bibidho-majumder-tini

মজুমদার তিনি, পিতৃনামে প্রিয়জন
স্মৃতিচারণা
নবকুমার বসু


প্রিয়জন বিয়োগের অবিশ্বাসী আকস্মিক ধাক্কা খাওয়ার অনুভবটা এখনও যায়নি। যাওয়ার কথাও না। কেননা কলকাতা মাস দুয়েক আগে ফেরার সময়ও টেলিফোনে কথা হয়েছিল। তার আগে বইমেলায় আনন্দ-র স্টল-এর পেছনের ঘরে, বলা উচিত, সমরেশদা (পিতৃনামের মজুমদারকে দাদা- সম্বোধন করতে সময় লেগেছিল, কিন্তু আড্ডা আর আন্তরিকতায় মেশা দাদা-ভাই সম্পর্কে ভেসে যেতে সময় লাগেনি!) -র সঙ্গে ওইভাবে ওখানে দেখা হওয়াটা ছিল নেহাতই ফর্মালিটি। কিংবা বলা যায় ‘বার্ডস অফ সেম ফেদার, ফ্লক্‌ টুগেদার’-এর মতো। আনন্দর ঘরে বই থাকলে, বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে সকলেই একবার পেছনের ওই ঘরে ঢুঁ মারেন।

সেখানে এককাপ কফি খেতে খেতে যেটুকু দেখা বা কথা হয়, আসলে বহু বছর যাবত সেটা হচ্ছে, মেলা থেকে বেরিয়ে কোথায় বসা হবে, কীভাবে যাওয়া হবে… সেই ব্যাপারে সামান্য পরিকল্পনাটুকু সেরে নেওয়া। বইমেলা হচ্ছে কমন জায়গা, আনন্দ পাবলিশার্স-এর পেছনে বসার ঘরটা হচ্ছে কমনেস্ট মিটিং প্লেস। সময়ের এধার-ওধারে দেখা না হলেও, সুবীর মিত্র, রাতুল বা তিলোত্তমার কাছ থেকে ঠিক সংবাদ পাওয়া যাবে – কে – কখন – কোথায়… ইত্যাদি।

শীত ফুরিয়ে যখন অশান্ত বসন্তের হাওয়ায় শ্রীপঞ্চমী আসব-আসব করছে, তখন বইমেলা উপলক্ষ্য করে, বহু বছর ধরেই এ হেন একটা রুটিন চালু হয়েছিল। অন্য সময়, অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে দেখা হোক বা না-হোক, এমনকী দূরভাষেও যোগাযোগ হোক বা না-হোক, মেলার মাঠে ওই ঠেক্‌, অনিবার্য ঠিকানাই বলা যায়।

বিকেল থেকে মেলায় ঘুরে বেড়ানোর ক্লান্তি কাটাতে অতঃপর কোথাও গিয়ে বসা। কতবার এমনও হয়েছে, তা সে পার্কসার্কাসের মিলনমেলা কিংবা সল্টলেক-এর করুণাময়ীর বইমেলা যেখান থেকেই হোক, ক্লাব বা কোনো পানশালায় না গিয়ে কাছাকাছি চেনাজানা প্রিয়জনের বাড়িতে গিয়েও বসা হয়েছে। সেটা অবশ্য পূর্বনির্ধারিত হতো। আসল ব্যাপারটাই ছিল মেলা থেকে সমরেশদাকে ধরে নেওয়া। তারপর নির্ভেজাল নিজেদের আড্ডায় বসা। বলে রাখা ভাল, ধরে নেওয়ার ব্যাপারটা অবশ্য একপেশে হতো না। সমরেশদা মানুষটা এমনই ইনহিবিশন-ফ্রি ছিলেন যে, এই অধীনের মতো নগণ্য লেখককে বিভিন্ন জায়গা থেকে তিনিই ধরে নিয়েছেন… কখনও নিরামিষ অপছন্দের আড্ডার কম্পালশন থেকে, চমৎকার তাৎক্ষণিক গল্পের ধোঁকা দিয়ে উদ্ধার করে নিয়ে গেছেন। বড় মনের মানুষ না হলে সেটা হতো না।

তবে এটুকুও বলা থাক, মজুমদার লেখকমশায়ের সঙ্গে সম্পর্কের অমন রসায়ন সোজাসুজি হয়নি। তারও গপ্পো আছে।

শুধু সমরেশদা নয়, আরও অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক রচনার নিরিখে কিংবা গড়ে ওঠার গোড়াপত্তনের সময়, আমাকে মাঝে মাঝেই কিছু অসহায় হিউমিলিয়েশনের শিকার হতে হয়েছে। কেন বুঝতে পারছেন?

কেননা আমার বাবার নাম সমরেশ বসু।

একসময় ওই খ্যাতিমান, স্টার লেখকটির সঙ্গে এই অধীনের মুখের মিলও ছিল যথেষ্ট। পরিচিতি ধরা পড়ে যেত আপনিই।

যখন থেকে লেখালিখি নিয়ে আমি আমার মতো পত্রপত্রিকার দপ্তরে ঘোরাঘুরি শুরু করেছি, তখন থেকেই আমাকে সম্পূর্ণ বিনা দোষে বিনা কারণে, ওইরকম হিউমিলিয়েটেড হওয়ার অভিজ্ঞতা মানতে হয়েছে। আর এখন এই বয়েসে পৌঁছে বলতে আর কোনো সংকোচ নেই যে, আমাদের দেশের নাম করা ভাল পত্রপত্রিকার সম্পাদক বা সম্পাদনা দপ্তরে যারা কাজ ও দেখাশোনা করতেন, তাঁদের অনেকের কাছ থেকেই আমি গোড়ার দিকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছি, একমাত্র এই দোষে যে আমার বাবা বিখ্যাত লেখক এবং আমি তাঁদের কাছে ধরা পড়ে গেছি মুখের মিলের জন্য।

আমার বাবার তো শত্রুর অভাব ছিল না।

তাঁর সময়ের অনেক পরিচিত সাহিত্য ব্যাক্তিত্বের গোপন এবং নেপথ্য অসূয়ার কাঁটা ও খোঁচা হজম করতে করতে, ষাট-সত্তর-আশির দশকে বাংলা সাহিত্যের শীর্ষস্থান এবং রাজপুত্রের তক্‌মাটি সমরেশ/কালকূটকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও যেহেতু এই কায়স্থ লেখকটি ছিলেন অকুতোভয় এবং অসমসাহসী এবং সবচেয়ে বেশি যা ছিল, নিজের লেখা সম্বন্ধে প্রবল আত্মবিশ্বাস, সেই কারণেই কোন ঈর্ষাকেই গুরুত্ব দেন নি। কোনো পিছুটানকে প্রশ্রয় দেন নি। যন্ত্রণাও সহ্য করতে পারতেন।

কিন্তু তাঁর স্বনামের মজুমদার লেখক প্রসঙ্গে তাঁর কথাই বা আসছে কেন?

আসছে, তার কারণ নিবন্ধ রচনাকার ওই নামের একজনের পুত্র, আর একজনের ভ্রাতৃসম। অবশ্য সমরেশদার সঙ্গে গোড়ার দিকে আলাপে এবং ঘনিষ্ঠতার পর্ব মোটেও তেমন মসৃণ হয়নি।

কিন্তু সেকথার পূর্বে, একেবারে সাম্প্রতিক সাক্ষাতের বিষয়ে দু-একটি তথ্য পরিবেশন করতে হবে।

আমি প্রবাসী হলেও, সমরেশদার সঙ্গে একটা মোটামুটি সময়ের ব্যবধানে যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি বিগত পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর ধরে সময়ের হিসাব করে বিলেত থেকেও কথা হয়। কথাবার্তা বলার ব্যাপারে আমার একটা স্বতঃপ্রবৃত্ত সচেতনতা আছে। আর সেটা হচ্ছে, খ্যাতিমানদের সময় সম্পর্কে আমার মূল্যবোধ। আমার চেনাজানা আর সুযোগ আছে বলেই, একজন ব্যস্ত এবং যশস্বী মানুষকে ইচ্ছে হলেই ফোন করব, সেটা থেকে বিরত থাকি।

স্বয়ং সমরেশ বসু, নিজের বাবার সঙ্গেও একই কারণে আমার দেখা সাক্ষাৎ কম হতো। এমনিতে দীর্ঘকাল হস্টেলবাসী হওয়ার কারণে আমি আংশিকভাবে পরিবার বিচ্ছিন্ন। অথচ সৌজন্য এবং আত্মসম্মানবোধের দীক্ষা আমি বাবার কাছ থেকেই পেয়েছি সমরেশদাকেও দূরদেশ থেকে টেলিফোন করে প্রথমে জানতে চাইতাম, এখন কথা বলা যাবে… নাকি… ইত্যাদি।

পরিচয় জানার পরে, অপরপ্রান্তের আন্তরিকতা কিন্তু পরের বাক্যটিতেই টের পাওয়া যায়। সমরেশদার ক্ষেত্রেও পেতাম। সমরেশদার সঙ্গে গল্প হতো। ঘরোয়া, বন্ধুবান্ধব নিয়ে, লেখালিখি নিয়ে এবং বিশেষ করে যেটা হতো কবে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা তাই নিয়ে। অনেকেই জানেন, সমরেশ মজুমদারের বিদেশে যাতায়াত করার প্রভূত সুযোগ যেন আপনা আপনিই জুটে যেত। আমেরিকার বঙ্গসম্মেলনে সবথেকে বেশিবার অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে যাওয়া আসা করেছেন সমরেশ মজুমদার ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আর ওই সম্মেলনে যাওয়ার উপলক্ষ্যে ফিরতি পথে অনেকেই একটা ব্রেকজার্নি করে কয়েকটা দিন য়্যুরোপে কাটিয়ে যেতেন।

আমার ইংল্যান্ডের বাড়িতে সমরেশদার বেশ কয়েকবার ঘুরে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘটেছিল ওই ফিরতি পথে। আর তারমধ্যে দিয়েই একটা পারিবারিক যোগস্থাপনের মতো সম্পর্ক রচিত হয়েছিল। আমার পরিবারের সদস্য হিসাবে বউ-ছেলেদের সঙ্গে ‘সমরেশদা’ হিসেবেই আত্মীয়তা একটা মাত্রা পেয়েছিল। ছেলেদের কাছে আর কিছু না হোক দাদু অথবা বিখ্যাত ঠাকুর্দার নামের আর একজন লেখক হতে পারেন, এই ব্যাপারটাই সম্ভবত প্রাথমিক বিস্ময়ের কারণ হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে, বাড়িতে দেখা, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, সন্ধ্যাহ্নিক এবং বিশেষ করে গানের অধিবেশন, অন্য বন্ধুদের আমাদের বাড়িতে আসা এবং সমরেশদারসহ অন্য কোনো বন্ধুর বাড়িতে সান্ধ্য আড্ডায় সম্পৃক্ত হতে যাওয়ার মধ্যে ওরা নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছিল, দাদুর সমনামের ব্যক্তিটি এবাড়ির সত্যি প্রিয়জন।

আমি বিশেষ করে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিলাম, আমরা সমরেশদাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করলেও, আমার দুই পুত্র অবলীলায় ‘সমরেশদা-তুমি’ করে নিয়েছিল। অর্থাৎ স্বীকৃত প্রিয়জন।

সেই সমরেশদার সঙ্গে কলকাতা গিয়েও পরপর কয়েকবার আর একসঙ্গে বসা হচ্ছিল না।

আমি খুশি হয়েছিলাম, কিছুটা অবাক-ও জেনে যে মজুমদারমশায় ধূমপান, জলপান(!) উভয়ই ত্যাগ করেছেন। ****** জিগ্যেস করলাম, সত্যি সত্যি সিগ্রেট ছেড়েছেন! নাকি…!

বরাবর যে কন্ঠে কথা বলেন, সেই বিশেষ উচ্চারণেই বললেন, সিরিয়াসলি… একদম। তারপরের কথাটাই আসল। – বিশ্বাস করো, সমরেশদা (বসু)র মতো সিগ্রেট আধখানা করে কিংবা বিড়ি… কোনো কিচ্ছু না।

ম্যানেজ করতে পারছেন?

পারতে হয় গো… পারতে হয়। তুমি যেরকম বলেছিলে, ‘অল অর নান্‌’ সেভাবেই…।

দারুণ! কিন্তু হুইস্কিটা পুরো ছাড়লেন কেন?

ছাড়িনি তো! কে বলল তোমায়?

সেটা ইম্পর্টান্ট্‌ নয়। কিন্তু শুনেছি।

তুমি এসো… একসঙ্গে বসা হবে… সাউথ সিটি বা আমার ক্লাব… যেখানে বলবে।

বছর তিনেক ধরে, হচ্ছে হবে করে সেই বসাটা কিন্তু হয়নি। মেলায় দেখা হয়েছে। কিন্তু কলকাতা বইমেলার আবহ, উদ্দেশ্য, আন্তরিকতা, মায়াময় আলাপচারিতার পরিবেশ… সবই চারদশকের শেষে এসে, একটি অনিবার্য গ্ল্যামারসর্বস্ব ভেজাল বাঙালিয়ানায় পর্যবসিত হওয়ায়, প্রিয়জন, বন্ধুরাও যেন গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসতে বাধ্য হয়ে চলেছেন। মেলায় মেলাত্ব নেই। ব্যবসা, শোঅফ, কৃত্রিম হাসি, অহেতুক সেলফি, দেখনদারিতে আসল টানগুলো সব গোল্লায় গেছে। তাই অভ্যাসের টানে বইমেলায় গিয়েও ইদানীং আর মিলনমেলা বলে মনে হয় না। চরিত্র বদল হয়ে গেছে।

সমরেশদাকে বললাম, খুব মিস্‌ করছি। উনি বললেন, ফোনে কথা বলব।

শেষবারের কথোপকথন এইরকম! সমরেশদা… দু বছর হয়ে গেল… দেখা হচ্ছে না কিন্তু।

দু বছর হয়ে গেল! মনে হচ্ছে না তো!

চোখের দেখার কথা বলছি না… ইন্টারন্যাশানাল ক্লাবে আপনার সঙ্গে বসেছি দু বছর আগে…।

কতদিন আছো কলকাতায়?

মার্চ-এর প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত।

তোমার বউদি চলে গেছেন… জানো তো?

জানি। লেখকদের স্ত্রীরা আগে চলে যাচ্ছেন… সঞ্জীবদা প্রফুল্লদা… লালাদা (বুদ্ধদেব গুহ)-র স্ত্রী তো কত আগেই…। থাক সে কথা। আপনি কেমন আছেন?

আশি পূর্ণ করার পরে যতখানি ফাস্‌ক্লাস থাকা যায়… ততটাই…।

ক্লাবে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন?

মোটেও না। তবে রাত করি না। কবে আসবে বলো!

আপনি যেদিন বলবেন… সকালে জানলেই ব্যবস্থা করে নেব। ইচ্ছে করলে আপনি সাউথসিটিতে…।

একটু দূর পড়ে যায়… ক্লাবটা মাঝামাঝি হয়…। দাঁড়াও তোমায় কী একটা যেন বলব ভেবেছিলাম… হ্যাঁ মনে পড়েছে তোমার রহস্য কাহিনিগুলো নিয়ে সমগ্র করার কথা ভাবো। দশটার ওপর হয়ে গেছে না?

হ্যাঁ তা হয়েছে। কিন্তু এসব কথা ফোনে হয় না। বসে আলোচনা করতে হবে। বঙ্গসম্মেলনে যাচ্ছেন নাকি?

মোটামুটি সেরকমই ঠিক হয়েছে… তুমি যাচ্ছো?

না, আমন্ত্রিত হই নি।

ফেরার পথে লন্ডন যাব। ভাবছি সেই সময় তোমার ওখানে… অসুবিধে নেই তো?

আপনিই তো বলেছিলেন, ইংল্যান্ডে আপনার একটা ঠিকানা আছে… অসুবিধের কথা ওঠে কি করে?

রাখী, ছেলে-বউমা, নাতিনাতনির খবর সব ঠিকঠাক?

টেলিফোনে বলব কেন? দেখা হবে স্কানথর্প-এর বাড়িতেই তো!

টুকটাক আরও কিছু কথা… বন্ধুবান্ধব পরিচিতিদের খবরাখবর হল। কিন্তু নিশ্চিতভাবে ঠিক হল না কবে বসা হবে! তার মধ্যে হঠাৎ একবার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা সমরেশদা (বসু)-র জন্ম শতবর্ষ আসছে না?

এই তো… এবছরের ডিসেম্বর মাসেই শতবর্ষের সূচনা বা পদার্পণ…

তারমানে… সমরেশদা আমার থেকে মাত্র উনিশ বছরের বড় ছিলেন! ভাবা যায় না… দুই নাম মিলিয়ে… ওই বয়েসের মধ্যেই কী কান্ড করে গিয়েছিলেন…! শতবর্ষ পালিত হবে তো ভাল করে?

আমি হেসে বললাম, সে কথা আমি বলব কী করে! বাংলা সাহিত্য পাঠক, সাহিত্য ব্যবসায়ী, সরকার ভাববে…।

হ্যাঁ… তা ঠিকই বলেছ। দায়িত্বটা বাংলাসাহিত্যপ্রেমী ও কারবারীদেরই… গভর্নমেন্টের তো বটেই।

ওসব কথাও আলোচনা হবে, আপনার সঙ্গে দেখা হলে… কিছু ভূমিকা আপনারও থাকবে।

নাহ্‌, বইমেলায় দেজ্‌ নাকি পত্রভারতীর স্টলে দেখা হলেও, সেই বসাটা আর হয়নি। হল-ও না। সেটা মাথায় আসে মে মাসের আট তারিখে… এই প্রায় মাস তিন আগে, পুজোর লেখা সদ্য শুরু করেছি। দিনের হিসেবে এখানে দুপুর হলেও কলকাতায় সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। রমাপদ পাহাড়ি, একসময় তথ্যকেন্দ্র পত্রিকার সম্পাদক, সম্প্রতি উত্তরবঙ্গ সংবাদ কাগজের সঙ্গে যুক্ত, টেলিফোন করলেন। – নবদা, রমাপদ পাহাড়ি… চিনতে পারছেন তো?

নিশ্চয়ই, চিনতে পারব না কেন! অনেকদিন অবশ্য তোমার খবর নেই।

হ্যাঁ দাদা…। তাহলেও একটা বিশেষ কারণে আজ ফোন করেছি…।

বলো… কী ব্যাপার?

সামান্য ইতস্তত করেই রমাপদ বললেন, মানে… নবদা… আজ এইমাত্র সমরেশদা চলে গেলেন… এখনও অফিশিয়ালি ডিক্লেয়ার করা হয়নি… আমি হাসপাতালের করিডর থেকে আপনাকে ফোন করছি।

আমার সেই মুহূর্তের অনুভূতিটা আজ এই লেখার সময়ও টের পাচ্ছি। অবাক-অবাক লাগছে। আমি ডাক্তার, মৃত্যু কম দেখিনি। অনিবার্য মৃত্যুর সামনে আমাকে স্থির, অচঞ্চল থাকতে হয়েছে। অন্যদের শোকোচ্ছ্বাস, কান্নায় ভেঙে পড়ার সামনে, আমাকে বাস্তবের মাটিতে পা শক্ত করে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে। জীবনের সব থেকে বড় ধাক্কা – মাতৃবিয়োগ, পিতৃবিয়োগের সময় আমি সামাল দিয়েছি অন্যদের। আপনজন-আত্মীয়-পাবলিক- মিডিয়া। আমি জানি, দুঃসংবাদে আমি ভেতরে ভেঙে গেলেও, চেষ্টা করি ওপরে শক্ত থাকতে।

সমরেশদা মৃত্যু সংবাদ পেয়েও তাই ছিলাম। কিন্তু মনে মনে ভাবছিলাম, ব্যাপারটা মানতে পারছি না কেন!

উত্তর পেয়েছি পরে। সেটা হচ্ছে, সমরেশদা কখনও কারুর কাছে নিজের শারীরিক ভাঙন বিষয়ে আলোচনা করতেন না আমার ধারণা তার পেছনে একটা কারণ হচ্ছে, মনে মনে ভাঙব তবু মচকাব না এই অ্যাটিচ্যুড। জীবন থেকে কখনো সরে যাব না, এই ভাবনায় কিছু মানুষ মৃত্যুর পদধ্বনিকে অস্বীকার করে।

তা নয়তো… পরে যা যা অসুস্থতার কথা শুনলাম, সেগুলোর বেশ কয়েকটা সম্পর্কে সমরেশদা আরও অনেকদিন আগে থাকতেই সাবধান হতে পারতেন। পারিবারিকভাবে নিঃসঙ্গ ছিলেন… এটা জানি। বলা যায় না, এমনও হতে পারে, নিজেকে নিঃসঙ্গ করেই রাখতেন হয়তো। যোগাযোগ বেশি ছিল বাইরের লোকের সঙ্গে। যতদূর বুঝতাম, সেই সব লোকজনের খুব একটা আন্তরিক অনুভব ছিল না। মেলামেশা ছিল ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যেই বেশি।

এ প্রসঙ্গ বিস্তারিত করব না আর। অনেক অপ্রিয় কথা এসে যাবে।

রমাপদ সেইদিন তখনই আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, সমরেশদাকে নিয়ে একটি দ্রুত নিবন্ধ রচনা করতে। বলেছিলাম সেটা এখনই পারব না। সমরেশদার ওপর আমার কয়েকবছর আগেকার একটি লেখা ওরা পরেরদিন ছেপেছিল উত্তরবঙ্গ সংবাদপত্রে। সমরেশ মজুমদার তো উত্তরবঙ্গেরই মানুষ।

কিন্তু সমরেশদার সঙ্গে নব্বই-এর দশকের আগে আমার যে সম্পর্ক, তা কিন্তু মোটেও মসৃণপথের কিনার ধরে হাঁটেনি। বরং এবড়োখেবড়ো, ঠোক্কর খেতে খেতে, নেহাৎ চেনাজানা আছে, এইরকম একটা শিথিলতায় টিকে ছিল।

সমরেশদা যখন দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক লেখার চান্স পেয়ে পরিচিত হয়ে চলেছেন, মনে আছে, আমি তখন বড়বাড়িতে পা রাখতে শুরু করেছি। এক আধটা ছোটগল্প… কখনও দেশ, কখনও আনন্দবাজার রবিবাসরীয়তে। প্রসঙ্গত একটা কথা এখানে বলে রাখি, সমরেশ মজুমদার হচ্ছেন একমাত্র লেখক, যিনি দেশ পত্রিকায় সব থেকে বেশি একের পর এক ধারাবাহিক উপন্যাস লেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। উত্তরাধিকার-কালবেলা-কালপুরুষ পরপর শেষ হতে না হতেই গর্ভধারিণী ও সাতকাহন। দেশ পত্রিকার এমনই ভূমিকা ছিল একসময়। যখন লেখকের স্বীকৃতি পাওয়া যেত ওই পত্রিকায় লেখা নির্বাচিত হলে। আর ধারাবাহিক উপন্যাস লেখার সুযোগ পাওয়ার অর্থ ছিল হাতে চাঁদ পাওয়া। সেই লেখা যদি পাঠক নন্দিত হতো, লেখককে অবশ্যই আর ফিরে দেখতে হতো না।

আবার উল্টোটাও যে হয়নি কখনও তা নয়।

দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেও, শেষপর্যন্ত হারিয়ে গেছেন এমন বিরল উদাহরণও আছে। যাক সে কথা।

সমরেশদার কথায় ফিরে আসি।

পরপর ধারাবাহিকের কল্যাণে সমরেশ মজুমদার যখন ষাটের দশকের লেখকদের অন্যতম, আমরা সত্তরের দশকের উঠ্‌তিরা স্বাভাবিক ভাবেই যশোপ্রার্থী এবং পরিচিত লেখকদের ঘনিষ্ঠতা সন্ধানী। সমরেশদাকে আমি চিনি, সেই আশির দশকের গোড়ায়, আমাকেও উনি চেনেন। আমরা তখন লিটিল ম্যাগ-এর তরুণ তুর্কী। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক সমরেশদা, খেয়াল করেছি, আমাকে পাত্তা দেন না – এড়িয়ে যান। আরও বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান লেখকের এই প্রবণতা আমাকে কষ্ট দিত। বিমল কর, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, মতি নন্দী… এঁরাও। পরে মনে হয়েছিল, যে কোনো কারণেই হোক, আমার পিতৃপরিচয়ই হয়তো এঁদের কাছে আমাকে অভাজন করে রেখেছিল। কেননা এঁরা এবং এরকমই আরও কয়েকজন সমরেশ বসুর ধারাবাহিকভাবে একটানা কয়েক দশক বাংলা সাহিত্যের উচ্চাসন দখল করে রাখার অনিবার্যতা মানতে পারতেন না বোধহয়। সে ব্যাপারে আমায় কেন অভাজন হতে হবে কে জানে বাবা!

কিন্তু সে যাক, কেননা ‘প্রোফেশনাল জেলাসি’ বলে একটা ব্যাপার থাকেই। কিন্তু আমি কে! সামান্য এক তরুণ গল্পকার (তখন), নিজেদের পত্রিকা নিয়ে মাতামাতি করি, ডাক্তারি করার মধ্যেই গল্পপাঠের আসর বসাই। তখন খ্যাতনামাদেরও ডেকে আনি… পরিচিত হওয়া, মতামত শোনা… এইসব। বলা যায়, আমাদের সত্তরের দশকের লেখকদের মধ্যে বেশ একটা সৌভ্রাত্র ছিল তখন। যাঁদের অনেকে এখনও রয়েছেন, অমর মিত্র, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, নবকুমার বসু, ভগীরথ মিশ্র… আবার চলেও গেছেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, দীপঙ্কর দাস, শচীন দাশ…। আমরা তো সিনিয়র লেখকদের কাছে যাবই। কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করব।

কিন্তু অন্য বড় লেখকদের নিয়ে আমার তত মাথাব্যথা ছিল না, যতটা সমরেশ মজুমদারকে নিয়ে ছিল। কেন জানি, হয়তো লেখক হিসাবে ওঁর স্মার্টনেস… আড্ডাবাজি… কিছু লেখা… সব মিলিয়েই। আমাকে ওঁর এড়িয়ে যাওয়াটা আমাকে বিদ্ধ করতো… প্রেস্টিজে লাগতো। লেখক হিসাবে ওঁর উত্থানটাও কিন্তু দেখার মতো ছিল।

একবার অশ্বিনীদত্ত রোডে (বালিগঞ্জ ত্রিকোণ পার্ক –এর কাছে) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কক্ষে আমাদের গল্পপাঠের আসরে এসেছেন সমরেশদা এবং লালাদা (বুদ্ধদেব গুহ)। গল্পপাঠ হল, আলোচনা, চা খাওয়া। আমার গল্প নিয়ে সমরেশদা মতামত দিলেন না। অন্যরা কেউ কেউ বলল… ইত্যাদি। ফেরার সময় আমার সুযোগ হল, দুই পরিচিত লেখকের পাশাপাশা একসঙ্গে হেঁটে হেঁটে রাসবিহারীর ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের দিকে আসার। দুচার কথার মধ্যেই সমরেশদাকে বললাম আপনার সঙ্গে একদিন গল্প করার খুব ইচ্ছে আমার। সাহিত্য নিয়ে না। এমনিই…। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।

এমন সোজাসুজি প্রস্তাবে বোধহয় সামান্য কৌতুক বোধই করে থাকবেন সমরেশদা। বললেন, তাই নাকি! আরে আমি তো জানি তুমি ব্যস্ত মানুষ… ডাক্তার। চলে আসলেই বসা যায়… সময় আছে? এই দেশপ্রিয় পার্কের কাছেই আমার এক বন্ধুর কাছে যাচ্ছি… তুমি আসতেই পারো।

লালাদার গাড়ি ছিল। ফিরে গেলেন। আমি, সমরেশদার সঙ্গে লেকটেরেস-এর একজনের বাড়িতে। সেখানে পানাড্ডার ব্যবস্থা ছিল। একটু তরল হওয়ার পরেই আড্ডা জমে গেল। সমরেশদা নিজেই বলে ফেললেন, আমাকে নাকি তাঁর স্নব আর নাকউঁচু মনে হতো। কেননা আমার বাবার নাম সমরেশ বসু। আর আমি নিজে ডাক্তার… তাই।

সত্যি কি করে বোঝাই, এগুলো কোনোটাই আমার আসল পরিচয় নয়! বরং একটু ভালবাসার কাঙাল।

আমি পরিবার বিচ্ছিন্ন এক প্রান্তবাসী, যাদবপুর বাঘাযতীনে থাকি, রুগি হয় না তাই চেম্বারে বসে গল্প লিখি। অথচ সংসার হয়ে গেছে তার মধ্যে, দুই ছেলে। বউও ডাক্তার বলে টিকে আছি… দুজনের রোজগারে।

সেই যোগাযোগটা শুরু হল। হামলে পড়ার মতো নয়। দূরত্ব রইল কিন্তু ভুল ধারণা রইল না। আমার গল্প ছাপা হলে এবং পড়লে সমরেশদা টেলিফোন করতেন। কয়েক বছর চলল এভাবেই।

উনিশশ’ অষ্টাশিতে পিতৃবিয়োগের পরে সমরেশদার সঙ্গে আমার যোগাযোগে একটা মাত্রা আসে। এর পরে আমিই বুঝতে পারি, সমরেশ মজুমদার মানুষটা নিজেই তখনকার লেখকবৃত্ত থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন এবং ওঁদের সমসাময়িক ষাটের দশকের লেখকরা সবাই-ই প্রায় ঈর্ষান্বিত ওঁর ওপর। কিন্তু ও ব্যাপারে কিছু করার নেই। কারণ ষাটের দশকের যেসব লেখক… যেমন, শেখর বসু, রমানাথ রায়, শৈবাল মিত্র, সুব্রত সেনগুপ্ত, কল্যাণ সেন, বলরাম বসাক, আশিস ঘোষ… এঁরা কেউই পরিচিতির দিক দিয়ে সমরেশ মজুমদারের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেন নি। একমাত্র বাণী বসু ছাড়া… যদিও বাণীদি একটু সিনিয়র। লেখার কোয়ালিটি হোক, বা লাক ফ্যাক্টর হোক, কিংবা বড়বাড়িতে চান্স পাওয়ার জন্যই হোক, শেষ পর্যন্ত মানতে হবে, ‘যো জিতা উহ্‌ সিকেন্দর’। সমরেশ মজুমদার নামটা পঞ্চাশের দশকের সুনীল, শ্যামল, শীর্ষেন্দু, দিব্যেন্দু, সঞ্জীব, প্রফুল্ল… এঁদের পরে আপনাআপনি পাঠক পরিচিতি লাভ করেছিল… এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

আনন্দবাজার, দেশ পত্রিকার নিয়মিত লেখক সমরেশ মজুমদার।

আর এই বাস্তব সত্য এখনও কে-ই বা অস্বীকার করবে যে, আনন্দবাজার হাউজে… আমি যাকে বলি, বড়বাড়ি, যে নিয়মিত লেখার চান্স পায়, তার লেখক পরিচিতি ছড়িয়ে পড়া সম্বন্ধে সন্দেহ থাকে না। লেখার কোয়ালিটি, ভালমন্দ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, তর্ক হতে পারে। কিন্তু ওই হাউজের জনপ্রিয়তা এবং বাঙালি পাঠকদের মধ্যে এখনও তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ নেই। আনন্দবাজার দেশ সানন্দা আনন্দমেলা আনন্দলোক… এখনও পত্রিকা বাজারের গ্ল্যামার।

এই মন্তব্যের অর্থ অবশ্যই তা নয়, ওগুলো ছাড়া ভালো পত্রপত্রিকা নেই। বৌদ্ধিক সাহিত্যপত্র তো আছেই।

আবার ওই হাউজের কাগজে লেখেন না, অথচ শক্তিশালী লেখক হিসেবে পরিচিত – তাঁদের সংখ্যাও কম না। কিন্তু কমার্শিয়াল এবং সাহিত্য সংস্কৃতির পত্রিকা হিসাবে, জনপ্রিয়তায়, আবাপ এখনও এগিয়ে। আর আমি যে সময়ের কথা বলছি, সেই আশি-নব্বই এর দশক এবং নতুন শতাব্দীর প্রথমদিকে আনন্দবাজার হাউজ –এর পত্রপত্রিকার কদর তথা গুরুত্ব এখনকার তুলনায় নিশ্চয়ই আরও বেশি ছিল।

এক এক করে ওই হাউজের বিখ্যাত সব লেখকরা… যেমন সমরেশ বসু – কালকূট, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, গৌরকিশোর ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মতি নন্দী, দিব্যেন্দু পালিত প্রমুখ চলে যাওয়ার পরে, সমরেশ মজুমদার হয়ে উঠেছিলেন ওখানকার মুখ্য লেখক। প্রায় পাঁচটি দশক ধরে, প্রয়াণের আগে পর্যন্ত বাঙালি লেখক হিসাবে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই না, বাংলাদেশেও সমরেশদা ছিলেন অতি পরিচিত এবং জনপ্রিয় গল্পকার ও উপন্যাসিক। এই বাস্তবতা মানতে হবে।

এর পরের প্রসঙ্গ, অর্থাৎ লেখক হিসাবে সমরেশদা কত বড় ছিলেন, বাংলা সাহিত্যে তাঁর ভূমিকা কতখানি স্থায়ী হবে, সাহিত্যিক হিসাবে কোন উচ্চতায় তিনি প্রতিষ্ঠিত হবেন বা হয়ে থাকবেন, সেই বিষয়ে মন্তব্য করার অধিকারী আমি নই। তাছাড়া সম্ভবত সেই সময়ও এখনও আসেনি। মৃত্যু মানুষের তথা লেখক-শিল্পী সকলের একটা মূল্যায়নের সুযোগ এনে দেয় সামগ্রিকতার নিরিখে। কিন্তু তা সময়সাপেক্ষ। ব্যক্তিজীবন অথবা আত্মীয়-বন্ধু-পরিচিত মানুষ হিসাবে যে কোনো একজনের পরিচয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শীতল হয়ে আসবে, সেটাই নিয়তি এবং দুনিয়ার নিয়ম। বেঁচে থাকে সৃষ্টি… অবশ্যই সব সৃষ্টি নয়। কালজয়ী শব্দটা এসেছে সেই কারণেই। কাল অথবা সময়ের দীর্ঘসূত্রী যে সৃষ্টি (লেখকের ক্ষেত্রে তাঁর রচনা) বেঁচে থাকবে, সেটুকুই বাঁচিয়ে রাখবে সৃষ্টিকর্তাকে।

বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার ধারাবাহিকতায় আমরা যদি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে ভাবতে শুরু করি, তাহলে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র হয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বেশ বুঝতে পারি – বহু লেখকের আসা যাওয়ার মধ্যে কে কে এবং কতটা তাঁদের লেখার গুণে এবং ধারে টিকে আছেন। কত লেখক হারিয়ে গেছেন তাও সত্যি। এমনকী জীবদ্দশায় যাঁরা রীতিমত জনপ্রিয় ছিলেন মৃত্যুর পরে সময় তাঁদের বিস্মৃতির অন্ধকারে নিয়ে গেছে। আবার এমন অনেক লেখক আছেন, যাঁরা প্রচুর লেখার পরেও, শেষপর্যন্ত দুটি-তিনটি-চারটিই হয়তো পাঠক মনে রেখেছেন।

একমাত্র তাঁরাই ব্যতিক্রমের নিশান উড়িয়ে এক একটি স্তম্ভ হয়ে উঠেছেন, যাঁরা স্বনামে অথবা ছদ্মনামে একাধিক এবং এক-একটি লেখায়, গল্পে, উপন্যাসে মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন তৈরি করতে পেরেছেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অনুসরণ করলে আমরা তার উত্তর পেয়ে যাব। সমরেশদা (মজুমদার) একটি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন দু-একবার, সেই নাম ছিল, ‘যীশু দাশগুপ্ত’। যে কোনো কারণেই হোক, সেই নাম পরিচিত হয়ে ওঠেনি এবং যতদূর জানি, সমরেশদা ছদ্মনাম ব্যবহারের ঝুঁকি প্রত্যাহার করেছিলেন শেষপর্যন্ত। তাঁর সব রচনা স্বনামেই, ধরা যেতে পারে।

এখনও পর্যন্ত সমরেশদার ব্যক্তি পরিচয়, স্মৃতি, যোগাযোগ প্রীতিময়তা, আড্ডাবাজি, কথোপকথন, ওঠা-বসা – হাসাহাসি সবই মিলেমিশে রয়েছে কাছের মানুষের মতো উষ্ণতায়। কিন্তু লেখক হিসাবে তাঁর ভূমিকা ও স্থান নির্দিষ্ট করবে ভবিষ্যৎ, যখন সব উষ্ণতার আবেগ ধীরে ধীরে শীতল হয়ে আসবে।…

আর একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা উচিত, যেহেতু সমরেশ নামের একটি প্রবল পরিচয়ের এ্যাডভান্টেজ এবং ঝুঁকি, উভয়েই সঙ্গে করে বাংলা সাহিত্যের মাঠে নেমেছিলেন মজুমদার মশায়। সমরেশ বসু শুধু স্বনামেই তখন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম স্তম্ভ। কালজয়ী হিসাবে স্বীকৃত একাধিক রচনা। তাঁর মন্তব্য ছিল, আমার নাম যদি ‘তারাশঙ্কর’ হতো, তাহলে বাংলা সাহিত্য চর্চা করতে আসার আগে আমি নাম বদলে আসতাম। বলা বাহুল্য এ মন্তব্যের লক্ষ্য কে। কিন্তু প্রগাড় প্রীতিময়তার অভাব ছিল না দুজনের মধ্যে।

এটাও সত্যি যে দুই সমরেশের মধ্যে সম্পর্কের রসায়ন ছিল যথেষ্ট নিবিড়। সমরেশদাকে দেখেছি আমাদের নৈহাটির বাড়ি কখনও ছুটে গেছেন বাবার দর্শনের আশায়। আবার তিনি (মজুমদার) মন্তব্য করেছিলেন, সমরেশদার কাছ থেকে আমি যতখানি পুরস্কৃত, ততখানিই তিরস্কৃত। আমার মনে হয়, এইসব মন্তব্যের ব্যাখ্যা পাঠকসাধারণের করাই ভাল। আগামি বছর থেকে সমরেশ বসু ও কালকূট –এর জন্মশতবর্ষ সূচনা… এবং ইতিমধ্যে বঙ্গসাহিত্যের আঙ্গিনায় তাঁর উভয়নামের ভূমিকা কালজয়ী আখ্যায় ভূষিত হয়েছে। সমরেশ মজুমদার মাত্র দুটি দশক পরেই শতায়ু লেখক বলে চিহ্নিত হবেন বহু রচনায় সমৃদ্ধ তাঁরও ভূমিকা ও অবস্থান এই দুই দশকে অবশ্যই নির্ধারিত হয়ে যাবে।

সমরেশদা আমার প্রিয়জনদের মধ্যে অন্যতম, ছিলেন… বলতে এখনও বাধছে। তাঁকে আমার মরণোত্তর নমস্কার।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

3 thoughts on “bibidho-majumder-tini

  1. অতি চমৎকার – এক
    হৃদযগ্রাহী , মর্মস্পর্শী , কখনও- ভুলবার – নয — মনোরম ভাষাবিন্যাসে — এই চিত্তাকর্ষক
    বিস্তারিত তথ্য সমৃদ্ধ বিবরণ ও বিশ্লেষণ ।
    নবকুমার বসুর জীবনের এই অভিজ্ঞতা — একমাত্র উনিই
    এই ভাবে সকলকে পরিবেশন করার ক্ষমতা রাখেন ।
    নিশ্চিত যে , বর্তমান সাহিত্য জগতের এই প্রতিষ্ঠিত লেখক
    তাঁর — অতি শ্রদ্ধাশীল পরম প্রিয
    পিতৃদেব সমরেশ ( বসু )– ও
    তাঁর হৃদয়ের অতি নিকটের
    আর এক – সমরেশ ( মজুমদার ) — বাংলা সাহিত্য জগতেরএই দুই দিকপাল অবিস্মরণীয মানুষের
    স্নেহ ধন্য — নিঃসন্দেহে ।।
    এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস ।
    নবকুমার বসু আরও অনেক
    প্রতিষ্ঠিত হযে উঠুক সাহিত্য জগতের
    এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা ।
    নবকুমারের মন থেকে
    সরে যাওয়া এক উদগ্রীব
    ভক্ত ।( জগদীশ বোস –বোস দা)

    1. মন থেকে সরে গেলে কেন তাঁকে প্রতিনিয়ত মনে পড়ে! দিনে কয়েকবার করে মনে পড়ে এখনও মুখস্থ ল্যান্ডলাইন ফোন নম্বরটা। আসলে সচেতনতা আর আড়স্টতা এসে গেছে অন্য কারণে। সেই কারণের আভাস হচ্ছে, যাঁকে ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি, আমার কোনো ভূমিকাই যেন তাঁর অস্বাচ্ছন্দ্যের কারণ না হয়। এর বেশি বলি কি করে! বোসদা জানেন, তিনি প্রকৃতই আমার প্রিয়জন। আর আমি জানি, আমি ভুলে যাওয়ার মানুষ না।

  2. অসাধারণ বললে অনেক অনেক কম বলা হয়, কত অজানারে জানি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *