short-stories-udbhranto

উদভ্রান্ত শূন্যতা

নাহার তৃণা

এত সর্তক থাকার পরও আচমকা শক্ত এক থাবায় বন্দী হবে তার বাড়ানো হাত, সেটা ভাবেনি জনি।
…………..
অসুস্থ বাপজানের ওষুধের পেছনে বাড়তি খরচ হওয়ায়, গতরাতে ওদের ভরপেট খাওয়া হয়নি। কাজে রওনা দেবার আগে পাউরুটি কলা খেতে অনিচ্ছুক বাপজানকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে জনি, ‘আইজ কাম ভালা হইল ভরপেট খিচুড়ি আর আন্ডা খাইম।’ এমন জমজমাট আনন্দের দিনে জামাতে জড়ো হওয়া মানুষের খেয়াল কিছুটা আনমনা হবার কথা। প্রথম জামাতে সুবিধা করতে পারেনি বলে দ্বিতীয় জামাতের জন্য অপেক্ষায় থাকবার পর বওনিতেই আচমকা জনি বমাল ধরাটা খেলো। বাপজান সাথে থাকলে এমনটা হতো না হয়ত। দু’দিন ধরে জনি’র বাবা কানা রমজানের ধুম জ্বর।

জনি আর ওর বাপজান, ঢাকা শহরের বিভিন্ন মসজিদ থেকে জুতা চুরি করে। বছর গড়াতে চললো ওরা একাজে নিযুক্ত। মকবুল মিয়ার দলের হয়ে কাজ করে জনিরা। সাধারণত, এসব কাজে একই এলাকার মসজিদে ঘন ঘন যাওয়ার নিয়ম নাই। গতকাল মাগরিবের ওয়াক্তে মাদানিয়া মসজিদ থেকে মাত্র দু’জোড়া পুরানো স্যাণ্ডেল হাতাতে পেরেছিল জনি। লোকজন ঈদের শেষ পর্যায়ের বাজার সওদায় ব্যস্ত থাকার কারণে, প্রতিদিনের চেয়ে জামাতে লোক কম ছিল। উৎসব ঘিরে হাভাতে সংসারের মুখ নাড়া থেকে বাঁচতে যে সমস্ত মানুষ, যারা হয় পাড়ার চা বিড়ির দোকান বা মসজিদে আশ্রয় নিয়ে থাকে, তেমন কিছু মৌসুমি মুসল্লি আর হাজিরা না দিয়ে থাকা অসম্ভব খোদা ভীরু নামাজি ছাড়া মসজিদে তেমন ভিড় ছিল না। কাজে সুবিধাও হয়নি তাই। জনি মওকা মতো দু’জোড়া পুরনো স্যাণ্ডেল বগলদাবা করে সটকে পড়েছিল।

কাজ শেষে স্যাণ্ডেল জমা দিতে গেলে চোরাই মাল জমাকারী কাদের মিয়া স্যাণ্ডেল দু’জোড়ার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে পাশে বসে পান চিবাতে থাকা মকবুল ওস্তাদের চোখের ইশারা মতো তিনটা পাঁচ টাকার নোট জনির শার্টের পকেটে গুঁজে দেয়। পাশ থেকে মকবুল ওস্তাদ প্রশ্ন করে,

-কি রে জইন্যা, আইজও তর বাপে আইবার পারলো না? কাইল ঈদের দিন, জামাতে বাপ পুতে একলগে গেলে কত সুবিদা পাইতি। জুতা সাফায়ে তর বাপ বহুত কামেল। রমজান মিয়া আর কাম পাইলো না। অহনই জ্বরজ্বালি বাদাইল।’

ভুল কিছু বলেনি ওস্তাদ। বাপজান এসব কাজে সত্যিই তুখোড় লোক। মসজিদে ঢুকে টার্গেট মুসল্লির সেজদায় যাওয়ার অপেক্ষা মাত্র, চোখের পলকে কেম্নে যে বাপজান জুতা স্যাণ্ডেল গায়েব করে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। জনির মাঝে মাঝে বুক কেমন ধড়ফড়ই করে। বাপজান সঙ্গে থাকলে লোকজনের সন্দেহ জাগে না তেমন। খামোখা প্রশ্নের সামনেও পড়তে হয় না। অনেক মসজিদেই আজকাল ‘জুতা চোর হতে সাবধান। নিজ দায়িত্বে জুতা হেফাজত করুন’ ইত্যাদি লেখা সাইন বোর্ড ঝুলতে দেখে। মসজিদে মসজিদে লোকজনও কেমন সাবধানী হয়ে গেছে। কিছু লোক আছে তাদের মতো ছোটো ছেলেদের একা দেখলে চোখে কেমন সন্দেহ নাচিয়ে চেয়ে থাকে। সে চোখের ভাষা বেশ স্পষ্ট। নামাজ পড়তে আসা হইছে, নাকি অন্য কোনো মতলবে! দু’একবার ওরকম দৃষ্টির সামনে পড়ে জনি ভয়ে কাবু হয়নি তা না। সেরকম সময়ে দ্রুত কলঘরে গিয়ে ওজু করার ভান ধরে জনি।

একটা সময় জনি গ্রামের স্কুলে পড়ার পাশাপাশি মসজিদের বড় হজুরের কাছে কোরান শিক্ষাও নিয়েছে। গোটা কতক সুরা, ওজু আর নামাজের নিয়ম তার জানা। সে রকম পরিস্হিতিতে পড়ে গেলে ঘটা করে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। জনির মা পারতপক্ষে নামাজ কাজা করেনি কখনও। ছেলেকে যত্ন নিয়ে নামাজ শিখিয়েছিল। খুব খোদা ভক্ত ছিল জনির মা কুসুম। সব সময় বলতো “আল্লারে ঠিক মতো ডাকলি তিনি ঠিক সাড়া দেন। তাঁরে বিশ্বাসের পুরস্কার দেন নিজ হাতে।” কিন্তু এত ভক্তির কোনো জাগতিক পুরস্কার কুসুমের ভাগ্যে জুটেনি। বরং উল্টো গণপিটুনিতে মরতে হয়েছে। সেদিন আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করা ডাকে খোদা নামের কোনো অস্তিত্বের দেখা পায়নি কুসুম। পাওয়া হয়নি তার বিশ্বাসের পুরস্কারও। মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নে মায়ের থেঁতলে যাওয়া শরীরটা দেখে জনি। বাকি রাতটা আর ঘুম আসে না তার চোখে।


জনিরা যখন গ্রামে, রমজান তখনও সুস্হ দু’চোখের মালিক। গ্রামে ঘরামির কাজ, ক্ষেতে কামলা খাটার কাজ, যখন যে কাজে ডাক পড়তো, সেটা করতো রমজান। গতর খাটিয়ে যা রোজগার হতো তাতে সংসার কোনো মতে একরকম চলেই যেত। মঙ্গা কবলিত এলাকা বিধায় খরার পেটে ফসলের মাঠ চালান হয়ে গেলে কাজকামের ডাক তেমন আসতো না বড় একটা। কাজেই রমজানের রোজগারও বন্ধ থাকতো প্রায়। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। সে জ্বালা জুড়াবার আশায়, আর যে কোনো একটা কাজ জুটে যাবেই এমন আকাঙ্খা, রমজানকে বউ বাচ্চাসহ ঢাকা শহরে টেনে আনে।

কিন্তু তিনটা দিন পার করেও সামান্য একটা কাজের হদিশ পেতে ব্যর্থ হয় রমজান। শহরের ফুটপাতে খেয়ে না খেয়ে কোনো ভাবে তিনটা দিন কাটিয়ে দেবার পর রমজানের পক্ষে বউ-ছেলের শুকনো মুখ সহ্য করাটা চরম কোনো শাস্তির মতো মনে হয়েছিল। সে শাস্তির জ্বালা ভুলতে গিয়ে আরও বড় ভুলে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। চলতি পথে লোকের পকেটে হাত রাখার উপযুক্ত মূল্যও তাকে চুকাতে হয়।

শহর ঢাকার বাতাসে উড়তে থাকা নানান কিসিমের হুল্লোড়ে কিছু হুজুগে লোক বিনোদনের খোরাক খুঁজে নিতে জানে। সে রকম কিছু লোক পকেট মারতে গিয়ে বমাল ধরা পড়া রমজানকে পেয়ে মহা উৎসাহে তার উপর কিল ঘুষি বর্ষণের উৎসবে মেতে ওঠে। ছেলের কাছে খবর পেয়ে স্বামীকে বাঁচানোর তাগিদে ছুটে আসা কুসুম সেই উন্মত্ত জনতার উৎসবের মুখে বোকার মতো নিজেকে সঁপে দেয়। চোরের সাক্ষী গাঁটকাটার উপযুক্ত শাস্তি দেবার লোকের অভাব হয়নি। একেই রোগাভোগা তার উপর টানা অনাহারের শরীর, সইবে কেন এতটা অযাচিত আপ্যায়ন!

ততক্ষণে জনগণের কিছু অংশ যথাযথ আইন প্রয়োগ করে রমজানের একটা চোখ উপড়ে নেয়ার কর্তব্যটা দ্রুত সেরে ফেলেছে। বেঁচে যাওয়া চোখটা দিয়ে ক্ষত বিক্ষত কুসুম লুটিয়ে পড়ছে, দৃশ্যটা দেখতে দেখতে অমানুষিক যন্ত্রণায় জ্ঞান হারায় রমজান। পাক্কা দু’দিন পর সরকারি হাসপাতালের বিছানায় রমজান চোখ মেলে। দু’চোখে অভ্যস্ত রমজানকে একচোখ হারানোর বাস্তবতা স্বীকার করে নিতে হয় চুপচাপ। কুসুমের পক্ষে আচমকা অতটা মার সহ্য করা সম্ভব হয়নি। সেদিন অকুস্হলেই তার মৃত্যু ঘটে। অচেনা শহরে নতুন আগত, উপরন্তু বাবা জ্ঞানহীন, নিতান্তই শিশু জনির পক্ষে মৃতের সৎকার সম্ভব না। সবদিক বিবেচনা করে স্হির হয় কুসুমের সৎকারের ভার আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামকে দেয়া বাস্তব সম্মত। এমন সিদ্ধান্ত, কাজে রূপ দেবার জন্য যথেষ্ট কাঠ খড় পুড়িয়ে তবেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে রাজী করাতে সম্মত হয় মকবুল মিয়া। কর্তৃপক্ষ দয়াপরবশ হয়ে কুসুমেরর লাশের ব্যবস্হা করে।

২.
সেদিনের ঘটনার পরপরই ভিড় ঠেলে মকবুল মিয়া উদয় হয়। রমজানকে হাসপাতালে নেয়া,কুসুমের সৎকারের ব্যবস্থা, জনিকে নিজের কাছে রাখা ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় সে দেখভাল করেছে জানতে পেরে মকবুল মিয়াকে খোদার পাঠানো ফেরেশতা মনে হয় রমজানের। মানবিকতার চেয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই মকবুল মিয়া সেদিন উপযাচক হয়ে এগিয়ে এসেছিল। ঢাকা শহরে গ্রাম থেকে আগত হাভাত মানুষদের মধ্যে থেকে শক্ত সবল যোগ্য লোক যাচাই বাছাই করে দলের জন্য সংগ্রহ করার কাজে ট্রেনস্টেশন, বাসস্টপে বছরে বার কয়েক হাজিরা দেয় মকবুল মিয়া। উদ্ভূত পরিস্হিতিতে মকবুল মিয়ার বুঝে নিতে সময় লাগেনি কামলা খাটা পরিশ্রমি শরীরের রমজান আর শিশু জনি মোক্ষম শিকার। তাদের চক্রে এরকম ভাসমান মানুষ নিয়ে নানামুখী কর্মকাণ্ড ক্রিয়াশীল। উপযক্ত ট্রেনিং পর্বের পর দক্ষতা অনুযায়ী এদের কাজে নিযুক্তের ব্যবস্হা আছে। বাপ ব্যাটা সেই থেকে মকবুল মিয়ার অপরাধী চক্রের সদস্য।

এক চোখ হারানোর কারণে রমজানের নতুন নামকরণ হয়ে যায় কানা রমজান। বাসস্টপ, রেলস্টেশন ইত্যাদি স্থান থেকে বেখেয়ালি মানুষজনের জিনিসপত্তর হাপিশ করা, মসজিদে জুতা চুরি, ইত্যাদি কাজে কানা রমজান অল্প দিনে নিজের দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হয়। দুঃসহ স্মৃতি জড়িত থাকায় পকেটমারার কাজে তাকে কিছুতেই রাজী করানো যায়নি। হাত সাফায়ে রমজান পুরনো অনেকের চেয়ে বেশ ভালো, ওকে অন্য বড় কাজে লাগানোর গোপন পরিকল্পনা থাকায় রমজানের ইচ্ছার বিরোধীতায় যেতে চায়নি মকবুল মিয়া। রমজানকে ওর মতো কাজ করার স্বাধীনতা দিয়ে আপাতত সময়কে গড়াতে দিচ্ছে।

ঢাকা শহরে যত মসজিদ আছে, মকবুল মিয়াদের মতো চক্রের নানান গ্রুপের বিভিন্ন সদস্যেরা সেখান থেকে জুতা চুরি করার পর সেগুলো টুকটাক মেরামতি, রঙ বা পালিশ করে ঢাকার বিভিন্ন ফুটপাতে, চোরাই বাজারে বিক্রি করা হয়। এক এলাকা থেকে চুরি যাওয়া জুতা স্যাণ্ডেল বিক্রি হয় অন্য এলাকার ফুটপাত বা চোরাই বাজারে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব কাজ যারা করে, চুরির বখরার বেলায় অনেক সময় তাদের ন্যায্য হিস্যা দেয়া হয় না। গল্পচ্ছলে মাঝে মধ্যে অন্যান্য দলের সদস্যরা এমন ক্ষোভ ঝাড়লেও মকবুল মিয়ার দলের সদস্যদের এ নিয়ে তেমন একটা ক্ষোভ নাই। অন্যদের চেয়ে মকবুল উস্তাদের মনটা তুলনামূলক দয়ালু।

বেশি দিন হয়নি জুতা পালিশ ছেড়ে জনিকে সরাসরি চুরির কাজে লাগানো হয়েছে। ভয়টা যেন পুরোপুরি কাটেনি ওর। ঈদের বিরাট জামাতে ছেলেটা বাপ ছাড়া একা কতটা সুবিধা করতে পারবে এটা নিয়ে খানিক চিন্তাগ্রস্ত মকবুল মিয়া। জনির এলাকার আশেপাশে যারা কাজে যাবে তাদের একজন আকবর এই বলে মকবুলকে আস্বস্ত করে,
-ডরাইয়েন না উস্তাদ। ঈদের দিন পাবলিকের দিল বহুত খুশ থাকে। জনি সেয়ানা বাপের পুলা, ঠিক পারবো।
-জইন্যা ধরা পইড়্যা গেলে কি করন লাগে মনে রাহিস কিন্তুক। দম আটকাইয়া শরীল একদম টাইট কইরা রাখবি।

জনির উদ্দশ্যে কথাগুলো বলে আতর মাখা টুপি মাথায় চড়িয়ে মকবুল মিয়া নিজেও ঈদের নামাজে শরিক হবার উদ্দেশ্যে বিপরীত মুখী মসজিদের দিকে হাঁটা দেয়।

জনি ঈদগাহে পৌঁছাবার কিছু আগেই প্রথম জামাতের নামাজ শুরু হয়ে গেছে। জায়গা না পেয়ে এককোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে নতুন কাপড় জুতায় সজ্জিত মানুষগুলোকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে। জামাতের অধিকাংশ লোকই যার যার জুতা সেজদার জায়গাতে রেখে নামাজে দাঁড়িয়েছে। খোদার ভয়ের চেয়ে জুতা চুরির ভয়ে কাবু থাকে লোকজন। ব্যাপারটায় জনির কেমন হাসি পায়। হয়ত আনমনা হয়েছিল খানিক, মানুষের ঠেলা ধাক্কায় খানিকটা সরে দাঁড়ায়। ওর বয়সী কিছু বাচ্চা ছেলে নামাজ শেষে একে অন্যের সাথে কোলাকুলি করছে দেখে জনির বুকটায় কেমন জানি করে। ওর মনে ইচ্ছা জাগে কেউ ওর সাথেও কোলাকুলি করুক। কিন্তু ওদের ঝকঝকে চেহারা, সুন্দর পোশাকের পাশে নিজেকে কল্পনা করতেই ইচ্ছাটা উবে যায়। মাইকে দ্বিতীয় জামাতের ঘোষণা শোনা যাচ্ছে। খামোখাই ভাবালুতা ঝেড়ে ফেলে জনি যুতসই জায়গা দখলে মনোযোগ দেয়। তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করতে থাকে সুবিধাজনক টার্গেট।

নতুন জুতা সেজদার কাছে নিয়ে বসে থাকা দু’জন দয়ালু চেহারার লোকের পাশের জায়গা খালি পেয়ে বসে পড়ে জনি। নামাজ শুরু হলে তক্কে তক্কে থাকতে হবে কখন সেজদায় যায় সবাই। বাপজানের শেখানো বুদ্ধিমত সবাই রুকুতে যাওয়া মাত্র মনে মনে এক দুই তিন গোনার প্রস্তুতি নিতে থাকে। দশ কি পনেরো গোনার আগেই ঝট করে জুতা নিয়ে চোখের পলকে সরে যাওয়া লাগবে। জনি ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশটা দেখে নেয় একবার। নামাজ ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। পেছনের দিকটায় আরেক বার আড়চোখে তাকায়। ওদিকটা দিয়ে পালানোই সুবিধাজনক মনে হয় তার। সুরা পড়া শেষ, এবার রুকু থেকে সেজদা… জনি মনে মনে গুনতে শুরু করে এক… দুই… তিন…

লোকটার জুতা জোড়া বেশ দামী। পাশের জনেরটাও তাই। একসাথে দু’জোড়া নেয়া গেলে কেল্লা ফতে… সেজদায় যাওয়া মাত্রই জনি ঝটিতি হাত বাড়ায় জুতার উদ্দেশ্যে। আচমকা শক্ত একটা থাবা উড়ে এসে ওর ছোট্ট হাতটা খপ্ করে ধরে ফেলায় কেমন থতমত খেয়ে যায় জনি। হাতটা শক্ত মুঠোতে ধরেই লোকটা বাকি নামাজ শেষ করে। চট করে দেখলে মনে হবে অবাধ্য ছেলে নামাজ ফেলে হুট করে অন্য কোথাও যেন পালিয়ে না যায়, তাই বুঝি বাবা শক্ত মুঠোয় ছেলের হাত ধরে রেখেছেন।

নামাজ শেষ হওয়া মাত্রই লোকটা বাজখাই গলায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে,
-এই হারামির বাচ্চা তোকে আমি প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছি। নামাজে বসে খালি উশখুশ। তোর সাথের লোকজন কই বল?
সজোরে থাপ্পড় এসে পড়ে গালে। আশপাশ থেকে জুটে যায় অনেকেই…কোলাকুলি ভুলে গলা তুলে উৎসাহী কেউ কেউ…
– বড় সাহস তো! নিশ্চয়ই এ একা না। সাথের সাঙ্গপাঙ্গরা আশেপাশেই আছে। পিঠে কিছু পড়লেই গড়গড় করে বলবে।

জনতা জনির মুখ থেকে গড়গড় করে স্বীকারোক্তি বের করানোর উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত।

ধরা পরার পরবর্তী সময়টা কিভাবে পার করতে হয় সে ট্রেনিংটা থাকা সত্ত্বেও ঘটনার আকস্মিকতায়, আতঙ্কে জনির দম কেমন আটকে আসতে থাকে। জড়ো হতে থাকা অতি উৎসাহী লোকগুলোর আসন্ন সম্মিলিত কিল ঘুষির ধকলটা সামাল দেয়া তার পক্ষে কতটা সম্ভব সেটা ভেবে, মকবুল উস্তাদের যাবতীয় উপদেশ ভুলে, নিয়ম মতো শরীর শক্ত করার বদলে ওর লকপকে শরীরটা কেমন শিথিল হয়ে পড়ে। উদভ্রান্ত শূন্যতায় ডুবে যেতে যেতে চকিতে একবার মায়ের থেতলে যাওয়া ক্ষত বিক্ষত মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। জ্বর শরীরে একলা ঘরে পড়ে থাকা বাপজানের কথা মনে হয়। আজ রাতে বোধ হয় বাপজানের আর খাওয়া হবে না….

ঈদের আনন্দঘন পরিবেশে পড়ে পাওয়া বাড়তি আনন্দে শরিক হওয়া উৎসাহী জনতার ক্ষুধার্ত হাত জনির শরীর লক্ষ্য করে নেমে আসতে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *