ফিচার
সুপ্রিয় চৌধুরী
স্বপ্নের মতো ইশকুলবাড়ি
চন্দ্রবিন্দুদের কী ছিল জানা নেই, তবে এই ছেলেটার একটা ছিল। জিতেন্দ্রনারায়ণ মেমোরিয়াল নার্সারি স্কুল। একদম রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে বড় রাস্তার ওপর। সারা দুনিয়ার খবর জানা নেই কিন্তু ওরকম একটা ইশকুল সে সময় গোটা দেশে ছিল না, হলফ করে বলতে পারি সে কথা। আর সেটা ওই শীত শীত পাহাড়ি কনভেন্ট আর আজকাল হালফিলের এইসব পাবলিক ইশকুলটিশকুলগুলোর কথা মাথায় রেখেই।
এই অবধি পড়েই প্রায় সবারই, বিশেষত যাঁরা জিতেন্দ্রনারায়ণে পড়েননি, মনে হতে পারে মালটা সক্কাল সক্কাল বাবা ভূতনাথের মহাপ্রসাদ প্রাপ্ত হয়নি তো? তাদের এহেন মনোভাবকে যথোচিত সম্মান জানিয়েও বলি, ধীরে রজনী ধীরে। ধৈর্যচ্যুতি ঘটার আগেই জিতেন্দ্রনারায়ণ সম্পর্কিত আমার রানিং কমেন্ট্রিটা একটু শুনে নিন চট করে। তারপর না হয় এহেন সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন। ফলে সময় নষ্ট না করে চলে আসা যাক বর্ণনায়।
বড়রাস্তার ওপর ইশকুলে ঢোকার মুখেই অর্ধচন্দ্রাকৃতি লোহার আর্চ গেট। তারপর দু’পাশে সুড়কি লাল রঙের দীর্ঘ করিডর। একদম শেষপ্রান্তে বেশ খানিকটা, এই গজদশেক মতো অ্যাজবেসটাসের শেড। অবশেষে বিশাল কোলাপসিপল গেটের ওপারেই সেই ওয়ান্ডারল্যান্ড! না, লুই ক্যারল বা অ্যালিসের নয়, একান্তভাবে আমার। গেটের দু’পাশ বেয়ে নুইয়ে পড়া বোগেনভিলিয়ার ঝাড়। গাঢ় লালচে গোলাপি ট্রেসিং পেপারের মতো পাতলা পাপড়িওয়ালা ফুল বারোমাস। ডানপাশে প্রিন্সিপালের দোতলা বাড়ি। একইরকম সুড়কি লাল। দরজার একধারে মিনিয়েচার ফুটবল সাইজ ফলের ভারে নুইয়ে পড়া বাতাবিলেবু আর একদম দরজা বেয়ে ওঠা আরেকটা লতানে গাছ। চকচকে কালচে মেরুন ছোট ছোট ফল। অপরূপ সুন্দর দেখতে। কৌতুহলবশে একবার ছিঁড়ে মুখে দিয়েছিলাম একটা। ভয়াবহ টক! আর জীবনে ও পথ মাড়াইনি কোনোদিন।
প্রিন্সিপাল বাড়ির পাশ ঘেঁষে চলে যাওয়া লাল সুড়কির পথ, দুপাশে ত্যাড়চা এক ইঁটের বর্ডার, একটু এগিয়েই দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে ইংরিজি ‘ওয়াই’ অক্ষরের মতো। যার বাঁদিকের ফলাটা গিয়ে শেষ হয়েছে স্কুলের গ্যারেজে। সুবিশাল চত্বরে দাঁড়ানো ঝকঝকে তিনটে স্কুল বাস। মার্ডগার্ডের ওপর চকচকে লোহার ফলকে ইংরিজিতে লেখা— ডজ।
গ্যারেজের পেছনেই দোতলা হাসপাতাল। স্কুলের নিজস্ব। যার একটা অংশ একান্তভাবেই ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব প্রয়োজনে। স্কুল চলাকালীন কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে। একটা স্কুলের নিজস্ব প্রয়োজনে একটা হাসপাতাল। সেসময় এ দেশের আর কোনো ইশকুলে ছিল অথবা আজও আছে কি?
অন্যদিক সুড়কি বেছানো ওয়াই পথের আর একটা ফলা সোজা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত বিশাল প্রার্থনা ভবনের দরজায়। ঢুকেই হাতের ডানকোনে ভবনের আকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো। কাঁটায় কাঁটায় দশটায় পিয়ানোয় এসে বসবেন চন্দ্রিকাদি। ইন্দিরা গান্ধী প্যাটার্ন বয়েজ কাট চুল। পাটপাট তাঁতের শাড়ি। থ্রি কোয়ার্টার হাতা ব্লাউজ। প্রখর ব্যক্তিত্ব। পাড়ায় অত্যন্ত অভিজাত এক ব্রাহ্ম বাড়ির মেয়ে। স্লিম, ধারালো খরখরে চেহারার সুন্দরী। মুখে প্রায় মিলিয়ে যাওয়া দু’-চারটে গুটিবসন্তের দাগ কি? একটু হাস্কি আর অসম্ভব সুরেলা গলা। নাকের ডগায় অর্ধ ডিম্বাকৃতি চশমা। এ স্কুলে জাতীয় সংগীত নেই। জনগণমন নেই। বন্দেমাতরম নেই। হও ধরমেতে ধীর নেই। তবে রবিঠাকুর আছেন। সর্বত্র। পিয়ানোর রিডে অলৌকিক অঙ্গুলিচালনা আর চন্দ্রিকাদির ঐশ্বরিক হাস্কি কন্ঠে পালটে পালটে যাবেন রোজ রোজ। ‘তাই তোমার আনন্দ’, ‘আমায় যে সব দিতে হবে’, ‘এই লভিনু সঙ্গ তব’… আরও কত, কত সব প্রার্থনা সঙ্গীত। সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গলা মেলাবে লাল সাদা ইউনিফর্মের কচি কচি গলাগুলো।
মিনিটপাঁচেক বাদে প্রার্থনা শেষ সেদিনের মতো। লাইন দিয়ে ইশকুল বাড়িতে ঢোকবার পালা এবার। হলের একদম শেষপ্রান্তে উইংসে পর্দা ঠাঙানো মঞ্চ। রবীন্দ্র জয়ন্তী, আরো সব অনুষ্ঠানের জন্য। ওখানেই পাতা সার সার চেয়ারে সেসব দিনগুলোয় ভরে যাবে হলঘর। স্টেজের পাশ ঘেঁষে একটা বড়সড় দরজা। সেটাই মূল স্কুলবাড়িতে ঢোকার পথ। চন্দ্রিকাদির গলায় একটা বড়সড় ফুটবল রেফারি মার্কা হুইসিল। সেই কম্যান্ডের তালে তালে ক্লাসের পর ক্লাস সেঁধিয়ে যাওয়া ভেতরে।
এল শেপের দোতলা স্কুলবাড়ি। একইরকম সুড়কি লাল রঙ। বারান্দার টাঙানো, মিকি মাউস, পিনোশিও, কাতুকুতু বুড়ো আর হুঁকোমুখো হ্যাংলার দল। খাঁচায় খাঁচায় খরগোশ, গিনিপিগ, বিলিতি ইঁদুর, লক্কা পায়রা। বারান্দার গা ঘেঁষেই বাগান আর খেলার মাঠ। বাগানের ঘাস সবুজ কার্পেটের মত ছাঁটা। কত যে গাছ ফুল আর ফলের। খেলার মাঠে স্লিপ, ঢেঁকি, মেরি গো রাউন্ড, রাইডিং কিউব। হুবহু ইওরোপের কোন কান্ট্রিসাইডের ল্যান্ডস্কেপ যেন। এবার আমরা সবাই কণাদি, খনাদি, স্মৃতিদি, শিবানীদি, মাধবীদি, বাসন্তীদিদের জিম্মায়। শুরু হবে ক্লাস। দুটোর কথা বলতেই হবে তার মধ্যে। গান আর ঘুম। গানের ক্লাস ফের সেই চন্দ্রিকাদি। এবার আর প্রার্থনা সঙ্গীত নয়। তার বদলে ‘হিমের রাতে ওই গগনের’, ‘হা রে রে রে’, ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির’, এরকম আরও অনেক কিছু। এরপর ঘুমের ক্লাস। আক্ষরিক অর্থেই। পাক্কা দেড়ঘণ্টা। দুপুর সাড়ে বারোটায় টিফিনের পরই পৌঁছে যেতে হবে দোতলার ওই বিশাল হলঘরটায়। টানা হলঘর জুড়ে পাতা সার সার মিনি শতরঞ্চি আর বালিশ। ধপাধপ শুয়ে পড়তে হবে একটুও সময় নষ্ট না করে। সে ঘুম পাক আর নাই পাক। এতটুকু চোখ পিটপিট মানেই স্মৃতিদির বোম্বাই ধমক— ‘অ্যাই! চোখের পাতা সেলাই করে রেখে দেব অ্যাকেবারে!’
আজকাল শুনেছি বিদেশে বড় বড় কর্পোরেট হাউসগুলোর আধিকারিকদের জন্য এ ধরনের ‘সিয়েস্তা’ বা ‘ন্যাপ’, থুড়ি ঘুমের সেশন বরাদ্দ থাকে। সেই পঞ্চাশ ষাটের দশকে কলকাতা শহরের বুকে এরকম একটা ভাবনা ভেবেছিলেন ইশকুলের প্রিন্সিপাল মৃন্ময়ী দেবী। আমরা সবাই যাঁকে ডাকতাম দিদিভাই বলে। তবে তাঁর ভাবনার অভিনবত্বের এখানেই শেষ নয়। স্কুলে ছেলেমেয়েরা যাতে সেরা পুষ্টিকর খাদ্যটি পায়, সে জন্য বাড়ি থেকে টিফিন আনায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল কর্তৃপক্ষের তরফে। আর সে কারণেই ইশকুলের পিছনে একফালি ফাঁকা জমিতে গোয়াল বানিয়ে পোষা হত দুটি হৃষ্টপুষ্ট জার্সি গাই। সকালে দোয়া খাঁটি দুধ আর একবাটি মুড়ি। এই ছিল ছাত্রছাত্রীদের নিত্যরোজের টিফিন। ভালো লাগুক আর নাই লাগুক, খেতেই হবে। কোন ওজর-আপত্তি চলবে না। তার আগে পরমপিতার উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সমবেত প্রার্থনা। প্রখর গ্রীষ্মে প্রতিটি ক্লাসের জানলায় টাঙানো হত খসখস। ইশকুল শুরুর আগে আর টিফিন টাইমে পিচকিরি দিয়ে ভেজানো হত নিয়মিত। খসখস ঝোলানো হত গরুর গোয়ালেও। সঙ্গে জাম্বো সাইজ দুটো স্ট্যান্ড ফ্যানের বোঁ বোঁ হাওয়া। কেষ্টর জীবদের যাতে কষ্ট না হয়।
প্রিন্সিপাল মৃন্ময়ী দেবী। অভিজাত চেহারা। পরনে সর্বদা ধবধবে সাদা তাঁতের শাড়ি। চোখে ফিনফিনে সোনালি ফ্রেমের চশমা। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত এবং ধনী ব্রাহ্ম পরিবারের অকালবিধবা। একমাত্র পুত্রসন্তান জিতেন্দ্রনারায়ণকেও অকালে হারিয়ে ছুটে বেড়িয়েছিলেন ইউরোপের দেশে দেশে। সেই অভিজ্ঞতা আর ব্রাহ্ম ঘরানার সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, দুয়ের মিশেলে গড়ে তুলেছিলেন এই স্কুল। আমার ছেলেবেলা। আমার জিতেন্দ্রনারায়ণ!
এহেন জিতেন্দ্রনারায়ণে এই অধমের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য স্মৃতি বলতে দু’টি, প্রেম এবং পেটখারাপ। দুঃখজনকটির প্রসঙ্গেই আসি প্রথমে। তখন নার্সারি টু কি থ্রি। আগের দিন বিকেলে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের উলটোফুটে লেডিজ পার্কের সামনে দুনিয়া সেরা আলুকাবলিটা বোধহয় একপাতার জায়গায় দু’-পাতা হয়ে গেছিল। পরদিন সকাল থেকেই পেটটা একটু একটু কেমন কেমন। সেটা চেপেই ইশকুলে। ঘন গোদুগ্ধে সমৃদ্ধ টিফিনের পর ঘুমের পালা সাঙ্গ করে ক্লাসে এসে বসতেই বুঝে ফেলেছিলাম আর রোখা যাবে না। কি দুর্মতিতে কে জানে, ব্যাগ খুলে সহজ পাঠ প্রথম ভাগটা বের সবার অলক্ষ্যে… কেন যে মনে হয়েছিল বহুজনের বিপদতারণ রবিঠাকুর আমাকেও এহেন বিপদে রক্ষা করতে পারবেন, কে জানে? সেটা হয়নি স্বাভাবিকভাবেই। রবিঠাকুরেও না। একটু বাদেই ক্লাস কাঁপানো ভয়াবহ নারকীয় পূতিগন্ধ! চেয়ারের দু’কূল ছাপিয়ে নির্গত তরল, মাধবীদির গগনভেদী আর্তনাদ— ‘এ ম্যাগো! মাখোওওন…!’
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ছুটির বেল। আমাকে নিতে এসে এক অসামান্য দৃশ্যপটের সম্মুখীন হয়েছিলেন আমার পিতৃদেব শ্রী অমিত চৌধুরী। লম্বা করিডর ধরে আমার বাপান্ত করতে করতে শৌচালয়ের দিকে এগোচ্ছে ইশকুলের পুরোনো আয়া, ভয়ংকর খিটখিটে স্বভাবের মাখনমাসি। ডানহাতে নাকে চাপা দেওয়া শাড়ির আঁচল। বামহস্তের তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের একদম শেষপ্রান্তে চিমটি কেটে ধরা বর্জ্য লতপত সেই সহজপাঠ। পেছনে পেছনে বলিপ্রদত্ত ছাগশিশুর ন্যায় অনুসরণরত এই অধম। ওষুধ, সাবু, পিওরিটি বার্লি, সঙ্গে পেঁপে, কাঁচকলা সহযোগে ভয়াবহরকম অখাদ্য পাতলা শিঙি মাছের ঝোল। মাতা অঞ্জলি চৌধুরানীর ভুবনবিখ্যাত ধমক এবং রামকিলের ভয়ে সেটাই সোনামুখ করে গিলতে বাধ্য হওয়া… এই নিষ্পাপ বালকের আগামি কয়েকদিন যে মোটেই সুখে কাটেনি সেটা বলাই বাহুল্য।
এবার প্রেম। আমার লেখার শুরুতেই পাঠকরা সম্ভবত বুঝে ফেলেছেন এ প্রতিষ্ঠানে ব্রাহ্ম সংস্কৃতি, বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথ এক সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত। আজ যারা ফেসবুক বা বইয়ের পেছনের মলাটে আমার বদখত কাটিং মুখমণ্ডলখানি দেখেন তাঁদের অবগতির জন্য জানাই, ওই বয়েসে চেহারাটা নেহাত পাতে না দেবার মতো ছিল না। ফলে ইশকুলের নাটকে মোটামুটি লিড রোল জুটেই যেত একখানা। আর জিতেন্দ্রনারায়ণের রবীন্দ্রজয়ন্তী মানে তো একটা হুলুস্থুলু কাণ্ড যাকে বলে আর কী। একমাস আগে থাকতে গান আর নাটকের মহলা, বাসন্তীদি, শিবানীদি, চন্দ্রিকাদিদের ব্যস্ততা একেবারে তুঙ্গে। কুচোকাঁচাগুলোকে এর মধ্যে গড়েপিটে নিতে হবে যে।
আজও মনে আছে, সেটা ছিল জিতেন্দ্রনারায়ণে আমার শেষ বছর। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা। আমি অর্জুন। বিপরীতে চিত্রাঙ্গদা অনুশীলা (নাম সামান্য পরিবর্তিত। একই ক্লাস। তিন বেঞ্চির ব্যাবধান মাত্র। বড় বড় আর টানা টানা দুটো চোখ। গোল ফেসকাটিং হুবহু কাবেরী বোস। অনুষ্ঠানের দিন স্টেজে তাথৈ পায়ে ঝড় তুলে ‘তুমি অর্জুন!’ বলে যেভাবে ধেয়ে এসেছিল, বুকের মধ্যে দিয়ে সার্কুলার রোডের বড়রাস্তায় ভোর পাঁচটার ফার্স্ট ট্রাম ছুটে চলে গেছিল একেবারে। ফলে পরদিন ঘুমের ক্লাসে পাশাপাশি শতরঞ্চিতে স্মৃতিদির ঈগল নজর এড়িয়ে যা হয় হবে বলে বিবাহের প্রস্তাবটা দিয়েই ফেলা গিয়েছিল ঘেমেনেয়ে কোনোমতে। জবাবে ‘অসভ্য কোথাকার, এক্ষুনি দিদিকে বলে দিচ্ছি!’ বলে চেঁচিয়ে ওঠার বদলে বন্ধ চোখে কীরকম অদ্ভুত একটা হাসি। আরও উল্লেখযোগ্য যেটা, তিন বেঞ্চির দূরত্বটা ঘুচে গিয়েছিল পরদিন থেকেই।
তারপর কেটে গেছে ষাট বছরেরও বেশি সময়। সেদিন কোন একটা কাজে যাচ্ছিলাম ও পথ দিয়ে। রাস্তার ওপর আমার স্বপ্নের মতো সেই জিতেন্দ্রনারায়ণ ইশকুল! জরাজীর্ণ, সারা শরীরে ক্ষয়ের ছাপ স্পষ্ট। শুনেছিলাম মৃন্ময়ীদেবীর জীবদ্দশাতেই, ইউনিয়ন, কর্মী বিক্ষোভ ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যায় ধুঁকছিল সেই ৭০-এর শেষভাগ থেকেই। ওঁর মৃত্যুর পর তো বন্ধই ছিল দীর্ঘকাল। পরবর্তীতে খুললেও সে সুদিন আর ফেরেনি কখনওই। বিয়ে, শ্রাদ্ধ, নানাবিধ অনুষ্ঠানে ভাড়া-টারা দেয়া হত অর্থাভাব মেটাতে। ওরকমই একটা অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলাম বছর আটেক আগে। রঙচটা দেয়াল। সিমেন্টের চলটা উঠে গিয়ে ইঁটের দাঁত বেরিয়ে পড়েছে জায়গায় জায়গায়। চুনকামের আদর বহুকাল মাখা হয় না গায়ে, বোঝা যাচ্ছিল পরিষ্কার। স্কুলের সেই হাসপাতাল এখন এক দাপুটে রাজনৈতিক নেতার নার্সিং হোম। চুপিচুপি সবার নজর এড়িয়ে উঠে গেছিলাম দোতলায়। হাতের ডানদিকে একদম শেষে ওই তো সেই ঘুমের ক্লাস। পা টিপে টিপে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম সামনে। তালাবন্ধ দরজা। তালার গায়ে মরচে। এর ওপারেই তো সেই যে একদিন… স্মৃতিদির নজরের সার্চলাইট এড়িয়ে…।
জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘জীবন গিয়েছে চলে…’ ইউরোপিয় ধাঁচের বাগান, প্রার্থনা গৃহ, গ্র্যান্ড পিয়ানো, দেয়ালে মিকি মাউস, পিনোশিও, হুঁকোমুখো হ্যাংলা, খাঁচায় খরগোশ, পায়রা, বিলিতি ইঁদুর, ছোট ছোট চেয়ার, বেঞ্চি, শতরঞ্চি, বালিশ, চন্দ্রিকাদি, বাসন্তীদি, শিবানীদি, কণাদি, খনাদি, স্মৃতিদি, মাধবীদি, ঘুমের ক্লাস, চিত্রাঙ্গদা আর অনুস্মৃতি নিয়ে দীনেন্দ্র স্ট্রিটের ওপর আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার স্বপ্নের ধ্বংসাবশেষ!
টল রয়্যাল চুন্নি
পাওয়া যেত দীনেন্দ্র স্ট্রিটে অমিয় কাকুর ‘অম্বস’ (অমিয় এবং বোসকে সংক্ষিপ্ত, একইসঙ্গে যুক্তাক্ষরে পরিণত করে) বিপনি, শ্রীমানি বাজারে শশর দোকান আর সুকিয়া স্ট্রিটে কালু ঘোষ লেনের উল্টোফুটে চার সিঁড়ি উঁচু বোস অ্যান্ড কোংয়ে।
এই অবধি পড়েটড়ে যাদের কাছে ব্যাপারটা বেজায় ধাঁধাটে মতো ঠেকছে, তাঁদের অবগতির উদ্দেশে জানাই, এগুলো সব গুলির নাম। কাঁচের গুলি। সে সময় জোর খেলা হত পাড়ায় পাড়ায়।
এর মধ্যে রয়্যাল। সাইজে বড়সড় একটা আঁশফলের মতো। বহিরাঙ্গ টলটলে স্বচ্ছ। ভেতরে আঁকাবাঁকা অপূর্ব সব রামধনু রঙা ডিজাইন। এরপর চুন্নি। আরও মিনিয়েচার সাইজ। একটা নকুলদানার সমান বড়জোর। একইরকম নকশাদার।
সবশেষে টল। আকারে গুলিজগতের সম্রাট। টেবিল টেনিস বলের চেয়ে একটু ছোট। চুন্নি বা রয়্যাল রঙবেরঙের হলেও টল কিন্তু অলওয়েজ ইন সিঙ্গল কালার। কালো, গাঢ় বাদামী অথবা নীল। দামও সবচাইতে বেশি। খেলায় ব্যবহার হতে দেখিনি কোনদিন। কিন্তু কোনো খেলুড়ের কাছে একটা টল থাকা মানে হেব্বি রেলা বা প্রেস্টিজের ব্যাপার সে সময়। একধরণের স্ট্যাটাস সিম্বল। খেলার ফাঁকে ফাঁকে এক-আধবার টলটা পকেট থেকে বের করে হালকা হালকা নাচাতে হবে শুধু। তাতেই বাকি গুলিবাজরা যাকে বলে মাত অ্যাক্কেবারে!
এই গুলি খেলার ব্যাপারটা ছিল মোটামুটি দু’ভাগে বিভক্ত। খাটান আর জিততাল। মাটিতে ইঞ্চিখানেক গোলপানা একটা গর্ত খুঁড়ে গল্ফ কোর্স স্টাইলে একটা পিল বা পটমতো। খেলাটা মূলত দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে। পিলের প্রায় হাতপাঁচেক দূর থেকে ডানহাতের বুড়ো আঙুল শক্ত করে মাটিতে চেপে দুই তর্জনীর চাপে ছিটকে দিতে হবে গুলিকে। যার গুলি পিলের সবচেয়ে কাছাকাছি যাবে সে জয়ী। তখন তার কাজ হবে পিলের একদম সামনে গিয়ে গুলি টিপ করে বসে থাকা। অন্যদিকে পরাজিত পক্ষের তখন একমাত্র লক্ষ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জয়ী পক্ষের টিপ এড়িয়ে নিজের গুলিকে পিল করা মানে গর্তটার মধ্যে ফেলে দেওয়া। কিন্তু সে কাজটা মোটেই সোজা নয়। কারণ পিলের কাছে শিকারি বাঘের মত ওঁৎ পেতে বসে থাকা জয়ী বিপক্ষ। যতবার কাছে আসার চেষ্টা চালানো হবে ততবার নিখুঁত টিপের মারে গুলি ছিটকে যাবে দূরে। ফলে আবার ‘ফির রাম সে’ বলে শুরু পিলের কাছাকাছি আসা এবং অন্তিমে পিল করার প্রচেষ্টা। শুধুমাত্র বিপক্ষকে খাটিয়ে চলার নির্দোষ আনন্দেই যদি খেলাটা চলে তাহলে তার নাম খাটান বা মিততাল। আর সেটা যদি স্বার্থগন্ধী হয় মানে আঙুলের মারে ছিটকে যাওয়া বিপক্ষের গুলিটি জয়ী পক্ষের পকেটে ঢুকে যায় তাহলে তার নাম জিততাল।
এখানে জানিয়ে রাখা দরকার, সেই সময় প্রতিটি পাড়ায় এই জিততালকে কিন্তু জুয়ার সমকক্ষ অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হত। ফলে পাড়ার সিনিয়ারদের চোখে পড়ে গেলে চাঁদি গরম করা রামগাঁট্টা, নিদেনপক্ষে ‘জুয়ো খ্যালা হচ্চে উল্লুক!’ বলে তেড়ে একটা বোম্বাই ধমক! পাড়ার এইসব স্বঘোষিত অবিভাবকরা একঝলক খেলুড়েদের চোখের নড়াচড়া বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখেই বুঝে ফেলতেন খেলাটা কী চলছে, মিততাল না জিততাল। কারণ তাঁদেরও সবারই বাল্যকাল নামে একটা ব্যাপার ছিল এবং তাঁরাও সবাই জিততাল খেলেই বড় হয়েছেন। বর্তমানে পাড়ার নীতি পুলিশের ভূমিকায়।
অন্য খেলাটার নাম চার-এক। পাড়ার অ্যাকসেন্টে— চ্যারাক। এখানে কোনো মিততাল নেই, পুরোটাই জিততাল। এ খেলার ময়দান বা ফিল্ড বলতে বেজায় পুরোনো কোনো ইঁটের দাঁত বের করা বাড়ির দেয়াল। সেই দেয়াল ঘেঁষে একটা চৌকনা খোপ কাটা হবে। একপক্ষ সেই খোপে ছড়িয়ে দেবে চারটি (কখনও ছয়) গুলি। তারপর কোন একটি নির্দিষ্ট গুলির দিকে আঙুল দেখিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে আহ্বান জানাবে লক্ষ্যভেদ করতে। এখানে কিন্তু ওই দুই তর্জনীর কৌশলটা নেই। তার বদলে শুধুমাত্র দক্ষিণ হস্তের মধ্যমা, তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলীকে কাজে লাগিয়ে তীরবেগে ছুঁড়ে মারতে হবে লক্ষ্যবস্তুকে তাক করে। মারের ধাক্কায় গুলি যাতে বেশিদূর ছিটকে না চলে যায় সেজন্যই পেছনে ওই দেয়ালের বন্দোবস্ত। লক্ষ্যভেদ করলে সেই গুলি ভেদকারীর। নইলে তাকে দান ছেড়ে দিয়ে কোর্টে গুলি ছড়িয়ে আহ্বান জানাতে হবে প্রতিপক্ষকে। চার-এক। এককথায় যাকে বলে গিয়ে হেব্বি প্রফেশনালদের খেল। আমাদের এলাকায় এ ধরনের তিন খলিফার নাম রামমোহন রায় রোডের অজয়, ছ’ নম্বর গলির বোকান আর পাশের বাড়ির আবাল্যবন্ধু সমীর। ওদের সঙ্গে পাঙ্গা নিতে যাওয়াটা অনেকটা ব্রাজিল ফুটবল টিমের সঙ্গে ভারতের খেলতে চাওয়ার মতো। একশোবার খেলা হলে একশো দশবার হারতে হবে। ফলে আমাদের খুঁজতে হত মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, ভূটানের মতো প্রতিপক্ষ। এরকমই একজন শিবেনদাদের গলির কতে। পরপর তিনটে গুলি খুইয়ে চারনম্বরটা দেওয়ার সময় তেরিয়াভাবে ঘোষণা করেছিল— ‘আর দোবো না!’ শুনেই ধাঁ করে রক্ত চড়ে গেছিল মাথায়! যার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল একটা টাইসন স্পেশাল। সোজা গিয়ে ল্যান্ড করেছিল কতের বাঁ চোখের কোনে। মুহূর্তে চোখটা ফুলে ঢোল কোলবালিশের মতো। কালচে বেগুনি রঙের গভীর কালশিটে।
কতের বড়কাকা সাধন মুখুজ্জে, মিনিটতিনেকের মধ্যে ভাইপোর হাত ধরে এসে হাজির আমাদের বাড়িতে। ‘দেকুন, দেকুন অমিতদা! আপনার ছেলে আমাদের কতের কী অবস্তাটাই না কোরেচে!’
আজও মনে আছে দিনটা ছিল শনিবার। বাবার হাফছুটি। বাড়ি ফিরে জামাকাপড় ছাড়তে না ছাড়তেই এহেন নালিশ শুনে সপাটে একটা চড়। মায়ের হাতে ব্যাপারটা নিত্যরোজের পাওনা হলেও বাবা কোনোদিন গায়ে হাত তোলেনি (পরবর্তীতে আর একবার ছাড়া)। ফলে ব্যাথার চেয়েও অপমানটা বুকে ধাক্কা মেরেছিল অনেক বেশি। আর সেই মূহুর্ত থেকেই মনের মধ্যে বলিউডি ভাষায় যাকে বলে— ‘বদলে কি আগ!’ এরপর মাসছয়ও কাটেনি, ফেডারেশন স্ট্রিটের মোড়ে কতেকে একলা পেয়ে… থাক, সে বড় করুণ কাহিনি! সময়সুযোগে শোনানো যাবে আরেকদিন।
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে
আমাদের ছেলেবেলায় কিন্তু যেত না। ফলে কবিতাটা তখনও লিখে ফেলতে হয়নি শঙ্খবাবুকে। আমাদের সময় বিজ্ঞাপন ছিল সত্যিই ‘লিমিটেড বাট এক্সক্লুসিভ অ্যান্ড এক্সট্রা অর্ডিনারি’। পাঠকরা এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন বিজ্ঞাপন বলতে এক্ষেত্রে বিভিন্ন কোম্পানি অথবা তাদের প্রোডাক্ট, সোজা ভাষায় উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর কথাই বলা হচ্ছে। সময় তখন সত্যিই অন্যরকম ছিল। হালফিলের মতো অযুতকোটি প্রোডাক্টে ছেয়ে যায়নি দোকানের শোকেসগুলো। বিজ্ঞাপনও কম কিন্তু ওই যে আগেই বলেছি, অভিনব এবং অসাধারণ। যতবার এসব মনে পড়ে ততবারই মাথার মধ্যে উথালপাথাল ঝড় তুলে সামনে এসে দাঁড়ায় এইচ. জি. ওয়েলস সায়েবের সেই টাইম মেশিনটা। পিঠে চাপিয়ে বিদ্যুৎগতির উড়ানে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেয় ধর্মতলায়, সন্ধের মুখে মুখে। এস. এন. ব্যানার্জি আর চৌরঙ্গী রোডের মোড়ে। হোয়াইটওয়ে লেডলের দোকানের উলটোফুটে অনাদির মোগলাই পরোটার পেছনে সায়েবি কেতার বাড়িটার ছাদে নীল আলোর চা ঢেলেই চলেছে বিশাল সাদা রঙের কেটলিটা। নীচে আধমানুষ সমান রঙিন আলোর লেটারহেডে লেখা— লিপটন। সে রং পালটাচ্ছে থেকে থেকে। লাল-নীল-সবুজ। ময়দান মার্কেটের ফুটপাত থেকে অবাক বিস্ময়ে বিভোর হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে ক্লাস টু-থ্রির বাচ্চা ছেলেটা।
ছেলেটাকে আরও টানত আর একটু দূরে পার্ক স্ট্রিট মোড়ের আকাশে উড়তে থাকা ওই বিশাল বেলুনটা। গায়ে লেখা ‘বার্মা শেল’। কখনও আবার ‘এসো’ (esso)। সে সময় এ শহরে রাজত্ব চালানো দুটি বহুজাতিক তেল কোম্পানি। আমার কৈশোরেই সম্ভবত পাততাড়ি গোটায় এ শহর থেকে। হাওয়ায় মিলিয়ে যায় বিজ্ঞাপনের বেলুনও।
আসুন, আকাশ থেকে নেমে এবার একটু দোতলা বাসে চাপা যাক। যে সময়কার কথা বলছি, তখন বেসরকারি বাস কোলকাতার রাস্তায় নামেনি বললেই চলে। পুরোটাই প্রায় সরকারি মালিকানাধীন। লাল রঙা গায়ে হালুমমুখো বাঘ। সিএসটিসি অর্থাৎ ক্যালকাটা স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের লোগো। বাস দু’রকম। একতলা আর দোতলা। এর মধ্যে দোতলা বাস। একতলা আর দোতলার মাঝখানে বাইরের লম্বা চওড়া জায়গাটায় বিভিন্ন সংস্থার বিজ্ঞাপন। এর মধ্যে সবথেকে চোখ টেনেছিল লেক্স। তখনকার জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের একটি সিগারেট। বিশাল বলশালী চেহারার নায়ক। পরনে স্কিনটাইট লাল টি শার্ট, সাদা ড্রেনপাইপ প্যান্ট আর ছুঁচোলো। অনেকটা বাঁটুল দি গ্রেট কার্টুনের আদলে আঁকা। তন্বী নায়িকাকে একহাতে জড়িয়ে অন্য হাতে মেজাজে সিগারেট ফুঁকছে। পাশে সিগারেটের প্যাকেটের ছবি আর তলায় বড় বড় লেটারহেডে ক্যাপশন— ‘সবার সেরা তামাকে গড়া / না খুব মিঠে না খুব কড়া।’ পাশে আরেকটু বড় অক্ষরে— ‘লেক্স’। একইসাথে সিনেমা শুরুর আগে ট্রেলার বা টিজারে অ্যানিমেশন ফিল্ম হিসেবেও দেখানো হত বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে। যদ্দুর শুনেছিলাম অসাধারণ এই ক্যাপশন থুড়ি দু-লাইনের ছড়াটি লিখেছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আর নায়কের ছবিটি এঁকেছিলেন সম্ভবত স্বনামধন্য কার্টুনিস্ট কাফি খাঁ মহাশয়। এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও ‘লেক্স’ আজও অমলিন মনের মনিকোঠায়!
আসুন, এবার একটু সেই সময়কার খবরের কাগজ আর মাসিক পত্রপত্রিকার পাতাগুলো ওল্টানো যাক। আজকালকার মতো ‘খবর কম অ্যাড বেশি’, ব্যাপারটা সেরকম ছিল না মোটেই। ছিল না সামনের গোটা পৃষ্ঠাটাই কোনো কোম্পানি বা তাদের ব্র্যান্ডের জন্য ছেড়ে দেয়ার রেওয়াজও। তবে যেটুকু ছিল, সেটুকু উৎকর্ষতা আর শৈল্পিক স্বকীয়তায় উজ্জ্বল, একথা অনস্বীকার্য। যার এক বৃহদাংশ দখল করে রয়েছে ছোট ছোট ক্যাপশন আর অনবদ্য সব ছড়া বা গ্রাফিতি। তার মধ্যে আজও মনে আছে পেপসোডেন্ট টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের সেই দুর্দান্ত ছড়াখানা। ‘দাঁতের ছোপ কোথায় গেল? একি তাজ্জব বাত! / পেপসোডেন্টে মেজেছেন যে আপনার দাঁত।’ এছাড়াও মনে আছে আর এক দাঁতের মাজন, সিগন্যালের অ্যাডটাও। কোনো ক্যাপশন বা ছড়া নেই। শুধু টিউব থেকে বেরিয়ে আসা পেস্টের ছবি। এই প্রথম একটা টুথপেষ্ট যার গায়ে সাদার মধ্যে উজ্জ্বল লাল ডোরাকাটা দাগ। ব্যাস! এতেই মাত শহরের কুচোকাঁচারা। এ অধম তো বটেই। কী পরিমাণ যুদ্ধ এবং অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে বহুল প্রচলিত পুরোনো ব্র্যান্ডটিকে হাটিয়ে গৃহে সিগন্যালের প্রবর্তন করেছিল তা বলতে গেলে আরেকটা মহাভারত হয়ে যাবে ফলে চলুন, ব্র্যান্ড পালটে ফেলা যাক। সেন র্যালে সাইকেল কোম্পানির বিজ্ঞাপনের এই দীর্ঘ ছড়াটা থাকত মাসিক সন্দেশের একদম শেষ পাতায়। যার মূল উপজীব্য শিবু বা বিশু নামে এক কিশোর ও তার নতুন কেনা র্যালে সাইকেল। ছড়ার পুরোটা মনে নেই, শুধু দুটো লাইন ছাড়া। সেটা এরকম। ‘যেতে হলে বজবজ, বিশ মাইল দূর / র্যালেখানা পেলে তার ঠোঁটে ফোটে সুর।’ সঙ্গে চলন্ত সাইকেলে শিসদানরত শিবু (নাকি বিশু?) চরিত্রটির অসামন্য এক কার্টুন চিত্র।
এরকমই আর একটি অসাধারণ বিজ্ঞাপন থাকত শুকতারার (নাকি শিশুসাথী?) শেষ পাতায়। বেনজিটল নামে একটি অ্যান্টিসেপটিক সাবানের বিজ্ঞাপন। প্রকাশিত হত প্রতিমাসে ধারাবাহিক কমিক স্ট্রিপের আদলে। অসামান্য সেই উপস্থাপনা আজও গেঁথে রয়েছে মনে।
অতঃপর ৮০-র দশকও জন্ম দিয়েছিল একগুচ্ছ দুর্দান্ত বিজ্ঞাপনের। কোন বিখ্যাত ব্যাক্তি বা সমকালীন উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনাকে নিয়ে আমূলের সেই অসামান্য সব ক্যাপশন, বোরোলিনের সংসারের গান, লিরিলের স্নানরতা লাস্যময়ী, ‘রিল্যাক্স, হ্যাভ আা চারমিনার’, ‘উইলস। মেড ফর ইচ আদার’…আর কত কত বলব? তবে ততদিনে যৌবনলোকে পদার্পণ ঘটে গেছে। আর এ ধারাবাহিকের বিষয় যেহেতু শুধুমাত্র শিশু আর কিশোরবেলা, ফলে এ প্রসঙ্গে ইতি টানতে হল। শুধু ৮০/৯০ দশকের বিজ্ঞাপন নিয়েই লেখার ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে।
রেডিওয় বিজ্ঞাপন। আমাদের মতো কুচোকাঁচাদের কানে প্রথম সেটা ঢোকে বেশ কিছুটা রহস্যময়ভাবেই। সালটা ’৬৫ কি ’৬৬। পাড়ায় আমাদের ন্যাচারাল লিডার টুলুদার বাড়ির উঠোনে সরস্বতী পুজোর শিকলি বানাচ্ছি সবাই মিলে। টুলুদার পাশে একটা ছোট ট্রানজিস্টার। সেখানে মহম্মদ রফি, আশা ভোঁসলে। কাশ্মীর কি কলি। শাম্মি-শর্মিলা। ‘দিওয়ানা হুয়া বাদল…’ হঠাৎই মাঝপথে গান থামিয়ে কোন পুরুষকন্ঠ— ‘নিরোধ, নিরোধ… ছোট পরিবার, সুখী পরিবার…’ ইত্যাদি ইত্যাদি। পরক্ষণেই ‘ধ্যাত্ বাঁ…’ বলে ফট করে টুলুদার রেডিও বন্ধ করে দেয়া মনের মধ্যে কৌতূহলের মাত্রাটা বাড়িয়ে দিয়েছিল কয়েকগুন। বিপুল সে রহস্য উদ্ধারে সেইসব নিষ্পাপ বালকদের লেগে গেছিল আরও বেশ কয়েকটা বছর। তবে সেটা অন্য কাহিনী। আলোচিত হবে অন্য কোনোদিন, প্রাপ্তবয়স্ক মহলে।
ব্রাজিলের কার্নিভাল দেখেছেন? পর্দায় অথবা বাস্তবে? অনেকটা সেই ধাঁচেই শোভাযাত্রা বেরোত আমার শৈশবের শহরে। রঙঝলমলে বিজ্ঞাপনের শোভাযাত্রা। এরকম দুটো শোভাযাত্রা আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। প্রথমটা সিগারেট আর দ্বিতীয়টা সার্কাস। প্রথমটার কথাই প্রথমে। একটি সিগারেট ব্র্যান্ডের লঞ্চ বা উদ্বোধন। পাসিং শো, নাকি উডবাইন? ভুলে গেছি এতদিনে। সেই উপলক্ষে শোভাযাত্রা চলেছে সার্কুলার রোডের বড় রাস্তা দিয়ে। বিশাল বিশাল রণপায় আট-দশজন মানুষ। মুখোশ পড়া মুখে ইয়া লম্বা সিগারেট। পরনে ঢোলা শার্ট। বিশাল পাজামার ঝুল লুটোচ্ছে মাটিতে। মিছিলের সামনে ব্যান্ডপার্টি। তারও সামনে নাচতে নাচতে চলেছে ক্লাউনের পোশাক পরা, মুখে রঙচঙ মাখা আরও কয়েকজন। হাতে সিগারেটের প্যাকেট। তা থেকে দেদার বিলোচ্ছে পথচারীদের মধ্যে। শুনেছিলাম ডালডা বনস্পতি বাজারে চালু করার সময় বিনে পয়সায় লুচি ভেজে খাওয়ানো হত নির্মাতা কোম্পানির তরফে। ধর্মতলা আর মৌলালির মোড়ে। সেটা দেখার সুযোগ হয়নি তবে সার্কাসেরটা দেখেছিলাম শীতের শুরুতে। একইরকম মিছিল। তবে আকারে অনেক বড়। সামনেই সার্কাসের নিজস্ব ব্যান্ড গ্রুপ। ড্রাম, ক্ল্যারিওনেট, ট্রাম্পেটে হাটারির সেই দুনিয়া কাঁপানো সুর। হাতে হাতে পোস্টার। তাতে বাঘ, সিংহ, হাতী, ঘোড়া, সাইকেল চালক শিম্পাঞ্জি, ভয়াল হাঁ-মুখ জলহস্তী, ট্র্যাপিজবালা, কামান থেকে উড়ে বেরোনো মানুষ, গোলাকার তারের খাঁচায় ঘুরপাকরত মোটরসাইকেল চালক আর জিমনাস্ট সুন্দরীদের ছবি। পিছনে নানাবিধ শারীরিক কসরত দেখাতে দেখাতে চলেছে বহুবর্ণ ঝলমলে পোশাকের একদল ক্লাউন। ঢোলা জামার পকেটে গোছা গোছা হ্যান্ডবিল। সার্কাসের বিজ্ঞাপন। খেলা দেখানোর মাঝেই সেগুলো পকেট থেকে বের করে ছুঁড়ে দিচ্ছে রাস্তার দুপাশে দাঁড়ানো মানুষদের উদ্দেশ্যে। মিছিলে সবার শেষে বিশাল এক হাতি। শরীরের সাথে মানানসই একজোড়া গজদন্ত। জরির কারুকাজ খচিত লাল ভেলভেট ঢাকা হাওদায় আসীনা ভারতমাতার সাজে সজ্জিতা এক সুন্দরী। হাতে ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা। মন্দিরাকৃতি হাওদার মাথায় ব্যানারে লেখা— ‘দ্য গ্রেট থ্রি রিং কমলা সার্কাস’।
এরকম আরেকটা মিছিল, সম্ভবত জেমিনি সার্কাসের, দেখার সুযোগ হয়েছিল বছরদুয়েক বাদে। তার পরবর্তী পাঁচ দশকে আর একবারও না। নিত্যরোজ সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা আর টিভি-র পর্দায় মুখ ঢেকে যাওয়া কোটি কোটি ‘অ্যাড’-এর ভিড়ে পথ হারিয়েছে সেসব মিছিল। এরকমটাই মনে হয় আজকাল।
রাশিয়ান বল
বিকেল সোয়া চারটে সাড়ে চারটে মতো হবে। ইশকুল থেকে ফিরে জামাকাপড়টাও ছাড়িনি ঠিকমতো। জানলায় ভেসে উঠল সমীর। পঞ্চতিক্ত খাওয়া মুখ। ‘দাঁত কেলিয়ে ঘরে বসে থাকলেই হবে (পরের চার অক্ষর অশ্রাব্য)? আজ ব্লাডার ঠাসার দিন না!’ মনে পড়ে গেল আজ শুক্কুরবার। আমাদের পালা। ‘চ, যাচ্ছি।’ বেজার মুখে বিছানা ছেড়ে উঠে পিছু নিলাম সমীরের।
প্রিয় পাঠকগণ, উপরোক্ত এই গোটাকয়েক লাইন পড়েটড়ে আপনাদের কিছু বোধগম্য হল কি? সম্ভবত না। ফলে এই অধম প্রতিবেদককেই নামতে হচ্ছে রহস্য উন্মোচনে। সুতরাং আর দেরি না করে আসুন আমার পিছুপিছু, সমীরকে অনুসরণ করা যাক।
বাড়ি লাগোয়া সরু গলিটা ধরে ক্যাপিটাল নার্সিং হোম, দীপেনদের বাড়ি, মনুদের বাড়ি, কুচুদের বাড়ি, বুটিদি, ফুটিদি, রীনাদিদের বাড়ি ছাড়িয়ে বিষ্টু ঘোষের বাড়ির দেয়ালে দুর্গাপিসির দেওয়া ঘুঁটের ছোপগুলো যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক সেখান থেকেই শুরু সঙ্ঘের মাঠ। আমাদের কৈশোরের একটুকরো স্বর্গ জন্নত হেভেন! একফালি খেলার মাঠ। নিজেকে চুনি, পিকে, জংলা দে, নঈম, কাজল মুখার্জি আর পিটার থঙ্গরাজ ভাবা আকাশকুসুম স্বপ্নের চারণভূমি। সমীরের হাতে একটা টি-শেপ ফুটবল আর একটা রবারের ব্লাডার। অনেকটা চুপসোনো ডাবের আকার। ব্লাডারের একপ্রান্তে একটা সরু নল। প্রথমেই ব্লাডারটাকে পুরে ফেলতে হবে ফুটবলের ভেতরে। জুতোর লেস পরানোর মত দু’ধারে ফুটো ফুটো চেরা জায়গাটা দিয়ে। বাইরে উঁচিয়ে থাকবে শুধু নলের অংশটা। সেখানে সাইকেলের পাম্প দিয়ে প্রাণান্তকর হ্যান্ডেল মেরে যাওয়া। অন্যজন বলটাকে ধরে বসে থাকবে চূড়ান্ত মনোযোগী পরীক্ষকের মতো। হাওয়া কমবেশি যেন না হয় কোনওমতে। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছনো মাত্র ‘ব্যস!’ বলে চেঁচিয়ে উঠবে সে। পাম্প থেকে বিযুক্ত করেই মুহূর্তের মধ্যে জবরদস্ত গিঁটে বেঁধে ফেলতে হবে নলটাকে। যাতে এতটুকু হাওয়াও বাইরে বেরোতে না পারে। তারপর অদ্ভুত কৌশলে নলটাকেও ভরে ফেলতে হবে বলের ভেতর। ইতিমধ্যে পাম্প চালকের হাতে উঠে এসেছে একটা কুরুশ। আগার দিকটার ফুটোয় গিঁট দিয়ে ঢুকিয়ে রাখা একটা গেঞ্জি দড়ির লেস। প্রতিটা ফুটোর মধ্যে দিয়ে রিভার্স নট কায়দায় বেঁধে ফেলতে হবে মোক্ষমভাবে। এতক্ষণে তৈরি হল সেই চর্মগোলক।
যতটা সহজে বর্ণনা করলাম, ব্যাপারটা আসলে কিন্তু মোটেই সেরকম জলভাত নয়। রকেট সায়েন্সের চাইতেও ঢের, ঢের বেশি কঠিন যাকে বলে। পুরো প্রক্রিয়াটা শেষ হবার পর ঝাড়া মিনিটদশেক শ্রীমানি বাজারের ফুটপাতে কালুভুলুদের মতো জিভ বের করে হাঁপাতে হত বেদম। হাতের গুলি ফুলে থাকত বিশ্বশ্রী মনোতোষ রায়ের মতো, ঝাড়া এক হপ্তা। ফলে ক্লাবের তরফে ডিউটি ভাগ করা থাকত। কবে কোন দু’জনের পালা পড়বে। যাদের কাঁধেই যেদিন এই মহাভার ন্যস্ত হত তাদেরই মুখমণ্ডল যে বেজায় ব্যাজার আকার ধারণ করত সে বিষয়ে আর সন্দেহ কী? আর এই ব্যাজার ভাবটা আরও বাড়ত মাঝেমাঝেই, পাম্প বিগড়োলে। তখন বল নিয়ে দৌড়োতে হত রাজাবাজারের মোড়ে, মইনু ওস্তাদের ভাড়ার সাইকেলের দোকানে। যেহেতু আমরা সবাই ওস্তাদের চার আনা ঘণ্টার পার্মানেন্ট খদ্দের তাই বল পাম্পটা যাকে বলে— একদম ফ্রি!
এইসব চক্করের মধ্যেই এসে পড়বে বাকি খেলুড়েরা। অর্থাৎ যাদের সেদিন বল ফোলানোর ডিউটি নেই। এরা প্রত্যেকেই একেকজন হাওয়া বিজ্ঞানী বা বিশারদ। বলে ঠিক আর ক’আউন্স হাওয়া ভরলেই বাউন্সটা একদম পারফেক্ট হত সে বিষয়ে নানাবিধ সুচিন্তিত মতামত। শোনামাত্র মটকাটা ধাঁ করে গরম হয়ে গেলেও ঠোঁটে সেফটিপিন মেরে থাকতাম। ‘দাঁড়াও শালা, বল চুপসোতে দু’দিন বড়জোর তিনদিনের বেশি তো নয়। হর কুত্তেকা দিন বদলতা। তখন আমরাই আবার হাওয়া বিশারদ আর তোমরা আসামির কাঠগড়ায়।’
যাই হোক, এ জাতীয় টুকটাক মন্তব্য আর জলবিছুটি মার্কা কথা ছোঁড়াছুড়ির পর শুরু তো হতো খেলা। তবে একটা ব্যাপারে বেশ কয়েকজনের প্রবল অনীহা। সেটা হেড দিতে ওঠা। বিশেষত যারা ফরোয়ার্ড আর ডিপ ডিফেন্সে খেলত। এর কারণ মূলত দুটো। এক— ধুলোকাদা মাখামাখি বলে দেবানন্দ কিংবা বিশ্বজিৎমার্কা অ্যালবার্ট কাটিং টেরিটির একদম সাড়ে তেরোটা বেজে যাওয়া। দুই— আরও ভয়ংকর যেটা, বারোমাস রোদজলের টানা ধকল সামলে গন্ডারের চামড়ার মতো মজবুত আর কামানের গোলার চাইতেও ভারি সেই ৭ নম্বর টি-শেপ ফুটবল (একদম সিনিয়ারদের জন্য ১০ নম্বর), বিশেষত কাদা শুকিয়ে খড়খড়ে লেসবাঁধা দিকটা, কপালে ঠিকঠাক জায়গায় একবার কানেক্টেড হওয়ার ওয়াস্তা শুধু। পরমুহূর্তেই বেম্মতালু বিকল করে দেয়া ৪৪০ ভোল্ট শক যেন! ফলে হেডের ব্যাপারটা এড়িয়ে চলার এই প্রবণতা। কিন্তু তাতে বিপদ আসত আরেকদিক থেকে। সেটা সিনিয়ারদের ছুটে এসে চাঁদি গরম করা রামগাঁট্টা। সঙ্গে সিলেক্টেড সব বাক্যবন্ধ। ‘এঃ শালা! বহুত বড় নায়ক হয়েছ! শাম্মি কাপুর! হেড নেবে না। শখের টেরি খারাপ হয়ে যাবে? দাঁড়াও বাঞ্চোৎ, কালকেই ইটালিয়ানে (রাস্তায় ইঁট পেতে বসা প্রামাণিকের কাছে) নিয়ে গিয়ে খোট্টা কদমছাঁট না দিইয়েছি তো…।’
সেইসব হেড না দিতে চাওয়া দুর্ভাগা অত্যাচারিতদের নীরব আর্তনাদ সম্ভবত ফুটবল বিধাতার কানে পৌঁছেছিল। যে সময়ের কথা বলছি তখন মালয়েশিয়ায় বিখ্যাত একটা আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট হত। যা বহুল পরিচিত ছিল মারডেকা ফুটবল নামে। ভারত তখন এশিয়ার ফুটবল মানচিত্রে এক সমীহ জাগানো নাম। মাত্র বছর দু’-তিনেক আগেই এশিয়ান গেমসে সোনা জিতেছে। মারডেকার ফাইনালে সেবার রানার্স হয় ভারতীয় দল। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী জনাব টুঙ্কু আবদুল রহমানের উপস্থিতিতে চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্স, উভয় পক্ষের সব খেলোয়াড়ের হাতেই একটি করে বল স্মারক হিসেবে তুলে দেয়া হয়। কলকাতায় আসার পর অচিরেই সেই বল চরম জনপ্রিয়তা লাভ করে ছড়িয়ে পড়ে শহরের মাঠময়দান থেকে নিয়ে পাড়ার অলিতেগলিতে। গন্ডারচর্মসম রুক্ষ এবং লৌহ গোলকের মতো বিপুল ওজনদার টি-শেপ ফুটবলের তুলনায় তুলতুলে হালকা। চকচকে মোলায়েম ত্বক। নাম রাশিয়ান বল। টি শেপের বদলে সারা গায়ে মাকড়শার জালের মতো সাদা কালো খোপ খোপ কেটে নিপুনভাবে একটাকে আরেকটার সঙ্গে জুড়ে দেয়া। সবচাইতে বড় ব্যাপার যেটা, ব্লাডার ঠাসা, লেস বাঁধার মত প্রাণান্তকর হ্যাপা পোহানোর কোন ব্যাপারস্যাপারই নেই। অদ্ভুত উন্নত প্রযুক্তিতে ব্লাডারটা আগে থেকেই ভেতরে ঠাসা। ইংরিজিতে যাকে বলে ইন বিল্ট। গায়ে একটা ছোট ফুটো। সেখান দিয়ে হাওয়া ভরার ব্যবস্হা। অথচ এতটুকু হাওয়া বাইরে বেরোবে না আর থাকবেও টি-শেপ বলের তুলনায় অনেকদিন বেশি। এদিকে পাম্পও করতে হবে অনেক কম। হেড দিতে উঠে কপালে ৪৪০ ভোল্টের শক খাওয়ার মতো আতঙ্ক নেই। দেবানন্দ টেরিটা নয় খেলার শেষে দুলালদার সেলুনে ঢুকে জল স্প্রে করে সরু দাঁড়ার চিরুনিতে ফের বাগিয়ে নেয়া যাবে। সব মিলিয়ে এই রাশিয়ান বল যে পাড়ায় পাড়ায় খেলুড়ে মহলে এক অনাবিল আনন্দধারা সিঞ্চন করতে সক্ষম হয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। মানতেই হবে সে কথা।
তবে এহেন চর্মগোলকের নাম রাশিয়ান বল কেন? উত্তর স্বরূপ ভাসা ভাসা যে দুয়েকটি তথ্য পেয়েছি তার মধ্যে একটি এরকম। ওই টুর্নামেন্টের ফাইনালে আমন্ত্রিত প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সর্বকালীন বিশ্বসেরা গোলরক্ষক সোভিয়েত রাশিয়ার লেভ ইয়াসিন। তিনিই ভারতীয় দলের অধিনায়ক পিকে অর্থাৎ প্রদীপ কুমার ব্যানার্জির হাতে তুলে দেন বলটি। যা অচিরেই শহরের অলিতে-গলিতে মুখে মুখে রাশিয়ান বল হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। যদিও এই তথ্যের সমর্থনে হিন্দিতে যাকে বলে ‘ঠোস সবুদ’, সেরকম মজবুত প্রমাণ পাইনি কিছু। চুনি, পিকে, জি. সি. দাস, ভোম্বলদা মানে সুভাষ ভৌমিকের পাশাপাশি ভারতীয় তথা আন্তর্জাতিক ফুটবল সম্পর্কে জ্ঞানের আর এক সিধুজ্যাঠা শ্রী নোবি কাপাডিয়ার ‘বেয়ারফুট টু বুটস’ বইটিতে নাকি এ সম্পর্কে কিঞ্চিৎ উল্লেখ রয়েছে। খোঁজে রয়েছি। আপনাদের কিছু জানা থাকলে জানাবেন। অজ্ঞান এই অধমের ডেটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আরও কিছুটা সমৃদ্ধ হবে। তাহলে আর কী? আজ এ পর্যন্তই। অপার বাংলা কর্তৃপক্ষ চাইলে আর বাকি পর্বগুলো মাথায় এলে লিখব এখানেই। হয়তো আগামি পুজোতেই। ততক্ষণ…
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
এই না হলে গদ্য? কি দ্রুত তার গতি, কি সুঠাম, কি স্মৃতি , কি সাবলীল ভাষা ? বেঁচে থাকুক এই লেখা আর লেখক।