short-story-sunnosthan-puron

শূন্যস্থান পূরণ

হিমি মিত্র রায়



‘লেবু চা মসলা চা! এই লেবু চা মসলা চা!’
‘এদিকে!! একটা চা!’
‘মসলা না লেবু, কাকু?’
‘লেবুই।
-কত, 5 টাকা?’
কান এঁটো করা হাসি হেসে ছেলেটি বলল,’পাঁচ টাকা দিয়ে এখন আর কিছু হয় নাকি কাকু? দিন, 10 টাকা দিন!’
‘লেবু চা মসলা চা!!!!! এই লেবু চা মসলা চা!!!!!!’

এসি টু টায়ারও এখন হকারদের কবলে, নিষ্কৃতি নেই।
উল্টো দিকে বসে থাকা টুপি পড়া দাঁড়িওয়ালা ভদ্রলোক বললেন, যাকে এক ঝটকায় দেখলে বেশ রঙিন স্বভাবের মনে হয়।
যা বলেছেন,’কে কখন উঠছে নামছে সব হিসেবের বাইরে। উপরি পাওনা এই আমাদের মত যদি বাথরুম লাগোয়া কামরা হয়, সারারাত দরজা খুলবে আর বন্ধ হবে।সঙ্গে ভেসে আসবে দুর্গন্ধ বাতাস , ঘুমের দফারফা!!!’
‘হাহাহাহাহা সে আর বলতে! এই আপনারা চা খাবেন ? চাওয়ালা ওদিকে চলে গেল বোধ হয়!’
পাশ থেকে ছিপছিপে চেহারার ভদ্র মহিলা হাত নেড়ে বললেন ।
‘চা খেতে ভালোবাসি না, আসলে আমার সুগার তো। চিনি ছাড়া চা আবার খেতে পারি না, তাই একেবারে বাদ দিয়ে দিয়েছি।’
‘আরে আমারও তাই অবস্থা! খেলে চিনি দিয়ে খাবো নয়তো খাবই না। যদিও সুগার একেবারেই কন্ট্রোলে, 140 । তবুও খাই না , কি এমন ব্যাপার?’
পাশে বসে থাকা ভদ্রমহিলা এবার মুখ খুললেন।
‘না খাওয়াযই বুদ্ধিমানের কাজ। আপনারা কোথায় চললেন , ব্যাঙ্গালোর?’
‘না আমরা গোপালপুর। আপনারা বুঝি ব্যাঙ্গালোর?’
‘হ্যাঁ মেয়ের কাছে। নতুন চাকরি নিয়ে গেছে তো, সংসার বুঝাতে যাচ্ছি।’
‘আমরা ঘুরতে। বুড়োবুড়ি একাই সব ঘুরে বেড়াই ,মেয়ের বিয়ে দিয়ে হাত পা ঝাড়া।’
‘আমাদের যাত্রাটা বেশ আনন্দের কাটবে আশা করি। এত লং জার্নি ভীষণ বিরক্ত লাগে , ঠিকঠাক সহযাত্রী না পেলেতো আরো চিত্তির। গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে , কি বলুন?’
‘এ একা গেলে ফ্লাইটে যাতায়াত করে। আমাকে বলে কত সুবিধে, সময় কম লাগে। আমার ভালো লাগে না, একটু ভয় লাগে আসলে, গেলে সব শেষ একবারে।’



ধীরাজ বোস আর সুজাতা বোসের এটাই প্রথম একসঙ্গে ব্যাঙ্গালোর যাত্রা। আগে বিরাজ বাবু একাই মেয়েকে পৌঁছাতে গিয়েছিলেন চাকরির পরীক্ষা দেওয়াতে । তারপর আরও দুবার গেছিলেন।এইবার সস্ত্রীক চলছেন এক মাসের জন্য।চাকরি করতেন, সবেমাত্র রিটায়ার করেছেন 6 মাস হল। এখন অফুরন্ত অবসর। মেয়েও বারবার বলেছে ব্যাঙ্গালোরে আসতে তাই যাচ্ছেন। নয়তো উনি বেশ ঘরকুনো এবং পুরাতন পন্থীও। অতি সামান্য এটিএম ব্যবহার করা শিখে উঠতে পারেন নি।পাড়ার বন্ধুবান্ধব ক্ষ্যাপায় । অবশ্য তাতে ওর কিছু এসে যায় না । বাড়িতেই টাকা ব্যাংক থেকে তুলে রেখে দেন। আর কোথাও যেতে গেলে বাড়িতে সবমিলিয়ে বারোটা তালা দেন।
আত্মীয়-স্বজনরাও হাসাহাসি করে ওকে নিয়ে। এমনি মানুষটা খুব ভাল, খেতে খাওয়াতে খুব ভালবাসেন, খরচাও করেন যখন যেমনি প্রয়োজন। স্ত্রী স্কুলে পড়াতেন। পাঁচ বছর হলো অবসর নিয়েছেন স্বেচ্ছায়। ১২০ কিমি যাতায়াত আর ভালো লাগছিলো না, শরীরে ব্যথা বেদনা বেশ বেড়েছে । আর অনেক বছর তো চাকরি হল, তাই স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলেন। এবার তাই ঘুরে বেড়ান এদিক-সেদিক। একটু আধটু সোশ্যাল ওয়ার্ক করেন। এভাবেই ভালো কাটে তার।এবার বেশ কদিনের জন্য মেয়ের কাছে যাচ্ছেন, আসলে মেয়ের জন্য ছেলে দেখতে।মেয়ে তামিল ছেলের প্রেমে পড়েছে , একই সঙ্গে চাকরি করে তারা। ওকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। আর কি, বাবা-মাকেও রাজি হতে হল, অশান্তি বাড়িয়ে লাভ কি!

“ডিনার!! ডিনার!!”
‘এই , দুটো লাগবে, ভেজ!!’
ও পাশের ভদ্রলোক হাত তুলে বললেন।
প্যান্ট্রির লোক চিরকুটে লিখে নিল।
‘আপনারা নিলেন না?’
‘নাহ, আজ নিয়ে এসেছি খাবার । কাল দুপুর থেকে নিতে হবে-‘,বললেন ধীরাজ বোস।
‘আসলে আমার আবার কোথাও যাওয়ার আগে রান্নাবান্নায় মন থাকে না, তাই ট্রেনেই খেয়ে নিই। আর বাড়িতে সেদ্ধ ভাত টাত দিয়ে চালিয়ে নিই। এও খেয়ে নেয় , ঝামেলা করে না।’
স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন ভদ্রমহিলা।
‘দেখলে, উনি কত সাহায্য করেন দিদিকে! তোমার তো আবার বাড়ির রুটি কষা আলুর দম পায়েস ছাড়া চলে না। জানেন তো?’
এ পাশের ভদ্রমহিলা ওদিকের ভদ্রমহিলার দিকে চেয়ে বললেন।
ধীরাজ বোস কিছু বললেন না। শুধু বোকা বোকা মুখ করে হাসেন। ভদ্রমহিলাও হেসে উঠলেন। দুজন নন বেঙ্গলি মেয়ে শুধু চিপস খাচ্ছে আর কানে হেডফোন গুঁজে মোবাইল খুঁটখুঁট করে চলছে। অন্য কোনো দিকে হুশ নেই। সত্যি ,আজকালকার ছেলেমেয়েরা মোবাইল পেলে আর কিছু চায় না । জগত সংসারে সব দূরে সরে যাক, শুধু মোবাইল চলতেই থাকে চলতেই থাকে।
ট্রেন থামল এক স্টেশনে।
‘কোথায় এল?
বৃষ্টিতে স্টেশনের নাম দেখা যাচ্ছে না।’
উঁকি মেরে দেখে বললেন পাশের ভদ্রলোক।
‘বৃষ্টি বলে স্টেশনে নামার হিড়িক নেই । নয় তো শুধু দরজা খোলা আর বন্ধ। আর বাইরে জলকাদা পায় ঘরে ঢোকা, অসহ্য!!’
‘যা বলেছেন! এই বাদাম খাবেন? বাড়িতে ভেজে এনেছি, নুন ছাড়া।’
হাত এগিয়ে দেয় ধীরাজ।
‘আপনাদের কিন্তু নাম জানা হয়নি।
আরে সেই তো সেই তো, আমি সুবিমল মিত্র, আর ইনি রিতা মিত্র। আপাতত ভ্রমণই আমাদের নেশা বুঝলেন ? বনে-বাদাড়ে পাহাড়ে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াই।একদিন না একদিনতো বিছানা নিতেই হবে কি বলেন?’
‘খুব ভাল, এমন কজন করে বলুন তো? আমার এ তো ঘর থেকে বেরই হতে চায় না। পাছে তালা ভেঙে চুরি না হয়!’
সশব্দে হেসে উঠল সকলে।
‘ভালো বলেছেন বৌদি, তবে আজকাল যা চুরি-চামারি বেড়েছে তাতে ঘর থেকে গিয়েও শান্তি নেই। আমাদের আসলে নিচতলায় ভাড়া রয়েছে বহুদিনের পুরনো, ওরা আত্মীয়ই বলতে পারেন। তাই চিন্তা কম থাকে আর আমরা বের হতে পারি নয়তো আমরাও পারতাম না। যাই হোক কলকাতায় কোথায় বাস আপনাদের?’
‘যাদবপুর। আর আপনারা?’
‘আমরা কলকাতা নই, বহরমপুর থেকে এসেছি।’
‘আচ্ছা আচ্ছা নবাবের শহরে থাকেন । তবে আপনাদের ওখানে তো কত ঘোরার জায়গা তাই না?’
‘ওই আর কি। তবে কি জানেন এত জায়গা ঘুরে বেড়াই নিজের জায়গা ভালভাবে ঘুরে দেখা হয়নি। ওই যে বলে না ,’বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ ঘুরে বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু, দেখা হয় নাই শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু।সেই আর কি!’
‘কলকাতায় আসেন না?’
‘হ্যাঁ মাঝে মাঝে আসি বৈকি।’
‘আমাদের বাড়িতে আসবেন কিন্তু বৌদিকে নিয়ে, খুব ভাল লাগবে।
আসব আসব, ঘোরার আরো একটা জায়গা হল আমাদের। ভালই হল।’
‘হ্যাঁ তাই তো ফোন নাম্বার নিয়ে নেবেন অবশ্যই , এক্ষুনি দিয়ে দিচ্ছি লিখে নিন, 1975.. ।’
নোটবুকে সবাই সবার ফোন নাম্বার সেভ করে নিল।
‘আমার আবার তেমন ফোন ব্যবহারের অভ্যাস নেই জানেন?’
‘সে কি এতো দেখি এর এটিএম কার্ড ব্যবহার না করার মত! আপনাদের তো খুব মিল দেখছি!’
‘দেখেছো তো, তুমি সবেতেই আমাকে দোষারোপ কর,উনি নিজে মোবাইল ব্যবহার করেন না।
আর বলবেন না দাদা, কি যে সমস্যা হয় আমার এইজন্য! একে বলে বোঝানো যায় না।
ল্যান্ডফোন নাম্বারটাই তবে..
হ্যাঁ হ্যাঁ লিখে নিন , ফাইভ তার আগে 09452 নেবেন।’


রাতের খাবার চলে আসে । দুই পরিবার ভাগাভাগি করে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিছানায় আসে। নীচের বার্থে দুই মহিলা আর ওপরে পুরুষেরা। টুকটাক কত গল্প হয় , দুজনে মেয়েদের কথা, সংসার স্বামী কত কিছু । আত্মীয়তা গড়ে ওঠে, মনে হয় কত দিনের চেনা! কোন কোন সময় এমন অচেনা যাত্রী নিজের হয়ে যায়। ধিরাজ বোসের আবার ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুম আসে না, পাশের দুটি মেয়ে তখনও জাগা। সুবিমল মিত্তির বাথরুম থেকে এসে পর্দা টেনে দিলেন । ধীরে ধীরে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল সকলে।



রাত তখন কটা হবে জানা নেই। মনে হচ্ছে ভোরের আলো হালকা হালকা দেখা যায়। একটা ঘোরের মধ্যে চোখ খুলে দেখে নিলেন সুজাতা ঘোষ, পাশের বার্থে ভদ্রমহিলাকে দেখা গেল না। বাথরুম গেছেন হয়ত। আবার ঘুমিয়ে পড়লেন । সকালে ঘুম ভাঙলো স্বামীর ডাকে।
‘কি ব্যাপার কত ঘুমোবে ?শিগগিরই উঠে দেখ কি অবস্থা!’
উঠে বসলেন উনি। ঘুম চোখে বললেন, ‘কি হয়েছে ?’
‘চুরি হয়ে গেছে, চুরি!!! সবকিছু !! আমার হ্যান্ডব্যাগ, তোমার হ্যান্ডব্যাগ , সব সব সব গেল!!!! আমাদের ব্যাঙ্গালোর যাওয়া অবধি হবে কিনা সন্দেহ !! সব তোমার আর আমার হ্যান্ডব্যাগে ছিল টাকা পয়সা, কিচ্ছু নেই !!!’
‘কি বলছ কি?? আরে!!! আমার মাথার কাছে যে পার্স ছিল সেটা কোথায় ??’
‘তাই তো বলছি কিচ্ছু নেই !!’
‘আমিতো এমন গভীর ঘুম কখনো ঘুমাই না গো, কেন এমন হল আমার ? মাথাটা ভার হয়ে আছে কিছু ঢুকছে না।’
ততক্ষণে আশেপাশে থেকে অন্যান্য যাত্রীরা চলে এসেছে।
‘কি হল দাদা কিছু হয়েছে নাকি?’
‘সব চুরি হয়ে গেছে আর বলবেন না। এখন কিভাবে সম্পূর্ণ রাস্তাটা যাব জানি না । সমস্ত টাকা পয়সা কাছে রাখবো বলে মাথার কাছে রেখেছি, উঠে দেখি কিচ্ছু নেই ‘ ,মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন ধীরাজবাবু।
সুজাতা দেবী তখনও কিছু বলার অবস্থায় নেই হা করে শুনছেন।
টহলদাড়ি পুলিশ চলে এসেছে, সমস্ত শুনে রিপোর্ট পাঠিয়েছে। তবে অদ্ভুত ব্যাপার সুকুমার মিত্ররা অনেকক্ষণ হলো জায়গায় নেই, শুধু ব্যাগ আছে । অন্যান্য প্যাসেঞ্জার তো বলেই চলেছে , পুলিশ থাকার কি মানে, এসি কামরায় এভাবে চুরি মানা যায় না, যাত্রীরা কোন ভরসায় আসবে ইত্যাদি।
পুলিশ উল্টো দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ইহা পর কৌন হে?
‘আমাদেরই মতন দুজন, স্বামী স্ত্রী।’
ধীরাজবাবুর স্ত্রী বললেন , ‘ওদের কিন্তু অনেকক্ষণ দেখছি না, ভোরে একটু ঘুম ভেঙেছিল তখনও এখানে ছিলেন না।’
ভিড় ঠেলে একজন এগিয়ে এসে বলল, ‘ওরা তো নেমে গেল দেখলাম । আমি বাথরুম যাচ্ছিলাম তখনই তো দেখলাম নেমে গেল।’
অবাক হয়ে গেলেন ধীরাজবাবুরা।
‘ব্যাগ ফেলে চলে গেলেন ! এ আবার কি? আমাদের যে বললেন গোপালপুর যাবেন !!’
ততক্ষনে বাথরুম প্যাসেজ খুঁজে ফেলা হয়েছে , কোথাও কেউ নেই। টহলদারি পুলিশ নীচ থেকে ব্যাগটা টেনে বের করল। খুলতেই বেরিয়ে এল ঠেসে ঢুকিয়ে রাখা কিছু খবরের কাগজ। ব্যাগে আর কিছু নেই ।
অবাক হয়ে চেয়ে রইলো উপস্থিত সকলে।
‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ এত বয়স্ক স্বামী-স্ত্রী ভালো মানুষের আড়ালে এই? ভাবা যায় যুগটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? দেখেছেন?’
‘তা নয়তো কি!! ভাবতেই তো অবাক লাগছে! আর পাশের মহিলা স্ত্রী কিনা কে জানে! হয়তো এসবই করে বেড়ায়!’
ধীরাজবাবুরা চুপ করে গেলেন ।আর একটাও কথা বের হলো না মুখ দিয়ে।


শেষমেষ ব্যাঙ্গালোর পৌঁছল ট্রেন। মেয়ে সব শুনেছিল ট্রেনে থাকতেই। টাকার সমস্যা বিশেষ হয়নি। সামান্য কিছু ভিআইপিতে ছিল তাই দিয়ে আর এক দিন কেটে গেছে।মেয়েতো খুব বকাবকি করেছে।বাবাকে বলেছে, ‘এই জন্য বলি এত টাকা নিয়ে ট্রাভেল কোরো না।তুমি তো শুনবে না, এখন বোঝো।’
ওই ল্যান্ড ফোন নাম্বারটি বহুবার চেষ্টা করেও লাইন পাওয়া যায়নি।



ব্যাঙ্গালোর এসে বেশ ভালো লাগছে। তিথি বাবা-মাকে পেয়ে কি করবে আর কি করবে না বুঝে পাচ্ছে না । একসঙ্গে মার্কেটিংয়ে যাওয়া, প্রায় রোজই মাকে ব্যাঙ্গালোর সিল্ক, কাঞ্জিভরম আরো কত গালভরা নামের শাড়ি কিনে দিয়েছে। বাবার জন্য দামী কোম্পানির সাফারি, হাতঘড়ি, যেগুলো খেতে ভালোবাসে সব জোগাড় করে নিয়ে আসছে, রোজ বিকেলে আড্ডা, গল্প করতে করতে দিন কাটছে । এসবের মধ্যে মাথা থেকে চুরির ঘটনা সম্পূর্ণ উড়ে গেল।


সেদিন দুপুরবেলা ব্যালকনিতে বসে সলিল চৌধুরীর গান শুনছিলেন ধীরাজবাবু । মোবাইলে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে । ফোন কানে দিয়ে বললেন উনি, ‘ ধীরাজ বোস বলছি, কে বলছেন?’
ও প্রান্ত থেকে একটি পুরুষ কন্ঠ ভেসে আসে ,’ আমি বলছি।’
‘আমি মানে? কাকে চাইছেন?’
‘আপনাকেই চাইছি, ধীরাজবাবু!’
‘হ্যাঁ, বলুন কি দরকার!’
‘তারপর ব্যাঙ্গালোর পৌঁছতে নিশ্চয়ই খুব অসুবিধা হয়েছিল আপনাদের?’
‘হ্যাঁ সে তো একটু হয়েছিল। কিন্তু আপনি কে সেটা বলুন আগে!’
‘ট্রেনে আমরাই ছিলাম আপনাদের সহযাত্রী। নাম বলেছিলাম সুবিমল এবং রিতা মিত্র।’


আকাশ থেকে পড়লেন ধীরাজ বাবু। কানে ফোন নিয়ে চুপ করে বসে থাকলেন।
‘অবাক হয়ে গেলেন তো ?শুনে ভাবছেন একজন চোর কিভাবে ফোন করছে?’
একটা দীর্ঘশ্বাস পেলেন ফোনের ওপ্রান্তে ধীরাজবাবু।
তাও কিছু বললেন না শুধু শুনে গেলেন।
শান্তির গলাটি আবার বলল, ‘মানবিকতা আপনাকে ফোন করাচ্ছে ধীরাজবাবু ।ওকে যে জবাবদিহি করতে পারছি না একদম ।গলার কাছটা বদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।’
‘পরিষ্কার করে বলুন কি চান আপনি।’
রাগত স্বরে উত্তর দিলেন।
জানেন আমরা খুব সুখী ছিলাম, একমাত্র মেয়েকে নিয়ে। আমি প্রাইভেটে চাকরি করতাম কিন্তু বেশ সচ্ছল জীবন কাটাতাম আমরা।মেয়ে ছিল আমাদের চোখের মনি।নাচ গান আবৃত্তিতে খুব পারদর্শী সেই মেয়ে। একমাত্র মেয়েকে মহা ধুমধাম করে বিয়ে দিলাম, সোনাদানা সহ অনেক কিছু যৌতুক দিলাম । তা সত্ত্বেও বিয়ের পর থেকেই মেয়ের ওপর শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার শুরু হল আরো টাকা আনবার জন্য। একসময় আর দিতে পারলাম না। একদিন খবর পেলাম মেয়ে গায়ে আগুন দিয়েছে।সব শেষ হয়ে গেল।জীবনে কিছু পাওয়ার থাকল না আর। রোজ রোজ একই জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম আমরা।দুজন অসুস্থ হতে থাকলাম পালা করে, জীবনটা যেন ধুকতে ধুকতে চলছিল। ডায়াবেটিস ধরা পড়ল দুজনেরই। চিন্তা আমাদেরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত হলাম, সারারাত জেগে কাটাতাম সিলিংএর দিকে তাকিয়ে।আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছিলাম, পারিনি । তখন ভাবলাম এমন একটা জিনিস করতে হবে যাতে ওটার প্রতি শুধু নজর থাকে।এই চিন্তাকে যে কোনোভাবে দূর করতে হবে জীবন থেকে।
হঠাৎ একদিন রাগের মাথায় এই বুদ্ধি মাথায় এল যে, লোকের থেকে টাকা চুরি করে ঘুরে বেড়াব দেশ-বিদেশ। নিজেদেরটা সহায় বলতে শুধুমাত্র এই বাড়ি। ভাবলাম এরকম করলে সব সময় ধরা পড়ার একটা ভয় থাকবে মনে, এই বুঝি পুলিশের হাতে ধরা পড়লাম। তাতে কিছুটা হলেও মেয়ের চিন্তা খানিকটা লাঘব হবে।’
ধীরাজবাবু শুধু শুনে চলছেন।
‘আমাদের হারানোর আর কিছু ছিল না ।জীবনটা শেষ হয়ে যাওয়ার আগে একটু বাঁচতে চেয়েছি একসঙ্গে। মেয়ের শোক ভুলতে চেয়েছি ,পন্থাটা ভুল জানি । কিন্তু বিশ্বাস করুন ধীরাজবাবু ,আমরা পারছিলাম না।’
একটা চাপা কান্নার আওয়াজ পেলেন ধীরাজবাবু , ও প্রান্ত থেকে।
‘আমার ফোন নাম্বার এটাই। আপনার মোবাইলে যেটা ছিল তা ভুল ।আপনি চাইলে পুলিশকে জানাতে পারেন। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকুন। আপনার মেয়েকে দুহাত ভরে আশীর্বাদ করলাম। নতুন জীবনে অনেক সুখী হোক আমাদের মা।’

‘কিগো কার সঙ্গে এতোক্ষণ কথা বলছিলে ? ছোড়দি ফোন করল নাকি?’
চমকে গেলেন ধীরাজবাবু।
‘কি ভাবছ, কার সঙ্গে কথা বলছিলে?’
‘তুমি চিনবে না, আমার এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে।’
স্ত্রী চলে যাওয়ার পর মোবাইলে নাম্বারটা দেখতে গিয়ে স্ক্রিনে ভেসে উঠলো ওদের তিনজনের মুখ, সস্ত্রীক ধীরাজ বাবু আর ওদের একমাত্র মেয়ে তিথি। কদিন পরেই বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। বাবা-মায়ের সঙ্গে গলা জড়াজড়ি করে কী হাসছে মেয়েটা!!


1 thought on “short-story-sunnosthan-puron

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *