স্মৃতিচারণ – প্রদীপ ঘোষ
চন্দ্রিমা রায়
প্রদীপ ঘোষ- বাংলা আবৃত্তির ইতিহাসের এক নাম। তাঁকে প্রথম চেনা যে বয়সে, তখন আমি নিতান্তই শিশু। বাড়িতে আবৃত্তি শব্দটির সঙ্গে সমোচ্চারিত হত তিনটি নাম- কাজী সব্যসাচী, শম্ভু মিত্র, প্রদীপ ঘোষ। তখন ক্যাসেট বাজানোর চল ছিল বাড়িতে বাড়িতে, পুজোর সময় ক্যাসেট আবার রোদেও দেওয়া হত। সেই তাঁকে দেখা, কালো চশমার মোটা কাঁচের আড়ালে দুটি জ্বলজ্বলে চোখ, মাথায় সাদা চুল। ক্যাসেটের ওপর লেখা –‘কামাল পাশা’, ‘আফ্রিকার বুকে একটি সকাল’, ‘পায়ে চলার পথ’। আমার দেখা জীবন্ত কিংবদন্তীদের একজন- প্রদীপ ঘোষ। প্রজ্ঞা কোনোদিন যার বিনয়কে স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং স্কিল- দুইই বহুমাত্রিক। যে কোনও একটি দিক নিয়ে শুরু করলেই শেষ করা মুশকিল। কিন্তু যেটুকু জানার সুযোগ পেয়েছি, আজ সেটুকুই ভাগ করে নেওয়া।
যে কোনও শিল্পীর কাজ কে বাকি সকলের থেকে যা আলাদা করে তা হল তাঁর মনন, চর্চা ও যাপন। প্রদীপ ঘোষ এক নির্মোহ সাধক। বারে বারে বলেছেন, “ভালো আবৃত্তিকার হতে গেলে আগে ভালো পাঠক হতে হয়। শুধু কবিতার জেরক্স চাইলে হয়না। একজন কবিকে বুঝতে গেলে গভীরভাবে তাঁর লেখা পড়তে হবে। জানতে হবে সে লেখার প্রেক্ষাপট, পরিপ্রেক্ষিত ও ইতিহাস”। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বিশ্বাসকে তিনি ধুলিকনার মত আগলে রেখেছেন। শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্ব সাহিত্যের অলিন্দ নিলয়ে অমন অবাধ যাতায়াত খুব কম মানুষেরই থাকে। বিশ্ব রাজনীতি, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বাংলা কবিতার তাৎপর্য সন্ধানে তিনি চিরদিন নিবিষ্ট ছাত্র। “relevanceবিহীন আবৃত্তি আস্ফালনেরই নামান্তর। সে উচ্চারণ একটি পাতাকেও কাঁপায় না” বলেছেন আমায় বারংবার। শুধু নিজের বিশ্বাসকে আগলে থাকা নয়, স্নেহভাজন অনুজদের মধ্যে সে বিশ্বাস জারিত করার নিয়ত চেষ্টা করে গেছেন তিনি। যেমনটা পরিবারের অভিবাবকদের করনীয়। শুধু skill বা expertise নয়, তাঁর আবৃত্তি চিরকালীন, তাঁর দুর্লভ মননের গুনেও।
তাঁর যে গুনটি আমাদের সবাইকে বিমোহিত করে রাখতো, তা হল তাঁর বাগ্মীতা। অমন জলের মত অনর্গল শব্দধারা তাঁর উচ্চারণে ঝরে পড়ত মুক্তোর মত। কি জমাট বুনন! কি সুচিন্তিত ভাবনা বিন্যাস! কিন্তু কখনই তাতে কালোয়াতির ছায়াটুকুও আসতো না। তাঁকে দেখেই শিখেছি কিভাবে কাঠিন্যের পাশ কাটিয়ে শ্রোতার হৃদয়ের কাছে রেখে আসতে হয় নিজের শব্দগুলোকে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বুঝি, shortcut বা strategy নয়, অনুশীলন এবং একমাত্র অনুশীলনই সেই পথ নির্মাণ করতে পারে, আজীবন এই অনুশীলন করতে পারলে কেউ প্রদীপ ঘোষ হন।
অনেকেই জানি হয়তো, শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসার কথা। প্রগাঢ় অনুরাগ বাংলা গানের প্রতিও। ইনস্টলেশন ফরম্যাটে কাজ করতে শুরু করেছি সদ্য। একদিন জিজ্ঞেস করলেন “কী কী কাজ করছো তোমরা ? মিশন, ভিশ্ন, অ্যাকশন প্ল্যান (mission, vision, action plan) আলাদা আলাদা বল” উত্তেজনার পারদে উদোর পিন্ডি ভুদোর ঘাড়ে চাপে আর কি তখন! অবধারিত বুঝলাম নুড়িকে পাহাড় ভেবে নিয়ে বসেছিলাম এতদিন। কাজটা আদতে দানাই বাঁধেনি। কিঞ্চিৎ মন খারাপ হলো! উল্টোদিকের কাঠের চেয়ারে বসা প্রদীপ কাকুর মুখে তখন মিটিমিটি হাসি; বলতে লাগলেন গল্প,- এম. এস. শুভলক্ষ্মী, সংযুক্তা পানিগ্রাহী, উদয় শংকর এর সঙ্গে তাঁর কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা। ডাইভারশন (diversion) এবং ডাইলিউশন (dilution) এর মাঝে নিজের আর্ট ফর্মটিকে টিকিয়ে রাখার কথা। এবং সেই গল্প থেকে আমি স্পষ্ট খুঁজে পেলাম সমাধানের পথ। সঙ্গে এও ভেবে বিস্মিত হলাম এমন কোন কাজটা তাঁরা করেননি যা আমরাই প্রথম করছি ভেবে আত্মশ্লাঘায় ডুবে মরেছি এতদিন! বিদেশে প্রথম আবৃত্তি নিয়ে গেছেন প্রদীপ ঘোষ। আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের হাসপাতালে ক্যান্সার আক্রান্তদের কবিতা শুনিয়ে সেখানকার ডাক্তারদের সঙ্গে মিউজিক থেরাপির অ্যাপ্লিকেশনের কাজ করেছেন তিনি। এই সময় দাঁড়িয়ে এসব কথা ভাবতে গেলে শুধু অবাকই হতে হয়!
আবৃত্তির সঙ্গে ‘না দেখে বলা’ বিষয়ে অনেকের মত আমারও কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল। এ ব্যাপারে তাঁর মত ছিল খুব স্পষ্ট। তিমি মনে করতেন “আবৃত্তি স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা নয়। না দেখে বলার উদ্যোগ সর্বত ভাবেই স্বাগত যদি তাতে একটি শব্দও অদলবদল না হয়”। কবিতা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বারাংবার বলেছেন এ কথা। অত্যন্ত অপছন্দ করতেন লাইন ভুল বলার, শব্দ এদিক ওদিক করার অভ্যেসকে। একথাও বলেছেন বেশ কয়েকবার—“আমরা অগ্রজ প্রজন্ম হাতে বই বা কাগজ রেখে বলি মানে এই নয় যে কবিতা গুলি আমাদের মুখস্থ নেই। অধিকাংশ কবিতাই আমাদের স্মৃতিতে থাকে। কিন্তু বলার সময় একটি শব্দও ভুল বলতে চাইনা। কবির লেখা কবিতার একটি শব্দও ভুল বলার অধিকার নেই আবৃত্তিকারের”। অধুনা সময়ে একটি চল হয়েছে অধিকাংশ কবিতা বা গানের মাঝের লাইন থেকে বলতে বা গাইতে শুরু করা। এই বিষয়েও একটি সুচিন্তিত ও স্পষ্ট বক্তব্য ছিল তাঁর, “Anything in the name of the experimentation does not qualify to be an experiment. পরীক্ষার সাথে নিরীক্ষার সম্পর্ক সমানুপাতিক। দীর্ঘকালীন গবেষণা, সুবিন্যস্ত তথ্যাদি এবং সুপ্রযুক্ত চিন্তা ভাবনা ছাড়া কোনও ধারনাই কক্ষনো নিরীক্ষার পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়না। পরীক্ষা তো অনেক দুরের কথা!” ‘Art for the sake of Art’ এ বিশ্বাসী প্রদীপকাকু কোনওরকম ফাঁকিবাজিকে জ্ঞানত প্রশ্রয় বা ছাড়পত্র দেন নি কোনোদিন। এখন যখন PR, Sponsorship, Event Partnership এর আধিপত্যে সংস্কৃতি জগতের ফিল্টার সার্কিট গুলি ক্রমশই অশক্ত, অথর্ব, অকেজো হতে হতে বাতিল হয়ে গেছে একেবারেই- সেই সময়েও যোধপুর পার্কের বাড়ির দোতলায় তাঁর নিজের সিগনেচার চেয়ারটিতে সজাগ বসে থাকেন প্রদীপ ঘোষ- আপোষহীন, অবিমিশ্র, অনড়- standing erect for the standard.
প্রদীপ ঘোষ সম্পর্কে লিখতে গেলে যে কথা না বললেই নয়, তাহলো ওনার পরিমিতিবোধ, সৌজন্যবোধ ও শালীনতা। আপাত নির্বিরোধী, সদাহাস্যমুখ, স্নেহপ্রবণ এই মানুষটি তার গভীরে ধূলিকণার মত লালন করেছেন তাঁর আদর্শ, জীবনবোধ এবং সত্যনিষ্ঠাকে। বৈভব, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কোন রকমের গেম প্ল্যান কোনদিন তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। আবৃত্তিকার হয়ে উপস্থাপকের কাজ করব কিনা এ নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম একসময়। ত্রাতা প্রদীপকাকু! বললেন “চুস ইয়োর ব্যাটেলস ওয়াইসলি (choose your battles wisely)”। বলেছিলেন “কবিতা জানা মানেই আ্যাঙ্কারিং এর মাঝে জোর করে কবিতা গুঁজে দিও না। ওতে অশিক্ষা প্রকাশ পায়। ইউ শুড সারভ আর্ট, নট ইয়োর ইগো (you should serve art, not your ego)”। এই পরিমিতিবোধ একজন শিল্পীর চরিত্র নির্মাণ করে; নির্মাণ করে তার ভাবমূর্তি।
প্রফেশনাল হ্যাজারডস অনেক সময়ই চেনা মানুষের মুখ বদলায়। দীর্ঘদিনের ভাবনায় আঘাত লাগে, রক্তপাত হয়, অভিযোগ, আক্রোশ জন্মায়। সে সবকিছুরই ঝাঁপি উপুড় করেছি তাঁর কাছে। শুনেছেন, ভেবেছেন, তারপর গভীরভাবে ডুবে গল্প বলেছেন। তাঁর শিক্ষকদের গল্প, অধ্যাপকদের গল্প, কবি বিষ্ণু দের গল্প, আচার্য তারাপদ চক্রবর্তীর গল্প। সে গল্পের অনুচ্চারিত নীতিবাক্যটি ছিল “আপোষ করোনা। সাধনায় সন্নিষ্ঠ হও আরো নিবিড় ভাবে”। অতি আপনজন না হলে কেউ মনের এমন যত্ন করে না, আজ বুঝি……
ক্যাসেটের খাপের ওপর লেখা প্রদীপ ঘোষ থেকে প্রদীপ কাকু– এক দীর্ঘ যাত্রাপথ। সে ইতিহাসের অবতরণ এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। তবে একথা না বললেই নয়, প্রদীপ কাকুর চলে যাওয়া আমার খুব গভীর ব্যক্তিগত ক্ষতি। নিকটজনদের অনেকেই কপট অনুযোগ করতেন তাঁর কাছে আমি নাকি একটু বেশিই প্রশ্রয় এবং আদর পেয়ে এসেছি। আমার নাকি সাত খুন মাপ সদাসর্বদা। কথাটা মিথ্যে নয়। অসীম স্নেহ দিয়েছেন তিনি। কলেজ থেকে যাওয়া মাত্র ব্যস্ত হয়ে পড়তেন…হাঁক পাড়তেন ভিতরে, “রুবি রুবি মেয়েটাকে খেতে দাও, কলেজ করে এসেছে”। বাড়ি ফিরে ফোন করতে দেরি হলে, তাঁর ল্যান্ডনম্বর থেকে ফোন পৌঁছে যেত “দিদিভাই পৌঁছলে?” এই ফোন গুলো জীবন থেকে ক্রমশ নেই হয়ে গেলে বোঝা যায় মাথার ওপরের রোদ্দুর বড্ড চড়া!
আবৃত্তির ইতিহাসে তিনি প্রবাদপুরুষ, চিরউজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তবু ব্যক্তিগত পরিসরের ক্ষতিটুকু রয়েই যায়। শেষের দিকে অসুস্থ হচ্ছিলেন বারবার। রুবি কাকিমা (ওঁর স্ত্রী) চলে যাবার পর আরো নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। শেষ দেখা কুড়ির মার্চ মাসে, রবীন্দ্র সদনে, কবিতা উৎসবে। জীবনের কী আশ্চর্য খেলা! সেদিন মঞ্চে তাঁর সঙ্গে একই সাথে বলার সুযোগ হলো আমার! এমন স্বপ্ন সত্যি হয় বুঝি? নিজেই জিজ্ঞেস করলেন “কী বলবে দিদিভাই?” আমি অপশন হিসেবে দুটো কবিতার নাম বললাম। উনিই বেছে দিলেন। বললেন “’পথের দিশা’ই বলো। সিলেকশন শোস ইয়োর ক্লাস (selection shows your class)”। সেদিনও জানতাম না আর দেখা হবে না, ঐ শেষ দেখা। ওই শেষবার শোনা, তাঁর আদরের ডাক ‘দিদিভাই’!
এই নীরব নিভৃত একাকী যাওয়া প্রদীপকাকুর একেবারেই প্রাপ্য ছিল না। শালীনতার, শিক্ষা ও সৌজন্যের পরোয়া না করা এই অসভ্য সময়ের কাছে প্রদীপ ঘোষ একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। একটি কমপ্লিট স্ট্যান্ডার্ড। এমন একটি দৃষ্টান্ত যাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করলেও আমরা নিজেরা উদ্ধার হতে পারি। অগ্রজ প্রজন্মকে ঠিক কেমন হলে মানায় প্রদীপ ঘোষ তার এপিটোম। অ্যাচিভমেন্ট কোনদিন তাঁর সহজিমাকে গ্রাস করতে পারিনি। এখানেই তিনি আলোর মতো সত্য, ভোরের মতো পুণ্যতোয়া, আকাশের মতো অনন্ত!
এই গান টুকুই কান্না হয়ে এসেছিল সেই দিন……
“যাও রে অনন্ত ধামে, অমৃতনিকেতনে-
অমরগণ লইবে তোমা উদার-প্রাণে।
দেবঋষি রাজঋষি ব্রহ্মঋষি যে লোকে
ধ্যানভরে গান করে একতানে-
যাও রে অনন্ত ধামে জ্যোতির্ময় আলয়ে…”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
“চুস ইয়োর ব্যাটেলস ওয়াইসলি (choose your battles wisely)”। বলেছিলেন “কবিতা জানা মানেই আ্যাঙ্কারিং এর মাঝে জোর করে কবিতা গুঁজে দিও না। ওতে অশিক্ষা প্রকাশ পায়।
ভীষন সত্য
Onek din pore ek hridaygrahi lekhar poros mon take chhueny gelo. Eto Sabyasachi jar bachik protiva ebong kolom soman tale chole.
Asadharan ekti shardharghya. Lekhati mon chhuye jai. Kabi r shilpi mononer o unar kabita sammandhhe dristi vangi ei lekhati pare jante pari. Khub sundar.
মন প্রাণ ভরে গেল। তাঁর সঙ্গে আমারও পরিচয় বহুদিনের। তাঁর মতো আপাদমস্তক ভদ্র মানুষ আমি কম পেয়েছি। আপনি খুব সত্যি বলেছেন। তাঁকে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই।
Sabai k ank dhonyobad.
Beautiful write up and very well expressed. Attyanto shundor aantorik prokash o uccho maaper lekha.