বিশুদা,
আজ তোমার কথা মনে পড়ছে।কলকাতায় এখন সদ্য সন্ধ্যা। আড্ডার চূড়ান্ত মুহূর্ত।তোমার চায়ের দোকান বন্ধ রেখেছ তো? করতেই হবে। করোনা ভাইরাস জব্দ করে দিল তোমার মত দাপুটে মানুষকে?
আমিও ঘরে বসে কাজ করছি।মাঝে মাঝে বাইরে চলে যাচ্ছে চোখ।আসছে গ্রীষ্মকাল। পোর্টল্যান্ডের বিথ্ণী শহর পাহাড়ের উপর।প্রকৃতি সাজিয়ে তুলছে চারিদিক ধীরে ধীরে।কী অদ্ভুত মায়াময়! বাঁচতে ইচ্ছে করে অনন্তকাল।পৃথিবী এমন সুন্দর,ভাবিনি কখনো।
আমেরিকায় আছি আজ অনেক বছর। কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে বন্ধু বৃত্ত – সব জায়গায় শুভব্রত সান্যাল জনপ্রিয় নাম।
পরিবারের কাছেও স্বামী এবং বাবা হিসেবে নিখুঁত। জীবনের প্রতিটি স্টেপ আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।যে কোনো চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে কখনো পিছিয়ে আসিনি। যাদবপুরে ইঞ্জনিয়ারিং পড়ার সময় তুমি বলতে:
লোকের ভরসা হবি, শুভ। ভার নয়।
সব ঠিক আছে বিশুদা। জো জিতা ওহি সিকন্দর … এ মন্ত্র জানা আছে আমার। তবু মনটা পাগলা হয় কেন ?এমন মার্সিডিজ গাড়ি, এমন বিশাল বাড়ি, কোটি টাকা… সব ছেড়ে উধাও হতে চায় ডুংরি নদীর ধারে!
বিশুদা, ওই শুভকে এখন ভীষন হিংসে হচ্ছে , জানো? ছেঁড়া নোংরা জিন্স, মুখে রুক্ষ দাঁড়ি , রোগা, কালো জ্বলজ্বল চোখের , নদীর জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে গিটার বাজানো ছেলেটার কিছুই ত ছিল না। কিস্যু না। স্রেফ তুমি আর গিটার।
রেগে গেলে? তনুর কথা বলিনি বলে? তনুর কথা মুখে বলতে হবে ? আমার রক্ত বলবে। আমার শ্বাস বলবে।বালিশ ভেজা প্রতিটি রাত বলবে। আলহাদী চঞ্চল ডুংরি নদীর তীরে ,খোলা আকাশ, সোনা গলা চাঁদের আলো, সাদা সাদা নুড়ি পাথর আর তনু। সমস্ত ধমনীতে বেজে ওঠে বাঁশি। তনুর হাতে প্রাণ পেত বাঁশের বাঁশি। কোথায় যেন ডুবে যেত মেয়েটা। বাঁশির সুরের মূর্ছনায় , সাদা পোশাকের তনু, ঠিক যেন স্বপ্নে দেখা আলোর পরী। যার চারিদিকে কোনো মলিনতা নেই। কোনো তুচ্ছতা নেই। নেই হতাশা। যেন ভালোবাসার গাছ। আমার আশ্রয়।
আমেরিকায় চলে আসার আগে বলেছিল:
জোর করব না। সম্ভব হলে ফিরে এসো।
– তুমি চলো আমার সঙ্গে। প্লিজ তনু।
– আমার অনেক দায়িত্ব গো। দেশ ছাড়তে পারব না।
নিষ্ঠুরের মত বলেছিলাম –
ভালোবাসা ছাড়তে পারবে?
আহত পাখির মত চোখ তুলে তাকিয়েছিল তনু।
আমি তোমাকে কত যে চাই।কত গভীর থেকে চাই।শুভ, তোমার প্রতিটি দিন ভরিয়ে রাখতে চাই। কিন্তু, সব চাওয়া, পাওয়া হয় না গো।
পাগলের মত চুমু খাচ্ছিলাম সেদিন। তনু আর থাকবে না? তনুর মাখন কোমল জোছনা শরীর ভিজিয়ে দেবে না আমার পৌরুষ? সেদিন প্লাবন ডেকেছিল নদীতে।ভেসে গিয়েছিল সব বাঁধ। আর তনু? মাটির মত মুখ বুজে গ্রহণ করেছিল আমার সমস্ত আবেগ!
বিশুদা,
তনু ঠিক বলেছিল। চাওয়া আর পাওয়ার মাঝে হিসেবে অনেক গরমিল থেকে যায়। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশে জমি দখল করার লড়াই করতে করতে ,অবহেলায় কোথায় হারিয়ে গেল ছোট্ট গ্রামের ধুলো মাটি পাথর আর সরল প্রেম। মনে যখন পড়ল, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর ফিরে যাওয়া যায় না!
জীবন বড় জটিল বিশুদা। মাকড়সার জালের মত গোল গোল বৃত্তে আটকে রাখে। সাফল্যের চটচট জালে আটকে থেকে, নিজেকে সুখী ভাবতেই ভালো লাগত এতকাল। তবে, আজ কেন এমন হল? বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে মৃত্যুর করাল থাবা। ধস নেমেছে শেয়ার মার্কেটে। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করছে মানুষ। যে ভাবেই হোক ফিরিয়ে আনব পুরনো পৃথিবী। এ অঙ্গীকার করে চলেছি ভিতর ভিতর।
সব চলছে। তবু, কেমন একলা লাগে। এতদিন যা কিছু অর্জন করেছি, কেমন মূল্যহীন লাগছে আজ। ভালো লাগে না। কিচ্ছু ভালো লাগে না!
অদ্ভুত ঘটনা কি বলো তো? এইরকম ভুলভাল হতাশার মেঘ যখন ঘিরে ধরে, দম বন্ধ করে দিতে চায়, ঠিক সেই সময় ভেসে আসে বাঁশির সুর।মেঘ সরিয়ে ভিজিয়ে দিতে থাকে ভালোবাসার বৃষ্টিজলে।শঙ্কিত মনের জমি আবার উর্বর হয় বৃষ্টির স্পর্শে। কে যেন ভিতর থেকে বলে, পারব। পারতে আমাদের হবেই।
বিশুদা,
ভরসা রেখো।
তোমার সিকন্দর হারতে শেখেনি। জিতব আমরাই।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন
বাঃ কী সুন্দর!
ভালো লাগলো।
Oshadharon…. ekta Darun lekha..