সৌভিক চক্রবর্তী
“Stuff your eyes with wonder… live as if you’d drop dead in ten seconds. See the world. It’s more fantastic than any dream made or paid for in factories.” —Ray Bradbury
১৯৫০ সাল। পাল্প পত্রিকা ‘আমেজিং স্টোরিজ’-এর মঞ্চে সায়েন্স ফিকশন (শুরুতে অবশ্য নাম ছিল সায়েন্টিফিকশন) নামক প্রায় নতুন এক সাহিত্যঘরানার আত্মপ্রকাশের পর কেটে গিয়েছে দু’ দশকেরও বেশি সময়। এই ক’ বছরে আরও সুশৃঙ্খল, আরও পরিণত হয়েছে সায়েন্স ফিকশন, জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে আমেরিকা মহাদেশজুড়ে। বিশেষ করে হার্ড সায়েন্স ফিকশন; জন উড ক্যাম্পবেল-এর নেতৃত্বে হার্ড উচ্চতার শ্রেষ্ঠ শিখর ছোঁয়ার দিকে এগিয়েছে। রোবটে মানুষে মারামারি অথবা এলিয়েন দানবদের সঙ্গে মহাকাশযাত্রীদের সম্মুখসমর—কল্পবিজ্ঞানের যা কিছু অন্ত্যজ সেই সবকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছেন ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’ পত্রিকার দোর্দন্ডপ্রতাপ সম্পাদক, পরিবর্তে বাছাই করা লেখকদের শিখিয়ে পড়িয়ে পত্রিকার পাতায় এনেছেন নিত্য নতুন প্লট, আশ্চর্য সব আইডিয়া, বিজ্ঞানপ্রযুক্তির চমকে দেওয়া তথ্য। এহেন সময়ে ডাবলডে প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হল ‘দ্য মার্শিয়ান ক্রনিকলস’। লেখক রে ব্র্যাডবেরি–আনকোরা না হলেও কল্পবিজ্ঞানের আঙিনায় স্বল্পপরিচিত নাম। বইটাও একটু অদ্ভুতঃ উপন্যাস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও আদতে ধারাবাহিকতার সরু সুতোয় গাঁথা, উপক্রমণিকা দিয়ে জোড়া অনেকগুলো গল্পের সমষ্টি। বইয়ের বিষয়বস্তু মানুষের মঙ্গলগ্রহ অভিযান।
মাস গেল, বছর গেল; বইবাজারে বিষবৎ পরিহার্য নতুন লেখকের গল্প সংকলন ডুবে যাওয়ার বদলে ভেসে রইল। না, কেবল ভেসেই রইল না, পাঠকের মুগ্ধতার ঢেউয়ে চেপে পৌঁছে গেল খ্যাতির দেশে। মানুষের বিস্ময়বোধ, অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার প্রচণ্ড ইচ্ছে, মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার রোম্যান্স এবং ফেলে আসা অতীতের প্রতি তীব্র আকর্ষণকে তাঁর কাহিনিতে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুললেন ব্র্যাডবেরি, সঙ্গে কেকের ওপর চেরি হয়ে সামনে এল তাঁর অপূর্ব কাব্যময় ভাষা– “Rocket summer. The words passed among the people in the open, airing houses. Rocket summer. The warm desert air changing the frost patterns on the windows, erasing the art work. The skis and sleds suddenly useless. The snow, falling from the cold sky upon the town, turned to a hot rain before it touched the ground.” ইতিহাস সৃষ্টি করল ‘দ্য মার্শিয়ান ক্রনিকলস’, কল্পবিজ্ঞানের ছোট্ট বৃত্তের বাইরে যে বৃহত্তর পাঠকসমাজ রয়েছে তার কাছে নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে তুলল অনায়াসে। ক্রিস্টোফার ঈশারউড-এর মতো মূলধারার সাহিত্যসমালোচকও উচ্ছ্বাস প্রকাশ না করে পারলেন না— “…the sheer lift and power of a truly original imagination exhilarates… His is a very great and unusual talent.”
২২শে আগস্ট, ১৯২০। ওয়াকিগেন, ইলিনয়ের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হয় রে ডগলাস ব্র্যাডবেরি-র। হাই স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর অর্থের অভাবে কলেজে পড়তে যাওয়া হয়নি, পাড়ার কার্নেগি লাইব্রেরির রাশি রাশি বইয়েই খুঁজে নিয়েছেন সান্ত্বনা। ছেলেবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল কল্পবিজ্ঞান, ফ্যান্টাসি, কমিক্সের প্রতি, গল্প শুনতে ভালোবাসতেন, লিখতেও। এগারো বছর বয়স থেকেই কাগজ কলম হাতে তুলে নেওয়া ছেলেটার বড় হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি লাগল না, তিরিশের দশকের শেষদিক থেকেই লেখালিখির জগতে প্রবেশ করলেন ব্র্যাডবেরি। প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বেছে নিলেন ফ্যান ম্যাগাজিন। বছর দুই তিন এভাবে চলার পর প্রথম বাণিজ্যিক পত্রিকায় তাঁর নাম ছাপার অক্ষরে এল। ১৯৪১ সালের নভেম্বর মাসে ‘সুপার সায়েন্স স্টোরিজ’ ম্যাগাজিনে প্রকাশ পেল হেনরি হাস-এর সঙ্গে যুগ্মভাবে লেখা নৈরাশ্যময় কল্পবিজ্ঞান গল্প ‘পেন্ডুলাম’, যেখানে সময়যন্ত্র আবিষ্কারের চেষ্টায় নিদারুণভাবে ব্যর্থ হওয়া এক বিজ্ঞানীকে শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর সমাজ তাকে ঝুলিয়ে দেয় বিশালাকায় এক পেন্ডুলামের সঙ্গে। তার পরের বছর পাঠক পেল ব্র্যাডবেরি-র ‘দ্য লেক’—ছেলেবেলায় জলে ডুবে মারা যাওয়া প্রেমিকাকে একবারের জন্য কাছে পেতে চাওয়া যুবকের করুণ ট্র্যাজেডি। ক্রমশ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সূচিপত্রে স্থায়ী নাম হয়ে উঠলেন তিনি।
আজ ভাবলে অবাক লাগে, আমেরিকান জঁর ফিকশনকে মাহাত্ম্যে উন্নীত করা রে ব্র্যাডবেরি প্রাথমিকভাবে পরিচিত হয়েছিলেন হরর গল্পের লেখক হিসেবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে হরর চর্চায় কারোর চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন ব্র্যাডবেরি। তাঁর অতি বড় শত্রুও স্বীকার করতে বাধ্য হবে, গতানুগতিকতার উলটোদিকে হেঁটে সচেতনভাবেই হরর সাহিত্যকে এক আলাদা মাত্রা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। ‘উইয়ার্ড টেলস’ জাতীয় পত্রিকায় একের পর এক কাহিনি লিখে পাঠকের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ানো ব্র্যাডবেরির ইউএসপি ছিল—না, রাক্ষস প্রেত পিশাচ বা ওয়্যারউল্ফ নয়, বরং মানবমনের গহিন অন্ধকার ছেঁকে তুলে আনা ভয়, যা নানান বিচিত্র রূপে মানুষের সামনে আসে। এই প্রসঙ্গে দুটো গল্পের উল্লেখ করা যেতে পারেঃ ‘স্কেলিটন’ এবং ‘দ্য জার’। প্রথম গল্পের নায়ক মিঃ হ্যারিস-কে আমরা দেখি তার শরীরের ভেতরের কঙ্কালকে কল্পনা করে আতঙ্কে শিউড়ে উঠতে, দ্বিতীয় গল্পে চার্লির বারো ডলারে কেনা, কাচের বোতলে রাখা অ্যালকোহলে ভাসমান বস্তুটা আপাত নিরীহ মফঃস্বলবাসীর মনের অবদমিত অশুভকে টেনে বের করে আনে। প্রশ্ন জাগতে পারে, কী এই ভয়, কী তার পরিচয়? উত্তর দিয়েছেন সমালোচক ডেমন নাইট। তাঁর মতে, এই ভয় হল— “…the fundamental prerational fears… the fear of things that are not self…”
সায়েন্স ফিকশন লেখক রে ব্র্যাডবেরি-কে নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি, এবং যা নিয়ে প্রায় সব সমালোচকই একমত হয়েছেন তা হলঃ ব্র্যাডবেরি-র কল্পবিজ্ঞান নিছকই কল্পনা, বিজ্ঞান সেখানে ব্রাত্য। সময়োপযোগী কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে উপযুক্ত মর্যাদা দেননি তিনি, না মাথা ঘামিয়েছেন ভবিষ্যতের প্রযুক্তি নিয়ে। যখন যেমন সুবিধে হয়েছে আজগুবি বিজ্ঞানের আসবাব দিয়ে গল্প নামক ফাঁকা ঘর ভরিয়েছেন। তাঁর মঙ্গলগ্রহ অজস্র অসঙ্গতিতে ভরা, তাঁর রকেটশিপ আদতে টিনের ক্যানেস্তারা, তাঁর কম্পিউটার বাচ্চাদের খেলনামাত্র। প্রশ্ন তোলা হয়েছে তাঁর কাহিনির গঠন এবং বিন্যাস নিয়েও, বলা হয়েছে তাঁর ভাষা কল্পবিজ্ঞানের অনুপযুক্ত, তাঁর চরিত্ররা অগভীর, তাঁর প্লট মানবিক আবেগ-অনুভূতির আঠায় চটচটে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে বক্তব্যগুলো সঠিক, কিন্তু প্রশিক্ষিত পাঠক সহজেই ধরতে পারবেন, এই ন্যূনতা ব্র্যাডবেরি-র নয়, ন্যূনতা তাঁর সমালোচকদের। চোখ ধাঁধানো সায়েন্টিফিক আবিষ্কার বা প্রযুক্তিবিদ্যা সংক্রান্ত কচকচির বাইরেও যে কল্পবিজ্ঞান অস্তিত্বরক্ষা করতে পারে, চূড়ান্ত মানবকেন্দ্রিক হয়েও সার্থকতা খুঁজে নিতে পারে, সমালোচকদের সঙ্কীর্ণ মন সেটা মেনে নিতে পারেনি। মেনে নিতে পারেনি ব্র্যাডবেরি-র মিথ-নির্মাণ, যা তাঁর গল্পের পরতে পরতে মিশে থেকেছে। মেনে নিতে পারেনি ব্র্যাডবেরি-র একান্ত নিজস্ব স্টাইল– কোনও বক্তব্যই সরাসরি উপস্থাপন করেন না তিনি, করেন উপমা, অলংকার এবং কিছু ইঙ্গিত ও চিহ্নের মাধ্যমে-– যা পাঠকের অন্তরের সবকটা তার ছুঁয়ে যায়। কেবল লেখার জন্যই লেখেননি রে ব্র্যাডবেরি, প্রতিটা গল্পকে অর্থও দিয়েছেন নিজের মতো করে, সাজিয়েছেন রূপক এবং ‘ফেবল’-এর রঙিন মোড়কে।
‘গোল্ডেন অ্যাপেলস অফ দ্য সান’ রে ব্র্যাডবেরি-র অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প, যেখানে ‘কোপা ডে অরো’ নামের এক মহাকাশযানে চড়ে একদল অভিযাত্রী মহাশূন্যে পাড়ি দেয়, সূর্যের বুক থেকে আগুন আনতে। প্রায় মহাকাব্যিক ভাষায় এখানে সূর্যের বন্দনা করেছেন ব্র্যাডবেরি, প্রকৃতির নিঃস্পৃহ অথচ ছন্দোবদ্ধ সৌন্দর্যকে অর্ঘ্য অর্পণ করেছেন– “For now there was only the sun and the sun and the sun. It was every horizon, it was every direction…It burned the eyelids and the serum of the dark world behind the lids, the retina, the hidden brain; and it burned sleep and the sweet memories of sleep and cool nightfall.” পৌরাণিক ইকারাস নকল ডানায় ভর করে সূর্যের উচ্চতাকে ছুঁতে চেয়েছিলেন; অসীম সামর্থ্যবান টাইটান প্রমিথিউস পৃথিবীর মানুষের হিতার্থে স্বর্গ থেকে চুরি করে এনেছিলেন পবিত্র আগুন। ব্র্যাডবেরি-র গল্পের নায়ক, ‘কোপা ডে অরো’র ক্যাপ্টেন যেন তাঁদেরই যোগ্য উত্তরসূরী, মানুষের অনন্ত জিজ্ঞাসা, প্রকৃতিকে জয় করার অদম্য আগ্রহের মূর্ত প্রতীক।
‘দ্য ম্যান’ গল্পেও একজন মহাকাশচারী ক্যাপ্টেনকে পাই আমরা, কিন্তু তিনি কোনওভাবেই নায়ক নন, বরং নিয়তির কাছে হেরে যাওয়া একজন তুচ্ছ মানুষ। ঔদ্ধ্বত্য এবং পেশিশক্তির আস্ফালনকে হাতিয়ার করে মানবতার মসীহার খোঁজ করেন তিনি, একের পর এক গ্রহে ছুটে বেড়ান, অথচ প্রতিবারই একতিলের জন্য তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার পরম সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হন। খালি চোখে সাদামাটা হলেও এই গল্পের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে আধ্যাত্মিকতার এক গহিন সত্য—ঈশ্বরের সন্তান আমাদের অন্তরে বিরাজমান, এবং তাঁকে বাইরে খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন। এই সত্য ক্যাপ্টেনের অজানা, সেজন্যই তিনি বারবার ব্যর্থ হন, এবং আগামীদিনেও হবেন— “And he’ll go on, planet after planet, seeking and seeking, and always and always he will be an hour late, or a half hour late, or ten minutes late, or a minute late. And finally he will miss out by only a few seconds.”
ব্র্যাডবেরি-র ‘ক্যালাইডস্কোপ’ গল্পেও আধ্যাত্মিকতার ছাপ স্পষ্ট। মহাশূন্যের বুকে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে যাওয়া অভিযাত্রীরা নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ধেয়ে যায়, অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে। প্রথমে আসে আতঙ্ক, তারপর ক্ষোভ, একেবারে শেষে অবশ্যম্ভাবীকে মেনে নেওয়ার পালা–- “They were all alone. Their voices had died like the echoes of the words of God spoken and vibrating in the starred deep…the shards of the kaleidoscope that had formed a thinking pattern for so long, hurled apart.” কাহিনির নায়ক লেস্পিয়ের উল্কার মতো খসে পড়ে পৃথিবীর বুকে, জ্বলে ওঠার আগের মুহূর্তে জীবনের অসাড়তা সম্পর্কে তার মনে প্রশ্ন জাগে। গল্প শেষ হয় এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েই। পাঠক কিছুটা হলেও যেন উপলব্ধি করতে পারে ঈশ্বরের পরিকল্পনা; জন্ম বা মৃত্যু কখনও নিষ্ফল হয় না, মহাবিশ্বের প্রতিটা প্রাণীই কোনও না কোনও বৃহৎ উদ্দেশ্য পালন করে—এই আশাব্যঞ্জক ধারণা তাঁদের মনে দৃঢ়তর হয়।
সাদা, কালো, ধূসর ইত্যাদি নানান ক্যানভাসে জীবনকে আঁকলেও সাহিত্যরচনার ক্ষেত্রে জীবনের একটা পর্যায়কেই প্রাধান্য দিয়েছেন ব্র্যাডবেরি—আর তা হল শৈশব। তাঁর চিন্তা, ভাবনা, বোধ সবকিছুই আবর্তিত হয়েছে শৈশবের বিভিন্ন আঙ্গিককে ঘিরে। যৌবন দাবি রাখে, মধ্যবয়স সবকিছুর যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা খোজে, কিন্তু শৈশব নিষ্কলুষ, সে শুধু অনুভব করে। শিশুরা কখনও উষ্ণ, কখনও শীতল, কখনও উৎসাহী আবার কখনও অবজ্ঞাপ্রবণ; কিন্তু সবসময়ই কৌতূহলী, রূপ-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শের মাধ্যমে বুঝে নিতে ইচ্ছুক পরিপার্শ্বের স্বরূপ। তাই হয়তো শিশুদের প্রতি ব্র্যাডবেরি-র এত টান– “The boys were playing on the green park diamond when he came by. He stood a little while among the oak-tree shadows, watching them hurl the white, snowy baseball into the warm summer air, saw the baseball shadow fly like a dark bird over the grass, saw their hands open in mouths to catch this swift piece of summer that now seemed most especially important to hold onto…”
ব্র্যাডবেরি-র গল্পের প্রাপ্তবয়স্ক, অভিজ্ঞ চরিত্ররাও শিশুসুলভ আচরণ করে– কখনও সরলতা, আবার কখনও বা অজানা ভয়ের দৃষ্টিতে দেখে জগৎ-সংসারকে। ‘দ্য আর্থ মেন’ গল্পে মঙ্গলের বুকে পাড়ি দেওয়া অভিযাত্রী থেকে ‘আ সাউন্ড অফ থাণ্ডার’ গল্পে ডাইনোসর শিকার করতে জুরাসিক যুগে গিয়ে পৌঁছোন শিকারীর দল– সবাই যেন ‘যেমন খুশি সাজো’ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা শিশু– মহাকাশচারী বা সময়ান্তরের যাত্রী সেজে বইয়ের পাতায় অভিনয় করছে। কখনও কখনও এই চরিত্ররা একমাত্রিক হয়ে পড়ে, বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়, কিন্তু তাও পাঠক ব্র্যাডবেরিকে ছেড়ে থাকতে পারেন না, কারণ শত ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও, শৈশবের হাতছানি বড় মধুর। মহিলা এবং বৃদ্ধদের নিয়ে লেখার সময়ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় ব্র্যাডবেরি দেন, কারণ নারীত্ব এবং প্রৌঢ়ত্ব ব্র্যাডবেরি-র কাছে শৈশবেরই আরেক রূপ। ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ নভেলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, সতেরো বছরের কিশোরী ক্ল্যারিস ম্যাক্লেলান-এর সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে একের পর এক বিশেষণের ফুল ফুটিয়েছেন ব্র্যাডবেরি, আপন খেয়ালে বয়ে চলা ঝর্নার স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে— “…her eyes were two miraculous bits of violet amber that might capture and hold him intact. Her face, turned to him now, was fragile milk crystal with a soft and constant light in it. It was not the hysterical light of electricity but — what? But the strangely comfortable and rare and gently flattering light of the candle.” বৃদ্ধদের চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে নরম, পেলব রঙ ব্যবহার করেছেন তিনি, আশ্রয় নিয়েছেন সহমর্মিতাঁর। ‘দ্য ডে ইট রেইনড ফরএভার’ গল্পে বৃদ্ধ মিঃ টার্লে যখন অবাক হন, সেই ভঙ্গিমাও তাই হয়ে ওঠে একান্তই শিশুসুলভ— “Mr Terle’s eyes grew wider and yet wider to take hold of what was coming. He held to the porch rail like the captain of a long-becalmed vessel feeling the first stir of some tropic breeze that smelled of lime and the ice-cool white meat of coconut.”
“বাচ্চারা গুনগুন করে
খোঁচা মেরে খুন করে
খাঁচার টিয়াকে
বাচ্চারা গুনগুন করে
বেবি-ডল গুম করে
খেলাঘরে রাখে।
বাচ্চারা দেয়ালা করে
বন্ধ জানালার ঘরে
খেলে ডার্করুম
বাচ্চারা দেয়ালা করে
নখে ফালাফালা করে
বাটন মাশরুম।”
বর্তমান সময়ের অন্যতম শক্তিশালী কথাশিল্পী সৈকত মুখোপাধ্যায় রে ব্র্যাডবেরি-র ভাবশিষ্য, তাই এমন কবিতা তিনি অনায়সে লিখতে পারেন। ঋদ্ধ পাঠক সৈকত জানেন, ব্র্যাডবেরি-র চোখে শৈশব কেবলই শোভন, নবীন, বিমল নয়, ক্ষেত্রবিশেষে হিংস্র এবং প্রতিশোধপরায়ণও। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ‘দ্য স্মল অ্যাসাসিন’ গল্পের সদ্যোজাত শিশুর কথা, যে তার মা বাবাকে ইচ্ছাকৃতভাবে খুন করে। কেন সে এরকম করে তার ব্যাখ্যাও লেখক বসিয়েছেন গল্পের এক চরিত্রের মুখে— ‘…an unborn child…it floats in a sleepy dark effluvium of timeless wonder and warm nourishment and silence…Then, suddenly, it is asked to give up its berth, is forced to vacate, propelled out into a noisy, uncaring, selfish, swift and merciless world… And the newborn resents it…resents the raw cold air, the huge spaces, the sudden departure from familiar things. And in the tiny filament of brain the only thing that the child knows is selfishness and hatred because the spell has been rudely shattered.” একই কথার প্রতিধ্বনি আমরা পাই ‘দ্য ভেল্ট’ গল্পে, যেখানে দুই ভাইবোন পিটার ও ওয়েন্ডি তাদের খেলাঘরকে কাজে লাগিয়ে মা বাবাকে খুন করে। একজন মনস্তাত্ত্বিক সেই নার্সারিঘরের দেওয়ালে হিংস্র সিংহদের দেখতে পান, এবং বলেন– “One of the original uses of these nurseries was so that we could study the patterns left on the walls by the child’s mind, study at our leisure, and help the child. In this case, however, the room has become a channel toward destructive thoughts, instead of a release away from them.”
‘লেট’স প্লে পয়জন’—যেখানে একজন কড়া স্কুলমাস্টারকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় একদঙ্গল বাচ্চা ছেলেমেয়ে–পড়ে মনে হতেই পারে, দোষটা বড়দের। বড়রা বাচ্চাদের বোঝার চেষ্টা করে না, নির্বোধ মনে করে দূরে সরিয়ে রাখে, ভাবে— “…children are invaders from another dimension…You are another race entirely, your motives, your beliefs, your disobediences. You are not human. You are—children.”, আর সেকারণে শিশুরাও তাদের ঘৃণা করে, পথ থেকে সরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু এই থিওরি আংশিকভাবে সত্যি, সব প্রশ্নের সমাধান এতে মেলে না। শিশুরা শুধু বড়দেরই তাদের শত্রু বলে মনে করে এমনটা নয়, অপেক্ষাকৃত দুর্বল, নিরীহ বা অন্যরকম শিশুদের প্রতিও বিদ্বেষভাব পোষণ করে। অনেকক্ষেত্রে তাদের নিষ্ঠুরতা ধর্ষকামের পর্যায়েও চলে যায়। ‘অল সামার ইন আ ডে’ গল্পের কথাই ধরা যাক। সাত বছরের অবিশ্রান্ত বৃষ্টির পর শুক্রগ্রহের আকাশে যখন সূর্য ওঠে, তখন স্কুলের বাচ্চারা, যারা এতদিন শুধু স্বপ্নেই কল্পনা করে এসেছে সূর্যকে— “…they were dreaming and remembering gold or a yellow crayon or a coin large enough to buy the world with…a warmness, like a blushing in the face, in the body, in the arms and legs and trembling hands.”—প্রাণভরে উপভোগ করে সে দৃশ্য, কিন্তু মার্গো বলে তাদেরই সহপাঠী একজন মেয়েকে জোর করে বন্দি করে রাখে অন্ধকার দেরাজের ভেতর। ‘প্লেগ্রাউন্ড’ গল্পের নায়ক তার ছোট ছেলেকে বিকেলবেলায় পার্কে খেলতে দিতে চান না, কারণ তিনি জানেন, পার্কের অন্যান্য বাচ্চারা তাকে হেনস্থা করবে, যন্ত্রণা দেবে। শৈশবের নিষ্পাপ সৌন্দর্যের পাশাপাশি এই আঁধারময় দিকটাকেও ব্র্যাডবেরি নির্দ্বিধায় ভাষা দিয়েছেন তাঁর সৃষ্টিতে, এজন্য তাঁর সাধুবাদ অবশ্যই প্রাপ্য।
সায়েন্স ফিকশন, ফ্যান্টাসি, হরর, ডার্ক ফ্যান্টাসি প্রভৃতি সাহিত্যধারাকে ‘এস্কেপিজম’ বলে দাগিয়ে দেওয়াটা পণ্ডিতম্মন্য সাহিত্যবোদ্ধাদের স্বভাবের মধ্যে পড়ে, প্রায় সারাটা জীবন কল্পবিজ্ঞান এবং ফ্যান্টাসি-র চর্চায় নিজেকে নিয়োগ করা ব্র্যাডবেরি-র বিরুদ্ধে সাহিত্যচর্চার নামে পলায়নবৃত্তির অভিযোগ ওঠাটাও তাই আশ্চর্য কিছু নয়। কিন্তু যারা এই অভিযোগ আনেন তাঁরা রে ব্র্যাডবেরি সম্বন্ধে, অথবা তাঁর সাহিত্যকর্ম সম্বন্ধে, আদৌ কিছুই জানেন না। “The good writers touch life often. The mediocre ones run a quick hand over her. The bad ones rape her and leave her for the flies” ব্র্যাডবেরি অসাধারণ একজন লেখক; জীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে ছুঁয়ে দেখেছেন তিনি, উপলব্ধি করেছেন হৃদয় দিয়ে, নিজের লেখায় তুলে এনেছেন বারবার। তাঁর ‘—অ্যান্ড দ্য মুন বি স্টিল অ্যাজ ব্রাইট’ গল্পে যে অভিযাত্রীরা তাচ্ছিল্যভরে মঙ্গলগ্রহের আদি অধিবাসীদের স্থাপত্য ভেঙে গুঁড়িয়ে নষ্ট করতে চায়, ‘দ্য পেডেস্ট্রিয়ান’ গল্পে যে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রশক্তি রাতেরবেলা পথিককে ফুটপাথে হাঁটতে বাধা দেয়, ‘দ্য ক্রাউড’ গল্পে যে বিবেকহীন মানুষের দল কোনও দুর্ঘটনাগ্রস্ত, মৃতপ্রায় লোকের চারপাশে শকুনের মতো ভিড় জমায়, তারা সকলেই বাস্তব থেকে উঠে আসা। এদের আমরা খুব ভালো করেই চিনি, কখনও চলার পথে, কখনও অফিসে কাজের ফাঁকে, কখনও আবার টিভিতে খবর দেখার সময় এদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। ব্র্যাডবেরি-র সাফল্যের এটাও একটা কারণ, বাস্তবানুগ বলেই তাঁর কাহিনিরা আজও এত উজ্জ্বল, আজও অমলিন আমাদের স্মৃতির ভাঁজে।
রে ব্র্যাডবেরি-কে নিয়ে লিখতে বসলে কথা ফুরোতে চায় না, মনে হয় লিখি, লিখেই যাই। কিন্তু কোথাও না কোথাও তো থামতেই হয়, যেমন থেমেছেন ব্র্যাডবেরি স্বয়ং, আপামর ভক্তকূলকে কাঁদিয়ে ২০১২ সালের ৫ই জুন অমৃতলোকের পথে যাত্রা করেছেন। পঞ্চভূতে বিলীন হয়েছে তাঁর দেহ, কিন্তু আমরা ভাগ্যবান, তাঁর সাহিত্যকর্ম, তাঁর অমূল্য সৃষ্টির ডালি আমাদের কাছেই থেকে গিয়েছে। সাদা কাগজের গায়ে কালো কালিতে ছাপা তাঁর উত্তরাধিকার, তাঁর চিন্তা-ভাবনা-অনুভূতির নির্যাস রয়েছে আমাদের নাগালের ভেতর, শুধু হাত বাড়িয়ে বইয়ের পাতাগুলো উলটে দেখার অপেক্ষা। আর তাই কখনও কখনও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, মারা যাননি রে ব্র্যাডবেরি, বরং রয়েছেন আমাদের মধ্যেই, তাঁর প্রিয় মঙ্গলগ্রহ, ওয়াকিগেন এবং আদুরে শৈশবের নরম ছায়ায়। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, গত ২২শে আগস্ট জন্মশতবর্ষে পা রাখা ইলিনয়ের জাদুকর অতীত হবেন না কোনোদিনই, অমর অক্ষয় হয়ে থাকবেন পাঠকদের মনের মণিকোঠায়, সন্ধ্যাতারার উজ্জ্বলতা নিয়ে।
***শেষ***
তথ্যসূত্রঃ
১। ‘When I was in kneepants: Ray Bradbury’, Damon Knight
২। ‘Bradbury on Children’, Lahna Diskin
৩। ‘Ray Bradbury Stories’, volumes 1&2, Ray Bradbury
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন