রম্যরচনা
চুমকি চট্টোপাধ্যায়
‘বুঝলি চানু, গুঞ্জামাসি আর হাসিমেসো! সে এক আজব জুটি! ‘পান মশলা মুখে দিয়ে নীচের ঠোঁট ওপরের দিকে তুলে (যাতে পিক গড়িয়ে না আসে) বলল রণো।
শনিবার একটু গভীর সন্ধের দিকে বন্ধুরা রণোদের বাড়ির রকে আড্ডা দিই। অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে যেতে যেতে প্রায় সাড়ে সাতটা, পৌনে আটটা বাজে। পরদিন রবিবার, অতএব সকালে অফিসের তাড়া থাকে না বলে শনিবার লেট সন্ধেকেই বেছে নিয়েছি আমরা।
মোটামুটি আট জনের গ্রুপ আমাদের। তবে প্রত্যেক শনিবার যে সবাই হাজির হতে পারে, তা নয়। জনা পাঁচেক আমরা রেগুলার যাই।
নানান আলোচনা হয় আড্ডায়। ঠাট্টা ইয়ার্কি তো মাস্ট। আজব ঘটনার স্টক সব থেকে বেশি রণেনের। শর্টে আমরা রণো বলে ডাকি।
সব বন্ধুদেরই নামের শর্ট ফর্ম আছে। আমি চয়ন, হয়ে গেছি চানু। বিকাশ হয়েছে বিকু। প্রদীপকে শর্টে পদু ডাকায় প্রবল আপত্তি জানিয়েছিল ও। শেষে ওর পদবী ধরে ‘ চন্দ ‘ বলেই ডাকা হয়। এসব নামের কারিকুরি ওই রণোর।
আজকের আড্ডায় রণো ওর মাসির বিয়ের গল্প শুরু করেছে। তার একটা কারণ হচ্ছে, বাচ্চুর মাসতুতো বোনের বিয়ে। পরের শনিবার ও আসতে পারবে না সেটা জানাতেই রণো শুরু করল ওর মাসির গল্প।
মাসির নাম গুঞ্জা। পাত্রের নাম হাসিরঞ্জন চক্রবর্তী।
যথেষ্ট বড় নাম তাই ছোট করে ‘ হাসি ‘।
‘ছেলের নাম হাসি?’ প্রশ্নটা করেই মনে হল একটু বোকা বোকা হয়ে গেল। লুজ বলে সপাটে ব্যাট চালালো রণো, ক্যান রে, ছেলেরা হাসে না বুজি? যে হাসে তার নাম হাসি অইতেই পারে।
রণোদের আদি বাড়ি ছিল ঢাকায়। মামাবাড়ি ফরিদপুর। যদিও দেশভাগের সময়ে চলে এসেছিল দুই পরিবার কিন্তু ভাষা ছাড়েননি কেউই। কাঠ বাঙাল ভাষায় কথা বলেন তারা। রণোর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা খাস কলকাতায় হলেও দিব্বি বাঙাল ভাষায় কথা বলতে পারে ও। এমনিতে ঝরঝরে কলকাতাইয়া ভাষায় কথা বললেও সময় সময় মাথায় বাঙাল ভাষার ভূত চাপে।
‘এদেশে জন্ম কর্ম আর ভাষা বলিস ওদেশের, কেনো রে?’ আমাদের প্রশ্নের জবাবে রণো বলে, ‘শোন, নদীতে যখন ভাটা চলে তখন পাড়ের কাদায় নৌকা যেমন সরসর কইরা আগোয়, বাঙাল ভাষাটা অইল গিয়া ঠিক ত্যামনে। পরিশ্রম লাগে না, বুঝলা? আর এখানকার ভাষা অইল জলে নৌকা বাওনের মতন, বৈঠা টাইনতে হয়, পরিশ্রম আসে।’
আমরা আর কথা বাড়াই না। কী যে বলল, মাথামুন্ডু বুঝলাম না কেউই। আমরা তো আর ডাঙায় নৌকো চড়িনি। রণোই বা কবে কোথায় চড়ল কে জানে।
‘গুঞ্জামাসি একটু সরল সাদাসিধে মানুষ, কেউ কেউ আড়ালে বলে “বোকা”। তাছাড়া, বয়েসও একটু বেশি হয়ে গেছিল।’ রণো আবার স্বাভাবিক ভাষায় ফিরেছে।
‘মাসি কেমনধারা মানুষ এই ঘটনা শুনলে বুঝতে পারবি। গুঞ্জামাসি কাঁদছে দেখে বাড়ির কেউ একজন জিগ্যেস করেছে, “কীরে, কাঁদছিস কেন?”
‘পড়ে গেছি।’ কাঁদতে কাঁদতে বলে মাসি।
‘কি করে পড়লি?’
গুঞ্জামাসি চেয়ারে উঠে আবার করে পড়ে দেখায় কী করে পড়েছে। দ্বিতীয় বারের চোট প্রথম বারের চেয়ে বেশি লাগে।
‘যাইহোক, কোনো এক ঘটকের মাধ্যমে সম্বন্ধ এসেছে। পাত্র খুবই ছোটখাটো একটা চাকরি করে তবে নিজস্ব বাড়ি আছে এবং সৌভাগ্যের কথা, তার তিনকুলে কেউ নেই।
‘এই হেন গুঞ্জামাসির শ্বশুরবাড়িতে লোকজন থাকলে যে কী কেলেঙ্কারি হতো তা কে জানে। তিনকুলে কেউ না থাকাটা আশীর্বাদ।’ রণো বলল।
‘মামারা তাই বেশি হালুমহুলুম না করে বিয়ে দিয়ে দিল। বিয়ের আয়োজন সব আমার মামাবাড়ি থেকেই করল। হাসিমেসোর বাড়িতে আয়োজন করার মতো কেউই তো নেই। তাই ঠিক হলো, বিয়ে আর বৌভাতের খাওয়া দাওয়া একসঙ্গেই করে দেওয়া হবে।
‘কত বছর আগের কথা?’ আমি জিগ্যেস করলাম।
বছর সাত আট হবে। আমি তখনও চাকরিতে ঢুকিনি। যাইহোক, বিয়েটা হলো। তিন চারজন পাড়ার লোক নিয়ে বিয়ে করতে এল হাসিমেসো।
‘আমরা ভেবেছিলাম, নামের মতোই হাসিখুশি হবে মানুষটা। ও হরি, মেসোর মুখে তো দেখি হাসি নাই। কথাও বলে না তেমন। কারণটা পরে বুঝেছিলাম।’
‘কি বুঝেছিলি?’
‘কইতাসি কইতাসি, সবুর কর মিঞা।’
রণোদের বাড়ি থেকে দশ পা গেলেই গোপালের চায়ের দোকান। প্রতি শনিবার চা এবং টিফিন কেক বাঁধা। রণো কী বুঝেছিল বলার আগেই মালপত্র এসে গেল। যেমন চা, তেমন কেক। সবাই গোগ্রাসে কেক গিলে চায়ে মন দিলাম।
‘বাসর ঘরেও হাসিমেসো কথা বলে না। আমরাও নাছোড়বান্দা। গান গাইতে হবে বলে বায়না করতে লাগলাম অল্পবয়সী যারা ছিলাম। আমাদের উৎপাতে বাধ্য হয়ে মেসো মুখ খুলল।’
‘আমি গা গা গা গান গাইতে পারি না।’ পানজর্দা খাওয়া কালচেমার্কা দাঁত দেখতে পেলাম। আর বুঝলাম হাসিমেসো তোতলা। সেরেছে! গুঞ্জা বলে ডাকবে কি করে! সে তো… যাকগে, মাসি বুঝে নেবে যা হবে।
রণোর কথা শুনে আমরা হাসতে শুরু করলাম। এখন তো স্ট্যামারিং সেরে যায় প্রথম দিকে চিকিৎসা করালে। হয়ত ততটা সচেতন ছিলেন না বা বাড়ির বড়রা গুরুত্ব দেননি।
‘মেসো গান গাইল না তাহলে?’
‘মেসোর মুখ শুকিয়ে আমসি দেখে আমরা আর জোরাজুরি করলাম না। পরদিন সকালে হাসতে হাসতে গুঞ্জামাসি মেসোর সঙ্গে চলে গেল।’
‘হাসতে হাসতে মানে? যাবার সময়ে তো মেয়েরা দেখেছি…।’
‘হ, দেখসস তো কান্দে। মাসি কান্দে নাই। আমার ধারণা রাত্রে মেসো মাসিরে নাম ধইরা ডাকসিলো। সেই যে মাসির হাসন শুরু অইসে সকালেও থামে নাই।’
রণোর কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়লাম আমরা।
‘আগো পোলাপান, অত হাইস্যো না। সাস্পেন্স অখনো বাকি আসে। শুন, ভয়ে গায়ের লোম খাড়াইয়া উঠবনে।’
ও বাবা, রণো বলে কী! তাহলে কি খুন খারাপির কেস নাকি? নিমেষে সবাই চুপ করে গিয়ে রণোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
‘বউভাতের পর্ব নেই, সব তো একদিনেই মিটে গেছে। মা গুঞ্জামাসিকে কানের দুল না কি একটা দিয়েছিল আর মেসোর জন্য শার্ট প্যান্টের পিস কিনে রেখেছিল দেবে বলে। সেটা দিয়ে ওঠার স্কোপ পায়নি বা তালেগোলে ভুলে গেছিল হয়তো।
‘বিয়ের দুদিন বাদে আমাকে ধরে বসল মা। মাসির বাড়িতে গিয়ে জিনিসগুলো দিয়ে আসার জন্য। আমিও ভাবলাম, যাই, দেখে আসি মাসির নতুন বাড়ি।
‘বেলগাছিয়ায় হাসিমেসোর বাড়ি। পৌঁছলাম সেখানে। বাড়িটা খুব পুরনো না হলেও দেখে বুঝলাম রঙটঙ হয় না অনেককাল। কড়া নাড়তেই গুঞ্জামাসি এসে দরজা খুলে দিল। আমাকে দেখে বেজায় খুশি।
‘বেশ অগোছাল অবস্থা ঘরের। মেসো একা মানুষ থাকত, অগোছাল তো হবেই। মাসি এবার গুছিয়ে গাছিয়ে নেবে।
‘মেসো কি অফিসে?’
‘হ্যাঁ, সাড়ে ছটা থেকে সাতটার মধ্যে ফেরে। তুই চা খাবি তো?’
‘তা খেতে পারি। মাসি, আগে এইগুলো নাও। মা পাঠিয়েছে মেসোর জন্য।’
‘গুঞ্জামাসি খুশি হয়ে প্যাকেট নিল। চা আর বিস্কুট খেয়ে উঠব উঠব করছি, পেটটা গুড়গুড় করে উঠল, বুঝলি। দুপুরে চিংড়ি মাছের ঘিলুর তরকারি দিয়ে একগাদা ভাত খেয়েছিলাম। অন্যদিনের চেয়ে বেশি। এই তরকারিটা আমার হেব্বি পছন্দের ছিল। এখন আর মাল পাওয়াই যায় না।
‘ভাবলাম, বাসে এতটা ফিরব, কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেলে মুশকিল। মাসিরই তো বাড়ি, সেরেই নিই।’
চন্দ বলে উঠল, ‘এই আরেক কাপ করে চা বলে আসি, আমি খাওয়াব। একটু পজ দে রণো।’
সাসপেন্সের কথা বলায় আমাদের কৌতূহল চূড়ান্ত। কী এমন ঘটেছিল যে, রণো ওই শব্দটা ব্যবহার করেছে। ইতিমধ্যে চন্দ চলে এলো চা আর লেড়ো বিস্কুট নিয়ে। রণো শুরু করল।
‘মাসিকে বললাম, বাথরুম যাব। মাসি বলল নিচের বাথরুমটায় খুব পা পিছলায়, তুই ওপরের বাথরুমে যা।’
‘আমি ওপরে উঠলাম। ঘরের পাশেই বাথরুম। ঢুকে পড়লাম। কাজ সারলাম। কমোডের ফ্ল্যাশ টিপতেই চাবিটা খুলে হাতে চলে এল। ভাঙা। মেরেছে! ফ্ল্যাশ তো হল না। কী করব এখন?
‘বালতি করে জল ঢালতে হবে ভেবে ট্যাপের নিচে তাকালাম। ওখানেই তো বালতি থাকার কথা। নেই। ছোট বাথরুম, এক নজরেই সবটা দেখে নেওয়া যায়। কোত্থাও বালতির চিহ্ন নেই। এবার আমি কি করব! ‘
‘গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল। কানের পাশ দিয়ে ঘাম গড়িয়ে নামতে শুরু করেছে। জামাকাপড় রাখার রডে একটা পুরনো গামছা ছাড়া আর কিছুই নেই। জীবনে ভগবানকে ডাকিনি, সেই মুহূর্তে স্মরণ করলাম।
মাসিকে ডেকে বালতি দিতে বলব ভাবতেই মনে হল আমি নিজে কি অবস্থায় আছি। জামাকাপড় পরারও উপায় নেই। হাতঘড়িতে সাতটা বাজতে দশ। হাসিমেসোর গলা পেলাম নীচে। ভাবছিলাম চিৎকার করে মাসিকে ডাকি। বলি এটা একটা বসত বাড়ির বাথরুম! তোমরা থাকো কি করে? চেপে গেলাম। নতুন কুটুম, মেসো কী ভাববে!’
‘কী করে উদ্ধার পেলি ওই পরিস্থিতি থেকে?’ একসঙ্গে সবাই প্রশ্ন করি।
‘সামনের শনিবার বলুম, এখন ওসব কওন ঠিক না।’ কিছুতেই রণো সেদিন আর কিছু বলল না।
এক সপ্তাহ ধরে মাথার মধ্যে পাক খেতে থাকল রণো কীভাবে বেরলো সেই ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে সেই চিন্তা। এই করতে করতে পরের শনিবার এসে গেল। অতি উৎসাহে সেদিন একটু আগেই পৌঁছে গেলাম রণোর ঠেকে।
আমাকে দেখে রণো হেসে বলে উঠল, ‘হাগনের গপ্পো শুনবার কী তাড়না দেখো, হেহে, পোলায় আইস্যা পড়সে।’
‘আসব না তো কী, তুই যেমন বদমাস। এটা কি অঙ্কের ক্লাস নাকি যে প্রবলেম সলভ করবার জন্য এক সপ্তাহ সময় দিবি? বল শিগগির, কী করেছিলি সেদিন। নাকি ওই অবস্থাতেই জামাকাপড় পরে বাড়ি ফিরেছিলি?’
ততক্ষণে বাকিরাও এসে গেছিল। সবাই মিলে কামড়ে ধরলাম রণোকে।
‘ওই গামছা যেটা ঝুলছিল, আমি সেই গামছা ল্যাঙোটের মতো করে পরে তার ওপর প্যান্ট চড়ালাম। জামা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এসেই “মাসি, বাথরুমে কাঁকড়া বিছে…” বলে বিকট চিৎকার জুড়লাম।‘
‘মাসি তখন রান্নাঘরে। হাসিমেসো প্রবল ভয় পেয়ে ” গু গু গু গু ” করেই চলেছে। আমি বললাম, “মেসো, শিগগির আমাকে একটা বালতি দিন, বিছেটাকে বন্দী করি।”
ততক্ষণে মাসি সেখানে এসে পড়ে একটা হ্যান্ডলহীন প্লাস্টিকের বালতি হন্তদন্ত হয়ে আমাকে দিয়ে গেল। আমি সেটা নিয়ে ধাঁ করে সেঁধিয়ে গেলাম হাসিমেসোর অ্যান্টিক বাথরুমে। তারপর ট্যাপের তলায় বালতি বসিয়ে নব ঘোরালাম। ফিস-স-স -ফিস ফিস আওয়াজ করে দু তিন ফোঁটা জল ফেলে তিনি স্তব্ধ হলেন।’
আমরা ঢোঁক গিলতে ভুলে গেছি তখন। মনে হচ্ছে কোনো রুদ্ধশ্বাস সিনেমার গল্প শুনছি। যথারীতি সময়মতোই চা আর কেক এসে গেছে কিন্তু আমরা হাতে নিয়ে বসে আছি।
‘কলে জল নেই?’ ঢোঁক গিলে চন্দ জিগ্যেস করল।
‘সেটাই কারণ ছিল হয়তো, কিন্তু আমি আর পারছিলাম না। কেন এলাম ভেবে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল। কমোড ঢাকা দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
‘নীচে নেমে দেখলাম মেসো চেয়ারে বসে আছে আমারই অপেক্ষায়। আমাকে দেখে বলল, “এসো, বো বো বো বো…”। আমি কোনো সময় না দিয়ে বললাম, “বিছেটাকে বন্দী করতে পারিনি, বালতি জোগাড় করতে করতে সে পালিয়েছে বা কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। আর একটা কথা, কাল রাতে মনে হয় আপনাদের বাড়ি চোর এসেছিল। বাথরুম নোংরা করে গেছে। দেখে নেবেন। আমি চললাম।’
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
দারুণ। খুব মজার গল্প।