short-story-apurba-nibas

অপূর্ব নিবাস
রম্যাণী গোস্বামী

নামের বাহার থাকলে কী হবে, এখন আর সে মোটেই রূপবান নয়। বরং ভাঙাচোরা, মলিন এবং হতশ্রী চেহারা হয়েছে তার দিনে দিনে। হাইওয়ের পাশের ছোট্ট একতলা বাড়িটিকে একসময় আদর করে ঘিরে রেখেছিল তিনটি মাঝারি আয়তনের পুকুর। তাদের আয়নার মত স্বচ্ছ জলে ছায়া পড়ত পুকুরগুলি ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা মোট বারোটি সুপুরি গাছের। দূর আকাশের ওই সাদা মেঘ ঝাঁপিয়ে পড়ে লুটোপুটি খেত পুকুরের বুকে। সব মিলিয়ে মিশিয়ে এই বাড়ি, পুকুর আর ওই আকাশ যেন একাকার হয়ে যেত। বাড়ির সদস্যদের নিজেদের বাড়িটাকে তখন মনে হত কত বড়!
বিশাল দালান ছাড়িয়ে ঘর দুয়ারে উপচে পড়ত রোদ, উঠোনে বিছানো পাকা ধান খেতে আসত টিয়েপাখির ঝাঁক। সেই উঠোনেই শীতে ডাঁই করা হত লেপ, তোশক, বালিশ। সার বেঁধে সাজানো হত টক ঝাল মিষ্টি আচারের মুখ খোলা সব কাচের বয়াম। মেঝেতে কাপড় বিছিয়ে তার উপরে রোদে দেওয়া হত ঘরে ফেটানো ডালের বড়ি, রঙ বেরঙের পাঁপড়। সেই উঠোনেই কাঠের নড়বড়ে টুল পেতে বাড়ির কর্তার তেল মালিশ, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়া। ছোট বাচ্চার চেঁচিয়ে আওড়ানো নামতার সঙ্গতে চলত রেডিওতে বিবিধ ভারতী।
সুপুরি গাছ এখন আর একটিও নেই। পুকুরগুলোও কোন কালে বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। বাড়িটির চারিপাশে বড় বড় ফ্ল্যাটবাড়ি উঠে যাওয়ার হারিয়ে গিয়েছে সূর্যের আলোর ভিতরে ঢোকার পাসপোর্ট। তাই স্যাঁতস্যাঁতে গর্তের মত খুপচি ঘরগুলোতে দিনের বেলাতেও লো-পাওয়ারের বাল্ব জ্বালিয়ে রাখতে হয়। ওতে ঘরের বাসিন্দাদের মুখগুলি দেখায় নিভে যাওয়া, ফ্যাকাসে ও নিরানন্দ।
সদানন্দবাবুর ঠাকুরদার খুব শখ ছিল যে আধুনিক কেতায় ছেলের নাম রাখবেন অপূর্ব। কিন্তু তার বাবার প্রবল অনিচ্ছায় সেটা সম্ভব হয়নি। পুরুষমানুষের নাম হবে ব্যক্তিত্বময়। নামেই তো চিনে নেবে গোটা দুনিয়া তার মালিককে। যেমন হল গিয়ে রনদাকিশোর, অথবা প্রতাপাদিত্য, নিদেনপক্ষে তরুণকুমার। তা নয়, অপূর্ব! এ আবার কেমনধারা নাম? এসব সখী-পানা নাম কেউ রাখে? দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাপের সামনে দাঁড়িয়ে ঠাকুরদা যৌবনে নিজের যে সাধ পূরণ করতে পারেননি তা তিনি করেছিলেন বৃদ্ধ বয়সে এসে এই বাড়ি তৈরির সময়। আরও একটি সাধ মিটিয়েছিলেন তিনি একমাত্র নাতির নামকরণের সময়। সদানন্দ! যদিও এবারের নামটি একটু সেকেলে, তবু আহা! কী চমৎকার হাসিখুশি নাম।
দুঃখের বিষয় হল এই যে ইদানিং সদানন্দবাবুর মুখে সেই হাসির দেখা পাওয়া যায় কালেভদ্রে। সমস্যা নামে নেই। সমস্যা এই বাড়িতে। ঠাকুরদার আমলের পুরনো বাড়িটাকে উনি না পারছেন ছাড়তে, না পারছেন রাখতে। কী আর করবেন, মৃত্যুর আগে বাবার হাত ধরে কথা দিয়েছিলেন, যতই পুরনো হয়ে যাক না কেন, লোভের বশবর্তী হয়ে কোনওদিনও কোনও প্রোমোটারের হাতে তুলে দেবেন না এই বাড়িকে। যদিও গিন্নীর যথেষ্ট আপত্তি ছিল সেই কথা দেওয়া নিয়ে, কিন্তু তখন তাদের নবীন বয়স, হৃদয় কিঞ্চিৎ উদার, প্রাণে অকারণ পুলক। সারাদিন খিটিমিটি বাঁধলেও রাতে শয্যায় এলে মিটমাট হয়ে যেতে সময় লাগে না। তাই অতশত ভাবেননি। কিন্তু বছর দশ গড়াতেই পরিস্থিতি আমূল বদলালো।
বিশ্বায়নের যুগ। চারদিকে পুরনো বাড়ি ভেঙে পটাপট উঠে যাচ্ছে ফ্ল্যাট। কাঁহাতক এই ভাঙাচোরা বাড়িকে আগলে রাখতে ভাল লাগে কারুর? তার মধ্যে গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্ন, বছরে একটা কী দুটো লেগেই আছে। প্রতিবেশী হোক বা আত্মীয়, প্যাঁচার মত মুখে জোর করে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে গিফট বগলে যেতে হয়েছে আর তাক লেগে যাওয়া চোখে চকচকে টাইলস বসানো মেঝে, দেওয়ালে মোম পালিশ রঙ, আগাগোড়া মার্বেল পাথরের ঠাকুর ঘর, দেড় লক্ষ টাকার মড্যুলার কিচেন দেখতে দেখতে গলায় অতি কষ্টে ঢোকাতে হয়েছে কবিরাজি অথবা ফিস ফ্রাই। রাতে যথারীতি গিন্নির মুখ হাঁড়ি।
ঝুরঝুর করে খসে না পড়ে একদিন, ছাদ ধসে পড়লেই বাঁচি। চাপা পড়ে মরি তিনজনে। শ্বশুরের ভিটায় তো মরেও পুণ্য। তাই না? তাছাড়া এই হানাবাড়িতে ভূতের মত বাঁচার চাইতে মরাও ভাল। দেখলে? সেদিনের ওই বিজয়-শ্যামলী, পুরনোটা প্রোমোটারকে গছিয়ে ওরাও কী সুন্দর উঠে গেল রাজারহাটের নতুন অ্যাপার্টমেন্টে। আর তুমি? উফ্‌… সারারাত গজগজ এবং বিলাপ করছিলেন গিন্নি।
হানাবাড়ি। পাপুনের বন্ধুরা আড়ালে এই নামেই ডাকে না এ বাড়িকে? চুপ করে থেকে মাথা ধরার ট্যাবলেটের সঙ্গে অপমানটা কুলকুচি করে গিলেছিলেন সদানন্দবাবু।
আর আজ? সেই গিন্নির মুখই এখন তেলতেলে ঘিয়ে মাখা লুচির মত। কী ছাই ফোর-লেন না কী যেন একটা রাস্তা হবে। হাই রোডের পাশে সব বাড়ি ভাঙা পড়বে। শিবের বাবার সাধ্যি নেই আটকায়। তা এই ভিটে তো দুদিন পর আপনা থেকেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছিল। বরং ভালই হল, খরচা করে ভাঙতে হবে না। উপরি পাওনা মোটা টাকার সরকারি অনুদান। ভিতরের দিকে জমিও পাওয়া গেছে। সামনে একটুখানি শখের বাগান। আলো বাতাস খেলে এমনি বড় বড় ঘর। খাসা দোতলা বাড়ি উঠে যাবে। মেইন রোড থেকে একটু দূরে হলেও সর্বক্ষণ গাড়ির প্যাঁ-পোঁ নেই। তাছাড়া ধুলো? দিনরাত যতই ঝাড়ো, সমস্ত ফার্নিচারের উপর এক পলতা ধুলো পড়েই থাকত। এখন মুক্তি। ঠাকুর, কে বলে যে তুমি নেই?
মায়ের চাইতেও বেশি খুশি হয়েছে কলেজ পড়ুয়া পাপুন ওরফে প্রিয়তোষ। এতটা বয়স হয়েছে, নিজের একটা ঘর তো দূরের কথা, লুকিয়ে সিগারেটটা ধরানোর মত একটা কোণা পাওয়া মুশকিল এই বাড়িতে। তুলি তো একবার বাথরুমে ঢুকে ওই চারকোণা চৌবাচ্চার ভিতর থেকে একটা কুচকুচে কালো ভেজা হাতকে নড়েচড়ে বেরিয়ে আসতে দেখে ভয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল। এমনিতেই লাইটের যা ছিরি! ঝুলকালি মাখা দেওয়াল যেন আরও বেশি করে শুষে নেয় আলো। অন্ধকারে কী দেখতে কী দেখেছে। পাপুন যাও বা বন্ধুদের প্রথম প্রথম বাড়িতে ডাকত, এই ঘটনার পর লজ্জায় ডাকেনি। তুলিও সেদিনের পর থেকে ভাল করে কথা বলেনা ওর সঙ্গে। শালা! আজই এসে ভেঙে দিক না বুলডোজার চালিয়ে। তারপর আর বাড়ি ফারি নয়, ঝাক্কাস একটা ফ্ল্যাটে চলে যাবে ওরা এই টাকায়। আজকাল বাড়ির কনসেপ্ট তো উঠেই যাচ্ছে। ফ্ল্যাটের দক্ষিণ দিকের বড় খোলামেলা ঘরটা নেবে ও। দেওয়ালে প্লাস্টিক পেইন্ট করাবে মভ রঙের, মডার্ন স্লিক ফারনিচারে সাজাবে নিজের ডেন, তারপর একটা পার্টি থ্রো করবে বন্ধুদের মধ্যে। তুলি হবে যার গেস্ট অফ অনার। এরপরও কি তুলির সঙ্গে ওর ব্যাপারটা জমবে না?
ঘটনা আরও আছে। আজ সকালে বাজারের থলি নিয়ে বেরনোর পথেই তিনটে বাড়ি পরের অর্ঘবাবুকে নিজের চোখে হাউহাউ করে কাঁদতে দেখেছেন সদানন্দবাবু। একতলাটা ভাড়া দিয়ে নতুন দোতলা করেছিলেন ভদ্রলোক মাত্র মাস আটেক হবে। নামী ইন্টেরিওর ডিজাইনার ডাকিয়ে সে এক এলাহি ব্যাপার। ফলস সিলিং, কাচের বারান্দা, দেওয়ালে আর মেঝেতে মহার্ঘ টালি। এখন বোঝো। সরকার যা নির্ধারিত দাম দেবে সেই টাকার অঙ্কটা নেহাতই ফিকে লাগছে নতুন ঝাঁ চকচকে দোতলাটার পাশে। কতগুলো টাকা শুধু শুধু গচ্ছা গেল। এত কাণ্ড করে সঞ্চয়ের সবটুকু ঢেলে দিলেন যার জন্য সেটা ভোগই করা হল না। কয়েকটা মাস আগেও যদি জানতে পারতেন ঘুণাক্ষরে, সঙ্গে সঙ্গে দোতলার কাজ বন্ধ করে দিতেন। একেই বলে কপাল। এখন উকিল ধরে কোর্টে ছোটাছুটি করছেন অর্ঘবাবু আর নিজের কপালকে দুষছেন। সদানন্দবাবুকে দেখেই করুণ মুখে বললেন, আহা দাদা, যদি আপনার মত আমিও একটুখানি ধৈর্য ধরে থাকতাম।
সত্যিই এতদিনের ধৈর্যের ফল মিলেছে। খুব ভাল দাঁও মেরেছেন সদানন্দবাবু। ঠাকুরদার আমলের পুরনো ভাঙাচোরা বাড়িটার হাত থেকে অবশেষে মুক্তি পাওয়া গেল। যা অবস্থা হয়েছিল তাতে এমনিতেই গাঁটের পয়সা খরচ করে লোক লাগিয়ে ভাঙতে হত কদিন পর। কেমন নিজে থেকেই সুযোগটা এসে গেল। একেই বলে কপাল! আত্মীয়-স্বজন, অফিস কলিগ, ছেলের বন্ধুরা, যারা এতদিন দরকারে অদরকারে এই বাড়িতে এসে ঐ ভেঙে যাওয়া কার্নিশ, মেঝের কোনায় কোনায় দেওয়াল থেকে খসে পড়া পলেস্তরার স্তুপ দেখে আঁতকে উঠত ভয়ে এবং বাইরে সমবেদনা মাখানো উৎকণ্ঠা দেখিয়ে মনে মনে ব্যঙ্গের হাসি হাসত, তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করছে যে জিত সদানন্দবাবুরই হয়েছে। অনেকদিন পর আজ শান্তিতে ঘুমোবেন সদানন্দ সরকার।
রাত নিঝুম। শুধু সদানন্দ নয়, বাড়ির সকলেই আজ পরম তৃপ্তিতে ঘুমোচ্ছে। কেবল ঘুমোচ্ছে না একজন। জরাজীর্ণ বাড়িটা। সে ওর ঘোলাটে পিচুটিমাখা চোখে চেয়ে চেয়ে দেখছে এর বাসিন্দাদের। বাহ! কী স্বার্থপর। কী নিদারুণ অকৃতজ্ঞ হতে পারে লোকগুলো। একটুও শোকতাপ নেই? এতদিনের স্মৃতি, বেদনা, আনন্দ, খণ্ড খণ্ড মুহূর্তের কিচ্ছু আর বেঁচে নেই? কোনও অনুভূতিই নেই এদের মনে?
ভাবছে আর ফুঁসছে ‘অপূর্ব নিবাস’। অভিমান ধীরে ধীরে পর্যবসিত হচ্ছে রাগে। উন্মত্ত রাগ সঞ্চারিত হচ্ছে অপূর্ব নিবাসের প্রতিটি ক্ষয়ে যাওয়া ইঁটে, সঞ্চারিত হচ্ছে ওর জং ধরা লোহার বিমে, নড়বড়ে বুনিয়াদে। বাড়িটির মজ্জায়, শিরায় বয়ে যাচ্ছে চরম প্রতিশোধস্পৃহা। খটখট শব্দে নড়ে উঠছে পাল্লাভাঙা কাঠের জানলা, উত্তেজনায় কেঁপে কেঁপে উঠছে রান্নাঘরের জোড়াতালি দেওয়া সিমেন্টের তাক। ঝনঝন করে উঠছে তাকে সাজানো থালাবাসন। বাড়ির মানুষগুলো তবুও নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে। ভাবলেশ। নিরুত্তাপ। ঠিক যেন জড়বস্তু। প্রতিশোধের ইচ্ছেয় একসময় প্রবলভাবে দুলে উঠল অপূর্ব নিবাসের নড়বড়ে দেওয়ালগুলো।
জরাগ্রস্ত বুড়োটা এবার হাসছে খলখল করে।
স্থানীয় সংবাদবার্তার খবর – গতকাল তিরিশে নভেম্বর রাত দুটো নাগাদ শহরের ভয়াল ভূমিকম্পের রিখটার স্কেলের মাত্রা ছিল আট দশমিক দুই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশ কিছু পুরনো বাড়ি ভেঙে পড়ায় অপমৃত্যু ঘটেছে বহু মানুষের।


এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন

10 thoughts on “short-story-apurba-nibas

  1. অপূর্ব । মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক । খুব ভালো লাগলো ।

    1. তোমার ফিডব্যাক পেয়ে ভালো লাগলো দিদি 🙂

    2. তোমার ফিডব্যাক পেয়ে ভালো লাগল আইভিদি

  2. চমৎকার হয়েছে গল্পটি। খুবই বাস্তবসম্মত এবং প্রাসঙ্গিক। আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানালাম রে, রম্যাণী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *