ফিচার
সুপ্রিয় চৌধুরী
অনেক ভেবে ঠিক করলাম এবারের লেখাটা আপনাদের জন্য লিখি। আপনারা মানে যারা দীর্ঘকাল প্রবাসে আছেন আর কি। জীবন নামক রেসে দৌড়োচ্ছেন লিসবন থেকে লিপজিগ, আটলান্টা থেকে আলাস্কা, অথবা রেস থেকে সদ্য অবসর নিয়ে থিতু হয়ে বসেছেন ওখানেই। অথচ প্রায় সবার মনেই আজও রয়ে গেছে এই শহরটা মানে কল্লোলিনী তিলোত্তমার অজস্র স্মৃতি। সেখানে শহর কলকাতার স্মৃতি থাকবে আর কলকাতা ময়দানের বিশেষত ময়দানি ফুটবলের স্মৃতি থাকবে না, সে আবার হয় নাকি? ফলে এই প্রতিবেদনের অবতারণা। উর্দুতে ঘটনা বা কাহিনী মানে তো দাস্তান। সেইসব আনোখা লাজিজ ময়দানি দাস্তানের কিছু টুকরো টুকরো কোলাজের মত স্মৃতি যা শুধুই কেঠো তথ্য বা পরিসংখ্যানের কচকচি নয়, মনের গহ্বর থেকে তুলে এনে গাঁথবার চেষ্টা করলাম এই আখ্যানে। নিশ্চিত, আপনাদের অনেকেরই ফেলে আসা স্মৃতি জেগে উঠবে এইসব দাস্তানের সঙ্গে। তাহলে? আর কালক্ষেপ না করে শুরু হয়ে যাক দাস্তান – এ – ময়দান।
প্র্যাকটিস, সই আর ডে-স্লিপ।
———————————
৫০ থেকে ৮০-র দশক অবধি ব্যাপারগুলো খুবজোর চালু ছিলো ময়দানে। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান আর মহামেডান স্পোর্টিং, এই তিন প্রধানেরই নিজের নিজের মাঠে অনুশীলন থাকতো ভোরবেলায়। প্র্যাকটিস দেখতে তিন দলেরই বহু সমর্থকদের জমায়েত হতো যার যার মাঠে। প্র্যাকটিসের শেষে দর্শকদের অন্যতম আকর্ষণ ছিলো দুটো। ফার্স্ট ডিভিশনে তিন প্রধানের ফুটবলাররা সেসময় সমর্থকদের কাছে মহাতারকা বা সুপারস্টারের মর্যাদা পেতেন। এমনকি জনপ্রিয়তায় রুপোলি পর্দার দুই আইকন উত্তমকুমার আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও রীতিমতো পাল্লা দিতে পারতেন এদের মধ্যে কেউ কেউ। এইসব তারকা ফুটবলারদের সই সংগ্রহ করাটা স্ট্যাম্প জমানো বা কয়েন কালেকশানের মতই একটা হবি বা নেশা ছিলো সেসময়। আমার এক বন্ধু তো রীতিমতো গোবদা একটা খাতায় সাঁটানো খেলোয়াড়দের ছবি আর তার তলায় প্রত্যেকের সই, এরকম একটা এ্যালবামই বানিয়ে ফেলেছিল।
সই ছাড়াও সমর্থকদের কাছে আকর্ষণের আরেক অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিলো ডে-স্লিপ। ছোট এক টুকরো চিরকুট কাগজে গোল রবার স্ট্যাম্প ছাপে ইংরিজিতে লেখা – Gate Pass বা Day Slip জাতীয় একটা কিছু। সঠিক মনে নেই এতদিনে। তলায় সেই ফুটবলারের সই। প্র্যাকটিসের পর ওরকম একটা ডে-স্লিপ পাওয়ার জন্য ফুটবলারদের কাছে কাকুতিমিনতি এমনকি হাতেপায়ে ধরা পর্যন্ত চলতো। যার ভাগ্যে এই প্রাপ্তি ঘটতো তার কাছে ব্যাপারটা গিয়ে দাঁড়াতো অনেকটা স্টেট লটারির টিকিট পাওয়ার মত। ষাট পয়সা বা এক টাকা দশের লাইনে ভয়ানক মারামারি, দাঙ্গা হাঙ্গামা, ঘোড়া পুলিশের তাড়া, ডান্ডার বাড়ি, এতবিধ নানাধরণের ঝামেলা এড়িয়ে মেম্বারশিপ গেট দিয়ে ঢুকে পড়া যেত গটগটিয়ে। একইসাথে টিকিটের খরচটাও যেতো বেঁচে। আজকের প্রজন্ম কল্পনাই করতে পারবে না ওই ষাট বা এক টাকা দশ পয়সা জোগাড় করাটা কি ভয়ংকর কঠিন কাজ ছিল সেই ৬০/৭০ দশকে একজন সাধারণ ক্লাব সমর্থকের পক্ষে। তবে সেই ডে-স্লিপ নামক সাত রাজার ধন এক মানিকের মত মহার্ঘ বস্তুটি হাতে পাওয়াটা ছিল আক্ষরিক অর্থেই স্টেট লটারির টিকিট পাওয়ার মতই ভাগ্যের ব্যাপার। কারণ তিন প্রধানে খেলোয়াড় সংখ্যা মেরেকেটে বড়জোর ৮০/৯০ জন। একেকজন আর কতজনকে টিকিট দেবেন? ফলে টিকিট বা গেট পাসের জন্য হাহাকার চলতেই থাকতো নিরন্তর।
এই আকালের বাজারে হঠাৎই একদিন প্ল্যানটা খেলে গেছিল এই অধমের মাথায়! বয়েস কত আর হবে তখন। এই বড়জোর চোদ্দ পনেরো। লিখবো, এই ভাবনাটা সাতান্ন বছর বয়েস অবধি মাথাতেও আসেনি। তবে আঁকা আর দেয়াল লেখা, এ ব্যাপারে কিঞ্চিৎ দক্ষতা ছিলো সেই কিশোর বয়েস থেকেই। ইশকুলে বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে যার ওই সই আর ছবির এ্যালবাম, বাড়ি থেকে সেটা আনিয়ে সেসময় তিন প্রধানের প্রায় সমস্ত ফুটবলারের সই নকল করে তুলে নেয়া হলো লম্বা রাফ খাতার পাতায়। চিৎপুরে কোম্পানি বাগানের কাছে রবার স্ট্যাম্পের দোকান থেকে তৈরি করিয়ে আনা হলো হুবহু একইরকম গোলাকৃতি ছোট রবার স্ট্যাম্প। বাকি কাজটা তো জলের মত সোজা। ছোট ছোট চিরকুট কাগজে প্রণব গাঙ্গুলী থেকে হাবিব, কাজল মুখার্জি হয়ে শ্যাম থাপা, স্ট্যাম্প সহ সবার সই। ঘুরে বেড়াতে লাগলো ক্লাস এইট নাইন টেন ইলেভেনের হাতে হাতে। টিফিনের সময় স্কুলের পাঁচিল টপকে ১২ নম্বর ট্রামে সোজা ধর্মতলা ময়দান। সদস্য গ্যালারিতে জমিয়ে বসা, টিম গোল করলে আনন্দে খাতা বই টিফিন বক্স হারিয়ে যাওয়া, সব মিলিয়ে যখন সুখসাগরে অবগাহন করছিল জীবন, বিপত্তিটা ঘটলো ঠিক সেই সময়ে। সর্বদাই নতুনত্বের সন্ধানে আগ্রহী এই অধমের হঠাৎই একদিন মনে হলো, আরে পি সিনহার সই নিয়ে তো কোনদিন মাঠে ঢোকা হয়নি! দ্য গ্রেট প্রশান্ত সিনহা। আমাদের লাল হলুদের ক্লাব বয়। ইস্টবেঙ্গল মিডফিল্ডের প্রাণভোমরা সেসময়। ৬২-র এশিয়ান গেমসে স্বর্ণপদক জয়ী ভারতীয় ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য। আজও চোখে লেগে রয়েছে রবীন্দ্র সরোবর মাঠে হাঙ্গেরির তাতাবানিয়া টিমের এগেনস্টে বাঁক খাওয়ানো ফ্রি কিকে তাঁর সেই অলৌকিক গোল! এহেন প্রশান্ত সিনহার সই জাল করা ডে-স্লিপ নিয়ে পৌঁছে গেলাম ইস্টবেঙ্গল মেম্বার্স গেটে। আগে বন্ধুরা। অন্যান্য ফুটবলারদের ‘সই করা’ ডে-স্লিপ দেখিয়ে একের পর এক দিব্যি সেঁধিয়ে গেল গেটের ভেতরে। সবার শেষে আমি। হেলতেদুলতে এগিয়ে গিয়ে গেটে দাঁড়ানো কর্মকর্তার হাতে চিরকুটটা দিতেই ধনুকের মত দুই ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন তিনি। চোখে ঘোর সন্দেহের দৃষ্টি। “এসো তো আমার সঙ্গে।” আরেক কর্মকর্তার হাতে গেট সামলানোর ভার দিয়ে আমার হাতটা ধরে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। খেলা শুরু হতে বড় জোর আর মিনিট পাঁচেক দেরী। মূল ময়দানে ঢোকার মুখেই কাঠের গ্যালারির নীচে পায়া খাটো কাঠের বেঞ্চিটার ওপর এক পা তুলে নীচু হয়ে বুট বাঁধছিলেন পি সিনহা। সোজা আমাকে নিয়ে বেঞ্চির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন কর্মকর্তা ভদ্রলোক। “প্রশান্তদা, আপনি এই ছেলেটাকে ডে-স্লিপ দিয়েছেন?” আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন মানুষটা। পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম, চূড়ান্ত মিথ্যেবাদী একটা ছেলের দিকে তাকানোর দৃষ্টি সেই দুচোখে। মনের মধ্যে চরম আশঙ্কার উথালপাথাল ঝড় নিয়েও প্রাণপণে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে চলেছিলাম নিজেকে। ছোট্ট করে একটা শুধু শব্দ – “না”। ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যাবে গাঁট্টা, কানমলা, চড়চাপাটি, নাকখত, কান ধরে ওঠবোস ইত্যাদি ইত্যাদি। সব মিলিয়ে হেনস্তার একশেষ একেবারে। গ্যালারির টঙে বন্ধুদের উদ্বিগ্ন মুখ! এখুনি তো…কিন্তু সবাইকে, সম্ভবত সেই কর্মকর্তাটিকেও বেজায় চমকে দিয়ে পুরোপুরি উল্টো ডজে খেললেন লাল হলুদ মাঝমাঠের রাজা। শান্ত গলায় কর্মকর্তা ভদ্রলোককে বললেন – “দেখুন, নর্ম্যালি আমি কাউকেই ডে-স্লিপ দিই না। তবে বাড়িতে আমার মিসেসকে পাড়ার ছেলেপুলেরা ধরাধরি করলে মাঝেসাঝে দিতে হয় দুয়েকটা। হতে পারে ছেলেটা এরকমই কোন সোর্স থেকে গেট পাসটা জোগাড় করেছে। ছেড়ে দিন ওকে।” চরম অনিচ্ছুক কর্মকর্তার হাতের মুঠোটা আলগা হতেই টেনে চোঁ চাঁ দৌড় লাগিয়েছিলাম গ্যালারির দিকে।
সেই কবেকার কথা! সেদিনের সেই কিশোর ছেলেটা আজ ৬৭। ৬৮-তে পড়বে এই ডিসেম্বরে। শেষ পাড়ানির কড়ি কুড়িয়ে নেয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে। আর আপনি স্যর, লাল হলুদ জনতার চোখের মণি পি সিনহা, অন্য আরেকটা কোন অলৌকিক মেঘের মাঠে খেলতে চলে গেছেন অনেকদিন! সেদিন ডাহা মিথ্যেুক জেনেও আপাদমস্তক খেলাপাগল একটা ছেলেকে কর্মকর্তাদের হাতে তুলে না দিয়ে তাকে খেলাটা দেখতে দিয়েছিলেন। জীবনেও শুধতে না পারা বিপুল ঋণের বোঝাটা আজও বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি কাঁধে!
শেষ অস্ত্র
———–
কিঞ্চিৎ ভারাক্রান্ত হয়ে গেল কি মনটা? আসুন, একটু হাল্কা করে দিই। সেসময় যারা ডে-স্লিপ জোগাড় করতে পারতেন না অথবা আমাদের মত উদ্ভাবনী শক্তিও ছিলো না, তারা আরেক পন্হা অবলম্বন করতেন। যাকে বলে শেষ অস্ত্র। মেম্বার্স গেটের পাশেই প্লেয়ার্স গেট। ফুটবলারদের ঢোকার দরজা। সেখানেই অপেক্ষা করতেন অনেকে। ফুটবলাররা ঢোকার মুখে ঘিরে ধরে কাকুতিমিনতি চালাতেন তাদেরও সঙ্গে নেয়ার জন্য। ব্যাপারটা ছিলো অনেকটা ওই লাগে তুক না লাগে তাকের মত আর কি। কখনও ফল মিলতো, কখনও মিলতো না। কেউ বা কখনোসখনো দয়াপরবশ হয়ে একাধজনকে সাথে নিতেন ,আবার কেউ পাত্তা না দিয়েই চলে যেতেন। সবারটা মনে নেই তবে দুজনের কথা আজও মনে আছে স্পষ্ট। মহম্মদ হাবিব আর চন্দ্রেশ্বর প্রসাদ। যাকে গোটা ময়দান চিনতো সি প্রসাদ নামে। ছ ফুট ছুঁইছুঁই দানবাকৃতি চেহারার স্টপার ব্যাক। তবে মনটাও শরীরের মতই বিশাল। গেটের কাছাকাছি এসেই শালপ্রাংশু, আজানুলম্বিত দু বাহু দুপাশে প্রসারিত করে দিতেন। যে কজন পারো ঝুলে পড়ো। ভেতরে গিয়েই এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলতেন পিঁপড়ের মত। মাটিতে পড়েই টেনে দৌড় সব্বাই গ্যালারির দিকে। সেসময় আমার পরিচিতদের মধ্যে অনেকেই গেট বৈতরণী প্রায় নিয়মিতভাবে পার হতেন সি প্রসাদের লেজ থুড়ি দু হাত ধরে।
অন্যজন মহম্মদ হাবিব। গেটের সামনে আসামাত্র ঘিরে ধরতো সমর্থকরা। সবার আবদার একটাই। মাঠে ঢোকাতে হবে। হাবিব। বেজায় সিরিয়াস ধরনের মানুষ। খুব একটা হাসতে দেখা যায়নি কোনদিন। ‘জ্যোতি বসু আর হাবিব, এই দুজনের মুখে হাসি দেখতে পাওয়াটা অত্যন্ত ভাগ্যের ব্যাপার’ – এরকম একটা জোক তখনকার দিনে খুব জোর চালু ছিলো এ শহরে।
এহেন হাবিব মিয়াঁ। গেটের সামনে এসেই ভালো করে একবার জরিপ করে নিতেন ভিড়টাকে। ভিড়ের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ আর সবচেয়ে অল্পবয়সী, এই দুজনকে ডেকে নিয়ে হাতদুটো ধরতেন শক্ত করে। পরমুহূর্তেই বোম্বাই একটা খ্যাঁকানি দিয়ে ভাগাতেন বাকি সবাইকে। তারপর দুজনের হাত ধরে গটগটিয়ে ঢুকে যেতেন প্লেয়ার্স গেট দিয়ে।
নামধামের ময়দান
———————-
কলকাতা ময়দানে তথা গড়ের মাঠের মহাতারকাদের মধ্যে অনেকেই দু-ধরণের নামে পরিচিত হতেন। প্রথমটা তাদের বাড়ির ডাকনাম। অপরটি সমর্থকদের কাছ থেকে শারীরিক অথবা অন্য কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে। প্রথম তালিকায় পরিমল দে ‘জংলা’, সমরেশ চৌধুরী ‘পিন্টু, গৌতম সরকার ‘কুটি’, প্রসূন ব্যানার্জি ‘গোপাল’, প্রণব গাঙ্গুলী আর সুব্রত ভট্টাচার্য ‘বাবলু’, স্বপন সেনগুপ্ত ‘চিংড়ি’, নির্মল সেনগুপ্ত ‘ঝুনু’, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ‘মনা’, সুরজিত সেনগুপ্ত বা বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য ‘বিশু’, সুভাষ ভৌমিক ‘ভোম্বল’ নামে অনেক বেশি পরিচিত ছিলেন কোলকাতা ময়দানে।
অন্যদিকে সমর্থকদের মুখে মুখে গোষ্ঠ পাল হয়ে গেছিলেন ‘চাইনিজ ওয়াল’, পি কে ব্যানার্জি ‘কানাডিয়ান টার্বো’, দীপু দাস, সাবির আলি বা অশোকলাল ব্যানার্জি ‘হেড মাস্টার’, মহম্মদ হাবিব ‘বড়ে মিয়াঁ’, ছোট ভাই মহম্মদ আকবর ‘ছোটে মিয়াঁ’, শ্যাম থাপা ‘গোল্ডেন বয়’, সুব্রত ভট্টাচার্য ‘সি আর পি’ বা ‘লগা’, পুঙ্গব কান্নন ‘ব্ল্যাক কোবরা’, চিমা ‘ব্ল্যাক প্যান্হার’, মইদুল ইসলাম ‘বাড়িওয়ালা’, প্রশান্ত ব্যানার্জি ‘বৌদি’, পিটার থঙ্গরাজ ‘ল্যাম্পপোস্ট’, বলাই দে ‘ফ্লাইং বার্ড’, অসীম মৌলিক ‘অরণ্যদেব’, মজিদ বাসকার ‘বাদশা’, হোসে রামিরেজ ব্যারেটো ‘সবুজ তোতা’, বাইচুং ভুটিয়া ‘পাহাড়ি বিছে’, মালসাওয়ামা টুলুঙ্গা ‘মামা’। আর হালফিলে লাল হলুদের দুই মণিপুরী মিডফিল্ডার নওবা আর ভাসুম তো ক্লাব সমর্থকদের মুখে মুখে হয়ে গেছিলেন বড় আদরের ‘টম এ্যান্ড জেরি’। এরকম আরো বেশ কিছু নাম মনে পড়ছে না ঠিক এই মুহূর্তে। পড়লে অবশ্যই জানিয়ে দেব। তবে চুনী গোস্বামীর শুভনাম মানে ভালো নাম কি, এটা কিন্তু রীতিমতো একটা কুইজের বিষয় হতে পারে। আপনাদের মানে অপার বাংলার পাঠকদের কাছে জানিয়ে রাখলাম চুপিচুপি। উত্তরটা হলো শ্রী সুবিমল গোস্বামী। কাউকে বলবেন না যেন।
ছোট টিমে বড় তারা
————————
তথাকথিত ছোট টিমে খেলেও টিমটিম করে জ্বলেননি এরা কেউ। হয়ে উঠেছিলেন ময়দানের উজ্জ্বল সব মহাতারকা। এই তালিকায় প্রথমেই আসবে দুই রেলওয়ে দলের নাম। বি এন আর ইস্টার্ন রেল। যেমন বি এন আরের আপ্পালারাজু, ভারালু, রাজেন্দ্র মোহন, কল্যান টিরকে, ডেনিস লাকড়া, দীপক দাস, বীরবাবু, অমিত দাশগুপ্তর নাম এদের মধ্যে সবিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে ইস্টার্ন রেলে পি কে ব্যানার্জি, উদয় শঙ্কর চৌধুরী, মীরকাশেম, সি আর দাসরা নিজেদের সময়ে ছিলেন ভারতীয় ফুটবলের উজ্জ্বল নক্ষত্র। এরা তারকা হয়ে উঠেছিলেন তিন প্রধানের জার্সি গায়ে না চড়িয়েই। এদের মধ্যে অনেকেই ভারতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন বিভিন্ন সময়ে। আবারও বলছি, সেটা বড় ক্লাবের তকমা না থাকা সত্বেও। আরও যেটা বলার, তিন প্রধান ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান আর মোহনবাগানকে টেক্কা দিয়ে ৬০-এর দশকে কোলকাতা লীগ আর বোম্বাইয়ে (তখন মুম্বাই হয়নি) রোভার্স কাপ জিতেছিল এই দুই টিম।
দুই রেল টিমের বাইরেও ফার্স্ট ডিভিশনের ক্লাবগুলোয় এমন কিছু ফুটবলার, যারা ৬০/৭০-এর দশকে হয়ে উঠেছিলেন বড় টিমগুলোর ত্রাস। এই তালিকায় এই মূহুর্তে মনে ভেসে উঠছে চারটে নাম। দেবী দত্ত, অনু চৌধুরী, কাশী নন্দী আর তন্ময় দত্ত। এদের মধ্যে প্রথম দুজন খেলতেন এরিয়ানে, তৃতীয় ও চতুর্থজন যথাক্রমে পোর্ট ট্রাস্ট এবং বাটা স্পোর্টসে। দেবী, অনু, কাশী সেন্টার ফরোয়ার্ড আর তন্ময় খেলতেন স্টপার ব্যাক পজিশনে। প্রথম তিনজনের গোলে একাধিকবার নাকের জলে চোখের জলে হতে হয়েছে তিণ প্রধানকে আর একইভাবে আটকে যেতে হয়েছে তন্ময়ের কাছে। আর খুব আশ্চর্যজনক ভাবে বড় ক্লাবের জার্সিতে এইসব অসামান্য ফুটবলারদের কাউকেই খেলতে দেখা যায়নি কোনদিন, যা সত্যিই অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক তিন প্রধানের সমর্থকদের কাছে।
এরাও খেলেছিলেন
———————–
ফুটবলাররা সাধারণত উঠে আসে হতদরিদ্র, নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। সারা পৃথিবীর ক্রীড়া ইতিহাসেই এটা বাস্তব এবং স্বীকৃত সত্য। আমাদের বাংলাও এর ব্যতিক্রম নয়। ৫০-এর দশক থেকে নিয়ে হালফিল, কলকাতা ময়দানে বড় ক্লাবে খেলতে চাওয়া ফুটবলারদের ক্ষেত্রে চারটে কারণ কাজ করতো বা এখনো করে এর পিছনে। সুনাম, অর্থ, সরকারি চাকরি এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ফুটবলের প্রতি তীব্র প্যাশন বা আবেগ। আর প্রথম তিনটি কারনের পিছনেও আবার একটা কমন ফ্যাক্টর কাজ করে। সেটা দারিদ্র্যকে জয় করা। এই প্রচলিত বৃত্তের বাইরে ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে মাত্র তিনজনকেই অধ্যাবধি চোখে পড়েছে আমার। এরা কেউই নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এমনকি সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানও নয়, এদের প্রত্যেকেরই উত্থান ঘটেছিলো অত্যন্ত ধনী ব্যবসায়ী পরিবার থেকে। এদের মধ্যে অন্যতম প্রণব গাঙ্গুলী, হাওড়ার এক অতীব ধনী শ্রেষ্ঠী পরিবারের সন্তান, সবুজ মেরুনের কিংবদন্তী লেফট আউট, ভারতীয় ফুটবলের আঙিনাতেও। দু’পায়ে গোলার মত শট আর সেই বিখ্যাত থ্রো! সাইড লাইন থেকে কর্নার কিকের মত সিধে গিয়ে পড়তো সতীর্থ স্ট্রাইকারের মাথায়। ময়দানে নামই হয়ে গেছিল ‘থ্রোয়ার’। গায়ে চড়িয়েছেন দেশের জার্সিও। ক্রিকেটও খেলেছেন ফার্স্ট ডিভিশনে। বাকি ফুটবলাররা যখন ট্রেনে, বাসে চড়ে ময়দানে আসতেন, প্রণব আসতেন তার নিজস্ব নীল রঙের ফিয়াট ড্রাইভ করে। গ্রীক ইশ্বর এ্যাপোলোর মত রূপবান প্রণব, মোহনবাগান টেন্টের সামনে গাড়ি পার্ক করে নেমে আসছেন, এ দৃশ্য আজও জীবন্ত একদা নিয়মিত মাঠে যাওয়া বহু প্রবীণের স্মৃতিতে।
দ্বিতীয় কল্যান সাহা। গড়িয়াহাটের মোড়ে এ শহরের অত্যন্ত বিখ্যাত এবং স্বনামধন্য এক বস্ত্র বিপনির মালিক বিপুল ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। কোটিপতি ব্যবসায়ীর জীবনের বদলে বেছে নিয়েছিলেন কোলকাতা ময়দানকে। লাল হলুদের দুরন্ত মিডফিল্ডার। ৭০ সালে এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ জয়ী ভারতীয় ফুটবল দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন কল্যান। অবসর নিয়েছিলেন সম্ভবত মোহনবাগানে খেলেই।
তালিকায় শেষ নামটা রবিন সিং। বর্তমান প্রজন্মের এই ফুটবলার দীর্ঘকাল চুটিয়ে খেলেছেন কোলকাতা ময়দানে, ইস্টবেঙ্গলের অজি উইঙ্গার টোলগের সেন্টার থেকে হেডে রবিনের গোল, বিখ্যাত হয়ে গেছিল গড়ের মাঠে। এছাড়াও খেলেছেন বেঙ্গালুরু এফ সি সহ একাধিক ক্লাবে। চড়িয়েছেন বাংলা সহ ভারতীয় দলের জার্সিও। অত্যন্ত ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে, ব্যবসা ছাড়াও দিল্লির উপকন্ঠে একাধিক ফার্মহাউস, এরকম একটা পারিবারিক ঘরানা সত্বেও জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ফুটবলকে। যা আজকের সময়ে বেশ খানিকটা বিস্ময়কর তো বটেই।
তিনজনের অন্যতম প্রণব গাঙ্গুলী, বর্তমানে থাকেন প্রবাসে মার্কিন মুলুকে। মাঝেমাঝে আসেন দেশে। একসময় দেখতাম প্রায় নিয়মিত পার্ক সার্কাস সেভেন পয়েন্টের ওপর ফলপট্টি থেকে ফল কিনছেন গাড়ি থেকে নেমে। আশি ছাড়িয়েছেন তাও বেশ কিছুকাল হলো। তবু নিজেই ড্রাইভ করতেন। তখনো কি নির্মেদ, ঋজু, সুঠাম চেহারা। এখনও। আর সেই একইরকম রূপবান। চিরকাল এরকমই সবুজ থাকুন কলকাতা ময়দানের ‘থ্রোয়ার’, চির মোহনবাগানি শ্রী প্রণব গাঙ্গুলী।
দ্বিতীয় রবিন সিং। সম্প্রতি খেলোয়াড় জীবন থেকে অবসর নিলেও জড়িয়ে রয়েছেন ফুটবলের সঙ্গেই। দেশের একাধিক ফুটবল টুর্নামেন্টে বিভিন্ন চ্যানেলে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ধারাভাষ্য দিতে দেখা যায় তাঁকে।
অতঃপর কল্যান সাহা। এরকম অনেক বিখ্যাত ফুটবলার আছেন যারা ফুটবল থেকে অবসর নেয়ার পর ময়দানের সঙ্গে সম্পর্কই চুকিয়ে দিয়েছেন বলতে গেলে। যেমন তুলসীদাস বলরাম, স্বপন সেনগুপ্ত, সুধীর কর্মকার, এরকম আরো অনেকে। কল্যানও এই তালিকায় পড়েন। আর এভাবেই একদিন চলে গেছেন বিস্মৃতির অন্তরালে! শেষ তথ্য অজানা।
আসলে কোলকাতা ময়দানের ফুটবল আর তার প্রায় দ্বিশতক অতিক্রান্ত ইতিহাস যেখানে এই খেলাটা শুধুমাত্র খেলা নয়, সমগ্র বাঙালি জাতিসত্বার এক অনন্য যাপন চিত্র, আ ওয়ে অফ লাইফ! তিন প্রধানের ক্লাব অন্ত প্রাণ কোটি কোটি সমর্থক, প্রিয় ক্লাবকে নিয়ে তাদের উন্মাদণা, খেলার বাইরেও গড়ে ওঠা কত মিথ, ঘটে যাওয়া কত ঘটনা অথবা ঘটনাক্রম, বাঙালির প্রিয়তম খাদ্য মাছের তালিকায় সেরা দুই মাছের ক্লাব সিম্বল হয়ে ওঠা, গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব এবং শত্রুতা, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল, লিডস, টটেনহাম হটস্পারের মতই সাবেক সংস্কৃতি, বনেদীয়ানা…এই বিপুল ঐশ্বর্য সম্ভারকে ধারণ করার জন্য একটা আর্কাইভও বোধহয় যথেষ্ট নয়। ফলে লেখা হলো না অনেককিছু, করা গেলো না বহু অমূল্য স্মৃতিচারণ আর দাস্তান-এ-ময়দানেও ইতি পড়লো আপাতত। প্রবাসী বন্ধুরা (এবং বাকিরাও) পড়ুন এবং পড়ান। যদি ভালো লাগে, যদি নিজের মাটিতে ফেলে আসা স্মৃতির সঙ্গে কোথাও মিল খুঁজে পান আর সর্বোপরি অপার বাংলা পত্রিকা কর্তৃপক্ষ যদি পুনঃপ্রকাশের যোগ্য মনে করেন, কথা দিচ্ছি, আগামী শারদীয় সংখ্যায় এখানেই প্রকাশিত হবে ‘ফির দাস্তান – এ – ময়দান’। ততক্ষণ…
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
আমার বয়সও লেখকের কাছাকাছি তাই এই লেখা সমস্ত রসটুকু চেটেপুটে উপভোগ করলাম। দু-একটা বাংলা বানান সংশোধনের দরকার। বাকি লেখা এক কথায় অসাধারণ। কিন্তু কোন জায়গায় তৎকালীন ফুটবলের আকৃতি এবং চেহারা সম্বন্ধে কিছু পেলাম না। ফুটবলের চামড়াকে দড়ি দিয়ে বাঁধা হতো, এটা আজকের দিনের মানুষের খুব জানা দরকার। ভালো থাকবেন। প্রণাম নেবেন।
সুপ্রিয়দা, আমি উজ্জ্বল, ( স্বপনের বন্ধু ),
যাকে আপনি সব সময় “ডাক্তার”বলে ডাকতেন। জানি না মনে আছে কিনা, কিন্তু আমি সবই মনে রেখেছি। সেই E- M ম্যাচ, ইস্টবেঙ্গল ৪-১ গোলে জিতেছিল, তারপর অভিজিৎ -এর বাড়িতে লুচি -মাংস খাওয়া। ওফ!!! কি সব আনন্দের দিন গেছে। আপনার লেখা “রাশিয়ান রুলেট” এবং ” সিউডো উইডো” দুটোই পড়েছি। অসাধারণ! বর্তমান বাংলা সাহিত্যে এতো ভালো ক্রাইম থ্রিলার নেই। আপনাকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই।