rannaghar-swader-anna-kahon

স্বাদের অন্ন কাহন
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


বাংলার খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে লিখতে বসলেই মধ্য যুগের কবি ঈশ্বর গুপ্ত কে মনে পড়ে। ভাতের মত সামান্য জিনিষও সেখানে বাদ পড়েনি।

‘‘ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালী সকল
ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।”

ধান-চালের সঙ্গে বাঙ্গালির সম্পর্ক কিন্তু আরও আগের। এযাবৎ ধান চাষের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অনেক প্রমাণও মিলেছে। পান্ডুরাজার ঢিবিতে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায় আনুমানিক দু’হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের ধানের আবাদ করার কথা। সেই ধানের বীজ মৃৎপাত্রে তারা সংরক্ষণ করতেন। কৃষিপ্রধান রাজ্যে ধান্যলক্ষ্মীর পুজো কিম্বা দুর্গাপুজোর নবপত্রিকায় ন’রকম সবুজ উদ্ভিদের সঙ্গে ধানচারাও যে থাকে তা আমাদের অজানা নয়। অন্যান্য জীবনদায়ী উদ্ভিদলতার মত ধান তো প্রাণদায়িনী মহালক্ষ্মী। সমগ্র রাজ্যবাসীর প্রধান আহার্য শস্যদানা। তাকে তো ভুলে গেলে চলবে না কৃষিপ্রধান দেশের মানুষকে। ধানের উত্পাদনের ওপর নির্ভরশীল রাজ্য আমাদের বাংলা। ধান আমাদের স্টেপল ফুড। ধান আমাদের অর্থকরী উদ্ভিদ। ধান থেকে উৎপন্ন অন্ন, চিঁড়ে, মুড়ি, খই সব আমাদের আপামর জনজীবনের একান্ত আপনার খাদ্য। তাই অঘ্রাণের নতুন ধান উঠলে নবান্ন উৎসবও আমাদের সেইকথাই মনে করিয়ে দেয়। এমনকি পৌষমাসের নতুন ধান দিয়ে পিঠেপুলি নিবেদন করে পৌষলক্ষ্মীর আবাহন আমাদের বাঙালীর অন্যতম লোকসংস্কৃতি।

পৌষ মাসে ঘরে ঘরে নতুন চালের সেই উত্‍সব বঙ্গদেশে এভাবেই রূপ পায় ‘পিঠে সংক্রান্তি’-র। অগ্রহায়ণ-পৌষের সোনালী উৎসব যেন ধানের শীষের ডগায় সেই বার্তা বয়ে আনে… ‘নতুন ধান্যে হবে নবান্ন’। আবার ভাদ্রমাসে আউস ধান উঠলে ভাদ্রলক্ষ্মীর পুজোও সর্বজনীন কৃষি দেবীর উদ্দেশ্যে থ্যাংকস গিভিং এর অনুরূপ।

মৌর্য এবং গুপ্ত যুগে শস্যের মধ্যে পঞ্চশস্যের (ধান্য-মাসকলাই-তিল-মুগ-যব) উল্লেখ রয়েছে, যা এখনও আমাদের বাঙালী পুজোর অন্যতম উপাচার। যেখানে গমের নাম নেই কিন্তু ধান রয়েছে। এমনকি ষোড়শদানে কাহনের চাল এবং তণ্ডুল উপস্থিত। এছাড়া আমাদের পুজো পার্বণে পিটুলি গোলা, সেও তো চাল বাটাই। পুজোর পুষ্পপাত্রে এবং নৈবেদ্যতেও ভেজানো আতপ চাল কিম্বা পুরোহিত বা রান্নার ঠাকুরকে রান্না-করা খাবারের পরিবর্তে চাল ডাল প্রভৃতির সঙ্গে একটি কয়েন এবং সিদ্ধ করে খাওয়ার যোগ্য আনাজ সাজিয়ে “সিধে” দেওয়ার রীতিও অনেক কালের। আবার কালীপুজো বা কোনও বিশেষ তিথিতে পর্বতের মত চুড়ো করে অন্ন ভোগ বা অন্নকূট? পুজোর অনুষঙ্গে ধানচালের এরূপ ব্যাবহার আজও প্রচলিত।


তাহলে বাঙালীর অন্যতম এই অন্নের কথা দিয়েই হোক শুরুয়াত। জানা যায়, প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ধান আমদানি হত। আর নদীমাতৃক বাংলার ভৌগোলিক কারণেই হোক কিম্বা আদিবাসী-কৌম সমাজের উত্তরাধিকারের ফলেই কৃষিপ্রধান বাংলার প্রধান খাদ্য হয়ে ওঠে ভাত। এমন সব খোঁজ রয়েছে আদিযুগ থেকেই। আদিযুগের প্রাকৃত ভাষায় লিখিত প্রাকৃত পৈঙ্গল গ্রন্থই তার প্রমাণ। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে পিঙ্গলের দ্বারা রচিত এই গ্রন্থটি ছন্দে বর্ণিত। আনুমানিক চতুর্দশ শতাব্দীতে বারাণসী ধামে এই প্রাকৃত পৈঙ্গলের সংকলন হয়। সংস্কৃতে রচিত কিন্তু প্রাকৃত ছন্দে লেখা সর্বজনবিদিত এই পদটি। মূলতঃ রাধাকৃষ্ণবিষয়ক পদ হলেও বাঙালীর সুস্বাদু জীবনযাপনের চিত্রটিও নিম্নোক্ত পদটিতে অতি সুমধুর ভাবে বর্ণিত।

ওগ্‌গর ভত্তা, রম্ভঅ পত্তা / গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সজুত্তা।
মইলি মচ্ছা, নালিচ গচ্ছা / দিজ্জই কন্তা, খাঅ পুণ্যবন্তা।।

কলাপাতায় বেড়ে দেওয়া হয়েছে ওগরা ভাত (ফ্যানভাত)। সঙ্গে গাওয়া ঘি, সুস্বাদু দুধ, মৌরলা মাছ, নালতে (পাট) শাক। এসব রান্না করে স্ত্রী পরিবেশন করছেন তাঁর কান্ত (স্বামী)কে এবং এই খাদ্যের মালিক সেই স্বামী সত্যই পুণ্যবান।

প্রাচীন সাহিত্যে পাকবিদ্যার উল্লেখ আছে। ভারতীয় সংস্কৃতির চৌষট্টিকলার মধ্যে অন্যতম হল রন্ধন কলা। গৃহদেবতার নৈবেদ্য বা অতিথি সত্কারের জন্য সুসজ্জিত খাদ্য পরিবেশনাও এর মধ্যেই পড়ে। সেই কোন যুগে গৃহস্বামীর উদ্দেশ্যে তাঁর ঘরণীর নিবেদিত অতি সাদামাটা খাদ্যও পরিবেশনার গুণে মহার্ঘ হয়ে উঠেছিল চর্যাপদে।

ইংরেজ আমলে আঠারো বার দুর্ভিক্ষে সামিল হয়েও ভেতোবাঙালি ভাত কে বর্জন করতে পারেনি। প্রাচীন আমল থেকেই ভাতের সঙ্গে যে তাদের নাড়ীর সম্পর্ক।

বাংলার সেন রাজাদের আমলে রাজা জয়চন্দ্রের পৃষ্ঠপোষক কবি ছিলেন শ্রীহর্ষ। তাঁর লেখা নৈষধচরিতে নল-দময়ন্তীর বিয়ের ভোজে গরম ধোঁয়া ওঠা অভগ্ন, ফুরফুরে সাদা ভাতের উল্লেখ রয়েছে। এই অভগ্ন ভাত বলতে মনে পড়ে বাঙালীর ঝরঝরে, দুধ সাদা জুঁইফুলের মত ভাতকেই। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আমরা দেখি সবাই স্টিকি রাইস খেতেই বেশী পছন্দ করে। আমরা হয় খাই ফ্যানাভাত, নয় খাই ঝরঝরে প্লেন রাইস আর নয়ত একটার গায়ে একটা না লাগা ধূমায়িত পোলাও ভাত। “পরিবেশিত অন্ন হইতে ধুম উঠিতেছে, তাহার প্রতিটি কণা অভগ্ন, একটি হইতে আরেকটি বিচ্ছিন্ন! সে অন্ন সুসিদ্ধ, সুস্বাদু আর শুভ্রবর্ণ, সরু ও সৌরভময়!’’

পর্তুগীজ এক পর্যটকের মতে বাংলার ভাত ইউরোপ বা অন্যান্য দেশের ভাত অপেক্ষা অনেক বেশী সুস্বাদু। চাল ফোটার সময় থেকে শুরু করে প্লেটে পরিবেশন অবধি ভাতের সুঘ্রাণে আর নিখুঁত সূক্ষ্মতা লক্ষ্য করার মত। বাঙালী গৃহিণীদের ভাত রান্নাটাও তেমন নৈপুণ্যের পরিচয় দেয়।

প্রখর গ্রীষ্মে এই বাংলায় বাসি পান্তাভাত বা জল ঢালা ঠাণ্ডা ভাতও খুব জনপ্রিয়। মুখে দারিদ্রের প্রকাশ না করে অম্লান বদনে এই বাঙালীর মুখেই শোনা যায় রসের কথা। সর্ব সমক্ষে বেগুণ পোড়া সহযোগে পান্তাভাত কে সে সাদরে বরণ করে নিয়ে বলে ” ঠান্ডি পোলাও আর বাইগন কি কাবাব জমে যাবে আজ”

চতুর্দশ শতকেই ‘চর্যাপদে’র ঢেন্ডন পাদের বৌদ্ধ গানের পদে দেখি সেসময় হাঁড়িতে ভাতের ব্যাবহার।

“টালত মোর ঘর নাহই পড়বেষী
হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী”

যার অর্থ হল বাড়িতে ভাতের জোগাড় নেই অথচ নিত্য প্রতিবেশীর আনাগোনা যা বাংলার অন্যতম চিরাচরিত প্রথা। প্রবাদেই আছে, আপনে খেতে পায় না শঙ্করা কে ডাকে। আবার মনসামঙ্গলের চাঁদ সওদাগরের স্ত্রী সনকার হাঁড়ি ভাতে উপচে পড়ে। ভাতের কোনও অভাব নেই সেখানে। ” যেই মাত্র হাড়িতে মেনকা দিবল হাত/ হাড়িতে পাইল উত্তম ব্যঞ্জন ভাত। ”

সে যুগে ধনী পরিবারের উৎসবে পরিবেশিত হত শালিধানের ভাত।
‘শাল্যা অন্ন বেঞ্জন পিষ্টক পরমান্ন’

রান্না হয়েছিল চাঁদসদাগরের ছেলে লখীন্দরের মুখে-ভাতে। জ্ঞাতিরা খেয়ে মহা খুশি, বিপ্ররা সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।

অন্নদামঙ্গলে ভিখারি শিবের মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে,
‘‘শাক নাই, শুক্তো নাই, ব্যঞ্জনও নাই, চাউল বাড়ন্ত, তবে ফ্যান–ভাত চাই’’

মধ্যযুগে বৃন্দাবন চন্দ্র দাসের চৈতন্য ভাগবতে চৈতন্যদেবের আহারের বর্ণনায় পাই অন্ন ঘৃত দুগ্ধ পায়স ইত্যাদির কথা। এছাড়া সার্বভৌম ভট্টাচার্যের কাছে চৈতন্যদেবের নিমন্ত্রণের মেন্যুতেও সেই ভাতের কথা।

“বর্তিসা কলার এক আঙ্গেটিয়া পাত,
ঊণ্ডারিল তিন মান তাম্বুলের ভাত
পীত সুগন্ধী ঘৃতে অন্ন সিক্ত কৈল,
চারিদিকে পাতে ঘৃত বহিয়া চলিল”

সেই সময়ে ভাতের সঙ্গে ঘি খাওয়ার খুব প্রচলন ছিল। বর্তমানেও যা অব্যাহত।

অতএব সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালীর স্টেপল ফুড যে ভাত তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক শ্রীপান্থ লিখেছেন, “বাঙালি যখন দুটি পদে খাওয়ার কথা বলে, তখন হয় বলে ডাল-ভাত, না হয় দুধ-ভাত, অথবা মাছ-ভাত”। অর্থাৎ ভাত হল বাঙালীর খাবারের মধ্যমনি ।

বাংলার গাঙ্গেয় উর্বর পলিমাটির কারণে বাঙালি জাতি চিরকাল ভাতকেই প্রাধান্য দিয়েছে। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ বইয়ের আদি পর্বে উল্লেখ করছেন, ‘ইতিহাসের উষাকাল হইতেই ধান্য যে-দেশের প্রথম ও প্রধান উৎপন্ন বস্তু, সে দেশে প্রধান খাদ্যই হইবে ভাত তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নেই । ভাত-ভক্ষণের এই অভ্যাস ও সংস্কার অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির দান।’

কৃত্তিবাসের রামায়ণে সীতার বিবাহ অনুষ্ঠানে জনক রাজা ভোজসভায় কিভাবে অতিথি সৎকারের আয়োজন করেছিলেন, তার বিস্তৃত বর্ণনায় রয়েছে “ঘৃত দুগ্ধে জনক করিলা সরোবর/ স্থানে স্থানে ভাণ্ডার করিল মনোহর।/রাশি রাশি তন্ডুল মিষ্টান্ন কাঁড়ি কাঁড়ি,/স্থানে স্থানে রাখে রাজা লক্ষ লক্ষ হাঁড়ি”। অন্যত্র, ভারে ভারে দধি দুগ্ধ ভারে ভারে কলা,/ ভারে ভারে ক্ষীর ঘৃত শর্করা উজলা।/সন্দেশের ভার লয়ে গেল ভারিগণ,/ অধিবাস করিবারে চলেন ব্রাহ্মণ”।

জলখাবারেও তণ্ডুল বা ধান জাত দ্রব্যাদির ব্যাবহারও প্রাচীন কাল থেকেই চালু ছিল।

চন্ডীমঙ্গলে খুল্লনার রন্ধনশৈলী ও কুটুম্বিতার পরিচয় দিতে রয়েছে “দধিপিঠা খান সভে মধুর পায়স”। আবার মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে ” দুর্বলার হাটে গমন” অংশে চিঁড়া খাওয়ার কথা পাই। “স্নান করি দুর্বলা, খায় দধি খণ্ড কলা, / চিঁড়া দই দেয় ভারিজনে”

চৈতন্যচরিতামৃতে বৈষ্ণবদের মালসা ভোগে অত্যুতকৃষ্ট ফলাহারে ও চিঁড়া, দই থাকবেই । তাছাড়াও খই মুড়কির ছড়াছড়ি সেখানে। সংস্কৃত চিপিটক শব্দ থেকে চিঁড়া শব্দটি এসেছে। ভেজা ধান সেদ্ধ করে ঢেঁকিতে চ্যাপ্টা করা হত সেকালে। গ্রামবাংলায় বহু যুগ পর্যন্ত এই পদ্ধতিতেই চিঁড়া তৈরী হত। এখনও অনেক পুজো পার্বণে বাঙালীর চিঁড়া খাওয়ার চল।

এখনও পানিহাটিতে নিত্যানন্দ মহাপ্রভু প্রবর্তিত চিঁড়ে মহোৎসবের ধুম দেখি আমরা। আবার শুকনো খোলায় ধান ভাজলে খই হয় তা বিভিন্ন লোকাচারে, বিবাহ, শ্রাদ্ধশান্তিতে ব্যাবহৃত হয়। কলা বা আম সহযোগে দই চিঁড়ে বা খই দই এখনও আমাদের উত্তম জলখাবার।

কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম তাঁর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে নিদয়ার মুখ দিয়ে তো বলিয়েছেন এরূপ ফলাহারের কথা। “যদি ভাল পাই মহিষা দই/ চিনি ফেলি কিছু মিশায়ে খই”

এবার আসি ধান থেকে প্রস্তুত মুড়ির কথায়। ফাঁপা ভাজা চাল কে মুড়ি বলে। চালে নুন মাখিয়ে ভিয়ানে হালকা আঁচে শুকনো করে আবার রোদে দিতে হয় এই মুড়ি কে। চৈতন্যচরিতামৃতে মুড়ি শব্দটি ব্যাবহৃত হয়নি কিন্তু ” সাদি তণ্ডুল ভাজা” বলতে সেখানে বৈষ্ণব পদকর্তা মুড়িকেই বুঝিয়েছেন।

বাঙালী পুত্র সন্তানের জন্মের আটদিনের মাথায় ” আটকড়াই” উৎসবেও মুড়ির ব্যাবহার এখনও রয়েছে। গ্রাম বাংলায় এখনও মহা সমারোহে মুড়ি উৎসব পালিত হয়। মানিক গাঙ্গুলি তাঁর ধর্মমঙ্গলে খই ও মুড়ির সঙ্গে গুড় মিশিয়ে তৈরী মুড়কি কে মিষ্টান্নের তালিকায় রেখেছেন।

সাদাভাত ছাড়া মধ্যযুগে তিনরকমের ভাত, পরমান্ন (পায়েস), খেচরান্ন (খিচুড়ি) এবং পলান্ন (পোলাও) রান্নার প্রচলন ছিল। তবে পলান্ন অর্থ হল পল বা মাংস মিশ্রিত অন্ন। আরেরকম পোলাও এর সঙ্গে বাঙালীর হাতেখড়ি হয়েছিল ঠাকুরের ভোগ নিবেদন করতে গিয়ে যার নাম পুষ্পান্ন বা নিরামিষ ঘি ভাত। সাহিত্যের ইতিহাসে এইসব ভাতের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে একাধিকবার।

পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগে বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলে বণিকসুন্দরীর রন্ধনযজ্ঞেও নানা প্রকার পিঠের সঙ্গে পায়েসের উল্লেখ ছিল।

“মিষ্টান্ন অনেক রান্ধে নানাবিধ রস/দুই তিন প্রকারের পিষ্টক পায়স/দুগ্ধে পিঠা ভালো মতো রান্ধে ততক্ষণ/ রন্ধন করিয়া হৈল হরষিত মন।”

আবার ১৫৭৫-এ দ্বিজ বংশীদাসের মনসামঙ্গল কাব্যে সনকার রান্না করা সুস্বাদু পদের মধ্যেও পরমান্নের কথা ছিল।

“কত যত ব্যঞ্জন যে নাহি লেখা জোখা / পরমান্ন পিষ্টক যে রান্ধিছে সনকা”

আবার চৈতন্যচরিতামৃতে রয়েছে “সঘৃত পায়স” এর কথা। অনেক প্রাচীন দৃষ্টান্তে পায়েস বা পরমান্ন কে দুধ শাকর বা পক্বান্ন বলা হয়েছে। বাঙলার পায়েস রান্নার উপকরণগুলি অর্থাৎ দুধ, গুড়, চিনি, সুগন্ধি চাল, নারকোল কিন্তু মধ্যযুগীয়।

বৌদ্ধ যুগেই আমরা শুনেছি এই পরমান্নের কথা। গ্রাম্য মেয়ে সুজাতা বুদ্ধের জন্য পরমান্ন রেঁধে নিবেদন করছেন। সাহেবরা বাংলায় এসে এই অমৃতসম চালের পায়েসের নাম দিয়েছিল “রাইস পুডিং”। সংস্কৃতে যাকে বলে পায়সম্, হিন্দিতে তা ক্ষীর আর বাংলায় পুজোর উদ্দেশ্যে বানানো ভোগের পায়েসকেই বলে পরমান্ন।

বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের পায়েস প্রকরণে সুজি, জাফরান যুক্ত হয় মধ্যযুগে যা দুর্লভ বস্তু। আবার পাকরাজেশ্বরে উল্লেখ আছে “সর পায়েস” আর “ফিরনি” যা আমদানি হয়েছিল মোগলাই খানার সঙ্গে। এভাবেই পরমান্নের বিবর্তনও বাঙালী হেঁশেলে লক্ষ্য করার মত।

এবার আসি সাদাভাতের কথায়। প্রাক ঔপনিবেশিক পর্বে অন্ন আর ভাতের সমার্থক অভিজ্ঞানের ধারণাটি নব্য বাঙালীর চেতনায় অনেকটাই মাজাঘষা হয়ে আজ ব্যাপক অর্থে ধরা দেয় আমাদের কাছে।

এ তো গেল পরমান্ন বা পায়েসের কথা। এবার আসি পলান্ন বা পোলাও তে। পোলাও এর ট্র্যাডিশনও বাংলায় বেশ প্রাচীন।

অন্নদামঙ্গলের দেবী অন্নপূর্ণা “অন্নমাংস সিক ভাজা কাবাব করিয়া” অর্থাৎ শিবের জন্য নিজেই রাঁধেন সঘৃত পলান্ন ও শিকপোড়া।

আবার বাঙালী মিঠে পোলাও মানেই নিরামিষ পুষ্পান্ন। মায়েদের মুখে শুনেছি ঠাকুরের ভোগ রাঁধার সময় পুষ্পান্নের কথা। চলতি কথায় যার আদুরে নাম ঘিভাত। পুষ্পান্ন শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পুজোর ভোগপ্রসাদের গন্ধ। পুষ্পান্ন হল ঠাকুরের ভোগের নিরামিষ পোলাও আর পলান্ন হল পল বা মাংস মিশ্রিত অন্ন। মূলতঃ সেসময় পোলাও রাঁধা হত গোবিন্দভোগ বা তুলসীভোগ অথবা চিনিগুড়া এইসব চাল দিয়ে। এখন বাসমতীতেও রাঁধা হয়। ইস্কুলের ব্যাকরণই জানিয়েছিল পলান্ন সমাস ভেঙে হয় পল বা মাংস মিশ্রিত অন্ন অর্থাত বিরিয়ানির অনুরূপ কিছু একটা পোলাও জাতীয়। শোনা যায় আর্মেনিয়া বা টার্কির “পিলাও” থেকে উদ্ভব এই পোলাও শব্দের। যার আভিধানিক অর্থ হল ঘি আর মশলাপাতি দিয়ে রাঁধা সুগন্ধী অন্ন।

আফগানিস্থানের বিখ্যাত “বর পিলাউ” এর খ্যাতি সর্বজনবিদিত। বিরিয়ানির অনুরূপ। পাখীর মাংস দিয়ে প্রস্তুত ভাত। ওদিকে পারস্য দেশের চিকিত্সা শাস্ত্রের পন্ডিত আবু আলি ইবন্‌ সিনার লেখায় রয়েছে পিলাফ বা প্লোভ নামের মাংস মিশ্রিত একটি চালের পদের কথা। আবার এই পিলাফ হল উজবেকিস্তানের বিয়ের অনুষ্ঠানে পরিবেশিত এক অভিজাত পদ। তবে প্লোভ বা পিলাফ কিন্তু আলেকজান্ডারের আমলে গ্রীসে ছড়িয়ে পড়া এক সুস্বাদু খাদ্য। তাহলে? পোলাও শব্দের উত্স যে দেশ থেকেই হোক না কেন তা পল মিশ্রিত পলান্ন। বাঙালী পোলাও কিন্তু সেই পুষ্পান্নতেই গিয়ে থেমেছে।

তবে বাঙালীর রান্নাঘরে ছুটির দিনের কমফর্ট কম্বো মিল যে পোলাও মাংস তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তখন মাথায় থাক পুষ্পান্নের গোবিন্দভোগ কিম্বা আসলি বাসমতী। বাজার চলতি লংগ্রেইন আতপ রাইসেই দৌড়ায় এই ঘরোয়া পোলাও। এখন আমরা স্বাস্থ্যসচেতন তাই ঘিয়ের ব্যাপারে উদার না হয়েও নামিয়ে ফেলা হয় এই পোলাও।

তবে সুগন্ধী চাল ছাড়াও পোলাও’র প্রধান অঙ্গ হল ভালো ঘি, কাজু-কিশমিশ-কাঠবাদাম আর ছোট, বড় দুরকম এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, জয়িত্রী, জায়ফল, সাজিরে, সা’মরিচ। আগে দেখেছি ঠাকুমা, দিদিমা আখনির জলে পোলাও রাঁধতেন। ওরা দিতেন কিশোরী রং। তারপর যেদিন মেটানিল ইয়ালোর নিষেধাজ্ঞা জারি হল তখন হয় সাদা পোলাও নয় সামান্য হলুদ গুঁড়ো। বাসন্তী পোলাও, জাফরানি জর্দা পোলাও, নার্গিশী পোলাও, পিজ পোলাও, সবজী পোলাও যাই গালভরা নাম দিয়ে পোলাও কে নানাভাবে পরিবেশন করা হোক না কেন মূল পদ্ধতি এক। আবুল ফজলের আইনি আকবরি তেও রয়েছে আকবরের আমলে পরিবেশিত জের্দ বেরিজ বা হলুদ চালের কথা। ফারসি ভাষায় বেরিজ হল চাল। সেই ভাতের মূল উপাদানে সুগন্ধী চাল, চিনি, ঘি, ড্রাই ফ্রুটস, আদা এবং দারচিনির উল্লেখ রয়েছে। প্রণালীতে রয়েছে “দমপুক্ত” বা দমে বসিয়ে সেই ভাত রান্নার কথাও। তবে মাংস দেওয়া যেতেও পারে এমন কথাও বলেছেন আবুল ফজল।

অতএব জানা গেল, ভেতো বাঙালির এই ভাত নিয়ে আদিখ্যেতা অনেককালের। একসময় শ্রীপান্থের অত্যন্ত সংশয় ছিল এই ‘ভেতো’ বিশেষণ টিতে। কিন্তু বৃহৎ বঙ্গে ভাতই যে মোটের ওপর প্রধান খাদ্য তা আমরা দেখলাম ওপরে। উনিশ শতকে উচ্চকোটি আধুনিক বাঙালীর যে নতুন আইডেন্টিটি তৈরী হয় তার সঙ্গে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িয়ে ছিল বাঙালীর রসনা সংস্কৃতি। ততদিনে বাঙালী এও জেনে গেছে যে ভাত আর ভাত গ্রহণের পরে দিবানিদ্রা যতই সুখকর হোক তা মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। কারণ শর্করা নির্ভর ভাত অধিক গ্রহণে কিন্তু মধ্যপ্রদেশের স্ফীতি বৃদ্ধি পায় তাই অনেকেই এড়িয়ে চলেন ভাত খাওয়া। তবে ভাত কিন্তু পরিমিত গ্রহণে শরীরে অত্যন্ত সুফল মেলে আর বিশেষত আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান রাজ্যে শরীর ঠাণ্ডা রাখতে ভাতের জুড়ি মেলা ভার।

প্রাক ঔপনিবেশিক অবিভক্ত বাংলায় বৈচিত্র্যময় ধান চাষের উল্লেখ আছে। অন্নদামঙ্গলে আউস, আমন বোরো ছাড়াও দলকচু, ঘি-কলা, মেঘ হাঁসা, কনকচুর, দাদুসাহি, বাঁশফুল, কেলেজিরা, বিষ্ণুভোগ, বাসমতী চালের উল্লেখ রয়েছে। গোবিন্দভোগ, রাধুনিপাগল, তুলাইপাঞ্জি, বাশকাঠি, জিরাকাটি, দুধেরসর, চামনমণি, মিনিকেট এসবের নাম আমরাও শুনি সেই যবে থেকে বাজার করতে যাই তবে থেকে। মিলন দত্তের “বাঙালীর খাদ্যকোষ” গ্রন্থে মঙ্গলকাব্যের ৬৫ রকমের চালের উল্লেখ রয়েছে।

বৃহৎ বঙ্গে প্রচলিত হাজারও রকমের চাল এখন বাঙালী খাদ্য সংস্কৃতির অঙ্গও বটে। তার মাঝেও আবার শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালীর ভোজবিলাসে কেবলমাত্রই মিহি, সরু আর মসৃণ দুধসাদা ভাতের স্বপ্নেই বাঙালী শেষমেশ তৃপ্ত হয়েছে। তবে বাংলার বাইরে আতপচালের কাটতি কে এখনও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে বাংলার সেদ্ধচালের আবেগ কে।

বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় তাঁর অন্ন প্রকরণে অভগ্ন ঝুরঝুরে ভাতের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এরূপঃ “চাল দেবে যততত, জল দেবে তাঁর তিন তত” কিম্বা
ফুটলে পরে ভাতে কাটি / তারপরে দেবে জ্বালে ডাঁটি

আজ প্রেসারে ভাত রান্না করতে জল দেওয়ার সময় এসব মনে পড়ে বৈকি। আবার মনে পড়ে ঠাকুমা দিদিমাদের অবলীলায় ঘিভাত কিম্বা পোলাও রান্নার কথা। ফুটন্ত জলের মধ্যে নরম কাপড়ের পুঁটুলি বেঁধে সব মশলা গুলো দিতেন। তারপর ঘি মাখানো চাল ছাড়তেন তাঁরা। জলের মাপ হবে চালের ওপরে চার আঙুল অবধি। এখন আমরা চালের দ্বিগুণ জল মেপে আগেই বসিয়ে দি। পাকা গিন্নীরা সেসময় সব কাজ করতেন চোখের আন্দাজে। অভিজ্ঞতার চোখ সে কথাই বলে দিত।

ঈশ্বরী পাটনির সেই “দুধেভাতে” র স্বপ্ন দেখতে দেখতে বাঙালী সে যুগে দেখেছিল মন্বন্তর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লাভজনক নীলচাষ। তখন ভাতের চিন্তা প্রকট হয়েছিল বৈকি। খাদ্য অন্তপ্রাণ কবি ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় তা প্রকট। তদানীন্তন রাণী ভিক্টোরিয়া কে সম্বোধন করে সেই দুশ্চিন্তার কথাই ফুটিয়েছিলেন তিনি।
“ভালো কার্যটি ধার্য করে যদি গো / এই রাজ্যটি করছে মা খাস ।
এসে এদেশে বসত কর, অন্নপূর্ণা মূর্তি ধর / অন্নদানে বাঁচাও রাজার প্রাণ ।
সব অন্নভূমি কর তুমি / তুলে নিয়ে নীলের চাষ,
কোথা মা পায়ে ধরি, হয়ে রাজ-রাজেশ্বরী / সন্তানেরে পূরাও অভিলাষ। ”

সাদাভাত বা রেস্তোরাঁর মহার্ঘ্য স্টিমড রাইসের প্রতি বাঙালীর আবেগ পলান্ন বা পরমান্ন অপেক্ষ কিছু কম নয়। ভোজনবিলাসী বাঙালী গোবিন্দভোগের ফুরফুরে ভাত দিয়ে মুড়িঘণ্ট, রামশাল চালের ভাতের সঙ্গে মাছের ঝোল, ঝিঙেশাল চালের ভাতের সঙ্গে নিরামিষ ডাল তরকারী, বাসমতী চালের সঙ্গে দই রুই বা চিংড়ি মালাইকারীর রসায়ন বোঝে। বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের পাকপ্রণালীর “অন্ন প্রকরণ” পরিচ্ছেদেও পীতবর্ণ, মিষ্ট অন্ন, পর্যুষিতান্ন, শাদা ঘৃতান্ন, সামান্য মিষ্ট অন্নপাক, জর্দা অন্ন, বাজরার অন্ন প্রাণালীর অজস্র নমুনা রয়েছে।

সবশেষে যে ভাতের কথা না বললে এই প্রবন্ধ অসমাপ্ত থেকে যাবে তা হল বাঙালীর প্রিয় খিচুড়ি। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ বলছে প্রাকৃত শব্দ ‘কিসর’ বা ‘কৃসরা’ থেকে ক্রমান্বয়ে খিচরি (রী/ড়ি/ড়ী) হয়ে আজকের অপভ্রংশ এই খিচুড়ি শব্দের বিবর্তন।

গ্রীক সম্রাট সেলুকাস ৩০৫ থেকে ৩০৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়ে ভারত আক্রমণের সময় “খিসরি” নামে একটা খাবারের উল্লেখ করেন যেটি চাল ও ডাল সহযোগে তৈরি খাবার। মরক্কো পরিব্রাজক ইবন বতুতা ১৩৫০ খ্রিঃ ভারতের থাকাকালীন খিচুড়ি জাতীয় খাবার দেখেছিলেন।

বৈদিক সাহিত্যে “ক্রসরন্ন” নামে যে শব্দটি পাওয়া যায় কিম্বা সংস্কৃতে ‘কৃশরান্ন ‘ বা ‘খিচ্চা’ নামের যে সুখাদ্যের কথা আছে তা মূলত তিল, মুগডাল আর চালে ঘৃতপক্ব অন্ন। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ অনুযায়ী চাল আর ডাল যেমন আলাদা খাওয়ার চল ছিল তেমনই চাল আর ডাল সমানুপাতে মিশিয়েও খাওয়া হত। চাণক্যের বর্ণনায় চন্দ্রগুপ্ত এর আমলে সুষম আহার খিচুড়ির বিবরণে রয়েছে এক প্রস্থ চাল, সিকি প্রস্থ ডাল, ১/৬২ প্রস্থ লবণ আর ১/১৬ প্রস্থ ঘি দিয়ে তৈরী খাবারের কথা।

বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের “পাকপ্রণালী”তে প্রায় সতেরো রকমের আর প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর ঠাকুরবাড়ির রান্না নিয়ে বিখ্যাত বইখানিতেও দেখি কুড়ি রকমের নিরামিষ খিচুড়ির কথা। সহজ পদ্যে তিনি লিখেছেন
“ডাল আর চালে খিচুড়ি বানায়। / খিচুড়ির স্বাদ পোলায়ে না পায়।/ খিচুড়ি বৈষ্ণব ও পোলাও শাক্ত। / নিরামিষ হিন্দু খিচুড়ির ভক্ত।”

প্রজ্ঞাসুন্দরীর কথায়
“সৈন্যের গুণে যেমন সেনাপতির খ্যাতি বর্ধিত হয়, সেইরূপ আনুষাঙ্গিক খাদ্যের গুণে প্রধান খাদ্য সমাধিক রুচিকর হইয়া ওঠে। খিচুড়ির এই আনুষাঙ্গিক খাদ্যের মধ্যে তখনও প্রধান হলো ইলিশ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ইলিশ ভাজা। গলা খিচুড়ি আর ভুনা খিচুড়ি উভয়েই বাঙালীর অন্যতম প্রিয়”

আলবেরুনী ভারততত্ত্বে যেমন খিচুড়ি প্রসঙ্গ এড়ায়নি তেমনি মনসামঙ্গলে আছে পার্বতীকে ডাবের জল দিয়ে মুগডালের খিচুড়ি রান্নার ফরমায়েশ করছেন শিব। ডাবের জল শিব পার্বতীর ধাম কৈলাসে না পাওয়া গেলেও মনসা মঙ্গলের রচয়িতা বিজয়গুপ্ত যেখানে জন্মেছিলেন অর্থাৎ বরিশাল সেখানে যে থিকথিক করছে নারকোল গাছ তাই ডাবের জলে খিচুড়ি রান্না সেদিক থেকে কিছু অমূলক নয়।

‘আদা কাসন্দা দিয়া করিবা খিচুড়ি’ এটিও মঙ্গলকাব্যের উক্তি।

ইলিশের সঙ্গতে বাঙালির খিচুড়ি নাহয় বর্ষাকালীন আবেগ। কিন্তু ইলিশের বিরহে বাকী ঋতু গুলিতে? পোরের ভাজা, লাবড়া, ছ্যাঁচড়া সহযোগেও দৌড়াতে থাকে বাঙালী হেঁশেলে।

সুকুমার রায় এই খিচুড়ির মাহাত্ম্য সেই কবেই বুঝেছিলেন। নয়ত ব্যাকরণ বহির্ভূত হাঁসজারু কিম্বা বকচ্ছপের জন্ম হয়? অর্থাৎ যেমন তেমন করে চালে আর ডালে বসিয়ে দিতে পারলেই তালেগোলে খিচুড়ি কিন্তু দাঁড়িয়ে যাবেই। এই যেমন আজ বাংলাভাষা খিচুড়িভাষায় পরিণত হচ্ছে কালে কালে। বাঙালীদের সবেতেই কথায় কথায় একটা খিচুড়ি পাকানোর অভ্যেস যেন গেল‌ই না, এমনটিও শুনে আসছি আমরা।

আভিধানিক অর্থ বলছে, ‘বৈসাদৃশ্যময় উপকরণে তৈরি মিশ্র খাদ্য।’ এমন হচপচ আইডিয়াই ছিল বুঝি খিচুড়ির জন্মলগ্নে। তা সে জগন্নাথদেবের দুর্লভ খিচুড়ি বা দ্বিপ্রাহরিক ভোগের খেচরান্ন। তার থেকেই বুঝি জগাখিচুড়ি শব্দটিরও জন্ম। অতএব দুয়ে দুয়ে চার করেই শেষ হল অন্নের অন্য স্বাদ কাহন।

তথ্যসূত্র:
খাবারের স্বাদকাহন – “শুভশ্রী” লিটল ম্যাগাজিন
বাঙালীর খাদ্যকোষ – মিলন দত্ত
পাকপ্রণালী – বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়
www.littlemag.org (ইতিহাসে ও সাহিত্যে বাঙালীর খাদ্যাভ্যাস এবং বাঙালী হেঁশেলে পর্তুগীজ প্রভাব – রাণা চক্রবর্তী)

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “rannaghar-swader-anna-kahon

  1. রীতিমত গবেষণাধর্মী লেখা। সেলাম তোমায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *