রিদি বলল, অফিস যখন যাচ্ছ না তখন বাজার থেকে ঘুরে এসো। বাড়িতেই তো বসে আছ!
সকাল। শাবিন ডাইনিংয়ে বসে আছে। সে টোস্টারে পাউরুটি টোস্ট করেছে। ডিমপোচ করেছে। নাস্তা শেষ করে এককাপ গ্রীন-টি নিয়ে বসেছে। তখন রিদি ঘর থেকে বের হলো। শাবিন বলল, অফিস থেকে আমি ছুটি নিইনি। ওয়ার্ক ফ্রম হোম। জরুরি রিপোর্ট লিখতে হবে। সাবমিট করার লাস্ট ডেট আজ।
রিদি বলল, আমাকে তুমি চাকরি করতে দাওনি কেন জানো?
তোমাকে আমি চাকরি করতে দিইনি কথাটা ঠিক না। তুমি চাকরি করোনি।
আমি চাকরি করলে তোমার এই অফিস নিয়ে নয়ছয় মার্কা ভুজুংভাজুং ওপেন হয়ে যেত। বাজারে যাও।
বাড়ির সামনে ভ্যানে লাউ, পটল, শাক কী কী সব বিক্রি হচ্ছে। দারোয়ানকে টাকা দাও, এনে দেবে।
তুমি হচ্ছো একজন পাড় অলস।
কী বলছ তুমি! বাজারে না গেলেই একজন মানুষ অলস হয়ে যায়?
তুমি র’চা খাও, ব্ল্যাক কফি, গ্রীন-টি খাও। কেন খাও?
লিপিড, কোলেস্টেরল ঠিক রাখার জন্য দুধ-চিনি ছাড়া চা খাই। গ্রীন-টি শরীরের জন্য খুবই উপকারি।
তুমি একটা ভ-টাইপের মানুষ। সত্য কথা বলার সাহস তোমার নেই। তুমি চায়ে দুধ-চিনির পরিমাণ ঠিক করতে পারো না বলে র’চা খাও। গ্রীন-টি বানানোতে কোনো ঝামেলা নেই। গরম পানিতে টিব্যাগ চুবিয়ে দিলেই হলো। তুমি তাই করো।
বুয়া এসেছে। ঘরে ঢুকে সে খানিকটা থমকে গেল। বাড়ির বাইরের দরজার দুটো চাবি। একটা চাবি শাবিনের কাছে থাকে। আরেকটা চাবি থাকে বুয়ার কাছে। বুয়া এসে বাড়ির কাজ করে রেখে চলে যায়।
বুয়া বলল, ভাইজান, অফিস যান নাই? শরীর খারাপ?
শাবিন নিস্তেজ গলায় বলল, ওয়ার্ক ফ্রম হোম। বাড়িতে বসে অফিসের কাজ করব। আজ কী রান্না হবে?
বুয়া বলল, ফ্রিজে মাছ আছে। দেখি সামনে ভ্যানে সবজি কী পাওয়া যায়।
চায়ে চুমুক দিয়েছে শাবিন। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঠান্ডা গ্রীন-টি খাওয়া যায় না। বেশি তেতো লাগে। শাবিন বলল, যাওয়ার আগে আমাকে এক কাপ চা দিয়ে যেয়ো।
শাবিন উঠে ধীর পায়ে বেডরুমে চলে গেল। সেখানে বসে ল্যাপটপে কাজ করবে।
রিদি হাঁটুমুড়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে। শাবিনকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলল, দরজা বন্ধ করে এসি অন করে দাও।
শাবিন ঘরের দরজা বন্ধ করে এসি অন করে দিলো। এসি থেকে কেমন অদ্ভুত ঘুটঘুট ধরনের শব্দ আসছে।
রিদি বলল, তিতুন সোনা আজ আমরা কোন ছড়াটা বলব? আম পাতা জোড়া জোড়া, মারব চাবুক চড়ব ঘোড়া, ওরে বুবু সরে দাঁড়া, আসছে আমার পাগলা ঘোড়া..
শাবিন রিদির মুখোমুখি চেয়ারে বসতে বসতে বলল, রিদি শোনো, আমাদের কোনো সন্তান নেই। যার আসা কথা ছিল সে আসেনি। তোমার গর্ভে তার মৃত্যু হয়েছে। এই সত্য তোমাকে মেনে নিতে হবে।
থমকে গিয়ে স্থির চোখে তাকিয়েছে রিদি। সে কঠিন গলায় বলল, তুমি একটা মিত্থুক।মহামিত্থুক। ফাজিল টাইপের মানুষ।
বলেই ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো। বিছানায় গোল হয়ে বসে বলল, আয় তিতুন, আমরা রাজা-প্রজা খেলি। তুই হচ্ছিস রাজা, আমি প্রজা। কাপড় দিয়ে আমার চোখ বেঁধে দেওয়া হবে। প্রজারা তো কিছু দেখতে পায় না। রাজা যা বলে তাই করে। আমার চোখ বাঁধা হয়ে গেলে তুই করবি কী…
শাবিন অবাক হয়ে দেখল রিদি ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে একা একা কথা বলছে। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় রিদির গর্ভে সন্তান আসে। সাড়ে চার মাসের মাথায় সেই সন্তান মিসক্যারেজ হয়ে যায়। তারপর থেকে রিদি অস্বাভাবিক আচরণ করে। সে তার সন্তানকে দেখতে পায়। কথা বলে। আদর করে। রিদি তার সন্তানের নাম রেখেছে তিতুন। একজন মনোচিকিৎসক রিদিকে দেখছেন। রিদির স্বাভাবিক হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
রিদি গলায় ঝুলানো ওড়না খুলে শাবিনের হাতে দিয়ে বলল, আমার চোখ বেঁধে দাও তো। শোনো, তুমি কিন্তু তিতুনকে কিছু বলে দেবে না। সে আমাকে ফাঁকি দিয়ে উলটাপালটা ইন্সট্রাকশন দেবে। আমি যদি তার ভুলভাল ইন্সট্রাকশন ধরে ফেলতে পারি তাহলে তিতুন প্রজা হবে আর আমি হব রাজা।
বুয়া কফি নিয়ে এসেছে। দুধ চিনি দিয়ে বানানো গাঢ় কফি। বুয়া বলল, ভাইজান, ঝিম ধরে বসে আছেন কেন? অফিসের কাজ করবেন বললেন!
ক্লান্ত চোখ তুলে শাবিন তাকাল। বুয়া বলল, কফি বানাই আনছি আপনার জন্য। নম্বর ওয়ান কফি। হোটেলে গেলেও এই কফি পাইতেন না। কফি দিছি তিন চামচ। দুধ-চিনি সমান-সমান। দুই চামচ। ফাস্টে কাপে কফি, দুধ আর চিনি নিছি। তার ভেতর অল্প একটু গরম পানি দিয়ে দিছি ঘুটা। ঘুটতে ঘুটতে কাদা বানাই ফেলছি। তারপর কাপের ভেতর একটু একটু করে আগুন গরম পানি ঢালছি আর ঘুটছি। ঘুটা শেষ হইলে ওপরে খানিকটা গুঁড়া কফি ছিটাই দিছি। কফিতে চুমুক দেন তারপর বলেন টেস্টের খবর কী।
শাবিন বলল, কফি খাব না। অফিস যাব।
অফিসে যাওয়ার ড্রেস পরে ল্যাপটপ হাতে নিয়ে শাবিন বের হয়ে গেল।
সন্ধ্যারাত টেলিভিশনে ইংরেজি সিনেমা হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সিনেমা। শাবিন আগ্রহ নিয়ে সিনেমা দেখছে।
রিদি বলল, খবর দাও। দশ বছরের এক শিশুর লাশ পাওয়া গেছে। কেটে ষোলো টুকরা করে বস্তায় ভরেছে।
শাবিন বলল, বীভৎস কোনো খবর দেখতে বা শুনতে আমার ভালো লাগে না।
রিদি বলল, তুমি একজন এসকেপিস্ট। সত্যের মুখোমুখি হতে চাও না। জীবনের সব ভয়ংকর ঘটনা এড়িয়ে যেতে চাও।
আমার ভালো লাগে না।
পালিয়ে বাঁচা যায় না। বেঁচে যদি থাকো। তাহলে মানুষ হয়ে বাঁচার চেষ্টা করো। সত্যকে ফেস করো। এভোয়েড করো না। তুমি কি কাপুরুষ, কাউয়ার্ড?
প্লিজ এভাবে বলবে না। আমার খারাপ লাগে।
তাহলে সাহসটা দেখাও। যা ঘটে গেছে তা বাস্তব। তাকে সত্য বলে মেনে নাও।
শাবিন প্রায় চিৎকার করে বলল, আমাদের কোনো কন্যা নেই সেই সত্যকে তাহলে তুমি মেনে নিচ্ছ না কেন?
রিদি শীতল গলায় বলল,আমাদের একজন কন্যা আছে। তার নাম তিতুন। সেই সত্য তুমি বারবার কেন এড়িয়ে যেতে চাইছ?
ডোর বেল বাজছে। শাবিন উঠে গিয়ে বাইরের দরজা খুলে দিলো। রবিন এসেছে। শাবিনের ছোটো ভাই। সে শাবিনের থেকে বয়সে দুই বছরের ছোটো। তবু শাবিন তাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করে। রবিন গুছিয়ে চিন্তা করতে পারে। সেইমতো কাজ করে। তার বাস্তব জ্ঞান অত্যন্ত প্রখর।
রবিন ড্রয়িংরুমের সোফায় বসতে বসতে বলল,আগামীকাল কোরআন খতম দেওয়া হবে। মাদ্রাসায় কথা বলেছি। সকালে দশজন ছেলে আসবে। তারা এখানে বসে কোরআন শরীফ পড়বে। দুপুরে খাবে। খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগামীকালের জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়েছ তো?
শাবিন বিস্মিত গলায় বলল, আগামীকাল তো আমরা বাড়িতে থাকব না। তোর ভাবি আর আমি যাব গোলাপ বাগানে। প্যারাডাইস রোজ নামে এক গোলাপের সন্ধান পাওয়া গেছে। অসাধারণ ফুল!
রবিন চুপ করে আছে। তার কষ্ট হচ্ছে। মন খারাপ হয়েছে অতিরিক্ত।
শাবিন বলল, যাবি তুই আমাদের সাথে। বেশি দূরে না, কাছেই। গাড়ি নিয়ে যাব।
রবিন শান্ত গলায় বলল, আগামীকাল ভাবির মৃত্যুবার্ষিকী।প্রথম।
শাবিনের চেহারায় আচমকা এলোমেলো ভাব চলে এসেছে। তাকে উদভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে। রিদির ব্রেইন ক্যান্সার হয়েছিল। ডাক্তার ছয়টা কেমো দিয়ে টিউমার অপারেশন করবেন বলেছিলেন। চারটা কেমো নেওয়ার পর রিদি মারা গেল।
শাবিন থমথমে গলায় বলল,এ বাড়িতে কিছু করার দরকার নেই। রিদি এখানে আছে। এখানে কিছু করতে গেলে রিদি জেনে যাবে। সে আর এখানে থাকবে না। চলে যাবে। আমরা একসাথে আছি। ভালো আছি।তুই যা।
শাবিনের দুই চোখ পানিতে ভরে গেছে। চোখের পানি উপচে পড়ার আগে রবিন উঠে পড়ল। সে এখন একজন মনোচিকিৎসকের খোঁজে যাবে। আগামীকাল শাবিনকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন
খুব ভাল লাগলো!!