স্মৃতিচারণ
পূরবী বসু
১৯৬৪ সাল। আমার জীবনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও বাঁক পরিবর্তনের বছর এটি। এই বছরেই আমার শিক্ষক শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল আমার। এ লেখা যাঁরা পড়বেন তাঁদের অনেকেরই জন্ম হয়তো ১৯৬৪ সালের পরে। তাঁদের কথা ভেবে ওই বছর আমাদের চারপাশে এবং জগৎজুড়ে উল্লেখযোগ্য কী ঘটেছিল তা সংক্ষেপে বর্ণনা করতে চাই এজন্যে যাতে ওই সময়টাকে কিছুটা হলেও ধরা যায়। ১৯৬৪ সালে দেশে চলছে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন। দীর্ঘ ছয় বছরে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এই সামরিকতন্ত্রে। এই সময় ১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকল পার্টিকে একত্রিত হয়ে একযোগে সামরিক শক্তিকে রুখে দাঁড়াতে বিপ্লবের জন্যে ডাক দিয়েছিলেন। পরিণামে তাকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে জেলে পাঠানো হয়। বছরের শুরুতেই কাশ্মীরের এক প্রাচীন দরগার এক চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকভারতের ইতিহাসে অন্যতম নিকৃষ্ট হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাঁধে ভারতে, ধারবাহিকতায় হিন্দু নিধন চলে পূর্ব বাংলায়। সত্যজিৎ রায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ‘চারুলতা’ (রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প নষ্টনীড় অবলম্বনে) মুক্তি পায় এই বছরে। সুভাষ দত্তের পরিচালনায় নতুন আঙ্গিকের ছবিতে কিশোরী কবরীর সতেজ আবির্ভাব ঘটে। সর্বকালের সেরা গানের দল বিলাতের ‘Beattles’ প্রথমবারের মত আমেরিকায় এসে গান করেন ও একটি রেকর্ড করেন এবং তাৎক্ষনিকভাবে আমেরিকা তো বটেই্, বিশ্ব জয় করে ফেলেন তাঁরা। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনে আমেরিকা তখন ক্ষতবিক্ষত। মাত্র কয়েক মাস আগেই প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে ডালাসে খুন করা হয়েছে। তাঁর অসমাপ্ত স্বপ্নের প্রকল্প বিখ্যাত Civil Liberty Act (ধর্ম, বর্ণ, জাতি, দৈশিক উৎস, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলে সর্বত্র সমঅধিকার ভোগ করবে) পাশ করেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন। এই জনসনই আবার ভিয়েতনাম যুদ্ধে আরো জোরালোভাবে আমেরিকাকে প্রোথিত করতে এবং ভিয়েতনামে প্রচুর আমেরিকান সৈন্য প্রেরণের বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেন। সেই বছরে পৃথিবীর নতুন হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন মোহম্মদ আলী তার জন্মগত নাম ক্লে ছেড়ে দিয়ে তার ইসলামিক নাম মোহম্মদ আলী গ্রহণ করেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যাবার জন্যে ড্রাফটেড হন আলী, কিন্তু যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করলে পরবর্তী পাঁচ বছর তাঁকে সরকারের সঙ্গে জটিল আইনী লড়াইতে কাটাতে হয়। ১৯৬৪ সালে ঢাকা টেলিভিশন স্টেশনের উদ্বোধন হয়। এই অঞ্চলে সেটাই প্রথম টেলিভিশন স্টেশন। এই বছর বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার পান শামসুদ্দিন আবুল কালাম (উপন্যাসে), শাহেদ আলী (ছোটগল্পে), সানাউল হক ও বেনজীর আহমেদ (কবিতায়)। ১৯৬৪ সালে আদমজি সাহিত্য পুরস্কার পান আহসান হাবীব।
আমরা জানতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য বাংলায় এমএ ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে হরগঙ্গা কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন শামসুজ্জামান খান স্যার। এই তরুণ সুশ্রী জামান স্যার হরগঙ্গায় পড়ালেও মুন্সীগঞ্জে বাস করতেন না। ঢাকা থেকে প্রতিদিন ভোরে লঞ্চে করে মুন্সীগঞ্জে এসে ক্লাস করে আবার বিকেলের লঞ্চে চেপে ঢাকা ফিরে যেতেন। চারদিকে জলে আবৃত বিচ্ছিন্ন দ্ব্বীপের মতো মুন্সীগঞ্জ মহকুমা শহর থেকে নদী পার না হয়ে কোথাও যাওয়া সম্ভব ছিল না। অন্য কোন ভূমিখন্ডের সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগের জন্যে কোন সেতু ছিল না তখন। প্রায় বছরেই, বিশেষ করে কালবৈশাখীতে, এক দুটো লঞ্চ ডুবতো ধলেশরী, শীতলক্ষা বা বুড়িগঙ্গায় মুন্সীগঞ্জে আসা-যাওয়ার পথে। চেনাঅচেনা বেশ কিছু মানুষ জলে ডুবে মারা যায়, মনে আছে আমার। তাদের সকলেই যে সাঁতার জানতো না সেটাও ঠিক নয়। গাদাগাদি করে বসা লঞ্চ থেকে বেরুতেই পারতো না অধিকাংশ লোক। যতবার এরকম লঞ্চ ডুবতো, প্রতিবার আমার বাবা বলতো, “এই তো ধলেশ্বরীর ওপরে শীঘ্রই সেতু হয়ে যাবে। তখন আর লঞ্চ বা জাহাজে নয়, গাড়ি কিংবা বাসে করে, একবারে না থেমে ঢাকা পৌঁছে যেতে পারব।” বাবার সেই স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে। তবে তা দেখে যাবার সুযোগ হয়নি আমার বাবার। তার অনেক আগেই বাবা মারা যায়।
শামসুজ্জামান স্যার ছাড়াও তখন হরগঙ্গায় বাংলা পড়াতেন আরো দুজন শিক্ষক, মোহসীন স্যার ও মজিদ স্যার। মোহসিন স্যারের বাড়ি মুন্সীগঞ্জেই। আমাদের মতো তাঁদের বাড়িতেও অনেকগুলো ভাইবোন। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে যথেষ্ট সখ্য ছিল। মজিদ স্যার চাকুরীসূত্রেই এসেছিলেন এই শহরে এবং পরিবার নিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকতেন কোর্টগাঁও এলাকায়। তাদের বাসাতেও দু’একবার গিয়েছি। তিনি ঢাকা বোর্ডের টেবুলেটর ছিলেন। তখন থেকে দু’বছর পরে এসএসসি পরীক্ষায় আমি ঢাকা বোর্ডের সব ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম, এই তথ্যটা তিনিই দিয়েছিলেন আমাকে ফল বেরিয়ে যাবার পরে। আমি তখন ঢাকায় পড়ি।
১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এমএ পরীক্ষা দিয়ে ফল বেরুবার আগেই হরগঙ্গায় পড়াতে ঢোকেন জামান (শামসুজ্জামান) স্যার। আর আমিও একই বছরে প্রায় একই সময় ছাত্রী হিসেবে প্রথম ভর্তি হই হরগঙ্গা কলেজে। ১৯৬৪ সালেই আমি এসএসসি পাশ করি। ম্যাট্রিক পরীক্ষার বদলে এসএসসি পাঠ্যক্রম চালু হবার দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র আমরা। আগের পদ্ধতি অর্থাৎ ম্যাট্রিক পরীক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, একই বছরে একই বোর্ড থেকে পাশ করা সকল ছাত্রছাত্রী বোর্ড নিয়ন্ত্রিত অভিন্ন পাঠ্যসূচি ও একই চূড়ান্ত পরীক্ষার উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে এসে ভর্তি হবার সময় ঠিক করতো আর্টস, সায়েন্স না কমার্সে ভর্তি হবে। কিন্তু এসএসসির পাঠ্যসূচিতে ইংরেজি, বাংলা, সাধারণ অঙ্কর মতো সর্বজনীন এবং সকলের জন্যে বাধ্যতামূলক বিষয়ে একই সিলেবাস ও পরীক্ষা সকল ছাত্রের জন্যে প্রযোজ্য হতো। কিন্তু হাই স্কুলের শুরুতেই অর্থাৎ ক্লাস নাইন থেকেই ছাত্ররা বিজ্ঞান (সায়েন্স), কলা (আর্টস বা Humanities) কিংবা কমার্সের যে কোন একটি বেছে নিতো এবং সেসব বিষয়েই তাদের পাঠ্যদান ও পরীক্ষা নেয়া হতো। আমাদের ক্লাসের অধিকাংশ ভাল ছাত্রী বিজ্ঞান শাখায় পড়তে গেলেও কেন জানি আমি হিউম্যানিটিজ-ই পড়েছি। আমার কাছে ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিদ্যা, অর্থনীতি বেশি লোভনীয় মনে হয়েছিল, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, অঙ্কের চাইতে।
১৯৬৪ সালটা আরম্ভই হয় আলাদারকমভাবে। জানুয়ারির শুরুতেই চারদিকে অমঙ্গলের ঘনঘটা। ভারতের কাশ্মীরের হযরত বাল দরগা থেকে পবিত্র কেশ চুরি হয়ে যাবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে উত্তপ্ত ও নৃশংস হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাঁধে সেখানে, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে উত্তপ্ত নগরী কলকাতায়। আর তারই অবধারিত জের হিসেবে আমাদের এই অঞ্চলে – পূর্ব বাংলায় তার ঢেউ ওঠে। মানে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে প্রচুর হিন্দুর জীবননাশ ঘটে। বিশেষ করে অবাঙালি মুসলমানের হাতে। আদমজী মিলের আশেপাশে কচুকাটা করা হয় বহু নির্দোষ মানুষকে। ১৯৬৪ সালে যেটা হয়েছিল আমার জীবনে দেখা এদেশের সমস্ত সাম্প্রদায়িক ঘটনার সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ ছিল সেটা। পাকিস্তান সরকারের পরোক্ষ মদত, বিশেষ করে এই হীন কাজে তাদের গণমাধ্যমের অবাধ ব্যবহার, প্রধানত রেডিও পাকিস্তানের উত্তেজনা ছড়ানো সংবাদ ও মন্তব্য পেশ, সাম্প্রদায়িক জুলুমের অন্যতম প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে উদার মুসলমান প্রতিবেশীর কাছ থেকে প্রতিরোধ এবং সাহায্যও এসেছিল প্রচুর। দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক মানিক মিয়া ১৬ জানুয়ারি পত্রিকা অফিসে সভা করে তার কাগজে বিশাল অক্ষরে হেডলাইন করেন ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ এবং এই শীর্ষক প্রচারণার মাধ্যমে হিন্দুদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগসহ অনেকেই তাতে সাড়া দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখে দাঁড়াও’ মর্মে বিবৃতি এবং দাঙ্গাবিরোধী মিছিলে নেতৃত্ব দেন। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে বহু হিন্দু পরিবারকে আশ্রয় দিয়ে ও খাদ্য সরবরাহ করে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। ঢাকার নবাবপুর এলাকায় বসবাসরত অনুবাদক আমীর হোসেন চৌধুরী যিনি বেগম রোকেয়ার ছোটবোন হোমায়রার একমাত্র পুত্র, প্রতিবেশী এক হিন্দু পরিবারকে সহিংস আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন।
আমি যতদূর দেখেছি, শুনেছি, পড়েছি, ’৪৭-এর দেশভাগের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে কখনো সেই রকম সাম্প্রদায়িক ‘দাঙ্গা’ হয়নি যেরকম হয় ভারতে। এখানে দুই ধর্মের উত্তেজিত জনতা পরস্পরকে খুন করতে এগিয়ে আসে না। মূলত ভারতের ধর্মীয় দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায়, কখনো অন্য কোন অছিলায় পূর্ববাংলা বা বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর যখন হামলা হয় (১৯৫০ ও ১৯৬৪ ব্যতিত) প্রাণসংহারের ঘটনা তেমন ঘটে না। তবে লুটতরাজ, অগ্নি সংযোগ, সম্পত্তি থেকে উৎখাত, মূর্তি বা দেবালয়ের ভাংচুর চলে, এবং বহুরকম দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এই অঞ্চলের হিন্দুরা সংখ্যায়, শক্তিতে, বিত্তে ও ক্ষমতায় এতোটাই দুর্বল যে তারা পালটা অস্ত্র ধরা দূরে থাক, নিজেদের রক্ষা করতে একটি লাঠি পর্যন্ত তুলে ধরতে অক্ষম। কোনরকম প্রতিরোধ গড়ে তোলে না তারা। প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসে না। কোনধরণের বাধা মৌখিক প্রতিবাদ পর্যন্ত করে না। কেবল জীবন নিয়ে পালাতে চেষ্টা করে। ফলে প্রকৃত অর্থে ‘দাঙ্গা’ হয় না এখানে। দুর্বলের ওপর সবলের একপেশে এবং প্রায়শ অঞ্চলভিত্তিক আক্রমণ আসে মাঝে মাঝে।
আমার বাবার বড় ভাইয়ের পরিবারের পাঁচজন (সকলেই নারী) সদস্য প্রাণ হারায় ১৯৬৪ এর সাম্প্রদায়িক হামলায়। বাকি যারা বেঁচে ছিল বাবার আদি বাড়িতে, মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে হাঁটা পথে মাত্র মাইল তিনেক দূরে, পঞ্চসার গ্রামে, আমার জ্যাঠামশাই ও তার পুত্রকন্যাসহ তারা নানা বয়সী, মোট সাত জন। জানুয়ারির শীত ও এরকম বিভৎস ও করুণ অভিজ্ঞতায় আতঙ্কিত এই সাতজন কাঁপতে কাঁপতে এসে মুন্সিগঞ্জে শহরে আমার বাবার ডাক্তারি প্র্যাক্টিস করে নিজের তৈরি করা ছোট্ট বাড়িতে (যে বাড়িতে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা, যেখানে আমরা তখন বাস করি) আশ্রয়গ্রহণ করে। ফলে আমাদের বাসায় সেইসময় তিল ধারণের জায়গা নেই। বাড়িতে কিছুক্ষণ পর পর কেউ না কেউ শোকে কাতর হয়ে মৃত আত্মীয়ের নাম ধরে উচ্চস্বরে বিলাপ করতে শুরু করে। সেবার জানুয়ারিতে শীতও পড়েছিল বটে। এই প্রবল শীতে সকলের জন্যে শীত বস্ত্র ও লেপকাঁথা যোগাড় করতে মা বাবা ঠাকুমার প্রাণান্তকর অবস্থা। এরই মাঝে বাবার এক ভক্ত (তাদের বাড়ির চিকিৎসক ছিল বাবা) মুন্সীগঞ্জের মহিউদ্দিন ভাই (মহিউদ্দিনা আহমেদ যিনি খুব ভালো সাঁতারু ছিলেন এবং মিঃ মুন্সীগঞ্জ নামে পরিচিত ছিলেন শহরে; পরবর্তীকালে যিনি আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর প্রধান দেহরক্ষী হন) যিনি বাবাকে কেবল ডাক্তার বলেই নয়, অন্য কোন কারণেও খুব মানতেন, মাঝে মঝে রাতে এসে উঁচু ভরাট কন্ঠে ডাক দিতেন বাইরে থেকে, “ডাক্তারবাবু, জাগা?” বাবার ঘুম খুব পাতলা, জেগে না থাকলেও জেগে যেতো কথা শুনে। বাবা সজাগ শুনলেই মহিউদ্দিন ভাই বলতে শুরু করতেন, “আরাম কইরা ঘুমান ডাক্তারবাবু। এখানে আমি বইস্যা আছি, কোন চিন্তা নাই আপনাদের। ঘুমান।” একথা বলে আমাদের পাকা ভিটার ওপর ঢেউ টিনের চৌচালা ঘরের প্রশ্বস্ত পিড়ায় এসে বসে থাকতেন মহিউদ্দিন ভাই। কতক্ষণ, কে জানে? সকালে উঠে কেউ কখনো তাঁকে দেখতে পায়নি। এরকম এক বিশেষ জরুরী ও ভয়ার্ত পরিস্থিতিতে, বর্ধিত পরিবারের একগাদা আত্মীয়স্বজন নিয়ে গিজ গিজ করে বাস করতে করতে এসএসসি পরীক্ষার জন্যে তৈরি হতে থাকি আমি। এমন অবস্থায় সকলে ভেবেছিল, এমনকি আমিও, যে একটা বা দুটা লেটারসহ ফার্স্ট ডিভিশন পাবো বলে যে আশা ছিল আমার, পরিবারের বা শিক্ষকদের, তা বুঝি আর হলো না। কিন্তু ফল বেরুলে সকলকে অবাক করে দিয়ে ঢাকা বোর্ডের (তখন পূর্ববাংলায় ৪টি শিক্ষা বোর্ড ছিল) কম্বাইন্ড মেরিট লিস্টে আমি মেয়েদের মধ্যে প্রথম ও ছেলেমেয়েদের ভেতর চতুর্থ স্ট্যান্ড করে ফেলি। বাড়ির সকলে মিলে উত্তেজিত হয়ে লক্ষ্য করি, শুধু রোল নম্বর (৮৮৫) নয়, আমার ও আমার স্কুলের পুরো নামই ছাপা হয়ে গেছে সব দৈনিকে অন্য সব মেধাবী ছাত্রদের সঙ্গে যাঁরা প্রায় সকলেই হয় ক্যাডেট কলেজ অথবা ঢাকার কোন নামকরা স্কুলের ছাত্র।
বাবা বলল “হিউম্যানিটিজে যখন এতো ভালো করেছিস ওটাই পড় কলেজে। আর দুইটা স্কলারশিপ (ফার্স্ট গ্রেড জেনারেল মেরিট স্কলারশিপ মাসে ৩০ টাকা ও ট্যালেন্ট স্কিম স্কলারশিপ মাসে ৪৫ টাকা; মোট ৭৫ টাকা প্রতি মাসে) যেহেতু পাচ্ছিস্, ট্যুইশনও লাগবে না, ঢাকায় ইডেন বা হোলিক্রসে ভর্তি হলে তোর স্কলারশিপের টাকাতেই তুই ভালোভাবে চলতে পারবি। ফলে ঢাকার কোন ভালো কলেজে ভর্তি হয়ে যা যাতে এইচএসসিতেও অনুরূপ ভালো ফল করতে পারিস।” তখন প্রতিদিন তিন বেলা খাবার ও প্রতি বিকালে নাস্তাসহ মাসে মাত্র তিরিশ টাকা ছিল ইডেন হোস্টেলের খরচ, প্রতি মাসে প্রতি ছাত্রীর জন্যে। বাবা জানে, আমাদের পড়ালেখা করাতে গিয়ে বাবার ওপর অর্থনৈতিক প্রবল চাপের কথা ভেবে আমি সদা উদ্বিগ্ন থাকি। মুন্সীগঞ্জে যারাই ভালো ফল করে, মানে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করে, প্রায় সকলেই রাজধানীতে চলে যায় অপেক্ষাকৃত মানসম্পন্ন কলেজে পড়ার জন্যে। আমি অবশ্য তখন একরকম জেদ করেই বাবার প্রস্তাবমতো দুটির একটাও করলাম না। তবে বাবাকে বুঝিয়ে রাজি করালাম। হিউম্যানিটিজ ছেড়ে সায়েন্সে ভর্তি হলাম। আর কলেজ হিসাবে বেছে নিলাম, ইডেন-হোলিক্রস নয়, স্থানীয় হরগঙ্গা কলেজকে, বাড়িতে থেকে যেখানে পড়তে পারি।
তখন এই কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের পিতা আযিমুদ্দিন আহমেদ। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদও বাংলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এএ পাশ করে যোগ দিয়েছিলেন হরগঙ্গায়। আমার দিদিরা পড়েছে তাঁর কাছে। কিন্তু কিছুদিন পরেই, অর্থাৎ আমি কলেজে ঢোকার আগেই তিনি ঢাকা চলে যান- সেখানেই শিক্ষকতা করেন বরাবর। কিন্তু তার অনুজ আব্দুল্লাহ্ আল মামুন তখনো আমাদের অতি প্রিয় কেমিস্ট্রির শিক্ষক হরগঙ্গায়। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগের বছরেই মাস্টার্স করেছিলেন। আর তাঁদের আরেক ভাই আব্দুল্লাহ্ আল্ মনসুর (পরে টেলিভিশনের জনপ্রিয় স্টার আল মনসুর ওরফে বেলাল) ছিল হরগঙ্গায় এইচএসসিতে আমারই সহপাঠী। শামসুজ্জামান স্যারের লোকসাহিত্যের ওপর বিশেষ আকর্ষণ ও মধ্যযুগের গীতিকবিতার প্রতি গভীর অনুরাগ আমাদেরও সম্মোহিত করেছিল। তিনি আমাদের লোকসাহিত্যের মহিমা বর্ণনা করতে করতে মাঝে মাঝে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তেন।
হরগঙ্গা কলেজের মঞ্চে কখনো কখনো নাটক হতো। শামসুজ্জামান স্যারের উৎসাহে সেবার মঞ্চস্থ হলো হরগঙ্গার সেই সময়ের প্রিন্সিপাল ও নাট্যকার আযিমুদ্দিন আহমদের লেখা ‘মহুয়া’ নাটকটি। মধ্যযুগের সেই বেদে মেয়ে মহুয়া আর ব্রাহ্মণপুত্র নদের চাঁদের অসম, অক্ষম ও দুর্বার প্রেমের আলেখ্য। নদের চাঁদ হয়েছিল আমাদের কলেজের বিএ ক্লাসের ছাত্র তখনকার দিনের মুন্সীগঞ্জে শহরের সবচাইতে ভালো অভিনেতা মোতাহার হোসেন। শ্যামলা, লম্বা, নির্মেদ মোতাহার ভাই সত্যি খুব আকর্ষণীয় দেহসৈষ্ঠবের অধিকারী ছিলেন। তাঁকে কলেজের বারাব্দায় দেখতে পেলে অনর্থক আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম। যদি ডেকে একটু কথা বলেন। তাদের বাসা ছিল আমাদের পাড়াতেই, বেশ কয়েকটা বাড়ি পরে। হাসি আপা-মঞ্জু আপা-আনিস ভাইদের বাড়ির উল্টোদিকে মাঠের ধারে। যেহেতু তখন ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে মঞ্চে নাটক করতে দেবার রেয়াজ ছিল না, মহুয়ার ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য ঢাকা থেকে একজন প্রফেশনাল অভিনেত্রী আনা হয়েছিল। মনে পড়ে, সেই নাটক দেখার জন্যে স্যার সে রাতে মুন্সীগঞ্জে ছিলেন, কেননা নাটক শেষ হবার আগেই লঞ্চঘাট থেকে ঢাকা বা নারায়নগঞ্জগামী শেষ লঞ্চ চলে যায়।
সেই সময় মফস্বলের কলেজগুলোর ভেতর হরগঙ্গা কলেজের ছাত্রাবাসের খুব সুনাম ছিল। বহুতল বিশিষ্ট এত বড় ও বহুমুখী সুযোগসুবিধাসহ কলেজ সংলগ্ন হোস্টেল বেশি কলেজের ছিল না, বিশেষ করে ঢাকার বাইরে-মফস্বলে। ছাত্রদের নিবাস ছাড়াও যেসব শিক্ষক তাঁদের পরিবার নিয়ে না এসে একাই পড়াতে আসতেন হরগঙ্গায়, অথবা তখনো বিবাহ-সংসার শুরু করেননি, সেই সব শিক্ষকদের জন্যেও আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো নিবাস ছিল ক্যাম্পাসের ভেতরেই। অন্য দিকে, পুকুর পাড়ে। সেই শিক্ষকদের নিবাসে মুন্সীগঞ্জের বাইরে থেকে আসা অনেক শিক্ষকই থাকতেন। কিন্তু শামসুজ্জামান স্যার কখনো থাকেননি সেখানে। গ্রীষ্ম-বর্ষা নির্বিশেষে রোজ ফিরে যেতেন ঢাকা যদিও তখন পর্যন্ত তিনি অবিবাহিতই ছিলেন। কিন্তু ‘মহুয়া’ নাটকটি দেখে সেই রাতে মুন্সীগঞ্জের কলেজের শিক্ষক আবাসনে থাকতে হয়েছিল তাঁকে।
শামসুজ্জামান স্যার শুধু আমাদের পাঠ্যবই থেকে গল্প-কবিতা-প্রবন্ধই পড়াতেন না, তিনি ঢাকা থেকে মজাদার ও তাজা সাহিত্য সংবাদ নিয়ে আসতেন আমাদের জন্যে। কোন লেখকের কী নতুন উপন্যাস বেরুলো, কোন কবি দারুণ এক কবিতা লিখেছেন, কোথায় কোন লিটল ম্যাগাজিন বের করছে কারা ইত্যাদি। উপন্যাসে তাঁর বিচারে শামসুদ্দিন আবুল কালামের বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়া উচিত। তিনি যখন আমাদের একথা বলেছিলেন তার কয়েক মাস পরেই ফেব্রুয়ারিতে শামসুদ্দিন আবুল কালাম উপন্যাসে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর বিবেচনা ও বিচক্ষনতায় মুগ্ধ হই আমরা। মনে পড়ে ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে আদমজি পুরস্কারের সংবাদও কাগজে ছাপার একদিন আগেই তাঁর মুখে প্রথম শুনেছিলাম আমরা। সেবার আদমজি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন আহসান হাবিব।
ইতোমধ্যে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে ঢাকার কোন সাহিত্য সঙ্ঘের আহবানে অনূর্ধ্ব আঠারো বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের ছোটগল্প লেখার প্রতিযোগিতায় আমি চুপি চুপি একটি গল্প পাঠিয়েছিলাম পোস্ট অফিসের মাধ্যমে। কেবল সাদা ফুলস্কেপ কাগজের (রুলটানা নয়) এক দিকে স্বহস্তে লিখিত গল্প পাঠাতে হবে। অনূর্ধ্ব শব্দসংখ্যাও উল্লেখিত ছিল মনে হয়। ততদিনে বিভিন্ন দৈনিক কাগজের বিশেষ শিশুপাতায় (সপ্তাহে একদিন) যেমন কচিকাঁচার আসর, খেলাঘর, সাত ভাই চম্পায় আমার গল্প, কবিতা অথবা চাইনিজ কালিতে আঁকা প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত চিত্র ছাপা হছে এক দু’টি করে। কিন্তু কোন গল্প প্রতিযোগিতায় সেই প্রথম অংশগ্রহণ আমার। দুই বছর আগে ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আহুত বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ(দঃ) এর জীবনীর ওপর রচনা লিখে এবং ডাকযোগে তা পাঠিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে পঞ্চাশ টাকা পুরস্কার পেয়েছিলাম। মনে আছে, একটি পোস্টকার্ডে আলিয়া মাদ্রাসা থেকে চিঠি পেয়ে আমি ও বাবা নিজেরা গিয়েছিলাম পুরস্কারের টাকা আনতে বক্সিবাজারের কাছে আলিয়া মাদ্রাসায়। দুইজনে মিলে লঞ্চে-বাসে-রিক্সা করে নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকা গিয়ে আবার মুন্সীগঞ্জে ফিরে আসতে, পথে খাওয়া চা-নাস্তাসহ, পঞ্চাশ টাকার এক তৃতীয়াংশ মাত্র খরচ হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, প্রতিযোগিতায় আমার এই গল্প পাঠাবার কথা এবারে আমি ছাড়া কেউ জানবে না। বাবাকে আমি সাধারণত সব বলি। কিন্তু আমি জানি তাঁকে বললে বাবা আশা করে থাকবে আমার গল্প বাছাইকালে গৃহিত হবে। তাকে প্রত্যাশাভঙ্গের কষ্টটা দিতে চাইনি বলেই কাউকে কিছু বলিনি। হঠাৎ একদিন ক্লাসে এসে জামান স্যার রোল কল করার পর ঘোষণা দেবার ভঙ্গিতে বললেন, অমুক (প্রতিষ্ঠানটি তেমন নাম করা কিছু নয়; নামটা ভুলে গিয়েছি) সাহিত্য প্রতিযোগিতায় পুরবী বসুর গল্প ‘সূর্যের ওপারে’ নির্বাচকমন্ডলীর সর্বসম্মতিক্রমে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। আর প্রথম হয়েছে চট্টগ্রামের পরাগ চৌধুরীর গল্প। তৃতীয় স্থান অধিকারীর নামও বলেছিলেন স্যার। এখন আর মনে পড়ছে না। পরাগ চৌধুরী নামটি এবং তার লেখার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম আমি কেননা সেও খেলাঘর, কচিকাঁচার আসরে নিয়মিত লিখতো। কিন্তু কেন জানি আমি সবসময়ে কল্পনা করতাম সে মেয়ে নয়। একটি ছেলে। শামসুজ্জামান স্যারই আমার ভুল ভাঙিয়ে দিলেন। পরাগ চৌধুরী আসলে প্রায় কৈশোর অতিক্রান্ত এক নারী। স্যারের প্রত্যক্ষ সংস্লিষ্টতা না থাকলেও গল্প প্রতিযোগিতা আহ্বান করা সংগঠনের অনেককেই তিনি জানতেন। আজই অ্যাওয়ার্ড নোটিশগুলো ডাকে পাঠানো হচ্ছে বিজয়ীদের কাছে। আগামী কাল কাগজে উঠবে। ফলে আমার জয়ী হবার কথা প্রকাশ করতে তাঁর বাধা নেই। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই তিনি ঘোষণাটি দিয়েছিলেন।
আমরা কলেজে ঢুকে বেশ কিছু প্রাচীন নিয়মের পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছি। এ কাজে আমার ও সুরাইয়ার সহযোগী ছিল মূলত আমাদের ক্লাসের তিনটি ছেলে- দুই মানিক ও বেলাল। যেমন কলেজের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে মামুন স্যার যে কেমিকেল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছেন সেখানে কার্যকরী পরিষদে কোন মেয়ে ছিল না, যদিও প্রতিটি বিজ্ঞান ক্লাসেই অল্প হলেও ছাত্রী ছিল। আমি প্রথম কেমিকেল সোসাইটির কার্যকরী পরিষদে যোগ দেই। একমাত্র নারী। কেমিকেল সোসাইটির অন্যতম সংগঠক হিসাবে অন্যদের সঙ্গে মুন্সীগঞ্জের আশেপাশে নানা ফ্যাক্টরী, যেমন সার কারখানা, লবনের কারখানা ঘুরে ঘুরে দেখেছি। একবার বেশ দূরে বড় ছইওয়ালা নৌকোয় করে এক আলুর গুদাম ও লবনের ফ্যাক্টরী দেখতে গিয়েছিলাম। একা মেয়ে হয়ে এতো দূর একগাদা ছেলে ও একজন তরুণ প্রফেসরের সঙ্গে যেতে যদি অস্বস্তি বোধ করি, মামুন স্যার নিজে থেকেই তাঁর মা ও ছোট বোনকে অর্থাৎ আমাদের কলেজের প্রিন্সিপালের স্ত্রী ও কন্যাকে আমাদের নৌকোয় তুলে নিয়েছিলেন। ১৯৬৪ এর আগে হরগঙ্গা কলেজের ছাত্র পরিষদের কোন নির্বাচনে কখনো কোন নারী অংশগ্রহণ করেনি। এবার ছাত্রলীগ থেকে ম্যাগাজিন সেক্রেটারির পদে মনোনয়ন দেয়া হলো কলেজের সবচাইতে জনপ্রিয় চৌকশ ছাত্র প্রিন্সিপাল-তনয়, কেমিস্ট্রি শিক্ষকের ছোটভাই, আমার সহপাঠী চটপটে আল মনসুরকে যে এক আধটু সাহিত্যও করে। অভিনয়-আবৃত্তি করে নিয়মিত। তার বিরুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে দাঁড়াবার মতো কাউকে মনমতো পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকের ধারণা হলো আল মনসুর অর্থাৎ বেলাল হয়ত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাবে। তখন একদল ছাত্র ইউনিয়নের নেতা গোছের সিনিয়র ছাত্র এসে ধরল আমাকে। তারা ভেবেচিন্তে ঠিক করেছে একমাত্র আমারই কিছুটা সম্ভাবনা রয়েছ বেলালের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জেতার। কিন্তু এত বড় প্রথাভাঙার কাজে একা সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পেলাম। তাদের বললাম আমার বাবার কাছে জেনে নিতে তিনি অনুমতি দেন কিনা। মাত্র কয়েক মাস আগেই এমন বিশাল এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়ে গেছে দেশে। ক্ষত শুকোয়নি তখন পর্যন্ত। ইলেকশনে দাঁড়ালে কত লোকের সঙ্গে দেখা করতে হবে, কথা বলতে হবে, নানা জায়গায় যেতে হবে, কলেজের মাঠে, মঞ্চে বক্তৃতা করতে হবে। আমার বাবা মেয়েদের অচিরাচরিত ভূমিকায় অংশগ্রহণে ও তাদের জন্যে সর্বক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি করতে সদা প্রস্তুত ও উৎসাহী ছিল। সেই সময়ের তুলনায় বাবা অনেক অগ্রগামী ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরেও বাবা কি এতটা যাবে? যেসব স্যারেরা আমাকে সাহস দিচ্ছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন শামসুজ্জামান স্যার, ইংরেজির শিক্ষক সদ্য পশ্চিম বাংলা থেকে আসা আজিজুল হক ও ভূগোলের শিক্ষক, যাঁর নামটা এখন আর মনে করতে পারছি না। আর মামুন স্যার! যদিও তার নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হচ্ছে, তবু এই প্রথাভাঙার কাজে তিনি আমাকে উৎসাহিতই করেছিলেন। আমার বাবা কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে রাজি হয়ে গেল ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের কাছে। বাবা কেবল আমার নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ছেলেদের একটাই প্রতিজ্ঞা করালো। প্রতিশ্রুতিটা এরকম। আমি আসন্ন নির্বাচনে সব কাজই করব, কেবল ক্যাম্পেইন করতে কলেজের বাইরে কোথাও যাবো না। আমার হয়ে সে কাজটি করতে হবে ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেদের। সানন্দে রাজি হয়ে গেল সবাই। মহা উত্তেজিত হয়ে ওরা ফিরে এলো। পরদিন থেকে শহরের সুউচ্চ জলের ট্যঙ্কের গায়ে, চায়ের দোকানের বেড়ার দরজায়, ছাদের কার্নিশে, সিমেন্টের বাউন্ডারি দেয়া দেয়ালে এবং প্রতিটি দালানের বাইরের দিকে মুখ করা দেয়ালে, কলেজের ভেতর সর্বত্র কলেজ নির্বাচনের পোস্টারে ছেয়ে যায়। বিশেষ করে আমার ও আল মনসুরের পাশাপাশি ছবিতে। এই ঘটনার অভিনবত্ব চিত্তাকর্ষক। হরগঙ্গা কলেজ বরাবরই ছেলেমেয়েদের নিয়ে সহ-শিক্ষালয়। কিন্তু এই প্রথম একটি মেয়ে নির্বাচন করছে। এই অভিনবত্বের জন্যে হোক, অথবা আমাকে অন্য কোন কারণে পছন্দ করার জন্যেই হোক সকলকে অবাক করে দিয়ে প্রিন্সিপালের পুত্র, কেমিস্ট্রি শিক্ষকের অনুজ, আমার সহপাঠী উদীয়মান সুশ্রী নাট্য শিল্পী আল মনসুরকে পরাজিত করে আমি ম্যাগাজিন সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়ে গেলাম। এর কিছুদিন পরেই স্যার চলে যান নতুন শিক্ষকতার চাকরী নিয়ে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। তার আগেই অবশ্য তাদের এমএ পরীক্ষার ফল বেরিয়ে যায়। স্যার তাঁর দীর্ঘ পরিশ্রমের স্বীকৃতি পেয়েছেন।
পরে লোকমুখে শুনেছি জগন্নাথ কলেজ থেকে স্যার যান ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখান থেকে ফের চলে আসেন ঢাকা শহরে বাংলা একাডেমির অন্যতম পরিচালক হিসেবে। সেখান থেকেই জাতীয় যাদুঘরের ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব কিছুদিন পালন করার পর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে ২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত নিযুক্ত ছিলেন। এই সময়ে তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হল ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা’ শিরোনামে ৬৪ খণ্ডে ৬৪ জেলার লোকজ সংস্কৃতির সংগ্রহশালা সম্পাদনা এবং ১১৪ খণ্ডে বাংলাদেশের ফোকলোর সংগ্রহশালা সম্পাদনা। সাহিত্যে অবদানের জন্যে ২০০১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান তিনি। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০১৭ সালে পান স্বাধীনতা পুরস্কার। ২০১৮ এর মাঝামাঝি সময়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন। ২০২০ তে বাংলা একাডেমীর সভাপতি ডঃ আনিসুজ্জামান কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার পর ডঃ শামসুজ্জামান খানকে বাংলা একাডেমীর সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি আবার ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠানে-স্বস্থানে-স্বভূমিকাতেই। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে বিলম্বিত বইমেলার ব্যস্ততার সময় কোভিড আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান ১৪ই এপ্রিল, ২০২১এ।
মুন্সীগঞ্জ থেকে স্যার চলে যাবার পর অনেকদিন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। প্রায় বছর পাঁচেক পরে স্যারের সঙ্গে আকস্মিক দেখা হয়ে যায় এক দুপুরে পুরনো ঢাকার আজাদ সিনেমা হলের সামনে। বছরটা ১৯৬৮-৬৯ এর দিকে। আজাদ সিনেমা হলে কোন কারণে একদিনের জন্যে ১৯৫৯ -এর এ জে কারদারের বিখ্যাত পাকিস্তানী ছায়াছবি ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ দেখানো হচ্ছিল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। বিয়ে হয়ে গেছে। জ্যোতি আমার সঙ্গেই ছিল। স্যারও এসেছিলেন সস্ত্রীক ছবি দেখতে। ভাবীকে সেদিনই প্রথম দেখলাম। স্যার তখন পড়ান ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখনই জানতে পারি স্যার জ্যোতির পূর্ব পরিচিত। একই ডিপার্টমেন্টের ছাত্র, জ্যোতির থেকে দু’বছর পরের ব্যাচ।
১৯৯১ সালে আমরা এক দশকের জন্যে ঢাকায় ফিরে না আসা পর্যন্ত স্যারের সঙ্গে আরেকবারই দেখা হয়েছিল ১৯৯০-৯১ এর দিকে। নিউ ইয়র্কে হাসান ফেরদৌসের বাড়িতে এক সন্ধ্যায়। অনেক লোকজন ছিল ঘরে। স্যারকে বহুদিন পরে দেখে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে উপস্থিত সকলকে যখন বলছিলাম তিনি আমার শিক্ষক, স্যারের মুখ চোখ দেখে বুঝি, আমার এই উক্তিতে উনি খুব অস্বস্তি বোধ করছেন। প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে না পারলেও স্যারের শশব্যস্ত প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্ত শব্দাবলিতে ব্যাপারটা আঁচ করতে পারি। এমন প্রৌঢ়া এক মহিলার শিক্ষক সাজতে স্যারের মতো সুপুরুষ ও সুঠাম দেহের অধিকারী ব্যক্তির দ্বিধা হয়েছে। না জানি তাঁর কত বেশি বয়স, ভাবছে বুঝি লোকে। এরকম বয়স্ক লোকের শিক্ষক হতে হলে যে বয়সের দরকার সেখানে নিজেকে প্রতিস্থাপনে লজ্জায় দ্বিধায় সঙ্কুচিত হয়ে তিনি বলে ওঠেন, “না, না ও কিছু নয়। এই মাত্র কয়েক মাসের জন্যে – তখন পর্যন্ত আমাদের পরীক্ষার রেজাল্টও বের হয়নি।” ব্যাপারটা টের পেয়ে আমার একটু মজাই লেগেছিল। দৃঢ়ভাবে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম, “স্যার, আপনি আমার শিক্ষক অথবা শিক্ষক নন। এর মাঝামাঝি তো কিছু নেই। যেমন একজন নারী হয় প্রেগনেন্ট অথবা প্রেগনেন্ট নয়। দুটোর মাঝেখানে কিছু হয় না। আমি সামান্য একটু প্রেগনেন্ট বলে কিছু নেই।” কেউ কেউ হেসে, হাততালি দিয়ে আমাকে সমর্থন করলো। স্যার যাতে আমদের মতো বৃদ্ধ ছাত্র নিয়ে এমন বিড়ম্বনায় ভবিষ্যতে না পড়েন তাই তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি যে কথা তিনি নিজেও ভালো করেই জানেন তা। বলি, “স্যার, মাস্টার হবার জন্যে ছাত্রের চাইতে অনেক বেশি বয়সী হতে হয় না কিন্তু সকল শিক্ষককে। ডঃ আনিসুজ্জামান জ্যোতির অন্যতম প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। অথচ তিনি জ্যোতির চাইতে মাত্র দু’বছরের বড়। আমার শিক্ষক বিদ্যুৎ দত্ত আমাদের থেকে মাত্র দু’ক্লাস ওপরে পড়তেন।”
স্যার জীবনে আমাকে প্রথম ফোন করেছিলেন বাংলা একাডেমির টেলিফোন থেকে সেখানকার মহাপরিচালক হিসাবে একটি সুখবর দিতে, সাত বছর আগে, আমাদের ডেনভার, কলোরাডোর বাড়িতে। পিয়াস মজিদ প্রথমে ফোন করে আমার সঙ্গে কথা বলে স্যারের হাতে ফোনটা দিয়েছিল। তাঁরা দুজনেই আমাকে অভিনন্দিত করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, ছোটগল্পে সেবার আমাকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার দেবার সিদ্ধান্তের কথা। স্যার জানালে, মাত্র গতকালই ফাইনাল কমিটির সকলে দস্তখত করে তালিকা জমা দিয়েছেন তাঁর কাছে। আজ পুরো একটি দিন নাকি তাঁরা নষ্ট করেছেন আমার টেলিফোন নম্বর খুঁজে পেতে। আমি অবাক হলাম। হায়াৎ মামুদ, শফি আহমেদ, দ্বিজেন শর্মা আমাদের কত ঘনিষ্ঠ বন্ধু রয়েছে সেখানে, কোথায় খুঁজেছেন তাঁরা ফোন নম্বর? সেদিনটা ছিল ২৯ জানুয়ারি, ২০১৪, রাত প্রায় এগারোটা। স্যার আমাকে সত্বর চলে আসতে বললেন। জানালেন এবার হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রী এবার থেকে নিজের হাতে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেবেন বিজয়ীদের হাতে। আর সেটা দেয়া হবে অন্যান্য বারের মতো ২১ ফেব্রুয়ারিতে নয়। মেলার প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রী যখন মেলা উদ্বোধন করেন, তখন, অর্থাৎ পয়লা ফেব্রুয়ারিতে। তার মানে আমাকে এক তারিখে যেতে হলে কালকের মধ্যেই অবশ্যই ঢাকার পথে উড়াল দিতে হবে। যেহেতু পূর্ব দিকে যাচ্ছি, যাবার সময় বারো ঘন্টা হারাবো আমরা ঘড়ির কাঁটায়। ফলে পথে বিমানটি কোন জায়গায় অনির্ধারিত দেরি করতে পারবে না। তাহলেই কেবল ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ছুটতে ছুটতে কোনমতে হয়তো বাংলা একাডেমি সোজা চলে যেতে পারি। কিন্তু আমি ও জ্যোতি সেই মুহূর্তে তৈরি হচ্ছিলাম ভোররাত্রে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে বিমান বন্দরে যেতে। জরুরী ভিত্তিতে এক বড় অরথোপেডিক স্পেশালিস্টকে দেখাতে। কিছুদিন আগে আমার ডান হাঁটু রিপ্লেস্মেন্ট সার্জারি হয়েছিল। নানা জটিলতার ভেতর এখন মনে হচ্ছে সেই হাঁটু সন্ধিতে ইনফেকশন হয়ে গেছে। বহু কষ্টে একটা এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেছে সেই ডাক্তারের সঙ্গে। আমরা তাই নিউ ইয়র্ক যাবার জন্যে স্যুটকেস গুছাচ্ছিলাম। বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়ার স্বপ্ন দূরে থাক, আমাকে এই পুরস্কারে জন্যে কেউ কোনদিন নমিনেট করেছেন বলেও কখনো শুনিনি। একদিন আগেও যদি জানতে পারতাম এবার বাংলা একাডেমি পুরস্কার আমাকে দেয়া হচ্ছে এবং সে অনুষ্ঠান হবে এ বছর থেকে পয়লা ফেব্রুয়ারিতে, হয়তো দুদিনের জন্যে হলেও যাবার চেষ্টা করতে পারতাম। এই শেষ মুহুর্তে আর কিছু করতে পারলাম না। এত অল্প সময়ের ভেতর টিকিট পাওয়া যাবে কিনা সেটাও জানিনা। অপ্রত্যাশিত খবরটা শুনে খুব খুশি হলেও একটু পর থেকেই তীব্র মনখারাপ লাগা শুরু হয়। মনে হয় ডাক্তারি সাক্ষাৎ বাদ দিয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে সর্ব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করে যদি দেখতে পারতাম কোনভাবে দুটো কিংবা অন্তত একটা টিকিট পাওয়া যায় কিনা; আর গেলে ঠিক সময় প্লেন ঢাকায় অবতরণ করে কিনা।
তবে পরে ভেবে দেখেছি, সেটা করতে গেলে চেষ্টাটি বৃথা হবার সম্ভাবনা অনেকটাই ছিল। আর নিউ ইয়র্কের ডাক্তার দেখাতে পারায় অন্তত নিশ্চিত হতে পেরেছি আমার ইনফেকশন তেমন মারাত্মক পর্যায়ে নেই যার জন্যে সম্পূর্ণ সার্জারি করা হাঁটু আবার খুলে স্টিলের কলকব্জা বদলে নতুন করে বসাতে হবে, যেটা ডেনভারের ডাক্তার সন্দেহ করছিলেন। এটা সত্য, মূল অনুষ্ঠানে গিয়ে বন্ধু মফিদুল হক, হারুণ হাবিব, জামিল চৌধুরী ও হেলাল হাফিজের সঙ্গে একত্রে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নিতে পারার অন্যরকম একটা থ্রিল ছিল। কিন্তু তা না পারলেও পরবর্তীকালে দেশে গেলে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ছোট্ট ঘরোয়া একটি চমৎকার অনুষ্ঠান করে শুধু আমাকে নয় ১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের হাতেও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা একাডেমি পুরস্কারের সার্টিফিকেট ও ক্রেস্ট তুলে দেয়া হয়।
ঘনিষ্ঠ বন্ধু, পারিবারিক সদস্য ও শুভাকাঙ্খীদের উপস্থিতিতে বাংলা একাডেমিতে আমার ও জ্যোতির হাতে এক বিশাল তোড়া ফুলসহ ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট তুলে দেন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ও সভাপতি ডঃ আনিসুজ্জামান। ছোট্ট বক্তৃতা ও চা-জলখাবার আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। বলাবাহুল্য মুক্তিযুদ্ধের বছরে জ্যোতি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ায় এবং পরবর্তীকালে বেশ কয়েক বছর প্রবাসে কাটানোর জন্যে এবং সেই সঙ্গে তখনকার সময়ে খুব ঘন ঘন মহাপরিচালকের পদে নতুন নতুন ব্যক্তির যোগদানের কারণে পুরস্কারের অর্থটা ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে আমি ঢাকা গেলে আমার হাতে তুলে দিলেও আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে জ্যোতিকে কোনরকম লিখিত স্বীকৃতি বা ক্রেস্ট দেয়া হয়নি। পুরস্কার পাবার ৪৩ বছর পরে ডঃ আনিসুজ্জামান ও ডঃ শামসুজ্জামান খানের যৌথ উদ্যোগে সেটাও ঘটে। এজন্যে আমরা খুবই কৃতজ্ঞ। ফলে বাংলা একাডেমি পুরস্কারের সনদ ও একুশের পদক প্রায় একই সময় হাতে পান জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। আর সেই বছরেই এই দুই মহাপ্রাণ, জ্যোতির ও আমার দুই প্রিয় শিক্ষক, সদ্য প্রকাশিত জ্যোতির নয়া-উদ্ভাবন ‘ছোট উপন্যাস’, ‘শূন্য নভে ভ্রমি’ ও আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘অবিনাশী যাত্রা’র মোড়ক উন্মোচন করেন প্রেস ক্লাবে অন্যপ্রকাশ আয়োজিত এক মনোরম অনুষ্ঠানে। দুইজন স্বনামধন্য বাংলার অধ্যাপক, লেখক, গবেষক, অত্যন্ত মার্জিত রুচির অধিকারী, বিনয়ী এবং সর্বার্থেই পরিপূর্ণ ভদ্রলোক, দেশের দুই শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী, একজন আমার শিক্ষক, অন্যজন জ্যোতির, আমাদের সাধারণ সাদামাটা জীবনকে বহুভাবেই রাঙিয়েছেন সন্দেহ নেই। তাঁরা আমাদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন। ঘরোয়া আড্ডাতে তাঁরা শিক্ষক নয় বন্ধুর অতো আড্ডাপ্রিয়, আমুদে, খোলামেলা ও হাসিখুশি। ভাবতে চাই না, বিশ্বাস করতেও না, কি অবাস্তবভাবে, কি নিদারুণভাবে এক বছরের ভেতর দুজনকেই হারালাম আমরা একই কালব্যাধিতে। গত দুই বছর অতিমারির জন্যে অন্য সকলের মতো আমরাও গৃহবন্দী। তা না হলে প্রায় প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি আসতে না আসতে ছুটি ঢাকায় – বইমেলায়। হঠাৎ করে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মতো এসে যেভাবে কোভিড আমাদের প্রিয়জনদের রাতারাতি কেড়ে নিল, তাতে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা কিংবা বইমেলা কি আর কখনো আগের মতো উপভোগ করতে পারবো? মনে হবে কি এখনো, ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা আর বাংলা একাডেমির বইমেলা ছাড়া আর কোথাও থাকা যায় না?
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন