short-story-sahos

সাহস
রুহুল আমিন


ধব ধবে সাদা কাগজ। সেই কাগজ দিয়ে সুন্দর করে মোড়ানো হলো চেক। সেই চেক খাকি রঙের একটা খামের মধ্যে ঢুকিয়ে প্যান্টের ডান দিকের পকেটে রাখলেন মকবুল হোসেন। এই চেক প্রভিডেন্ট ফান্ডের। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে মকবুল হোসেন এই তেরো লক্ষ টাকার এই চেক পেয়েছেন।

সরকারি কেরানির চাকরি। তেত্রিশ বছর সাত মাস নয় দিন চাকরি করে অবসর। মকবুল হোসেন পকেটে চেক নিয়ে প্রথমে গেলেন হাসপাতাল। হাসপাতালের চারশ বারো নাম্বার বেডে স্ত্রী রাবেয়া খাতুন শুয়ে আছেন। রাবেয়াকে ভর্তি করা হয়েছে গত শুক্রবার। ডায়বেটিস আবার বেড়েছে। এমনটা প্রায় হয়, তবে এবার খুব বেড়েছে। প্রথম দিকে অবস্থা খুব খারাপ থাকলেও এখন ভালো। হাসপাতালে রাবেয়ার সাথে আছে ছোট মেয়ে টুম্পা। এই কয়টা দিন মেয়েটার উপর দিয়ে বেশ ধকল যাচ্ছে। মকবুল হোসেন হাসপাতালে গেলে মেয়েটা বাসায় গিয়ে গোসল-টোসল সেরে আসে। হাসপাতাল মকবুল হোসেনের খুব অপ্রিয় জিনিস। খুব অপ্রিয়। অপ্রিয় হলেও এই রাবেয়ার জন্য প্রায় হাসপাতালে আসতে হয়। এই নিয়ে মাঝে মাঝে রাবেয়ার উপর খুব রাগও হয়। রাগ হলেও মানুষটাকে কিছু বলতে পারেন না মকবুল হোসেন। রাবেয়ার প্রতি তার ভীষণ মায়া।

হাসপাতালে এসে দেখলেন রাবেয়া ঘুমাচ্ছে। ঘুমের ঘোরে খুব শব্দ করে নাক ডাকছে। রাবেয়ার এই স্বভাবটি আছে। ঘুমাতে গেলেই কেমন শব্দ করে নাক ডাকে। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন এই নাক ডাকার শব্দ কানে যেন সয়ে গেছে। রাবেয়ার বেডের পাশে বসে মকবুল হোসেন পকেট থেকে চেকের খামটা আবার বের করলেন। চেকের গায়ে টাকার অংকে তেরো এর পর শূন্যগুলো গুনে দেখলেন। পাঁচ শূন্য ঠিক আছে। চেকটা দেখে ঠিক আগের মত সাদা কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে, খামে ঢুকিয়ে পকেটে রাখলেন। আজ মেয়েটা আসতে দেরি করছে। মেয়েটা আসলেই মকবুল হোসেন হাসপাতাল থেকে বের হবেন। প্রায় ঘন্টাদুয়েক পার হতেই টুম্পা হাসপাতালে ফিরে আসে। টুম্পা আসার পর পরই মকবুল হোসেন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

চকবাজারের দিকে যেতে রাস্তার পাশে বিশাল বিশাল শিলকড়ই গাছ। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে মকবুল হোসেন এই গাছগুলো দেখে কিছুক্ষণ হাঁটলেন। এই বড় গাছগুলোর নিচ দিয়ে হাঁটতে মাঝে মাঝে খুব ভালো লাগে মকবুল হোসেনের। তবে আজ হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। পায়ের গোড়ালির ব্যথাটা আবার বেড়েছে। বছরের এই সময়টায় ব্যথাটা খুব বাড়ে। মকবুল হোসেন মাঝে মাঝে প্যান্টের পকেটের গায়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখেন চেকটা ঠিকটাক আছে কি না। চেকটা হাতে নেওয়ার পর থেকে টেনশনটা যেন বেড়েছে। আগামী মাসে পেনশনের তেরো হাজার টাকা ছাড়া আর কোনো আয় নেই। সংসারের সব খরচ হিসেব করা। বড় ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে খুলনায়। প্রতি মাসে ছেলের জন্য সেই খুলনায় টাকা পাঠানো। বড় মেয়ের কোচিং ফি, ছোট মেয়ের টিচারের বেতন। নিজের আর রাবেয়ার আটশ টাকার ওষুধ নিয়ম করা। সবকিছুর চিন্তা মাথায় আসতেই মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করা শুরু করল। মকবুল হোসেন একটু এগিয়ে চায়ের দোকানের টুলে গিয়ে বসলেন। এমন মাথা ঝিম ঝিম করা নিয়ে হাঁটা নিরাপদ নয়। হুট করে একটা অঘটন ঘটলে সব শেষ হয়ে যাবে।

মকবুল হোসেন বিয়েটা করেছেন একটু দেরিতেই। ছেলেমেয়েরা এখনো পড়ালেখা করছে। তারা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগেই মকবুল হোসেনের চাকরির সময়টা শেষ হয়ে গেল। এই নিয়ে বেশ কয়দিন নানা চিন্তা করতে করতে মকবুল হোসেনের সময় যাচ্ছে। যদিও অবসরে গিয়ে বেশকিছু টাকা হাতে এসেছে। এখন এই টাকা গুছিয়ে রেখে কিছু আয়ের ব্যবস্থা করা জরুরী। মাস শেষে পেনশনের টাকার সাথে কিছু বাড়তি আয় হলে সংসারটা কোনোভাবে চলে যাবে।

মকবুল হোসেন খুব ভীতু প্রকৃতির মানুষ। বেশি টাকা পয়সার লোভ কখনোই ছিল না। সৎভাবে যা আয় করেছেন তা দিয়ে কিছুটা টানাটানি হলেও ছেলেমেয়ে নিয়ে বেশ সুখেই ছিলেন। কিন্তু গুছিয়ে ওঠার আগে চাকরির বয়সটা শেষ হয়ে সব কেমন যেন ঝামেলা পাকিয়ে দিল। মকবুল হোসেন স্ত্রী রাবেয়া খাতুনের সাথে আগে থেকেই শলা-পরামর্শ করে রেখেছে। এই টাকার কিছু অংশ ব্যাংকে রেখে দিবেন। মেয়ে দুইটা বড় হচ্ছে। সামনে তাদের বিয়ে-শাদিতে এই টাকার প্রয়োজন হবে। বাকি টাকা দিয়ে কিছু একটা করতে পারলে মাস শেষে সামান্য আয় হবে। এই আয় দিয়ে সংসারটা মোটামুটি চলে যাবে।

হাসপাতাল থেকে বের হয়ে সারাদিন এদিকসেদিক ঘোরাঘুরির পর পকেটে চেক নিয়ে মকবুল হোসেন গেল নবাবপুরে পুরনো বন্ধু হাসমতের কাছে। হাসমত খুব ভালো মানুষ। সব সময় সুগদ্ধি জর্দা দিয়ে পান থাকে তার মুখে। আজও আছে। এতদিন পর মকবুল হোসনকে দেখে খুব অবাক হলো হাসমত।

অনেকদির পর দুই বন্ধুর দেখা। নানা রকম কথা হচ্ছে। মকবুল হোসেন গল্প করে এটা সেটা নিয়ে। মাঝে মাঝে প্যান্টের পকেটের উপর হাত বুলিয়ে চেকের খামটা ছুঁয়ে দেখে। মকবুল হোসেন নিশ্চিত হয় চেকের খামটা ঠিকটাক আছে কি না। বন্ধু হাসমতের বিশাল ব্যবসা। হাসমত একটু পর পর চেক সই করে। দুই, পাঁচ, সাত লাখ টাকার চেক নিমেষেই সই করে মকবুলকে বলে, দোস্ত ব্যবসাপাতি জিনিসটা বেশ ঝামেলার। তোমরা তো চাকরি-বাকরি করে বেশ ভালো করেছো। কোন টেনশন নাই। আমাদের সারাদিন টেনশন। কোটি টাকার পুঁজি দিয়েও শান্তি নাই। এই টেনশনের কারণে রাতে ঠিক মত ঘুমাতেও পারি না।

হাসমতের কথা শুনে মকবুল হোসেন চুপসে গেল। যে মানুষ কোটি টাকার ব্যবসা দিয়েও টেনশন করে, সেই ব্যবসা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। তার সাথে এই অল্প টাকার আলাপ করে কোনো লাভ হবে না। তাছাড়া এসব টেনশন নিয়ে ব্যবসাপাতি করার মত সাহস মকবুল হোসেনের কোনো কালে ছিল না।

মাস পার হলো। মকবুল হোসেন কোনো কুল কিনারা করতে পারে নি। কিছু একটা করা দরকার। মকবুলের শশুরবাড়ির এক আত্বীয় গাড়ির ব্যবসা করে বেশ নাম-ধাম করেছে। ছোট একটা পিকআপ থেকে এখন আট-দশটা ট্রাকের মালিক। রাবেয়ার পরামর্শে একদিন গেলেন সেই আত্মীয়ের কাছে। তিনি পরামর্শ দিলেন একটা বাস কিনতে। বাসের ব্যবসা এখন বেশ ভালো যাচ্ছে। লাখ দশেক টাকা দিয়ে বেশ ভালো একটা বাস পাওয়া যাবে। দিনশেষে একটা ধরা আয়। ঠিকটাক বছর দুয়েক চললে গাড়ির টাকা উঠে আসবে। তারপর যা আসবে সব লাভ।

পরামর্শ মকবুলের খুব পছন্দ হলো। তাছাড়া হাতে সময় যেহেতু আছে তবে গাড়ি দেখাশোনার কাজটা করাও সহজ হবে। ঐ আত্মীয়ের সহযোগিতায় মাস খানেকের মধ্যে আট লাখ টাকা দিয়ে একটা বাস কিনে ফেললেন মকবুল হোসেন। বাকি টাকা রাখলেন ব্যাংকে।

মায়ের দোয়া গ্যারেজ। মাথার উপর বেশ শব্দ করে ফ্যান চলছে। ফ্যানটা যে হারে শব্দ করে ঘুরছে সে হারে বাতাস হচ্ছে না। মকবুল হোসেন মাঝে মাঝে মাথা ঘুরিয়ে ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করে।

মকবুল হোসেন বসে আছেন এই মায়ের দোয়া গ্যারেজের মালিক আজিজ মিস্ত্রির রুমে। এখন গ্যারেজে নতুন একটা বাসের গায়ে খুব গাঢ় করে সবুজ রং করা হয়েছে। এখন সেই সবুজ রঙের উপর একটা বিমানের ছবি আঁকছে একজন। সেই ছবির নিচে অন্যজন গাড়ির নাম লিখতে কি সব যেন করছে।। নামটা কী হবে সেটা এখন ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। অর্ধেক লেখা হয়েছে। মবকুল হোসেন একদৃষ্টে সেই গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি একটু একটু করে ঘামছেন। গাড়ি কিনেছেন প্রায় আট মাস হতে চলল। প্রথম তিন মাস গাড়ি থেকে আয় ঠিকটাক মত এসেছে। মাস তিনেক যেতেই শুরু হলো নানা রকমের ঝামেলা। আজ এটা নষ্ট তো কাল ওটা। এতগুলো টাকা দিয়ে কেনা গাড়ি মাস শেষে খরচ বাদ দিয়ে আয় বলতে তেমন কিছুই নেই। কোনো কোনো মাসে ব্যাংকে জমিয়ে রাখা টাকা থেকে খরচ করে গাড়ি সারাতে হচ্ছে। আটমাসে এই নিয়ে গাড়ির পেছনে আরো লাখ দুয়েক টাকা খরচ হয়ে গেল।

আশা ছিল এই গাড়ি থেকে মাস শেষে কিছু টাকা আয় হবে। এখন আয় দুরে থাক, জমানো টাকা থেকে খরচ হচ্ছে প্রায়। এই নিয়ে মকবুল হোসেনের ভেতর ভয় বাড়তে থাকে। নানা চিন্তায় শরীরটা কেমন যেন আস্তে আস্তে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা পাশ করে বেরুতে আরো বছর দুয়েক লাগবে। দিন দিন ছেলেমেয়েদের খরচ বাড়ছে।

বাসের চিন্তায় যখন সব গুলিয়ে ফেলছেন তখন কী করা উচিত তার পরামর্শ নিতে গেল বন্ধু হাসমতের কাছে। তার কথা শুনে ভয় আরো বাড়ল। সে বলল, তুমি মিয়া এটা কোনো কাজ করলে? এই বাস-টাসের ব্যবসা বুঝি তোমার জন্য! তোমার মত সহজ সরল মানুষ দিয়ে এই ব্যবসা হবে না বন্ধু। তুমি অন্যকিছু করো। তাছাড়া তোমার গাড়ির এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তা তো লাখ পাঁচেক বেচতে পারো কি না সন্দেহ আছে। তারচেয়ে আরো কিছুদিন চেষ্টা করে দেখো।

বন্ধুর কথা শুনে মকবুল খুব আশাহত হয়ে পড়ে। ঠিক ঐ হাসমতের কথায় বলে আজিজ মিস্ত্রিও। আজিজ মিস্ত্রি খুব ভালো মানুষ। সে এই মকবুল হোসেনকে বেশ সমীহ করে। এই গাড়ির নানা বিপদে আজিজ মিস্ত্রিই এগিয়ে আসে। মকবুল হোসেন ভাবে, এই আজিজ মিস্ত্রি পাশে না থাকলে এতদিনে গাড়ির চাকা নিয়ে বাড়ি যেতে হত।

মকবুল হোসেন বাসায় গাড়ির বিষয়টা বেশ গোপন করেই চলেন। রাবেয়া খাতুনের শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। এই সময় গাড়ির বিষয়গুলো মাথায় নিলে মানুষটার শরীর আরো খারাপ হবে। ছেলেটা খুলনা থেকে ফোন দিয়ে গাড়ির খোঁজ খবর নিতে চেষ্টা করে। যদিও ছেলেটা খুব করে বলেছিল গাড়ির ব্যবসার দিকে না যেতে। মকবুল হোসেন তেমন করে পাত্তা দেয়নি। এখন এসব শুনলে ছেলেটা মন খারাপ করবে। এই নিয়ে নানা চিন্তা করে মকবুল হোসেন চুপ করে থাকে। মেয়েরা বাবার হাবভাব দেখে বুঝতে পারে কিছু একটা লুকাচ্ছে। বাবাকে দিন দিন এমন করে পাল্টাতে দেখে মেয়ে দুইটা নানা প্রশ্ন করলে মকবুল হোসেন এড়িয়ে চলেন।

খবরটা শুনলো সকালের দিকে। আজিজ মিস্ত্রি ফোন দিয়ে বলল, গাড়ি তো এক্সিডেন্ট করছে মিয়া ভাই। গাড়ির অবস্থা কী তা এখনো জানা যায় নি। গাড়ি সীতাকুন্ড। আমি যাচ্ছি। আপনার যাওয়ার দরকার নাই। আপনি ঠান্ডা মাথায় আমার গ্যারেজে এসে বসে থাকেন। যা হওয়ার হইছে। এই নিয়ে এখন বেশি চিন্তা করলে আপনার শরীর আরো খারাপ হবে।

আজিজের কথা শুনে মকবুল হোসেন কোনো কথা বলল না। ফজরের নামাজটা শেষ করে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলেন। বিষয়টা বাসার কাউকে বুঝতে দিলেন না। সকালের নাস্তা সেরে সোজা আজিজ মিস্ত্রির গ্যারেজে আসলেন। তখন থেকে ঐ আজিজের রুমে বসে আছেন।

আজিজ মিস্ত্রির গ্যারেজের নতুন রঙ দেওয়া গাড়ির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মকবুল হোসেন নানা বিষয় চিন্তা করেন। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আজিজ মিস্ত্রি গিয়েছে সীতাকুন্ড। যদিও এতক্ষণে চলে আসার কথা। কিন্তু আসে নি। গাড়ির ইঞ্জিনের অবস্থা ভালো না। এক্সিডেন্টে গাড়ির সামনের দিকে বেশ ক্ষতি হয়েছে। এই গাড়ি গ্যারেজে আনা প্রয়োজন। গাড়ি আনতে ক্রেন পাঠাতে হবে। ক্রেনের জন্য খবর দেওয়া হয়েছে। আজিজ মিস্ত্রি আসলে বিস্তারিত জানা যাবে। ফোনে এতসব নিয়ে কথা বলতে মকবুল হোসেনের ইচ্ছে করছে না।

এতটা বছর চাকরি করল মকবুল হোসেন কিন্তু কখনও এমন করে নানা দুশ্চিন্তা মাথায় আসে নি। এখন দিন দিন খারাপ চিন্তা এসে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ঘুমাতে গেলে সেই চিন্তা দ্বিগুন হয়ে সবকিছু কেমন যেন উলটপালট করে দিচ্ছে। মেয়েদের বিয়ের জন্য ব্যাংকে জমিয়ে রাখা টাকা থেকে গাড়িটার পেছনে অনেকগুলো টাকা চলে গেল। সময় যত যাচ্ছে লাভের চেয়ে লোকসানের পাল্লাটা যেন ভারি হতে চলেছে।

গাড়ি আসা অবদি আজিজের গ্যারেজে বসে থাকল মকবুল হোসেন। ক্রেন দিয়ে গাড়ি আনতে আনতে অনেক রাত হয়ে গেল। সীতাকুন্ড থেকে গাড়ি আসা পর্যন্ত মকবুল হোসেন একটুও নড়ল না। তাঁর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। গ্যারেজে রঙের কাজ চলা বাসটির রঙ করা প্রায় শেষ। মকবুল হোসেন ঠিক আগের মত বাসটির দিকে তাকিয়ে আছে। বাসটি এখন দেখতে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। রাত এগারোটার দিকে সীতাকুন্ড থেকে ক্রেন দিয়ে বাস নিয়ে আসল আজিজ মিস্ত্রি ।

গাড়ির অবস্থা খুব একটা ভালো না। মকবুল হোসেন শুধু একবার তাকালো। ঐ একবার। তারপর আর একটুও না। ইচ্ছে করেই তাকালো না। ক্রেনের ভাড়া দিয়ে মকবুল হোসেন আজিজের গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে পড়ল। হঠাৎ করে এই গ্যারেজে তার কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাসটা ঐ একবার দেখার পর নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে বোধহয় দম বন্ধ হয়ে মারা যাবেন। মকবুল হোসেন দ্রুত গ্যারেজ থেকে বের হয়ে বাসায় দিকে রওনা দিলেন।

প্রায় তিনদিন হতে চলল মকবুল হোসেন আজিজের গ্যারেজের দিকে ভুলেও যান না। গাড়ি এক্সিডেন্টের খবর অনেকে জেনে গিয়েছে। রাস্তার বের হলে সবাই জানতে চায়। মকবুল হোসেনের খুব বিরক্ত লাগে। এই নিয়ে কারও সাথে কথা বলতে খুব কষ্ট লাগে। খুব একটা বাসা থেকে বেরও হতে চান না। তারপরও পরিচিত আত্বীয়-স্বজন ফোন দিয়ে নানা কথা শোনায়। সেদিন একজন ফোন দিয়ে বলল, তুমি আর কোনো কাজ পেলে না যে ঐ বাস কিনতে গেলে! এই গাড়ির ব্যবসা সবাইরে দিয়ে হয় বুঝি! এখন বুঝবে এই কেমন ব্যবসা।

নানাজনের নানা কথা শুনে মকবুল হোসেন চুপ করে থাকে। কী বলবে খুঁজে পায় না। অবসরের পর হাতে টাকা পেয়ে অনেকের ধারে ধারে ঘুরেছে একটা ভালো পরামর্শের জন্য। সবাই এড়িয়ে গেছেন। এখন বিপদের সময় সবাই ঠিকই নানা কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। এসব কথা শুনে মকবুল হোসেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। এসব মানুষের প্রশ্নের কোনো উত্তর জানা নেই তার। জানা নেই বলে নীরব হয়ে শুনতে থাকে।

আজ সকাল থেকে বেশ কুয়াশা পড়ছে। মকবুল হোসেন মসজিদে ফজরের নামাজ শেষ করে উত্তর পাড়ার গলি হয়ে আজিজ মিস্ত্রির গ্যারেজের দিকে হাঁটতে লাগলেন। ঠিক এই ভোরের দিকে ছেলেটা ফোন দিল। ফোন দিয়ে চুপ করে আছে। মকবুল হোসেন বঝতে পারে ছেলেটা কান্না চেপে রেখেছে। মকবুল হোসেন যেই বলে উঠল, আব্বাজান, অমনি ছেলেটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

মকবুল হোসেন খুব শান্ত হয়ে ছেলের কান্না শুনছে। গত কয়েকটা দিন নিজের ভেতর যে অস্থিরতা, যে ভয়, যে সংশয় নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে তা যেন নিমেষেই কোথাও উধাও হয়ে গেল। ছেলের এই কান্না শুনে বুকের ভেতরটা কেমন যেন শীতল হয়ে গেল। সাহসটা খুব বেড়ে গেল। মকবুল হোসেন বুঝতে পারে ছেলেটা গাড়িটার এক্সিডেন্টের খবর শুনে ফেলেছে। ছেলে কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল, আব্বা তুমি আর এসব গাড়ি-টাড়ি নিয়ে একটুও চিন্তা করবে না। একটুও না। যা হওয়ার হয়েছে। আর একটু অপেক্ষা করো। মাত্র দুইটা বছরই তো। আমি পাশ করে বের হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি শুধু ঐ মসজিদে যাবে। তোমার আর কোনো কাজ করা লাগবে না আব্বা।

ছেলেকে কিছু একটা বলতে যাবে মকবুল হোসেন কিন্তু গলাটা কেমন যেন ধরে আসে। পৃথিবীতে মানুষ যখন অসহায় হয়ে পড়ে তখন নিশ্চয় সৃষ্টিকর্তা কিছু সাহস আর সুখের উপসর্গ দিয়ে মানুষকে জাগিয়ে তুলেন। মকবুল হোসেনের কাছে মনে হলো তার এই সন্তানগুলো সেই সুখ আর সাহসের উপসর্গ।

মকবুল হোসেন আজিজ মিস্ত্রির গ্যারেজে কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। কাছাকাছি গিয়েই আবার উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। তার এখন আর আজিজ মিস্ত্রির গ্যারেজে যেতে ইচ্ছে করছে না। নিজের ভেতর যে সুখ আর সাহস তিনি অনুভব করছেন তা ঐ আজিজ মিস্ত্রির গ্যারেজে গিয়ে ভাঙ্গা গাড়ি দেখে শেষ করতে চান না।

মকবুল হোসেন হাঁটছেন বড় বড় কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর নীচ দিয়ে। আজ কেন জানি পায়ের গোড়ালিতে একটুও ব্যথা নেই। মকবুল হোসেন অনুভব করতে পারছেন শুধু তার গোড়ালিতে না, ভয়ে, সংশয়ে বুকের ভেতর সবসময় যে ব্যথাটা ছিল তাও এখন নেই। তিনি বুঝতে পারেন তার ভেতর বিশাল একটা সাহসের সমুদ্র জেগে উঠেছে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *