rannaghor-dhakar-purono-khawar

ঢাকার পুরনো খাবার
শাহনাজ ইসলাম
পুরান ঢাকার খাদ্য-পানীয়ে একটা দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে লেগে থাকা আপাত বিলুপ্ত খানদানি আভিজাত্যের সংযোগ একে একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। স্বাদে-গন্ধে-পরিবেশনে এই খাবার ঠিক বাঙালির চিরায়ত খাদ্যের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। তাতে মিশে আছে তুর্কি-মোগল খাদ্যের রীতি। দীর্ঘকালের পরিক্রমায় এসব খাদ্য-পানীয় এবং পরিবেশনার রীতিতেও পরিবর্তন এসেছে।

রাজধানী ঢাকার খাবারের বিশেষত্ব মোঘলাই খাবার, ঢাকাই কাবাব আর বাকরখানি। মুগলরাই এদেশে কাবাবের প্রচলন করে। এটি প্রস্ত্ততের জন্য মাংসের টুকরাগুলিকে মশলা মেখে লোহার শিকে গাঁথা হয় এবং কয়লার আগুনে রেখে ভালভাবে ঝলসানো হয়। বাখরখানি ‘তন্দুর’ অথবা কাঠ-কয়লার আগুনে সেঁকা হয়। কাবাবের সঙ্গে এটি খেতে খুব ভাল।

আটা থেকে তৈরি রুটির খবর পাওয়া যায় বাংলায় তুর্কিদের আগমনের পর পরই। লুচি, পুরির খবরও আসে এই সময়ে। সতের শতকে আলাওলের কাব্যে শিরমাল রুটির কথা আছে। এখন ঢাকাই খাবার বলতে আমরা যেগুলো বুঝে থাকি যেমন_পোলাও, কোরমা, কালিয়া, কাবাব ইত্যাদির চল শুরু হয় সুলতানী আমলেই। পলান্ন অর্থে বিরিয়ানির খবরও পাওয়া যায় এ সময়ে।

সতের শতকের কবি রায়শেখরের লেখায় মিষ্টান্নের তালিকা আছে যেমন_মনোহরা বা প্রাণহরা, রেউড়ি, লাড্ডু, খাজা, পেড়া, সরভাজা ইত্যাদি। পানীয় হিসেবে তরল দুধের ব্যবহার সুপ্রাচীনকালের। মাঠার চলও তদ্রূপই। মিষ্টিদ্রব্য মিশ্রিত পানীয়কে পানা বলা হতো। শরবত এসেছে মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাবে। মোগল আমলে গুজরাটিরা ঢাকায় ছোলার ছাতু দিয়ে নুরজাহানি কাবাব তৈরি করত। এ আমলের শেষদিকে আর্মেনীয়রা এক ধরনের কাবাবের প্রচলন করে, ঢাকায় যার নাম তাশ কাবাব।

বিশ শতকের চকবাজারে বেলের শরবত, তোকমাইয়ের শরবত, ফালুদার শরবতের দোকান ছিল। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় চা পান জনপ্রিয়তা লাভ করে। ঢাকায় তখন বেশ কিছু চায়ের দোকান ছিল। মালাই-ভাসা চায়ের খুব কদর ছিল। ঢাকার নবাববাড়িতে চায়ের চল হয়েছিল এরও বেশ আগে। আসামে তাদের নিজস্ব চায়ের বাগান ছিল। রেস্টুরেন্টের প্রচলন হয়েছিল সে আমলেই। বাঙালি বাবুদের কাঁটাচামচ দিয়ে কাটলেট খাওয়ার খবরও মিলেছে। বিশ শতকের ঢাকার ত্রিশের দশকের খাবার ছিল মাছের কাবাব, মোরগের রেজালা, শরবতি পোলাও, নারগিসি পোলাও ও কাবাবি বাকরখানি। বাকরখানি (শুকনা রুটি) সম্ভবত পাঞ্জাব থেকে এ দেশে চালান হয়ে এসেছে। মিষ্টি, নোনতা, দুধওয়ালা, মাখনওয়ালা- নানা রকম বাকরখানি পাওয়া যেত ঢাকায়। এখনো কিছু কিছু পাওয়া যায়। বিশ শতকের ঢাকার অধিকাংশ বাড়িতেই পনিরের প্রচলন ছিল। কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম পনিরের জন্য খ্যাত ছিল। বাজার ঢাকায় ছিল বলে লোকে একে ঢাকাই পনির বলত।

গরিবরা চর্যাপদের আমলেও খুদের জাউ খেত, এখনো পুরান ঢাকার গরিবরা পুরি খায়। তবে যাদের বদৌলতেই হোক বার্গার, হটডগের ধাক্কা সামলেও বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও, ফিরনি, জর্দা, ফালুদা, শামি কাবাব, কাটলেট (বাংলাবাজারের ক্যাফে কর্নারের কাটলেট বিখ্যাত) ঢাকায় টিকে আছে।

ঢাকার বাবুর্চিদের সৃজনশীলতা আর বাংলার ফলে-ফসলে মুঘল বা তুর্কি-আফগান খাবারগুলোকে এখন বিদেশি বলে ভাবাই দুষ্কর। কোনো বিশেষ উপলক্ষ বা আনন্দ-উৎসবের প্রয়োজনে, এমনকি মনে একটু ভালো খাবারের বাসনা উদয় হলেও রসনা তৃপ্তির জন্য এখন সবাই পোলাও, বিরিয়ানির কথাই ভাবেন। বিয়েশাদি তো পোলাও ইত্যাদি ছাড়া অকল্পনীয়। এই খাবারগুলো এ দেশে তুর্কি-মোগল-আফগানরা আমদানি করেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আসা বাবুর্চিদের রন্ধনকলা রপ্ত করে নিয়েছেন এ দেশি সহযোগীরা।
এ ছাড়া আঠারো-উনিশ শতকে ঢাকায় ইউরোপীয় সাহেবদের অনেকের বাড়িতে বা প্রতিষ্ঠানে হান্ডি বাবুর্চিরা কাজ করতেন। খাবারের সুস্বাদ মনিবের সঙ্গে তাঁদের অনেকেরই সুসম্পর্ক সৃষ্টি করেছিল। এমনকি ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার সময় অনেকে তাঁদের বাবুর্চিকেও সঙ্গে নিয়ে গেছেন বা দেশে গিয়ে চিঠিপত্র দিয়ে প্রিয় বাবুর্চির ব্যক্তিগত খোঁজখবরও নিয়েছেন। ঢাকা ছেড়ে যাওয়া সাহেবরা লন্ডন থেকে তাঁর সঙ্গে পত্রে যোগাযোগ রাখতেন। ইউরোপীয় সাহেবদের কিচেনে ঢাকার কুকেরা কারি পাকাতে গিয়ে তুর্কি-মোগলাই খানার সঙ্গে ইউরোপীয় কোর্সও শিখে ফেলেন। ফলে এশিয়া-ইউরোপের মধুর মিলন ঘটে যায় বাংলার রন্ধনশিল্পীদের হাতে।

নবাববাড়ির বাবুর্চিদের মধ্যে খ্যাতিমান ছিলেন হাসান জান। তিনি স্যার সলিমুল্লাহর প্রধান বাবুর্চি ছিলেন। এ ছাড়া ছিলেন গুলকান বাবুর্চি, হাফিজ উদ্দিন বাবুর্চি। আগে আমন্ত্রিত ব্রিটিশ সাহেবদের জন্য ইংরেজ বাবুর্চি ভাড়া করে আনা হতো নবাববাড়িতে। তবে পরে নবাবদের বাবুর্চিরাই বিলেতি রেসিপিতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এ ছাড়া প্রাত্যহিক রান্নার জন্য ‘পাকানেওয়লী’ বলে মহিলা বাবুর্চিরা বংশপরম্পরায় নবাববাড়িতে কাজ করতেন। তাঁদের নাম-পরিচয় অবশ্য তেমন পাওয়া যায় না। ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে ঢাকার অন্য খ্যাতিমান বাবুর্চিদের মধ্যে ছিলেন বংশীবাজারের ইদু খলিফা ও জানু খলিফা; এঁরা ইউরোপীয় রান্নায় দক্ষ ছিলেন। ঈদ বা বড় মজলিশে রান্না করতেন রহমান বাবুর্চি, শুক্কুর বাবুর্চি, চামু বাবুর্চি, সিকিম বাবুর্চি প্রমুখ। সুখ্যাত বাবুর্চিদের নিয়ে তখন ঢাকার ধনাঢ্য ও অভিজাত পরিবারের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতাও চলত। প্রায়ই একে অন্যের বাবুর্চিকে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে যেতেন। এটা তাঁদের মধ্যে একটা আত্মশ্লাঘার বিষয় বলে গণ্য হতো এবং আড্ডা-দরবারে সে কথা তাঁরা গর্বের সঙ্গেই উল্লেখ করতেন।

রেসিপি- ১
শামি কাবাব উপকরণঃ
প্রণালীঃ
রেসিপি- ২
শিক কাবাব উপকরণঃ
প্রণালীঃ
মাংসের পর্দা চর্বি ফেলে দিয়ে পাতলা ফিতার মতো করে কেটে পেঁপে বাটা ও বেসন বাদে সব উপকরণ দিয়ে মেখে দুই থেকে তিন ঘণ্টা রাখতে হবে। মাঝে এক ঘন্টা পর পেঁপে বাটা দিয়ে মাখতে হবে। বেসন শুকনা তাওয়ায় টেলে নিয়ে মাংসের সাথে ভালোমতো মাখতে হবে। এবার শিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গাথঁতে হবে। এবার কাবাবের চুলায় কাঠ কয়লার আগুন তৈরি করে সিকে গাঁথা মাংসগুলো শিক সহ চুলায় বসাতে হবে। মাঝে মাঝে শিক ধরে ঘুরিয়ে দিতে হবে যেন মাংস পুড়ে না যায়। মাঝে মাঝে কাবাবের উপর ঘি ও মাখানো মসলার প্রলেপ দিতে হবে। কাবাব হয়ে গেলে রায় তার সাথে নান রুটি পরোটা দিয়ে পরিবেশন করুন।
পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *