bibidho-megh-rajyer-buke

মেঘ রাজ্যের বুকে সাহসিনী নারী সরলা ঠাকরেল
ফিচার
বিতস্তা ঘোষাল


সালটা ১৯৩৬। সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় এক খবরের দিকে চোখ আটকে গেল এদেশের মানুষের। একটি বিমানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক কন্যা। পরনে শাড়ি। ঘটি হাতা ব্লাউজ, হাতে চুড়ি। গলায় লম্বা হার ঝুলোনো। মাথার উপর সানলাস। পায়ে চটি। দেখলে মনে হচ্ছে এক সাধারণ গৃহবধূ বিমানের গায়ে হেলান দিয়ে বুঝি শখ করে ছবি তুলছেন কিংবা, কোনো সিনেমার নায়িকার ফিল্মের শুটিং চলছে। আশ্চর্য হবার কিছুই নেই এতে। তার কারণ এর আগে বিশ্ব জেনেছে দুই অসীম সাহসী নারীর কথা, যাঁরা বিমান চালিয়ে, পুরুষ নিয়ন্ত্রিত একচ্ছত্র পরিসেবায় আঘাত এনেছিলেন। প্রথম জন অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্ট, ১৯২১ সালে টাকা জমিয়ে কিনার এয়ারস্টারের দুই আসনের একটি পুরনো হলুদ রঙের বিমান কিনে প্রথম নারী বৈমানিক হিসেবে ১,৪০,০০ ফুট উপর দিয়ে বিমান চালানোর রেকর্ড করে ফেলেছেন। তাঁর এই বিমানের নাম ছিল ‘দ্য ক্যানারি’।

এর বারো বছর পর আরব বিশ্বের আরেক নারী লতফিয়া এলনাদি ১৯৩৩ সালে ২৫ বছর বয়সে কায়রোর বাইরে এক ছোট্ট এয়ারস্ট্রিপ থেকে একটি জিপসি মথ প্লেন নিয়ে আকাশে উড়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। তখন তাঁদের নিয়ে উন্মাদনা তুঙ্গে। একাধিক কাগজে লেখা হচ্ছে তাঁদের জয় যাত্রার কথা। শোনা যাচ্ছে বিশ্ব বিখ্যাত পরিচালকরা লতফিয়া এলনাদির জীবনী নিয়ে সিনেমা বানাবার ইচ্ছে প্রকাশ করছেন।

কাজেই হতেই পারে ভারতেও এমন কোনো পরিকল্পনা চলছে। ছবিটি তোলাও হচ্ছে সেই একই রকম দেখতে জিপসি মথ প্লেনের কাছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ভারত তখন ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে। এই সময় কালে দুটি মাত্র সিনেমা বানানো হয়েছিল। তার মধ্যে প্রথমটি ১৯১৩ সালে প্রযোজক ও পরিচালক দাদাসাহেব ফালকের নির্বাক ছবি রাজা হরিশচন্দ্র ও অন্যটি ১৯৩১ সালে আরদেশির ইরানির প্রযোজনায় প্রথম সবাক হিন্দি ছবি আলম আরা। আর এই দুটিতেই নারী অভিনেত্রী পাওয়া যায়নি। তাহলে কি এবার আর একটি ছবির পরিকল্পনা চলছে?

কিন্তু সংবাদপত্রের লেখা পড়ে অবাক হল তামাম দেশবাসী। অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্ট ও লতফিয়া এলনাদির পদাঙ্ক অনুসরণ করে এদেশে টানা এক হাজার ঘন্টা বিমান চালিয়ে রেকর্ড গড়েছেন এই মেয়ে। নাম সরলা ঠকরাল।

কে এই সরলা? জানা গেল করাচি ও লাহোরের মধ্যে উড়ে চলা বিমানের প্রথম ভারতীয়, এয়ারমেইল পাইলট লাইসেন্স প্রাপক পি.ডি. শর্মার স্ত্রী তিনি। জন্ম ১৯১৪ সালের ৮ অগস্ট। দিল্লির একটি পরিবারে। শৈশব থেকেই তিনি কেবল গৃহস্থালির কাজেই নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চাননি। স্বপ্ন দেখতেন আকাশ জয় করবেন। কিন্তু সরলার এই ইচ্ছের দাম ছিল না তাঁর পরিবারের কাছে। আর পাঁচজন ভারতীয় মেয়ের মতোই ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। তারপরই বদলে যায় জীবন। স্বামী পি.ডি. শর্মার পরিবারের নয়জন পাইলট ছিলেন, সরলার স্বামী নিজেও পাইলট। তিনি তাঁকে পাইলট হতে উৎসাহ যোগালেন।

আর শ্বশুরমশাই তাঁকে লাহরের একটি ফ্লাইং স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। সেখানে সেই সময় কোনো মেয়েকেই দেখা যেত না। সরলাকে প্লেনের পুঁথিগত বিদ্যা এবং হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দুটোই শেখানো হয়। বুদ্ধিমতী ও মেধাবী ছাত্রী শিগগিড়িই প্রাথমিক লাইসেন্স পেয়ে প্রশিক্ষকের অনুমতি পেলেন একা একটি বিমান চালাবার। তারপর লাহোর ফ্লাইং ক্লাবের মালিকানাধীন জিপসি মথ বিমানটিকে টানা এক হাজার ঘণ্টা চালিয়ে ভারতের ইতিহাসে স্থান করে নিলেন “এ” লাইসেন্স পাওয়া প্রথম মহিলা পাইলট হিসাবে। তখন তাঁর বয়স একুশ। বাড়িতে চার বছরের কন্যা।

ক্যাপ্টেন শর্মা ১৯৩৯ সালে যোধপুরে একটি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। এর কিছু সময়ের পর, সরলা নিজের বাণিজ্যিক পাইলট লাইসেন্সের প্রশিক্ষণ নেবার জন্য আবেদন করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু এসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং সিভিল পাইলট প্রশিক্ষণ স্থগিত করা হয়েছিল। নিজের বাচ্চাকে বড় করা, জীবিকা অর্জনের তাগিদ প্রভৃতি কারণে তিনি শেষ পর্যন্ত বাণিজ্যিক বৈমানিক হওয়ার স্বপ্ন ত্যাগ করে লাহোরে ফিরে আসেন এবং সেখানে মেয়ো স্কুল অব আর্টে ভর্তি হন। সেখানে তিনি বেঙ্গল স্কুল অফ পেইন্টিং এর উপর প্রশিক্ষণ নেন ও ফাইন আর্টসের উপর ডিপ্লোমা অর্জন করেন।

সরলা এর পর আর্য সমাজে যোগ দেন। ইতিমধ্যে ভারত স্বাধীন হয় ও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পাকিস্থান ও ভারত নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। তখন তিনি দুই কন্যাকে নিয়ে দিল্লিতে চলে আসেন। এখানেই তাঁর সাথে আর. পি. ঠকরালের পরিচয় হলে তাঁকে তিনি ১৯৪৮ সালে বিয়ে করেন।

সরলা, যিনি মাটি নামেও পরিচিত ছিলেন, এরপর শুরু করেন পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকারের নকশার কাজ। ক্রমে হয়ে ওঠেন একজন সফল মহিলা ব্যবসায়ী। পাশাপাশি চিত্রকর হিসাবেও প্রতিষ্ঠা পান।

বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত সহ সমাজের একাধিক উচ্চ স্তরের নারীর পোশাকের ডিজাইন তিনিই করতেন। এমনকি ন্যাশানাল স্কুল অফ ড্রামা ও কটেজ এম্পোরিয়ামের জন্য কস্টিউম, গহনার সঙ্গে ব্লক প্রিন্টিং ও শাড়ির ডিজাইনিংও তিনিই শুরু করেন।

হতে চেয়েছিলেন পাইলট। ভারতীয় ইতিহাসে নাম উঠলেও কমার্সিয়াল প্লেনের পাইলট হবার স্বপ্ন অধরা রইল। কিন্তু সফল নারী উদ্যোগপতি হিসাবেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনন্যা। জানা যায়নি লতফিয়া এলনাদির মতো প্রথম যখন তিনি একাকী আকাশে উড়লেন, সেই দিনের অনুভূতির কথা। জানা গেলে এলনাদির মতো তিনিও হয়তো বলতেন-

“প্রথম যখন আমি বিমান নিয়ে আকাশে উড়লাম, তখন বিমানটিকে বেশ হালকা মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আর কেউ নেই আমার সঙ্গে। আমার মনে হচ্ছিল, পুরো বিশ্ব যেন আমার। যে স্বাধীনতার স্বপ্ন আমি সবসময় দেখেছি, সেই স্বাধীনতা যেন এখন আমার হাতের মুঠোয়।”

আজীবন স্বাধীন ভাবে বাঁচতে চাওয়া এই সাহসী নারীর মৃত্যু হয় ১৫ই মার্চ ২০০৮ সালে। আজ যখন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তরে নারী নির্যাতন, মেয়েদের অধিকার নানাভাবে খর্ব করা হচ্ছে, স্বাধীনভাবে মেয়েদের বেঁচে থাকাও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠছে এই দেশে, তখন ওই সময় দাঁড়িয়ে এই বীরাঙ্গনার আকাশে ওড়ার দৃষ্টান্ত আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই ও স্বপ্ন পূরণের পথকে আশার আলো দেখতে সাহায্য করে।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “bibidho-megh-rajyer-buke

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *