aparbangla-prabandho-19-se-may

উনিশে মে’র চেতনা : বরাক উপত্যকার বাংলা কাব্য

বিশ্বতোষ চৌধুরী

ভূমিকার পরিবর্তে –
“কাছাড়ের সাম্প্রতিক ইতিহাস জানতে চেয়েছ বন্ধু, শোনো
একাদশ শহীদের রক্তরাঙা মাতৃভাষা আসে নি এখনো
কূটচক্রী ভেদনীতি হিংসাঘন জিঘাংসায় মেলিয়াছে পাখা…”

১৯৬১র ১৯ মে শিলচর রেলস্টেশনে মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে বন্দুকের নলের সামনে এগারোটি যৌবন তাদের বুক পেতে দিয়েছিল। রক্তস্নাত শিলচরের খবর জানাতে কবি শক্তিপদ ব্রহ্মাচারী তাঁর ‘বন্ধু চিন্তাহরণ দাশকে’ উল্লিখিত কবিতাটি লিখেছিলেন। পত্রাকারে লিখিত এই কবিতাটি আজ পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আঞ্চলিকতাবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ ছাড়াও জাতি, ধর্ম, ভাষা ও বর্ণভিত্তিক বিভেদ সৃষ্টির প্রবণতা এখন পর্যন্ত বরাক উপত্যকার (পূর্বতন কাছাড়) মেলবন্ধনের ভিত্তিভূমিকে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। রক্তক্ষরা উনিশে মে’র বয়স আজ পঁয়ত্রিশ বছর। একষট্টির পর প্রতিটি দশকে রাষ্ট্রশক্তি তথাকথিত গণতন্ত্রের মুখোশ পরে এ উপত্যকার মানুষের ‘মুখের ভাষা বুকের রুধিরে’ কালো হাতের থাবা বসিয়েছে। কিন্তু বারবারই জাগ্রত জনশক্তির নিকট রাষ্ট্রশক্তি পরাস্ত হয়েছে। আসাম সরকার মেনে নিয়েছে বরাক উপত্যকার সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতির মৌলিক অধিকার। নির্দিষ্টকালের জন্যে পেয়েছি আমরা সরকারী স্বীকৃতি। ভাষা আইনও সংশোধিত হয়েছে। তথাপি শহীদের রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্র্য অধিকার আজও বরাক উপত্যকার মানুষের করায়ত্ত নয়। বরং সরকারী কূটনীতি বিভেদ সৃষ্টি করে স-হিংস জিঘাংসার ডালপালা বিস্তার করেছে। রক্তরাঙা মাতৃভাষা পরিপূর্ণভাবে আসেনি এখনও।

প্রেক্ষাপট

প্রসঙ্গ বিস্তার করা প্রয়োজন।
১৯৬০ সাল। দিল্লিতে তখন জহরলাল নেহেরু। আসামে বিমলাপ্রসাদ চালিহা। কংগ্রেস সরকার। আসাম প্রদেশ কংগ্রেসের সভায় অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যভাষা করার প্রস্তাব নেওয়া হল। মুখ্যমন্ত্রী চালিহা বিধানসভায় এই ব্যাপারে বিল আনবেন বলে ঘোষণা করলেন। উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি ভাষার নামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে দিল সমগ্র আসামে। বলাবাহুল্য, ১৯৫১ এবং ১৯৫৫ সালেও অসমীয়া সম্প্রসারণবাদীদের নখরাঘাতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নীলাকাশ কলুষিত হয়ে উঠেছিল। এরই ফলশ্রুতি রাজ্যভাষা অসমীয়া করার প্রস্তাব।
বরাক উপত্যকার প্রধান শহর শিলচরে ‘নিখিল আসাম বাংলা ও অন্যান্য অনসমীয়া ভাষা সন্মেলনে’ বাঙালি ও অনসমীয়া ভাষাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা ভাষার প্রশ্নে স্থিতাবস্থাকে সমর্থন করলেন তথাপি ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর ‘রাজ্যভাষাবিল’ পাশ হয়ে গেল আসাম বিধানসভায়। আসামের সরকারী ভাষা হল অসমীয়া কিন্তু কাছাড়ের (অধুনা বরাক উপত্যকা) জন্যে জেলা স্তরে রইল বাংলা ভাষা।
কাছাড় জেলার প্রতি মানুষ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। ‘কাছাড় জেলা জন সন্মেলন’ এবার ‘বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম রাজ্যভাষা’ রূপে স্বীকৃতির দাবিতে শুরু হল আন্দোলন। সমগ্র বরাক উপত্যকার যুবশক্তি ‘জান দেবো না তবু জবান দেব না’ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল চারদিকে। কাছাড় জেলা সংগ্রাম পরিষদের তরুণ তরুণীরা সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করলেন। বরাক-কুশিয়ারা-ধলেশ্বরী নদী তীরের আকাশে বাতাসে ‘বাংলাভাষা জিন্দাবাদ’, ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’, ‘বিনে স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা’ – ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠল চারদিক। আবালবৃদ্ধবনিতা পথে বেরিয়ে এলেন মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা এবং রাজ্যের শিক্ষা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার স্বাভাবিক অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখার দাবিতে।
এলো ঐতিহাসিক ১৯ মে। সেদিন কাছাড়ের ত্রিশ লক্ষ মানুষের রাতের ঘুম যেন কেড়ে নিয়েছিল কেউ। সমগ্র উপত্যকা জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করল সরকার। শাসকগোষ্ঠী মদমত্ত হয়ে সন্ত্রাস জাগিয়ে তোলার ব্যর্থ চেষ্টায় মিলিটারী দিয়ে সমর ক্ষেত্র রচনা করল। বরাকের মানুষ তাতেও পিছপা হলেন না এতটুকু। ভোর থেকে শিলচর-করিমগঞ্জ-হাইলাকান্দি শহর তথা গ্রাম-গঞ্জের হাজার হাজার মানুষ ট্রেনের চাকা বন্ধ করে দিলেন, বিমানের পাখা নড়ল না, স্কুল-কলেজ বন্ধ রইল, অফিস আদালতের তালা খুলল না। রেল লাইনের উপর শুয়ে পড়লেন তরুণতরুণীরা। সত্যাগ্রহীদের উপর তখন পুলিশের বুটের আঘাত, টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ার কুন্ডলী আর বেধড়ক লাঠির ঘায়ে রক্তাক্ত হয়ে উঠল বরাক-কুশিয়ারা-ধলেশ্বরীর মাটি। তবুও আন্দোলনকারীরা অটল অনড় হয়ে পড়ে রইলেন। জেলে তখন আর জায়গা হচ্ছে না, গ্রাম-শহরের হাসপাতালে ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই– বরাক উপত্যকার মানুষের সংগ্রামী চেতনার কাছে পরাস্ত হয়ে শাসকগোষ্ঠীর পুলিশ বাহিনী আরো মরিয়া হয়ে উঠেছে। মধ্য আকাশের সূর্য তখন কিছু পশ্চিমের পথে পা বাড়িয়েছে– দুপুর দুটো বেজে দশ। মধ্য আকাশের সূর্য তখন কিছু পশ্চিমের পথে পা বাড়িয়েছে– দুপুর দুটো বেজে দশ, পর পর গুলির শব্দে কেঁপে উঠল শিলচর রেলস্টেশনের চারদিক। বৃষ্টির মত ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বেরিয়ে এলো বন্দুকের নল থেকে। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকল ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’, ‘বাংলাভাষা জিন্দাবাদ’। রক্তের বন্যায় ভেসে গেল শিলচরের রেল প্ল্যাটফর্ম। এগারোটি তাজা প্রাণ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। স্বাধীন ভারতবর্ষে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে সংগ্রাম করে শহীদ হতে হল দশটি যুবক ও একটি যুবতীর– এর চেয়ে লজ্জার, এর চেয়ে কলঙ্কের ইতিহাস আর কী হতে পারে। বিড়ম্বিত মানুষ মৃত্যুর বধিরতায় আঁতকে ওঠে,

‘আমার নিজস্ব কুশপুত্তলিকা আমি আজ
নিজেই পোড়াব’
(ডেটলাইন আসাম ১৯৮৩ : তপোধীর ভট্টাচার্য)
এরপরও দীর্ঘ তিন দশক ধরে এই আন্দোলন বরাক উপত্যকার শহরে ও গ্রামে নানা সময়ে নানাভাবে উদ্বেল হয়ে উঠেছে। ১৯৭২ এ বাচ্চু চক্রবর্তী এবং ১৯৮৬ তে জগন্ময় ও দিব্যেন্দু আন্দোলনের প্রবহমান ধারার মধ্যেই আত্মোৎসর্গ করেছেন।

বরাক উপত্যকার আত্মপরিচয় : কেন বাংলা?

বরাক উপত্যকায় বাঙালি বসতির ইতিহাস সুপ্রাচীন। ‘দেশভাগ ও স্বাধীনতার আগে যে অঞ্চলটি সুরমা উপত্যকা নামে পরিচিত ছিল, সেই অঞ্চলের একটি অংশের বর্তমান ভৌগোলিক নাম বরাক উপত্যকা। ভারতের ঈশান কোণে বাংলাদেশ সংলগ্ন আসাম রাজ্যের এই ভূখন্ড বর্তমানে তিনটি জেলায় বিভক্ত। বরাক উপত্যকা বলতে বর্তমানে কাছাড়, কারিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি – আসামের এই তিনটি জেলার সমষ্টিকেই বোঝায়।
বরাক নদীর দুটি প্রধান শাখা সুরমা ও কুশিয়ারা। দেশ ভাগের পূর্ব পর্যন্ত সুরমা তীরবর্তী শ্রীহট্ট ছিল এই অববাহিকার বৃহত্তম শহর এবং সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চার প্রধান কেন্দ্র। সম্ভবত এজন্যেই শ্রীহট্টের ধাত্রী নদী সুরমার নামে, বরাক ও তার শাখানদীগুলির বিস্তীর্ণ অববাহিকারই জনপ্রিয় নাম ছিল সুরমা উপত্যকা। বাঙালি জীবন গঠনে নদীমাতৃক বঙ্গভূমির অন্তর্গত অন্যান্য নদীর মতো বরাকের ভূমিকাও বিশিষ্ট। মূলত ব্রহ্মপুত্র ও বরাক, এই দুই নদী উপত্যকার সমষ্টিকে নিয়েই বর্তমান আসাম বা অসম।’
‘ভৌগোলিক কারণেই অতি প্রাচীন কালে ভারত-আর্যগোষ্ঠীর লোকেরা ইতিহাসের বিশ্বব্যাপী চিরন্তনধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতিবেশী বঙ্গদেশ হতে ছড়িয়ে পড়েছিলেন এই বরাক-সুরমা উপত্যকায়। এই উপত্যকায় বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির ভিত গড়ে উঠেছিল একই সুবাদে। মধ্যযুগে করিমগঞ্জসহ এই উপত্যকার বিস্তীর্ণ অংশে তুর্কী ও মোঘল শাসকেরা স্থানীয় শাসনকার্যে বাংলার ব্যবহার অব্যাহত রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে কাছাড়ের ডিমাসা রাজত্বকালে রাজপরিবার এই উপত্যকার মূল বাঙালী সংস্কৃতির বহমান স্রোতের শরিক হয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। পণ্ডিতেরা সংস্কৃত কাব্যের বাংলা অনুবাদ করেছেন রাজ-আনুকূল্যে। বলাবাহুল্য, সুপ্রাচীন অতীতকাল থেকে প্রবহমান বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার এই ধারা বিংশ শতাব্দীতে এসে অসংখ্য শাখাপ্রশাখায় পত্র-পুষ্পে পল্লবিত।

বরাক উপত্যকার কাব্য : উনিশের চেতনা

প্রায় তেত্রিশ লক্ষ লোকের বাসভূমি এই উপত্যকার অধিকাংশই বাঙালি। সর্বশেষ সেন্সাস অনুসারে বরাক উপত্যকার জনসংখ্যার শতকরা আশি ভাগ বঙ্গভাষী। এ ছাড়া রয়েছেন মনিপুরী, ডিমাসা, বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী, নেপালি, মিজো ইত্যাদি। ‘রাষ্ট্রনৈতিক বিচারে এই উপত্যকা আসামের, কিন্তু সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে তা বাংলার। অর্থাৎ আবহমানকালের বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গেই এর নাড়ীর সম্বন্ধ, প্রাণের সংযোগ। বাঙালির জীবনধারা ও সাহিত্য, যে পতন অভ্যুদয়ের পথে সহস্রাধিক বছর ধরে প্রবাহিত, বরাকের বাঙালিও সেই পথের পথিক।…
বরাক উপত্যকা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাষা-সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হয়েও আসলে আসামের অন্তর্ভুক্ত হবার কারণ রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক। এই অন্তর্ভুক্তি, সকল জাতি উপজাতির কাছে তখনই সুখকর হতো, যদি সমস্ত ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি সমান মর্যাদা প্রদর্শনের ঐতিহ্যময় ধারাটি অক্ষুণ্ণ থাকত।’ তা নয় বলেই এখানে মুখের ভাষার সম্মান রক্ষার জন্য বুকের রুধির ঢেলে দিতে হয়। শোকস্তব্ধ কবি অনুভব করেন,
আমার লেখনী স্তব্ধ
তার ভাষা কেড়ে নিয়ে গেছে
ছায়াচ্ছন্ন অবাক শিলচর
সব শান্তি ছায়া তার মুছে দিয়ে গেল
হিংসার কুটিল এক দারুণ আঘাত।
(অবাক শিলচর : অনুরূপা বিশ্বাস)
অনুভূতিপ্রবণ কবিরা এই ভাষা আন্দোলনের দ্বারা আলোড়িত, বিক্ষুব্ধ ও প্রভাবিত হয়েছেন। পঞ্চাশ-ষাট দশকের কবিরা তো বটেই, সত্তর আশির দশকের অনেক তরুণ কবির কাব্যে ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও বৈশিষ্ট্যের ছাপ বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। উনিশে মে, তাই
আমার চেতনায় তুমি সাগর সেনের রবীন্দ্রসঙ্গীত
কণ্ঠে ফিরোজা বেগমের নজরুল
আমার ভুবনে তুমি অঘ্রাণের প্রলম্বিত শীত
‘সুদাসমালীর ঘরে কাননের সরোবরে’
ফোটা পদ্মফুল।
… … …
তুমিই আমার মে-মাসের কৃষ্ণচূড়া
ফেব্রুয়ারির ঝড়
তুমিই আমার অগ্নিবীণার তার গিঁটছেড়া
ঈশান খুঁটির ঘর
… … …
তুমিই আমার উনিশ-একুশ, জন্মের পরিচয়
শত কোলাহলেও তোমাকে কখনো ভুলবার নয়।
(১৯শে মে : বিজয়কুমার ভট্টাচার্য)
আমাদের পাশেই বাংলাদেশ, আমাদের পূর্বতন নিবাস। তারও ভাষা সংগ্রামের রক্তাক্ত এক ইতিহাস আছে। সালাম-বরকত-রফিকরা তাঁদের প্রাণের বিনিময়ে মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষা করেছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দুকে চাপিয়ে দেবার নামে যে সর্বনাশা শক্তি তৎপর হয়ে উঠেছিল তা প্রতিহত করতে বাংলাদেশের সম্মিলিত জনশক্তি সংঘবদ্ধ হয়ে সংগ্রামে নেমেছিল। সেই সংগ্রামী সেনানায়করা তাদের মাতৃভাষা বাংলার জয়ধ্বজা উড়িয়ে স্বাধীনতা পেয়েছে। জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের। ‘একুশে ফেব্রুয়ারী তাই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে প্রগতির লড়াইয়ের দ্যোতক। ধর্মের পরিচয়ে বিভক্ত বাঙালী জাতিসত্তার ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে জাতিগত পরিচয়ে উত্তরণের দিক নির্দেশ।’
বরাকের ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস বা সংবাদটুকু আসামের বাঙালি ছাড়া অন্য রাজ্যের অধিকাংশ বাঙালিরাই জানেন না। তারা শুধু জানেন ২১শে ফেব্রুয়ারী। এ বড় আক্ষেপের বিষয়। কিন্তু বরাক উপত্যকাবাসীর নিকট ওপার বাংলার একুশে ফেব্রুয়ারী (১৯৫২) অপেক্ষা, এপারের ঊনিশের মে’র গৌরব কোন অংশেই কম নয়। চেতনার মানদণ্ডে বরাকের নিকট ঊনিশ-একুশ সমার্থক।
হাজারটা দিন, হাজারটা রাত, বাঁচতে বাঁচতে মরে গেলাম
নিজের সুখের এবং দুখের, সপ্তকাহন গেয়ে গেলাম
তোমরা যারা বুক পেতেছ, হাড় দিয়েছ বজ্র গড়ার
একুশ আমার, উনিশ আমার, আজকে সেলাম, আজকে সেলাম
( ঊনিশ আমার একুশ আমার : স্বর্ণালী বিশ্বাস)
‘এখানকার বাঙালী যে স্থানগত ও রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও, ঘরে বাইরে সর্বত্র নিজেদের ভাষা-শিল্প-সংস্কৃতির গৌরব বৃদ্ধি করে চলেছেন, ইতিহাসে এ দৃষ্টান্ত বিরল। শুধু মুখের ভাষায় নয়, বুকের অনুভূতি দিয়েই বরাকের বাঙালী বিশ্বাস করে ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি! বাংলাভাষা।’ আশির দশকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ‘বঙাল খেদা’ আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত কবিতায় তাই কবি যেমন প্রতিস্পর্ধী, মাতৃভাষার গৌরবে তেমনি স্ফীতবক্ষ –
সাতটি ভাই চম্পা, আর একটি পারুল বোন
কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল; এই যে ঈশান কোন
কোন ভাষাতে হাসি কাঁদি, কান পেতে তা শোন
শুনলি না? ঐ কুচক্রীদের ছা’
তিরিশ লাখের কণ্ঠভেদী আওয়াজ শুনে যা
বাংলা আমার মাতৃভাষা; ঈশান বাংলা মা!
(ঈশান বাংলা : শক্তিপদ ব্রহ্মচারী)

সময়ের চিহ্ন ফুটিয়ে তুলতে বরাক উপত্যকার বাংলা সাহিত্যে উনিশের চেতনায় পঞ্চাশ ষাট-সত্তর-আশির দশকের কবিদের কাব্য বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা গেল। তবে এ কথা অবশ্যই বলা প্রয়োজন পঞ্চাশ-ষাটের কবিতা প্রতিবাদী হয়েও মূলত ‘ইঙ্গিতধর্মী’ আর সত্তর-আশি ‘বিবৃতিধর্মী’। পঞ্চাশ-ষাটের সুর পঞ্চমে বাঁধা, আর সত্তর-আশি তার সপ্তকে।
উনিশ আমার চেতনার আকাশে
ঊষার সূর্য লাল।
উনিশ আমার ভায়ের চিতা
বোনের শশুরাল।
উনিশ আমার সন্তান হারানো
মায়ের অশ্রুজল
উনিশ আমার বুকের ব্যথা
শোকের তাজমহল।
… … …
উনিশ আমার ভাষা দিয়েছে
দিয়েছে আমার প্রাণ
উনিশ আমার অমর শহীদের
আত্মবলিদান।
উনিশ এখন মাঠে রাখালের
মন মোহনীয়া বাঁশি
উনিশ এখন শিশুর মুখের
প্রাণ জাগানো হাসি
… … …
বর্ণমালার বিজয়ী ধ্বজা
উনিশ এনে দিলে
উনিশ তোমায় ভুলিতে পারি কি
ওগো উনিশে মে।
(উনিশ আমার উনিশ : জালালউদ্দিন লস্কর)

মাতৃভাষা বাংলাকে গভীরভাবে ভালবাসার মধ্য দিয়েই এই উপত্যকার কবিরা একটি বৃহত্তর মেলবন্ধনের চেষ্টা করেছেন। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ও উদার মানবতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সমস্ত জাতি উপজাতি ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষাবিকাশে দু’হাতে বাড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। ভারতের ঐক্যমূলক ধারাটির শুধুমাত্র ভাবাত্মক সহযোগী নন, সমস্ত ভাষা সংস্কৃতির স্বকীয়তা রক্ষা করে বাস্তব ঐক্যভূমির অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন। আর এ জন্যে বরাক উপত্যকার কবিদের পক্ষে বলা সম্ভব –
বাংলা আমার ‘আই’ ভাষা গো
বিশ্ব আমার ঠাঁই
প্রফুল্ল ও ভৃগু আমার খুল্লতাত ভাই
(ঈশান বাংলা : শক্তিপদ ব্রহ্মচারী)
আশার কথা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অসমীয়া বিদ্বৎসমাজের বৃহত্তর অংশই ভাষা সংস্কৃতির আগ্রাসনবাদের বিরোধী। মৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্বের মধ্য দিয়েই সমগ্র আসামে উন্মুক্ত উদার সাহিত্য সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল রচিত হতে পারে। পরিপূর্ণ চিরস্থায়ী অধিকার অর্জনের আগে উনিশের ডাক অব্যাহত থাকবে। ততদিন পর্যন্ত ব্যাকুলতা, উৎকণ্ঠা ও জিজ্ঞাসা।
এতো জল কেন চোখে
বন্যার মত অকুল কান্না
উনিশে, তোমার বুকে।
(উনিশের ডাক : অনুরূপ বিশ্বাস)
তুমুল ঝড় এসে বারবার আমাদের দুলিয়ে দিয়ে গেছে বলেই ‘উনিশে, প্রলয় হাঁকে।’ বরাক উপত্যকার কাব্যে ও জীবনে উনিশে মে ও একুশে ফেব্রুয়ারী আমাদের মেরুদণ্ডকে টান টান রাখতে উদ্বুদ্ধ করে যায়। তাই পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের একুশে বরাক পারেরই উজ্জীবনের মন্ত্র হয়ে পড়ে। সংগ্রাম, স্বাধিকার ও স্বভূমির আরেক নাম উনিশ আর একুশ।
বুকের লোহু চোখের পানি কম ঝরালি না –
খড়ো চাল আর মাটির ঘরের বাঙালিনী মা
রইল পড়ে অশন-বসন, মাথার চুলে জট,
আয়না দিলুম কাঁকই দিলুম শয্যা ছেড়ে ওঠ!
দ্যাখ মা এবার দু’চোখ মেলে
(তোর) কামাল করা দামাল ছেলে
বিল-হাওরে গান জুড়েছে ভাসিয়ে দিয়ে না’,
(আমার) উড়াল পাখির মুখের বুলি বঙ্গভূমি মা।
(এক।। দুই।। বাহান্ন : শক্তিপদ ব্রহ্মচারী)
উনিশে মে’র পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আজও রচিত হয়নি, হয়ত বা এই কারনেই ভারতবর্ষের যেখানেই বাঙালিরা রয়েছেন তাদের নিকট উনিশে মে বার্তা গিয়ে পৌঁছয়নি। অনুসন্ধানী দৃষ্টি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় চোখ রেখে চলেছে। অদূর ভবিষ্যতে অনাদি অতীত উচ্চারণ করবে কলঙ্কিত অধ্যায়ের প্রতিটি শব্দ। ততদিন আমরা দৃঢ় থাকি এই প্রত্যয়ে :
যে ভাষায় মাকে প্রথম ভেবেছি, সে ভাষা আমার দেবতা।
কথা কইবার অধিকার তাতে, নেবই আমরা নেব তা
নেহেরু-ফারুক-চলিহার দল বলে, ‘বুলেট না বাংলা’
জান দেবো, তবু জবান না, করুক না যত হামলা।
(কমলা ভট্টাচার্যের মায়ের কান্না : মনীশ ঘটক)

1 thought on “aparbangla-prabandho-19-se-may

  1. “জান দেবো, তবু জবান না,করুক না যত হামলা’
    এই লাইনটা খুব বেশি মনে ধাক্কা দেয়,৬১-এর কবিতাগুলো পড়লেই গা শিহরিয়ে উঠে, সত্যিই তো এমনটা হয়েছিল ১৯-শে মে-র আন্দোলনে।অনেক ভালো লাগলো স্যার পাঠ করে। সাথে সাথে ‘অপার বাংলা’র সদস্যদেরকে ধন্যবাদ এইটা শেয়ার করার জন্য তাদের ওয়েবসাইটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *