হামিদ কায়সার
অলঙ্করণ : অনির্বাণ কায়সার
আমার বন্ধু সৈকত শুধু হাসে। কারণে-অকারণে হাসে। এই যেমন এখন বেধড়ক হাসতে লাগল, বেদম! কমলাপুর স্টেশনে আমার টিকেট-নির্দিষ্ট বগি খুঁজে না পাওয়ার ঘটনা শুনে, এবং তার পরপরই অপ্রত্যাশিতভাবে বসার দারুণ একটা রাজসিক ব্যবস্থা হয়েছে জেনেও- হাসতে হাসতে ওর বিষম খাওয়ার জো হলো এবং হাসতে হাসতেই ও মোবাইলের লাইন কেটে দেওয়ার আগে-আগে জানিয়ে রাখতে পারল যে, আচ্ছা ভাই আসেন! আমি সারারাত আপনার জন্য জেগে থাকব, আপনি যখন খুশি কল দিয়েন! তারপরও ও কথাটা শেষ করতে পারেনি হাসির উচ্ছ্রিত ঝর্ণাধারায়!
সত্যি কথা বলতে কি, সৈকত ওর এই হাসিটুকুর জন্যই ঢাকা শহরে থাকতে পারল না। হাঁ, সত্যি, এই হাসির স্বভাবের জন্যই ওকে ঢাকা শহর ছাড়তে হলো। ঢাকায় তো আর এতো হাসার অবকাশ নেই, এতো হাসার সুযোগ কেউ দেয় না ঢাকা-শহরে। এখানে সবাই উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। কারো দিকে কারোর তাকানোর অবসর নেই। দম ফেলার ফুরসত নেই। তাড়াগ্রস্ত সময়ে তাই কারণে-অকারণে কাউকে হাসতে দেখলে ঢাকা শহর তাকে ভালো চোখে দেখে না, ভ্রুকুটি তোলে, মনে করে যে ভারসাম্যহীন বা পাগল কিনা।
তবে যে ওকে কেবল এ-হাসির স্বভাবের জন্যই ঢাকা ছাড়তে হয়েছে, ব্যাপারটা এমন ঢালাওভাবে বলাটাও সমীচিন হবে না। আসলে ওর স্ত্রীর মোটামুটি বেতনের চাকরি আর ওর নিজের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের টুকটাক ইনকামে ঢাকায় কোনোমতো জীবনটা চলে যাচ্ছিল। তা সত্ত্বেও, বউ ফাতিমা কনসিভ করার পর, ওর হঠাৎ মনের ভেতর একটা প্রশ্ন খচখচিয়ে উঠলো যে ওর অনাগত সন্তানটি মানুষ হবে কিনা এ-ঢাকা শহরের ময়লা নর্দমার জঞ্জালে? শ্বাস নেবে শিসাযুক্ত বিষাক্ত হাওয়ায়? বেড়ে ওঠবে ভিড় যানজটে ভরা স্বার্থান্ধ সব মানুষের ভাগাড়ে? তারচেয়ে কেন গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছে না সে? সেখানে তো এখনো গাছপালা আছে, নদীগুলো ধুকতে ধুকতেও বইছে। হাওয়া সেখানে এখনো সবুজ নির্মল, পাখিরা গান গাওয়াও ভুলে যায়নি সম্পূর্ণ। কাকলি আছে। দিগন্ত-বিস্তৃত প্রায় একশো একর জমি অনাবিল সবুজের ঢেউ হয়ে ওকে ক্রমশ ডাকতে লাগলো।
সন্দেহ নেই যে, এই একশো একর জমিই ওকে লোভ বা প্রলোভন বা নির্ভরতা বা অবলম্বন যাই-ই বলি না কেন, ঢাকা ছাড়তে সবচেয়ে নিয়ামক ভূমিকা রেখেছে। যদি ওখানে কৃষি-খামার করা যায়! জৈব সার বা দেশীয় গোবর সার ব্যবহার করে ফলানো যায় শাকসবজির বিপুল আবাদ, তার আয়ে সন্তানকে নিয়ে ওদের দুজনের ছোট সংসারটা ভালোভাবেই চলে যাবে। তাছাড়া ফাতিমাকে নিয়ে একটা কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারও গড়ে তোলা সম্ভব! সব মিলিয়ে বেশ হাইজিন জীবনযাপনই হবে। তারপর ও আর এক মুহূর্তও ভাবার জন্য দেরি করেনি। সন্তান গ্রামের বাড়িতে জন্ম দেওয়ার শখ- এ অজুহাত দেখিয়ে চিরকাল গ্রামেই জীবন কাটিয়ে দেয়া অথচ নগরমুখী বাবা-মাকে বোঝাতে সক্ষম হয়ে চলে গেল নেত্রকোনা। তারপর তো প্ল্যানমতো ওখানে ওরা ভালোভাবেই জীবনযাপন করছে। ঢাকার ডাক্তারদের সিজারের ফাঁদ-পাতা বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দাইয়ের কাছে স্বাভাবিকভাবে জন্ম-নেওয়া মেয়েটাও হেসে-খেলে বড় হয়ে উঠছে, পা ফেলতে যাচ্ছে একবছরে।
সৈকত নেত্রকোনায় চলে যাওয়ার একটা প্রভাব আমার ওপর ভালোভাবেই পড়েছিল। আমি আর সৈকত- আমরা দুজনই কর্পোরেট জীবনযাত্রার ধাক্কায় ভেতরে ভেতরে তীব্র এক নিঃসঙ্গতা বোধে জর্জরিত হচ্ছিলাম। আমি জব করি একটা বিজ্ঞাপনী ফার্মের ক্রিয়েটিভ সেকশনে আর সৈকত জব করতো একটা কমপিউটার দোকানে- আমরা কী নিজেদের অফিস, কী সামাজিক জীবনে ক্রমান্বয়ে দেখছিলাম যে, মানুষ দিনদিন কেমন বদলে যাচ্ছে। প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো খোঁজ রাখছে না। সবকিছুই চলছে স্বার্থের বিনিময়ে এবং টাকা-ক্ষমতা এসবই হয়ে উঠছে মূল চালিকাশক্তি। নতুন এই দৃশ্যপটের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার মানসিকতা না থাকার ফলে দুজনই ক্রমশ নিজেদের বন্ধুহীন মনে করছিলাম। তাই সুযোগ পেলেই আমরা ছুটির দিনগুলোতে একসঙ্গে হতাম, সুখদুঃখের কথা বলতাম আর এই দরদালানের ঢাকা শহরে কোথাও এখনো একফোঁটা সবুজ আছে কিনা, তারই খোঁজ রাখতাম। আমরা দুজন কখনো সবুজ মোরাম বাঁধানো গুলশানের রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ পার্কে পড়ন্ত বিকেলে গিয়ে বসে থাকতাম, কখনো নগর হওয়ার অপেক্ষা-কাতর নগরের বাইরে প্লটসমৃদ্ধ তিনশো ফুট বা আফতাবনগরে ছুটে বেড়াতাম।
সৈকত ঢাকা শহর ছেড়ে যাওয়ার পর আমার এই সবুজ ভ্রমণটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। একা একা আর কোথাও যেতে উৎসাহ পাই না। আমি ক্রমেই ওর অভাব অনুধাবন করি। সৈকতও যে আমার অভাব সেই গ্রামের নিভৃতে গিয়েও বোধ করছিল, তারও অবশ্য বেশ নমুনা পাচ্ছিলাম। সেখানেও তো সবুজের অপমৃত্যু ঘটতে শুরু করেছে! দুর্বিপাক সেখানেও ক্ষয়ের মতো। তাই কদিন পরপরই ও আমাকে ডাকতে লাগলো, ভাই শুক্রবারে হাওর এক্সপ্রেসে ওঠে চলে আসেন। শিমুলবাগান দেখতে যাবো। কখনো বা আমন্ত্রণ জানায় হাওর দেখতে। ভরা থই থই বর্ষায় একবার আমরা দুজন খালিয়াজুড়ি-কৃষ্ণপুর হাওরে বেড়িয়ে এসেছি। এভাবে কখনো ওর ডাকে সাড়া দিই, কখনো আবার তাল মিলিয়ে ছুটে যেতে পারি না। কিন্তু এবার আর ওর ডাককে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারলাম না। ওর জোর নিমন্ত্রণ, ভাই! কৃষ্ণপুর ডাকবাংলোয় চলেন দুটোরাত একসঙ্গে কাটিয়ে আসি। আমি সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলাম। ভরা বর্ষার কৃষ্ণপুরের ডাকবাংলোয় দু-রাত থেকে এলেও উন্নায় কখনো যাওয়া হয়নি। সৈকত আমাকে সব সময়ই প্রলুদ্ধ করে এসেছে, উন্নায় নাকি ধানক্ষেতের সবুজ অন্য আরেক রূপের বিভূতি নিয়ে হাজির হয় হাওরে। সে নাকি অদ্ভুত এক দৃশ্য! মাঠের পর মাঠ, দিগন্তের পর দিগন্ত ছড়িয়ে থাকে ধানক্ষেতের অনাবিল সবুজ। আর সেই সবুজের হাতছানি যে আমাকে ডাকবে না, তাও কি হয়!
গত পরশু নাকি তার আগের দিন আমি নিজে এই কমলাপুর স্টেশনে এসে টিকেট নিয়ে গেলাম। কী করবো! এখনো অনলাইন অ্যাপস্-এ অভ্যস্ত হতে পারিনি। তবে তিনদিন আগে গিয়েও প্রত্যাশামতো শোভন চেয়ার আমার কপালে জুটেনি। অথচ সৈকত আমাকে বারবার সতর্ক করেছে, ভাই শোভন চেয়ার ছাড়া আসবেন না। তিনদিন আগে টিকেট কাটলেই শোভন চেয়ার পাবেন। ওর কথামতো তো আমি তাই-ই করেছি। তবু কেন যে শোভন চেয়ার জুটলো না- সেটা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি! যাত্রাটা হয়তো দুতিনদিন পিছিয়ে দিলে শোভন চেয়ার পাওয়া যেত! আমার তো আর সে-উপায় নেই। অফিস আছে, ছুটিছাটা নেয়ার ব্যাপারস্যাপার আছে। তাছাড়া কাউন্টারের সুন্দরী মেয়েটার প্রভাব থাকলেও থাকতে পারে। তিনি আমাকে শোভন ক্লাস নিতেই প্ররোচনা যুগিয়েছিলেন। নিয়ে যান, সিট ভালোই হবে। তো আমিও উনার কথায় আস্থাবান হয়ে ফরফর করে টিকিট কেটে চলে এলাম। তখন কে জানতো যে, সে টিকিট নিয়েই এতো কাহিনি হবে!
হাওর এক্সপ্রেস ছাড়ে রাত এগারোটা পঞ্চাশে। রাস্তায় প্রবল যানজট হয় বলে আমি আগে আগেই বেরিয়ে এসেছিলাম বাসা থেকে। কিন্তু হায়! সেদিন রাস্তা এতো ফাঁকা ছিল যে, আমি ট্রেন ছাড়ার একঘণ্টা আগেই পৌঁছে গেলাম কমলাপুর স্টেশন। গিয়ে দেখি অলরেডি হাওর এক্সপ্রেস দু-নম্বর প্ল্যাটফরমে ভিড়িয়ে রাখা হয়েছে। মনে মনে একটু পুলকিত হয়েই ছুটে গেলাম ট্রেনের দিকে। সময় যেহেতু আছে, বেশ ঠাণ্ডা মাথায় এক্সট্রা ওয়ান বগিটা খুঁজে নেব! তো আমি ঢিমেতালে ভঙ্গিতেই ট্রেনের এ-প্রান্ত থেকে সে-প্রান্ত যাই। এক্সট্রা ওয়ান আর খুঁজে পাই না। খুঁজে পাই না তো পাই-ই না। আমার মাথা খারাপ হওয়ার জো হয়! মনে মনে নিজের ওপরই আস্থা হারিয়ে ফেলি! কোথাও কি কোনো ভুল হচ্ছে! এক্সট্রা ওয়ান চোখে পড়ছে না কেন? আমি আবারও এ-মাথা থেকে ও-মাথায় দিশেহারা আতংক নিয়ে ছুটি। আমার কি মতিভ্রম হলো? নাকি দৃষ্টিশক্তিই হারাতে বসেছি! হঠাৎ এক্সট্রা থ্রি-র সামনে একজন অ্যাটেনডেন্সকে দেখে শরণাপন্ন হলাম। আমার হাতের টিকেট তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ভাই! আমি তো এক্সট্রা ওয়ান খুঁজে পাচ্ছি না।
তিনি আমার টিকেট দেখামাত্রই আর্তনাদ করে উঠলেন, আপনে তো ভালো সমস্যায় পড়েছেন। আজ তো এক্সট্রা ওয়ান লাগায়নি। বলেই আমাকে টানতে টানতে এক্সট্রা থ্রির দরজা দিয়ে ট্রেনের ভেতরে উঠিয়ে নিলেন। আমাকে আহা উহু বা হতাশা প্রকাশেরও সুযোগ দিলেন না। টানতে টানতে কোণের দিকের এক ছোট্ট কামরার সামনে দাঁড়ালেন। ত্বরিৎ ক্ষিপ্রতায় লোহার দরজা খুলে ঢুকিয়ে দিলেন সেখানে। বাইরের জানালা খোলা। ডানপাশের সিটে দুজন আরামসে বসা যাবে। আর বামপাশের সিটটা উঁচু। দুজনের ব্যাগ বা জিনিসপত্তর রাখার ব্যবস্থা বোধহয়। ঝট করে কোনো সিট নাম্বার চোখে পড়লো না। অ্যাটেনডেন্স আমাকে জানালার পাশে বসিয়ে দিয়ে হাতের ইশারায় কী একটা ইঙ্গিত করে ব্যস্ত-ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন। আমি আমার দুপা আরামে ছড়িয়ে বসে পড়লাম। মনে মনে বেশ বিগলিত বোধ করছি, আমি কি সত্যি সত্যি এই আসনে চেপে মোহনগঞ্জ যাচ্ছি? তাহলে তো পোয়াবারো। কিন্তু আনন্দে যে পুরোপুরি ভাসবো, তাও পারছি না। অ্যাটেনডেন্স লোকটি তো আমাকে কিছুই বলেনি। শুধু মোরগার মতো বসিয়ে রেখে চলে গেলেন। আমাকে অবশ্য খুব বেশিক্ষণ থাকতে হলো না অপেক্ষায়। একটু পরই অর্ধ-ময়লা শাদা স্যুট পরা ছোটোখাটো সাইজের কালো অ্যাটেনডেন্স লোকটা একসঙ্গে তিনজন যাত্রীকে ধরে বগলদাবা করে এ-কামরাটায় ঢুকলেন। একজনকে বসালেন আমার পাশেই। আর বাকি দুজনকে বসিয়ে দিলেন সেই বাক্সপ্যাটরা রাখার উঁচু সিটে।
তারপর তিনি ভেতর থেকে লোহার দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে, তিন যাত্রীর দিকে তাকিয়ে অর্ডারের ভঙ্গিতে বললেন, দেন! আপনাদের সিটের ব্যবস্থা করে দিছি।
আমার তিনপাশের তিনযাত্রী যে একসঙ্গে আসেনি, তারা আলাদা আলাদাভাবে আসা মানুষ, তা তাদের কথাবার্তা আর বডিল্যাঙ্গুয়েজেই প্রকাশ পেতে লাগলো। তাদের মধ্য থেকে একজন যিনি লুঙিপরা, হঠাৎ করেই ওজর দেখাতে লাগলেন যে, আরে ভাই ব্যস্ত হইছেন ক্যানো। টাকা তো নিবেনই। একটু বসি, জিরাই, তারপর দিই। অ্যাটেনডেন্স লোকটি রুক্ষ হয়ে উঠলো, না না। নগদ ফগদ দিয়া দেন। নাইলে বসার মানুষের অভাব নাই। আইনা বসাইয়া দিমু।
এই এক কথাতেই কাজ হয়ে গেলো। লোক তিনটি সুড়সুড় করে যার-যার পকেট থেকে টাকা বের করে অ্যাটেনডেন্সের হাতে বাড়িয়ে দেয়। একজনের টাকার অংক দেখে হুংকার দিয়ে ওঠলো মানুষটা, দুইশো ক্যানো দিলেন? বাকিটা?
বাকিটা একটু পরে লন। ভাঙতি নাই।
কতো টাকার ভাংতি? দেন আমি ভাংতি দেব।
তখন লোকটি উলটো বললো, মিয়া দুইশো টাকাই তো রাখতে পারতেন? আপনেগো প্যাট আর ভরতে চায় না।
আপনে তো ভেজাইলা মানুষ! উপকারিরে বাঘে খায়। বাইর হন। বাইর হন। ভেজাইলা মানুষকে তখন অ্যাটেনডেন্স বাইরে নেওয়ার জন্য টানাটানি শুরু করল। সে অমনি ভালোমানুষের মতো আরো পঞ্চাশ টাকা বের করে আপত্তি জানানোর ভঙ্গিতে বলল, আপনে গো আর আউশ মিটে না!
আমার সিটে একজন আর সামনের সেই উঁচু চূঁড়ামতো জায়গা, যেখানে মালছামানা রাখার কথা, সেখানে আরো দুজনকে বসিয়ে দিয়ে অ্যাটেনডেন্স, আড়াইশো টাকা করে মোট সাতশত পঞ্চাশ টাকা ঝটপট আদায় করে একটা আলগা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বোধহয় একটু বিব্রত অবস্থায় পড়লেন জনাব। আমার তো টিকেট কাটাই আছে, আমার কাছে আবার টাকা চান কীভাবে? অথচ আমার জায়গায় অন্য কাউকে এনে বসালে তিনি ঝটপট নগদ আড়াইশো টাকা লাভ করতে পারতেন। বোধহয় সে মেসেজটাই মৃদু হাসার সংকেতে আমাকে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তারপর আমার দিক থেকে উপযুক্ত সাড়া না পেয়ে আমাদের চারজনকে বিপুল সাহস যুগিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে যথেষ্ঠ সাহস দিতেও ভুললেন না, কেউ কিছু জিগাইলে বলবেন, আমরা টিকেট কাটছি। আরামে চইলা যান। আর দরজাটা লাগাইয়া বসেন।
শোভনের হৈ-হট্টগোল আর গণজোয়ারের ভেতর না থেকে যে, এরকম একটা স্পেশাল বন্দোবস্ত মিলে যাবে আমার জন্য, সেটা তো ভাবনার বাইরেই ছিল, অপ্রত্যাশিতও ছিল। সঙ্গে সঙ্গে সৈকতকে না-জানানোর লোভ তো আমি কিছুতেই সামলাতে পারি না! তাছাড়া বগি হাওয়া হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাও তো কম আকর্ষণীয় না! আমি একটু থিতু হয়েই সৈকতকে কল দিয়ে বসলাম। আর তখনই সৈকত আমার কথা শুনে হেসে উঠলো। ওর স্বভাবমতোই হো হো অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। বুঝতে পারলাম, আমার এমন একটা আরামে বসার ব্যবস্থা হওয়ায় ও খুব খুশি হয়েছে। খুশির জোয়ারেই হাসছে। সঙ্গে সঙ্গে এও বুঝলাম, এ হাসি ওর স্বভাবজাত মজ্জাগত।
যা হোক, সৈকতের সঙ্গে হাসাহাসি শেষ করে আমি এবার একটু নিজেকে আরামে রাখার আয়োজনে মেতে উঠি। কতক্ষণ পা দুটো উঠিয়ে জোড়াসীন বসে সুখ-সুখ কল্পনায় ভাসতে চাই। তারপর সিদ্ধান্ত নিতে পারি না, বই পড়ে সময় কাটাব নাকি গান শুনে। অবশেষে আমি ফেসবুকেরই দ্বারস্থ হই। একটু পর ট্রেনও গা ঝাড়া দিয়ে চলতে শুরু করল। আমি মাঝে মধ্যে আড়চোখে অন্য তিনযাত্রীকেও দেখি। আমারই মতো, নিজেদেরকে একটা স্বস্তির জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সফলতায় কীভাবে এই বিশেষ সুবিধাটুকু উপভোগ করবে, তারই আয়োজনে বুঁদ হয়ে আছে। বিশেষ করে সামনের দিকে বসা দুজন। ভেতর থেকে কামরার লোহার দরজাটা ভালোমতো চাপিয়ে দিয়ে- আসন একটু উঁচু বলেই কিনা, দুজনই পা উঁচিয়ে জুত করে বসেছে। আর আমার পাশের জনও বেশ রিল্যাক্সড। চোখেমুখে শান্তির ভঙ্গি। হবেই তো! প্রত্যাশার বাইরে এ-প্রাপ্তি। ওরা তিনজন ধরেই নিয়েছিল সারা পথ ট্রেনে যেতে হবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এ-সুখের আবেশেই কিনা, খুব দ্রুতই দেখলাম, তিনজনই ঘুমিয়ে পড়লো। এভাবে ঘুমিয়ে পড়তে পারলে আমার জন্যও ব্যাপারটা সুখকর হতো। যা আমার জন্য ভীষণ জরুরিও। হার্টের রোগী বলে কথা। ডায়াবেটিসও আছে। ওদের দেখাদেখি তাই ঘুমের চেষ্টা করি। ঘুম আসে না। ঘুমের কোনো লক্ষণও পাই না- ঝিমানো কিংবা ক্লান্তিভাব।
আসলে আমার সত্তার আরেকটি অংশ যে ঘুমাতে চাইছে না, সে সত্যও আমার কাছে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে। এই যে সঙ্গে এতো বড় ব্যাগ, একে অরক্ষিত রেখে কি আমি শান্তিমতো ঘুমাতে পারব? আমি যেভাবে ব্যাগটাকে শক্ত করে ধরে রেখেছি, ঘুমিয়ে পড়লেই যে আমার হাতের বন্ধন শিথিল হয়ে পড়বে- সেই সত্য কি আমি জানি না? আমি মনে মনে হিসেব কষতে লাগলাম, কত টাকার জিনিস থাকতে পারে আমার এ-ব্যাগে। একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা- দাম এক লাখ বিশ হাজার টাকা। লেনেভো একটা নোটবুক বাইশ হাজার টাকা। এছাড়া কাপড়চোপড় বইপত্তর এটা=সেটা মিলিয়ে ধরে নিই আরো প্রায় তিরিশ-চল্লিশ হাজার টাকার জিনিসপত্তর রয়েছে। স্যামসাং গ্যালাক্সি মোবাইলটা অবশ্য ব্যাগে নেই। মুঠোর ভেতর। ওটাও ঘুম না আসার আরেক কারণ। বরঞ্চ মোবাইল ফোন হাতে রাখাই রিস্ক। সবাই দেখছে। এবং কখন যে লোভের থাবা কোনদিক থেকে তেড়ে আসে! ট্রেনের ভেতর থেকে যেমন হাত বাড়াতে পারে, জানালা দিয়ে ছোঁ মারার লোকেরও অভাব নেই। একবার টঙ্গীতে থেমে থাকা ট্রেনটা যখন কেবল চলতে শুরু করেছিল, বাইরে থেকে লাফিয়ে একটা হাত কীভাবে নোকিয়ার সে-সেটটা নিয়ে গেল বুঝতেই পারিনি।
অন্য তিন যাত্রীকে দেখো কতো নিশ্চিন্ত! গভীর ঘুমে ডুবে আছে। সবার কাছেই মোবাইল ফোন। কারো ব্যাগে বা কারো পকেটে। দেখেছি তো একনজর। কারোর মোবাইলের দামই কোনোভাবে একহাজার টাকার ওপরে হবে না। কেন যে আমি এতো দামি দামি সব জিনিসপত্তর নিয়ে ট্রাভেল করছি! নিজের ওপরই নিজের চরম বিরক্তি লাগলো। যত ঝাড়া হাত-পা থাকা যায়, ততই যে জীবন সহজ এবং নির্ভার এটা বুঝেও যেন বুঝতে চাই না। মেনে চলাটা সত্যি টাফ।
কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর স্টেশনের দূরত্ব খুব বেশি নয়। অথচ ট্রেনটা যেন বেশ সময় নিয়ে নিয়েই পৌঁছাল বিমানবন্দর স্টেশন এবং বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলো। মনে হচ্ছে ট্রেনটি স্টেশন হিসেবে এ-বিমানবন্দরটিকে খুব ভালোবাসে। এখান থেকে ওর সরতেই ইচ্ছে করছে না। যেন নামবে স্টেশনটার প্ল্যাটফর্মে। একটা পান মুখ দিয়ে চিবুতে চিবুতে ঘুরে ঘুরে দেখবে সব। তারপর আয়েশে ওঠার পর ধীরে-সুস্থে আবার চলতে শুরু করবে। যেমনটা আমার হয়। স্টেশনে-স্টেশনে নামাটা আমার খুব পছন্দ। স্টেশনে নামব, ঝাল বা টকজাতীয় একটা কিছু খাব, নিছক চুমু দেব চায়ের কাপে। তারপর ট্রেন ছাড়ার সংকেত শুনলেই লাফিয়ে ছুটে যাব কম্পার্টমেন্টের দিকে। এখন আর সেটা সম্ভব হলো না। সঙ্গে শুধুমাত্র এই দামী জিনিসপত্তরসমেত ব্যাগটা থাকার কারণে।
যা হোক, ট্রেনটি আবার ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি আর ঘুমানোর চেষ্টা না করে একটা ভিডিও সঙ দেখায় মেতে থাকতে চাইলাম। বাড়তি একটা দারুণ আসন যখন পেয়েই গিয়েছি, মুহূর্তটা মনে হয় উপভোগ করাই ভালো। বাইরে ফুরফুরে বাতাস, শীত চলে যাওয়ার মুহূর্তে যে-রকম থাকে আর কি, বাতাসে শীতলতার পরশ অথচ খুব ঠাণ্ডা ব্যাপারটাও নেই। ভালোই লাগছিল। যেন বসন্তের মুখরিত আহ্বান। আর এদিকে মোহনীয় সুর আর মাদকতাপূর্ণ দৃশ্যপটের দ্বিমুখী সংযোগ। যাকে বলে আনন্দের বুদবুদে টগবগ করতে লাগলাম। ট্রেন যত এগোয় আমার আনন্দ যেন নতুন নতুন পুলকিত পাখনায় নয়া পুচ্ছতা পায়। আর কে না জানে মানুষের আনন্দময় মুহূর্তগুলো কাটে দ্রুত। তাই টঙ্গী স্টেশনটাও বুঝি একটু আগেভাগেই এসে পড়লো।
বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকজন যাত্রীকে কম্পার্টমেন্টে বলতে শুনলাম হাওরের তো টঙ্গীতে স্টেশন নাই। আজকে ধরল যে! ওদের কথোপকথন থেকে উত্তরও মিলল। আজ দ্বিতীয় বিশ্ব এজতেমা শেষ হয়েছে। হুমম, এখন তো আবার এজতেমা হয় দুটো। বেলা বারোটা থেকেই লোকজন যে-যার গন্তব্যে ফিরতে শুরু করে। সে হিসেবে এখন ফেরার শেষবেলা। বাইরে তাকিয়ে তার প্রভাবও দেখলাম। কয়েকজন মুসল্লি টুপলাটুপলি নিয়ে দাঁড়ানো। কেউ কেউ ট্রেনে ওঠার চেষ্টায় বগি থেকে বগিতে ছুটোছুটি করছে। তবে মুসল্লিদের চেয়ে লক্ষ্য করলাম পুলিশের সংখ্যাই বেশি। এবং সবাই প্রায় লাগেজসমেত। মুসল্লিদের ফেরার সময় বোধহয় শেষ হয়ে এলো। ডিউটি শেষ করে শুরু হয়েছে এখন পুলিশের ফেরার পর্ব। এজতেমায় এতো বিপুলসংখ্যক মানুষ আসে যে, শুধুমাত্র গাজীপুরের পুলিশ দিয়ে বোধহয় নিরাপত্তা রক্ষা সম্ভব হয় না। বিভিন্ন ডিস্ট্রিক্ট থেকেও দায়িত্ব পালন করতে নিয়ে আসা হয় পুলিশ।
টঙ্গী স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার দশ মিনিট যেতে না যেতেই আমি যখন ভিডিও সঙে ভালোই জমে গেছি আর আমার সঙ্গের বাকি তিনজনের ঘুমও পেয়েছে ব্যাপক গভীরতা; তখনই আমাদের কামরার দরজাটা ঠক ঠক করে কেঁপে উঠলো। সেই সঙ্গে শোরগোল, চিৎকার! অনুমান করলাম, নিশ্চয়ই টঙ্গী স্টেশন থেকে সদ্য ওঠা কোনো আত্মদম্ভী বেয়াড়া-গোছের যাত্রী জোর করে চাইছে এ-কামরায় নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে অথবা কোনো পলিটিক্যাল পান্ডা। তাই শব্দটা শুনেও না শোনার ভান করতে লাগলাম। ওদিকে দরজায় লাথির আঘাত বেড়ে যেতে লাগলো বেধড়ক, শব্দের মাত্রাও হতে লাগলো প্রকট। সেই সঙ্গে অস্থির কন্ঠের গালাগালি। স্বভাবতই আমার তিনসঙ্গীর ঘুম ভেঙে যায়। একজন আঁতকে ওঠে বললো, ডাকাত আইলো নাকি? শেষে আমাদের চারজনের চোখের ভাষাই এক হয়ে স্থিরীকৃত হলো যে, দরজাটা খুলে দেওয়াই দরকার। তা না হলে হয়তো দরজা না-খোলার জন্য উলটো আমাকে মাশুল দেওয়া লাগতে পারে। পাশে বসা ছেলেটি হন্তদন্ত অস্থির ভঙ্গিতে ঠেলে-ধাক্কিয়ে দ্রুত খুলে দিল দরজা। অমনি দুজন বেশ দশাসই পুলিশ অফিসারের রাগী ক্রদ্ধ মুখ দরজার সামনে দৃশ্যমান হলো। গাল পেড়ে উঠলো একজন, অ্যাই দরজা খুলতাছিস না কেন মাঙের পোলা। বাপের সম্পত্তি পাইছস। বাইর হ। মাদার চোদের বাচ্চারা!
আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল আমার! কোনোদিন যে আমার মতো সাদাসিধে একজন সাধারণ চাকুরীজীবী মানুষকেও পুলিশের গালি হজম করতে হবে, কল্পনায়ও ছিল না। হয়তো সরাসরি আমাকে গালি দেয়নি, কিন্তু আমাদের চারজনের ওপরই তো বর্তে সে গালির তবারক। যাকে বলে একেবারে ধুর ধুর করে তাড়ানো! সে-ভঙ্গিতেই সবাইকে কামরা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুকুম দিল দুজন। আমার সঙ্গে যে তিন সহযাত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, ওরা তিনজনই যেহেতু টিকেট কাটেনি, সম্পূর্ণ অবৈধ, সুড়সুড় করে সোজা বেরিয়ে গেল। কিন্তু আমি তো টিকেট কেটেছি এবং সেটা আমার হাতের মুঠোর শক্ত বন্ধনে ধরাও রয়েছে। আমি কেন বেরিয়ে যাব? শেষবারের চেষ্টায় হাতের টিকেটটা দেখিয়ে বললাম, আমার তো টিকেট আছে।
পুলিশ অফিসার জানতে চাইলেন, সিট নাম্বার কতো। বললাম বাইশ। সে তখন আমি যে-জায়গাটায় আসন নিয়েছিলাম সেখানে আরামে নিশ্চিন্তে নিজেকে ঢেলে দিয়ে হালকা চালে জানালো, বাইশ নাম্বারে গিয়ে বসেন। তাকে বোঝাতে চাই, বাইশ নাম্বারে বসবো কী, সে বগিটাই তো নাই! আরেকজন অফিসার দরজা চাপাতে শশব্যস্ত হওয়ার ভঙ্গি দেখিয়ে পরামর্শ দিল, অ্যাটেনডেন্সকে জানান। কোথাও না কোথাও বসিয়ে দেবে! কথা বলতে বলতেই সে রুমের দরজাটা ভেতর থেকে এমনভাবে চাপাতে লাগলো যে, আমি রীতিমতো সরে আসতে বাধ্য হলাম।
সরে আসতে আসতেই আমি আর ওই বিশেষ কামরার মানুষ রইলাম না, হয়ে ওঠলাম এক্সটেনশন থ্রি বগির অবাঞ্চিত একজন। হ্যাঁ অবাঞ্চিতই তো বলব। তা ছাড়া আর কি! যেখানে বসার তো কোনো সিট দূরের কথা, একতিল দাঁড়ানোর জায়গাও দুর্লভ। সম্ভবত একটা পিঁপড়েও এখন এই বগির ভেতর হাঁটার কথা ভাবতে পারবে না। পদ্মায় বাড়ি ভেঙে গেলে কেমন অনুভূতি হয় জানি না, মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়লে কেমন লাগে সে অভিজ্ঞতাও অজ্ঞাত- কিন্তু বুকের ভেতরটায় যেন এক প্রলয়কাণ্ড ঘটে যেতে লাগল। নিজেকে এতোটা অসহায় আমার আর কখনোই মনে হয়নি। ট্রেনের টিকেট কেটে এসেও যে কেউ এমন ভয়াবহ অবস্থায় পড়তে পারে, তা আমার ধারণায় তো ধারণা, কল্পনায়ও ছিল না। লোকজনের চিপার ভেতর চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যখন কী করবো না করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না, তখনই সৌভাগ্যক্রমে দেখলাম যে, একজন লম্বাচওড়া পাতলা কোঁকড়া চুলঅলা অ্যাটেনডেন্স এসে হাজির হল। শাদা পুরনো ময়লা এপ্রোণ গায়ে চড়িয়ে সে ডানদিক থেকে বামদিকে যাচ্ছিল। আমি তার পথ আটকে দাঁড়াই। গভীর অভিযোগের সুরে টিকেট দেখাতে দেখাতে জানালাম, টিকেট কেটেও কেন আমার এ অবস্থা হবে? বলুন? জবাব দিন?
মনে হলো তিনি বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছেন। কিন্তু কোনো জবাব দিলেন না। বা কী জবাব দেবেন, তা যেন বুঝে উঠতে পারলেন না। নীরবে শুধু তাকে অনুসরণ করতে একটা ইশারা দিলেন। অগত্যা আর কী। আমিও তাকে নীরবে অনুসরণ করি। আমরা এক্সটেনশন থ্রি থেকে নতুন আরেক কম্পার্টমেন্টে পৌঁছাই।
এটা কি আসলে কম্পার্টমেন্ট? আমি ওখানে ঢুকেই হোঁচট খেলাম। দুপাশে কোনো আসন নেই। ঢালাও মেঝেতে মাদুর পেতে বসে আছে নানা-বয়সী লোকজন। বিশেষ করে যুবকের সংখ্যাই বেশি। মাঝে-মধ্যে নারীও আছে এক দুজন। আর আছে পুলিশ। এতো পুলিশ কেন আজ? নিজের ভেতর টের পাই পুলিশের প্রতি তীব্র রাগ! হুঁট করে দুজন কোথা থেকে এসে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। অনতিবিলম্বেই আমার রাগটা পুলিশের পাশাপাশি তাবলীগ জামাতের ওপরও আছর হয়। ওদের জন্যই তো এতো পুলিশ! হঠাৎ মনে হয় আমার! তাবলীগ জামাত নাকি দু-গ্রুপ হয়ে গেছে! এবং এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের ওপর প্রবল মারমুখী! সেজন্যই বুঝি এবার এজতেমায় পুলিশের এতো ব্যাপক উপস্থিতি!
দুপাশে লোকজন এতোটাই ঘন হয়ে বসা যে, মাঝখান দিয়ে যাওয়া-আসার পথটা একদম সরু। সেখান দিয়ে হেঁটে গেলে দুপাশের কোনো কোনো বসা মানুষের গায়ে পা লেগে যেতে বাধ্য। আমি অতি সাবধানে সে-পথে লম্বু অ্যাটেনডেন্সের পেছন পেছন হাঁটতে থাকি। এবং একসময় আমরা এক গরম ইলেকট্রিক চুল্লির সামনে গিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে পড়ি। বিশাল বড় কোমর-সমান বৈদ্যুতিক চুল্লিতে চা বানানোর ততোটাই বিশাল কেতলি। ভেতর সাইডে দাঁড়িয়ে একজন রেলওয়ের পোশাক পরা মানুষ চা বানাতে ব্যতিব্যস্ত। তার পেছনে বগির শেষ সীমানা ঘেঁষে লোহার বেঞ্চিমতো টুলে বসে আছে দুজন পুলিশ, তিনচারজন মাতবর গোছের মানুষ। যারা দেশ এবং দেশের উন্নয়ন নিয়ে গরম গরম বক্তব্য দিচ্ছিল। লোকজনের চোখে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নাকি চোখেই পড়ছে না বলে, তারা বেশ উষ্মা প্রকাশ করছিল। আমাকে সেই জ্বালাময়ী বক্তব্যের কাছে এবং চুল্লির উত্তাপের কাছে রেখে লম্বু অ্যাটেনডেন্স বললেন, আপাতত এখানেই দাঁড়ান। আমি দেখছি কী করা যায়। এই বলেই অ্যাটেনডেন্স লোকটা আর দাঁড়াল না, যে-সরু পথে আমরা এসেছিলাম, সে-পথেই সে বেশ অভ্যস্ত ভঙ্গিতে দ্রুত হেঁটে এক্সটেনশন থ্রির দিকে মিলিয়ে গেল।
একটু পরই আমি বৈদ্যুতিক চুল্লির গরম ভাপের সঙ্গে টের পেলাম, পেছনে চা-বানানোর লোকটার মেজাজের গরমও কতটা উত্তাপ ছড়ানো থাকতে পারে। বাবুর্চি চা বানাচ্ছিলেন আর আমাকে বিরক্ত চোখে দেখছিলেন। তিনি যে এখানে আমার এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা সহ্য করতে পারছেন না বেশ বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু বুঝলে কী হবে! আমার তো কিছুই করার নেই। বস্তুত এখান থেকে সরার বিন্দুমাত্র স্পেস নেই কোনো। ডানপাশে এক পুলিশ তার ডান ও বাম পা দুদিকে ছড়িয়ে বসে আছে। তার গা থেকে নিজেকে বাঁচাতে এক বোরকাপরা তরুণী বৈদ্যুতিক-চুল্লির প্রায় নিচ পর্যন্ত চলে এসেছে। আরেকটু ভেতরে চাপলে যে সে-বেচারীর বোরকায় আগুন ধরে যাবে, সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আর পুলিশের ওপাশে আরেক ভদ্রলোক কোনোমতো জবুথবু হয়ে বসা। কারণ তার ওপাশে আর জায়গা নেই। সেখানে ছোট একটা টেবিলমতো, পার্মানেন্ট। যার ওপরে তিন তরুণ বসে বসে পা ঝোলাচ্ছে। টেবিলের ওপাশেরই আবার পাতা মাদুরে গাদাগাদি করে বসে আছে তরুণের দল। কেউ কেউ এই তুমুল হইচই ভিড়বাট্টার মধ্যেও চুটিয়ে ঘুমাচ্ছে। মাঝখানে সরু চলাচলের রাস্তার পর বাঁপাশেও একই অবস্থা। কোথাও তিল ঠাঁই নাহি রে!
মাঝখানে কেবল আমিই একা চুল্লির গায়ের ঠেকা সামলাতে কিছুটা চলাফেরার খালি জায়গাটাতে নিজেকে কোনোমতো ঠেকাঠোকা দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আর মাঝে-মধ্যেই এর-ওর ঠেলাধাক্কা খাচ্ছি। বিশেষ করে বাবুর্চি একে-ওকে যখনই চা দিতে যাচ্ছে আসছে আমাকে ইচ্ছে করেই যেন বেঢপ একটা ধাক্কা দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তিনি আমার এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছেন না। একবার তো মুখ ফসকে ধমকেই ওঠলেন, আপনে যে এখানে বেক্কলের মতো দাঁড়াইলেন, মানুষ কেমনে হাঁটাচলা করবো, চিন্তা করছেন? আমি তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে চুলার দিকে সরে গিয়ে তাকে যাওয়ার পথ করে দিলাম। আর এই চুলার দিকে সরতে গিয়েই যে ডানপাশে পুলিশের সামনে বসা লোকটির পায়ে পা লেগে যাবে, কে জানতো। সে সাপের মতো ফস করে ওঠলো, অই মিয়া চোখে দেখেন না? পাড়াইতাছেন যে?
আমি আসলে কোনদিকে যাব। চরম অসহায় বোধ করি। তখনই একটা উনিশ-বিশ বছরের যুবক মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আমাকে সাপোর্ট দিতেই যেন বলে উঠলো, আরে মানুষটা কী করবো? আসেন ভাই, আপনে আমার এখানে আসেন।
আমি দেখলাম যে, চুলার বিপরীত দিকে বসা অসংখ্য মানুষের ভেতর কোনোভাবে নিজেকে ঠেকিয়ে রেখেছে তরুণ, নিজেই ভালোভাবে বসতে পারছে না। সে-অবস্থায়ও সে চাইছে আমাকে জায়গা করে দিতে। আদতে সেখানে আমার কেন, এক বছরের শিশুর পক্ষেও বসাটা সম্ভব না। তরুণ আমাকে দ্বিধান্বিত দেখে আবারো ডেকে ওঠলো, আরে আসেন তো!
কী করবো, আমি সত্যিই দাঁড়াতে পারছিলাম না। একে তো চুলার উত্তাপ আর বাবুর্চির গরম চাহনি! দুই, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে আমার ব্যথা ধরে গেছে। তাই অসহায় আত্মসমর্পণের মতো তরুণের নির্দেশিত জায়গার দিকেই হাঁটতে থাকি। আমাকে সেমুখো যেতে দেখে সেখানে বসা একজন আতংকগ্রস্তের মতো চেঁচিয়ে ওঠলো, ‘আরে এদিকে কই বইবো?’
তরুণটি অই লোকের সঙ্গে তর্কে মেতে ওঠলো। ‘একজন মানুষের জায়গা হইবোই। কোনো ব্যাপার হইলো?’ তরুণটির দৃঢ় কন্ঠের বিপরীতে অপরপক্ষের কোনো সাড়া-শব্দ খুঁজে পেলাম না। কিন্তু আমার নিজেরো সেখানে গিয়ে বসার উৎসাহ ভেতরে ভেতরে মিইয়ে আসছিল। অযাচিতভাবে এতগুলো লোককে কষ্ট দিতে মোটেও ইচ্ছে করলো না। শুধু তো আমি নই, সঙ্গে একটা বেশ ওজনদার রুকস্যাকও রয়েছে।
তরুণটি যেন আমাকে কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকতে দিতে নারাজ। ভেতর দিক থেকে সে একটু সামনের দিকে সরে এসে রাস্তার দিকের লোকটিকে আরো একটু ভেতরের দিকে ঠেলে দেয়। আর সে ওর পাশে আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে বসানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে থাকে। বসেন তো ভাই, বসেন।
আমার এই জনযটের ভেতরও চোখের সামনে একটা ঝলমলে নীল আকাশ উঁকি মেরে ওঠলো। কতো ফাঁকা কতো স্পেস! সেখানে শুভ্র মেঘেরা কী সুন্দর ভেসে বেড়াচ্ছে! এখনো তাহলে সব মানুষ পাথর হয়ে যায়নি! হৃদয়ানুভূতির ব্যাপারটা তাহলে এখনো অবশিষ্ট আছে! আমি গুটিসুটি মেরে তরুণের পাশে নিজেকে কোনোমতো আঁটিয়ে দিই। ধীরে ধীরে যেন নিজের ভেতরে সেই ফুরফুরে বেড়ানোর আমেজটাও ফিরে পেতে থাকি। ক্রমশ ওর সঙ্গে আমার ফিসফাস আলাপ জমে ওঠে। জানলাম যে ওর নাম মঈনুল হক নিলয়। বাড়ি সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা। পড়ে আনন্দমোহন কলেজে। নিলয় যে শুধু আমারই সমব্যথী তা না, ওর ভেতরে যে একজন চেগুয়েভারা আছে তাও বেশ টের পেলাম। ট্রেন তখন জয়দেবপুর ছাড়িয়ে গিয়েছে। জায়গাটা কোথায় বলতে পারবো না। হঠাৎ করেই দেখতে পেলাম আমাকে যে বেটে কালোমতো অ্যাটেনডেন্স সেই বিশেষ রুমটিতে বসিয়েছিল, এক্সটেনশন থ্রি থেকে সে এই ক্যান্টিনের দিকেই আসছে। আর তাকে দেখতে পেয়েই কোন গর্ত থেকে যেন বেরিয়ে আসলো আমার সঙ্গে সেই বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত রুমের তিনযাত্রীর একজন! সে সোজা অ্যাপেনডেন্সের সামনের পথ আটকে দাঁড়াল, ‘অ্যাই মিয়া তুমি যে আমার কাছ থেকে সিট দিবা বইলা টাকা নিলা, সেই সিট কই? তোমার পুলিশ বাবারে বসাইয়া রাখছো। আমার টাকা ফেরত দাও।
অ্যাটেনডেন্স বুঝি এরকম অবস্থায় পড়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। গা গো করতে লাগলো। আমি তো সিট দিছিলামই। আপনে ধইরা রাখতে না পারলে আমি কি করুম?
তখন লোকটা উলটো ধমকে ওঠলো, তোমার পুলিশ বাবার লগে কি আমি নাড়াই দিমু? আমি অতো কিছু বুঝি না। আমার টাকা ফেরত দাও।
অ্যাটেনডেন্স আবারো ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে, ওতো সিট দিছিলোই, টাকা ফেরত দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু সেই যাত্রী কোনো কথাই মানতে রাজি নয়। সে আরো জোরে জোরে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিল। তখনই সেই উত্তপ্ত চুলার পেছনে বসা দুজন পুলিশের একজন প্রচণ্ড ক্রোধে চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে এলো, অ্যাই ব্যাটা। এতো ফটর ফটর করছ ক্যান। ঘাড় ধইরা কিন্তু ট্রেন থেইকা নামাইয়া দিমু। ট্রেনে ওঠছস কি মাগনা যাইতে? টাকা নিছে তো কি অইছে, আঁ? কি অইছে?
প্রতিবাদী লোকটি হঠাৎ একেবারে সামনে রাইফেল সমেত ফণা তোলা পুলিশ দেখে চুপসে যায়। কিন্তু আমার পাশে বসা নিলয় ফস করে উঠে দাঁড়ায়। সরোষে চিৎকার করে ওঠে, হেই বেটায় তো বাটপাড়ি কইরা টাকা নিছে আর আপনে তারে সাপোর্ট দিতাছেন, আপনার কি স্বার্থ, শুনি?
পুলিশ অফিসার হকচকিয়ে যায়। কেউ যে তার মুখের ওপর এভাবে দড়াম করে কথা বলে ওঠবে, তা বুঝি ওর ধারণায় ছিল না। সে যুক্তিহীনভাবে নিলয়ের ওপর ধমকে ওঠলো। চুপ করে বসো থাকো। তুমি ক্যাডা? ট্রেনের মধ্যে কোনো ঝামেলা করবা না। মাগনা যাইতে যাইতে আরাম পাইয়া গেছো।
নিলয় তবু বসে না। চুপও করে না। হ আমরা চুপ করে বসে থাকি বলেই তো আপনারা জুত পাইয়া গেছেন। ও বৈদ্যুতির চুলোর দিকেই একেবারের ক্যান্টিনের গা ঘেঁষে বসা এক বৃদ্ধা আর তার সাথের মেয়েটির দিকে হাত তুলে দেখাতে দেখাতে বললো, এই যে বুড়া বেটি আর তার নাতি নাতনি এরা কি আপনার ট্রেনে ওঠছে? আপনে কেন এগো কাছতে টাকা নিলেন? আপনে টাকা নেওয়ার কে?
পুলিশ অফিসারটি যুবকের অভিযোগের মুখে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী বলবে যেন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। হুংকার দিয়ে ওঠলো, আর একটা কথা কইলে কিন্তু থানায় ভইরা রাখুম।
নিলয় কী বলতে যাচ্ছিল। ওর পাশের দুই সহযোগী দুপাশ থেকে ওর মুখ চেপে ধরলো। ওকে জোর করে বসিয়ে দিল। নিলয় রাগে গজ গজ করতে থাকে, যা ইচ্ছা তাই করব। দেশটারে মগের মুল্লুক পাইছে।
নিলয়ের কথা হঠাৎ চাপা পড়ে যায় একদল তরুণের সমস্বর গানের দঙ্গলে। আহা! আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা! আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। গানের সুরে সুরে ক্যান্টিনের পরিবেশটা কেমন সুরেলা হয়ে ওঠে। পুলিশ অফিসারটি নিজের গাত্রদাহ লুকিয়ে আবার সেই বৈদ্যুতির চুলার পেছনের টুলটিতে গিয়ে বসেছে। বেটে কালো অ্যাটেনডেন্সও হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে কখন। অভিযোগকারী আমার সেই সহযাত্রীও আবার কোন গর্তে গিয়ে ঢুকেছে। গানের গলা ক্রমশই চড়া হয়ে উঠছে। এই ক্যান্টিনে ঢোকার মুখেই একেবারে ডানপাশে মাদুর পেতে ঘন হয়ে বসা দশবারোজনের মতো যুবক। নিলয়ের কাছে জানলাম, ওরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একসঙ্গে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছে। আর প্রতিবারই নাকি ট্রেনের টিকেট না কেটে ক্যান্টিনে বসেই বাড়ি ফেরে। ক্যান্টিনে বসার জন্য একশো দু’শো যা পারে দিয়ে দেয় জায়গামতো।
গলায় গলা মিলিয়ে গান তুলছে ওরা। আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা। আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম। ওদের গানের সুরে তালে মুহূর্তেই পরিবেশটা পাল্টে যায়।
এই রাতদুপুরে না ঘুমিয়ে যে ওরা হঠাৎ গান ধরেছে, এ যেন সব পিছুটান উপেক্ষা করে জীবনেরই এগিয়ে যাওয়ার জয়যাত্রা। মূঢ়তার প্রতি জড়তার প্রতি অবসাদের প্রতিও অবজ্ঞা। সেই জীবনের চঞ্চলতা আমাকেও স্পর্শ করে। আমি সেই তোড়ে ভেসে গিয়েই কিনা আমার বন্ধু সৈকতকে এই রাতদুপুরেও কল দিয়ে বসলাম। দেখি যে সেও জেগে আছে। ভাই আমারো ঘুম হচ্ছে না। আপনার কি অবস্থা। আমার কাহিনি শুনে সৈকত আবারো হো হো হেসে উঠলো। ভাই সিংহাসনে বসলেন। আবার রাজ্য হারালেন। এবার একেবারে ক্যান্টিনে ঠাঁই। ভালোই। উপভোগ করতে পারলে ভালোই। কজনের এসব উপভোগ করার মন আছে। আসেন ভাই! আমি জেগেই থাকবো। নেত্রকোনার আগের স্টেশনে এসে কল দেবেন।
আমার বন্ধু সৈকতের হাসির লহরীতে যুবকদের গানের জলসা আমার কাছে যেন আরো আনন্দময় স্বর্গ হয়ে উঠলো। আমি ওদের গানেই মনোযোগ দিই। কী যে মায়া ধরাইলি। আমায় পাগলি করিলি।… ওদের গান শুনি আর পুলিশ কতোদূর বোরখাপরা মহিলার দিকে এগোতে পারলো তা চাক্ষুস করি। দেখি যে ভালোই এগিয়েছে। এক পর্যায়ে রোরখা পরা ছিপছিপে নারীটি মৃদু কন্ঠে প্রতিবাদও করে উঠলো। আহা সরেন তো। এতো চাপতেছেন কেন? পুলিশ লোকটির কোনো বিকার নেই।
সৈকত আমাকে বলেছিল নেত্রকোনা স্টেশনের আগের স্টেশনে পৌঁছেই যেন ওকে আমি কল দিই। একসময় গানে গানে সেই স্টেশন এসে যায়। শেষ রাত এখন আস্তে আস্তে ভোরের প্রহরের দিকে এগোচ্ছে। কখন যে ট্রেন দেখতে দেখতে নেত্রকোনায় পৌঁছে গেল বলতেও পারবো না। হঠাৎ ট্রেনটা থামতে না থামতেই সৈকতের কল এলো, ভাই আপনি ক্যান্টিন থেকে নেমে যান। ছ নামবার বগিতে আসেন, শোভন চেয়ারে।
আমি ক্যান্টিন থেকে নেমেই সে-বগির উদ্দেশে দৌড়াতে থাকি। বগি খোঁজার আগেই সৈকতের সঙ্গে আমার প্ল্যাটফরমে দেখা হয়ে যায়। ও আমাকে নিয়ে ছ নাম্বার বগিতে উঠে বসলো।
এই ভোররাতে শোভন চেয়ারের প্রায় সব আসনই খালি। আমি আর সৈকত একসাথে পাশাপাশি বসে পড়লাম। আর সৈকত উৎসুক হয়ে আমার ট্রেনের অভিজ্ঞতার কথা আরো ডিটেইলস জানতে চাইলো। মোবাইলে তো আর সব বলা হয়ে ওঠেনি। আমি যে টিকেট কেটেও সিট তো সিট, বগিই পাইনি, সেটা শুনে ও হাসিতে ফেটে পড়ে। হঠাৎ বিলাসী কক্ষ পাওয়াটাও ওকে হাসির যোগান দেয়। আর হাসতে হাসতে আমাদের আড্ডা যখন মুখর আমাদের কথা শুনেই কিনা, পাশের সিটের এক বুড়ো অশিক্ষিত টাইপের মানুষ সৈকতের দিকে জামার পকেট থেকে বের করে ওনার টিকেটটা বাড়িয়ে দিল, দেখেন তো বাবা! আমার টিকেটটা ঠিক আছে নি? সে জানাল ৫৫ টাকা করে দুটো টিকেট কেটেছে। শ্যামগঞ্জ থেকে ঠাকুরাকোনা যাবে। সে-মতোই সে টাকা দিয়েছে। অথচ সৈকত দেখলো টিকেটের মধ্যে লেখা রয়েছে ৩৫ টাকা। তাও আবার স্ট্যান্ডিং টিকেট। শ্যামগঞ্জ থেকে নেত্রকোনা, ঠাকুরাকোনা নয়। যদিও আমরা তখন নেত্রকোনা পার হয়ে এসেছি। পরের স্টেশনেই আসবে সেই ঠাকুরাকোনা।
সৈকত টিকেটটা দেখেই হেসে ফেললো। সে হাসির সামনে থতমত স্তব্ধ বিব্রত বুড়ো। মানুষটা সৈকতের হাসিতে তো বটেই কথা শুনেও ঘাবড়ে যায়, চাচা আপনার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। টাকাও বেশি নিছে। টিকেটও দিল না, সিটও দিল না। আবার গন্তব্যের টিকেটও দিল না। আপনি তো এখন অবৈধ। আপনার এই টিকেট ছিল নেত্রকোনা পর্যন্ত। চাচা বারবার বোঝাতে লাগলো, আমি তো ৫৫ টাকা দিয়া ঠাকুরাকোনার টিকেট কাটছি। চাচার কথা শুনে আবারো হেসে উঠলো সৈকত। চাচা আপনি তো ঠিকই কাটছেন, তারা তো আপনাকে দেয় নাই। তারা দিছে অন্য টিকেট। আবারো সৈকতের হো হো হাসি। সৈকতের সেই হাসির তোড়ের সামনে দুলতে দুলতে জড়োসড়ো থতমত বুড়ো অসহায় চোখে বলে ওঠলো, হাইসেন না। হাইসেন না। এতো ফজরের সময় এতো হাসাটা ভালা না।
বুড়োর কথা শুনে সৈকতের হাসি বিব্রত হয়ে ঝুলে থাকে ওর দু-ঠোঁটের কোণে। আর, আমি চেষ্টা করি বুড়োর ভাষা বুঝে ওঠতে, কথাটা সে কি বিরক্তিতে বললো নাকি ঠাট্টা না রাগ? নাকি ঠকে যাওয়ার কষ্টে! আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
সত্যি কথা বলতে কি, সৈকত ওর এই হাসিটুকুর জন্যই ঢাকা শহরে থাকতে পারল না। হাঁ, সত্যি, এই হাসির স্বভাবের জন্যই ওকে ঢাকা শহর ছাড়তে হলো। ঢাকায় তো আর এতো হাসার অবকাশ নেই, এতো হাসার সুযোগ কেউ দেয় না ঢাকা-শহরে। এখানে সবাই উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। কারো দিকে কারোর তাকানোর অবসর নেই। দম ফেলার ফুরসত নেই। তাড়াগ্রস্ত সময়ে তাই কারণে-অকারণে কাউকে হাসতে দেখলে ঢাকা শহর তাকে ভালো চোখে দেখে না, ভ্রুকুটি তোলে, মনে করে যে ভারসাম্যহীন বা পাগল কিনা।
তবে যে ওকে কেবল এ-হাসির স্বভাবের জন্যই ঢাকা ছাড়তে হয়েছে, ব্যাপারটা এমন ঢালাওভাবে বলাটাও সমীচিন হবে না। আসলে ওর স্ত্রীর মোটামুটি বেতনের চাকরি আর ওর নিজের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের টুকটাক ইনকামে ঢাকায় কোনোমতো জীবনটা চলে যাচ্ছিল। তা সত্ত্বেও, বউ ফাতিমা কনসিভ করার পর, ওর হঠাৎ মনের ভেতর একটা প্রশ্ন খচখচিয়ে উঠলো যে ওর অনাগত সন্তানটি মানুষ হবে কিনা এ-ঢাকা শহরের ময়লা নর্দমার জঞ্জালে? শ্বাস নেবে শিসাযুক্ত বিষাক্ত হাওয়ায়? বেড়ে ওঠবে ভিড় যানজটে ভরা স্বার্থান্ধ সব মানুষের ভাগাড়ে? তারচেয়ে কেন গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছে না সে? সেখানে তো এখনো গাছপালা আছে, নদীগুলো ধুকতে ধুকতেও বইছে। হাওয়া সেখানে এখনো সবুজ নির্মল, পাখিরা গান গাওয়াও ভুলে যায়নি সম্পূর্ণ। কাকলি আছে। দিগন্ত-বিস্তৃত প্রায় একশো একর জমি অনাবিল সবুজের ঢেউ হয়ে ওকে ক্রমশ ডাকতে লাগলো।
সন্দেহ নেই যে, এই একশো একর জমিই ওকে লোভ বা প্রলোভন বা নির্ভরতা বা অবলম্বন যাই-ই বলি না কেন, ঢাকা ছাড়তে সবচেয়ে নিয়ামক ভূমিকা রেখেছে। যদি ওখানে কৃষি-খামার করা যায়! জৈব সার বা দেশীয় গোবর সার ব্যবহার করে ফলানো যায় শাকসবজির বিপুল আবাদ, তার আয়ে সন্তানকে নিয়ে ওদের দুজনের ছোট সংসারটা ভালোভাবেই চলে যাবে। তাছাড়া ফাতিমাকে নিয়ে একটা কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারও গড়ে তোলা সম্ভব! সব মিলিয়ে বেশ হাইজিন জীবনযাপনই হবে। তারপর ও আর এক মুহূর্তও ভাবার জন্য দেরি করেনি। সন্তান গ্রামের বাড়িতে জন্ম দেওয়ার শখ- এ অজুহাত দেখিয়ে চিরকাল গ্রামেই জীবন কাটিয়ে দেয়া অথচ নগরমুখী বাবা-মাকে বোঝাতে সক্ষম হয়ে চলে গেল নেত্রকোনা। তারপর তো প্ল্যানমতো ওখানে ওরা ভালোভাবেই জীবনযাপন করছে। ঢাকার ডাক্তারদের সিজারের ফাঁদ-পাতা বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দাইয়ের কাছে স্বাভাবিকভাবে জন্ম-নেওয়া মেয়েটাও হেসে-খেলে বড় হয়ে উঠছে, পা ফেলতে যাচ্ছে একবছরে।
সৈকত নেত্রকোনায় চলে যাওয়ার একটা প্রভাব আমার ওপর ভালোভাবেই পড়েছিল। আমি আর সৈকত- আমরা দুজনই কর্পোরেট জীবনযাত্রার ধাক্কায় ভেতরে ভেতরে তীব্র এক নিঃসঙ্গতা বোধে জর্জরিত হচ্ছিলাম। আমি জব করি একটা বিজ্ঞাপনী ফার্মের ক্রিয়েটিভ সেকশনে আর সৈকত জব করতো একটা কমপিউটার দোকানে- আমরা কী নিজেদের অফিস, কী সামাজিক জীবনে ক্রমান্বয়ে দেখছিলাম যে, মানুষ দিনদিন কেমন বদলে যাচ্ছে। প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো খোঁজ রাখছে না। সবকিছুই চলছে স্বার্থের বিনিময়ে এবং টাকা-ক্ষমতা এসবই হয়ে উঠছে মূল চালিকাশক্তি। নতুন এই দৃশ্যপটের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার মানসিকতা না থাকার ফলে দুজনই ক্রমশ নিজেদের বন্ধুহীন মনে করছিলাম। তাই সুযোগ পেলেই আমরা ছুটির দিনগুলোতে একসঙ্গে হতাম, সুখদুঃখের কথা বলতাম আর এই দরদালানের ঢাকা শহরে কোথাও এখনো একফোঁটা সবুজ আছে কিনা, তারই খোঁজ রাখতাম। আমরা দুজন কখনো সবুজ মোরাম বাঁধানো গুলশানের রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ পার্কে পড়ন্ত বিকেলে গিয়ে বসে থাকতাম, কখনো নগর হওয়ার অপেক্ষা-কাতর নগরের বাইরে প্লটসমৃদ্ধ তিনশো ফুট বা আফতাবনগরে ছুটে বেড়াতাম।
সৈকত ঢাকা শহর ছেড়ে যাওয়ার পর আমার এই সবুজ ভ্রমণটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। একা একা আর কোথাও যেতে উৎসাহ পাই না। আমি ক্রমেই ওর অভাব অনুধাবন করি। সৈকতও যে আমার অভাব সেই গ্রামের নিভৃতে গিয়েও বোধ করছিল, তারও অবশ্য বেশ নমুনা পাচ্ছিলাম। সেখানেও তো সবুজের অপমৃত্যু ঘটতে শুরু করেছে! দুর্বিপাক সেখানেও ক্ষয়ের মতো। তাই কদিন পরপরই ও আমাকে ডাকতে লাগলো, ভাই শুক্রবারে হাওর এক্সপ্রেসে ওঠে চলে আসেন। শিমুলবাগান দেখতে যাবো। কখনো বা আমন্ত্রণ জানায় হাওর দেখতে। ভরা থই থই বর্ষায় একবার আমরা দুজন খালিয়াজুড়ি-কৃষ্ণপুর হাওরে বেড়িয়ে এসেছি। এভাবে কখনো ওর ডাকে সাড়া দিই, কখনো আবার তাল মিলিয়ে ছুটে যেতে পারি না। কিন্তু এবার আর ওর ডাককে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারলাম না। ওর জোর নিমন্ত্রণ, ভাই! কৃষ্ণপুর ডাকবাংলোয় চলেন দুটোরাত একসঙ্গে কাটিয়ে আসি। আমি সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলাম। ভরা বর্ষার কৃষ্ণপুরের ডাকবাংলোয় দু-রাত থেকে এলেও উন্নায় কখনো যাওয়া হয়নি। সৈকত আমাকে সব সময়ই প্রলুদ্ধ করে এসেছে, উন্নায় নাকি ধানক্ষেতের সবুজ অন্য আরেক রূপের বিভূতি নিয়ে হাজির হয় হাওরে। সে নাকি অদ্ভুত এক দৃশ্য! মাঠের পর মাঠ, দিগন্তের পর দিগন্ত ছড়িয়ে থাকে ধানক্ষেতের অনাবিল সবুজ। আর সেই সবুজের হাতছানি যে আমাকে ডাকবে না, তাও কি হয়!
গত পরশু নাকি তার আগের দিন আমি নিজে এই কমলাপুর স্টেশনে এসে টিকেট নিয়ে গেলাম। কী করবো! এখনো অনলাইন অ্যাপস্-এ অভ্যস্ত হতে পারিনি। তবে তিনদিন আগে গিয়েও প্রত্যাশামতো শোভন চেয়ার আমার কপালে জুটেনি। অথচ সৈকত আমাকে বারবার সতর্ক করেছে, ভাই শোভন চেয়ার ছাড়া আসবেন না। তিনদিন আগে টিকেট কাটলেই শোভন চেয়ার পাবেন। ওর কথামতো তো আমি তাই-ই করেছি। তবু কেন যে শোভন চেয়ার জুটলো না- সেটা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি! যাত্রাটা হয়তো দুতিনদিন পিছিয়ে দিলে শোভন চেয়ার পাওয়া যেত! আমার তো আর সে-উপায় নেই। অফিস আছে, ছুটিছাটা নেয়ার ব্যাপারস্যাপার আছে। তাছাড়া কাউন্টারের সুন্দরী মেয়েটার প্রভাব থাকলেও থাকতে পারে। তিনি আমাকে শোভন ক্লাস নিতেই প্ররোচনা যুগিয়েছিলেন। নিয়ে যান, সিট ভালোই হবে। তো আমিও উনার কথায় আস্থাবান হয়ে ফরফর করে টিকিট কেটে চলে এলাম। তখন কে জানতো যে, সে টিকিট নিয়েই এতো কাহিনি হবে!
হাওর এক্সপ্রেস ছাড়ে রাত এগারোটা পঞ্চাশে। রাস্তায় প্রবল যানজট হয় বলে আমি আগে আগেই বেরিয়ে এসেছিলাম বাসা থেকে। কিন্তু হায়! সেদিন রাস্তা এতো ফাঁকা ছিল যে, আমি ট্রেন ছাড়ার একঘণ্টা আগেই পৌঁছে গেলাম কমলাপুর স্টেশন। গিয়ে দেখি অলরেডি হাওর এক্সপ্রেস দু-নম্বর প্ল্যাটফরমে ভিড়িয়ে রাখা হয়েছে। মনে মনে একটু পুলকিত হয়েই ছুটে গেলাম ট্রেনের দিকে। সময় যেহেতু আছে, বেশ ঠাণ্ডা মাথায় এক্সট্রা ওয়ান বগিটা খুঁজে নেব! তো আমি ঢিমেতালে ভঙ্গিতেই ট্রেনের এ-প্রান্ত থেকে সে-প্রান্ত যাই। এক্সট্রা ওয়ান আর খুঁজে পাই না। খুঁজে পাই না তো পাই-ই না। আমার মাথা খারাপ হওয়ার জো হয়! মনে মনে নিজের ওপরই আস্থা হারিয়ে ফেলি! কোথাও কি কোনো ভুল হচ্ছে! এক্সট্রা ওয়ান চোখে পড়ছে না কেন? আমি আবারও এ-মাথা থেকে ও-মাথায় দিশেহারা আতংক নিয়ে ছুটি। আমার কি মতিভ্রম হলো? নাকি দৃষ্টিশক্তিই হারাতে বসেছি! হঠাৎ এক্সট্রা থ্রি-র সামনে একজন অ্যাটেনডেন্সকে দেখে শরণাপন্ন হলাম। আমার হাতের টিকেট তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ভাই! আমি তো এক্সট্রা ওয়ান খুঁজে পাচ্ছি না।
তিনি আমার টিকেট দেখামাত্রই আর্তনাদ করে উঠলেন, আপনে তো ভালো সমস্যায় পড়েছেন। আজ তো এক্সট্রা ওয়ান লাগায়নি। বলেই আমাকে টানতে টানতে এক্সট্রা থ্রির দরজা দিয়ে ট্রেনের ভেতরে উঠিয়ে নিলেন। আমাকে আহা উহু বা হতাশা প্রকাশেরও সুযোগ দিলেন না। টানতে টানতে কোণের দিকের এক ছোট্ট কামরার সামনে দাঁড়ালেন। ত্বরিৎ ক্ষিপ্রতায় লোহার দরজা খুলে ঢুকিয়ে দিলেন সেখানে। বাইরের জানালা খোলা। ডানপাশের সিটে দুজন আরামসে বসা যাবে। আর বামপাশের সিটটা উঁচু। দুজনের ব্যাগ বা জিনিসপত্তর রাখার ব্যবস্থা বোধহয়। ঝট করে কোনো সিট নাম্বার চোখে পড়লো না। অ্যাটেনডেন্স আমাকে জানালার পাশে বসিয়ে দিয়ে হাতের ইশারায় কী একটা ইঙ্গিত করে ব্যস্ত-ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন। আমি আমার দুপা আরামে ছড়িয়ে বসে পড়লাম। মনে মনে বেশ বিগলিত বোধ করছি, আমি কি সত্যি সত্যি এই আসনে চেপে মোহনগঞ্জ যাচ্ছি? তাহলে তো পোয়াবারো। কিন্তু আনন্দে যে পুরোপুরি ভাসবো, তাও পারছি না। অ্যাটেনডেন্স লোকটি তো আমাকে কিছুই বলেনি। শুধু মোরগার মতো বসিয়ে রেখে চলে গেলেন। আমাকে অবশ্য খুব বেশিক্ষণ থাকতে হলো না অপেক্ষায়। একটু পরই অর্ধ-ময়লা শাদা স্যুট পরা ছোটোখাটো সাইজের কালো অ্যাটেনডেন্স লোকটা একসঙ্গে তিনজন যাত্রীকে ধরে বগলদাবা করে এ-কামরাটায় ঢুকলেন। একজনকে বসালেন আমার পাশেই। আর বাকি দুজনকে বসিয়ে দিলেন সেই বাক্সপ্যাটরা রাখার উঁচু সিটে।
তারপর তিনি ভেতর থেকে লোহার দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে, তিন যাত্রীর দিকে তাকিয়ে অর্ডারের ভঙ্গিতে বললেন, দেন! আপনাদের সিটের ব্যবস্থা করে দিছি।
আমার তিনপাশের তিনযাত্রী যে একসঙ্গে আসেনি, তারা আলাদা আলাদাভাবে আসা মানুষ, তা তাদের কথাবার্তা আর বডিল্যাঙ্গুয়েজেই প্রকাশ পেতে লাগলো। তাদের মধ্য থেকে একজন যিনি লুঙিপরা, হঠাৎ করেই ওজর দেখাতে লাগলেন যে, আরে ভাই ব্যস্ত হইছেন ক্যানো। টাকা তো নিবেনই। একটু বসি, জিরাই, তারপর দিই। অ্যাটেনডেন্স লোকটি রুক্ষ হয়ে উঠলো, না না। নগদ ফগদ দিয়া দেন। নাইলে বসার মানুষের অভাব নাই। আইনা বসাইয়া দিমু।
এই এক কথাতেই কাজ হয়ে গেলো। লোক তিনটি সুড়সুড় করে যার-যার পকেট থেকে টাকা বের করে অ্যাটেনডেন্সের হাতে বাড়িয়ে দেয়। একজনের টাকার অংক দেখে হুংকার দিয়ে ওঠলো মানুষটা, দুইশো ক্যানো দিলেন? বাকিটা?
বাকিটা একটু পরে লন। ভাঙতি নাই।
কতো টাকার ভাংতি? দেন আমি ভাংতি দেব।
তখন লোকটি উলটো বললো, মিয়া দুইশো টাকাই তো রাখতে পারতেন? আপনেগো প্যাট আর ভরতে চায় না।
আপনে তো ভেজাইলা মানুষ! উপকারিরে বাঘে খায়। বাইর হন। বাইর হন। ভেজাইলা মানুষকে তখন অ্যাটেনডেন্স বাইরে নেওয়ার জন্য টানাটানি শুরু করল। সে অমনি ভালোমানুষের মতো আরো পঞ্চাশ টাকা বের করে আপত্তি জানানোর ভঙ্গিতে বলল, আপনে গো আর আউশ মিটে না!
আমার সিটে একজন আর সামনের সেই উঁচু চূঁড়ামতো জায়গা, যেখানে মালছামানা রাখার কথা, সেখানে আরো দুজনকে বসিয়ে দিয়ে অ্যাটেনডেন্স, আড়াইশো টাকা করে মোট সাতশত পঞ্চাশ টাকা ঝটপট আদায় করে একটা আলগা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বোধহয় একটু বিব্রত অবস্থায় পড়লেন জনাব। আমার তো টিকেট কাটাই আছে, আমার কাছে আবার টাকা চান কীভাবে? অথচ আমার জায়গায় অন্য কাউকে এনে বসালে তিনি ঝটপট নগদ আড়াইশো টাকা লাভ করতে পারতেন। বোধহয় সে মেসেজটাই মৃদু হাসার সংকেতে আমাকে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তারপর আমার দিক থেকে উপযুক্ত সাড়া না পেয়ে আমাদের চারজনকে বিপুল সাহস যুগিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে যথেষ্ঠ সাহস দিতেও ভুললেন না, কেউ কিছু জিগাইলে বলবেন, আমরা টিকেট কাটছি। আরামে চইলা যান। আর দরজাটা লাগাইয়া বসেন।
শোভনের হৈ-হট্টগোল আর গণজোয়ারের ভেতর না থেকে যে, এরকম একটা স্পেশাল বন্দোবস্ত মিলে যাবে আমার জন্য, সেটা তো ভাবনার বাইরেই ছিল, অপ্রত্যাশিতও ছিল। সঙ্গে সঙ্গে সৈকতকে না-জানানোর লোভ তো আমি কিছুতেই সামলাতে পারি না! তাছাড়া বগি হাওয়া হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাও তো কম আকর্ষণীয় না! আমি একটু থিতু হয়েই সৈকতকে কল দিয়ে বসলাম। আর তখনই সৈকত আমার কথা শুনে হেসে উঠলো। ওর স্বভাবমতোই হো হো অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। বুঝতে পারলাম, আমার এমন একটা আরামে বসার ব্যবস্থা হওয়ায় ও খুব খুশি হয়েছে। খুশির জোয়ারেই হাসছে। সঙ্গে সঙ্গে এও বুঝলাম, এ হাসি ওর স্বভাবজাত মজ্জাগত।
যা হোক, সৈকতের সঙ্গে হাসাহাসি শেষ করে আমি এবার একটু নিজেকে আরামে রাখার আয়োজনে মেতে উঠি। কতক্ষণ পা দুটো উঠিয়ে জোড়াসীন বসে সুখ-সুখ কল্পনায় ভাসতে চাই। তারপর সিদ্ধান্ত নিতে পারি না, বই পড়ে সময় কাটাব নাকি গান শুনে। অবশেষে আমি ফেসবুকেরই দ্বারস্থ হই। একটু পর ট্রেনও গা ঝাড়া দিয়ে চলতে শুরু করল। আমি মাঝে মধ্যে আড়চোখে অন্য তিনযাত্রীকেও দেখি। আমারই মতো, নিজেদেরকে একটা স্বস্তির জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সফলতায় কীভাবে এই বিশেষ সুবিধাটুকু উপভোগ করবে, তারই আয়োজনে বুঁদ হয়ে আছে। বিশেষ করে সামনের দিকে বসা দুজন। ভেতর থেকে কামরার লোহার দরজাটা ভালোমতো চাপিয়ে দিয়ে- আসন একটু উঁচু বলেই কিনা, দুজনই পা উঁচিয়ে জুত করে বসেছে। আর আমার পাশের জনও বেশ রিল্যাক্সড। চোখেমুখে শান্তির ভঙ্গি। হবেই তো! প্রত্যাশার বাইরে এ-প্রাপ্তি। ওরা তিনজন ধরেই নিয়েছিল সারা পথ ট্রেনে যেতে হবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এ-সুখের আবেশেই কিনা, খুব দ্রুতই দেখলাম, তিনজনই ঘুমিয়ে পড়লো। এভাবে ঘুমিয়ে পড়তে পারলে আমার জন্যও ব্যাপারটা সুখকর হতো। যা আমার জন্য ভীষণ জরুরিও। হার্টের রোগী বলে কথা। ডায়াবেটিসও আছে। ওদের দেখাদেখি তাই ঘুমের চেষ্টা করি। ঘুম আসে না। ঘুমের কোনো লক্ষণও পাই না- ঝিমানো কিংবা ক্লান্তিভাব।
আসলে আমার সত্তার আরেকটি অংশ যে ঘুমাতে চাইছে না, সে সত্যও আমার কাছে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে। এই যে সঙ্গে এতো বড় ব্যাগ, একে অরক্ষিত রেখে কি আমি শান্তিমতো ঘুমাতে পারব? আমি যেভাবে ব্যাগটাকে শক্ত করে ধরে রেখেছি, ঘুমিয়ে পড়লেই যে আমার হাতের বন্ধন শিথিল হয়ে পড়বে- সেই সত্য কি আমি জানি না? আমি মনে মনে হিসেব কষতে লাগলাম, কত টাকার জিনিস থাকতে পারে আমার এ-ব্যাগে। একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা- দাম এক লাখ বিশ হাজার টাকা। লেনেভো একটা নোটবুক বাইশ হাজার টাকা। এছাড়া কাপড়চোপড় বইপত্তর এটা=সেটা মিলিয়ে ধরে নিই আরো প্রায় তিরিশ-চল্লিশ হাজার টাকার জিনিসপত্তর রয়েছে। স্যামসাং গ্যালাক্সি মোবাইলটা অবশ্য ব্যাগে নেই। মুঠোর ভেতর। ওটাও ঘুম না আসার আরেক কারণ। বরঞ্চ মোবাইল ফোন হাতে রাখাই রিস্ক। সবাই দেখছে। এবং কখন যে লোভের থাবা কোনদিক থেকে তেড়ে আসে! ট্রেনের ভেতর থেকে যেমন হাত বাড়াতে পারে, জানালা দিয়ে ছোঁ মারার লোকেরও অভাব নেই। একবার টঙ্গীতে থেমে থাকা ট্রেনটা যখন কেবল চলতে শুরু করেছিল, বাইরে থেকে লাফিয়ে একটা হাত কীভাবে নোকিয়ার সে-সেটটা নিয়ে গেল বুঝতেই পারিনি।
অন্য তিন যাত্রীকে দেখো কতো নিশ্চিন্ত! গভীর ঘুমে ডুবে আছে। সবার কাছেই মোবাইল ফোন। কারো ব্যাগে বা কারো পকেটে। দেখেছি তো একনজর। কারোর মোবাইলের দামই কোনোভাবে একহাজার টাকার ওপরে হবে না। কেন যে আমি এতো দামি দামি সব জিনিসপত্তর নিয়ে ট্রাভেল করছি! নিজের ওপরই নিজের চরম বিরক্তি লাগলো। যত ঝাড়া হাত-পা থাকা যায়, ততই যে জীবন সহজ এবং নির্ভার এটা বুঝেও যেন বুঝতে চাই না। মেনে চলাটা সত্যি টাফ।
কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর স্টেশনের দূরত্ব খুব বেশি নয়। অথচ ট্রেনটা যেন বেশ সময় নিয়ে নিয়েই পৌঁছাল বিমানবন্দর স্টেশন এবং বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলো। মনে হচ্ছে ট্রেনটি স্টেশন হিসেবে এ-বিমানবন্দরটিকে খুব ভালোবাসে। এখান থেকে ওর সরতেই ইচ্ছে করছে না। যেন নামবে স্টেশনটার প্ল্যাটফর্মে। একটা পান মুখ দিয়ে চিবুতে চিবুতে ঘুরে ঘুরে দেখবে সব। তারপর আয়েশে ওঠার পর ধীরে-সুস্থে আবার চলতে শুরু করবে। যেমনটা আমার হয়। স্টেশনে-স্টেশনে নামাটা আমার খুব পছন্দ। স্টেশনে নামব, ঝাল বা টকজাতীয় একটা কিছু খাব, নিছক চুমু দেব চায়ের কাপে। তারপর ট্রেন ছাড়ার সংকেত শুনলেই লাফিয়ে ছুটে যাব কম্পার্টমেন্টের দিকে। এখন আর সেটা সম্ভব হলো না। সঙ্গে শুধুমাত্র এই দামী জিনিসপত্তরসমেত ব্যাগটা থাকার কারণে।
যা হোক, ট্রেনটি আবার ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি আর ঘুমানোর চেষ্টা না করে একটা ভিডিও সঙ দেখায় মেতে থাকতে চাইলাম। বাড়তি একটা দারুণ আসন যখন পেয়েই গিয়েছি, মুহূর্তটা মনে হয় উপভোগ করাই ভালো। বাইরে ফুরফুরে বাতাস, শীত চলে যাওয়ার মুহূর্তে যে-রকম থাকে আর কি, বাতাসে শীতলতার পরশ অথচ খুব ঠাণ্ডা ব্যাপারটাও নেই। ভালোই লাগছিল। যেন বসন্তের মুখরিত আহ্বান। আর এদিকে মোহনীয় সুর আর মাদকতাপূর্ণ দৃশ্যপটের দ্বিমুখী সংযোগ। যাকে বলে আনন্দের বুদবুদে টগবগ করতে লাগলাম। ট্রেন যত এগোয় আমার আনন্দ যেন নতুন নতুন পুলকিত পাখনায় নয়া পুচ্ছতা পায়। আর কে না জানে মানুষের আনন্দময় মুহূর্তগুলো কাটে দ্রুত। তাই টঙ্গী স্টেশনটাও বুঝি একটু আগেভাগেই এসে পড়লো।
বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকজন যাত্রীকে কম্পার্টমেন্টে বলতে শুনলাম হাওরের তো টঙ্গীতে স্টেশন নাই। আজকে ধরল যে! ওদের কথোপকথন থেকে উত্তরও মিলল। আজ দ্বিতীয় বিশ্ব এজতেমা শেষ হয়েছে। হুমম, এখন তো আবার এজতেমা হয় দুটো। বেলা বারোটা থেকেই লোকজন যে-যার গন্তব্যে ফিরতে শুরু করে। সে হিসেবে এখন ফেরার শেষবেলা। বাইরে তাকিয়ে তার প্রভাবও দেখলাম। কয়েকজন মুসল্লি টুপলাটুপলি নিয়ে দাঁড়ানো। কেউ কেউ ট্রেনে ওঠার চেষ্টায় বগি থেকে বগিতে ছুটোছুটি করছে। তবে মুসল্লিদের চেয়ে লক্ষ্য করলাম পুলিশের সংখ্যাই বেশি। এবং সবাই প্রায় লাগেজসমেত। মুসল্লিদের ফেরার সময় বোধহয় শেষ হয়ে এলো। ডিউটি শেষ করে শুরু হয়েছে এখন পুলিশের ফেরার পর্ব। এজতেমায় এতো বিপুলসংখ্যক মানুষ আসে যে, শুধুমাত্র গাজীপুরের পুলিশ দিয়ে বোধহয় নিরাপত্তা রক্ষা সম্ভব হয় না। বিভিন্ন ডিস্ট্রিক্ট থেকেও দায়িত্ব পালন করতে নিয়ে আসা হয় পুলিশ।
টঙ্গী স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার দশ মিনিট যেতে না যেতেই আমি যখন ভিডিও সঙে ভালোই জমে গেছি আর আমার সঙ্গের বাকি তিনজনের ঘুমও পেয়েছে ব্যাপক গভীরতা; তখনই আমাদের কামরার দরজাটা ঠক ঠক করে কেঁপে উঠলো। সেই সঙ্গে শোরগোল, চিৎকার! অনুমান করলাম, নিশ্চয়ই টঙ্গী স্টেশন থেকে সদ্য ওঠা কোনো আত্মদম্ভী বেয়াড়া-গোছের যাত্রী জোর করে চাইছে এ-কামরায় নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে অথবা কোনো পলিটিক্যাল পান্ডা। তাই শব্দটা শুনেও না শোনার ভান করতে লাগলাম। ওদিকে দরজায় লাথির আঘাত বেড়ে যেতে লাগলো বেধড়ক, শব্দের মাত্রাও হতে লাগলো প্রকট। সেই সঙ্গে অস্থির কন্ঠের গালাগালি। স্বভাবতই আমার তিনসঙ্গীর ঘুম ভেঙে যায়। একজন আঁতকে ওঠে বললো, ডাকাত আইলো নাকি? শেষে আমাদের চারজনের চোখের ভাষাই এক হয়ে স্থিরীকৃত হলো যে, দরজাটা খুলে দেওয়াই দরকার। তা না হলে হয়তো দরজা না-খোলার জন্য উলটো আমাকে মাশুল দেওয়া লাগতে পারে। পাশে বসা ছেলেটি হন্তদন্ত অস্থির ভঙ্গিতে ঠেলে-ধাক্কিয়ে দ্রুত খুলে দিল দরজা। অমনি দুজন বেশ দশাসই পুলিশ অফিসারের রাগী ক্রদ্ধ মুখ দরজার সামনে দৃশ্যমান হলো। গাল পেড়ে উঠলো একজন, অ্যাই দরজা খুলতাছিস না কেন মাঙের পোলা। বাপের সম্পত্তি পাইছস। বাইর হ। মাদার চোদের বাচ্চারা!
আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল আমার! কোনোদিন যে আমার মতো সাদাসিধে একজন সাধারণ চাকুরীজীবী মানুষকেও পুলিশের গালি হজম করতে হবে, কল্পনায়ও ছিল না। হয়তো সরাসরি আমাকে গালি দেয়নি, কিন্তু আমাদের চারজনের ওপরই তো বর্তে সে গালির তবারক। যাকে বলে একেবারে ধুর ধুর করে তাড়ানো! সে-ভঙ্গিতেই সবাইকে কামরা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুকুম দিল দুজন। আমার সঙ্গে যে তিন সহযাত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, ওরা তিনজনই যেহেতু টিকেট কাটেনি, সম্পূর্ণ অবৈধ, সুড়সুড় করে সোজা বেরিয়ে গেল। কিন্তু আমি তো টিকেট কেটেছি এবং সেটা আমার হাতের মুঠোর শক্ত বন্ধনে ধরাও রয়েছে। আমি কেন বেরিয়ে যাব? শেষবারের চেষ্টায় হাতের টিকেটটা দেখিয়ে বললাম, আমার তো টিকেট আছে।
পুলিশ অফিসার জানতে চাইলেন, সিট নাম্বার কতো। বললাম বাইশ। সে তখন আমি যে-জায়গাটায় আসন নিয়েছিলাম সেখানে আরামে নিশ্চিন্তে নিজেকে ঢেলে দিয়ে হালকা চালে জানালো, বাইশ নাম্বারে গিয়ে বসেন। তাকে বোঝাতে চাই, বাইশ নাম্বারে বসবো কী, সে বগিটাই তো নাই! আরেকজন অফিসার দরজা চাপাতে শশব্যস্ত হওয়ার ভঙ্গি দেখিয়ে পরামর্শ দিল, অ্যাটেনডেন্সকে জানান। কোথাও না কোথাও বসিয়ে দেবে! কথা বলতে বলতেই সে রুমের দরজাটা ভেতর থেকে এমনভাবে চাপাতে লাগলো যে, আমি রীতিমতো সরে আসতে বাধ্য হলাম।
সরে আসতে আসতেই আমি আর ওই বিশেষ কামরার মানুষ রইলাম না, হয়ে ওঠলাম এক্সটেনশন থ্রি বগির অবাঞ্চিত একজন। হ্যাঁ অবাঞ্চিতই তো বলব। তা ছাড়া আর কি! যেখানে বসার তো কোনো সিট দূরের কথা, একতিল দাঁড়ানোর জায়গাও দুর্লভ। সম্ভবত একটা পিঁপড়েও এখন এই বগির ভেতর হাঁটার কথা ভাবতে পারবে না। পদ্মায় বাড়ি ভেঙে গেলে কেমন অনুভূতি হয় জানি না, মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়লে কেমন লাগে সে অভিজ্ঞতাও অজ্ঞাত- কিন্তু বুকের ভেতরটায় যেন এক প্রলয়কাণ্ড ঘটে যেতে লাগল। নিজেকে এতোটা অসহায় আমার আর কখনোই মনে হয়নি। ট্রেনের টিকেট কেটে এসেও যে কেউ এমন ভয়াবহ অবস্থায় পড়তে পারে, তা আমার ধারণায় তো ধারণা, কল্পনায়ও ছিল না। লোকজনের চিপার ভেতর চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যখন কী করবো না করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না, তখনই সৌভাগ্যক্রমে দেখলাম যে, একজন লম্বাচওড়া পাতলা কোঁকড়া চুলঅলা অ্যাটেনডেন্স এসে হাজির হল। শাদা পুরনো ময়লা এপ্রোণ গায়ে চড়িয়ে সে ডানদিক থেকে বামদিকে যাচ্ছিল। আমি তার পথ আটকে দাঁড়াই। গভীর অভিযোগের সুরে টিকেট দেখাতে দেখাতে জানালাম, টিকেট কেটেও কেন আমার এ অবস্থা হবে? বলুন? জবাব দিন?
মনে হলো তিনি বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছেন। কিন্তু কোনো জবাব দিলেন না। বা কী জবাব দেবেন, তা যেন বুঝে উঠতে পারলেন না। নীরবে শুধু তাকে অনুসরণ করতে একটা ইশারা দিলেন। অগত্যা আর কী। আমিও তাকে নীরবে অনুসরণ করি। আমরা এক্সটেনশন থ্রি থেকে নতুন আরেক কম্পার্টমেন্টে পৌঁছাই।
এটা কি আসলে কম্পার্টমেন্ট? আমি ওখানে ঢুকেই হোঁচট খেলাম। দুপাশে কোনো আসন নেই। ঢালাও মেঝেতে মাদুর পেতে বসে আছে নানা-বয়সী লোকজন। বিশেষ করে যুবকের সংখ্যাই বেশি। মাঝে-মধ্যে নারীও আছে এক দুজন। আর আছে পুলিশ। এতো পুলিশ কেন আজ? নিজের ভেতর টের পাই পুলিশের প্রতি তীব্র রাগ! হুঁট করে দুজন কোথা থেকে এসে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। অনতিবিলম্বেই আমার রাগটা পুলিশের পাশাপাশি তাবলীগ জামাতের ওপরও আছর হয়। ওদের জন্যই তো এতো পুলিশ! হঠাৎ মনে হয় আমার! তাবলীগ জামাত নাকি দু-গ্রুপ হয়ে গেছে! এবং এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের ওপর প্রবল মারমুখী! সেজন্যই বুঝি এবার এজতেমায় পুলিশের এতো ব্যাপক উপস্থিতি!
দুপাশে লোকজন এতোটাই ঘন হয়ে বসা যে, মাঝখান দিয়ে যাওয়া-আসার পথটা একদম সরু। সেখান দিয়ে হেঁটে গেলে দুপাশের কোনো কোনো বসা মানুষের গায়ে পা লেগে যেতে বাধ্য। আমি অতি সাবধানে সে-পথে লম্বু অ্যাটেনডেন্সের পেছন পেছন হাঁটতে থাকি। এবং একসময় আমরা এক গরম ইলেকট্রিক চুল্লির সামনে গিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে পড়ি। বিশাল বড় কোমর-সমান বৈদ্যুতিক চুল্লিতে চা বানানোর ততোটাই বিশাল কেতলি। ভেতর সাইডে দাঁড়িয়ে একজন রেলওয়ের পোশাক পরা মানুষ চা বানাতে ব্যতিব্যস্ত। তার পেছনে বগির শেষ সীমানা ঘেঁষে লোহার বেঞ্চিমতো টুলে বসে আছে দুজন পুলিশ, তিনচারজন মাতবর গোছের মানুষ। যারা দেশ এবং দেশের উন্নয়ন নিয়ে গরম গরম বক্তব্য দিচ্ছিল। লোকজনের চোখে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নাকি চোখেই পড়ছে না বলে, তারা বেশ উষ্মা প্রকাশ করছিল। আমাকে সেই জ্বালাময়ী বক্তব্যের কাছে এবং চুল্লির উত্তাপের কাছে রেখে লম্বু অ্যাটেনডেন্স বললেন, আপাতত এখানেই দাঁড়ান। আমি দেখছি কী করা যায়। এই বলেই অ্যাটেনডেন্স লোকটা আর দাঁড়াল না, যে-সরু পথে আমরা এসেছিলাম, সে-পথেই সে বেশ অভ্যস্ত ভঙ্গিতে দ্রুত হেঁটে এক্সটেনশন থ্রির দিকে মিলিয়ে গেল।
একটু পরই আমি বৈদ্যুতিক চুল্লির গরম ভাপের সঙ্গে টের পেলাম, পেছনে চা-বানানোর লোকটার মেজাজের গরমও কতটা উত্তাপ ছড়ানো থাকতে পারে। বাবুর্চি চা বানাচ্ছিলেন আর আমাকে বিরক্ত চোখে দেখছিলেন। তিনি যে এখানে আমার এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা সহ্য করতে পারছেন না বেশ বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু বুঝলে কী হবে! আমার তো কিছুই করার নেই। বস্তুত এখান থেকে সরার বিন্দুমাত্র স্পেস নেই কোনো। ডানপাশে এক পুলিশ তার ডান ও বাম পা দুদিকে ছড়িয়ে বসে আছে। তার গা থেকে নিজেকে বাঁচাতে এক বোরকাপরা তরুণী বৈদ্যুতিক-চুল্লির প্রায় নিচ পর্যন্ত চলে এসেছে। আরেকটু ভেতরে চাপলে যে সে-বেচারীর বোরকায় আগুন ধরে যাবে, সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আর পুলিশের ওপাশে আরেক ভদ্রলোক কোনোমতো জবুথবু হয়ে বসা। কারণ তার ওপাশে আর জায়গা নেই। সেখানে ছোট একটা টেবিলমতো, পার্মানেন্ট। যার ওপরে তিন তরুণ বসে বসে পা ঝোলাচ্ছে। টেবিলের ওপাশেরই আবার পাতা মাদুরে গাদাগাদি করে বসে আছে তরুণের দল। কেউ কেউ এই তুমুল হইচই ভিড়বাট্টার মধ্যেও চুটিয়ে ঘুমাচ্ছে। মাঝখানে সরু চলাচলের রাস্তার পর বাঁপাশেও একই অবস্থা। কোথাও তিল ঠাঁই নাহি রে!
মাঝখানে কেবল আমিই একা চুল্লির গায়ের ঠেকা সামলাতে কিছুটা চলাফেরার খালি জায়গাটাতে নিজেকে কোনোমতো ঠেকাঠোকা দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আর মাঝে-মধ্যেই এর-ওর ঠেলাধাক্কা খাচ্ছি। বিশেষ করে বাবুর্চি একে-ওকে যখনই চা দিতে যাচ্ছে আসছে আমাকে ইচ্ছে করেই যেন বেঢপ একটা ধাক্কা দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তিনি আমার এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছেন না। একবার তো মুখ ফসকে ধমকেই ওঠলেন, আপনে যে এখানে বেক্কলের মতো দাঁড়াইলেন, মানুষ কেমনে হাঁটাচলা করবো, চিন্তা করছেন? আমি তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে চুলার দিকে সরে গিয়ে তাকে যাওয়ার পথ করে দিলাম। আর এই চুলার দিকে সরতে গিয়েই যে ডানপাশে পুলিশের সামনে বসা লোকটির পায়ে পা লেগে যাবে, কে জানতো। সে সাপের মতো ফস করে ওঠলো, অই মিয়া চোখে দেখেন না? পাড়াইতাছেন যে?
আমি আসলে কোনদিকে যাব। চরম অসহায় বোধ করি। তখনই একটা উনিশ-বিশ বছরের যুবক মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আমাকে সাপোর্ট দিতেই যেন বলে উঠলো, আরে মানুষটা কী করবো? আসেন ভাই, আপনে আমার এখানে আসেন।
আমি দেখলাম যে, চুলার বিপরীত দিকে বসা অসংখ্য মানুষের ভেতর কোনোভাবে নিজেকে ঠেকিয়ে রেখেছে তরুণ, নিজেই ভালোভাবে বসতে পারছে না। সে-অবস্থায়ও সে চাইছে আমাকে জায়গা করে দিতে। আদতে সেখানে আমার কেন, এক বছরের শিশুর পক্ষেও বসাটা সম্ভব না। তরুণ আমাকে দ্বিধান্বিত দেখে আবারো ডেকে ওঠলো, আরে আসেন তো!
কী করবো, আমি সত্যিই দাঁড়াতে পারছিলাম না। একে তো চুলার উত্তাপ আর বাবুর্চির গরম চাহনি! দুই, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে আমার ব্যথা ধরে গেছে। তাই অসহায় আত্মসমর্পণের মতো তরুণের নির্দেশিত জায়গার দিকেই হাঁটতে থাকি। আমাকে সেমুখো যেতে দেখে সেখানে বসা একজন আতংকগ্রস্তের মতো চেঁচিয়ে ওঠলো, ‘আরে এদিকে কই বইবো?’
তরুণটি অই লোকের সঙ্গে তর্কে মেতে ওঠলো। ‘একজন মানুষের জায়গা হইবোই। কোনো ব্যাপার হইলো?’ তরুণটির দৃঢ় কন্ঠের বিপরীতে অপরপক্ষের কোনো সাড়া-শব্দ খুঁজে পেলাম না। কিন্তু আমার নিজেরো সেখানে গিয়ে বসার উৎসাহ ভেতরে ভেতরে মিইয়ে আসছিল। অযাচিতভাবে এতগুলো লোককে কষ্ট দিতে মোটেও ইচ্ছে করলো না। শুধু তো আমি নই, সঙ্গে একটা বেশ ওজনদার রুকস্যাকও রয়েছে।
তরুণটি যেন আমাকে কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকতে দিতে নারাজ। ভেতর দিক থেকে সে একটু সামনের দিকে সরে এসে রাস্তার দিকের লোকটিকে আরো একটু ভেতরের দিকে ঠেলে দেয়। আর সে ওর পাশে আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে বসানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে থাকে। বসেন তো ভাই, বসেন।
আমার এই জনযটের ভেতরও চোখের সামনে একটা ঝলমলে নীল আকাশ উঁকি মেরে ওঠলো। কতো ফাঁকা কতো স্পেস! সেখানে শুভ্র মেঘেরা কী সুন্দর ভেসে বেড়াচ্ছে! এখনো তাহলে সব মানুষ পাথর হয়ে যায়নি! হৃদয়ানুভূতির ব্যাপারটা তাহলে এখনো অবশিষ্ট আছে! আমি গুটিসুটি মেরে তরুণের পাশে নিজেকে কোনোমতো আঁটিয়ে দিই। ধীরে ধীরে যেন নিজের ভেতরে সেই ফুরফুরে বেড়ানোর আমেজটাও ফিরে পেতে থাকি। ক্রমশ ওর সঙ্গে আমার ফিসফাস আলাপ জমে ওঠে। জানলাম যে ওর নাম মঈনুল হক নিলয়। বাড়ি সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা। পড়ে আনন্দমোহন কলেজে। নিলয় যে শুধু আমারই সমব্যথী তা না, ওর ভেতরে যে একজন চেগুয়েভারা আছে তাও বেশ টের পেলাম। ট্রেন তখন জয়দেবপুর ছাড়িয়ে গিয়েছে। জায়গাটা কোথায় বলতে পারবো না। হঠাৎ করেই দেখতে পেলাম আমাকে যে বেটে কালোমতো অ্যাটেনডেন্স সেই বিশেষ রুমটিতে বসিয়েছিল, এক্সটেনশন থ্রি থেকে সে এই ক্যান্টিনের দিকেই আসছে। আর তাকে দেখতে পেয়েই কোন গর্ত থেকে যেন বেরিয়ে আসলো আমার সঙ্গে সেই বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত রুমের তিনযাত্রীর একজন! সে সোজা অ্যাপেনডেন্সের সামনের পথ আটকে দাঁড়াল, ‘অ্যাই মিয়া তুমি যে আমার কাছ থেকে সিট দিবা বইলা টাকা নিলা, সেই সিট কই? তোমার পুলিশ বাবারে বসাইয়া রাখছো। আমার টাকা ফেরত দাও।
অ্যাটেনডেন্স বুঝি এরকম অবস্থায় পড়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। গা গো করতে লাগলো। আমি তো সিট দিছিলামই। আপনে ধইরা রাখতে না পারলে আমি কি করুম?
তখন লোকটা উলটো ধমকে ওঠলো, তোমার পুলিশ বাবার লগে কি আমি নাড়াই দিমু? আমি অতো কিছু বুঝি না। আমার টাকা ফেরত দাও।
অ্যাটেনডেন্স আবারো ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে, ওতো সিট দিছিলোই, টাকা ফেরত দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু সেই যাত্রী কোনো কথাই মানতে রাজি নয়। সে আরো জোরে জোরে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিল। তখনই সেই উত্তপ্ত চুলার পেছনে বসা দুজন পুলিশের একজন প্রচণ্ড ক্রোধে চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে এলো, অ্যাই ব্যাটা। এতো ফটর ফটর করছ ক্যান। ঘাড় ধইরা কিন্তু ট্রেন থেইকা নামাইয়া দিমু। ট্রেনে ওঠছস কি মাগনা যাইতে? টাকা নিছে তো কি অইছে, আঁ? কি অইছে?
প্রতিবাদী লোকটি হঠাৎ একেবারে সামনে রাইফেল সমেত ফণা তোলা পুলিশ দেখে চুপসে যায়। কিন্তু আমার পাশে বসা নিলয় ফস করে উঠে দাঁড়ায়। সরোষে চিৎকার করে ওঠে, হেই বেটায় তো বাটপাড়ি কইরা টাকা নিছে আর আপনে তারে সাপোর্ট দিতাছেন, আপনার কি স্বার্থ, শুনি?
পুলিশ অফিসার হকচকিয়ে যায়। কেউ যে তার মুখের ওপর এভাবে দড়াম করে কথা বলে ওঠবে, তা বুঝি ওর ধারণায় ছিল না। সে যুক্তিহীনভাবে নিলয়ের ওপর ধমকে ওঠলো। চুপ করে বসো থাকো। তুমি ক্যাডা? ট্রেনের মধ্যে কোনো ঝামেলা করবা না। মাগনা যাইতে যাইতে আরাম পাইয়া গেছো।
নিলয় তবু বসে না। চুপও করে না। হ আমরা চুপ করে বসে থাকি বলেই তো আপনারা জুত পাইয়া গেছেন। ও বৈদ্যুতির চুলোর দিকেই একেবারের ক্যান্টিনের গা ঘেঁষে বসা এক বৃদ্ধা আর তার সাথের মেয়েটির দিকে হাত তুলে দেখাতে দেখাতে বললো, এই যে বুড়া বেটি আর তার নাতি নাতনি এরা কি আপনার ট্রেনে ওঠছে? আপনে কেন এগো কাছতে টাকা নিলেন? আপনে টাকা নেওয়ার কে?
পুলিশ অফিসারটি যুবকের অভিযোগের মুখে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী বলবে যেন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। হুংকার দিয়ে ওঠলো, আর একটা কথা কইলে কিন্তু থানায় ভইরা রাখুম।
নিলয় কী বলতে যাচ্ছিল। ওর পাশের দুই সহযোগী দুপাশ থেকে ওর মুখ চেপে ধরলো। ওকে জোর করে বসিয়ে দিল। নিলয় রাগে গজ গজ করতে থাকে, যা ইচ্ছা তাই করব। দেশটারে মগের মুল্লুক পাইছে।
নিলয়ের কথা হঠাৎ চাপা পড়ে যায় একদল তরুণের সমস্বর গানের দঙ্গলে। আহা! আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা! আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। গানের সুরে সুরে ক্যান্টিনের পরিবেশটা কেমন সুরেলা হয়ে ওঠে। পুলিশ অফিসারটি নিজের গাত্রদাহ লুকিয়ে আবার সেই বৈদ্যুতির চুলার পেছনের টুলটিতে গিয়ে বসেছে। বেটে কালো অ্যাটেনডেন্সও হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে কখন। অভিযোগকারী আমার সেই সহযাত্রীও আবার কোন গর্তে গিয়ে ঢুকেছে। গানের গলা ক্রমশই চড়া হয়ে উঠছে। এই ক্যান্টিনে ঢোকার মুখেই একেবারে ডানপাশে মাদুর পেতে ঘন হয়ে বসা দশবারোজনের মতো যুবক। নিলয়ের কাছে জানলাম, ওরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একসঙ্গে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছে। আর প্রতিবারই নাকি ট্রেনের টিকেট না কেটে ক্যান্টিনে বসেই বাড়ি ফেরে। ক্যান্টিনে বসার জন্য একশো দু’শো যা পারে দিয়ে দেয় জায়গামতো।
গলায় গলা মিলিয়ে গান তুলছে ওরা। আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা। আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম। ওদের গানের সুরে তালে মুহূর্তেই পরিবেশটা পাল্টে যায়।
এই রাতদুপুরে না ঘুমিয়ে যে ওরা হঠাৎ গান ধরেছে, এ যেন সব পিছুটান উপেক্ষা করে জীবনেরই এগিয়ে যাওয়ার জয়যাত্রা। মূঢ়তার প্রতি জড়তার প্রতি অবসাদের প্রতিও অবজ্ঞা। সেই জীবনের চঞ্চলতা আমাকেও স্পর্শ করে। আমি সেই তোড়ে ভেসে গিয়েই কিনা আমার বন্ধু সৈকতকে এই রাতদুপুরেও কল দিয়ে বসলাম। দেখি যে সেও জেগে আছে। ভাই আমারো ঘুম হচ্ছে না। আপনার কি অবস্থা। আমার কাহিনি শুনে সৈকত আবারো হো হো হেসে উঠলো। ভাই সিংহাসনে বসলেন। আবার রাজ্য হারালেন। এবার একেবারে ক্যান্টিনে ঠাঁই। ভালোই। উপভোগ করতে পারলে ভালোই। কজনের এসব উপভোগ করার মন আছে। আসেন ভাই! আমি জেগেই থাকবো। নেত্রকোনার আগের স্টেশনে এসে কল দেবেন।
আমার বন্ধু সৈকতের হাসির লহরীতে যুবকদের গানের জলসা আমার কাছে যেন আরো আনন্দময় স্বর্গ হয়ে উঠলো। আমি ওদের গানেই মনোযোগ দিই। কী যে মায়া ধরাইলি। আমায় পাগলি করিলি।… ওদের গান শুনি আর পুলিশ কতোদূর বোরখাপরা মহিলার দিকে এগোতে পারলো তা চাক্ষুস করি। দেখি যে ভালোই এগিয়েছে। এক পর্যায়ে রোরখা পরা ছিপছিপে নারীটি মৃদু কন্ঠে প্রতিবাদও করে উঠলো। আহা সরেন তো। এতো চাপতেছেন কেন? পুলিশ লোকটির কোনো বিকার নেই।
সৈকত আমাকে বলেছিল নেত্রকোনা স্টেশনের আগের স্টেশনে পৌঁছেই যেন ওকে আমি কল দিই। একসময় গানে গানে সেই স্টেশন এসে যায়। শেষ রাত এখন আস্তে আস্তে ভোরের প্রহরের দিকে এগোচ্ছে। কখন যে ট্রেন দেখতে দেখতে নেত্রকোনায় পৌঁছে গেল বলতেও পারবো না। হঠাৎ ট্রেনটা থামতে না থামতেই সৈকতের কল এলো, ভাই আপনি ক্যান্টিন থেকে নেমে যান। ছ নামবার বগিতে আসেন, শোভন চেয়ারে।
আমি ক্যান্টিন থেকে নেমেই সে-বগির উদ্দেশে দৌড়াতে থাকি। বগি খোঁজার আগেই সৈকতের সঙ্গে আমার প্ল্যাটফরমে দেখা হয়ে যায়। ও আমাকে নিয়ে ছ নাম্বার বগিতে উঠে বসলো।
এই ভোররাতে শোভন চেয়ারের প্রায় সব আসনই খালি। আমি আর সৈকত একসাথে পাশাপাশি বসে পড়লাম। আর সৈকত উৎসুক হয়ে আমার ট্রেনের অভিজ্ঞতার কথা আরো ডিটেইলস জানতে চাইলো। মোবাইলে তো আর সব বলা হয়ে ওঠেনি। আমি যে টিকেট কেটেও সিট তো সিট, বগিই পাইনি, সেটা শুনে ও হাসিতে ফেটে পড়ে। হঠাৎ বিলাসী কক্ষ পাওয়াটাও ওকে হাসির যোগান দেয়। আর হাসতে হাসতে আমাদের আড্ডা যখন মুখর আমাদের কথা শুনেই কিনা, পাশের সিটের এক বুড়ো অশিক্ষিত টাইপের মানুষ সৈকতের দিকে জামার পকেট থেকে বের করে ওনার টিকেটটা বাড়িয়ে দিল, দেখেন তো বাবা! আমার টিকেটটা ঠিক আছে নি? সে জানাল ৫৫ টাকা করে দুটো টিকেট কেটেছে। শ্যামগঞ্জ থেকে ঠাকুরাকোনা যাবে। সে-মতোই সে টাকা দিয়েছে। অথচ সৈকত দেখলো টিকেটের মধ্যে লেখা রয়েছে ৩৫ টাকা। তাও আবার স্ট্যান্ডিং টিকেট। শ্যামগঞ্জ থেকে নেত্রকোনা, ঠাকুরাকোনা নয়। যদিও আমরা তখন নেত্রকোনা পার হয়ে এসেছি। পরের স্টেশনেই আসবে সেই ঠাকুরাকোনা।
সৈকত টিকেটটা দেখেই হেসে ফেললো। সে হাসির সামনে থতমত স্তব্ধ বিব্রত বুড়ো। মানুষটা সৈকতের হাসিতে তো বটেই কথা শুনেও ঘাবড়ে যায়, চাচা আপনার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। টাকাও বেশি নিছে। টিকেটও দিল না, সিটও দিল না। আবার গন্তব্যের টিকেটও দিল না। আপনি তো এখন অবৈধ। আপনার এই টিকেট ছিল নেত্রকোনা পর্যন্ত। চাচা বারবার বোঝাতে লাগলো, আমি তো ৫৫ টাকা দিয়া ঠাকুরাকোনার টিকেট কাটছি। চাচার কথা শুনে আবারো হেসে উঠলো সৈকত। চাচা আপনি তো ঠিকই কাটছেন, তারা তো আপনাকে দেয় নাই। তারা দিছে অন্য টিকেট। আবারো সৈকতের হো হো হাসি। সৈকতের সেই হাসির তোড়ের সামনে দুলতে দুলতে জড়োসড়ো থতমত বুড়ো অসহায় চোখে বলে ওঠলো, হাইসেন না। হাইসেন না। এতো ফজরের সময় এতো হাসাটা ভালা না।
বুড়োর কথা শুনে সৈকতের হাসি বিব্রত হয়ে ঝুলে থাকে ওর দু-ঠোঁটের কোণে। আর, আমি চেষ্টা করি বুড়োর ভাষা বুঝে ওঠতে, কথাটা সে কি বিরক্তিতে বললো নাকি ঠাট্টা না রাগ? নাকি ঠকে যাওয়ার কষ্টে! আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন