একজন অশীতিপর তরুণ, দেবেশ রায়

একজন অশীতিপর তরুণ, দেবেশ রায়
তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
এ সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক দেবেশ রায় খুব আকস্মিকভাবে প্রয়াত হয়েছেন গত ১৪ জুন রাতে। এ নয় যে, তিনি অকাল প্রয়াত। আশির গন্ডি পেরিয়েছেন কয়েক বছর আগে। কিন্তু এই বয়সেও তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে তরুণ। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর মেধা ছিল একই রকম প্রখর যেমনটি ছিল যুবক বয়সে। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল অসম্ভব। এখনও প্রতিদিন নিয়ম করে লিখতে বসতেন, যখন লিখতেন না, পড়তেন বাকি সময়। পড়তেন বিশ্বসাহিত্যের শেষতম ভালো সাহিত্য, পড়তেন বাংলাসাহিত্যের তরুণতম লেখক-লেখিকার গল্প-উপন্যাসও।
তাঁর প্রয়াণ এতই আকস্মিক যে, বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল। শেষ কয়েক বছর কানে শুনতে পেতেন না বলে কথা বলতেন হোয়াটস্ আপে। আমি শেষবার কথা বলেছি লকডাউন শুরু হওয়ার কয়েকদিন পর। ‘এই পর্বে আপনার কী অভিজ্ঞতা ‘ জিজ্ঞাসা করায় বলেছিলেন ‘আমি খুব ভালো আছি। কোনও অসুবিধায় হচ্ছে না। দুজন কাজের মেয়ের একজন আসতে পারছে না, অন্যজন সারাক্ষন দেখাশুনো করছে। ‘অশীতিপর একজন তরুণের এই হল জীবনদর্শন।
তাঁর আত্মবিশ্বাস থেকেই বোঝা যায় একটা ফ্ল্যাটে এক থাকেন, অথচ সারা বিশ্ব যখন অনিশ্চয়তায় ভুগছে, তিনি অকুতোভয়। হঠাৎ তাঁর এই অসুস্থতা, তখনও শুনলাম বলেছেন, ‘তেমন কিছু নয়। অথচ —
গত বছর একবার গুরুতর অসুস্থ হয়েছিলেন, হিমোগ্লোবিন ৬, তার মধ্যেও লেখালিখি করছিলেন, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আবার নিজের টেবিলে কাজ করছিলেন স্বমহিমায়। ঘরে একা থাকার সমস্যা বুঝে তাঁর পুত্রবধূ জোর করে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন দিল্লিতে, একটু সুস্থ হতেই বলেছিলেন পুজোর আগে আমি কলকাতা ফিরবই।
গত তিরিশ বছরেরও বেশি আমরা দেবেশদার সান্নিধ্য পেয়েছি। এরকম পণ্ডিত মানুষ বাংলা সাহিত্যে হাতে-গোনা। একের পর এক তাঁর উপন্যাস কাঁপিয়ে দিয়েছে বাংলা সাহিত্যের প্রাঙ্গণ। মফস্বলী বৃত্তান্ত, তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, সময়-অসময়ের বৃত্তান্ত, দাঙ্গার প্রতিবেদন। সর্বশেষ বই, সুবৃহৎ উপন্যাস বরিশালের যোগেন মন্ডল।

শেষ বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা হাজার পৃষ্ঠার উপর, একশো একাশিটি পরিচ্ছেদ। বাংলার অনেক মানুষই হয়তো যোগেন মণ্ডলের নাম শোনেননি, অথচ সেই মানুষটিকে নিয়ে কয়েক বছর অশেষ পরিশ্রম করে লিখলেন এত বড়ো মাপের একটি উপন্যাস। অবিভক্ত বাংলার তপশিলি নেতা বরিশালের যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ছিলেন অবিসংবাদিত শূদ্রনেতা। তিনিই একমাত্র ভারতীয় যিনি পাকিস্তানকে তাঁর স্বদেশ বলেছিলেন ও সেই কালবেলায় ভারতবর্ষ -ধ্যানটিকে রক্ষা করেছিলেন। দেবেশ রায় শুধু ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন শিক্ষকও। মনে পড়ে নব্বই দশকের প্রথমে চৌরঙ্গীমোড়ের বিশাল বাড়িটির তিনতলায় ছিল ‘প্রতিক্ষণ ‘-এর অফিস। সেখানে প্রতি বৃহস্পতিবার আসতেন, আমরা বেশ কয়েকজন সমকালীন লেখক বসতাম তাঁকে ঘিরে। তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ কথা শুনতাম খুবই মনোযোগ দিয়ে। বিশ্বসাহিত্য নিয়ে কথা বলতেন বেশি। কাকে বলে ভালো উপন্যাস। কেন ভালো। বেশ অথোরিটি নিয়ে কথা বলতেন। সাহিত্য বিষয়ে কত খবর যে রাখেন, কত পরামর্শ দিতেন লেখার বিষয়ে, তা আমাদের কাছে ছিল অমূল্য সম্পদ।
বিশ্ব সাহিত্যের আধুনিকতম গল্পগুলির সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিতে তিনি সেবার একটি বড়ো প্রকল্প হাতে নিলেন ‘প্রতিক্ষণ ‘পত্রিকার তরফে। বিদেশের নানা ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনূদিত একাধিক সংকলন থেকে একটি করে গল্পের ফটোকপি তুলে দিলেন আমাদের হাতে। বললেন বাংলায় অনুবাদ করে তাঁর কাছে দিতে। মাসখানেকের মধ্যে সব অনুবাদ হাতে পেতে প্রকাশ করলেন একটি অসাধারণ বই, ‘সেই মোহনার ধারে’। সাতাশটি গল্প নিয়ে বইটি, যার প্রথম গল্প ছিল সিংহলী ভাষা থেকে, শেষ গল্প চেক ভাষার। মাঝে ল্যাটিন আমেরিকা, ইজরায়েল, লেবানন, জাপান, পাকিস্তান, ঘানা, পোল্যান্ড-এরকম প্রায় সমগ্র বিশ্বকে তুলে ধরলেন দু’মলাটের মধ্যে। আমার হাতে পড়েছিল ইজরায়েলের স্যামুয়েল যোশফ অ্যাগনানের লেখা একটি গল্প, যার শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘পুনযৌর্বনের দিনগুলি’।
গল্পগুলি নিয়ে বেশ কয়েকদিন আলোচনাও করেছিলেন বিশ্ব সাহিত্যের শেষতম ধরন নিয়ে। অন্য দেশের গল্প পড়ার একটা সুবিধে হল সেখানকার মানুষদের যেমন জানা যায়, তাদের জীবনযাপন, সংকটের সঙ্গেও পরিচিত হওয়া যায়। গল্পের বিষয়ও কত অভিনব হতে পারে তাও জানা গেলো সংকলনটি থেকে।
তাঁকে স্বমহিমায় পাওয়া যেত কোনো বক্তৃতা সভায়। সভায় বলতে পারাটা ছিল তাঁর খুব প্রিয়। ঘন্টার পর ঘন্টা বলতে তাঁর কোনোও ক্লান্তি ছিল না। বলতে পারতেন নানা বিষয়ে। খুবই পান্ডিত্যপূর্ণ ছিল সেই সব ভাষণ। খুবই কর্তৃত্ব নিয়ে বলতেন তাঁর বক্তব্য।
গল্প-উপন্যাস ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রবন্ধ লিখতেন। বেশিরভাগই সাহিত্য বিষয়ে, কিন্তু রাজনৈতিক বিষয়গুলিও বিশ্লেষণ করতেন খুব প্রাঞ্জল করে। শেষ দিকে নানা সংবাদপত্রে পোস্ট -এডিটোরিয়াল লিখতেন সমকালীন বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করে। একটি দৈনিকে লিখছিলেন আত্মজীবনীর নানা খণ্ডাংশ।
গত দু বছরে আমি দু’বার তাঁর ফ্ল্যাটে গেছি। দুটো বই দিতে। ‘দ্বৈরথ ‘ আর ‘নদী মাটি অরণ্য’। বললেন, এতো বড়ো বই, সময় লাগবে। ‘দ্বৈরথ ‘ পড়তে শুরু করে আমাকে একদিন বকলেন, বললেন, ‘গ্রামবাংলা সম্পর্কে যার এত অভিজ্ঞতা, সে কেন গোয়েন্দা উপন্যাস লিখবে! ‘দ্বৈরথ ‘ পড়তে পড়তে হোয়াটস আপে অনেক কিছু লিখলেন বইটি সম্পর্কে। তারপর একদিন লিখলেন, আমি দিল্লী যাচ্ছি, দ্বৈরথ পড়া শেষ হয়নি বলে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি দিল্লিতে। আমি অবাক, এরকম ঢাউস একটা বই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন দিল্লিতে।
দিল্লি থেকে ফিরে এসে উপন্যাসটি নিয়ে একটা বড়ো প্রবন্ধ লিখলেন ‘একান্তর’ পত্রিকায়।
আমার ভাবনার ত্রিসীমানায় ছিল না উনি লিখবেন। প্রবন্ধটিতে আমার সমকালীন আরও কয়েকজন লেখকের লেখার প্রশংসা করলেন।
অনুজ এতজন লেখকের লেখা খুঁটিয়ে পড়া, কারও লেখা ভালো লাগলে তাকে ফোন করে বলা, কোথাও ত্রূটি নজরে পড়লে সে-বিষয়ে আলোচনা করা–তাঁর সময়ের লেখকদের চেয়ে তিনি এখানেও এগিয়ে।
আমার আরও কৃতজ্ঞতা বীরবল উপন্যাস লেখা শুরু করার পর। বললেন, ‘বীরবলকে নিয়ে লেখার কথা ভেবেছেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।’ এক সন্ধেয় অনেক পরামর্শ দিলেন উপন্যাসটির গঠন বিষয়ে। ‘বর্তমান’ পত্রিকার রবিবারের পাতায় প্রথম কিস্তি বেরোনোর পর এক দীর্ঘ চিঠি লিখলেন আমাকে উৎসাহ দিয়ে। বইটি উৎসর্গ করেছি তাঁকেই। বইটি বেরোনের পর আমার ভূমিকা অংশে কয়েকটা ছাপার ভুল থাকায় লিখলাম, ভুল সংশোধন করতে গিয়েছি, হাতে পেলেই আপনার কাছে যাব বইটি দিতে। তারপর হঠাৎ লক ডাউন। বইটি তাঁর হাতে দিতে পারলাম না এ আপশোস আমার কখনও যাবে না। কি যে ঘটে গেল!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *