short-story-meye-mohol-2

মেয়েমহলের একটি অলস দুপুর (ধারাবাহিক)

সুস্মিতা কুন্ডূুুুুুুুুুু

(৭)

“অ টুসু! ক’ না রে। কী হইসে? এই বুড়ি ঠ্যাকমাটাকে মন খুলে ক’ হক্কল কথা”
অশীতিপর ঠাকুমার কোলে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে টুসু চুপ করে। ভিজে চুলের গোছায় জীর্ণ শীর্ণ কোঁচকানো চামড়াওয়ালা ক’টা আঙ্গুল পরম স্নেহে ঘোরাফেরা করতে থাকে।
টুসুর মনের ভেতরে আগুন জ্বলছে। সারা শরীরটায় কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। অটোতে ঐ নোংরা লোকটা, ছিঃ ছিঃ! বাবার বয়সী লোকটা, তার পাশে বসেছিল অটোতে। কলেজে শেষের দুটো ক্লাস হয়নি, ম্যাডাম আসেননি বলে। তাই দুপুরবেলায় অসময়ে বাড়ি ফিরছিল আজ। বাস থেকে নেমে একটা ফাঁকা অটোও পেয়েছিল। পরের স্টপ থেকে একজন মাঝবয়সী লোক উঠে পাশে বসছিল ওর। তিনজনের সিটে দুজন বসার ফলে বেশ খালি জায়গা থাকা সত্ত্বেও লোকটা কেমন যেন গায়ে উঠে আসছিল। ক্রমশঃ ডানদিকে সরতে সরতে আর জায়গাও ছিলনা সরার মত। মুখচোরা স্বভাবের টুসুও বলতে বাধ্য হয়েছিল,
“একটু সরে বসুন না!”
অটোওয়ালাটা যেন আয়নার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে পেছনের সিটে টুসুর দুরবস্থাটা উপভোগ করছিল। লালচে পানের ছোপ ধরা দাঁতের নোংরা একটা হাসি দিয়ে লোকটা বড়জোর দু’ইঞ্চিটাক সরে বসেছিল বাঁদিকে। কয়েক মিনিট ডানদিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল টুসু হঠাৎই বাঁদিক থেকে মৃদু মৃদু ঝাঁকুনিতে চমকে ঘাড়টা ঘোরাতেই লোকটার সাথে সটান চোখে চোখ পড়ে গেছিল। মনে হ’ল যেন চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে ওকে। টুসুর সাথে চোখ মিলতেই লোকটা অদ্ভুতভাবে ইশারা করতে লাগল। স্বাভাবিক প্রতিবর্ত ক্রিয়ার নিয়মেই লোকটার ইশারা অনুসরন করে টুসুর চোখ চলে গেছিল লোকটার কোলের দিকে।
সঙ্গে সঙ্গে ঘেন্নায় গা’টা রি রি করে উঠছিল ওর। একটা নাইলনের বাজারের ব্যাগ কোলে রেখে তার আড়ালে লোকটা… ওর চোখে পড়তে ব্যাগটা সরিয়ে নোংরামিটা আরও প্রকাশ করেছিল লোকটা। টুসু চিৎকার করে উঠেছিল আর থাকতে না পেরে,
“থামান অটোটা! আমি এখানেই নামবো।”
অটোওয়ালা সব বুঝেও না বোঝার ভান করে বলে,
“দিদি আপনার স্টপিজ আসতে দেরি আছে তো অ্যাখুনো!”
চোখ বুজে দিগ্বিদিগিক জ্ঞান শূন্য হয়ে চেঁচিয়েছিল টুসু ফের,
“থামান বলছি!”
অটোর ডানদিকের দরজার রেলিংটা কোনওমতে টপকে, ওদিক দিয়েই নেমে পড়েছিল। বাঁদিকে আর ঘাড় ঘোরাতেও বমি পাচ্ছিল। নামার সময় অনুভব করল ওর পাছায় একটা নোংরা হাত কেউ মুছে দিল।

তখনও প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা বাকি, সামনে একটা রিক্সা পেয়ে কোনও কথা না বলে দৌড়ে উঠে পড়েছিল টুসু বাড়ি ফিরেই আগে স্নানঘরে গিয়ে ঠাণ্ডা জলই মাথায় ঢালতে শুরু করে। পরণের চূড়িদারটা ঘেন্নায় দুমড়ে মুচড়ে বাথরুমের এক কোণে ছুঁড়ে দিয়েছিল। কাকীমণির সাথেও কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না, কারোর সাথেই না। নিজের ঘরে গুম হযে বসে রয়েছে তখন থেকে।

এই বুড়ো মানুষটাকে কী বলবে ভেবে পায়না টুসু। কোলে মুখটা গুঁজে ঠাকুমার আঁচলের আমসত্ত্ব আমসত্ত্ব গন্ধটা বুকভরে নিতে থাকে। মনে হয় আবার ছোট্টটি হয়ে আমসত্ত্ব চুরি করে বেড়ায় সারা দুপুর। যেখানেই যাক মা বাবার হাত ধরে যাবে। কোনও শয়তান লোক এরকম নোংরামি করতে পারবে না। কেন যে বড় হ’ল টুসু! পুরুষমানুষ দেখলে এবার থেকে ঘৃণায় মনটা ভরে যাবে ওর। আবার চোখ ছাপিযে কান্না আসে।

(৮)

-“আরে অ মেয়ে! তহন থিক্যা শুধু কাঁদছস! বল কী হইসে!”

নাতনীর চোখের কষ্টটা বড্ড চেনা লাগে শশীবালার। কী হয়েছে মেয়েটার সাথে, না জানা অব্দি দুর্বল হৃৎপিণ্ডটা যেন বুকের খাঁচার মধ্যে ছটফট করছে। কী অঘটন ঘটল মেয়েটার সাথে! মা মঙ্গলচণ্ডী কি তবে আরও একবার ব্যর্থ হ’লেন সরকারবাড়ির বৌ-ঝিয়ের মান বাঁচাতে?

অনেক স্মৃতি বিবর্ণ হয়ে গেছে বয়সের ভারে তবুও দাগগুলো আজও টাটকা। নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে সরকারকত্তার হাত ধরে এদেশে এসেছিল, কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে।
না সে রাতে কাঁটাতারের আঁচড়ে গা চেরেনি, চিরেছিল ক’দিন আগের এক রাত্রে, শশীবালার স্বামী নীরেন্দ্রনাথের অনুপস্থিতির সুযোগে যখন বাড়িতে কয়েকজন মনুষ্যরূপী পিশাচ চড়াও হয়েছিল। তাদের মুখ দেখতে পায়নি তখনের তিন সন্তানের মা, সোমত্থ বয়সের শশীবালার, তাদের ধর্ম কী তা আজও জানেনা কমলা। তবে পাপের কোনও ধর্ম হয়না, পাপীর কোনও জাত হয়না, এই সারসত্যটা সেই নির্মম রাতে বুঝে গিয়েছিল শশী। সারারাত ধরে ওই লোকগুলোর কামনা লালসার বারংবার শিকার হয়ে ভোরবেলায় প্রায় অচৈতন্য শরীরটা টানতে টানতে গেছিল পুকুরঘাটে। বারবার ডুব দিয়ে, গায়ে মাটি ঘষে শুদ্ধ করতে চেয়েছিল নিজেকে।

আজ তাই টুসুরে স্নানঘরে ওভাবে পাগলের মত দৌড়ে ঢুকতে দেখে বুকের মধ্যে যে অ-কালবোশেখি শুরু হয়েছে তা চট করে থামার নয়।

শশীবালাও আশ্রয় খুঁজেছিল স্বামীর বুকে, কিন্তু মেলেনি। স্বামীর স্পর্শে আর সেই স্নেহ মমতা পায়নি আর কোনওদিনের জন্য, চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল সেই বন্ধন। নীরেন্দ্রনাথ কেমন যেন ঘৃণা করতেন শশীকে। শরীরের তাড়নায় যখন মিলিত হ’তেন স্ত্রীর সাথে, তখন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখতেন। শশীবালা আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারেননি বা নীরেন্দ্রনাথ স্ত্রীকে তাড়িয়ে দিতে পারেননি শুধু একটাই কারণে। রূপেন, হীরেন আর ধীরেনের মুখ চেয়ে। এই ঘটনার ক’দিন পরেই পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে নিজের দেশের, গ্রামের, ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি দিলেন ওঁরা। মনে মনে কষ্টের সাথে একটু আনন্দও পেয়েছিলেন শশীবালা। ভেবেছিলেন এই পরিবেশ থেকে দূরে গেলে হয়ত নিজে ভয়াবহ ওই স্মৃতিগুলো থেকে মুক্তি পাবেন এবং স্বামীর সাথে নতুন করে সব শুরু করতে পারবেন।

কিন্তু সব বন্ধন কেটে যেতে পারলেন কই? ধোঁয়াশা ঘেরা, প্রশ্নচিহ্নে ভরা, একটা দুঃস্বপ্নের বীজ গর্ভে করে নিয়ে গেলেন। না, শশী জানেন না পরেশ নীরেন্দ্রনাথের ঔরসজাত সন্তান কী না। কারণ ঐ ঘটনার আট’মাসের মাথায় পরেশের জন্ম। যদিও ঘটনার দু’রাত্তির আগে অব্দিও নীরেন্দ্রনাথ তাঁর স্বামীর অধিকার নিয়মিতভাবেই ফলিয়েছেন, তবুও এই সন্তান তাঁর, এটা কোনওদিনই স্বীকার করেননি তিনি। এমনকী যখন পরেশের নাম দাদাদের নামের সাথে মিলিয়ে বীরেন রাখতে চেয়েছিলেন শশীবালা, নীরেন্দ্রনাথ মত দেননি। উনিও বুক ঠুকে বলতে পারেনা যে সন্তানটি নীরেন্দ্রনাথেরই।

জন্মদুর্ভাগা ছেলেটার কপালও এমনি যে বেচারা মায়ের মুখের আদল হুবহু নিয়ে ধরাধামে এসেছে। কথায় বলে ‘মাতৃমুখী বেজায় সুখী’, কিন্তু পরেশের সেটাই কাল হ’ল। দাদাদের মুখের আদলে বাবার সুস্পষ্ট ছাপ থাকলেও পরেশে একেবারেই মায়ের মত দেখতে তাই তার জন্মরহস্যের এস্পার ওস্পার হ’ল না। একটা কাঁটার মত বিঁধে রইল বাপের গলায় সে। মাও প্রাণখুলে স্নেহ করতে পারেনা সে ছেলেকে।

তারপর সেই যে ছোটোখাটো চাকরি জুটিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে কোন ছোটো বয়সে আর ফিরল না। শশীবালার সন্দেহ হয় নীরেন্দ্রনাথই পরেশকে ডেকে ওর জন্মবৃত্তান্ত শুনিয়েছেন, মুখচোরা ছেলেটি লজ্জায় ঘৃণায় মাটিতে মিশে বিদায় নিয়েছে চিরতরে এই সরকার বাড়ি থেকে। সাথে সাথেই তাকে সব সম্পত্তির অধিকার থেকেও বঞ্চিত করেছেন তার ‘বাবা’। নাতনীটাকে দেখলে পরেশের কথা বড্ড মনে পড়ে। ওরা একে অপরকে দেখেনি কিন্তু টুসুর মুখের আদল একেবারে পরেশের মত, স্বভাবটাও মুখচোরা একইরকম।

কী যে হ’ল মেয়েটার! বড্ড অন্যরকমের আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো। ওদের মনের নাগাল পাওয়া বড় কঠিন।

(৯)

ল্যাপটপটা কোলে নিয়ে সোফায় অলসভাবে বসেছিল কৌশানী। শীতের দুপুরে বাড়িতে থাকলে কেমন গা ম্যাজম্যাজ করে। এর থেকে কলেজে গিয়ে ক্যান্টিনে বসে একটা সিগারেটে টান দিতে পারলে হ’ত। বাড়িতে তো তারও উপায় নেই। মা সামনে এসে এমনভাবে তাকাবে যেন কোনও ডাকাত বা খুনীকে দেখছে। আর রাত্রে বৌদি ফিরলেই কানে তুলবে, তখন একগাদা জ্ঞান শুনে কান ঝালাপালা হবে। যে কৌশানী মৈত্রকে উঠতে বসতে ছেলেরা প্রেম নিবেদন করে তাকে বাড়িতে এরকম দুগ্ধপোষ্য শিশুর ম’ত ট্রিট করা হয় জানলে, ওরা মনে হয় প্রোপোজাল ফেরত নিয়ে নেবে সব।

মাঝে মাঝে মনে হয় ছোড়দা এই সো কলড মিত্তিরবাড়ির থেকে বিদেশে পালিয়ে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। সব কিছু যেন বড্ড নিয়মে চলে এই বাড়িতে। রাশভারী উকিল বাবা, অত্যন্ত রকমের চিন্তান্বিত আতঙ্কিত মা, সফল দাদারা, পারফেক্ট দশভূজা বৌদি…
না একটু ভুল হ’ল পারফেক্ট নয়, বৌদি মা হতে পারেনি আজও। আর সেই শিশুর অভাবেই বুঝি বাড়ির সবথেকে ছোটো কৌশানীকেই সবাই শিশু মনে করে এখনও। অবশ্য ছোড়দার বিয়ে হয়ে বাচ্চাকাচ্চা হ’লে…
তবে ছোড়দা ওই বৈদেহী বলে গুজরাটি মেয়েটার সাথে বিদেশে লিভ টুগেদার করে। ও কোনওদিন আর দেশে ফিরবে বলে মনে হয় না। বাড়ির আর কেউ এটা না জানলেও কৌশানী জানে। বৈদেহী, আমেরিকান ওই ছেলেটা অ্যাস্টন আর ওই মারাঠি মেয়েটা অদিতি, এসেছিল সবাই দুর্গাপুজোর সময়, ছোড়দার সাথেই।

ওদের কথাবার্তা অভ্যাস সব দেখে বোঝা যাচ্ছিল বিদেশের স্বাধীনতাটা ওরা কতটা উপভোগ করে। এত বাধানিষেধে দমবন্ধ করে থাকতে হয় না। মা বৌদি যে কৌশানীর খারাপ চায় তা নয়, তবু প্রতি পদে ওকে নজরে রাখা অসহ্য লাগে। এই তো সেবার যখনই ও অ্যাস্টনের সাথে হেসে কথা বলছিল, মায়ের ভুরুটা কুঁচকে যাচ্ছিল আর বৌদির কাছে গিয়ে কীসব বলছিল। খানিকবাদে বৌদি ওকে কিছুনা কিছু কাজের অজুহাতে ডেকে নিচ্ছিল।
বিরক্তিকর!

অ্যাস্টনের দিক থেকে বিপদ আসতে পারে ভেবে বাড়ির লোকেরা ভয়ে ভয়ে থাকলেও বিপদ এসেছিল অন্যদিক থেকে। লক্ষ্মীপুজোর পরের দিন যেদিন ওদের রাতের ফ্লাইটে ফিরে যাওয়ার কথা, হঠাতই সেদিন দুপুরে ফাঁকা ঘরে কৌশানীকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিল অদিতি। কৌশানীর জীবনে এই স্পর্শটা অনাঘ্রাত নয়, তবে আরেকটা মেয়ের থেকে, এটা ও অনুধাবন করেনি। ঘটনাটায় ও যত না বিস্মিত হয়েছিল তার থেকে বেশি অবাক হয়েছিল এটা অনুভব করে যে, ওর ভালো লেগেছে ব্যাপারটা। একটা অন্যরকম ভালো লাগা, সারা শরীরের শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে যাওয়া মাদকতা। এর পরের অনেকগুলো দুপুর ওই স্মৃতির রোমন্থন করে, বুকের ভেতরটা তিরতির করে কেঁপে উঠেছে কৌশানীর।

ল্যাপটপে ফেসবুকে লগ-ইন করে কৌশানী, অদিতির প্রোফাইলে যায়। কভারে অদিতির ছবি, আরেকটি মেয়েকে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে রয়েছে। স্টেটাসে লেখা ‘ইন আ রিলেশনশিপ’।
কৌশানী আপন মনে মৃদুগলায় বলে ওঠে,
“শি কেম আউট অফ দ্য ক্লোজেট ফাইনালি! ইয়েস শি ডিড।”

(১০)

ক্লোজেটে হ্যাঙ্গারে দামী কাশ্মীরি শালটা ভাঁজ করে যত্ন করে ঝুলিয়ে রাখে নীলিমা। আজ মেয়েটাকে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেরী হয়ে গেল বড্ড। প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজতে যায়। সদর দরজা দিয়ে ঢোকার সময় সরলাদি, পদ্মদি আর মুকুজ্জেবুড়ির সাথে দেখা হল, বাড়ি ফিরে যাচ্ছে ওরা। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে নীলিমার ওদের সাথে দুপুরে ছাদে বসে আড্ডা দিতে। কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানির এমন কাজের চাপ যে ছুটি তো দূর ওভারটাইম করতে পারলে ভালো হয়।

তার ওপর ওই ডিভোর্সী বনাণী! বুকের খাঁজ দেখিয়ে, পাছা দুলিয়ে বড়সাহেবকে হাতের তালুবন্দী করে ফেলেছে প্রায়। সব কাজ নীলিমা করে আর ক্রেডিট ও নিয়ে যায়, হতচ্ছাড়ি বেহায়া মেয়েছেলে। মাথাটা গরম হ’তে থাকে নীলিমার। ছেলে কলিগগুলোও ওর এফিসিয়েন্সি নিয়ে আজকাল কথা শোনায়। ঐ তো সেদিন অ্যাকাউন্টস টিমের রজত বলে নতুন চ্যাংড়া ছেলেটা বলেই দিল,
“নীলিমাদির দ্বারা কি আর টাইমে ফাইলে ডেটা এন্ট্রি হবে? মনটা যে মেয়ের কাছেই পড়ে রয়েছে!”
যদিও কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে নয় কিন্তু তাই বলে এটাও সত্যি নয় যে নিজের কাজে ফাঁকি দেয় নীলিমা। দুধের শিশুকে মায়ের জিম্মায় রেখে এসে কাজ করতে বসলে কতটাই বা মনোসংযোগ করা যায়। তবুও চাকরিটা ছাড়তে মন চায়না। নিজের অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে মনে হয় স্বাবলম্বী হওয়ার ওই অবলম্বনটুকু।

মেয়েটার কান্নায় চমক ভাঙে নীলিমার। রীতেন্দুর আসার সময় হয়েছে, কী করে যেন মেয়েটা বাপের আসার সময়টা ঠিক টের পেয়ে যায় আর ছটপট করে। যতক্ষণ না বাপ এসে কোলে নিচ্ছে এই ফোঁপানি চলবে। নাহ্ রীতেন্দু মেয়ে বউকে সত্যিই বড় ভালোবাসে। নীলিমা গলা তুলে ডাকে,
“ও চাঁপার মা, মিলির কাঁথাগুলো তুলে এনেছো? নইলে ঠাণ্ডা কনকনে হয়ে যাবে কিন্তু।”

“হ্যাঁ গো! ঐ তো সব গুচিয়ে রেকেচি তাকটায়।”

একটু অন্যমনস্ক চাঁপার মায়ের গলাটা, যদিও সেটা এ বাড়ির কেউই খেয়াল করে না। একরত্তি ছেলেটাকে ঘরে চাঁপার বাপের কাছে রেখে এসেছে। লোকটার ডানহাতটা ট্রেনে হকারি করতে করতে, দুপুরের গ্যালপিং লোকাল থেকে ঝাঁপ দিয়ে নামতে গিয়ে ছেঁচড়ে যায় ট্রেন আর প্লাটফর্মের মাঝের ফাঁকটায়, পচে ঘা হয়ে শেষে কেটে বাদ দিতে হয়। তবে বাঁহাতে সবই একটু একটু করে পারছে আজকাল। ছেলেটার বড্ড জ্বর এসেছিল কাল রাত্রে, সেজন্যই বেশি চিন্তা হচ্ছে।

চাঁপা মরে ইস্তক মনটা একটুতেই কু ডাকে বড়। ডেঙ্গুতে পনেরদিন ভুগে চাঁপা চলে যাওয়ার ছ’বছর পর যখন ছেলেটা হ’ল তখনও সবাই ওকে চাঁপার মা বলেই ডাকত। লোকে একবারও ভাবত না এই ডাকটা ওর বুকে কতটা শূলের মত বেঁধে। ছেলেটা হ’তে তাই চাঁপার বাপ ছেলের ডাকনামও রাখল চাঁপা। বলেছিল,
-“বুঝলি মণি, ঐ নামটাই থাক ছেলের। তবে আর তোর কষ্ট হবে না কেউ তোকে ‘চাঁপার মা’ বলে ডাকলে।”

গলাটা বুজে এসেছিল মণির মানে চাঁপার মায়ের, তাদের এই বস্তির ঘরে আর কোন পুরুষমানুষ আছে যে এত ভালোবাসে তার বৌকে! সেই ভালোমানুষটাই হাত খুইয়ে যেন কেমনপারা হয়ে গেছিল। তবে হাল ছাড়েনি মণি, নিজের ঘাড়ে সব দায়িত্ব নিয়ে সুস্থ করে তুলছে মানুষটাকে ধীরে ধীরে।

সরকারবুড়ির কাছে বুড়োকত্তার পুরনো কটা গরমজামা থাকলে চাইতে হবে মানুষটার জন্য। ছেলেটার জন্যও মিলিসোনার পুরনো সোয়েটার চাইতে হবে কটা। না এ চাওয়ায় লজ্জা নেই চাঁপার মায়ের।

ধীরে ধীরে সদর দরজায় খিল দিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ায় চাঁপার মা। মজলিশ ভেঙে সবাই যে যার বাড়ি গিয়ে ‘মনের মানুষ’ চালিয়েছে। এ বাড়িতেও টি. ভি. অন হয়েছে, ডাইনিং-এ। তাড়াতাড়ি চার বারং আটচল্লিশ সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করে ও। ছাদের সব গুছিয়ে তুলে বুড়ির সন্ধের প্রদীপ ধূপ রেডি করে যদি শেষটা দেখতে পায়, ললিতার মিথ্যে আজ ধরা পড়ল কী না!

(১১)

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাঁপার মা নাইলনের মাদুরের প্রস্থের দিকটা ধরে ঝাড়ে, ঢেউ খেলে যায় নীল সাদা মাদুরের গায়ে। গোধুলীর কনে দেখা আলোয় মনে হয় নীল সমুদ্দুরের ঢেউয়ে দোলা খাচ্ছে আকাশের সাদা মেঘ। কিছু গুজব ধুলোবালির মত ছড়িয়ে পড়ে ছাদময়। খেজুর পাতার ঝাঁটা দিয়ে একটু পরেই সেগুলো ঝেড়ে ছাদের কোনে জমা করবে চাঁপার মা। কিছু গল্প ফের মাদুরের কাঠির ফাঁকে মোড়া হয়ে যায় পরের দিন বুড়োকত্তার ঘরের গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লকের ‘ঢং ঢং ঢং’-এর অপেক্ষায়।

কে জানে কয়েক বছর পরের আর একটা শীতের দুপুরের গল্পটা হয়ত একটু অন্যরকম হবে। ললিতা হয়ত তখনও রাহুলকে পাওয়ার জন্য আলোর বিরুদ্ধে প্যাঁচ কষতেই থাকবে। কিন্তু টুসু আর কৌশানী হয়ত তখন ব্যস্ত থাকবে ভিসার ইন্টারভিউ নিয়ে। দু’জনেই যে একসাথে প্রিপারেশন নিয়ে জি. আর. ই. তে ভালো স্কোর করেছে। খুব ভালো বন্ধু এখন ওরা। হয়ত বা বন্ধুর থেকেও খানিক বেশি।

আর সরলা! সে তো তখন মস্ত আঁতেপ্রেনিওর। সরলার বিয়ে হলনা এতটা বয়স গড়িয়ে গিয়েও, সবাই সেটা দেখতেই এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে ভুলেই গেছিল ও খুব ভালো রাঁধুনি। দোনোমোনো করতে করতে শেষে মুকুজ্জেবুড়ির ঠ্যালা খেয়ে নিজের ঘরোয়া ‘সরলা লাহার হেঁশেল’ চালুই করে ফেলল। অফিসের চাকুরিওয়ালাদের জন্য টিফিনের সার্ভিস। মুকুজ্জেবুড়ি কত রকমের নতুন ধরনের আইটেমও শেখায় পুরনো দিনের। আর শীতের মরশুমে বুড়ির স্পেশাল রেসিপির আস্কে পিঠে আর মোহনপুলির তো বিশাল ডিমাণ্ড। তবে সরলাকে পঞ্চাশজনের অনুষ্ঠানে খাওয়ার সাপ্লাই দেওয়ার প্রথম বড় কন্ট্রাক্টটা কিন্তু বোসবাড়ির পদ্মাবৌদিই দিয়েছেন, ছেলের আশীর্বাদের।

কোনও এক দুপুরে গাড়িটা নিয়ে বেরনোর সময় ঊর্মি হয়ত পাশের ড্রাইভিং সিটে বসা সীতাংশুকে বলবে
-“একটু দাঁড় করাও না গাড়িটা।”
জানলার কাঁচ নামিয়ে সরকারবাড়ির ছাদের দিকে তাকিয়ে হেসে হাত নাড়বে। সেখান থেকে প্রত্যুত্তরে হাত নাড়বে রমলা। অনেকগুলো উলের সোয়েটার রমলা বুনে ঊর্মির হাতে দিয়েছে যে অনাথ আশ্রমের বাচ্চাগুলোর জন্য। গাড়িটা এগিয়ে গেলে, বিনতা রমলা সৌরজা তিন জা মিলে আলোচনা করবে,
“সত্যি ঊর্মির মত মানুষ হয় না। নিজের সন্তান নেই তো কী হয়েছে কতগুলো অনাথ বাচ্চার মুখ থেকে ‘মা’ ডাক শুনছে মেয়েটা।”

ঠিক তখনই সীতাংশু আলতো করে হাতটা রাখবে পাশের সিটে বসা নিজের স্ত্রীর হাতে, যার জন্য গর্বে ওর বুকটা ভরে থাকে।
ও হ্যাঁ আজ আসলে আলম ওর মেয়ে জুবিনকে বড় স্কুলে ভর্তি করাতে গেছে, তাই সীতাংশুই ড্রাইভ করছে। অবশ্য ও ছুটি থাকলে প্রায়সই যায় ঊর্মির সাথে। জুবিনের স্কুলে আমাদের বাবুসোনাও ভর্তি হতে গেছে বাবার হাত ধরে, সৌরজা অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছে।

চাঁপার মা ছাদের মাদুর ফের গুটোতে থাকে স্বপ্নরা গল্পরা গুজবরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে দেওয়ালির ফুলঝুরি থেকে ঝরে পড়া আলোর রোশনাইয়ের মত। মাথার ওপরের আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বোয়িং 777-300ER এয়ারবাস। ইকনমি সিটের জানলা দিয়ে নীচের মেঘের দিকে চেয়ে আছে প্রিয়াংশু হয়ত। পাশে মেমবউ, ইণ্ডিয়া দেখতে চেয়েছে যে। অনেকটা সামনের বিজনেস ক্লাসে বসে আছে মধ্যবয়সের পরেশ। দেশে ফিরছে বহুবছর পর, মায়ের সামনে গিয়ে একবার দাঁড়াতে চায় শুধু।

(১২)

কী ভাবছেন? বড্ড গাঁজাখুরি স্বপ্ন, অবাস্তব ভবিষ্যৎ। হয়ত তাই! মেয়েমহলের কত অলস দুপুরই তো এরকম গুজবেই কেটে যায়। স্বপ্ন বোনা হয় ৯ নং উলের কাঁটায়। কখনও আসনের বকুলফুল নকশায় ফুটে ওঠে না বলা কাহিনী। চটের ধূসর টুকরোয় ঠিক ঘর গুনে গুনে ভরাট হয় যত না পাওয়া ফাঁকফোকর।

রেসিপির নুন মরিচের পরিমাপের আদানপ্রাদানের মধ্যে দিয়ে স্বপ্ন দেওয়ানেওয়ার ব্যবসা চলে। হিরো হিরোইনের দুঃখ কষ্টের বা আনন্দের গাথায় মধ্যবিত্তর গল্পগুলো জায়গা করে নেয়, নাকি উল্টোটা? এক দুপুরে নদীর জলের মত বয়ে যায় কতগুলো জীবন। আমরা নিকোনো মাটির দুয়ার দেখি, আল্পনা দেখি, মূর্তির গায়ে গর্জন তেলের চমক দেখি, কিন্তু আসল গল্প জড়িয়ে থাকে খড় বিচালী কাঠামোয়। সূর্য অস্তাচলে যায়, আশা দিয়ে কাল আবার হবে। সব গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আরেকটা দিন আছে। সব ছড়িয়ে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য আছে আরও কিছু সময়।

সামনের পেয়ারা গাছটার শুকনো পাতা উড়িয়ে বাতাস ফেলে সরকারবাড়ির ছাতে। ওইতে লেখা হবে কালকের গল্পগুজব।
কুলোর ওপর মেলা বিউলির ডালের পোস্ত ছড়ানো গয়না বড়িগুলো তুলে নিয়ে যায় চাঁপার মা। ইসস আজ দেরী হয়ে গেল তুলতে। কাঁচের বয়ামের গা দিয়ে গড়ানো আচারের সর্ষের তেল জিভে লাগিয়ে, টাকরায় ‘চটাস’ করে আওয়াজ বাজিয়ে তড়িঘড়ি পালায় উত্তুরে বাতাস। এক্ষুণি চাঁপার মা আবার সব তুলে নিয়ে চলে যাবে নইলে ‘পরে।

(সমাপ্ত)

মেয়েমহলের একটি অলস দুপুর (ধারাবাহিক) এর প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন


 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *