আর ধন্যবাদ দেবার প্রয়োজন নেই।” সাহিল হাসতে হাসতে বলে।

সাহিলের হাসি সংক্রামিত হয় সোহাগের ঠোঁটেও। সে জিজ্ঞাসা করে,

-”বন্ধুর নাম?”

-”আমি সাহিল” করমর্দনের জন্য হাত বাড়ায় সে।

-”আমি সোহাগ, চলুন বন্ধুত্ব হয়ে গেল যখন, একটু চা খাওয়া যাক।” সাহিলের বাড়ানো হাতে অল্প ঝাঁকুনি দিয়ে সোহাগ বলে।

পাশে একটা চায়ের দোকান দেখে, চা খাবার বাসনা জেগেছিল সোহাগের, তাই সেখানে গিয়েই দাঁড়াল দুজনে। পাশাপাশি দাঁড়ানোতে, সাহিলের শরীর থেকে এই গন্ধটা ভেসে এসে আবার জড়িয়ে ধরল সোহাগকে। গন্ধটার মধ্যে পরিচিতের আহ্বান আছে, নির্ভেজাল নির্ভরতা আছে, অকৃত্রিম ভালোলাগা আছে, আর যে কি আছে তাকে প্রকাশ করার মত উপযুক্ত শব্দ যখন মনে মনে হাতড়াচ্ছে সোহাগ, তখনই চমক ভাঙলো সাহিলের ডাকে,

-”ম্যাডাম, চা‘

সাহিলের বাড়িয়ে ধরা চায়ের ভাঁড়টা নিয়ে লম্বা একটা চুমুক লাগালো সে।

-”কোথায় চাকরি করেন আপনি?”

-”পড়াই, আশুতোষ কলেজে।”

-”ওরে ব্বাবা! তাহলে তো আমি ভুল বলে ফেলেছি।”

লম্বা করে জিভ কাটে সাহিল।

-”কি ভুল?” সোহাগ যারপরনাই অবাক হয়।

-”ঐ বন্ধুত্বের কথাটা! আসলে আমার পড়াশোনা তো মাধ্যমিক পর্যন্ত! আর আপনার তো প্রচুর পড়াশোনা, তাই বলছিলাম আর কি, আপনার আর আমার বন্ধুত্ব হয় না কি কখনও।”

সাহিলের বলার ধরনে হেসে ফেলে সোহাগ।

-”কে বলেছে হয়না! পড়াশোনা দিয়ে বন্ধুত্ব হয় না কি? কিন্তু, আপনি মাধ্যমিকের পর পড়েন নি কেন?”

–ইচ্ছা ছিল জানেন, কিন্তু হলনা। বাবা চলে গেলেন হঠাৎ করেই, আমাকে ব্যবসার দায়িত্ব নিতে হল। মা, ছোট ভাই বোন, সবার দায়িত্ব আমার ওপরেই এসে গেল তো!”

সাহিলের কথা শুনতে শুনতে সোহাগ ভাবছিল, এটাও তো একরকমের শ্রেণী বৈষম্য, পড়াশোনা, ডিগ্রির মাপ কাঠিতে শিক্ষিত অশিক্ষিতের শ্রেণী। সমাজ থেকে এই বৈষম্য দূর করা তার পক্ষে আর সম্ভব হবে না ঠিকই, কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে তো সে এই বৈষম্য না–ও রাখতে পারে। নিজেই প্রথম ধর্মাচরণ করে তবে তো তা অন্যকে করতে বলা উচিত। চায়ের ভাঁড়ে শেষ চুমুক দিয়ে তাই সোহাগ বলে,

-”সাহিল, আজ থেকে আমরা বন্ধু। ঠিক আছে! আর এই চায়ের দামটা আমিই দেবো, কারণ আমি আজ ডেকেছি, পকেট থেকে হাতটা তাই বার করে ফেলুন।”

সাহিল এবার হেসে ফেলে, সোহাগের কথা শুনে। বলে,

-”ঠিক আছে। ম্যাডামের আজ্ঞা বলে কথা, এই বার করলাম পকেট থেকে হাত। কিন্তু কাল আমার খাওয়ানোর পালা।”

সাহিলের সঙ্গে সোহাগের বন্ধুত্বটা হয়েই গেল সত্যি সত্যিই, কেবল কথার কথা হয়ে থেমে রইল না। সোহাগের যেদিনগুলোতে অন্য কোথাও কাজ থাকে না, কলেজ থেকে সোজা বাড়িতেই ফেরে, সেই দিনগুলো ও মোড়ের মাথাতে নেমে সাহিলের সঙ্গে দেখা করে ফেরে। দোকানে চাপ না থাকলে, সাহিলও বেরিয়ে পড়ে, দুজনে চা খায়, গল্প–টল্প করে কিছুক্ষণ বাদে বাড়ি ফেরে। তাছাড়া হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ তো থাকেই। নিজের পরিচিত দুনিয়াটার বিজ্ঞ মানুষদের গণ্ডীর বাইরে এসে, সাহিলের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললে, সোহাগের খুব ফ্রেশ লাগে, মাথা, মন দুই–ই খুব হালকা হয়ে যায়। সাহিলের একটা বিশেষ গুণ আছে, ও সোজা কথা সব সময়ই সোজা করে বলে, এমনকি কঠিন কথাও ও এমন সোজাসাপটা বলে যে প্রথমে বেশ হালকা বলেই মনে হয়। পরে শ্রোতা ভাবতে বসে, কথাটাকে যতটা সোজা বলে ভাবা গেছিল তা তো নয়ই, বরং বেশ ওজনদার। সাহিলের এই সারল্য সোহাগের খুব ভালো লাগে। ও ভাবে, কিছুদিন সাহিলের কাছে শিক্ষানবিশী করবে, এই অকপট থাকার বিদ্যাটা আয়ত্ব করার জন্য।

কিছু কিছু ব্যাপার আলোচনা করার ক্ষেত্রে সাহিলের মতামত রীতিমত তাক লাগিয়ে দিয়েছে সোহাগকে। ওর ভাবনা চিন্তার মধ্যে যে একটা ফ্রেশ ভাব আছে, সেটা সোহাগ আর আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীধারী বন্ধুদের মধ্যে নেই। বোধহয় পাণ্ডিত্যের ভারে চাপা পড়ে গেছে, সোহাগ ভাবে।

সাহিলের স্পষ্ট কথা, মাঝে মাঝে সোহাগের বুকে এসে সটান ধাক্কা দেয়, ভেঙে দেয় ওর পরিশীলিত বিশ্বাস সংস্কার। আবার নতুন করে ভাবতে বসায় ওকে, নিজেকে নতুন করে চিনতে শেখায়।

সেদিন যেমন রাতে ভারত–পাকিস্থান ক্রিকেট ম্যাচ ছিল। সোহাগ অত ক্রিকেট প্রেমী নয় বলে, ওর মনেও ছিল না সে কথা। কলেজ থেকে ফেরার পথে, সাহিলের দোকানের মাথায় জাতীয় পতাকা টাঙানো দেখে সোহাগ অবাক–ই হয়,

-”আজ পনেরই আগস্ট না ছাব্বিশে জানুয়ারী, পতাকা টাঙিয়েছ যে?”

-”তার চাইতেও বড় দিন আজ।”

-”মানে?”

-”ইন্ডিয়া–পাকিস্থান ম্যাচ। আমরা যে পাকিস্থানের সাপোর্টার নই, দেশদ্রোহী নই, তার তো একটা প্রমাণ দিতে হবে!” সাহিল হাসতে হাসতেই বলে কথাটা। কিন্তু সোহাগের বুকে এসে বেঁধে। ভীষণ লজ্জিত–ও হয় সে। ঠিকই তো বলেছে সাহিল। হয়ত ওর চোদ্দো পুরুষের কেউ কোনোদিন পাকিস্থানে যায়–ই নি, হয়ত ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ কোনোদিন সমর্থন ও করেনি তারা। এদেশে জন্মে এ দেশের মাটিতেই শুয়ে আছে মৃত্যুর পর। শুধুমাত্র মুসলিম হবার কারণেই প্রতি মুহূর্ত্তে ভারতীয়ত্বের প্রমাণ দিতে হয় তাদের। এত গুলো বছর পার হয়ে যাবার পর ও এই লজ্জা বয়ে নিয়ে যেতে হয় বলে, সাহিলের সামনে একজন হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি বলে সোহাগ লজ্জিত হয়। যেখানে মানুষের আত্মার অপমান হয়, সেখানে অন্যান্য যুক্তি গুলো কতটা কতটা অবাস্তব, ভাবে সে।

সেদিন সকাল ছটায়, সাহিলের ‘গুডমর্নিং‘ মেসেজ পেয়ে দারুণ অবাক সোহাগ। যে ছেলে সকাল আটটার আগে বিছানা ছাড়ে না বলে জানে সে, কি এমন ঘটনা ঘটল যে সকাল ছটাতে তার ‘শুভ সকাল‘ হল?

সেদিন সন্ধ্যেতে বাড়ি ফেরার পথে সাহিলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সোহাগের। কথাবার্তা সেরে বাড়ি ফেরার পথে সাহিল ওকে বাইকে করে বাড়িতে পৌঁছে দিতে আসছিল। সোহাগের হঠাৎ সকালের কথাটা মনে পড়ে গেল বলে, প্রশ্নটা করেই ফেলল।

-”কাল রাতে ঘুমোও নি নাকি? আজ একেবারে ভোরবেলা ‘গুড মর্নিং‘ যে,”

-”আসলে ভোরবেলা নাইটফল হলতো, তাই ঘুমটা ভেঙে গেল তাড়াতাড়ি।”

সোহাগের কান ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে, সাহিলের কথা শুনে। এই রকম একটা কথা যে সাহিল ওকে অম্লানবদনে বলতে পারে, ও ভাবতে ও পারেনি। হয়ত বাইকের আওয়াজে ঠিকমত শুনতে পায়নি কথাটা ভেবে, সোহাগ আবার জিজ্ঞাসা করে

-”কি বললে, কি হয়েছিল?”

সাহিল নির্বিকার ভাবে একই কথা আবার ও উচ্চারণ করে। বলার ভঙ্গীটা এমন যেন, কালরাতে সিনেমা দেখতে গেছিলাম গোছের একদম সাদামাটা কথা সে বলছে।

সোহাগ কিছু আর বলতে পারেনা প্রত্যুত্তরে।

বাড়ি ফিরে গিয়ে, পরে ভাবে সোহাগ, স্টুডেন্ট লাইফে, এই রকম মুক্তির কথাই তো সে নিজে বন্ধুদের মধ্যে জোর গলায় বলতো। নিজেও তো এইরকম একটা মুক্ত পৃথিবীর–ই স্বপ্ন দেখতো, যেখানে মেয়েদের কথা আর ছেলেদের কথা বলে আলাদা করে কিছু থাকবে না। মেয়েদের পিরিয়ডস নিয়ে গোপনীয়তা, রাখ–রাখ ঢাখ–ঢাখ ব্যাপারের বিরুদ্ধে যেসব ছেলেমেয়েরা এখন কলেজে লড়াই করছে, তাদের প্রতি যদি তার পূর্ণ সমর্থন থাকে, তবে যখন একটা ছেলে, তার নাইটফলসের কথা একটা মেয়ের সামনে বলে, তখন তাতেই বা লজ্জিত হবার কি থাকতে পারে? পিরিয়ডসের মত এটাও তো একটা স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার। তাহলে কোনো পুরুষের মুখ থেকে এই স্বাভাবিক ঘটনার কথা সে যদি স্বাভাবিক ভাবে শুনে স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাপারটাকে নিতে না পারে, তবে সেটাতো হবে তার চরম দ্বিচারিতা। মুখে একরকমের কথা, কাজের ক্ষেত্রে আলাদা প্রতিক্রিয়া।

মনে মনে সাহিলকে তাই ধন্যবাদ জানায় সোহাগ। তার মনের একটা বন্ধ দরজার ওপর আলো ফেলে দেখিয়ে দিল সাহিল, যে এতদিন মনের এই বন্ধ দরজাটার অস্তিত্বের কথা সে জানত–ই না। বুঝিয়ে দিল তার চিন্তাভাবনায় কতটা ফাঁকি ছিল, দ্বিচারিতা ছিল!

+অনুচ্ছেদ ৬

”বাত নিকলে গি তো দূর তলক যায়েগী
লোগ বে বজহা উদাসি কা শবাব পুছেঙ্গে
ইয়ে ভি পুছেঙ্গে, তুম ইতনি পরেসাঁ কিঁউ হো,
উঙ্গলিয়া উঠেঙ্গে শুখে হুয়ে বালোঁ কি তরফ

এক নজর দেখেঙ্গে গুজরে হুয়ে সালোঁ কি তরফ”-

বিছানায় মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল সোহাগ আর ওর কানে গোঁজা হেডফোনে বাজছিল জগজিৎ সিং এর গলায় এই নাজমটা। গানের শব্দগুলো আশ্চর্য্যভাবে মিলে যাচ্ছিল তার বর্তমান অবস্থার সঙ্গে, জগজিতের কণ্ঠে থাকা বেদনার রেশও মিলে যাচ্ছিল তার কষ্টের সঙ্গে। আর তাই হোস্টেলের ফাঁকা ঘরের বিছানায় শুয়ে সে শুধু কাঁদছিল। তার বুকের মধ্যে জমে থাকা প্রবল কষ্টটাকে কান্না হয়ে বের হয়ে যেতে দিচ্ছিল গানের যথাযোগ্য সঙ্গতে। সোহাগ আজ ক্লাশে যায়নি, ইউনিয়নের কাজে যায়নি, এমনকি কয়েকটা ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাশে লেকচারিং করার যে দায়িত্ব তাকে দল দিয়েছিল, সেখানেও অন্য কাউকে পাঠানোর জন্য সে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে শরীর খারাপের অজুহাতে। সকাল থেকেই কানে হেডফোন লাগিয়ে সে চুপচাপ শুয়ে–ই আছে, আর ফোনে লোড করে রাখা গজলগুলো বেজে যাচ্ছে একটার পর একটা। এই গজলগুলোর আশ্চর্য্য সুন্দর দুনিয়াতে তার পা রাখা ঈশানদার হাত ধরেই। কতদিন, কতঘন্টা ভালোলাগা কোনো গজলের আলোচনাতে কোনো নতুন উর্দু শব্দের অর্থ জানার জন্য উইকিপিডিয়া–তে, বুঁদ হয়ে থেকেছে তারা দুজন একসাথে! কোনো নতুন গান শুনলে, একে অন্যকে না শোনানো পর্যন্ত তারা তৃপ্তি পায়নি, ভালো লাগাটা এনজয় করতে পারেনি। একটা সময় পর, সোহাগের মনে হত, জগজিৎ সিং এর গজলের প্রতি তাদের দুজনের যে ভালোবাসা সেই ভালোবাসা যেন তাদের দুজনকে একসূত্রে বেঁধে ফেলেছে। সেই কথাটা ঈশানদাকে বলতে সে–ও সহমত পোষণ করে-”সেটা তো হতেই পারে। দেখিস না, রাইটার ক্রিকেটার, সিনেমাস্টারদের যারা ফ্যান হয়, তাদের ও একটা ক্লাব থাকে।”

এই যে সোহাগ নামের একলা মেয়েটি, যাকে গোটা ক্যাম্পাস চেনে বেপরোয়া এবং ডাকাবুকো বলে, সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে যে ক্যাম্পাসময় দাপিয়ে বেড়ায়, এ ডিপার্টমেন্ট থেকে সে ডিপার্টমেন্ট, প্রেম যার কাছে নিছক-ই এনার্জি আর সময়ের অপচয়, সেই মেয়েটিকে যদি কেউ এখন দেখে, হোস্টেলের ঘরে একলাটি চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে চলেছে, সে কি চিনতে পারবে?

সোহাগ নিজেই চিনতে পারছে না নিজেকে। সে কখনো জানত না বা জানার চেষ্টা ও করেনি, যে সে ঈশানের প্রেমে পড়েছে কিনা। আসলে এরকম একটা অসম্ভব কথা সে কখনো ভেবে ও দেখেনি, কারণ সে জানত প্রথম থেকেই পর্ণা আর ঈশানের সম্পর্কটার কথা, আর ঈশানও কখনো সোহাগকে বলেনি মুখ ফুটে যে সে ওকে ভালোবেসে ফেলেছে নিজের অজ্ঞাতসারে কখন যেন। কারণ এটা বললে, তার নিজের কানেই হাস্যকর ঠেকত কথাটা, কিন্তু এটা তাদের দুজনেরই জানা ছিল যে সব কথা মুখে বলার অপেক্ষায় থাকে না। ভালোবাসা এমন এক সত্যি যে চোখ থেকে চোখে চলে যায় সেই সত্যির বার্তা।

”কৌন কহতা হ্যায়, মুহাব্বত কি জুবান হোতি হ্যায়

ইয়ে হকিকৎ তো নিগাহ্‌ সে বয়ান হোতি হ্যায়”

সোহাগের চোখে চোখ রেখে ঈশান যেমন দেখেছিল, পূর্ব জন্ম কিংবা তারও আগের কোনো অতি চেনা চিত্র, ঈশানের চোখে ও সোহাগ দেখেছিল তার অনন্তকালের ঘরবাড়ি।

ঈশানের সঙ্গে পরিচয়ের সময় থেকেই পর্ণার অস্তিত্বের কথা জানা ছিল সোহাগের, তাতে সে বিন্দুমাত্র বিচলিত ছিল না, কারণ ঈশানকে অধিকার করার ইচ্ছা তার মধ্যে বিন্দুমাত্র ছিলনা। প্রেম, বিয়ে, সংসার ইত্যাদি ব্যাপারগুলোকে তার জীবনের প্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলোর তালিকা থেকে বহু আগেই বাদ দিয়ে রেখেছিল সে। কারণ ছোটবেলা থেকে সে ভাবত যে, এই ব্যাপারগুলো তাকে ক্রমাগত পেছনে টানবে, স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে পৌঁছতে দেবে না। সুতরাং ঈশান, পর্ণাকে বিয়ে করে সুখী দাম্পত্য জীবন কাটাবে, এটা মন থেকে মেনে নিতে তার কোনো অসুবিধা হয়নি, শুধু সে চেয়েছিল, ঈশানের সঙ্গে তার যোগসূত্রটি, তার মনের বন্ধনটা যেন চিরটাকাল একই রকম থাকে। সে চেয়েছিল, বিধ্বস্ত হলে বা সংকটে পড়লে কখনো ঈশানের কণ্ঠস্বর মুছিয়ে দেবে শ্রান্তি, দীর্ঘ উড়ানে যদি ডানা ক্লান্ত হয় তার, ঈশান ফিরিয়ে দেবে তাকে হৃত জীবনীশক্তি; কারণ ঈশান যে তার সোলমেট, সেকথা তো সে-ই জানিয়েছিল সোহাগকে!

কিন্তু কি যে হয়ে গেল হঠাৎ করে! কদিন ধরেই সোহাগের মনে হচ্ছিল যে তাদের ফ্রিকোয়েন্সিটা ঠিকমত মিলছে না। দেখা ও হচ্ছিল না ঠিকমত, কিংবা দেখা হলেও ঠিকমত কথা বলছিল না ঈশান, যেটুকু কথা হচ্ছিল তাতে মন ভরছিল না সোহাগের, ঠিকমত টিউনিং না হওয়ায় কেমন যেন অধরা থেকে যাচ্ছিল ঈশান। ওর মধ্যে কেমন একটা ছাড়া-ছাড়া ভাব অনুভব করতে পারছিল সোহাগ, কাল তাই ইউনিয়ন রুমে দেখা হবার পর একটু আলাদা পেয়ে সোহাগ ঈশানকে এই এড়িয়ে যাওয়া গোছের ব্যাপার, যেটা তার মনে হচ্ছে, তার সত্যতা সম্পর্কে জানতে চায়। তখনই সেই সাংঘাতিক কথাটা বলে সে।

-”অ্যাভয়েড করছি, বুঝতে পারছিস তো?”

সোহাগ কথাটা শুনে, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে নি। এমন একটা কথা যে ওকে কেউ কখনো বলতে পারে, এটা ও ভাবতেও পারেনি কখনও। কিন্তু ঈশানের দিকে তাকিয়ে ও বুঝতে পারে ঈশান সিরিয়াস। কোনো কথা আর বলতে পারেন সোহাগ, মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসে ছিল ইউনিয়ন রুম থেকে তারপর ক্লাশেও ফিরতে পারে নি আর, ফিরে এসেছিল হোস্টেলে।

প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠার পর সোহাগ একটু যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করার চেষ্টা করে, যাতে ঈশানের এই অসংলগ্ন ব্যবহারের পেছনে একটা বিশ্বাসযোগ্য কারণ খুঁজে বের করতে পারে। তার অপমান ও যন্ত্রনায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া মনটাকে কিছুটা শান্তি দেবার জন্য সেইরকম একটা কারণের খোঁজ পাওয়াটা ভীষণই জরুরী ছিল সেই সময়ে। যুক্তি দিয়ে চিন্তা করে একটি মাত্র কারণেরই সে সন্ধান পেল, সেটা হল পর্ণাদি। পর্ণাদি যে তার সঙ্গে ঈশানদার মেলামেশা করাটা পছন্দ করেনা একদম, সেটা জানে সোহাগ; কিন্তু ব্যাপারটা তো বহুদিনের সমস্যা, নতুন কিছু নয়! তাহলে নতুন করে এমন কি কারণ ঘটল যে ঈশানদা তাকে এমন কঠিন একটা কথা শুনিয়ে দিতে পারল? উদ্বিগ্ন হয় সোহাগ। তারপরেই আবার ভাবে, যদি তেমন কিছু ঘটেও থাকে, তবে সোহাগকে অ্যাভয়েড কেন, ইনভলভ করলেই তো মিটে যেত সমস্যা! কারণ জ্ঞানতঃ সে তো কখনো ঈশানের ক্ষতি চাইবে না। কোনো বাইরের কারণে যদি সোহাগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা, কথা বলা একান্তই অসম্ভব হয়ে পড়ে, তবে সে কথা তাকে খোলাখুলি বললেই তো মিটে যেত সমস্যা। সে নিজেই সরিয়ে নিত নিজেকে, কষ্ট করে আর তাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত না।

এই কথা ভাবার পর-ই ঈশানের প্রতি তার অভিমান আরও গাঢ় হয়। তার আত্মসম্মান ও আহত হয়, যতবার ঈশানের বলা কথাটা তার মনে পড়ে। অভিমানে, অপমানে তার চোখ ফেটে বেরিয়ে আসা জলের ধারাকে কিছুতেই থামাতে পারে না সে। শেষ পর্যন্ত সে ডায়রি আর পেন নিয়ে বসে। ছোট থেকেই বাবা তাকে শিখিয়েছিলেন ”যে সমস্যা তোকে কষ্ট দেবে অথচ তুই কাউকে বলে হালকা হতে পারবি না, সেটা লিখে ফেলবি। দেখবি বুকটা অনেক হালকা হয়ে যাবে।” বাবার কথা মনে করে, সে ঈশানের প্রতি মনের মধ্যে জমা হওয়া অভিমান উগরে দেয় চিঠির পাতায়। যদিও এই চিঠি কখনো যে ঈশানের কাছে পৌঁছবে না জেনেও সে লেখে। কাগজের বুকে পেনের আঁচড়ে আঁকে তার কষ্টের ছবি। যেভাবে এযাবৎকাল ডায়রির সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে অশ্রু তার কাটাকুটির ছক।

সেই ভালো,

ভেঙে দাও সান্নিধ্যের সাঁকো

প্রতীক্ষা রেখোনা।

সাঁকো থাকলেই পারাপারের ইচ্ছা

সমস্ত প্রহর জুড়ে তীব্র প্রতীক্ষা

প্রাচীন ভিক্ষুর মত বসে আছি

অবসাদে ঢেকে যায় অনন্ত অপেক্ষা।

এই ভালো

অস্তিত্বে শুধু জেগে থাকো

আলিঙ্গনে থেকো না

জলোচ্ছাসে ভেসে যাই যদি

নাম ধরে ডেকোনা।

জলোচ্ছাসে ভাসতে থাকে সোহাগ, হোস্টেলের একলা ঘরে, অন্ধকার একলা বিছানায়, বিন্দু বিন্দু জল হয়ে নেমে আসে তার আত্মার অপমান। তার সমস্ত মন ঈশানের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে ”ইয়া তো মিট যাইয়ে, ইয়া মিটা দিজিয়ে”। আবার চলে আসে ঈশানের সঙ্গে কাটানো ভালো সময়গুলোর অনুসঙ্গ, এই গানের লাইন দুটির হাত ধরে, আবার উপচে ওঠে কান্না, কিভাবে সে বের হবে এই সব স্মৃতি থেকে? অসহায় লাগে তার। সে বুঝতে পারে, বাইরের ঈশান নামক রক্ত মাংসের মানুষটি যতই থাকে এড়িয়ে চলুক না কেন, তার আত্মার সঙ্গে যে ঈশান একবার জুড়ে গেছে, তাকে মুছে ফেলে তার কোনদিন সে এক পা-ও এগোতে পারবে না। কারণ ঈশান যে রূপকথার গল্প শুনিয়েছিলেন তাকে, আর সে-ও সম্মোহিতের মত বিশ্বাস করেছিল সেই গল্প, সে-ই গল্প তার মনে গভীর ভাবে গেঁথে গেছে। ঈশানের মত তারাও বিশ্বাস করতে ভালো লেগেছিল বহু বহু জন্ম ধরেই তারা একে অন্যের পরিপূরক। যদিও জন্মান্তর বাদে বিশ্বাসী কখনো ছিল না সোহাগ, তবুও ঈশান যখন তাকে বলেছিল, একটি মাত্র পরমাত্মা থেকে যখন জন্ম নিয়ে, সমস্ত আত্মা পৃথিবীতে নেমে আসে দেহ ধারণের জন্য, সেই সময় থেকেই তারা দুজন পরস্পরের সঙ্গী। তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো জন্ম; প্রতি জন্মেই তারা খুঁজেছে পরস্পরকে; কখনো পেয়েছে কখনো বা পায়নি। যখন পায়নি, অতৃপ্ত থেকে গেছে তারা। পুনর্জন্ম ও কখনো মুছিয়ে দিতে পারেনি, ভোলাতে পারেনি তাদের পরস্পরের প্রতি টানকে। যেভাবে, যে দেশ-কালেই তারা জন্ম নিক না কেন, দেখা মাত্র পরস্পরকে ঠিকই চিনে নিতে পারবে তারা, ঠিক যেমন এখন ঈশান তার সোহাগ খুঁজে নিয়েছে পরম্পরকে। কারণ একের সঙ্গে অন্যের মিলন ছাড়া তারা যে সম্পূর্ণ নয়; সোহাগ আর ঈশান যে একে অন্যের সোল-মেট।

পাক্কা দুদিন পর ক্লাশে এল সোহাগ। সেদিন দুপুরে সে-ই যে ইউনিয়ন রুম থেকে হোস্টেলে ফিরেছিল, তারপর দু-দিন আর বেরোয়নি হোস্টেল ছেড়ে। বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করলে বলেছে শরীর খারাপ। দুদিন পর যখন ক্লাশে এল, তখন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে ওর ওপর দিয়ে। কাজেই যারা শুনেছিল শরীর খারাপের কারণে ও ক্লাশে আসছে না, তারা ওকে দেখেই বুঝতে পারল, শরীর সত্যিই কতটা খারাপ হয়েছিল! তার হাটাচলা থেকে উধাও আত্মপ্রত্যয়, মুখে নেই ঝলমলে হাসি, চোখের দৃষ্টিতেও নেই সেই জ্যোতি, যেন এক সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। চোখ তো মনের আয়না, হৃদয়ের আনন্দ দ্যুতির প্রকাশ হয় চোখেই, তাই তার চোখ আজ স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছিল কতটা কষ্ট রয়েছে সোহাগের ভেতরে।

সোহাগকে ক্লাশে ঢুকে একা একটা বেঞ্চে বসতে দেখে, রিম্বিক নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এসে বসল ওর পাশে। রিম্বিককে পাশে বসতে দেখে সোহাগ হাসে তার দিকে তাকিয়ে, বড় ম্লান হাসি। রিম্বিক কিছু একটা বলতে যাবে তার আগে-ই ক্লাশে স্যার চলে এলেন।

ক্লাশ শেষ হয়ে যাবার পর রিম্বিক বলল।

-আমি জানি, তোর শরীর না, মন খারাপ, তাই তো?

সোহাগ কিছু বলে না চুপ করে থাকে। কারণ এরপর প্রশ্ন আসবে, ‘কেন, আমরাতো বন্ধু, আমাদের বল।’

ওর এখন কোনো কথাই বলতে ভালো লাগছিল না। আসলে এমন কিছু কথা থাকে, যেটা দুনিয়ার কাউকে বলা যায় না। এমন কিছু কষ্ট থাকে, যা কারো সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়না। আর এই সত্যি কথাটা কেউ কেউ বুঝতেও চায়না। কাজেই রিম্বিক সহ অন্য বন্ধুদের প্রশ্নগুলো কিভাবে এড়িয়ে যাবে সেটাই ভাবতে থাকে সোহাগ।

-”তোর্সা তোকে ফোন করেছিল শরীর খারাপ শুনে; তোর্সা, আয়েশা তোকে দেখতে যাবে হোস্টেলে ভেবেছিল, কিন্তু তুই বারণ করে দিলি যখন, তখনই বুঝে গেছি আমি, তোর অসুখটা কোথায়।”

এবারেও কিছু বলে না সোহাগ, কী-ই বা বলার আছে, রিম্বিকের পরবর্তী প্রশ্নটার অপেক্ষা করতে করতে ও ভাবতে থাকে কি উত্তর দেবে, যাতে সত্যি কথাটা না বলেও তার বন্ধুদের মনে আঘাত না দিয়েও সমস্যাটা থেকে বের হয়ে আসা যায়।

কিন্তু কিছুই করতে হল না সোহাগকে, রিম্বিকই বাঁচিয়ে দিল ওকে।

-”শোন, আমরা কেউ-ই জানতে চাইব না তোর কাছে কেন তোর মন খারাপ। কিন্তু তোকে এরকমভাবে দেখে তো আমরা অভ্যস্ত নই, তাই খুব খারাপ লাগছে। তুই যখন কারো সঙ্গে শেয়ার করবি না, তখন নিজেকে একটু তাড়াতাড়ি সামলে নে প্লিজ।”

রিম্বিককে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ জানায় সোহাগ। ওর কাছে এতটা সমঝ্‌দারি সত্যিই সোহাগ আশা করেনি। মুখে বলে শুধু, -‘চেষ্টা করছি’। আর মনে মনে বলে, ”গভীর ক্ষত সারতে সময় তো লাগবেই, আর সব ক্ষত কি সারে?” তবে রিম্বিকের কথাতে একটা কাজ অবশ্যই হল। সোহাগ বাস্তবটার মুখোমুখি হল। সে বুঝল, ভেতরে যতই নদীর পাড় ভাঙুক যতই বন্যার জল ঢুকে পড়ুক হু-হু শব্দে, বাইরেটাকে আগের মত রাখার চেষ্টা করতে হবে সচেতনভাবে, চেষ্টা করে, নাহলে পরিবর্তনটা কারোর নজরই এড়াবে না।

আর তাই সে দ্রুত শিখতে লাগল, দুই চরিত্রের মধ্যে সহজ যাতায়াতের পদ্ধতি। কিভাবে দ্রুত ‘আসল আমি’ থেকে বের হয়ে গিয়ে ঢুকে পড়তে হয় ‘বাইরের আমি’র মধ্যে, কিভাবে সুইচ ‘অফ’, ‘অন’ করার মত ‘অফ’ থাকা মুডকে ঝটপট ‘অন’ করতে হয় জনসমক্ষে, সবই সে অভ্যাস করতে লাগল প্রয়োজনের তাগিদে। ছদ্মবেশ ধারণ সে একদম পছন্দ করত না কোনোকালেই; সবসময় ভাবত, নিজের ভেতর আর বাইরেটা একদম একই রকম রাখবে সে, কাচের মত স্বচ্ছ, কিন্তু পারল না। আর সমস্ত মানুষের মত, খোলস ধারণ করতে শিখতে হল তাকে, বদলে ফেলতে হল নিজেকে।

নিজেকে ভুলে থাকার জন্য, ক্যাম্পাসে থাকাকালীন সোহাগ, ক্লাসমেটদের সঙ্গে বেশী বেশী সময় কাটাতে লাগল, যা আগে কখন করেনি। বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে সিনেমা দেখতে যাওয়া, নাটক দেখতে যাওয়া শুরু করল সে। কখনো বা স্থানীয় কোনো বন্ধুর বাড়ি ক্লাশ এর পর বেড়াতে চলে গেল। এই দিনগুলোতে রিম্বিক ওকে ভীষণই সাহায্য করছিল। ক্লাশের মিস্‌ হয়ে যাওয়া নোটস দিয়ে যেমন সাহায্য করছিল, তেমনই আবার কখনো ক্লাশ শেষের পর ওকে, ওদের থিয়েটারের গ্রুপের শো থাকলে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছিল। সোহাগ ও বিনা বাক্যব্যয়ে চলে গেছে রিম্বিকের সঙ্গে, কারণ একজন বা একাধিক মানুষের উপস্থিতি সেই সময় তার পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক মনে হচ্ছিল। কারণ একা হলেই তো সোহাগের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে অন্য এক সোহাগ, যে কিনা ঈশানেরই খণ্ডিত অংশ বিশেষ। ঈশানকে ছাড়া যার অস্তিত্ব গভীর সংকটে। যতদিন ঈশান তার সঙ্গে ছিল, কাজে কিংবা অকাজে সারাদিন বহুবার বহুরকম কথাবার্তা হত তাদের মধ্যে, ততদিন বোঝেনি সোহাগ, ঈশানের শিকড় তার ভেতরে এতটা গভীরে গেঁথে গেছে। আজ যখন সে আলাদা হয়ে গেছে, তখন তাকে সোহাগ প্রত্যেক প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে অনুভব করতে পারছে। ছেড়ে চলে গেছে বলেই যেন বেশী কাছের হয়ে গেছে, অমূল্য হয়ে গেছে।

রিম্বিক তার কথা রেখেছিল। এইসব সংকটের দিনগুলোতে পাশাপাশি চলার সময়, একবারও উচ্চারণ করেনি ঈশানের নাম, জানতে চায়নি কি সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল সোহাগের সঙ্গে ঈশানের, বা কেন তারা এখন পরস্পরকে এড়িয়ে চলে! উপরন্তু, সোহাগের এলোমেলো হয়ে যাওয়া মনটাকে পড়াশোনাতে ফেরানোর জন্য, অন্য বন্ধুদের থেকে একটু বেশীই চেষ্টা করে সে। বইপত্র, নোটস দেওয়া ছাড়াও ওকে সঙ্গে করে নিয়মিত লাইব্রেরী যাওয়া আর সেখানে বসে পড়ার অভ্যাস সোহাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয় সে। রিম্বিককে বুদ্ধিমান, লেখাপড়ায় ভালো বলেই এতদিন জানত সোহাগ, এখন তার সহানুভূতিশীল মনটাকেও দেখতে পেল সে। ধীরে ধীরে মনটাকে পড়াশোনাতে বসিয়ে দিতে পারল সোহাগ, যেটা ভীষণ দরকারি ছিল, কারণ পরীক্ষার বেশীদিন বাকি ছিলনা আর।

সংকটের সময় যে বন্ধু একটা সাহায্যের হাত বাড়ায় তার প্রতি কৃতজ্ঞতার সাথে সাথে ভালোবাসা বোধ ও যে তৈরী হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক!

মাস্টার্স শেষ করার পর, রিম্বিকের ইচ্ছে ছিল সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার; সেজন্য ভালোরকম পড়াশোনা করা প্রয়োজন। আর সোহাগের ইচ্ছে ছিল গবেষণা করার। এম.এস.সি পড়ার সময়েই তাই সে বিভিন্ন রিসার্চ ইনস্টিটিউট গুলোতে পরীক্ষা দিতে থাকছিল, জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপের জন্য নেট পরীক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি। ইউ.জি.সি’র জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপটা যখন পেয়ে গেল সোহাগ, তখন রিম্বিক প্রস্তাবটা দিল।

-”চল, বিয়ে করে নিই।”

সোহাগের সঙ্গে রিম্বিকের সম্পর্কটা ততদিনে নিছক বন্ধুত্বের গন্ডি পার হয়ে, যতটা এগিয়েছে তাতে এরকম একটা প্রস্তাব দেওয়াটা খুব একটা অনভিপ্রেত কিছু নয়। তবু একটু থতমত খায় সোহাগ। কারণ বিয়ে করার কথা তখন-ও পর্যন্ত ঘুণাক্ষরে ভাবেও নি সে। বিয়ে, সংসার এই সব ব্যাপারগুলো ও একটু এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করতো, কারণ কেরিয়ার তৈরী পড়াশোনা শেষ করাটা-ই তার কাছে পাখির চোখ ছিল। তাই সে বলে,

-”এখনই বিয়ের কথা? বিয়ে করা কি পালিয়ে যাচ্ছে? না তোর কেরিয়ার তৈরী হয়েছে, না আমার, সেগুলো কর আগে!”

-”একসাথে থাকলে সেগুলো আরো ভালো হবে। কোনো টেনশন থাকবে না তো তোকে ছেড়ে থাকার! তুই তোর পড়াশোনা করবি, আমি আমার। তোর ফেলোশিপের টাকায় খাব, বিন্দাস থাকবো, এনি প্রবলেম?”

-”তার জন্য বিয়ের কি দরকার? এমনিই থাক না একসাথে, আগে কিছুদিন আমার সাথে থেকে দ্যাখ্‌ থাকতে পারিস কি-না, তারপর বিয়ে করিস! যদি দেখিস পোষালো না, নিজের পথ দেখতে পারবি।”

-”ঠিক, ঠিক, উকিল মোক্তার কোর্ট কাছারি না করেই তল্পিতল্পা গুছোতে পারব কি বলিস?”

সোহাগের প্রস্তাবটা রিম্বিকের মনে ধরে। বিয়ের ভাবনাটা যদিও ওর মাথাতে এসেছিল, তবু চাকরি বাকরি না করে বিয়ে করাটা, বাবা-মা আত্মীয়সেজনরা কেমন ভাবে নেবেন, সেটা ভেবে ওর মনটা একটু খুঁত খুঁত করছিল বৈকি। লিভ ইন সম্পর্কে থাকলে, সাপও মরল, আবার লাঠি ও ভাঙলো না।

ইউনিভার্সিটির হোস্টেল আর মেস ছেড়ে তারা যেদিন এই ফ্ল্যাটে উঠে এল, সেদিন সঙ্গে ছিল সোহাগে বাবা মা, আর কাছের বন্ধুরা কজন। এই ফ্ল্যাটটা সোহাগের মামার, যিনি কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন, আর বছরের পর বছর ফ্ল্যাটটা বন্ধই পড়ে থাকে। সোহাগের মায়ের ওপরই মাঝে মাঝে এসে ফ্ল্যাটটা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা, ট্যাক্স দেওয়া বিদ্যুতের বিল, ফ্ল্যাটের অন্যান্য বকেয়া দেওয়ার দায়িত্ব ন্যস্ত। এখন সোহাগের থাকার প্রয়োজন শুনে তিনি যেন হাতে চাঁদ পেলেন, অন্তত কেউ তো বসবাস করবে। সোহাগকে নতুন সংসার গোছাতে সাহায্য করার জন্য ওর বাবা মা প্রথমদিন সঙ্গে এলেন। যদি ও সংসার বলতে যা বোঝায়, ওদের ডেরাটাকে সে আখ্যা দেওয়া যায় কি-না সেটা নিয়ে দুবার ভাবতে হবে। কারণ দুজনেরই পড়াশোনার চাপ, তাই রান্নাবান্নার পাট রাখেনি ওরা বাড়িতে। খাওয়া দাওয়া হোমসার্ভিসে। বাড়িতে শুধু চা আর প্রয়োজন হলে ম্যাগি বানানোর বন্দোবস্ত। তাই এটাকে মেসের একটু পরিশীলিত, পরিমার্জিত সংস্করণ বলাটাই শ্রেয়। তবুও সোহাগের মা দারুণ খুশী, কারণ তার ছন্নছাড়া মেয়েটা কোনোদিন কোথাও থিতু হতে পারবে না এটা ভেবে তিনি মনে মনে খুবই শঙ্কিত ছিলেন। এখন এই যে রিম্বিকের সাথে সোহাগের একসাথে থাকার শুরু, না হোক এটা বিয়ে, তবু তো একত্র বসবাস; এই যে দুজনের মধ্যেকার বন্ধন, না হোক তা আইনি তবু তো একটা বন্ধন; এই বন্ধনে যে তার এলোমেলো মেয়েটা বাঁধা পড়েছে, তাতে ও তিনি স্বস্তি পেলেন।

সোহাগের রিম্বিকের কাছের বন্ধুরা, ঋষি, তোর্ষা আর আয়েশা, তারাও খুব খুশী, সোহাগ-রিম্বিকের সম্পর্কটা নতুন মাত্রা পাওয়াতে। সোহাগের জন্য বিশেষতঃ তারা স্বস্তি পেয়েছে, কারণ সোহাগের বুনো হাঁসের পেছনে দৌড়নোটা কখনই তারা মন থেকে মানতে পারেনি।

সারাটা দিন সবাই একসাথে কাটিয়ে, হৈ হল্লা করে, ওদের নতুন বাসস্থানটা গোছগোছ করে দিয়ে, সন্ধ্যার পর সোহাগের মা, বাবা, আর বন্ধুরা সবাই চলে গেল। এবারে শুধু রিম্বিক আর সোহাগ। এখন থেকে দুজনের দুঃখ, সুখ, ভালো মন্দের ভাগ বাঁটোয়ারা শুধু দুজনের মধ্যেই হবে। যখন তারা শুধুমাত্র বন্ধু ছিল, তখনকার যে পারস্পরিক সমঝোতা ছিল, তা এখন বদলে যাবে, পাবে নতুন মাত্রা। দূরে থাকাকালীন মানুষের অনেক অপছন্দের জিনিস-ই চোখে পড়ে না, কিংবা চোখে পড়লেই সেটা খুব বেশী কিছু গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। কিন্তু কাছে এলেই অনেক সূক্ষ্ম, চুলের মত সরু ছিদ্র ও বড় হয়ে দেখা দেয়। এইসব অপছন্দের জিনিসকে বড় করে না দেখে, উপেক্ষা করতে পারলে তবে-ই দৃঢ় হয় বন্ধন, টিকে যায় সম্পর্ক। ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে ধৈর্য্য আর সহনশীলতার পরীক্ষায় পাশ না করলে, দুজন মানুষকে একসাথে বেঁধে রাখতে পারেনা কোনো বন্ধন-ই। এত কিছু ভেবে, কোনো মানুষ কি আর কোনো সম্পর্কে জড়ায়? তবু, সোহাগের মনে তার নিজের প্রকৃতি নিয়ে একটু চিন্তা ছিল-ই। কারণ সে সবসময় যা, তা-ই হয়েই থাকতে চায়, যেমন, মেক-আপ করে নিজের রূপের খুঁত গুলো ঢাকার পক্ষপাতী নয় সে কোনোদিনই, তেমনই, কাছের মানুষের কাছে সে কোনো রকম আড়াল, ভনিতা রাখার পক্ষপাতীও নয়। নিজেকে খোলাখাতার মত মেলে ধরতে চায় রিম্বিকের সামনে, তাই সেদিন সন্ধ্যায়, তারা দুজনে একা হবার পর, সোহাগ ‘শ্রীজাত’র লেখা একটা কবিতা শোনায় রিম্বিককে-

আমার একটা ‘তুই’ চাই-

একটা সত্যিকারের তুই চাই

যে জানবে আমার পুরো ভিতরটা

জানবে আমার লুকানো সব দোষ

আমার বদমাইশি, আমার নোংরামি

আমার কলঙ্ক

যে নিজে থেকে আমার ভুলগুলোর

অংশীদার হবে…

আমার পাপগুলোকে অর্ধেক

করে লিখে নেবে নিজের খাতার

প্রথম পাতায়…

আমি এমন একটি ‘তুই’ চাই

যাকে আমি নির্দ্বিধায় উপহার দেব

আমার সব অনিয়ম

আমার অপারগতা, আমার বদভ্যাস

আমার উছৃঙ্খলতা…

পুরো কবিতাটা আর শেষ করতে পারেনি সোহাগ, তার আগেই তাকে বুকে টেনে নিয়েছিল রিম্বিক, আর বলেছিল ”তোকে কথা দিচ্ছি সোহাগ, আমি চেষ্টা করব।”

ক্রমশঃ …

Copyright © 2023 অপারবাংলা