bibidho-adwitiyo-lila-nag

অদ্বিতীয়া লীলা নাগ: এক অবিস্মরণীয় নারী
স্মৃতিচারণা
পূরবী বসু


বাংলাদেশের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বয়স একশত দুই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুই নারী ছাত্রের একজন হলেন লীলা নাগ। প্রকৃতপক্ষে, তিনিই প্রথম নারী যিনি আইন ও প্রশাসনের সঙ্গে লড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা মেয়েদের জন্যে অবারিত করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম ডিগ্রীধারী (এম এ) নারীও লীলা নাগ।

সময়টা ঊনিশ শতকের শেষ। বিশ শতকের শুরু। এক উত্তেজনাময় যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে পুরো উপমহাদেশ। লীলা নাগের জন্ম সেই সময়। ১৯০০ সালের অক্টোবরে। ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে তখন উথাল পাতাল অবস্থা। ঘটনাবহুল দ্রুত পরিবর্তনশীল দু’টি শতকের সন্ধিক্ষণে তখন ইংরেজদের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য – স্বাধীন দেশের নাগরিক হবার স্বপ্নে চারদিকে বিভিন্ন আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছে – সংসদীয় ও বিপ্লবী দুই পদ্ধতিতেই।

শিক্ষিত, বনেদী, প্রগতিশীল পরিবারের লীলা নাগের বাড়ির আবহাওয়া তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজকর্মের অনুকূল ছিল। তাঁর মেজিস্ট্রেট পিতা এক ইংরেজ অপরাধীর শাস্তি মওকুফ করতে রাজি না হওয়ায় রাজ রোষনলে পড়ে প্রাপ্য পদোন্নতি না পাওয়ায় চাকরী ছেড়ে দিয়ে দিল্লির আইন সভার সদস্য হন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সহমত জানাতে সেই আইন সভার সদস্য পদেও ইস্তফা দেন। ফলে দেখাই যাচ্ছে শুধু কর্মসূত্রে নয়, জীবনের পথেঘাটে যেখানে সম্ভব দেশবাসীর মনে মানবতাবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন। তার পরিবারে রাজনৈতিক সচেতনতা দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা লোকদের জাগিয়ে তুলে তাদের সহজ ভাষায় পুরো অবস্থাটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করতেন।

লীলা নাগ তার বহুমুখী প্রতিভা, দৃঢ়তা ও নিষ্ঠার কল্যাণে একসংগে বহুবিধ দেশাত্মমূলক ও নারী প্রগতির কাজে এমন সুচারুরূপে, এতোটা মগ্নতার সংঙ্গে সম্পন্ন করতে পারতেন যে দেখা যেতো প্রতিটি কাজ-ই নিখুঁত হয়েছে ফলাফল প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে। লীলা নাগ ছিলেন নারী শিক্ষায় অগ্রগামী নেত্রী। নারীর শিক্ষা প্রসারে ও মানোন্নয়নে সর্বদাই ব্যস্ত ছিলেন তিনি। নারীর উপার্জন ও স্বাবলম্বিতা অর্জন এবং নিরাপত্তা রক্ষায় ছিলেন সদা সতর্ক। নারীর শিক্ষা ও উপার্জনের মাধ্যমে নারীর আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠা ও দেশপ্রেম জাগ্রত করার চেষ্টা যেমন করেছেন তিনি, তাদের শারীরিকভাবে সুস্থ ও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে এবং আত্মরক্ষার খাতিরে নানারকম ব্যয়াম ও শারীরিক কসরতের অনুশীলন দিয়ে প্রতিদিনের কর্মযজ্ঞে রুটিনের মতো তা ব্যবহারে উৎসাহ দিতেন।

লীলা নাগ ছিলেন একাধারে একজন বাঙালি সাংবাদিক, নারীপ্রগতির রূপকার, সমাজসংস্কারক, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় নেত্রী, সংবাদপত্র ও সাহিত্য ম্যাগাজিনের সম্পাদক, সংসদ সদস্য ও একজন সুলেখিকা। বহুকিছু করতে গিয়ে তিনি নিজের সৃজনশীলতার চর্চা করার, সাহিত্য রচনা করার মতো নিরবচ্ছিন্ন সময় বা সুযোগ পান নি। যা লিখেছেন তাও প্রধানত অতি গতিময় ভাষায়, সংক্ষেপে, তাঁর রাজনৈতিক বা সামাজিক ভাবনাগুলোকে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্যে। আর লিখেছেন বাঙ্গালির মানসে রবীন্দ্রনাথের ব্যাপক উপস্থিতি ও প্রভাবের কথা। ব্যক্তিগতভাবে তিনি অত্যন্ত প্রচারবিমুখ ব্যক্তি ছিলেন। আর তাই সকলের এমন কি জেল থেকে চিঠিতে স্বামী অনিলের অনুরোধ সত্ত্বেও কোন আত্মকথা বা আত্মজীবনী লিখে যান নি লীলা। তাঁর নিজের কথা নিজের কাছে যেটুকু আমরা জানি তা মূলত তাঁর চিঠিপত্র, দিপালী সংঘের বা জয়শ্রীর কাজকর্মের হিসাব রাখার ডায়েরী বা খরচের হিসাবপত্রের খাতা কিংবা বাজারের ফর্দ থেকে। যে পরিমিত সাহিত্যচর্চা তিনি করেছেন তার উপস্থাপনা, গতি, ভাষার ওপর দখল এবং বিষয়বস্তু থেকে বোঝা যায়, তিনি লেখার সময় সর্বোপরি তাঁর পাঠকদের কথা, তাঁদের কল্যাণের কথা, তাদের করণীয়ের কথা মনে রেখেই লিখেছেন। তাঁর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখা “আমাদের রবিতর্পণ” ও অন্য লেখা সমাজ গঠন ও বিবর্তনে সাহিত্যের ভূমিকার ওপর “সমাজ ও সাহিত্য” লেখা দুটো তাঁর লেখনী শক্তির জ্বলন্ত প্রমাণ। বাঙালি জীবনের দুই প্রধান স্তম্ভ রবীন্দ্রনাথ এবং স্বদেশপ্রেম নিয়ে কলম ধরতে বাধ্য হন লীলা।

আমাদের রবিতর্পণে লীলা তার জীবনের পথপ্রদর্শক, রবীন্দ্রনাথের বিশালত্ব বর্ণনা করে রবি ঠাকুরের দিপালী সংঘ পরিদর্শন এবং এক সাথে এতো মেয়ের সমাবেশ দেখে প্রীত হবার কথাও জানান। সাহিত্য ও সমাজ নামে তাঁর অন্য একটি প্রবন্ধে তিনি জোর দিয়ে লেখেন সাহিত্য যদি সমাজের প্রতিফলন না ঘটায় সেটা সাহিত্য নয়, সাহিত্যের জন্যে সাহিত্য করায় বিশ্বাস ছিল না তাঁর। তিনি এই প্রবন্ধে দেশ বিভাগ পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িকতাকে সবচাইতে বড় শত্রু ও চ্যালেঞ্জ মনে করে দুই বাংলার নারীদেরকেই রান্নার রেসিপির মতো করে এই ব্যাপারে তাদের করনীয়ের কথা লিপিবদ্ধ করেন।

আসামের গোয়ালপাড়ায় জন্ম লীলা নাগের। সেই সময় আসাম আর সিলেট অঞ্চলের লোকদের মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতির একটি নিকট বাঁধন ছিল। লীলার পিতা গিরীশচন্দ্র নাগ মেজিস্ট্রেট ছিলেন। লীলা নাগের পরিবার ছিল তখনকার দিনের সিলেটী সংস্কৃতিমনা ও শিক্ষিত একটি পরিবার। পিতার বদলীর চাকুরীর জন্যে প্রথম কয়েক বছর এখানে সেখানে স্কুলে গেলেও মাধ্যমিক স্কুল থেকে কলেজে যাওয়া পর্যন্ত ইডেন স্কুলে বৃত্তি নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেন। ইডেনে স্কুল শেষ করে তিনি কলকাতার বেথুন কলেজে যান। ১৯২১ সালে বেথুন কলেজ থেকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়ে বি এ পাশ করেন এবং পদ্মাাবতী স্বর্ণপদক লাভ করেন। তাঁর বিপ্লবী চেতনা বেথুন কলেজে পড়ার সময়েই উন্মোচিত হয়। তিনি সিনিয়র ছাত্রনেতা পদবী অর্জিন করেন। তাঁর নির্দেশে কলেজের রিইউনিয়ন করা তারই পরিকল্পনা। কলেজের পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে আগত বড় লাট পত্নীকে কলেজের মেয়েদের নতজানু হয়ে স্বাগতম জানাবার অবমানাকর আনুষ্ঠিকতা পরিত্যাগ করে সাধারণভাবে অন্য অতিথিদের যেভাবে সম্মাণ জানিয়ে অভ্যর্থনা করা হয়, ঠিক সেই ভাবেই বড়লাট পত্নীকেও করা হয় এর পর থেকে। ১৯১৭ সালের ২ রা অক্টোবর সতেরো বছরের লীলা বাবাকে চিঠি লিখে নিজের জীবনের লক্ষ্য ও আদর্শের কথা ব্যক্ত করেন। লীলা বাবাকে লেখেন,

“আমার ক্ষুদ্র শক্তি যদি একটি লোকের উপকার করতে পারতো, তাহলে আমি ধন্য হতুম। সত্যি বলছি – এ আমার বক্তৃতা নয়,- এটা আমার প্রাণের কথা। এ আমার ideal- আশীর্বাদ করো এই জন্মে যদি কিছু করতে না পারি, আবার যেন এই আমার প্রিয় ভারতবর্ষেই জন্ম গ্রহণ করি। একে সেবা করে এ জন্মের আশ মেটাতে।

……আমার উদ্দেশ্য নয় এই পৃথিবীতে লোকের প্রিয় হওয়া, কিন্তু এই পৃথিবীতে খাঁটি হওয়া। খাঁটি হয়েও যদি প্রিয় হতে পারি তবে তো কথাই নেই।”

১৯২১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল়য়ে ইংরেজি বিভাগে এমএতে ভর্তি হবার ইচ্ছা পোষন করেন। তাঁর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ছাত্রী ছিল না। ছেলেদের যেরকম আবাসিক হল ছিল, যেমন সলিমুল্লাহ হল, ঢাকা হল, জগন্নাথ হল, মেয়েদের জন্যে তেমন কোন আবাসিক হল ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কতৃপক্ষ তাই ঘোষণা দিয়েছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার আইন থাকা সত্বেও পরিবেশ ও ব্যবস্থা সহশিক্ষার উপযোগী নয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা মেয়েদের জন্যে খোলা ছিল না। কিন্তু লীলা নাগের দৃঢ়তা, মেধা ও আগ্রহ বিচার করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ১৭ নম্বর অ্যাক্টের ৫ নম্বর ধারা (XVII এর ৫ নম্বর ধারা The University shall be open to all persons of either sex race, creed or and of whatever class…)” অনুসরণে তৎকালীন ইংরেজ ভাইস চান্সেলর ডঃ পি জে হার্টজ তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্যে বিশেষ অনুমতি প্রদান করেন। তাঁর অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় এই অঞ্চলে উভয় লিঙ্গের জন্যে মানসম্পন্ন উচ্চ শিক্ষানিকেতন। মেয়েদের জন্যে পথ খুলে যাওয়ায় লীলা নাগ যে বছর (১৯২১) ইংরেজিতে এম এ তে ভর্তি হন, সেই এক-ই বছর অর্থনীতিতে অনার্সে ভর্তি হন সুষমা সেনগুপ্ত। সেই হিসেবে লীলা ও সুষমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুই ছাত্রী।

১৯২১ সালে ভারতীয় নারীর ভোটাধিকারের আন্দোলন শুরু হলে লীলা এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ‘নিখিলবঙ্গ নারী ভোটাধিকার কমিটি’ র সহ-সম্পাদিকা নির্বাচিত হন।

রাজনৈতিক কর্মাবলি লীলাকে পড়াশোনায় নিবিড় মনোযোগ দেবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বেথুন কলেজে বি এতে ফার্স ক্লাস ফার্স্ট হয়ে পদ্মাবতী স্বর্ণ পদক অর্জন করা লীলা ১৯২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় বিভাগে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী এমএ ডিগ্রীধারী।

লীলা নাগ ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর একান্ত বিশ্বাসী সহকারী ও নেতৃ স্থানীয় অনুগামী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন তিনি। গান্ধীর সঙ্গেও খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন বিশেষ করে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময়। প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, বুদ্ধদেব বসু, কাজী মোতাহার হোসেন, সরোজিনী নাইডুসহ তখনকার দিনের নানা বিষয়ে বিখ্যাত সকল মনিষীরাই লীলার বহুমুখী কাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্যে সশস্ত্র বিপ্লব ও অসহযোগী অহিংস আন্দোলন দুটোতেই নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। মহত্মা গান্ধির আদেশে তিনি ও আশালতা সেন বাংলার চড়কা কাটার অহিংস আব্দোলনে যোগ দেবার জন্যে জনগনকে উদবুদ্ধ করেন। নিজে চড়কা কাটেন।

১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন-বিরোধী হরতাল কর্মসূচিতে ঢাকার মহিলাদের সংগঠিত করে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।

১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেস ও বাংলার বিপ্লবী দলগুলো সুভাষচন্দ্রের চারপাশে সমবেত হতে শুরু করে। সহকর্মীদের সাথে অনিল রায় ও সহযোদ্ধা বন্ধু লীলা নাগ সেখানে উপস্থিত হন। নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলনে বাংলার নারী আন্দোলনের ইতিহাস উপস্থাপনার জন্যে লীলাকে মঞ্চে ডাকা হয়। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁর বিপ্লবী দলে যোগদানের পথ পাকাপোক্ত হয়।

সুভাষচন্দ্র বসু জেলে যাবার আগে লীলাকে তার দলের কাগজ Forward Block এর সম্পাদনার দায়িত্বই শুধু দিয়ে যান না, তাঁর অনুপস্থিতিতে তিনি লীল রায় ও অনিল রায়কে ফরোয়ার্ড ব্লককে সংগঠিত করার দায়িত্ব-ও দিয়ে যান যা যথাযথভাবে পালন করতে গিয়ে লীলাকে দেশের এ প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে বেড়াতে হয়েছে। লীলা নাগ-ই একমাত্র বাঙালি নারী যিনি ভারতের কন্সটিটুয়েন্ট এসেমব্লির সদস্য হিসেবে ভারতের সংবিধান রচনায় অংশগ্রহণ করেন। এমন বহুমাত্রিক বর্ণিল কর্মময় জীবন সর্বার্থেই অতুলনীয়।

সমাজের প্রতি স্তরে ও পরিবেশে নারীর প্রতি পুরুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভংগী লীলাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিত। দিপালী সংঘ ছাড়াও তিনি অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত ছিলেন অনিল রায়ের শ্রীসংঘের সাথে। শ্রীসংঘে যোগদানের পর বিপ্লবী আন্দোলনেও তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে যান সর্বোচ্চ নেতৃত্বে। কিন্তু বিদ্যালয় থেকে শুরু করে সশস্ত্র বিপ্লব পর্যন্ত সকল স্থানে পরদেশী শাসকদের সকল রকমভাবে আঘাত করতে প্রস্তুত ছিলেন তিনি ইনি। দেশের স্বাধীনতার জন্যে সশস্ত্র বিপ্লব, আবার সেই সঙ্গে মহাত্মা গান্ধির ডাকে অসহযোগ আব্দোলনে যোগ দিয়ে দলবল নিয়ে চড়কা চালিয়ে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে, সংসদে নতুন আইন নির্মাণে বা চলতি আইনের কোন বিশেষ ধারার সূক্ষ্ম বিশ্লেষন করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন নারীপুরুষের এই অবস্থান ও পারস্পরিক সম্পর্ক সর্বত্র এক-ই রকম বৈষম্যময়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পোষাকে পাওয়া গিয়েছিল তার স্বহস্তে লিখিত কয়েকটি কথা, ‘দেশের মুক্তি-সংগ্রামে নারী ও পুরুষের পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করিয়াছিল। যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে পারে, আমরা ভগিনীরা কেন উহা পারিব না’। বহুমাত্রিক এইসব কাজ করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছেন, কেবল নারী শিক্ষ, নারীর কল্যাণময়ী রূপ বজায় রাখা নারীর জন্যে যথেষ্ট নয়। সমাজ পরিবর্তনও নারীকে সম মর্যাদা দেবে না যতদন দেশ স্বাধীন না করতে পারে এদেশের জনগণ। নারীর প্রকৃত মুক্তি কখনো আসতে পারে না যতদিন তারা ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে নিজের দেশকে মুক্ত করতে না পারছে।

ছাত্রাবস্থায় তাঁর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সান্নিধ্য পাবার সুযোগ হয় ঢাকায়। রবীন্দ্রনাথকে তিনি তাঁর জীবনের পথপ্রদর্শক হিসাবেই গ্রহণ করেছিলেন।

পাকভারতের স্বাধীনতার প্রাক্কালে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে অনেকগুলো বড় আকারের দাঙ্গা হয়। এইসব দাঙ্গার সময় লীলা নাগ কলকাতা ও নোয়াখালিতে নিজের জীবন বিপন্ন করে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকদের রক্ষা করেন। নোয়াখালিতে দাঙ্গার সময় তাঁর সংঙ্গে ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ ঘটে মহাত্মা গান্ধীর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায়। সেখানে লীলার কথাবার্তা, কাজকর্ম ও নিষ্ঠা দেখে মুগ্ধ হয়ে গান্ধি তাকে তার কাজের সহযোগী হতে উত্তর ভারতে আসার আমন্ত্রন জানান; গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে লীলা পূর্ববঙ্গেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ লীলার কাজকর্ম, সাংগঠনিক ক্ষমতা ও দিপালী সংঘ পরিদর্শণ করে লীলাকে শান্তিনিকেতনে এসে কাজ করার জন্যে বিশেষভাবে অনুরোধ জানালে লীলা স্পষ্ট জানিয়ে দেন তার কাজের ক্ষেত্র বদলাবার কথা তিনি চিন্তাতেও আনতে অক্ষম। রবীন্দ্রনাথ লীলাকে বুঝতে পারেন এবং তাকে দূর থেকেই শুভেচ্ছা জানান। ওদিকে গুরুসদয় দত্তও লীলাকে তার ব্রতচারী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার জন্যে ডেকেছিলেন। কিন্তু লীলা ঢাকা ছাড়া এবং তার করনীয় বলে যেটা স্থির করেছেন সেটি ছাড়া কোথাও যেতে চান নি। তবে এইসব মহান ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও দীর্ঘ আলোচনা তাঁর জীবনে গভীর রেখাপাত করে। কলকাতার দাঙ্গার সময় নেতাজির ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও বাংলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুদ্দীন চৌধুরীকে কলকাতার পার্ক সার্কাস থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসে তিনি তাঁকে তার নিজের রাসবিহারী এভেনিউর বাড়িতে নিরাপদে রেখে দেন যতদিন পর্যন্ত চৌধুরী সাহেব শান্তিপূর্ণভাবে নিজের ঘরে ফিরে যেতে না পেরেছিলেন। লীলা নাগের মৃত্যুর অনেক পরে বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক সভায় বক্তৃতাকালে আশরাফফুদ্দীন চৌধুরী সেই দিনের কথা, বিশেষ করে লীলা নাগের অসীম সাহস ও মানবতার কথা বলতে বলতে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। এইরকম সাহস তিনি নিজের জীবনে প্রত্যক্ষ করেছেন ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। দেশভাগের সেই নিদারুণ দোলাচলে কলকাতা থেকে পূর্ববঙ্গে সদ্য আগত কবি ও সর্বশ্রদ্ধেয় সুফিয়া কামালকে ঢাকার এক আশ্রয়কেন্দ্র থেকে উদ্ধার করে তাঁকে তাঁর পরিচিত পরিবেশ ও গৃহস্থলে নিয়ে আসেন লীলা নাগ। পরে লীলা নাগের সঙ্গে সুফিয়া কামালও দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্যে পথে নামেন।

নারীর মনে দেশপ্রেম আরো বেশি জাগ্রত করার লক্ষে দিপালী সংঘের মাধ্যমে বাংলার বড় বড় মানুষদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতো দিপালী সংঘ।

১৯২৫ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দিপালী সংঘের তরফ থেকে

একটি সভা আহ্বান করা হয়। সেদিন সকল নারী মিলে দেশবন্ধুর জীবনী পাঠ করেন এবং তাঁর অসাধারণ দেশপ্রেম সম্পর্কে আলোচনা করে শোকসুচক প্রস্তাব গ্রহণ করেন।

১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা এলে লীলা নাগের আমন্ত্রণে দিপালী সংঘ পরিদর্শন করেন। সব দেখে শুনে অত্যন্ত আপ্লুত রবীন্দ্রনাথ বলেন, ”সমস্ত এশিয়াতে মেয়েদের এত বড় সভা দেখিনি কোথাও…।’

১৯২৬ সালে দীপালি মহাত্মা গান্ধীকে অভিনন্দন জ্ঞাপনের আয়োজন করে। তিন হাজার মহিলার সমাবেশে তাকে সংবর্ধিত করা হয় এবং তাকে দশ সের চড়কার সুতো উপহার দেয়া হয়। ৩০ জন মহিলা স্বেচ্ছাসেবিকা সভার শৃঙ্খলা রক্ষা করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী দীপালি সংঘের কার্যাবলি দর্শনে বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করেন। দীপালি কর্তৃক আয়োজিত এই সকল অনুষ্ঠান ব্যতীত আরও সভা-সমিতির ব্যবস্থা করা হয়৷ তার মধ্যে “নারীর সমানাধিকার” সম্পর্কে আলোচনা সভা বিশেষ

উল্লেখযোগ্য. আলোচনা শেষে গৃহীত প্রস্তাবসমূহ বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় প্রেরণ করা হয়।

লীলার এক ক্লাস উপরের ছাত্র সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর সম্পর্কে লেখেন, ‘এঁর মত সমাজ-সেবিকা ও মর্যাদাময়ী নারী আর দেখি নাই। এঁর থিওরী হল, নারীদেরও উপার্জনশীলা হতে হবে, নইলে কখনো তারা পুরুষের কাছে মর্যাদা পাবে না। তাই তিনি মেয়েদের তৈরি সুন্দর নক্সা বা এমরোড্যয়ারি করা রুমাল, টেবলক্লথ ও অন্যান্য কুটিরশিল্পের কাজ বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সব বিক্রি করে তিনি মেয়েদের একটা উপার্জনের পন্থা বের করে দেন।? বিখ্যাত কবি এবং তখনকার দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু বলেন, “তাঁর প্রতি একটি বিস্ময়মিশ্রিত শ্রদ্ধা অনুভব করতাম”।

আগেই বলেছি, নারীসমাজের অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অভিশপ্ত জীবনে জ্ঞানের আলো বিকিরণের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েই লীলা ১২ জন নারী সাথী সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন তাঁর বিখ্যাত ‘দীপালিসংঘ’। মেয়েদের প্রতি অন্যায় অবিচার, অসম্মানের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহী মন ধীরে ধীরে আরো প্রসারিত হয়। আর তখন কেবল ব্যক্তি নারীর জন্যে নয়, তাঁর বিদ্রোহী প্রাণ ফুঁসে উঠেছিল সমগ্র মাতৃভূমির পরাধীনতার অপমান ও বেদনার অবসান ঘটাবার সংকল্পে ও প্রচেষ্টায়। তিনি টের পান নারীর জন্যে কল্যাণময়ী রূপে আত্মপ্রকাশ বা সমাজসংস্কার-ই যথেষ্ট নয়। নারী মুক্তির পূর্বশর্ত মাতৃভূমির মুক্তি – পরাধীনতার শৃংখল থেকে দেশোদ্ধার। বরাবর রাজনীতি সচেতন লীলা নাগ অতঃপর পুরোপুরি সশস্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি সহপাঠী বন্ধু, প্রতিবেশী কমরেড অনিল রায়ের বিপ্লবী দল শ্রীসংঘে যোগ দেন। এখানে ঢুকতেও নারী হওয়ার কারনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রচন্ড বাধার সম্মুখীণ হন লীলা। তখন পর্যন্ত সশস্ত্র দলে নারী নিয়োগ বিশেষ করে উঁচু পর্যায়ে নারীর অন্তর্ভুক্তি মেনে নেয়া হয়নি, কিন্তু লীলা রায় সব বাধা অতিক্রম করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন ঢুকেছিলেন, তেমনি শ্রীসংঘে যোগদান করেও নিজের নিষ্ঠা, দৃঢ়তা ও কর্মদক্ষতায় অচিরেই নেতৃত্বের দায়িত্ব কাঁধে নেন বিশেষ করে যখন অনিল রায়কে জেলে ঢোকানো হয়।

নারীদের ভেতর শিক্ষা বিস্তারে তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দিপালী সংঘ প্রতিষ্ঠা করেই দিপালী বালিকা বিদ্যালয় (এখনকার কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুল) এবং পরে আরেকটি হাই স্কুল (আরমানিটোলা হাই স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন। তবে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠাণ বয়স্ক নারীদের জন্যে শিক্ষা ও হাতেকলমে কিছু তৈরি করা শিখিয়ে তাদের উপার্জনক্ষম করে তোলার জন্যে প্রতিষ্ঠিত নারী শিক্ষা মন্দির (বর্তমানে শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়)। কেবল নারীদের হাতে তৈরি বিক্রয়যোগ্য জিনিস বানানো শিখিয়েই দায়িত্ব শেষ করতেন না লীলা। তখনকার সময়ে অভিনব পদ্ধতিতে বছরে একবার করে বিশাল দিপালী শিল্পপ্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে তিনি এইসব হস্তশিল্পের প্রসার ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন।

সাবালিকা নারীদের পড়াশোনায় শিল্প শিক্ষা, বেতের ও সূচের নানা জিনিস তৈরি করা, রোগীর পরিচর্যা, সন্তান পালন ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়ের সঙ্গে সংস্কৃতিচর্চা, নারীর সম-অধিকার, নারীর স্বাবলম্বিতা, স্বাধিকার চর্চার কথাও থাকতো। রাজনীতি বিষয়ে পড়াতে গিয়ে রাজনৈতিকভাবে জাগরণমূলক কর্মসূচিও ছিল পাঠ্যসূচিতে। ছিল ব্যায়ামাগার। সেখানে লাঠি,

ছুরিখেলা, শরীরচর্চা শেখানো হতো আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে। তিনি মনে করতেন নারীকে স্বাবলম্বী হতে হবে আত্মরক্ষায়।

১৯৩০ সালে বাংলার সকল বিপ্লবী দলের নেতৃস্থানীয়দের ইংরেজ সরকার একযোগে গ্রেপ্তার শুরু করলে অনিল রায় ও তাঁর সহকর্মীরাও গ্রেপ্তার হন। তখন শ্রীসংঘের সর্বময় নেতৃত্বের দায়িত্ব লীলা নাগের কাঁধে এসে পড়ে। শ্রীসংঘের সদস্যরা সশস্ত্র বিপ্লব পরিচালনা করার জন্য অস্ত্রসংগ্রহ ও বোমা তৈরী করেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল মামলার জন্য লীলা নাগ ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের ইন্দুমতি সিংহ কে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে দেন। সূর্যসেনের পরামর্শে প্রথম নারী বিপ্লবী শহীদ প্রীতিলতা দীপালি সংঘের সদস্য হয়ে বিপ্লবী জীবনের পাঠ নিয়েছিলেন লীলা নাগের কাছে। কথিত আছে লীলা নাগ নিজে প্রীতিলতাকে রাইফেল চালানো শিখিয়েছিলেন। ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর দুর্ধর্ষ রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানের পর বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে কার্যকলাপ আরো জোরদার হয়। ১৯৩১ সালের এপ্রিলে বিপ্লবীদের গুলিতে জজ গার্লিক ও কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্স নিহত হলে পুলিশ আরো তৎপর হয়ে উঠে। বিশেষ টার্গেট নারী রাজনৈতিক কর্মী ও নেত্রী। কেননা স্টিভেন্স হত্যাকান্ডের সাথে দু’জন তরুণী’ জড়িত ছিল। ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর লীলা নাগকে গ্রেপ্তার করা হয়। লীলা নাগ ভারতবর্ষে বিনা বিচারে আটক প্রথম নারী রাজবন্দী।

১৯৩৭ এর অক্টোবরে লীলা নাগ কারামুক্ত হন। লীলা নাগের কর্মদক্ষতা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও সাহসের সঙ্গে সুভাষ বসুর আগেই পরিচয় হয়েছিল। লীলা জেল থেকে বেরুলে এবং নিজে জেলে ঢোকার আগে তাই সুভাষ বসু ফরোয়ার্ড ব্লক কাগজের সম্পাদনা ভার লীলা নাগকে দিয়ে গিয়েছিলেন। কাগজের সম্পাদনা ছাড়াও তার নেতৃত্বের এবং সংগঠনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তিনি দিয়ে যান লীলা ও অনিল রায় দম্পতিকে। ১৯৪৬ সালে লীলা নাগ বাংলার সাধারণ আসন থেকে ভারতীয় কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন এবং ভারতের সংবিধান রচনাকার্যে অংশগ্রহণ করেন।

লীলা নাগের সম্পাদনায় বাংলার প্রথম নারী ম্যাগাজিন জয়শ্রী বের হয়। প্রথম সংখ্যায় প্রচ্ছদ করেন নন্দলাল বসু। রবীন্দ্রনাথ-ই ম্যাগাজিনের নামকরণ করেন এবং প্রথম সংখ্যায় তাঁর আশীর্বাণী কবিতায় লিখে দেন যা লীলা নাগ জয়শ্রীর প্রথম সংখ্যায় ছাপান।

বিজয়িনী নাই তব ভয়,
দুঃখে ও ব্যথায় তব জয়।
অন্যায়ের অপমান
সম্মান করিবে দান,
জয়শ্রীর এই পরিচয়।

এর পরেও রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং সমসাময়িক বিখ্যাত প্রায় সকল লেখকই লিখেছেন এই কাগজে। লিখেছেন স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলনকারী দেশপ্রেমে নিবেদিত বিখ্যাত সব রাজনৈতিক ব্যক্তিগণ। মেয়েদের শিক্ষা, উপার্জন ও স্বাবলম্বিতার কথা ভেবে দিপালী সংঘ প্রতিষ্ঠার পর পর-ই তিনি জয়শ্রী প্রকাশ আরম্ভ করেন। তবে বিপ্লবী দৃষ্টিকোণ থেকে কাগজটি বেরুলেও এই কাগজ কোন বিশেষ দলের মুখপাত্র ছিল না। এমন কি মেয়েদের কথা মনে রেখে এটি প্রকাশিত হলেও নারীপুরুষ নির্বিশেষে এখানে লিখতেন এবং বিষয়বস্তু নানা বৈচিত্র্যে ভরা ছিল।

জয়শ্রী প্রথম থেকেই সরকারী রোষানলে পড়ে। বিভিন্ন ছুঁতা ধরে সরকার বেশ কয়েকবার সাময়িকভাবে জয়শ্রীর প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই আবার পুনরায় বের হয় জয়শ্রী। শেষপর্যন্ত ১৯৩৫ সালে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় ঢাকা শহর হতে এটির প্রকাশনা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৩৮ সালে জুলাই মাসে পত্রিকাটির পুনরায় প্রকাশনা শুরু হয় কলকাতায়। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকাশনার সূচনাকে অভিনন্দন জানিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু লেখেন – “জয়শ্রী’র পুনরাবির্ভাবে আমি পরম সমাদরে সম্বর্ধনা করিতেছি। গত কয়েক বৎসর সমস্ত দেশের উপর দিয়া যে ঝড় বহিয়া গিয়াছে, “জয়শ্রী”র প্রতিষ্ঠাত্রীমণ্ডলও তাহা হইতে নিস্তার পান নাই। আজ সেই ঝটিকা শেষে দেশ আবার আত্মপ্রতিষ্ঠ হইতে সচেষ্ট। নূতন কালের, নতুন পরিবেশের উপযোগী চিন্তাধারা ও কর্মধারাও সন্ধান করিতেছে। জয়শ্রী দেশের এই পরমক্ষণে সেই আত্ম প্রতিষ্ঠার ও আত্মসন্ধানের সাধনাকে জয়যুক্ত ও শ্রীমণ্ডিত করুক ইহাই আমার নিবেদন।”

প্রিয় পত্রিকা জয়শ্রীকে বার বার এই রকম গলাটিপে হত্যা, আর বারবার তার নতুন করে উত্থানে সরোজিনী নাইডু জয়শ্রীকে ফিনিক্স পাখির সংঙ্গে তুলনা করে বলেন, যতই একে ভষ্মিভূত করা হোক না কেন, ফিনিক্স পাখীর মতো সে তার নিজের ছাই থেকেই আবার জেগে উঠবে।

সাহিত্য পাঠ ও সাহিত্যরচনা করা ছাড়াও লীলা নিয়মিত গান করতেন ও সেতার বাজাতেন। মা বাবা আত্মীয়স্বজনদের ক্রমাগত চাপেও গতানুগতিক বিয়ের পিড়িতে বসতে অস্বীকার করেন লীলা। অবশেষে ১৯৩৯ সালে ৪০ বছর বয়সে ছাত্রাবস্থা থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহপাঠী, সহকর্মী শ্রীসংঘের কমরেড অনিল রায়কে নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করেন লীলা এবং তখন থেকে লীলা রায় বলে পরিচিত হন।

দেশ ভাগের পরেও তিনি স্বামীসহ ঢাকাতেই নারীর উন্নয়নে কাজ করার জন্যে থেকে যাবার সংকল্প করেন। দেশবিভাগ, বিশেষ করে বাংলা বিভাজনের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন লীলা রায়। এই ব্যাপারে নেতৃত্বদানকারী শরৎ বসু, আবুল হাসিম, প্রমুখের সংঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন তিনি এবং প্রয়োজনীয় কাজ, যেমন গণসংযোগ, মতামত সংগ্রহ, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দেনদরবার ইত্যাদি করে যেতেন দিনের পর দিন। শরৎ বসু ও আবুল হাশিমদের সঙ্গে তিনি ও অনিল দিল্লী পর্যন্ত যান ভারত ভাগ, বিশেষ করে বাংলা ভাগ রোধ করার জন্যে। ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা দ্বিখন্ডিত হলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্য আর কোনোদিন আসবে না, এই বিশ্বাসের কারণে বাংলা ভাগ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন লীলা ও অনিল। তারপরেও অমোঘ ঘটনাটি যখন ঘটলোই, লীলা ও অনিল স্থির করলেন তাঁরা পূর্ববাংলাকেই তাঁদের কর্মক্ষেত্র বানাবেন। বিশেষত তাঁরা দুজনেই যেহেতু এই অঞ্চলেরই মানুষ এবং সারা জীবন তাঁরা পূর্ববাংলাতেই সমাজসংস্কারের ও রাজনৈতিক কাজ করেছেন। স্বাধীন দেশে জনগণের জন্যেও বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্যে এই পূর্ববাংলাতেই বিশেষত ঢাকায় গঠনমূলক রাজনীতি ও নারী শিক্ষাদানের কাজে সম্পৃক্ত হতে চেয়েছিলেনে তাঁরা। বলা বাহুল্য লীলা নাগের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষালয়ে তিনি নিজে প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষের আসনে বসে প্রতিদিন ক্লাশ নেওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক কাজ নিজের হাতে করলেও কখনো একপয়সা বেতন নেন নি। বরং স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্যে একটা বিশাল অঙ্ক তিনি বরাবর তাঁর পরিবার থেকে বিশেষ করে তাঁর পিতার কাছ থেকে নিয়েছিলেন। লীলার অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে কাজ করার ধারা অনুসরণ করে আরো অনেক শিক্ষকই বিনা বেতনে পড়াতে শুরু করেন। আর ছাত্রীরাও সবাই বিনা বেতনে স্কুলে পড়তো।

লীলা নাগ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন অকুতোভয় ও নিবেদিত নেত্রী ছিলেন। এজন্য বহুবার তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। বেশ কয়েকবার কারাবরণ করেন তিনি। দেশভাগের পরেও লীলা নাগ স্বামীসহ ঢাকায় থেকে যাবার ব্যাপারে মনোস্থির করলেও পাকিস্তানী সরকারের অত্যাচারে এবং বিশেষ করে তাঁকে ভারতের চর আখ্যা দিয়ে প্রচন্ড হেনস্থা করায় লীলাকে অবশেষে বাধ্য হয়ে স্বামী অনিল রায়সহ ভগ্ন হৃদয়ে ভারত চলে যেতে হয়। ইতোমধ্যে তিনি প্রায় এক ডজন প্রাইমারী স্কুল, দুটি হাই স্কুল ও তিনটি বয়স্ক মেয়েদের শিক্ষা নিকেতন খোলেন ঢাকায়। শুধু লেখাপড়া শেখানো নয়, মেয়েদের স্বাস্থ্যসচেতনতা ও পুষ্টি সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া, তাদের শরীর স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্যে এবং আত্মরক্ষায় দরকারী ও সম্ভাব্য শারীরিক শক্তি অর্জনের ও কলাকৌশল প্রয়োগের শিক্ষা দেবারও ব্যবস্থা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন নারীর নিজের স্বাবলম্বিতার জন্যেই তার আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেকেই যথাসম্ভব নিতে হবে। কংগ্রেস, দিপালী সংঘ এবং পরবর্তীকালে ফরোয়ার্ড ব্লক ছাড়াও আমরা জানি তিনি যুক্ত ছিলেন অনিল রায়ের বিপ্লবী দল শ্রীসংঘের সাথে। শ্রীসংঘে যোগদানের পর বিপ্লবী আন্দোলনেও তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে যান সর্বোচ্চ নেতৃত্বে। কিন্তু বিয়ের মাত্র তের বছরের মাথায় ১৯৫২ সালে অনিল মারা যান ক্যান্সারে। মানসিকভাবে বিধধ্স্ত লীলা তবু দেশের কাজে পিছপা হন না। ঢাকার অনুকরণে তিনি কলকাতায় মেয়েদের জন্যে কয়েকটি স্কুল ও একটি হোস্টেল খোলেন।

লীলা রায় নিঃসন্দেহে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও নারীশিক্ষায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী । দেশের স্বাধীনতা আনতে গিয়ে তাঁকে বহুবার দীর্ঘ কারাবাস করতে হয়। পুলিশের তাড়া খেয়ে কলকাতা গিয়েও তিনি সেখানে পূর্ববাংলা থেকে আসা সহস্র সহস্র উদ্বাস্তু শরনার্থীদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করার জন্যে সরকারের ওপর চাপ দিতে শুরু করেন। আগ্রহী ও দুঃস্থ নারী ও শিশুদের জন্যে এই বাংলাতেও ধীরে ধীরে আরো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

১৯৬৪ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কবল থেকে “বাংলা বাঁচাও” আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার অপরাধে তাকে আবার গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয় পশ্চিম বাংলার জেলে। ১৯৬৬ সাল থেকে লীলা নাগের স্বাস্থ্যহানি ঘটতে থাকে। দুই দুইবার সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন সংজ্ঞাহীন ও অচলাবস্থায় হাসপাতালে ভুগে ভুগে ১৯৭০ সালের ১১ জুন কলকাতায় এই বহুমাত্রিক কর্মে পটিয়সী মহিয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে।



নির্বাচিত সূচি
১) ‘লীলা নাগ পরিচিতি’, লীলা নাগ শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, (সম্পাদনা পরিষদ: অজয় রায় আহ্বায়ক, আনিসুজ্জামান, রঙ্গলাল সেন, মাহফুজা খানম, আবুল হাসনাত, মফিদুল হক) বিপ্লবী লীলা নাগ জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন পরিষদ, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৩
https://www-rokomari-com.translate.goog/book/3036/lila-nag-shotoborser-shroddhanjoli?_x_tr_sl=bn&_x_tr_tl=en&_x_tr_hl=en&_x_tr_pto=sc
২) সুহাসিনী দাস, লীলা নাগকে যেমন দেখেছি, গ শতবর্ষে১। ‘লীলা নাগ পরিচিতি’, লীলা নাগ শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, (সম্পাদনা পরিষদ: অজয় রায় আহ্বায়ক, আনিসুজ্জামান, রর শ্রদ্ধাঞ্জলি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৮-১১১
৩) দীপংকর মোহান্ত, লীলা রায় ও বাংলার নারী জাগরণ, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃ. ১৮পৃ. ১৭
৪) লীলা নাগ, আমাদের রবীন্দ্রতর্পণ, লীলা নাগ শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, পৃ২৭৭ – ২৮৩ (মুল রচনা “জয়শ্রী থেকে)
৫) লীলানাগ, সাহিত্য ও সমাজ,লীলা নাগ শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, পৃ ২৮৪ – ২৯০ (মুল রচনা জয়শ্রী থেকে)
৬). উমা দেবী, জয়শ্রেীঃ লীলা নাগ লীলা রায়, ‘লীলা নাগ পরিচিতি’, লীলা নাগ শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, (সম্পাদনা: অজয় রায়), পৃ ১২১-১২৪ ২০০৩
৭) মুনতাসীর মামুন, ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, অখণ্ড, অনন্যা, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ৪৮০-৪৮৪
৮) আশালতা সেন, সেকালের কথা, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০০৫, পৃ. ১৯
৯) সুফিয়া কামাল, একালে আমাদের কাল, সাজেদ কামাল সম্পাদিত, সুফিয়া কামাল রচনা সংগ্রহ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০২, পৃ. ৫৯২
১০) মালেকা বেগম, নারী ও সমাজঃ লীলা নাগ ও তাঁর জীবনসাধনা, প্রতিচিন্তা, ২৯ এপ্রিল, ২০১৮ মালেকা বেগম।
১১) রঙ্গলাল সেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী বিপ্লবী লীলা নাগ; ‘লীলা নাগ পরিচিতি’, লীলা নাগ শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, (সম্পাদনা: অজয় রায়) ২১-৩১, ২০০৩

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *