নন্দিনী নাগ
একে তো শীতকাল, তার ওপর ছাইরঙা আকাশ, মন ভাল থাকার কোনো উপায়ই রাখেনি ওপরওয়ালা। যদিও দূষণের কল্যানে কলকাতার আকাশের এখন ছাই রঙটাই স্বাভাবিক, শরত নামের কোনো ঋতুর অস্তিত্বই যেখানে নেই, সেখানে আবার নীল রঙের আকাশ দেখার স্বপ্ন! স্বপ্ন অবশ্য দেখে না কৌশিক, ওদের প্রজন্মের কোনো ছেলেমেয়েই দেখে না, দেখতে জানেও না। পজিটিভ ইমোশনগুলো তৈরি হবার সুযোগ না হলেও নেগেটিভ ইমোশনের যথেষ্টই বাড়বাড়ন্ত। যেমন মানসিক অবসাদে ভোগার ব্যাপারটা অনেক ছোটোবেলা থেকেই ঢুকে গেছে ওদের ‘ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট’মার্কা জীবনে, আর তার জন্য জমি তৈরি করে রেখেছে সমাজ, পরিবার।
আজ যেমন সকাল থেকেই চুড়ান্ত ডিপ্রেশন হচ্ছে কৌশিকের। আকাশের ওপর কয়েক পোঁচ স্লেট কালারের শেড, যেটা দেখলে বরাবরই ওর মন খারাপ করে। এখন যদিও ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, আবহাওয়া দপ্তরের হিসেবে শীতকাল। কিন্তু পশ্চিমি ঝঞ্ঝা না কি সব যেন ঢুকে পড়েছে। তার জন্য আজ সারাটাদিনই ঝিরঝিরে বৃষ্টি থাকবে, এমনটাই পূর্বাভাস দিয়েছে হাওয়া অফিস। অতএব সারাদিন ঘরবন্দী থাকা, মানে নিজেকে নিয়ে ভাববার জন্য অঢেল সময়, মা বাবার প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে থাকা চোখের সামনে ঘোরাঘুরি, পুরো পরিস্থিতিটাই অসহনীয়।
যদিও বাবা-মা কখনোই কিছু বলেন না কৌশিককে, ওর ইচ্ছের বিরূদ্ধে জোর করে কিছু চাপিয়েও দেননি কোনদিন, এটা অস্বীকার করার উপায় ওর নেই। কিন্তু কৌশিকের নিজেরও তো বিবেক আছে, লজ্জা নামের কিছু একটা আছে শরীরে! যতই একমাত্র সন্তান হোক, এককাঁড়ি টাকার শ্রাদ্ধ করে লেখাপড়া শেখানোর পর যদি ছেলে চাকরিবাকরি না করে খোদার খাসী হয়ে চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়, কোন বাবা-মা সেটা দেখে আহ্লাদে গদগদ চিত্ত হতে পারে! এটুকু বুঝতে পারবে না এত বোকা তো আর কৌশিক নয়, বয়সও তো আঠাশ পেরিয়েছে।
কিন্তু সব জেনেবুঝেও কিছু করার নেই ওর। একগাদা ডিগ্রির বোঝা পিঠে বয়ে নিয়ে, ফার্মগুলোর দরজায় দরজায় ঘুরে, এতদিনে যে একটাও চাকরি জুটবে না, সেটা তো কৌশিকেরও জানা ছিল না! জানলে অন্ততপক্ষে বাপের এতগুলো টাকা ধ্বংস করত না, মোটামুটি একটা পাসকোর্সের কমার্স গ্রাজুয়েট হয়ে, বাপের ব্যবসাতেই ঢুকে পড়তে পারত। এখন তো সেটাও পারছে না, এত উচ্চশিক্ষিত হয়ে মিষ্টির দোকানদারী করলে সেটা কি ভালো দেখায়, নাকি মেনে নিতে মন চায়!
অথচ কয়েকবছর আগেও ব্যাপারটা এত কঠিন ছিল না। মাধ্যমিকের উজ্জ্বল রত্নদের অবধারিত গন্তব্য ছিল হায়ার সেকেন্ডারিতে সায়েন্স। তারপর যারা জয়েন্ট এন্ট্রান্সকে পাখির চোখ করে নিত তাদের ভবিষ্যৎ তো মোটা প্রিমিয়ামের ইন্সিওরেন্স থেকে পাওয়া সুরক্ষার মত নিরাপদ। ডাক্তারদের পেশায় প্রতিষ্ঠিত হতে একটু সময় লাগলেও, ইঞ্জিনীয়ারদের কপাল অত্যন্ত চওড়া ছিল। পুরোদস্তুর ইঞ্জিনীয়ার হবার আগেই তাদের জন্য লোভনীয় চাকরির বিপণি সাজিয়ে কলেজে কলেজে এসে যেত কোম্পানিগুলো, চলতি কথায় যাকে বলা হত ক্যাম্পাসিং। থার্ড ইয়ার বা ফোর্থ ইয়ারে পড়তে পড়তেই চাকরি নিশ্চিত। এরপর অফার লেটারটা পকেটস্থ করে বিন্দাস কলেজের ফাইনাল পরীক্ষাটা দাও,তারপর ড্যাং ড্যাং করে ঢুকে যাও চাকরিতে। মোটা মাইনের চাকরিই যদি সুখে থাকার পাসওয়ার্ড হয়, আর ভাল চাকরি পাওয়াটাই যদি কষ্ট করে পড়াশোনা করার কারণ হয় তবে ইঞ্জিনীয়ারদের মোক্ষলাভ এক্কেবারে সংশয়াতীত ছিল। ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার একটা চল কৌশিকদের পরিবারে ছিলই। শিবপুর বি ই কলেজের স্নাতক, ওর দুই কাকাকে একটা দিনও বেকার অবস্থায় বসে থাকতে হয়নি বাড়িতে। কিন্তু কয়েক দশকে পরিস্থিতি যে এতটা পাল্টে যাবে কেই বা আন্দাজ করতে পেরেছিল! বরাবরের ভাল ছাত্র কৌশিক উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে যখন ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে ঢুকেছিল তখন কাকারাও কেউ নিষেধ করেনি, শুধু বাবা-ই যা বারণ করেছিলেন। কিন্তু বাবার কথাকে মোটেও পাত্তা দেয়নি সে। টনকটা প্রথম নড়ল যখন থার্ডইয়ার তো কোন ছার এমনকি ফোর্থইয়ারেও কোনরকম ক্যাম্পাসিং হল না। বি ই কলেজ থেকে ওরা বেরলো শুধু সার্টিফিকেট নিয়ে, চাকরি তো নয়ই এমনকি তার কোনোরকম নিশ্চয়তা নিয়েও নয়!
ব্যাপারস্যাপার দেখে কৌশিকের বাবা নিদান দিলেন, “চাকরির বাজার এখন যেমন কঠিন হয়ে গেছে তাতে শুধু ডিগ্রির সার্টিফিকেট দিয়ে সাইকেল সারানোর দোকানেও কাজ পাওয়া যাবে না। বরং এমটেকটা করে নাও।”
সুতরাং বাপের টাকা ধ্বংস করে আবার দু’বছর কচলাতে হল। এম টেক করার পরেও যখন ভাল চাকরি জুটল না, তখন কৌশিক নিজে থেকেই ম্যানেজমেন্ট পড়ার সিদ্ধান্ত নিল। মানে আবার বাবার টাকা ধ্বংস, আর এবারের পরিমাণটা আরো বেশি। কারণ উচ্চশিক্ষার খাতিরে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে হল তো!
কলকাতায় চারপুরুষের বনেদি মিষ্টির ব্যবসা কৌশিকদের। দুই কাকা চাকরির সুবাদে চিরকালই কলকাতার বাইরে থেকেছেন বলে ব্যবসা সামলানোর ব্যাটনটা ঠাকুরদার হাত থেকে সরাসরি কৌশিকের বাবার হাতে চলে এসেছে। ছোটবেলায় মাঝে মাঝেই দোকানে যেত কৌশিক, বড় হয়েও ওর সেই অভ্যাসটা ছিল। ছোট্ট থেকে যাওয়া-আসা ছিল বলে দোকানের কর্মচারীদের সবাইকেই চিনত ও, আর ঠাকুরদার আমলের পুরনো কর্মচারীরা খুব ভালও বাসত কৌশিককে।
এমবিএ করে দুবছর বাদে কলকাতায় পাকাপাকিভাবে ফেরার পর সেদিনই প্রথম দোকানে গেছিল কৌশিক, বিশেষ প্রয়োজনে। এই দু বছরে দোকানের অনেক পরিবর্তন হয়েছে, হওয়াটাই স্বাভাবিক। পুরো দোকানটা এয়ারকন্ডিশনড হয়েছে, দেওয়ালে প্যাস্টেলশেড, তার ওপরে কলকাতার মিষ্টির বিবর্তনের সচিত্র ইতিহাস। দেওয়ালের ধার বরাবর লাগানো হয়েছে কাউন্টার টেবিল, দাঁড়িয়ে খাওয়ার জন্য। খদ্দেরদের বিশুদ্ধ পানীয়জল যোগান দেবার জন্য লাগানো হয়েছে ওয়াটার পিউরিফায়ার কারণ জালার জল প্লাস্টিকের জাগে ভরে গলায় ঢালার দিন আর নেই! বেশ একটা ঝাঁ-চকচকে সময়োপযোগী লুক এসেছে দোকানটাতে। পুরনো দিনের দু-একটা মিষ্টি বাদ চলে গেছে, বদলে এসেছে বেশ কয়েকটা ফিউশন মিষ্টি। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন চোখে পড়ল কর্মচারীর সংখ্যায়। দোকানের কাউন্টারে কাজ করা ছেলে চোখে পড়ার মত কম, এমনকি মিষ্টি বানানোর কারিগরের সংখ্যাও আগের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। ব্যাপারটা দেখে খারাপ লাগল কৌশিকের।
“এতজন কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়েছে মাত্র দু’বছরে, তবে কি ব্যবসা ভাল চলছে না!” এই চিন্তাটাই প্রথমে মাথায় এল কৌশিকের। যদিও সেন্ট্রালি এসি দোকান, কম্পিউটারাইজড কাউন্টার, ভেতরের ডেকরেশন সেকথা বলছে না। ব্যবসার ব্যাপারে এমনিতে কোনো আগ্রহ নেই ওর, তবুও আজ বেশ দুশ্চিন্তা হল। বাড়ি ফিরে গিয়েই বাবার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবে বলে ঠিক করে নিল কৌশিক।
“আরে কৌশিক না?”
গ্র্যান্ড হোটেলের সামনের ফুটপাথ ধরে এলোমেলো হাঁটছিল কৌশিক। বিকেলে এসপ্ল্যানেডে যে থিকথিকে ভিড় থাকে, সেই ভিড়ে মিশে যাবার তাগিদে এখানে আসা। চেনা মানুষের মধ্যে, বন্ধুদের আড্ডায় আর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না সে। যতটা সম্ভব পালিয়ে পালিয়েই থাকতে চেষ্টা করে আত্মীয়স্বজন, পরিচিতদের কাছ থেকে। এই তো সেদিন, পাড়ার অমলজেঠু দুম করে বলেই বসলেন “এখনো চাকরি পাওনি? তাহলে লেখাপড়ায় এত ভালো হয়ে কী লাভ হল?” একে বয়স্ক মানুষ, তার ওপরে কৌশিক চিরকাল জেঠু বলে ডেকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে এসেছে, তাই তাঁকে কোনোরকম রূঢ় কথা বলতে মুখে বাধল ওর। কোনরকমে বাক্যবাণটি হজম করে চুপচাপ চলে এসেছিল কৌশিক। অমলজেঠুর এমন মনোভাবের পেছনে যে কী কারণ আছে সেটা তো ভালো করেই জানে কৌশিক। অমলজেঠুর ছোটছেলে তপন কৌশিকের সঙ্গে স্কুলে পড়ত, বরাবরের ব্যাকবেঞ্চার। কোনোমতে টেনেটুনে নাক-কান কেটে পাশ করত প্রতি বছর আর কৌশিক ছিল ক্লাসের ভালো ছেলে, প্রতিবছর স্ট্যান্ড করত। সেই তপন যেখানে সরকারি অফিসে চাকরি করছে কয়েক বছর হল, সেখানে কৌশিক ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে জেনে জেঠুর এমন কথা মনে আসাটা দোষের কিছু নয়!
“কিরে কি ভাবছিস? চিনতে পারছিস না?”
“তুই অম্লান তো, চিনব না কেন? কি করছিস এখানে?” অম্লানকে প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে চায় না কৌশিক।
“আমার তো এখানেই অফিস। তুই কোথায় আছিস?”
যথারীতি বাউন্সার ধেয়ে এল অম্লানের দিক থেকে।
এই একটা প্রশ্নের হাত থেকে পালানোর জন্য চেনা দুনিয়াটার বাইরে লুকাতে চায় সে, কিন্তু প্রশ্নটা কিছুতেই তার পিছু ছাড়েনা।
কৌশিকের নীরবতায় অম্লান হয়ত কিছু বুঝে থাকবে, তাই প্রসঙ্গটা বদলালো।
“আরে ব্রাদার এত বছর পর তোর দেখা পেয়েছি, সহজে ছাড়ব নাকি! চল কোথাও বসি” কৌশিকের কোনোরকম ওজর আপত্তিতে কান না দিয়ে অম্লান জোর করে ওকে ধরে নিয়ে গেল কাছাকাছি একটা বার কাম রেস্টুরেন্টে।
“সুদীপ, বিতান, অতনুর সঙ্গে মাঝেমধ্যেই দেখা হয়, আড্ডা ফাড্ডাও হয়, শুধু তুই-ই ভোকাট্টা!”
“আমি তো দু বছর কলকাতার বাইরে ছিলাম।”
সংক্ষেপে জবাব দেয় কৌশিক।
“আরে ইয়ার তারও আগে থেকে খুঁজছি তোকে, সোশ্যাল মিডিয়াতেও তোকে পাইনি। তুই স্কুলের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগই রাখিস না নাকি?”
এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে প্রসঙ্গটা বদলানোর জন্য কৌশিক প্রশ্ন করল “বিতান আর অতনুর খবর কি রে? ওদের সাথে আমার যোগাযোগ নেই অনেকদিন!”
“তোরা তিনজন তো ছিলি থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। আর স্কুলের ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড পজিশন তিনটে ছিল তোদের বাপের সম্পত্তি। তিনটেতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হতিস। আর আমরা তো শালা ছিলাম ফেকলুমাল! অতনু এখন এন আর এসে আছে, আর বিতান বিদ্যাসাগর কলেজে।” “দেশে চাকরির বাজারে যতই ধ্বস নামুক না কেন, শালা ডাক্তার আর মাস্টারের ভাত কেউ মারতে পারবে না। ঋগ্বেদের যুগেও এদের ডিমান্ড ছিল, আর এখনও আছে।” কৌশিকের মুখ ফস্কে কথাটা বার হয়ে গেল। বলে ফেলার পর কথাটা ওর নিজের কানেই খুব খারাপ শোনাল। অম্লান কেমন ভাবে নিল কথাটা কে জানে! হয়ত জেলাস ভাবছে কৌশিককে। ও কিন্তু কাউকেই ঈর্ষা করে না। করবেই বা কেন? যে যার নিজের যোগ্যতাতে চাকরি পেয়েছে। এখন আর কি করা যাবে,বলা কথা তো আর ফিরিয়ে নেওয়া যায়না!
বছর তিনেক কলকাতার কোনো বার কিংবা হাইফাই রেস্তোরাঁতে যায়নি কৌশিক, যাবার মত কোনো উপলক্ষ্য আসেনি বলেই। তাই ওদের টেবিলে অর্ডার নিতে আসা ওয়েটারটিকে দেখে চমকে উঠেছিল ও। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, গোটা রেস্তোরাঁর চিত্রটা একই রকম, ওয়েটাররা সকলেই রোবট। অম্লানের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল কৌশিক, ও মিটিমিটি হাসছে।
“তুই যে অনেকদিন এসবের বাইরে আছিস সেটা বুঝতে পারলাম। কলকাতার ম্যাক্সিমাম বারেই এখন রোবট ওয়েটার। বড় বড় হোটেলগুলোতেও তো এখন রুমসার্ভিস, হাউসকিপিং সবই রোবট।”
“তাই হবে হয় তো” ভাবে কৌশিক। কত কীই তো তার অজ্ঞাতসারে বেমালুম বদলে গেছে! তাদের নিজেদের দোকানেই মানুষের বদলে যন্ত্রেরা মিষ্টি বানাচ্ছে, আর মানুষের থেকে বেশি দক্ষতা দেখাচ্ছে, এই কথাটাও তো তার জানা ছিল না। বাবাকে জিজ্ঞেস না করলে কৌশিক জানতেই পারত না যে মানুষ কারিগরের চেয়ে যন্ত্রের কদর এখন অনেক বেশি। অবশ্য অন্য আর একটা ব্যাপার ও জেনে গেছে এই কয়েক মাসে। চাকরিপ্রার্থী হিসাবে, বিভিন্ন কোম্পানি আর ইঞ্জিনীয়ারিং ফার্মে গিয়ে দেখেছে সেগুলোতে প্রাথমিক বাছাইয়ের কাজটা যন্ত্রমানবেরাই করে। হাজার হাজার প্রার্থীর সি ভি থেকে কোম্পানির প্রয়োজন অনুযায়ী যাদের যোগ্য বলে মনে করে এই যন্ত্রমানবেরা, তাদেরই কেবল ইন্টারভিউতে ডাকা হয়।
কোন ভাবনার সূত্র ধরে কোন ভাবনাতে আবার ঢুকে গেল মনটা! বিষণ্ণ বোধ করে কৌশিক। যেখানেই নিয়ে যাও না কেন মনটাকে, সে আবার ঘুরে ফিরে সেই “চাকরি” নামক ব্ল্যাক হোলে এসে ঢুকবেই ঢুকবে, আর গিলে খেতে চাইবে কৌশিকের সমস্ত সত্ত্বাকে।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। অম্লানের কোনকথাই আর ভালো লাগছিল না। স্কুলজীবনের মজার মজার গল্প শুনেও আর প্রাণ খুলে হাসতে পারছিল না, অমন সুস্বাদু খাদ্য বা পানীয় কোনোটাই যেন গলা দিয়ে নামতে চাইছিল না। সবটাই বিস্বাদ আর কটু লাগছিল কৌশিকের। কোনরকমে অম্লানের কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করে বেরিয়ে এল ও।
সেদিন রাতে ঘুম আসছিল না কৌশিকের। ঘরের লাগোয়া খোলা ছাদটাতে অস্থির ভাবে পায়চারি করছিল, আর সিগারেট পোড়াচ্ছিল একটার পর একটা। আজ সন্ধ্যেবেলা অম্লান ওকে একবার কথাচ্ছলে বলেছিল, দেশের মাটি কামড়ে পড়ে না থেকে বাইরে যাবার কথা ভাবতে। “এমন অনেক দেশ রয়েছে যেখানে শালা আমাদের মত এত মানুষ পয়দা হয়নি। সেসব জায়গায় এমন আকাল লাগেনি চাকরির।”
ঠিক-ই তো বলেছে অম্লান, কৌশিকের মনে হচ্ছিল, অস্ট্রেলিয়া, ইটালি কিংবা নিউজিল্যান্ড চলে যাবে। একটু খোঁজাখুঁজি করলে কলেজের কোনো না কোনো সিনিয়রকে পাওয়া যাবে এইসব দেশে। তাদের মাধ্যমে নিশ্চয়ই একটা চাকরি জোগাড় হয়ে যাবে, যোগ্যতা তো কিছু কম নেই ওর!
কিন্তু চাকরির জন্য দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া মা বাবা যে কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না, সেটা জানে কৌশিক। একমাত্র সন্তান সে, স্বার্থপরের মত বাবা মা কে ফেলে চলে যাবার ভাবনায় তার নিজের মনেরও সমর্থন নেই। এই মানসিক দ্বন্দ্ব তাকে প্রতিমুহূর্তে এফোঁড় ওফোঁড় করছে, অথচ এই সমস্যাটা তার মত করে বুঝে সমাধান বাতলাতে পারে এমন একজন মানুষও নেই। তার মত কর্মহীন দুর্ভাগাকে বন্ধুরা সবসময়েই পরামর্শ দেয়, ‘চাকরির জন্য পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে চলে যাওয়া উচিত’। কয়েকজন তো আবার আরও নির্দয়ভাবে বলে, “যা পরিস্থিতি তাতে গু চাটার কাজ পেলেও ছেড়ে দেওয়া উচিত না।”
আবার কৌশিকের বাবা মা কাকা কাকিমারা কেউই দেশ ছাড়ার প্রস্তাব মোটেই কানে তুলতে রাজি নন। সবসময় কানের সামনে সেই এক ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছে “চাকরির দরকার কি তোর? নিজেদের এতবড় ব্যবসা থাকতে?”
কথাটা ভুল কিছু নয়। দুই কাকারই একটি করে মেয়ে, সুতরাং ব্যবসা চালানোর যোগ্য উত্তরাধিকার যে কৌশিকের ওপর বর্তাবে এটাই স্বাভাবিক।
সুতরাং নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হবে। কিন্তু কি সিদ্ধান্ত নেবে কৌশিক? দেশের বাইরে যাবার চেষ্টাটাকে কি আর একটা বছরের জন্য মুলতুবি রাখবে?
বড় হল ঘরটাতে জনা তিরিশেক ছেলেমেয়ে তখনও বসে ছিল। যারা ইন্টারভিউ দিতে ঢুকছিল, তারা কেউই আর এই দিক দিয়ে বার হচ্ছিল না। নিশ্চয়ই অন্য কোনো রাস্তা রেখেছে এরা ইন্টারভিউ রুম থেকে বাইরে বেরনোর জন্য, যাতে যাদের ইন্টারভিউ দেওয়া হয়ে গেছে তাদের সঙ্গে কোনোরকম আইডিয়া শেয়ার না করতে পারে ফ্রেশাররা। নিজের ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে করতে এইসব কথাই ভাবছিল কৌশিক।
‘ফিউচার এনার্জি’ হল সেই এগারটা কোম্পানির মধ্যে একটা, যেগুলোর ক্ষেত্রে তার অন্তত ইন্টারভিউ বোর্ড পর্যন্ত পৌঁছনোর সৌভাগ্য হয়েছে। এমবিএ কমপ্লিট করার পর গত একবছরে সমস্ত সম্ভাব্য জায়গাতেই অ্যাপ্লাই করেছে কৌশিক, দেশের মধ্যে কোনো কোম্পানিকেই বাদ দেয়নি, কোনো কোনো জায়গায় তো নিজে থেকেই সিভি জমা করে এসেছে। কিন্তু মাত্র এগারোটা জায়গা ছাড়া আর কোনো কোম্পানি থেকেই ইন্টারভিউয়ের কল পর্যন্ত পায়নি। আগের দশটা জায়গাতে ইন্টারভিউ বোর্ডে বাদ পড়ে গেছে কোনো অজ্ঞাত কারণে। বড্ড হতাশ লাগছে কৌশিকের, প্রায় বছর ঘুরতে চলল এম বি এ করে বসে আছে ও, এবার হয়ত চাকরির চেষ্টা ছেড়ে বাবার সাথে দোকানেই বসতে হবে।
“কৌশিক মিত্র, নেক্সট আপনি” ঘরের দেওয়ালে গাঁথা মাইক্রোফোনে নিজের নামটা শুনে, এলোমেলো চিন্তার দুনিয়া থেকে বাস্তবে ফিরে এল ও। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে টাইয়ের নটটা ঠিকঠাক করে নিল, জেল দিয়ে সেট করা চুলে অভ্যাসবশত একবার আঙুল চালিয়ে নিল, একটা একটা করে পা তুলে, আরেক পায়ের পেছনে নিয়ে গিয়ে, যথেষ্ট চকচকে জুতোজোড়াকে প্যান্টের পেছনে ঘষে আরও একটু চকচকে করে নিল। নিজেকে যাতে যথেষ্ট স্মার্ট আর সপ্রতিভ লাগে সেই ব্যাপারে সতর্ক হয়ে ভেতরে ঢুকল সে।
চেম্বারের ভেতরে মাত্র তিনজন এক্সপার্ট ছিলেন, আজ অবধি কোনো ইন্টারভিউ বোর্ডে এত কম এক্সপার্ট কখনো দেখেনি কৌশিক, তাই একটু অবাকই হল ও। ভেতরে ঢোকামাত্র একজন বিশেষজ্ঞ হাত বাড়িয়ে কৌশিকের ফাইলটা নিলেন বটে, কিন্তু তিনি সিভিটাতে ওপর ওপর একবার চোখ বুলিয়েই রেখে দিলেন আর বাদবাকি সার্টিফিকেটগুলো ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখলেন না। আর বাকি দুজন তো ফাইলটাও ছুঁয়ে দেখলেন না। এক্সপার্টদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে কৌশিকের আর বুঝতে বাকি থাকল না যে এবারেও তার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে না। ক্যান্ডিডেট এদের ঠিক করাই আছে, ইন্টারভিউটা কেবল লোক দেখানো। মুডটা অফ হয়ে গেলেও কাগজপত্তরগুলো গুছিয়ে নিয়ে মুখে একটা গৌতমবুদ্ধের মত প্রশান্তির হাসি লটকে বসে কৌশিক যখন ভাবছে ‘অতঃকিম?’, তখনই বোর্ডের প্রথম প্রশ্নটা এল তার কাছে, “অল্টারনেটিং কারেন্ট কিভাবে প্রডিউসড হয় জানেন?”
প্রশ্নটা শুনে কৌশিক বুঝতে পারল না এটা কেমন প্রহসন! স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীর যেটা জানার কথা, সেটা একজন ইঞ্জিনীয়ারকে চাকরির ইন্টারভিউতে জিজ্ঞেস করার পেছনে কী দুর্বুদ্ধি থাকতে পারে সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল ও। কৌশিককে চুপ করে থাকতে দেখে আবার ধেয়ে এল প্রশ্নটা “কি হল, তাড়াতাড়ি উত্তর দিন, জানেন?”
এবার মেজাজটা বিগড়ালো ওর। চাকরিটা যখন হবেই না বোঝা যাচ্ছে, তখন আর এদের ফালতু সম্মান দেখানোর দরকার নেই, ভাবল কৌশিক। তাই সে দাপটের সঙ্গে উত্তর দিল, “এটা জানতে কষ্ট করে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে হয়না,স্কুলের সিলেবাসেই আছে।”
চেয়ার ছেড়ে কৌশিক উঠে পড়েছিল, কারণ এমন উদ্ধতভাবে উত্তর দেবার পর, ওকে যে দরজা দেখিয়ে দেওয়া হবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল ও। তবে নিজের দিক থেকে কোনরকম খামতি রাখাটা উচিত হবে না, এটা ভেবে কৌশিক গড়গড় করে বলতে শুরু করল, “একটা স্ট্রং ম্যাগনেটিক ফিল্ড, তার মধ্যে একটা কন্ডাটিং মেটেরিয়ালের ক্লোজড লুপ। এক্সটারনাল এনার্জি দিয়ে লুপের সাথে কানেক্টেড টারবাইনটাকে ঘোরালে, লুপটাও ঘুরবে ম্যাগনেটিক ফিল্ডের ভেতরে। যতক্ষণ লুপটা ঘুরতে থাকবে, ততক্ষণ এর দুই এন্ড থেকে অল্টারনেটিং ভোল্টেজ পাওয়া যাবে। দিস ইস দ্য প্রিন্সিপল অফ এসি জেনারেটর। ভেরি সিম্পল।”
নিজেকে মঙ্গলগ্রহের মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেও বোধহয় এতটা অবাক হত না কৌশিক, যতটা হল টেবিলের ওধারে বসা, সবচাইতে বয়স্ক মানুষটার জলদগম্ভীর গলায় বলা কথাটা শুনে।
“গুড। এবার তাহলে আমাদের প্রোডাকশন হাউসটা দেখে আসুন, বাদবাকি সব কথাবার্তা তারপর বলা যাবে।”
‘তার মানে আমি সিলেক্টেড! নয়ত প্রোডাকশন হাউস কেন দেখাতে নিয়ে যাবে!’ কৌশিক বুঝতে পারছিল না কথাটা কি সত্যি সত্যিই ও শুনল, নাকি দীর্ঘদিন ধরে একই জিনিস নিয়ে ভেবে ভেবে ওর মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে, তাই যা শোনার ইচ্ছে মন সেটা নিজে নিজেই বানিয়ে নিচ্ছে! তাই একবার যাচাই করে নেবে ভাবল। কিন্তু ও কিছু বলার আগেই টেবিলের ওপর রাখা বেলটা বাজালেন একজন এক্সপার্ট, সঙ্গে সঙ্গে একজন সিকিউরিটি গার্ড ঘরে এল।
“একে নিয়ে যান দুনম্বরে আর পরের জনকে পাঠিয়ে দিন।”
হতভম্বের মত গার্ডকে অনুসরণ করে দু’নম্বর ঘরে পৌঁছে কৌশিক দেখল জনা কুড়ি ছেলেমেয়ে আগে থেকেই বসে আছে সেখানে।
‘তার মানে সবাইকেই এরা বসিয়ে রাখছে! কিন্তু কেন? সবাইকে নিশ্চয়ই নেওয়া সম্ভব নয়।’
স্বাভাবিকভাবেই কথাটা মনে হল কৌশিকের, ‘ফিউচার এনার্জি’র ব্যাপারস্যাপার কিচ্ছু মাথায় ঢুকছিল না ওর।
ঘরের মধ্যে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর মুখ দেখেই অনুমান করা যাচ্ছিল ওদের অবস্থাও তথৈবচ, কৌশিকের মত ওরাও বিশবাঁও জলে। কৌশিক তবুও কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে নিজে থেকে একজনের সাথে কথা বলল। একজনকে মুখ খুলতে দেখে বাকিরাও যেন তুবড়ির মত ফেটে পড়ল, এতক্ষণ সাহসে কুলাচ্ছিল না। প্রত্যেকেই ভাবছিল সেই একমাত্র আহাম্মক, বাকিরা পুরো পদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এখন সকলেই মুখ খোলায় এটুকু অন্তত বোঝা গেল যে এদের এই আজব কায়দায় সিলেকশনের মাথামুণ্ডু কেউই বুঝতে পারেনি, কৌশিকের মতই কেউই জানে না তারা আদৌ সিলেকটেড কি না।
ইতিমধ্যে আরও কয়েকটা বলির পাঁঠা প্রবেশ করল বধ্যভূমিতে, এক নম্বর ঘরের বেড়া পেরিয়ে দু’নম্বর ঘরে এবং যথারীতি চোখ ভর্তি প্রশ্ন নিয়ে।
দু’নম্বর ঘরে ততক্ষণে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ। একটা বদ্ধঘরে একদল উন্মাদ এতগুলো হতভাগ্যকে পুরে দিয়ে কি প্রহসন করতে চলেছে, সেই কথা ভাবতে ভাবতে কৌশিকের আউসভিৎজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বারের কথা মনে পড়ে গেল। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে নিয়ে যাবার নাম করে ক্যাম্পে বন্দী হতভাগ্য ইহুদিদের গাদাগাদি করে একটা বড় ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হত আর তারপর সেই ঘরে সায়ানাইড গ্যাস ঢুকিয়ে দিলেই কার্যসিদ্ধি! অল্পখরচে এবং অনায়াসে, মাত্র একমিনিটেই একহাজার ইহুদি হয়ে যেত স্রেফ লাশ! তারপর সেগুলোকে এক দরজা দিয়ে বাইরে ফেলে, অন্য দরজা দিয়ে ‘তাজা মাল’ ঘরে ঢোকাত।
এরাও কি তেমন কিছু করতে চায়! এত এত উচ্চশিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়ে, দেশ এবং সমাজ-ব্যবস্থার বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে আছে! সেই লজ্জার কিছুটা লুকিয়ে ফেলার জন্য এরা এই ইঁদুরকল পেতেছে নাকি! হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। হয়ত ‘ফিউচার এনার্জি’ নামের আড়ালে রয়েছে সরকারের কোনো একটা দপ্তর।
নিজের ভাবনার জগতে ডুবে গেছিল কৌশিক, খেয়ালই করেনি কখন যে একজন স্যুটেড বুটেড ভদ্রলোক এসে ঢুকেছেন দু’নম্বর ঘরে। চেহারা এবং হাবভাবে বোঝা গেল ইনি ফিউচার এনার্জি গ্রুপের কোনো কেষ্টবিষ্টু। ওনাকে দেখে সকলেই একটু নড়েচড়ে বসল, এইবারে নিশ্চয়ই ফাইনাল কিছু বলবে। পজিটিভ, নেগেটিভ যাই হোক না কেন এবারে ডিক্লেয়ার করে দিলে ভাল হয়। নার্ভগুলো আর চাপ নিতে পারছে না।
কিন্তু ভদ্রলোক সে সবের ধারপাশ দিয়ে গেলেন না। রহস্য আরও ঘনীভূত করে ঘোষণা করলেন, “প্রথম পঁচিশজন আমার সঙ্গে আসুন।”
আর ধৈর্য ধরতে পারল না কৌশিক।
“এক্সকিউজ মি স্যর, ওয়ান কোয়েশ্চেন।”
“হ্যাঁ ভাই বলুন?”
“আমরা কি সিলেক্টেড?”
ভদ্রলোকের চোখে মুখে একটা হাসি বিদ্যুতের মত ঝিলিক দিয়ে গেল। বড় রহস্যময় সেই হাসি। তাতে মনের অন্ধকার তো কাটলই না বরং আরও বাড়ল।
“এখনও সে কথা বলার সময় আসেনি। আগে আপনাদের প্রোডাকশন হাউস ভিজিটে যেতে হবে, তারপর সিদ্ধান্ত হবে।”
ভদ্রলোক যে দরজা দিয়ে এসেছিলেন সেই দরজা দিয়ে বার হয়ে গেলেন। পঁচিশ জন চাকরি প্রার্থী ইঞ্জিনীয়ার ছেলেমেয়ে তাকে দম দেওয়া পুতুলের মত নিঃশব্দে অনুসরণ করতে লাগল।
বিরাট একটা হলঘরে ঢুকল সবাই। কোনো ঐতিহাসিক জায়গা কিংবা মিউজিয়াম দেখতে ঢোকার আগে ট্যুর গাইড যেমন আগে ট্যুরিস্টদের এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে নিয়ে বর্ণনা করেন আগামি দ্রষ্টব্যের বিষয়ে, তেমনই কৌশিকদের পঁচিশজনকে দাঁড় করিয়ে ‘ফিউচার এনার্জি’র প্রতিনিধি ভদ্রলোক বলতে থাকলেন “আপনারা জানেন গোটা পৃথিবীর এখন প্রধান সমস্যা এনার্জি ক্রাইসিস। আমাদের সিভিলাইজেশন যত ডেভেলপড হচ্ছে তত আমরা যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়ছি। যন্ত্র ছাড়া পৃথিবীতে প্রতিটা সেকেন্ডই অচল। এত যন্ত্র চালাতে প্রয়োজন প্রচুর এনার্জি। অথচ পৃথিবীর রিসোর্স সব শেষের পথে। আমরা এখন আনকনভেনশনাল এনার্জির ওপর ডিপেন্ড করে আছি। এই অবস্থায় ‘ফিউচার এনার্জি’ গ্রুপ নতুন আইডিয়া মার্কেটে আনছে অল্টারনেটিং কারেন্ট প্রোডাকশন করার জন্য। এই কাজে আমাদের প্রচুর ম্যান পাওয়ার দরকার, তাই আপনারা যদি চান আপনারা প্রত্যেকেই ‘ফিউচার এনার্জি’ গ্রুপের একটা পার্ট হতে পারেন।”
চাকরি খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েগুলোর চোখমুখ চকচকে হয়ে উঠল এই কথা শুনে। অনেকেই ভাবল ভগবান এতবড় একটা ফার্মে চাকরি ভাগ্যে লিখে রেখেছিলেন বলে এতদিন বেকার বসিয়ে রেখেছিলেন। এইজন্যই বলে সবুরে মেওয়া ফলে। “চলুন, এবার ফ্যাক্টরিতে যাওয়া যাক। ফ্যাক্টরি ভিজিটের পর আপনারা রাজী থাকলে, আজই কন্ট্রাক্ট পেপারে সাইন করে দেবেন। ইচ্ছে করলে আগামীকাল থেকেই আপনারা জয়েন করতে পারেন।” আগামীকালই বহু প্রতীক্ষিত চাকরি! ছেলেমেয়েগুলোর মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছে, বেলুনের মত আকাশে ভেসে যেতে চাইছিল ওরা। বলতে গেলে উড়তে উড়তেই পরবর্তী গন্তব্যে গেল ওরা, স্বপ্নের সওদাগরের পেছন পেছন।
একটা ঝুলন্ত ব্রিজের মত জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল কৌশিকদের, যেখান থেকে নিচে তাকালে ফ্যাক্টরির কর্মকান্ড দেখা যায়।
কৌশিক দেখল সারি সারি কনভেয়ার বেল্টের মত লম্বা লম্বা বেল্টের অ্যারেঞ্জমেন্ট যার শুরুতে কতগুলো চৌকো চৌকো খুপরি। বেল্টগুলোর শেষপ্রান্ত আর একটা খুপরির মধ্যে ঢুকেছে। “এই যে বেল্টগুলো দেখছেন, এর প্রতিটাই এক একটা এনার্জি প্রোডাকশন ইউনিট। এরকম ইউনিট আমাদের তিরিশ হাজার আছে। সারাদিনে কয়েক শিফটে কাজ চলে। আমরা এরকম ইউনিটের সংখ্যা আরও বাড়াতে চাইছি।”
“কিন্তু প্রোডাকশনটা হয় কিভাবে?” একটি মেয়ে জানতে চাইল।
“এই বেল্টগুলো ওই যে দূরের ঘরগুলোতে ঢুকছে, ওই ঘরগুলোতে কমপ্লিট সেট আপ আছে। টারবাইনের সঙ্গে যুক্ত কয়েল, যেটা ম্যাগনেটিক ফিল্ডে ঘুরলে বিদ্যুৎ তৈরি হবে। বেল্টগুলোকে সচল রাখার ব্যবস্থা এই কাছের বক্সগুলোতে।”
“সেটাতো বুঝতেই পারছি। কিন্তু এর মধ্যে আমাদের ভূমিকা কোথায়? আই মিন আমাদের জব রেসপন্সিবিলিটিটা কি” কৌশিক জিজ্ঞেস করে।
“চলুন এবার সেটাই দেখাব।”
ভদ্রলোক ব্রিজের শেষ প্রান্তে থাকা লিফটের দিকে এগিয়ে যান আর তাকে অনুসরণ করে নির্বাক পঁচিশটি ছেলেমেয়ে।
আর ভাল লাগছিল না কৌশিকের। সেই সকাল দশটায় এসে ঢুকেছে আর এখন প্রায় তিনটের দিকে ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে। এখনও সেই একই গোলকধাঁধায় কানামাছি খেলা চলছে। খিদেতে পেট চুঁইচুঁই করছে সেকথা না হয় আপাতত বাদই থাকল, কিন্তু এতক্ষণ ধরে একটা সিগারেটেও টান না দিতে পেরে মগজটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে অক্সিজেনের অভাবে ব্রেনটা ড্রাই হয়ে গেছে আর বুকের খাঁচাটাও কেমন যেন দুমড়ে মুচড়ে গেছে। নিজের ওপর ভয়ানক রাগ হচ্ছিল ওর এই সময়ে। কি দরকার ছিল ফালতু এই সব বাহারি সাবজেক্ট নিয়ে পড়ার! পাতি গ্র্যাজুয়েট হয়ে বাপের ব্যবসায় মন দিলে এতদিনে বিয়েটা করে, দুই বাচ্চার বাপ হয়ে যেতে পারত! এই জন্যই বড়দের কথা শুনতে হয়। তখন বাবা অনেকবার নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু কৌশিকই জেদ ধরে বসেছিল। আর ইঞ্জিনীয়ারিং ডিগ্রিটা পাবার যদি এতই লোভ ছিল তবে ফুড টেকনোলোজি নিয়ে পড়লেই ল্যাঠা চুকে যেত। ডিগ্রি ও জুটত আবার মিষ্টির ব্যবসায় সেই বিদ্যে কাজে লাগানোর সুযোগ ও থাকত।
কৌশিক বেশ বুঝতে পারছিল, ওর মেজাজের পারদ চড়তে শুরু করে দিয়েছে। খুব ক্ষিদে পেয়ে গেলে বরাবরই এমন হয় ওর। যদিও এখানে রাগ দেখানোর মত কোনো জায়গাই নেই, তবু ভয়ানক রাগ হচ্ছে, আর ওই মুখে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে মূর্তিমান ভগবান সেজে ঘুরে বেড়ানো লোকটার চুলের মুঠিটা ধরে মাথাটা দেওয়ালে ঠুকে দিতে ইচ্ছে করছে!
লিফটটা যেখানে এসে থামল সেটা একটা প্রায় অন্ধকার চাতাল মত জায়গা, রাক্ষসের পেটের মত বিরাট লিফটা থেকে নেমে চাতাল বরাবর এগোতে গিয়ে অনেকেই হোঁচট খেল। চাতালটা শেষপ্রান্তে পৌঁছে, আলো আঁধারিতে কৌশিক দেখল ওখানে পরপর সাজানো রয়েছে কতগুলো ছোট ছোট বাক্সের মত জিনিস। চোখটা অন্ধকারে একটু সয়ে যাবার পর ও দেখতে পেল ওখানে কয়েকশ বাক্স রয়েছে আর প্রতিটা একই রকম দেখতে। বাক্সগুলো মেরেকেটে ফুট তিনেক উঁচু, তার বেশি নয় আর চওড়াও খুব কম বড়জোর এক-দেড় হাত।
তাহলে এইগুলোর মধ্যেই মেশিন থাকে ভাবল কৌশিক।
“আসুন” একটা বাক্সের দরজা খুললেন ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের পেছন দিক থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল পঁচিশটি ছেলেমেয়ে, ভেতরে কি আছে দেখার জন্য। ভদ্রলোক এবারে সামনে থেকে সরে দাঁড়ালেন।
পেটভর্তি ক্ষিদে আর প্রায় ফাঁকা হয়ে আসা মগজ নিয়ে, পঁচিশটি ক্লান্ত ছেলেমেয়ে দেখল, বেঞ্চের মত সরু একটা বেডে শুয়ে, ক্রমাগত প্যাডেলিং করে চলেছে একটি ছেলে। আর সেই প্যাডেলিং এর জেরে ঘুরে চলেছে কনভেয়ার বেল্টটি, ঘুরেই চলেছে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
অসাধারণ..অনবদ্য..
বাস্তবকে মনে করালো লেখা৷ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক৷ শেষের ট্যুইস্টটাও মারাত্মক৷ কুর্নিশ লেখিকাকে৷
Shesh ta onyorokom kichhu hobe mone hoechhilo kintu etota mormantik vabini…khub valo laglo pore.expectation bere gelo onekta..