bibidho-mosha

মশা
রম্যরচনা
উল্লাস মল্লিক


মশাকে ইদানীং মানুষ বাঘ সিংহের থেকেও বেশি ভয় পাচ্ছে। কামড়ালেই ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া। পৃথিবীর ভিসা শেষ। পঙ্গপালের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে বাড়ছে মশা। তাড়ালেও যেতে চায় না; মারলেও মরতে চায় না। শালা রক্তবীজের বংশধর। ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর ধার ধারে না। মানুষ সন্ত্রস্ত। মশা খেদাবার নানা উপায় বের করেছে তারা। মসকিউটো কয়েল ম্যাট বা ডিসপেনসার। কিন্তু এসবে এতটুকু দমছে না মশারা। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলার কমরেডদের মতো দিব্যি খাপ খাইয়ে নিয়েছে। একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব। পুটুস করে কাউকে হুল দিয়ে হয়তো জ্বলন্ত কয়েলের ওপর বসছে; কিংবা ডিসপেনসারের চারপাশে পোঁ পোঁ করে ঘুরে নিচ্ছে। এই পোঁ পোঁ-টা আসলে বিজয় সংগীত। ম্যাচ জেতার আনন্দ। আমাদের এই ছোট্ট একটা হুলের জোর হাতির শুঁড়ের থেকে কম নয়। শোনা যাচ্ছে ইদানিং নাকি মশারা পার্টি-টার্টিও দিচ্ছে। কেউ অক্কা-টক্কা পেলে পান ভোজনের ব্যবস্থা করছে তারা। যার কামড়ে মরেছে সেই মশাকেই স্পনসর করতে হচ্ছে। এতে ইয়ং মশারা কামড়াবার উৎসাহ পাচ্ছে।

মশা অবশ্য কিছুটা জব্দ মশারির কাছে। মশার অরি, মশারি। একটা বৈরি ভাব। এই একটা জায়গায় ওরা বড় অসহায়। জোঁকের যেমন নুন, মশার তেমনি মশারি। একবার টাঙিয়ে ফেলতে পারলেই মশা জব্দ। তখন কেঁদে কেঁদে চারপাশে ঘোরা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তবে আইনের মতো মশারিরও ফাঁক থাকে। ওস্তাদ মশা ঠিক সেই ফাঁক খুঁজে নেয়। তারপর পর্বতারোহীর মতো প্রবল ধৈর্য এবং অধ্যাবসায়ে একটু একটু করে শরীর গলায় অন্তঃপুরে। অবশেষে শুরু করে লীলা। প্রথমেই কামড়া-কামড়ির দিকে যায় না। ভাবটা এমন, অনেক কসরত করে ঢুকতে হয়েছে বস্‌; প্রথমে একটু জ্বালাই তোমাকে, তারপর দেখা যাবে। কানের কাছে পোঁ পোঁ সুরে গান শুরু করে দেয়। নিদ্রাবিতাড়নী সংগীত। ঘুম যাবে চটকে। অগত্যা উঠে পড়ে টর্চ জ্বেলে মশার খোঁজ। কিন্তু মশারির মধ্যে মশা খোঁজা, আর খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা একই ব্যাপার। তাই কিছুতেই খুঁজে পাওয়া গেল না। কিন্তু আলো নিভিয়ে যেই শুল আবার সেই অমোঘ পোঁ পোঁ। আবার আলো জ্বেলে খানাতল্লাশ; এক বন্ধু বলেছিল, ওগুলো মশা নয়, মশার ভূত। চারপাশে মশা যেমন আছে, মশার ভূতও আছে। প্রচুর মশা অপঘাতে মরে। আত্মা মুক্তি পায় না। তারা সূক্ষ্ম দেহে ঘুরে বেড়ায়। তাই খুঁজেও পাওয়া যায় না তাদের।

বন্ধু ঠিক না বেঠিক জানি না। কিন্তু এটা সত্যি প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মশা অপঘাতে মরে। জীবনে মশা মারেনি এমন মানুষ বিরল। মাছি মারা কেরানিদের জীবনে একটাও মাছি মারতে না হলেও বিস্তর মশা মারতে হয়। আসলে মশা মারাটা ঠিক প্রাণী হত্যার মধ্যে পড়ে না। চা খেলে যেমন উপোস ভঙ্গ হয় না। দেখেছি প্রবল ধার্মিক মানুষ মাছ মাংস খান না, কোনও প্রাণীকে আঘাত করেন না, তিনিও কিন্তু মশা কামড়ালে চাপড়ে দিচ্ছেন।

মশাদের রক্ত খাওয়াটাও নাকি এক বিস্ময়। এ এমন আজব প্রাণী, যে কিনা নিজের ওজনের চেয়ে বেশি ওজনের রক্ত খেতে পারে। খেয়ে আর ওড়ার ক্ষমতা থাকে না; সহজেই শিকার হয় শিকারির হাতে।

বিল্টুদার কথা খুব মনে পড়ে। বড় মামার ছেলে। মামাবাড়ি গেলে বিল্টুদার সঙ্গে এক বিছানায় শুতাম। সেদিনও শুয়েছি। মামার বাড়ি মশার উৎপাত খুব। মুশকিল আসান মশারি। মশারির মধ্যে দু’ভাই। কিন্তু একটু পরেই কানে এল সেই তন্দ্রাহরণী সংগীত। আমি উঠে বসলাম। দেখি বিল্টুদাও উঠে বসেছে। ওরও কানে একই গান। এখন প্রশ্ন, এক পিসই কি ঢুকেছে, নাকি একজোড়া! আলো জ্বালা হল। কিন্তু তোমার দেখা নাই রে, তোমার দেখা নাই। নির্ঘাত জঙ্গিদের মতো আত্মগোপন করে আছে গভীর গোপন ডেরায়। দুজনেই চিরুনি তল্লাশি চালালাম। কিন্তু নো পাত্তা। হতাশ হয়ে শুয়ে পড়লাম, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার উঠতে হল। এই করতে করতে মাঝরাতে ধরা পড়ল আসামিরা। এক্ষেত্রে দেখামাত্রেই গুলির নির্দেশ থাকে। কিন্তু বিল্টুদা নিষেধ করল। অবাক হয়ে ভাবলাম, গাঁধিগিরি করছে নাকি বিল্টুদা! ক্ষমা করে দিচ্ছে মশাদের। বিল্টুদা বলল, ‘ওসব কিছু নয়, ওরা আমাদের মাঝরাত পর্যন্ত বোর করেছে; আমরাও বাকি রাতটা ওদের বোর করব। প্রথমে দেখতে হবে আমাদের লুপ হোলস্‌ কোথায়; মানে কোথা দিয়ে ওরা এন্ট্রি নিয়েছে।’ দেখা গেল মশারির এক কোনে পাশাপাশি দুটো ফুটো. নিশ্চিত হলাম, এই রন্ধ্র দিয়েই ঢুকেছে কালনাগিনী। বিল্টুদা বলল, ‘দেখ কি করি।’

তা দেখলাম বটে। প্রথমে মশাগুলোকে তাড়িয়ে বের করে দিল বাইরে, খাতার পাতা থেকে একটা টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে পাকিয়ে সরু একটা নল তৈরী করল বিল্টুদা। তারপর একটা ফুটো দিয়ে কাগজের নলটা ঢুকিয়ে অন্য ফুটো দিয়ে বের করে দিল। অর্থাৎ বাইরে থেকে মশা নলের একটা মুখ দিয়ে ঢুকলে অন্য মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে। জন্মে ভেতরে ঢোকা হবে না তার।

পরদিন সকালে উঠে দেখি মেঝেতে দুটো মশা মরে পড়ে আছে। বিল্টুদা বলল, ‘হতাশায় সুইসাইড করেছে।’

এক চৈনিক মহাপুরুষ নাকি বলেছিলেন, ‘মশা আসলে মশা নয়; ওরা ঈশ্বরের প্রেরিত দূত। হুল দিয়ে মানুষের বিবেককে জাগ্রত করে। বলতে চায়, হে মানুষ, অত ঘুমিও না। জীবনটা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেবার নয়। যে ঘুমিয়ে থাকে তার ভাগ্যও ঘুমিয়ে থাকে। অতএব, উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত।’

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *